আলিবর্দী খান
বিধান ও উন্নতিকল্পে তিনি যেসব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন সে সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন;
ক্স ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিষয়ে অবহিত হবেন।
ক্স আলীবর্দীর শাসনকালের একটি মূল্যায়ন করতে পারবেন।
আলিবর্দী খানের প্রথম জীবন ও তাঁর মসনদ লাভ
নবাব আলিবর্দী খান একজন অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন। সামান্য অবস্থা হতে স্বীয় কর্মদক্ষতা ও
প্রতিভাবলে তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ
শাসনকর্তা ও রণনিপুণ সেনাপতি। আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুঘল রাজশক্তির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা
ও বিপর্যয়কালে আলিবর্দী মুর্শিদাবাদের মসনদে বসে মারাঠা আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থেকে
বাংলাকে রক্ষা করেন। তাঁর শাসনকাল বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
আলিবর্দী খানের প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলী। তিনি ছিলেন জাতিতে তুর্কি ও ধর্মীয় বিশ্বাসে শিয়া
মতাবলম্বী। পিতার সঙ্গে তিনি ও তাঁর ভাই মির্জা আহমেদ ভাগ্যানে¦ষণে দিল্লিতে আসেন এবং সম্রাট
আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আযমের অধীনে তাঁরা সামান্য চাকুরি করতেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধে শাহজাদা
আযম নিহত হলে তাঁরা চাকুরি হারান এবং পরে বাংলায় আসেন। সুবাদার মুর্শিদকুলী খানের অধীনে
চাকুরির চেষ্টা করে মির্জা মুহম্মদ ব্যর্থ হন এবং অতপর তাঁর পরিবার সহ উড়িষ্যার নায়েব নাজিম
সুজাউদ্দিনের আশ্রয় লাভের চেষ্টা করেন। ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে সুজাউদ্দিন তাঁকে ১০০ টাকা বেতনে রাজস্ব
বিভাগের চাকুরিতে নিয়োগ করেন। অল্পদিনের মধ্যে মির্জা মুহম্মদ আলী স্বীয় কর্মক্ষমতা গুণে সবন্তপুরের
থানাদার পদে উন্নীত হন এবং ৬০০ অশ্বারোহীর মনসব লাভ করেন। এ সময় তাঁর ভাই মির্জা হাজী
আহমেদও উড়িষ্যায় আসেন এবং দুই ভাই শাসনকার্যে সুজাউদ্দিনকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। ১৭২৭
খ্রিস্টাব্দে সুজাউদ্দিনের বাংলার মসনদ লাভের ব্যাপারে তাঁরা কৃতিত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন। নতুন নবাব তাঁদের
কাজে এত মুগ্ধ হন যে, তিনি হাজী আহমেদকে তাঁর অন্যতম উপদেষ্টা ও বাংলার দিওয়ান নিযুক্ত করেন
এবং মির্জা মুহম্মদ আলীকে রাজমহলের ফৌজদার নিয়োগ ও তাঁকে আলিবর্দী খান উপাধিতে ভ‚ষিত করেন
(১৭২৮ খ্রি:)। এ সময় থেকেই মির্জা মুহম্মদ আলী পরিচিত হন আলিবর্দী খান নামে।
১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে আলিবর্দী খান বিহারের নায়েব নাজিম পদে নিযুক্ত হন এবং সুজাউদ্দিনের সুপারিশে সম্রাট
তাঁকে পাঁচ হাজারী মনসব প্রদান করেন। এ সময় থেকে বাংলার রাজনীতিতে আলিবর্দী খানের পরিবারের
প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। বিহারের শাসনকার্যে আলিবর্দী যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। ইতোপূর্বে দুর্বল
শাসনের সুযোগে জমিদাররা সেখানে অবাধ্য হয় এবং রাজস্ব প্রদানে গড়িমসি করে। আলিবর্দী খান তাদের
বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে নিয়মিত কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন। মুঙ্গের জেলার বিদ্রোহী উপজাতিগুলোকেও
তিনি শক্তহাতে দমন করেন। এর ফলে আলিবর্দী খানের সুনাম বৃদ্ধি পায়।
১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে নবাব সুজাউদ্দিন খানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান বাংলার মসনদে বসেন।
সরফরাজ খান আলিবর্দীকে বিহারের নায়েব নাজিম পদে বহাল রাখেন এবং কিছুদিন তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক
বজায় থাকে। পরবর্তী সময়ে নবাবের উপদেষ্টাগণ আলিবর্দী খানের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ঈর্ষানি¦ত হয়ে তাঁর
বিরোধিতা শুরু করেন এবং নবাবকে পরামর্শ দেন আলিবর্দী খানের পরিবারের প্রতিপত্তি ধ্বংস করার জন্য।
তাঁদের পরামর্শে নবাব হাজী আহমেদ সহ আলিবর্দীর আত্মীয়-স্বজনদের উচ্চপদ থেকে অপসারণ করেন।
তাছাড়া নবাবের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ হাজী আহমেদের সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করেন। এ অবস্থার
সুযোগ নিয়ে নবাব সরফরাজ খানের প্রশাসনের প্রতি যাঁরা অসন্তুষ্ট ছিলেন তাঁদের মধ্যে আলম চাঁদ ও
জগতশেঠ হাজী আহমেদকে নবাবের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকেন এবং তাঁকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি
দেন। হাজী আহমেদ নবাবের উপদেষ্টাদের দ্বারা তাঁর অপমানের কথা অতিরঞ্জিত করে বার বার আলিবর্দী
খানকে জানান এবং তাঁকে উত্তেজিত করে তোলেন। এতে আলিবর্দী খান নিজ পরিবারের সম্মান ও
নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং নবাব সরফরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের
জন্য প্রস্তুত হন।
১৭৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আলিবর্দী খান সসৈন্যে পাটনা থেকে মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা করেন।
রাজমহল পৌঁছে তিনি নবাবকে জানান যে, আপন ভাই ও পরিবারকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করার
জন্য তিনি অগ্রসর হয়েছেন এবং নবাবের প্রতি তাঁর আনুগত্য রয়েছে। তাঁর ভাই হাজী আহমেদ ও
পরিবার-পরিজনদের তাঁর কাছে আসার অনুমতি দিতে তিনি নবাবের প্রতি অনুরোধ জানান। আলিবর্দীর
অনুরোধে হতবাক হয়েও নবাব তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শে সে অনুরোধ রক্ষা করেন। হাজী আহমেদ
আলিবর্দীর সাথে মিলিত হয়ে তাঁকে প্ররোচনা দেন যেন তিনি সরফরাজ খানকে সরিয়ে মুর্শিদাবাদ দখল
করেন। অপরদিকে নবাবও তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলিবর্দীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
নবাবের সাথে আলিবর্দীর আপোষ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুর্শিদাবাদ
থেকে ২৬ মাইল উত্তর-পশ্চিমে গিরিয়া নামক স্থানে ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দের ৯ এপ্রিল দুই বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড
যুদ্ধ হয়। গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খান পরাজিত ও নিহত হন। তিন দিন পরে আলিবর্দী খান বিজয় গৌরবে
মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে মসনদে আরোহণ করেন। কয়েক মাসের মধ্যে আলিবর্দী খান সম্রাট মুহম্মদ শাহের
ফরমান লাভ করায় মসনদে তাঁর অধিকার বৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
নবাব আলিবর্দী মসনদে আরোহণ করে বাংলায় সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের দিকে মনোনিবেশ করেন।
প্রথমে তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন। উড়িষ্যার নায়েব
নাজিম দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করেন। আলিবর্দী খান তাঁকে দমন করার
জন্য ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিরুদ্ধে গমন করেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী হায়দ্রাবাদের
নিজামের আশ্রয় গ্রহণ করেন। আলিবর্দী খান তাঁর জামাতা সৈয়দ আহমেদকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম
নিযুক্ত করে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু দ্বিতীয় মুর্শিদকুলীর জামাতা মির্জা বাকের শীঘ্রই মারাঠা
সৈন্যদের সহায়তায় উড়িষ্যার রাজধানী কটক দখল এবং সৈয়দ আহমেদকে বন্দি করেন। এ সংবাদ পেয়ে
আলিবর্দী খান আবার উড়িষ্যায় যান এবং রায়পুর নামক স্থানে এক যুদ্ধে মির্জা বাকেরকে পরাজিত করেন
(ডিসেম্বর, ১৭৪১ খ্রি:)। তিন মাস তাঁর কটকে অবস্থানের ফলে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। অতপর নবাব
শেখ মাসুদ পানিপথীকে উড়িষ্যা প্রদেশের নায়েব নাজিম নিযুক্ত করে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
আলিবর্দী ও মারাঠা আক্রমণ
নবাব আলিবর্দী খানকে তাঁর রাজত্বের বেশির ভাগ সময় মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকতে হয়।
১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর কাল তিনি মারাঠা হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
ইতিহাসে মারাঠা আক্রমণের ঘটনাবলী বর্গীর হামলা নামে সুপরিচিত। এ সময় বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুর
অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও নৃশংসতার শিকার হয়। রাজধানী মুর্শিদাবাদও লুণ্ঠিত হয়। প্রায় প্রতি বছরই
মারাঠা শক্তি বাংলা ও উড়িষ্যায় হামলা চালায়।নবাব আলিবর্দী খান অবিরাম প্রতিরোধ যুদ্ধে
আপোষহীনভাবে হানাদারদের বিতাড়িত করে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হন।
দাক্ষিণাত্যের মারাঠা রাজ্যের অধিপতি শিবাজীর পৌত্র রাজা শাহুর নেতৃত্বে মারাঠা নায়করা শক্তি প্রয়োগ ও
লুটতরাজের মাধ্যমে চৌথ নামক কর আদায়ের অভিপ্রায়ে বিভিন্ন দিকে হানা দিতে থাকে এবং এ প্রক্রিয়াতে
তারা বাংলা পর্যন্ত পৌঁছে। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরের মারাঠা নায়ক রঘুজী ভোঁসলা তাঁর প্রধামন্ত্রী ভাস্কর
পন্ডিতকে ৪০ হাজার সৈন্য সহ বাংলা আক্রমণ করতে পাঠান। বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
লুটতরাজ ও অগ্নি-সংযোগ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করলেও ভাস্কর পন্ডিত এ অভিযানে শোচনীয়
পরাজয় বরণ করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পরের বছর রঘুজী ভোঁসলা স্বয়ং মারাঠা বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে
তিনিও ব্যর্থ হন। ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় মারাঠা আক্রমণকালে ভাস্কর পন্ডিত নিহত হন। চতুর্থ এবং পঞ্চম
মারাঠা আক্রমণকালে তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়। এভাবে মারাঠা শক্তি বার বার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে
হানা দিতে থাকে এবং টানা সম্মুখ যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হয়ে তারা অনিয়মিত যুদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করে। তাদের
আক্রমণে বহু এলাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং জনগণ অবর্ণনীয় দুর্দশায় নিপতিত হয়। নবাব আলিবর্দী বৃদ্ধ
হলেও বীরত্বের সঙ্গে আপোষহীনভাবে লড়াই করে মারাঠাদের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দেন।
দীর্ঘ ১০ বছরের যুদ্ধের ফলে ক্লান্ত হয়ে শেষে উভয় পক্ষই শান্তির অনে¦ষায় সমঝোতার পথ বেছে নেয়।
মারাঠারাও কোন ভ‚খন্ড লাভ করতে পারেনি এবং তাদের অনেক লোকক্ষয় হয়। ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে উভয়ের
মধ্যে সম্পাদিত এক সন্ধি চুক্তিতে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। বাংলার জন্য নবাব রঘুজীকে বার্ষিক ১২ লক্ষ
