অপারেশন বারবারোসার বর্ণনা দাও ।

হিটলারের রাশিয়ায় সামরিক আগ্রাসনের নাম অপারেশন বারবারোসা।
অপারেশন বারবারোসার কারণ
হিটলার কর্তৃক জার্মানির পূর্বদিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রধান বাধা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে উন্মাদ কমিউনিস্ট বিরোধী এডলফ হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় আসেন। হিটলার ইতিপূর্বেই তার 'Mein Kampf' নামক গ্রন্থের ভার্সাই চুক্তি বাতিলসহ বৃহত্তর জার্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিল। হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য পূর্বমুখী সম্প্রসারণ (Drang nach osten) এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের বিশাল ভূখণ্ডে প্রভাব স্থাপনের প্রধান অন্তরায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিশ্চিহ্ন করা জরুরি বিবেচিত হয়। 'Mein Kampf' গ্রন্থে হিটলার উদ্বৃত্ত জার্মান জনগণের লেবেনসরাউম (Lebensraum) বা বাসস্থান ব্যবস্থার জন্য পূর্বে ইউরোপ তথা রাশিয়ার দিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল ।
রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে হিটলার কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল। পূর্ব অধ্যায়ে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হিটলার কর্তৃক এই অনাক্রমণ চুক্তি লঙ্ঘন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সম্ভাব্য কারণগুলো নিম্নরূপ ছিল :
১. প্রকৃতপক্ষে হিটলারের ইহুদি, স্লাভ ও কমিউনিজম বিরোধী রাজনীতির এবং পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি সামঞ্জস্যহীন ছিল। স্বাভাবিকভাবেই হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ ছিল তার পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণ নীতির মূল লক্ষ্যে ফিরে আসা। হিটলার কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে সোভিয়েতকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। তাই রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত হিটলারের রণনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল।
২. জার্মানি কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের পেছনে অর্থনৈতিক কারণও ছিল। অধ্যাপক রাইডারের মতে, অর্থনৈতিক কারণই অনাক্রমণ চুক্তির ব্যর্থতার জন্য দায়ী। অর্থনৈতিক দিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি হিটলারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। স্টালিন জার্মানির সঙ্গে চুক্তির সুযোগ নিয়ে বাল্টিক অঞ্চলের তিনটি রাষ্ট্র ও বেসারাবিয়া দখল করে নেয় এবং ফিনল্যান্ড থেকেও সুযোগ আদায় করতে থাকে। বলকান অঞ্চলের উপর রাশিয়ার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হিটলারের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। রুমানিয়ার খনিজ তৈল হিটলারের যুদ্ধের জন্য জরুরি বিবেচিত হয়।
এছাড়া ইউরোপ অবরুদ্ধ জার্মানির জীবনরক্ত অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল রাশিয়ার বিভিন্ন কাঁচামাল যেমন- ইউক্রেনের খাদ্যশস্য, কয়লা ও লোহা এবং ককেশাসের তৈল ক্ষেত্র আয়ত্তে আনয়নের উপর। ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে একটি নয়া রুশ-জার্মান অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও হিটলার সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই এসব কাঁচামালের অধিকার অর্জনের জন্য হিটলার অনাক্রমণ চুক্তি লঙ্ঘন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় ।
৩. রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি হিটলারের নিকট ছিল একটি কৌশলগত বিষয়মাত্র। এর প্রতি তিনি একনিষ্ঠ ছিলেন না। ঐতিহাসিক বুলকের মতে, ‘একের পর এক’ (One by one) নীতির দ্বারা পরিচালিত হিটলার পাশ্চাত্য শক্তির পরাজয়ের পর পূর্বের দিকে ঝাঁপ দেয়। অর্থাৎ তিনি রাশিয়া আক্রমণ করেন ।
