ইংরেজদের দিওয়ানী লাভ ও দ্বৈত শাসন


বক্সারের যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ লাভ
করে। রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করে প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথে তখন কোন বাধা অবশিষ্ট
ছিল না। মীর জাফর পূর্ব থেকেই কোম্পানির ওপর নির্ভর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে
চুক্তির ফলে তিনি তাঁর দরবারে একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট রাখতে রাজি হন। আরোপিত শর্তের কারণে
নবাবের অর্থনৈতিক দুরবস্থা বৃদ্ধি পায় এবং সামরিক ক্ষেত্রেও তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের
ফেব্রুয়ারি মাসে মীর জাফরের মৃত্যুর পর কোম্পানি তাঁর অল্পবয়স্ক পুত্র নজমুদ্দৌলাকে মসনদে বসায়। কিন্তু
তাঁর শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয় একজন ইংরেজ প্রতিনিধির হাতে। এর ফলে সরাসরি ইংরেজ রাজত্বের
সূচনা না হলেও বাংলায় ক্ষমতার চাবিকাঠি ইংরেজদের হাতেই পৌঁছে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি রবার্ট
ক্লাইভ দ্বিতীয়বারের মতো কলিকাতা কাউন্সিলের গভর্নর হয়ে এলে মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সাথে এক
চুক্তিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ানী অর্থাৎ রাজস্ব ক্ষমতা লাভ করেন। বাংলায় সূচিত হয়
ঔপনিবেশিক শাসনের।
কোম্পানির দিওয়ানী লাভ
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দিওয়ানী লাভ বাংলা তথা ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিার ক্ষেত্রে একটি
গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মুঘল শাসন ব্যবস্থায় প্রত্যেক সুবা বা প্রদেশে সুবাদার ও দিওয়ানী নামে দু'জন
কর্মকর্তা ছিলেন। এরা উভয়েই মুঘল সম্রাট কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত হতেন এবং স্ব স্ব দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে
সম্রাটের নিকট জবাবদিহি করতেন। সুবাদার বা নাজিমের অধীনে ছিল প্রতিরক্ষা, বিচার ও বেসামরিক
প্রশাসন; আর দিওয়ানের দায়িত্বে ছিল মূলত রাজস্ব শাসন। ক্ষমতার এই বিন্যাসে স্বাধীন অবস্থানে থেকে
তাঁরা একে অপরকে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতেন এবং কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করা থেকে
বিরত থাকতেন। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খানের সুবাদারী লাভের পূর্ব পর্যন্ত সুবাদারী ও দিওয়ানী পৃথক
পৃথক ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত ছিল। মুর্শিদকুলী খানই সর্বপ্রথম এই শাসনতান্ত্রিক প্রথা ভঙ্গ করে দিওয়ানীর
দায়িত্বও নিজে গ্রহণ করেন এবং তাঁর পরবর্তী অন্যান্য সুবাদাররা সে রীতি অনুসরণ করায় দিওয়ানী ও
নিজামত শাসন একীভ‚ত হয়ে পড়ে।
পলাশীর যুদ্ধের পর নবাবের নিজামত ক্ষমতা হ্রাস পায়। মীর কাসিম স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতে চেয়ে
সিংহাসনচ্যুত হন। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে নবাব মীর জাফরের মৃত্যুর পর ইংরেজগণ তাঁর


ইউনিট--- পৃষ্ঠা  ১৬০
অল্পবয়স্ক পুত্র নজমুদ্দৌলাকে বাংলার সিংহাসনে বসায়। নতুন নবাব ছিলেন সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির ওপর
নির্ভরশীল এবং তাদের হাতের পুতুল মাত্র। বক্সারের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে দিল্লির সম্রাট শাহ আলমও
তখন হয়ে পড়েন অসহায় এবং ইংরেজদের কৃপাপ্রার্থী। এ সময় লর্ড ক্লাইভ দ্বিতীয় বারের মতো বাংলার
গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অত্যন্ত সুচতুর ও বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ক্লাইভ ভারতে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার
স্বপ্ন দেখলেও কোম্পানির স্বার্থকেই তিনি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন। তিনি এলাহাবাদে সম্রাট শাহ আলমের
নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে প্রচুর উপহার দেন। সম্রাটের মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তিনি
কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ানী প্রদানের প্রার্থনা করেন। সম্রাট পলাশী যুদ্ধের পর থেকে
বাংলার রাজস্ব পেতেন না। সুবা বাংলা আবার দিল্লির নিয়ন্ত্রণে আসবে, এমন আশাও তিনি ত্যাগ
করেছিলেন। এমতাবস্থায় সম্রাট শাহ আলম বিনা দ্বিধায় ক্লাইভের প্রস্তাবে রাজি হন এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের
১২ আগস্ট এক চুক্তিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব শাসন ক্ষমতা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেন।
এলাহাবাদের সন্ধি নামে এ চুক্তিতে স্থির হয় যে, দিওয়ানী লাভের বিনিময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা এবং নিজামত শাসনের জন্য মুর্শিদাবাদের নবাবকে বছরে ৫৩ লক্ষ টাকা
প্রদান করবে। এই চুক্তি ইংরেজ কোম্পানিকে রাজস্ব শাসনের অধিকার দেয় এবং সূত্রপাত ঘটায়
ঔপনিবেশিক শাসনের। নিজামত ক্ষমতা বাংলার নবাবের হাতে এবং দিওয়ানী শাসন কোম্পানির নিকট
অর্পণের এ ব্যবস্থা ইতিহাসে ‘দ্বৈত শাসন' নামে সুপরিচিত।
দ্বৈত শাসনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
দিওয়ানী হস্তান্তরের ফলে রাজস্ব শাসন পরিচালনার ক্ষমতা কোম্পানি লাভ করে। কিন্তু ক্লাইভ উক্ত দায়িত্ব
দেশীয় আমলাতন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেন, যদিও সর্বময় ক্ষমতা থাকবে কোম্পানির হাতেই। বাংলার জন্য
সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খান এবং বিহারে রাজা সিতাব রায়কে নায়েব দিওয়ান নিযুক্ত করা হয়। সংগৃহীত
রাজস্ব থেকে সমস্ত প্রশাসনিক ব্যয় মিটানোর পর তাঁরা উদ্বৃত্ত রাজস্ব কোম্পানিকে প্রদান করবেন।
কোম্পানির পক্ষ থেকে তদারক করার জন্য একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট মুর্শিদাবাদ দরবারে অবস্থান
করবেন। নবাব নজমুদ্দৌলাকে মসনদে বসাবার সময় কোম্পানি রেজা খানকে নায়েব নাজিম নিযুক্ত করেন।
এখন কোম্পানি ঐ একই ব্যক্তিকে বাংলার নায়েব দিওয়ানের দায়িত্ব দেন। এতে এক দ্বৈত শাসনের মধ্যে
আরেক দ্বৈততার সৃষ্টি হয়। প্রথমত, নিজামত ও দিওয়ানী দুই পৃথক কর্তৃপক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়ায়
এক দ্বৈত শাসনের সূচনা ঘটে, আবার কোম্পানির রাজস্ব শাসনের দায়িত্ব নায়েব দিওয়ানদের হাতে
হস্তান্তরিত হওয়ায় আরেক দ্বৈত শাসনের সৃষ্টি হয়। কোম্পানি রাজস্ব পরিচালনার ক্ষমতা হাতে নিলেও
সরাসরি সে দায়িত্ব পালনে রাজি হয়নি। অর্থাৎ কোম্পানি কর্তৃক সরাসরি দিওয়ানীর দায়িত্ব গ্রহণে কিছু
অসুবিধাও ছিল। সরাসরি দিওয়ানী শাসন পরিচালনার জন্য যে জনবলের প্রয়োজন তা আদৌ কোম্পানির
ছিল না। তাছাড়া এদেশের ভাষা, আইন-কানুন ও রাজস্ব শাসনের রীতি-নীতি সম্পর্কে কোম্পানির
কর্মচারীরা ছিলেন অনভিজ্ঞ। তদুপরি সরাসরি রাজস্ব শাসনের ভার হাতে নিলে এদেশে বাণিজ্যরত অন্যান্য
ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ¡ সৃষ্টি হওয়ারও আশঙ্কা ছিল। তাই সচতুর ক্লাইভ দেশীয় এজেন্সীর
ওপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে কোম্পানির নিকট রাখেন শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে তত্ত¡াবধানের ক্ষমতা।
রেজা খানকে রাজস্ব শাসনে পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয় এবং কোম্পানি প্রতিশ্রুতি দেয় যে, রাজস্ব বিষয়ে প্রচলিত
ব্যবস্থায় তারা কোন পরিবর্তন আনবে না। ক্লাইভের সময় কোম্পানির কর্মচারীরা রেজা খানের কর্মকান্ডে
হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ক্লাইভের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে দ্বৈত শাসনে সমস্যা দেখা
দেয়। এই সময়ে ভ‚মি রাজস্ব বেশ বৃদ্ধি করা হয় এবং কঠোরভাবে তা আদায়ও করা হয়। তাছাড়া
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের লুণ্ঠন নীতির ফলে দেশের দুরবস্থা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তারা
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে। রেজা খান কোম্পানির কর্মকর্তাদের অবহিত করেন
যে, তাদের কর্মচারীরা কম মূল্যে দ্রব্যাদি ক্রয় করে অধিক মূল্যে বিক্রি করে, রায়তদেরকে নামমাত্র মূল্যে
নানাবিধ দ্রব্যাদি সরবরাহে বাধ্যকরে, দেশীয় ব্যবসায়ীদের ওপর অত্যাচার করে এবং বাণিজ্য শুল্ক দিতে
অস্বীকার করে। কিন্তু কোম্পানি এ সবের কোন প্রতিকার করার দরকার মনে করেনি।
কোম্পানির কর্মচারী গোমস্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও অত্যাচারের ফলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার
উপক্রম হয়। তার ওপর ছিল ক্রমাগতভাবে রাজস্ব বৃদ্ধির চাপ। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে রেজা খান অভিযোগ
করেন যে, নবাব আলিবর্দীর সময়ে পূর্ণিয়া জেলার রাজস্ব ছিল ৪ লক্ষ টাকা, ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে তা বৃদ্ধি পেয়ে
২৫ লক্ষ টাকায় ওঠে। অনুরূপভাবে দিনাজপুরের রাজস্ব ১২ লক্ষ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ লক্ষ টাকায় উন্নীত
হয়। রেজা খানকে কোম্পানির চাপে এই বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হয়। ফলে অনেক পরগণা হতে
রায়তরা আমিলদের উৎপীড়ন সহ্য করতে না পেরে অন্যত্র পলায়ন করে বা পেশা পরিবর্তন করে। রেজা
খান কোম্পানিকে জানান যে, ইতোপূর্বে বাংলা এত সম্পদশালী ছিল যে, দূর দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে
আসতো এবং লক্ষ লক্ষ টাকার পূঁজি খাটাতো। এখন কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা ও তাদের কর্মচারীদের
অত্যাচারের ফলে রায়তরা সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। এর প্রতিকার না হলে মহা বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
ক্লাইভের পরবর্তী গভর্নর ভেরেলেস্টও বলেছেন যে, দ্বৈত শাসনে বাংলার রায়তদের ওপর অত্যাচার হয়েছে
এবং কৃষি উৎপাদন ও ব্যবসার অবনতি ঘটেছে। কিন্তু কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা অর্থনীতির অধোগতি
রোধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে এক দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া বাংলায় নেমে
আসে যা ‘ছিয়াত্তরের মন¦ন্তর' নামে পরিচিত এবং এতে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
দ্বৈত শাসনের ফলে সৃষ্ট অব্যবস্থা, ইংরেজ কর্মচারী ও তাদের গোমস্তাদের লুণ্ঠন, ভ‚মি রাজস্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি
এবং অনাবৃষ্টির কারণে ফসলহানি হওয়ায় এই ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। দুর্ভিক্ষের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল
১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ হতে পরপর দু'বছরের প্রচন্ড ক্ষরায় ফসলহানি হওয়া এবং বাজারে খাদ্য শস্যের মূল্যবৃদ্ধি।
টাকায় এক মণ হতে চাউলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে টাকায় ৩ সেরে দাঁড়ায়। অধিক মুনাফার জন্য কোম্পানির
কর্মচারী ও গোমস্তারা খোলা বাজার থেকে চাল, ডাল কিনে মজুদ করে এবং মানুষের দুর্দশা বাড়িয়ে
তোলে। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পায়। অনাহারে চতুর্দিকে মৃত্যু আর
মানুষের লাশ পড়ে থাকে। মুর্শিদাবাদ থেকে কোম্পানির আবাসিক প্রতিনিধি রিচার্ড বেচার এক রিপোর্টে
বলেন, “এ এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য, এর বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। দেশের কোন কোন অংশে যে মানুষ ক্ষুধার
তাড়নায় মৃত মানুষ ভক্ষণ করছে, তা গুজব নয়, সত্যি। অনাহারজনিত মৃতের সংখ্যা প্রতি ষোল জনের
মধ্যে ছয় জন।” নিরন্ন মানুষকে বাঁচানোর জন্য সরকার বিভিন্ন জেলায় লঙ্গরখানা খোলে এবং কিছু অর্থ
বরাদ্দ দেয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অতি সামান্য। ইংরেজ কর্মচারী চার্লস গ্রান্ট লিখেন, “আমি
স্বচক্ষে দেখলাম, মুর্শিদাবাদে ৭৭ হাজার লোককে অনেক মাস খাওয়ানোর পরেও প্রত্যহ সেখানে প্রায় ৫
শত লোক মৃত্যুবরণ করে। রাস্তাঘাট থেকে মৃতদেহ কুড়িয়ে নেয়ার জন্য একদল লোক নিয়োজিত করতে
হয়। মৃতদেহ যারা কুড়ায়, তারাও ক্ষুধার জ্বালায় একে একে মৃত্যুবরণ করে। রাস্তাঘাট ও ঘরের ভেতর
পড়ে থাকা মৃতদেহ শিয়াল, কুকুর এবং শকুনী টানাটানি করতে থাকে। পঁচা মৃত দেহের গন্ধ এবং
অর্ধমৃতদের কান্না ও কাতরানির জন্য রাস্তায় বের হওয়া দায়। পরিস্থিতি এমন পাশবিক যে শিশু মৃত পিতামাতাকে খায়, মা তার মৃত শিশুকে খায়।”
১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে দুর্ভিক্ষ কিছুটা প্রশমিত হলেও মৃতের সংখ্যা কমেনি। কারণ দুর্ভিক্ষের পর
দেখা দেয় মহামারী। দুর্ভিক্ষ চলাকালে যারা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করে তারাই মহামারীর


কবলে পতিত হয়। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পলায়ন করে; কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তি বা দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করে।
এমনিভাবে দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং পলায়নের ফলে বাংলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি পতিত ও জঙ্গলাকীর্ণ
হয়ে পড়ে। এ দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক কোটি লোক মারা যায়Ñ যারা ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় একতৃতীয়াংশ। কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বাংলার রেশম ও তাঁত শিল্প এ সময় দারুনভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের এত দুঃখ-দুর্দশা সত্তে¡ও তাদের
কাছ থেকে অধিক হারে রাজস্ব আদায় করা হয়। এমনকি যারা মৃত্যুবরণ করে বা অন্যত্র পালিয়ে যায়
তাদের দেয় রাজস্ব প্রতিবেশীদের নিকট হতে জোর করে আদায়ের চেষ্টা চলে।
এ দুর্ভিক্ষের এক পরোক্ষ ফল দ্বৈত শাসনের অবসান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দায়িত্বহীন ক্ষমতা ও
শোষণনীতি যে মহাদুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার জন্য দায়ী কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তা অনুভব করে। সে কারণে তারা
দিওয়ানী শাসন সরাসরি হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কর্তৃপক্ষ দ্বৈত
শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজস্ব শাসনের দায়িত্বভার নিজ হাতে গ্রহণ করে।
সারসংক্ষেপ
বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পূর্ব ও উত্তর ভারতে অদ্বিতীয় রাজনৈতিক
শক্তিতে পরিণত হয়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ বাংলায় এসে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত দিল্লির সম্রাট
দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে এক চুক্তি করে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ানী শাসন তথা রাজস্ব
আদায়ের ক্ষমতা লাভ করেন। সম্রাটের সাথে ক্লাইভের এ চুক্তি এলাহাবাদের সন্ধি (আগস্ট, ১৭৬৫
খ্রি.) নামে পরিচিত। ক্লাইভ রাজস্ব শাসনের জন্য দেশীয় নায়েব দিওয়ান নিয়োগ করে রাজস্ব শাসনে
দ্বৈততা সৃষ্টি করেন। কোম্পানির হাতে ক্ষমতা এবং অন্যের ওপর দায়িত্ব অর্পণের এ ব্যবস্থা দ্বৈত শাসন
নামে পরিচিত। কিন্তু এ ব্যবস্থার ফলে রাজস্ব শাসনে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোম্পানির
কর্মচারীদের দুর্নীতি, স্বার্থপরতা এবং রাজস্ব শাসনে হস্তক্ষেপ নীতির ফলে এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এতে কৃষি ব্যবস্থা, বাণিজ্য ও দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে। এর সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ পরিণাম ১৭৭০
খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ, যা ছিয়াত্তরের মন¦ন্তর নামে পরিচিত। দ্বৈত শাসনের চরম ব্যর্থতায় ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে এ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে প্রত্যক্ষভাবে রাজস্ব শাসনের দায়িত্ব হাতে নেয়।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১। আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (১২০০Ñ১৮৫৭ খ্রি.)।
২। ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
৩। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। ক্লাইভ কত খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার বাংলার গভর্নর হন?
(ক) ১৭৬২ খ্রি. (খ) ১৭৬৫ খ্রি.
(গ) ১৭৬৭ খ্রি. (ঘ) ১৭৭০ খ্রি.।
২। প্রাদেশিক দিওয়ানের নিয়োগকর্তা কে ছিলেন?
(ক) সুবাদার (খ) কেন্দ্রীয় দিওয়ান
(গ) সম্রাট (ঘ) সিপাহসালার।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিহাস পৃষ্ঠা  ১৬৩
৩। মীর জাফরের মৃত্যুর পর কে বাংলার নবাব হন?
(ক) মীর কাশিম (খ) মিরণ
(গ) সিরাজ উদ্দৌলা (ঘ) নজমুদ্দৌলা।
৪। এলাহাবাদের সন্ধিচুক্তি কখন সম্পাদিত হয়?
(ক) ১৭৬৪ খ্রি. (খ) ১৭৬৫ খ্রি.
(গ) ১৭৬৭ খ্রি. (ঘ) ১৭৭০ খ্রি.।
৫। এলাহাবাদের সন্ধি অনুযায়ী দিওয়ানী শাসন লাভের বিনিময়ে কোম্পানি সম্রাটকে বাৎসরিক কত লক্ষ
টাকা দেবে?
(ক) ২৬ লক্ষ (খ) ৩৬ লক্ষ
(গ) ৪৬ লক্ষ (ঘ) ৫৩ লক্ষ।
৬। নবাব আলিবর্দীর সময়ে পূর্ণিয়া জেলার রাজস্বের পরিমাণ কত ছিল?
(ক) ২ লক্ষ টাকা (খ) ৩ লক্ষ টাকা
(গ) ৪ লক্ষ টাকা (ঘ) ৭ লক্ষ টাকা।
৭। দ্বৈত শাসনের অবসান কখন হয়?
(ক) ১৭৭০ খ্রি. (খ) ১৭৭২ খ্রি.
(গ) ১৭৭৪ খ্রি. (ঘ) ১৭৭৫ খ্রি.।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। দিওয়ানী কি তা সংক্ষেপে বর্ণনা করুন।
২। দ্বৈত শাসনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করুন।
৩। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। বাংলায় ইংরেজদের দিওয়ানী লাভের পটভ‚মি আলোচনা করুন।
২। দ্বৈত শাসন বলতে কি বুঝায়? এর ফলাফল আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]