টাকা চৌথ দিতে স্বীকৃত হন এবং বিনিময়ে মারাঠারা বাংলা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। জালেশ্বরের
নিকটে সুবর্ণরেখা নদী বাংলা ও উড়িষ্যার মধ্যে সীমান্ত নির্ধারিত হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আলিবর্দী খান
মারাঠাদের অনুগত মীর হাবিবকে তাঁর নায়েব রূপে উড়িষ্যা শাসনের ভার দেন। কিন্তু এক বছর পর মারাঠা
সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করে এবং রঘুজীর এক সভাসদ মুসলেহউদ্দিন খানকে উড়িষ্যার শাসন ক্ষমতা দেয়া
হয়। এর ফলে উড়িষ্যার ওপর কার্যত বাংলার নবাবের কর্তৃত্ব লোপ পায় এবং মারাঠাদের রাজনৈতিক
আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
আলিবর্দী ও আফগান বিদ্রোহ
মারাঠাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকাকালে ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে নবাব আলিবর্দী খানের আফগান সেনাপতি গোলাম
মুস্তফা খান বিদ্রোহী হন। তাঁর অধীনে একটি বড় আফগান সৈন্যদল ছিল এবং তিনি এমন ধারণা পোষণ
করতেন যে, নবাব আলিবর্দীর রাজ্যের নিরাপত্তা ও শক্তি আফগানদের বাহুবলের ওপর নির্ভরশীল। নবাবের
নিকট তিনি বিহারের নায়েব নাজিমের পদ দাবি করেন। নবাব তাঁর এ দাবি পূরণ না করায় তিনি প্রথমে
মুর্শিদাবাদ দখলের পরিকল্পনা করেন এবং পরে পাটনা আক্রমণ করতে অগ্রসর হন। বিহারের নায়েব
নাজিম জৈনুদ্দিন আফগান বাহিনীর পাটনা আক্রমণ ব্যর্থ করে দেন এবং তাদেরকে বিহার হতে বিতাড়িত
করেন। এ সময় মারাঠা আক্রমণের সুযোগ নিয়ে মুস্তফা খান পুনরায় পাটনার দিকে অগ্রসর হন। জৈনুদ্দিন
তাঁকে ভোজপুরের নিকটে এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন (জুন, ১৭৪৫ খ্রি.)। আফগান বাহিনী
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। এর ফলে প্রথম আফগান বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় আফগান বিদ্রোহ সংঘটিত হয় ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে। বিহারের দুই আফগান সেনাপতি শমসের খান ও
সরদার খান বিশ্বাসঘাতকতা করে নায়েব নাজিম জৈনুদ্দিন ও তাঁর পিতা হাজী আহমেদকে হত্যা করে পাটনা
দখল করে নেয়। তারা জৈনুদ্দিনের স্ত্রী ও আলিবর্দীর কন্যা আমেনা বেগম ও তাঁর সন্তানদের বন্দি করে।
নবাব এ সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিহার যাত্রা করেন। মারাঠারাও এ সময় বিদ্রোহী আফগানদের সাথে
যোগ দিতে অগ্রসর হয়। পাটনার ২৬ মাইল দূরে কালাদিয়ারা নামক স্থানে এক যুদ্ধে আলিবর্দী আফগান ও
মারাঠাদের মিলিত বাহিনীকে পরাভ‚ত করে বিহারে পুনরায় তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন (এপ্রিল, ১৭৪৮
খ্রি:)।
অভ্যন্তরীণ সংস্কার কার্যাদি
আলিবর্দী খান তাঁর শাসনকালের ১১ বছর যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিদ্রোহ দমনে ব্যাপৃত থাকায় দেশের উন্নতির দিকে
তেমন নজর দিতে পারেননি। মারাঠাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের পর তিনি প্রজাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ বিধানের
কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মারাঠাদের অত্যাচার ও লুটতরাজের দরুন পশ্চিম বাংলার জনগণের জানমালের
প্রভুত ক্ষতি হয় এবং কৃষি, শিল্প বাণিজ্যের অবনতি ঘটে। তিনি দ্রুত শহর ও গ্রামগুলোর মেরামত ও
পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন। ব্যাপক চাষাবাদ সহ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা
গৃহীত হয়। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জমিদারদের সাথে চুক্তি করা হয় যেন তারা প্রজাদেরকে নিপীড়ন না