৪. ব্রিটেনের যুদ্ধে জার্মানির বিমান বহরের ব্যাপক ক্ষতি হলে হিটলারের এ আশঙ্কা হয় যে, এ সুযোগে বিরাট লোকবলের অধিকারী রাশিয়া জার্মানিকে পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করবে। তাই এ সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্য তিনি অগ্রগামী হয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন। ন্ত
৫. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে রাশিয়া জার্মানিকে প্রভূত খাদ্য ও রসদ সরবরাহ করে। রাশিয়া দূরপ্রাচ্য থেকে রাবার, টিন, নিকেল প্রভৃতি সাইবেরিয়ার পথে এনে জার্মানিকে সরবরাহ করে। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে জার্মানির হাতে ফ্রান্সের পতনের পর রুশ নেতারা জার্মানির সামরিক শক্তি সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়ে। এ সকল সরবরাহ বন্ধ করা হয়। এ জন্য জার্মানি ক্রুদ্ধ হয়।
৬. সোভিয়েত সরকার দার্দানেলিস প্রণালির উপর রুশ নৌ আধিপত্য দাবি করলে জার্মানি আপত্তি জানায় ।
৭. ইতোমধ্যে পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের রণাঙ্গনে জার্মান সেনাবাহিনীর অভাবনীয় সাফল্য হিটলারকে রাশিয়া আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করে। এছাড়া রাশিয়ার উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে জার্মানির আশঙ্কা বাড়ে। হিটলার এ আশঙ্কা করে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ পর্যন্ত জার্মানি আক্রমণ করবে। আক্রান্ত হওয়া অপেক্ষা আক্রমণ করাকেই তিনি সঠিক নীতি বলে মনে করেন।
১৯৪০ সালের শেষ দিকে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের মস্কো সফরকে কেন্দ্র করে হিটলারের এ আশঙ্কা আরো দৃঢ় হয় যে, টিলজিটের সন্ধি ভঙ্গ করে রাশিয়া যেমন নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের পক্ষে যোগ দিয়েছিল, ঠিক তেমনি রাশিয়া আবার রুশ-জার্মান চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলারের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন মৈত্রী জোটে যোগ দিবে। সুতরাং রাশিয়া-ব্রিটেন-মার্কিন মৈত্রী জোট গঠনের পূর্বেই দ্রুত আক্রমণ করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংসের জন্য হিটলার জার্মান সৈন্যবাহিনীকে আদেশ দেন।
রাশিয়ায় চূড়ান্ত সামরিক আগ্রাসন
জার্মানি পূর্ব ইউরোপের বল্কান রাজ্যসমূহ দখল করলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, জার্মান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ব্রিটেনের যুদ্ধ চলার সময়ই হিটলার রাশিয়া আক্রমণের খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেন। এ পরিকল্পনার মূল কথা ছিল সর্বাধিক কম সময়ের মধ্যে রাশিয়ার যুদ্ধ শেষ করা। কারণ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাশিয়ার যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে যে মারাত্মক ভুল করেন, হিটলার সে পথে পা দিতে চাননি। শীত শুরু হওয়ার পূর্বে তিন মাসের মধ্যে রুশ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে বলে হিটলারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ।
বল্কান অঞ্চলে আক্রমণের সময়েই ১৯৪০ সালের ১৮ ডিসেম্বর হিটলার ‘অপারেশন বারবারোসা' (Operation barbarosssa) কোড নামে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের ছয় মাস পরে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ শুরু করে। রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের ২১ মাস পর এ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে জার্মান বাহিনী ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। উল্লেখ্য, ২২ জুন (১৮১২ সালে) নেপোলিয়ন কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের তারিখেই হিটলার (২২ জুন ১৯৪১) রাশিয়া আক্রমণ শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ৪০,০০,০০০ সৈন্য, ৩,৩০০ ট্যাংক ও ৫,০০০ বোমারু বিমানসহ ‘অপারেশন বারবারোসা' নামের সর্বাত্মক জার্মান অভিযান শুরু হয়। এই যুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ স্থলযুদ্ধের সূচনা করে ।
হিটলার আর তার জেনারেলরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে 'ব্লিসক্রিগের (বিদ্যুৎগতিতে যুদ্ধের) পরিকল্পনা করেছিল। তারা ভেবেছিল, মাত্র তিন মাসের মধ্যেই লাল ফৌজকে (Red Army) পরাজিত করা যাবে, গুড়িয়ে দেওয়া যাবে সোভিয়েত জনগণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা খতম হবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগুলো তাদের গোলামে পরিণত হবে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন বারবারোসা' নামের সর্বাত্মক আক্রমণে জার্মানির সঙ্গে যোগ দেয় ফ্যাসিস্ট ইতালি, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড, নাজিপন্থি শ্লোভাকিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া ।
অপারেশন বারবারোসার ঘটনাপ্রবাহ
জার্মান ঐতিহাসিকরা জার্মানির পূর্ব ফ্রন্টে অপারেশন বারবারোসা বা রাশিয়া আক্রমণকে কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ে বিভক্ত করেনি। তবে রাশিয়ান ঐতিহাসিকরা জার্মানি ও এর মিত্রদের বিরুদ্ধে তাদের দেশপ্রেমিক মহাযুদ্ধকে তিনটি প্রধান পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।
১. ১৯৪১ সালের ২২ জুন থেকে ১৯৪২ সালের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত,
২. ১৯৪২ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে ১৯৪৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং ৩. ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৪৫ সালের ৯ মে পর্যন্ত। ১৯৪১ সালের ২২ জুন থেকে ১৯৪৫ সালের ৯ মে জার্মানির আত্মসমর্পণ পর্যন্ত জার্মানির অপারেশন বারবারোসার বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধ পরিচালিত হয় ।
প্রথম পর্যায়ে ১৯৪১ সালের ২২ জুন সম্পূর্ণ অতর্কিতভাবে বিশাল আকারের জার্মান বাহিনী ভারমাখট ব্লিৎসক্রিগের গতিতে রাশিয়া আক্রমণ করে। হিটলারের তৃতীয় রাইখ আর্মি বাল্টিক থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত ১৮ শত মাইল দীর্ঘ যুদ্ধ ফ্রন্টে জার্মান বিমান বাহিনীর ছত্রছায়ার এর সাঁজোয়া ও যন্ত্রচালিত বাহিনী লাল ফৌজের রক্ষাব্যূহ ভেদ করে এবং রাশিয়ার বাফার জোন অতিক্রম করে প্রায় ছয় শত মাইল পর্যন্ত রাশিয়ার ভিতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় লাল ফৌজ তাদের রাজ্যক্ষেত্র ত্যাগ করে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের প্রথম মাসে জার্মানরা ব্রেস্টদুর্গ ইউক্রেনের একাংশ, মোলদাভিয়া, বেলারুশ, লিথুনিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়া অধিকার করে নেয়। জার্মান প্যাঞ্জার বাহিনী রুশ অধিকৃত পোল্যান্ড দখল করে কার্জন লাইন ভেঙে ১৭ জুলাই রাশিয়ার সোলেনস্ক শহরে পৌঁছে যায়। জার্মান বাহিনী লেনিনগ্রাদকে তাদের কামানের গোলার নিশানায় পরিণত করে এবং সেপ্টেম্বর মাসে সেবাস্তপোল, কিয়েভ ও ওডেসা বন্দর অধিকার করে। কিয়েভে প্রায় চার লক্ষ সোভিয়েত নাগরিক বন্দি হয়। প্রথম পাঁচ মাসের যুদ্ধে জার্মান বাহিনী সোভিয়েতের প্রায় ৬,১৪,০০০ বর্গমাইল স্থান অধিকার করে নেয়। তবে নাজি বাহিনী লেনিনগ্রাদ দীর্ঘদিন অবরোধ করলেও তা দখলে ব্যর্থ হয়। এ সময় সোভিয়েত দেশপ্রেমিক জনগণের গেরিলা আক্রমণে জার্মান ফ্রন্টলাইনের ব্যাপক ক্ষতি হতে থাকে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]