মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধের ফলাফল সংক্ষেপে আলোচনা কর ।

মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধের ফলাফল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বৃহৎ এবং রক্তাক্ত ক্ষেত্র ছিল পূর্ব ফ্রন্ট বা সোভিয়েত ইউনিয়ন। মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ এ ফ্রন্টেই সংঘটিত হয়। যুদ্ধে শুধু এ ফ্রন্টেই ৩ কোটির বেশি মানুষ নিহত হয়। জার্মান সেনাশক্তির ৮০ শতাংশ পূর্ব ফ্রন্টে তথা রাশিয়ার হাতে নিহত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অন্যান্য ফ্রন্টের চেয়ে এ ফ্রন্টে অধিক এলাকা নিয়ে যুদ্ধ বিস্তার লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মানরা ইচ্ছাকৃত অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে মানুষের রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে। উন্মাদ কমিউনিস্ট বিরোধী হিটলার সন্ত্রাস দ্বারা বিজয় অর্জন করতে চেয়েছিলেন। পশ্চিম ফ্রন্টে এরূপ নিষ্ঠুরতা ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। 'টাইম' পত্রিকার মতে, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধের সময়কাল, ভূখণ্ডগত এলাকা এবং ধ্বংসাত্মক ঘটনা, জীবনহানি সবদিক থেকে পশ্চিম ফ্রন্ট বা পশ্চিম ইউরোপ অপেক্ষা পূর্ব ফ্রন্ট তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে ৪ গুণ বেশি ঘটেছে।
জার্মান অধিকৃত সোভিয়েত দেশগুলোতে সাধারণ নাগরিকদের উপর অবর্ণনীয় নারকীয়তা চালানো হয়। তাদেরকে হাজারে হাজারে বন্দি শিবিরে আটক করে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। গ্রামের পর গ্রামে গণহত্যা চালানো হয়। উভয় পক্ষের পোড়ামাটি নীতির ফলে প্রচুর সাধারণ জনগণের জানমালের ক্ষতি হয়। এভাবে কমপক্ষে ২০ মিলিয়ন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। গবেষক জিওফ্রে এ. হস্কিং- এর মতে, ‘যে ব্যাপকহারে সোভিয়েত জনগোষ্ঠী নিহত হয় তার এক বিরাট অংশ ছিল সন্তান জন্মদানে সক্ষম যুবক নাগরিক', ১৯৩৯ সালের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে সোভিয়েত লোকসংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন কমে যায়। আবার সোভিয়েত রেড আর্মি জার্মানি দখল করলে তাদের আক্রমণে অনেক জার্মান নাগরিক নিহত ও বাস্তুচ্যুত হয়। ইয়াল্টা সম্মেলনের চুক্তি মোতাবেক পূর্ব প্রাশিয়া ও সাইলেশিয়ার জার্মান জনগোষ্ঠী ওডার-নিস রেখার পশ্চিম অংশে বিতাড়িত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামরিক দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজয়ী হলেও অর্থনৈতিক ও শিল্প কাঠামোগতভাবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের অধিকাংশ ঘটনা হয় রাশিয়ায় জনঅধ্যুষিত এলাকায়, নতুবা তার নিকটে সংঘটিত হয়েছে উভয় পক্ষের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের জীবনহানির সাথে সাথে বস্তুগত সম্পদও ধ্বংস হয়েছে। নুরেমবার্গে আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে সোভিয়েত লেফটেন্যান্ট জেনারেল রোমান রুডেনকো (Roman Rudenko) কর্তৃক উপস্থাপিত সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংসের সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপ :
১. অক্ষশক্তির আক্রমণে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে সম্পত্তি (Property) ধ্বংস হয় তার মূল্য ধরা হয় ৬৭৯ বিলিয়ন রুবলস ।
লেনিনগ্রাদ অবরোধের সময় এ একটি মাত্র শহরেই ১২ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। পুরো যুদ্ধের সময় ১০ মিলিয়ন রুশ সেনা এবং ১৫ মিলিয়ন সাধারণ নাগরিক নিহত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকসংখ্যার যুদ্ধে চিরতরে হারিয়ে যায় ।
এ যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের আর্থিক ক্ষতির সীমা ছিল না। নাৎসি আক্রমণকারীরা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ১,৭১০টি নগর ও শহর, ১,০০,০০০টি যৌথ এবং রাষ্ট্রীয় খামার, ৭০,০০০ এর বেশি গ্রাম বা হ্যামলেট, ২,৫০৮টি শিল্প স্থাপনা, ৪০,০০০ মাইলের বেশি রেলপথ, ৪,১০০টি রেলস্টেশন, ৪০,০০০টি হাসপাতাল, ৮৪,০০০টি স্কুল এবং ৪৩,০০০টি পাবলিক লাইব্রেরি ধ্বংস করে ও আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয় । পশ্চিম রাশিয়ার শহর ও গ্রামগুলোর একটিও অক্ষত ছিল না। সেগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আড়াই কোটি মানুষ গৃহহীন হয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত সময়ে যুদ্ধে রাশিয়ায় যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল তেমনটা আর কখনো কোনো দেশে হয়নি। একমাত্র পূর্ব উরাল অঞ্চলের কিছু কলকারখানা অক্ষত ছিল। বিদেশি অর্থনীতিবিদরা বিশ্বাস করতো সোভিয়েত অর্থনীতির ক্ষত সারতে কমপক্ষে ৪টি পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনার প্রয়োজন হবে। কারো ধারণা ছিল শত বৎসর লাগবে জাতীয় অর্থনীতিকে যুদ্ধ পূর্ব অবস্থায় পৌছাতে ।
৪. রাশিয়ায় গৃহপালিত পশুর অধিকাংশ জার্মানরা খাদ্য হিসেবে হত্যা করে। ৭ মিলিয়ন ঘোড়া এবং ১৭ মিলিয়ন ভেড়া ও ছাগল হয় হত্যা করা অথবা তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বন্যপ্রাণী দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৪৩-৪৫ সালের দিকে সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রসরের সাথে সাথে বহু নেকড়ে ও শৃগাল পশ্চিম দিকে পালিয়ে যায়। ফলে পশ্চিম দিকে ধীরে ধীরে জলাতংক রোগ (Rabies) মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সাল নাগাদ এ রোগ ইংলিশ চ্যানেল উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে যায় ।
অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রেট পেট্রিওটিক যুদ্ধে জয়লাভ ১৯১৭ সালের মহান অক্টোবর বিপ্লবের মতো বিশ্ব রাজনীতিতে একটি শক্ত প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে বিশ্বে সমাজতন্ত্রের শক্তি ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেলেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার ফলে পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত হয় এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ফলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব হয় । জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের আঘাতে সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে থাকে এবং এর ধ্বংসের মধ্য থেকে অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এসব দেশের কোনো কোনোটি সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হয়। আফ্রিকায় স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
দেশপ্রেমিক মহাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়লাভের ফলে তার সহযোগিতায় পূর্ব ইউরোপের আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, রুমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ায় জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। এ সকল দেশের কমিউনিস্ট পার্টি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তে স্ব স্ব দেশে সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হয়।
জাপানের সামরিক পরাজয়ের ফলে এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাধিদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। সোভিয়েত বাহিনী উত্তর কোরিয়া থেকে জাপানি আক্রমণকারীদের বিতাড়িত করে। সেখানে স্থাপিত হয় জনগণতান্ত্রিক কোরিয়া প্রজাতন্ত্র। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে চীনের জনগণ। প্রতিক্রিয়াশীল কুওমিনতাও সরকার উচ্ছেদ করে ক্ষমতা হাতে নেয়। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে স্থাপিত হয় চীন জনপ্রজাতন্ত্র । সমাজতন্ত্র গড়তে শুরু করে চীনের জনগণ। জাপানি আক্রমণকারী এবং ফরাসি উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণ লড়াই চালাচ্ছিল দীর্ঘকাল যাবৎ। সেই সংগ্রাম সাফল্যমণ্ডিত হয় দেশের উত্তর ভাগে, সেখানে স্থাপিত হয় গণতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র। এসব প্রজাতন্ত্রের স্বপক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অস্তিত্বের প্রথম দিন থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বিস্তৃত এবং বহুমুখী সহায়তা দিতে আরম্ভ করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই পুঁজিতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসে এগারোটা রাষ্ট্র- আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, চীন, চেকোস্লোভাকিয়া, গণতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক জার্মান প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, জনগণতান্ত্রিক কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, রুমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মঙ্গোলিয়া জনপ্রজাতন্ত্রের সঙ্গে এই রাষ্ট্রগুলো মিলে গড়ে ওঠে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা। এর মধ্যে পড়ে পৃথিবীর এলাকার চতুর্থাংশ এবং পৃথিবীর জনসংখ্যার তৃতীয়াংশের বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির সৃষ্টি এই সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা- শ্রমিক শ্রেণি এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের দৃঢ় দুর্গ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি ( Super power) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রাশিয়া অল্পদিনের মধ্যে আণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্ব যথাক্রমে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুসারে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সোভিয়েতের নেতৃত্বে ওয়ারশো ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো সামরিক জোট গড়ে ওঠে। দুই পরাশক্তির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সৃষ্টি হয়। দ্বিকেন্দ্রিক (Bi-polar) বিশ্ব ব্যবস্থায় পৃথিবীতে সরাসরি যুদ্ধের সৃষ্টি না হলেও একপ্রকার সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করে- যা ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধের ফলাফলকে তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী এ দু'ভাগে ভাগ করে বেশ কিছু শিরোনামে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধে রাশিয়ার জয়লাভ বিশ্বকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করলেও এই যুদ্ধে রাশিয়াকে অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অনেকে ভেবেছিলেন নাৎসি আক্রমণ থেকে রাশিয়া নিস্তার পাবে না। বাস্তবে তা ঘটেনি। নাৎসি সমরাস্ত্রের চাকা কুরুক্ষেত্রে মহাবীর কর্ণের রথের চাকার মতোই রাশিয়ার মাটি গ্রাস করে নেয়। তবে রাশিয়াকে এই জয়ের জন্য অনেক মূল দিতে হয়। প্রায় ১০ মিলিয়ন রুশ সেনা যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে এবং ১৫ মিলিয়ন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। রাশিয়ার লোকসংখ্যার এক-দশমাংশ এই যুদ্ধে চিরতরে হারিয়ে যায়।
এই যুদ্ধে রাশিয়ার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সীমা পরিসীমা ছিল না। রাশিয়ার গৃহপালিত পশুর অধিকাংশ জার্মানরা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। পশ্চিম রাশিয়ার শহর ও গ্রামগুলোর একটিও অক্ষত ছিল না। সেগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একমাত্র পূর্ব ইউরাল অঞ্চলের কিছু কলকারখানা অক্ষত ছিল। চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে সেগুলোকে বেশি সময় খাটাবার ফলে যন্ত্রপাতি ক্ষয় পায়। অধিকাংশ কয়লাখনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৪৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত রুশ সরকারের প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধে ১,৭১০টি শহর এবং ৭০,০০০ এর বেশি গ্রাম ধ্বংস হয়েছিল। এবং ৬০,০০,০০০ বাসভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জার্মানরা রাশিয়ার ৩১,৮৫০টি কলকারখানা, ৮৪,০০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৪৩,০০০ গ্রন্থাগার ধ্বংস করে। জার্মান অধিকৃত অঞ্চলের জাতীয় আয়ের দুই তৃতীয়াংশ তারা বিনষ্ট করেছিল। শহর ও গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের ক্ষতি হয়েছিল গণনাতীত রুবল।
মোট কথা লোকবল ও আর্থিক দিক দিয়ে রাশিয়া এই চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল।
সুদূরপ্রসারী ফলাফল
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয়লাভের পথ প্রশস্ত
মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধে রাশিয়ার জয়লাভ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়লাভের পথ প্রশস্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে রুশ বিজয় এক অসাধারণ ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ে রাশিয়ার অবদান ছিল বেশি। এ যুদ্ধে রাশিয়া মিত্রশক্তির পক্ষে যোগদান করলে বিশ্ব জনমত মিত্রশক্তির পক্ষে চলে যায়। মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধে জার্মানি ২৫৬ ডিভিশন সেনার মধ্য ১৭৯ ডিভিশন সেনা নিয়োগ করে। এই যুদ্ধে রাশিয়া জার্মান বাহিনীকে চরমভাবে পরাস্ত করে। বিশেষ করে স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধে অপরাজিত জার্মান সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। যুদ্ধে রাশিয়ার জয় এবং জার্মানি বাহিনীর পরাজয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়লাভের পথ প্রশস্ত করে।
২. একটি প্রধান শক্তি হিসেবে রাশিয়ার উত্থান
মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধে জয়লাভের পর বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়ার ভূমিকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তিরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের প্রভাব পড়ে। এসবের পরিণতিতে মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের পর রাশিয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার গুরুত্ব অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল। রাশিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তি তখন পশ্চিম ইউরোপে ছিল না।
৩. স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য প্রেরণা
মহা দেশপ্রেমিক যুদ্ধে রাশিয়ার জয়লাভের ফলে ইউরোপের বহুজাতি পুঁজিপতি ও জমিদারদের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলার প্রেরণা লাভ করে। বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী শিকড়ের গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ ও পরাধীন দেশগুলোর জনগণের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বিরাট আকার ধারণ করে। এশিয়ায় ইউরোপের অধীনে থাকা উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতার আশা জাগ্রত হয়। এর ফলে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, মিশর এবং এশিয়া ও আফ্রিকার বহুদেশ ঔপনিবেশিকতার নিগড় ভেঙে ফেলে।
৪. সমাজতন্ত্রের বিকাশ ও সাম্যবাদী বিশ্বের উদ্ভব
মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধে জয়লাভের ফলে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের জয়লাভ ঘটে। যুদ্ধের ভেতর দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় নবশক্তিতে। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের পতনের ফলে সামগ্রিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। যুদ্ধোত্তর যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান শক্তি।
মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ও মধ্য ইউরোপকে নাৎসি জার্মানির হাত থেকে মুক্ত করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। এখানে রুশ হস্তক্ষেপে সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে । সাম্যবাদী ভাবধারা প্রসারের জন্য স্টালিন পূর্ব ইউরোপে রুশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার নীতি নেন। এখানে সোভিয়েত ধাঁচের সামজতন্ত্র বিকশিত হয়। এভাবে পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদী বিশ্বের উদ্ভব ঘটে ।
৫. মহাজোটের ভাঙন
মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের পরে রাশিয়া একটি প্রধান শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আবির্ভূত হলে মহাজোট ভেঙে যায়। তাছাড়া মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধে জয়লাভের পরে মহাজোটের আর প্রয়োজন ছিল না। কেননা অক্ষশক্তিকে পরাস্ত করার জন্যই মহাজোট গঠিত হয়েছিল। মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের পরে এর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার প্রাধান্য স্থাপন ও সাম্যবাদের বিকাশ পশ্চিমা শক্তিবর্গের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাছাড়া রুজভেল্টের মৃত্যুর পর নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কঠোর মনোভাব এবং রুশ বিরোধিতা মহাজোটকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে।
জার্মানদের দ্বারা রুশদের উপর চাপিয়ে দেওয়া এই মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের প্রথম দিকে রাশিয়া পিছু হটলেও শেষ পর্যন্ত বিজয় লাভ করে। যেভাবে কার্যত কোনো সহায়তা ছাড়াই রাশিয়া হিটলারের মোকাবিলা করে তা ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে। ফ্যাসিস্ট জার্মানি ও সমরবাদী জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই এ অদৃষ্টপূর্ব সামরিক নৈপুণ্য ও সহনশক্তি, অধ্যবসায়, শৌর্য ও গণবীরত্বের যে দৃষ্টান্ত রুশ সৈন্যরা দেয় ইতিহাসে তার তুলনা নেই। রুশ জনগণের দেশপ্রেম, রুশ সমাজের নৈতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য, রুশ জনগণের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিভিন্ন জাতির বন্ধুত্ব-এসবের অপরাজেয় শক্তির প্রমাণ হয় মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের মহাপরীক্ষার সময়ে। মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধে দেশরক্ষায় রুশ জনগণের অমিত শৌর্যের কাহিনি হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে রুশ সৈন্যের বীরোচিত সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চাদভূমিতে রুশ জনগণের নিঃস্বার্থ পরিশ্রমের কথা। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]