করেন। দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার জন্য নবাব আলিবর্দী বণিক ও ভ‚স্বামীদের কাছ থেকে
অতিরিক্ত কিছু অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা নেন। এর ফলে এক শ্রেণীর হিন্দু জমিদারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি
হয়।
ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে সম্পর্ক
নবাব আলিবর্দী খানের সময়ে ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। শুধু ইংরেজ ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানিই নয়, ওলন্দাজ ও ফরাসি বণিকরাও বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটায়। কিন্তু এদের অনেকে
অসৎ পন্থা অবলম্বন করে কোম্পানির ব্যবসার নাম দিয়ে নিজেরা ব্যবসা করে এবং বাণিজ্য শুল্ক ফাঁকি
দেয়। এসব অন্যায় বিষয়ে নবাব আলিবর্দী খান কঠোর মনোভাব পোষণ করলেও তিনি সরকারের রাজস্ব
বৃদ্ধির স্বার্থে বিদেশীদের ব্যবসা-বাণিজ্য উৎসাহিত করেন। তিনি বিধিমত শুল্ক ছাড়া অধিক অর্থ আদায়
করতেন না। কেবল মারাঠা যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি সব বণিকদের থেকে অর্থ সাহায্য নিতে বাধ্য
হন। ইউরোপীয় বণিকদের সম্ভাব্য সব ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা দেয়া হলেও নবাব তাদেরকে কোন
সামরিক বা রাজনৈতিক সুবিধা দেননি। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে নবাব আলিবর্দী এক নির্দেশে ইংরেজ, ফরাসি ও
ওলন্দাজ বণিকদেরকে তাঁর রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িত হতে এবং দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন।
আলিবর্দী খানের চরিত্র ও কৃতিত্ব
বাংলার মসনদে ১৬ বছর আসীন থাকার পরে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১০ই এপ্রিল নবাব আলিবর্দী খান মৃত্যুবরণ
করেন। সেনাপতি ও শাসক হিসেবে তিনি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বই শুধু দেখাননি, স্বীয় কার্যকলাপ ও
চরিত্রগুণে বাংলার ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান দখল করেছেন। সামান্য অবস্থা থেকে তিনি স্বীয় সাহস ও প্রতিভার
দ্বারা বাংলার মসনদ লাভে সক্ষম হন। সুবাদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও বিদ্রোহ
দমন করে রাজ্যের ঐক্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। দীর্ঘ ১০ বছর মারাঠা হানাদারদের বিরুদ্ধে
আপোষহীনভাবে সংগ্রাম করে তিনি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেন।
আলিবর্দী খান শান্তিপ্রিয় ও প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। জমিদাররা যাতে প্রজাদের ওপর নিপীড়ন করতে না
পারে সেদিকে তাঁর লক্ষ্য ছিল। সমকালীন ইতিহাস লেখকরা তাঁর চরিত্র গুণ ও ব্যক্তিত্বের ভ‚য়সী প্রশংসা
করেছেন। তিনি উদার, দয়ালু ও ধর্মে নিষ্ঠাবান ছিলেন। শত্রুর প্রতি তাঁর মহানুভবতার উল্লেখ করে সিয়ারউল-মুতাখখেরীনের লেখক গোলাম হোসেন তাবাতাবাই তাঁকে ‘মহৎপ্রাণ' বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি
অনাড়ম্বর ও সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন এবং কঠোর সংযম প্রদর্শন করেন। আলিবর্দী খান নিজে
বিদ্বান ছিলেন এবং শিক্ষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। তিনি কবি, পন্ডিত, লেখক ও গুণীদের সমাদর ও
তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সব ধর্মের প্রতি তাঁর সহিষ্ণু মনোভাব ছিল। সে কারণে তিনি নিষ্ঠাবান
মুসলমান হয়েও হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি অনুসরণ করেন এবং অনেক হিন্দুকে শাসনকার্যের দায়িত্বপূর্ণ
পদে নিয়োগ দেন। তাঁর শাসনামলে বাংলায় ফারসি সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক চর্চা
হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ফারসি সাহিত্য দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবানি¦ত ও সমৃদ্ধ হয়।
সারসংক্ষেপ
মুঘল যুগে বাংলায় যে কয়জন প্রাদেশিক শাসনকর্তা তাঁদের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা দ্বারা ইতিহাসে
বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছেন, তাঁদের মধ্যে নবাব আলিবর্দী খান অন্যতম। ভাগ্যানে¦ষী এই তুর্কি
সামান্য অবস্থা থেকে স্বীয় প্রতিভা ও সাহস দ্বারা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মসনদ অধিকারে সক্ষম
হন। মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও ভাঙ্গনের কালে সুদূর বাংলা প্রদেশকে তিনি অভ্যন্তরীণ ও বহি:শত্রুর
আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছেন। ১০ বছর টানা লড়াই করেও দুর্ধর্ষ মারাঠা জাতি বাংলায় আধিপত্য
প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। অর্থনৈতিক স্বার্থে ইউরোপীয় বণিকদের তিনি নিজ রাজ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করার
সুবিধা দিলেও তাদেরকে এদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বা দুর্গ নির্মাণ করা থেকে বিরত রেখেছিল।
আলিবর্দী খান একজন অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। সমকালীন ইতিহাস লেখকরা তাঁর
চারিত্রিক গুণাবলী ও সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর শাসনামল বাংলার ইতিহাসের গৌরবময়
অধ্যায়।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১। আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (১২০০-১৮৫৭ খ্রি.)।
২। ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
৩। গঁযধসসবফ গড়যধৎ অষর, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব গঁংষরসং ড়ভ ইবহমধষ, ঠড়ষ. ১(অ).
৪। ঔ.ঘ. ঝধৎশধৎ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ, ঠড়ষ.ওও.
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিহাস পৃষ্ঠা ১৩৫
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। আলিবর্দী খান জাতিতে ছিলেনÑ
(ক) ইরানি (খ) তুর্কি
(গ) বিহারি (ঘ) পাঞ্জাবি।
২। আলিবর্দী খান কখন বিহারের নায়েব নাজিমের পদে নিযুক্ত হন?
(ক) ১৭২৮ খ্রি: (খ) ১৭৩১ খ্রি:
(গ) ১৭৩৩ খ্রি: (ঘ) ১৭৩৯ খ্রি:।
৩। সরফরাজ খান কোন যুদ্ধে নিহত হন?
(ক) বক্সারের যুদ্ধে (খ) উদয়নালার যুদ্ধে
(গ) কাটোয়ার যুদ্ধে (ঘ) গিরিয়ার যুদ্ধে।
৪। বাংলায় প্রথম মারাঠা আক্রমণ শুরু হয়Ñ
(ক) ১৭৩৯ খ্রি: (খ) ১৭৪২ খ্রি:
(গ) ১৭৪৪ খ্রি: (ঘ) ১৭৫১ খ্রি:
৫। সিয়ার-উল-মুতাখখেরীনের রচয়িতা কে?
(ক) আমির খসরু (খ) করম আলী
(গ) গোলাম হোসেন তাবাতাবাই (ঘ) ফেরদৌসি।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। আলিবর্দী খানের প্রথম জীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিন।
২। মসনদে বসার পর আলিবর্দী খান প্রাথমিকভাবে কি কি অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন? কিভাবে তিনি
ঐগুলো দূর করেন?
৩। আলিবর্দীর শাসনকালে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন।
৪। ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে নবাব আলিবর্দীর সম্পর্ক কিরূপ ছিল?
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। নবাব আলিবর্দী খানের প্রথম জীবন ও তাঁর বাংলার মসনদ লাভের পটভ‚মি আলোচনা করুন।
২। আলিবর্দী খানের শাসনকালের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিন।
৩। নবাব আলিবর্দী খানের চরিত্র ও কৃতিত্বের মূল্যায়ন করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত