বাংলা তথা ভারতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সর্বাগ্রে যার নাম করতে হয়, তিনি হলেন রবার্ট
ক্লাইভ। ১৭৫৬ থেকে ১৭৬০ খ্রি. পর্যন্ত বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় ক্লাইভের অবদান ছিল অনেক।
কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ষড়যন্ত্র, শঠতা, জালিয়াতি, দুর্নীতি ও সকলঘৃণ্যপন্থার আশ্রয়
গ্রহণকরেছিলেন। তার এসব অপকর্মকে দেখতে হবে ব্রিটিশ জাতির অবস্থান থেকে।স্বীকার করতে হবে
তিনি ছিলেন ক্ষুরধার ক‚টনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী এবংএকজন দক্ষ সেনাপতি।তবে দুর্নীতি, অর্থলিপ্সা এবং
ষড়যন্ত্রের মতো নীচ ও জঘন্যতম বিষয়গুলো ক্লাইভের চরিত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
ক্লাইভের প্রাথমিক জীবন
রবার্ট ক্লাইভ ১৭২৫ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ১৯ বছর তখন তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে
কেরানি হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিল মাদ্রাজ। কিছুদিনের মধ্যে তিনি কেরানির চাকরি
পরিত্যাগ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদলে যোগ দেন এবং ১৭৫১ খিস্টাব্দের মধ্যে ক্যাপ্টেন পদে
উন্নীত হন। একই সময় ভারতে ইংরেজদের সাথে ফরাসিদের তুমুল প্রতিদ্বন্দি¡তা চলছিল। বিশেষ করে
কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধে ইংরেজরা ফরাসিদের হাতে যখন পরাজিত হতে চলছিল সেই মুহ‚র্তে ক্লাইভের
রণকৌশল ইংরেজদের শুধু রক্ষাই করেনি বরং ঐতিহাসিক বিজয় এনে দিয়েছিল। কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধে
ক্লাইভ ফরাসিদের সরাসরি আক্রমণ না করে কর্ণাটকের রাজধানী আর্কট দখল করেন। ফরাসিরা ৫৩ দিন
যুদ্ধ করে আর্কট দখল করতে পারেনি। এরপর ক্লাইভ র্অনি ও কাবেরী পাকের যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজিত
করে দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। কর্নাটকের সিংহাসনে ইংরেজদের সমর্থিত প্রার্থী
মোহাম্মদ আলীকে বসানো সম্ভব হয় এবং সেখানে ফরাসিদের আধিপত্য লোপ পায়। এভাবে ক্লাইভের
রণনৈপুণ্য, সাহস এবং বিচক্ষণতার কারণে ভারতে ইংরেজরা ফরাসিদের পেছনে ফেলে অনেক এগিয়ে যায়
এবং ক্লাইভের সুনামও বৃদ্ধি পায়।
নবাব সিরাজ উদ্দৌলা কলিকাতা অধিকারের মধ্য দিয়ে যখন বাংলায় ইংরেজ স্বার্থ চূড়ান্ত হুমকির সম্মুখীন
তখন ক্লাইভ মাদ্রাজ হতে বাংলায় আসেন। তিনি এবং ওয়াটসন সহজেই কলিকাতা ও হুগলী পুনরুদ্ধার
করেন। এরফলে নবাব বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। ক্লাইভ নবাবকে বাধা
দিয়ে সন্ধি করতে বাধ্য করেন।এটি আলীনগরের সন্ধি নামে খ্যাত এবং এই সন্ধি অনুযায়ী ইংরেজরা
বিনাশুল্কে বাণিজ্য, ফোর্ট উইলিয়ামে দুর্গ স্থাপন সহ আরো অনেক সুবিধা পায়। নবাবের সাথে সন্ধি
করলেও ক্লাইভ নিশ্চিত হতে পারেননি। তিনি বুঝতে পারলেন যে, সিরাজ ক্ষমতায় থাকলে বাংলায় ইংরেজ
স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। তদুপরি ফরাসিরা নবাবের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ছিল এবং নবাবের সাথে
তাদের মিত্রতা ঘনিষ্ঠতর হচ্ছিল। তিনি বাংলায় ফরাসিদের আধিপত্য ধ্বংস করার জন্যে সুযোগের
অপেক্ষায় ছিলেন। কর্ণাটকের তৃতীয় যুদ্ধের সময় ক্লাইভ চন্দননগরে ফরাসি বাণিজ্য কুঠি দখল করে নেন।
এই ঘটনায় নবাব রুষ্ট হন এবং তিনি ফরাসিদের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে ক্লাইভের উদ্বেগ অনেক বৃদ্ধি
পায়।
এই সময় মুর্শিদাবাদে (বাংলার রাজধানী) নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে একটি গোপন ষড়যন্ত্র চলছিল। ক্লাইভ
এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। তিনি দেখলেন যে, ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একটি সুবর্ণ
সুযোগ। ক্লাইভ ইংরেজ স্বার্থের জন্যে চক্রান্ত, জালিয়াতি, দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচার ইত্যাদি নীচ ও ঘৃণ্য
পথ অবলম্বন করেন। নবাবের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী দলের নেতা ছিলেন মীরজাফর। ক্লাইভ সিরাজকে
সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যে গোপন চুক্তি করেন এবং এজন্যে তিনি অর্থ ও
বাণিজ্য সুবিধা লাভের প্রতিশ্রুতি পান। এতে ক্লাইভের চরিত্রের স্বার্থপরতা ও নীচতার পরিচয় প্রকাশিত
হয়।
মীরজাফরের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ক্লাইভ নবাব সিরাজের সাথে যুদ্ধে অগ্রসর হলেন। পলাশীর
প্রান্তরে সিরাজের পরাজয় ঘটলে বাংলায় ক্লাইভ ক্ষমতার নেপথ্য নায়কে পরিণত হন।নতুন নবাব মীরজাফর
ক্লাইভের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। মীরজাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২৪ পরগনায় জমিদারী প্রদান
করে এবং কোম্পানি তাঁকে এই জমিদারীর গভর্নর নিযুক্ত করে। ক্লাইভ স্বয়ং বিশাল অংকের টাকা ও জমি
গ্রহণ করেন।এদিকে নতুন নবাব মীরজাফর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। যেমন
মেদিনীপুরের শাসনকর্তা রামরাম সিংহ, পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা হাজির আলী এবং আলী গোহর (পরবর্তীকালে
সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম নামে খ্যাত) বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মীরজাফর ক্লাইভের সমর্থনে এবং
সহযোগিতায় এসব বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হন। এর পুরস্কার হিসেবে মীরজাফর ক্লাইভকে কলিকাতার
দক্ষিণাঞ্চলের একটি অংশের জায়গীর প্রদান করেন। এই অঞ্চলটি ক্লাইভের জায়গীর নামে পরিচিত ছিল।
নতুন নবাবের প্রচন্ড অর্থনৈতিক সংকট সত্তে¡ও ক্লাইভ মীরজাফরের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে
বিলম্ব করেননি।
নতুন নবাবকে হাতের পুতুলে পরিণত করা ছাড়াও ক্লাইভ ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ
সাফল্য অর্জন করেন। এর মধ্যে ছিল ফরাসিদের উত্তর-সরকার অধিকার এবং ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে
জয়লাভ। ১৭৫৯ খ্রি. ফরাসি গভর্নর কাউন্ট লালি দাক্ষিণাত্য থেকে দুর্ধর্ষ ফরাসি বুসিকে প্রত্যাহার করলে
একটি সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে চতুর ক্লাইভ ইংরেজ সেনাপতি কর্নেল ফোর্ডকে উত্তরসরকার দখল করার জন্যে প্রেরণ করেন। ফোর্ড প্রায় বিনা প্রতিরোধে ফরাসিদের বিতাড়িত করে উত্তরসরকার দখল করেন। ১৭৫৯ খ্রি. ইন্দোনেশিয়ার বাটাভিয়া (বর্তমান জাকার্তা) থেকে বেশকিছু ওলন্দাজ
সৈন্য হুগলী আক্রমণ করে। ক্লাইভ সহজেই এদের পরাজিত করে বাংলায় ইংরেজ আধিপত্যকে আরো
বিস্তৃত করেন।
ক্লাইভের দ্বিতীয় পর্যায়ের শাসনকাল (১৭৬৫Ñ৬৭ খ্রি.)
ক্লাইভের অবর্তমানে বাংলায় কুশাসনের ব্যাপকতা প্রকট হয়ে ওঠে। কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা
নানারকম দুর্নীতিতে লিপ্ত হয় এবং দস্তকের অপব্যবহার করতে থাকে। ফলে বাংলার অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঘোর অরাজকতা ও বিশৃ´খলার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থার অবসানের
জন্যে কোম্পানির পরিচালকমন্ডলী লর্ড ক্লাইভকে দ্বিতীয়বার বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন।
যদিও অনেক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে, “চুরি এবং দুর্নীতি বন্ধের জন্যে এক মহাচোরকে নিযুক্ত করা
হয়েছিল”।
দিওয়ানী লাভ
দ্বিতীয়বার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে ক্লাইভ যখন বাংলায় আসেন, তখন তাঁর সামনে
কতগুলো সমস্যা ছিল। তিনি লক্ষ্য করেন যে, বক্সারের যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় যে
ক্ষমতা লাভ করে তার কোন আইনগত ভিত্তি ছিল না। কারণ বক্সারের যুদ্ধে মোঘল সম্রাট পরাজিত হলেও
তিনিই ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী। বক্সারের যুদ্ধের পর অযোধ্যার নবাবের সাথে কোন
সন্ধি সম্পাদিত হয়নি। বাংলার নবাবের সাথেও কোম্পানির সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়নি। সুতরাং ক্লাইভের
সামনে প্রধান দুটি সমস্যা ছিল। প্রথমত, বাংলা ও অযোধ্যার দুই নবাব ও মোঘল সম্রাটের সাথে
কোম্পানির সম্পর্ক স্থির করা। দ্বিতীয়ত, শাসন কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রবর্তন করে অব্যবস্থা ও
দুর্নীতির অবসান করা।
বক্সারের যুদ্ধের পর অযোধ্যার নবাব ও দিল্লির মোঘল সম্রাট দুর্বল হয়ে পড়েন। ক্লাইভ ইচ্ছা করলেই
অযোধ্যা ও দিল্লি দখল করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বাইরে কোম্পানির রাজ্যের
সীমা বিস্তার না করার নীতি অনুসরণ করেন। বরং তিনি তাদেরকে ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল করে রাখার
পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি অযোধ্যায় নবাব সুজা উদ্দৌলাকে নবাব হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে
তিনি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা এবং কারা ও এলাহাবাদ জেলা আদায় করেন। তখন দিল্লিতে মুঘল সম্রাট শাহ
আলম ছিলেন একজন দুর্বল শাসক। যেহেতু আইনগতভাবে তিনিই ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী,
তাই তাঁর কাছ থেকে দিওয়ানী লাভের পদক্ষেপ নেন। ক্লাইভ শাহ আলমকে কারা ও এলাহাবাদ এলাকা
দুটি প্রদান করেন এবং বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দিওয়ানী লাভ করেন।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দিওয়ানীর গুরুত্ব অনেক। কারণ এর মাধ্যমেই কোম্পানি বাংলা-বিহারউড়িষ্যায় আইনগত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়। এরপর নবাবের পদ বাহ্যিকভাবে রাখা হলেও তাঁর
প্রকৃত প্রশাসনিক ক্ষমতা আর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। ক্লাইভ নিজেই স্বীকার করেছেন যে, দিওয়ানীর
মাধ্যমে কোম্পানি বাংলায় সকল ক্ষমতার উৎসে পরিণত হয়। নায়েব সামরিক ক্ষমতা কোম্পানির হাতে
চলে যায় এবং তিনি কোম্পানির নিযুক্ত নায়েব সুবা মোহাম্মদ রেজা খানের হাতে নিজামতের যাবতীয়
ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হন। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে, দিওয়ানী লাভের পর থেকে কোম্পানির
রাজস্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলে একদিকে যেমন আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে, অন্যদিকে তেমনি সৈন্যসংখ্যাও
বৃদ্ধি করে কোম্পানি রাজ্য বিস্তারেও সমর্থ হয়।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত