অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে (মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর) ভারতে কয়েকটি স্বাধীন বা অর্ধস্বাধীন
রাজ্যের উদ্ভব হয়। এগুলো ছিল বাংলা, অযোধ্যা, হায়দ্রাবাদ, মহীশূর ও মারাঠা রাজ্য। এসব রাজ্যগুলোর
মধ্যে প্রথমে বাংলা ইংরেজরা দখল করে নেয়। তারপর ব্রিটিশরা ক্রমশ গ্রাস করে সমগ্র ভারতবর্ষ। তবে
একই সমান্তরালে যে সকল দেশীয় নরপতি ভারতে ইংরেজদের সার্বভৌম শক্তি বিস্তার রোধের চেষ্টা চালিয়ে
ছিলেন, তাঁদের মধ্যে টিপু সুলতান ছিলেন অন্যতম। বস্তুত ইংরেজদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারে
সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলেন টিপু। যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শহীদ
হয়েছেন তিনি। এসব কারণে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে টিপু এক কিংবদন্তীর নায়ক।
টিপু-ইংরেজ সংঘর্ষের পটভ‚মি এবং টিপুর প্রতি ইংরেজদের মনোভাব
টিপুর পিতা হায়দার আলী ১৭৬১ খ্রি. মহীশূরের ক্ষমতা দখল করেন। তিনি অল্পকালের মধ্যেই মহীশূরকে
ভারতবর্ষের মধ্যে একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেন। ১৭৬৯ খ্রি. থেকে তিনি ইংরেজদের যুদ্ধে পরাস্ত
করে মাদ্রাজ পর্যন্ত হঠিয়ে দেন। ১৭৮২ খ্রি. দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সময় তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে টিপু
সুলতান ক্ষমতায় বসেন।
আঠার শতকের যে কোন ভারতীয় শাসকদের চেয়ে টিপু যথার্থই অনুধাবন করেছিলেন যে, ব্রিটিশ শক্তি
সমগ্র ভারতের যেকোন শক্তির পক্ষে আতঙ্ক ও বিপদের কারণ। তাই তিন ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে
অবিচল দৃঢ়তা ও অসম সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।এর ফলে ইংরেজরা তাঁকে মনে করেছিল এক
ভয়ানক শত্রু। পিতার ন্যায় টিপুও ইংরেজ বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। অন্যদিকে পিটের ভারত শাসন
আইনে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ
বিপরীত। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা দেখলেন যে, দক্ষিণ ভারতে ইংরেজদের নিরাপত্তা,
ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি স্বার্থের ক্ষেত্রে টিপুর মহীশূর রাজ্য সবচেয়ে বড় হুমকিস্বরূপ। ভারতের রাজনীতির
ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকার নির্দেশ নিয়ে লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে আসেন। কিন্তু তিনি অল্পকালের মধ্যেই
বুঝতে পারলেন যে, ভারতে ব্রিটিশ প্রভুত্ব বিস্তার করতে হলে টিপুকে পরাজিত করতেই হবে। তদুপরি সেই
সময় দক্ষিণ ভারতে শক্তি সাম্য (ইধষধহপব ড়ভ চড়বিৎ) টিপুর পক্ষে ছিল। শুধু দক্ষিণ ভারতেই নয় সমগ্র
ভারতে টিপুর রাজ্য ছিল সর্বাধিক শক্তিশালী, সুশাসিত ও সমৃদ্ধ। টিপু দক্ষিণ ভারতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ¡ী
হায়দ্রাবাদের নিজাম এবং উদীয়মান শক্তি মারাঠাদের সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করে সবাইকে বিস্মিত
করেন। ভারতে ইংরেজদের ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ¡ী ইউরোপীয় শক্তি ফরাসিদের সাথে টিপু সুসম্পর্ক স্থাপন
করেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, টিপু ফ্রান্সের বিপ্লবী দল ‘জ্যাকোবিন ক্লাবের' সদস্য ছিলেন।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধে তিনি ফরাসিদের পাশাপাশি তুরস্কের সুলতানের সাহায্য কামনা করেন।
ভারতের নতুন গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিস এসব কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং ভারতে ইংরেজ স্বার্থ
বিপন্ন হবার সম্ভাবনা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
স্বাধীনচেতা টিপু রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমে ‘স্বাধীনতা বৃক্ষ' নামে একটি গাছের চারা রোপন করেন। সে সময়
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সেনাবাহিনীর মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার অভাব ছিল প্রকট। তিনি ইউরোপীয় সামরিক
বাহিনীর অনুকরণে এবং ফরাসি সমরবিদদের তত্ত¡াবধানে একটি সুশৃ´খল ও আধুনিক বাহিনী গঠন করেন।
তাঁর পদাতিক বাহিনীকে ইউরোপীয় ধরনের ‘মাস্কেট' বন্দুক ও বেয়নেট দ্বারা সুসজ্জিত করা হয়। অবশ্য
এসব অস্ত্র মহীশূরেই নির্মিত হতো। তিনি একটি আধুনিক নৌবহর গঠনের চেষ্টা করেন। এজন্যে তিনি
দুটো জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র(উড়পশুধৎফ) প্রতিষ্ঠা করেন। এবং নৌবাহিনীর জাহাজের দুটো ‘মডেল' টিপু
নিজেই প্রস্তুত করেন। অর্থাৎ সুগঠিত ও সুসজ্জিত টিপুর বাহিনী ইংরেজদের মনে ভীতির সঞ্চার করে।
ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির সম্মুখে টিপু যখন পাহাড়ের মতো অবিচল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন,
তখন কর্নওয়ালিস টিপুর রাজ্য তথা মালাবারের ওপর লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কর্নওয়ালিসের কাছে
মনে হয়েছিল যে, মালাবার অঞ্চলের মসলা ও চন্দন কাঠের ব্যবসায় অংশ নেওয়া এবং ইংরেজদের স্বার্থে
এই ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ইংরেজ উপনিবেশ বিস্তারের জন্যে
কালিকট ও ক্যানন বন্দর দখল করা খুবই জরুরি ছিল। তদুপরি এই পথ দিয়ে ব্রিটেন সহ ইউরোপের সাথে
নৌযোগাযোগ সবচেয়ে সহজতর ছিল। অন্যদিকে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এবং আমেরিকায় ১৩টি উপনিবেশ
হারিয়ে কর্নওয়ালিস সদ্য ভারতে এসেছেন। ফলে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার এবং ক্ষতিপূরণের জন্যে কর্নওয়ালিস
টিপুর সমৃদ্ধ রাজ্য জয়ের পরিকল্পনা করেন। সুতরাং দেখা যায় যে, ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্য বিস্তারের দ্বিতীয়
পর্যায়ে ভারতে ইংরেজ শাসন সম্প্রসারণের প্রয়োজনও ছিল।
তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ
১৭৮৩ খ্রি. টিপুর পিতা হায়দার আলীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয় অর্থাৎ যখন দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ
(১৭৮০Ñ৮৪ খ্রি.) চলছিল।এ সময় ইংরেজরা হায়দার আলী ও টিপুর হাতে পর্যুদস্ত হয়। ১৭৮৪ খ্রি. টিপু
বিদনুর ও ম্যাঙ্গালোর দখল করেন। ইংরেজরা তখন সন্ধি করতে বাধ্য এবং স্বাক্ষরিত হয় ম্যাঙ্গালোর চুক্তি।
এ চুক্তি অনুযায়ী দু'পক্ষের মধ্যে বৈরিতার আপাত অবসান হয়েছিল সত্য, কিন্তু ইঙ্গ-মহীশূর বিরোধিতার
কোন স্থায়ী সমাধান হয়নি। অর্থাৎ ম্যাঙ্গালোর চুক্তি ছিল নামমাত্র সন্ধি।টিপু কিংবা ইংরেজ উভয়ই
বুঝেছিলেন যে, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। টিপু সুলতান অথবা ইংরেজ যেকোন একপক্ষ দাক্ষিণাত্য
থেকে উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ চলবেই, এই নিরেট সত্য কথাটি কারো অবিদিত ছিল না।
দুর্ধর্ষ স্বাধীনচেতা বীর টিপু দাক্ষিণাত্যের ভ‚মি থেকে বৃটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের জাল ছিন্ন করতে
বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি এজন্যে ইংরেজদের প্রতিদ্বন্দ¡ী ইউরোপীয় রাষ্ট্র এবং এশিয়ার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর
সাহায্যও কামনা করেছিলেন।
এদিকে আঠার শতকের আশির দশকে দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। ১৭৮৮
খ্রি. কর্নওয়ালিস দাক্ষিণাত্যে টিপুর প্রতিদ্বন্দ¡ী নিজামের কাছ থেকে গুন্টুর নামক ভ‚খন্ডটি উপহার হিসেবে
গ্রহণ করেন। বিনিময়ে তিনি প্রয়োজনবোধে নিজামকে সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এক বছর পর
(১৭৮৯ খ্রি.) কর্নওয়ালিস আরেক ধাপ অগ্রসর হয়ে দাক্ষিণাত্যে নিজামের নেতৃত্বে শক্তিসংঘ গঠনের ইচ্ছা
প্রকাশ করেন। কিন্তু টিপুকে গ্রহণ করার কোন ইঙ্গিত তাতে ছিল না। এমনকি টিপুকে সংবাদ পর্যন্ত দেয়ার
সৌজন্য কর্নওয়ালিস দেখাননি। ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার জন ম্যালকম ও উলক্স কর্নওয়ালিসের এই
আচরণকে টিপুর সাথে চুক্তিবিরোধী আচরণ এবং বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেছেন। এমতাবস্থায়
টিপু ১৭৮৯ খ্রি. ইংরেজ সমর্থক ত্রিবাঙ্কুর রাজ্য আক্রমণ করে ৩য় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের (১৭৯০-৯২ খ্রি.)
সূচনা করেন। ত্রিবাঙ্কুরের রাজা মাদ্রাজে ইংরেজ সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করলে সম্ভবত ভয়ে তারা অগ্রসর
হয়নি। ফলে কর্নওয়ালিস মাদ্রাজ সরকারের তীব্র নিন্দা করেন এবং দাক্ষিণাত্যে টিপুর প্রতিদ্বন্দ¡ী মারাঠা
এবং নিজাম-এর সাথে ‘ত্রিশক্তি মৈত্রী' (ঞৎরঢ়ষব অষষরধহপব) গঠন করেন। কর্নওয়ালিস নিজে সেনাপতি
হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হল এবং কোনপক্ষই জয়লাভ করতে সমর্থ হয়নি। শেষ
পর্যšন্তটিপু পরাজিত হয়ে শ্রীরঙ্গপত্তম (১৭৯২ খ্রি.)-এর চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ সন্ধিতে কতকগুলো
অপমানজনক শর্ত ছিল। যেমন- ইংরেজরা সম্পদশালী মালাবার উপক‚ল অধিকার করে নেয়। দ্বিতীয়ত,
টিপুর রাজ্যের অধিকাংশ ভ‚খন্ড ইংরেজ, মারাঠা ও নিজাম দখল করে। তৃতীয়ত, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ
প্রচুর অর্থ ইংরেজদের প্রদান এমনকি টিপু তাঁর দুই পুত্রকেও ইংরেজদের হাতে জিম্মি হিসেবে সমর্পণ
করেন।
চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ
টিপু সুলতানের ন্যায় একজন স্বাধীনচেতা, দেশপ্রেমিক সুলতানের পক্ষে শ্রীরঙ্গপতনের অপমানজনক শর্ত
বেশিদিন মেনে চলা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে আঠার শতকের নব্বই-এর দশকে ফরাসি সমরবিদদের
সহায়তা পেয়ে টিপু উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি ফ্রান্সের বিপ্লবী দল জ্যাকোবিন পার্টির সদস্যপদ
গ্রহণ করেন এবং ইংরেজদের চরম শত্রু ফ্রান্সের বিপ্লবী ঘটনা প্রবাহ তাঁকে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। প্রাপ্ত
তথ্যে দেখা যায় যে, ১৭৯৯ খ্রি. তিনি মরিশাসে ফরাসি গভর্নরের কাছে দূত প্রেরণ করে সাহায্য প্রার্থনা
করেন এবং তিনি কিছু সৈন্য টিপুর কাছে প্রেরণ করেন।
অন্যদিকে ভারতে পৌঁছেই পরবর্তী গভর্নর জেনারেল ঘোর সাম্রাজ্যবাদী ওয়েলেসলি টিপুর রণসজ্জার
বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে মাদ্রাজ কাউন্সিলের বিরোধিতা সত্তে¡ও টিপুকে দমন করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি
কর্নওয়ালিসের সময় স্বাক্ষরিত ‘ত্রিশক্তি মৈত্রী' চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করেন। সহজেই নিজামকে ইংরেজের
পক্ষে আনা হয়। কিন্তু মারাঠারা সহজে ইংরেজ পক্ষে যোগ দিতে চায়নি। তখন টিপুর রাজ্যের একাংশ
মারাঠাদের প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়ায় তারা ইংরেজ পক্ষে যোগ দেয়।
রণপ্রস্তুতি সমাপ্ত করে ওয়েলেসলি টিপুকে অধীনতামূলক মিত্রতা গ্রহণ করার জন্যে আমন্ত্রণ জানান।
তদুপরি তিনি তাঁর ফরাসি মৈত্রিতা সম্পর্ক কৈফিয়তও তলব করেন। কিন্তু স্বাধীনচেতা টিপু এসব আহবান
ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা হয়। সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ইংরেজরা
উন্নত অস্ত্র এবং মারাঠা ও নিজামের বাহিনীর সহায়তায় টিপুকে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। ফলে টিপু
সদাশির ও মলভেলীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমে এসে সৈন্য সমাবেশ করেন। ইংরেজ
বাহিনী টিপুর রাজধানী অবরোধ করে। উভয়পক্ষে একমাস যুদ্ধ চলে। টিপু বীরের মতো যুদ্ধ করে
প্রাণত্যাগ করেন। ইংরেজরা এক প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুকে পরাজিত করে স্বস্তিবোধ করে।
টিপুর পতনের পর গোটা রাজ্যকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। অধিকাংশ এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা
হয়। নিজামকেও দেয়া হয় এক ক্ষুদ্রাংশ। মারাঠাদেরকে পূর্বশর্ত সহ কিছু ভ‚খন্ড দেয়ার কথা বললে তারা
গ্রহণ করেনি। এই ব্যবচ্ছেদের পর মহীশূর রাজ্যের অবশিষ্ট ক্ষুদ্র অংশটিতে মহীশূরের প্রাচীন এক হিন্দু
রাজবংশের উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতায় বসানো হয়।
টিপু সুলতানের পরাজয়ের কারণ
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী সংগ্রামে টিপু এক অবিস্মরণীয় নাম। একটি প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে
তিনি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁর পতনের কিছু কারণ ছিল ঃ
১. অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, অশ্বারোহী বাহিনীর অবক্ষয় এবং টিপু কর্তৃক হায়দার আলীর সমর
নীতি বর্জন এর জন্যে দায়ী। টিপুর জীবন আলেখ্যের রচয়িতা ঐতিহাসিক মহিবুল হাসান অবশ্য একে
অন্যতম কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, প্রধান কারণ হিসেবে নয়। শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি অনুযায়ী টিপু
অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করে কৌশলগত ভুল করেছেন। কিন্তু ইংরেজদের সাথে
সম্পাদিত চুক্তির মর্যাদা তিনি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
২. ইংরেজদের হাতে টিপুর পরাজয়ের মূল কারণ ছিল ইঙ্গ-মারাঠা-নিজামের ত্রিশক্তি জোট। ইংরেজরা
চাতুর্যের সাথে দুর্ধর্ষ মারাঠা শক্তিকে টিপুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। তদুপরি সম্মিলিত বাহিনীর সৈন্য
সংখ্যা থেকে টিপুর সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক কম। অন্যদিকে টিপু দেশীয় রাজাদের সহায়তা পাননি,
প্রয়োজনীয় মুহ‚র্তে বৈদেশিক সহায়তাও পাননি। বিভিন্ন দেশে দূত প্রেরণ করে তিনি কেবল মৌখিক
সহানুভ‚তি লাভ করেছিলেন। অল্প সংখ্যক ফরাসি স্বেচ্ছাসেবক টিপুকে সাহায্য করতে এসে তাঁর প্রতি
ওয়েলেসলির সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি করেছিল মাত্র।
টিপু সুলতানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন
ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করতে যারা আমৃত্যু যুদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে টিপু
সুলতান অন্যতম। তিনি ছিলেন মহান যোদ্ধা, দেশপ্রেমিক এবং স্বাধীনচেতা। ইংরেজদের সাথে
অধীনতামূলক মিত্রতা স্বাক্ষর করে তিনি সহজেই নিজ রাজ্য ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু স্বদেশপ্রেম ও
আত্মমর্যাদা বোধের কারণে তিনি তা করেননি। ইংরেজ দার্শনিক মিল টিপুকে প্রাচ্যের একজন শ্রেষ্ঠ রাজা
হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মুর এবং ডিরোম লেখকরা টিপুর রাজ্যের সমৃদ্ধি এবং জনগণের সুখ-শান্তির
বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ইংরেজরা যখন মহীশূর রাজ্য দখল করে তখন তারা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য
করছিল যে, ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত সাম্রাজ্যের কৃষক-সমাজের তুলনায় মহীশূরের কৃষক-সমাজ অনেক বেশি
সমৃদ্ধির অধিকারী। ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল স্যার জন শোর লিখেছিলেন, “টিপুর রাজ্যমধ্যে
প্রজাদের স্বার্থ সুরক্ষিত, কাজ করতে তারা উৎসাহিত হয়। কারণ শ্রমের ফল তারা ভোগ করতে পায়।”
নতুন নতুন বিষয় প্রবর্তনের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারে ধর্ম, ইতিহাস, রণনীতি,
চিকিৎসা ও গণিতের গ্রন্থ ছিল। অন্যদিকে তিনি ছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক মানুষ। ১৭৯১ খ্রি. মারাঠা
বাহিনী কর্তৃক ‘শৃঙ্গেরি মঠ' লুণ্ঠিত হওয়ার পর টিপু সারাদাদেবীর মূর্তি নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেন।
শ্রীরঙ্গনাথ মন্দিরের দূরত্ব টিপুর প্রাসাদ থেকে মাত্র একশত গজ। তিনি নিজ রাজ্যে আধুনিক অর্থনৈতিক
ব্যবস্থা চালু করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে রাজ্যটি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সুতরাং বলা যায় যে, এরূপ প্রতিক‚ল
পরিস্থিতিতে টিপুর পরাজয় ছিল নক্ষত্রের পতনের মতো।
সারসংক্ষেপ
ভারতবর্ষে ইংরেজদের সার্বভৌম ক্ষমতা বিস্তারের বিরুদ্ধে যে সকল দেশীয় নরপতি অবিচল দৃঢ়তা,
অসম সাহস দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, মহীশূরের টিপু সুলতান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এ
লক্ষ্যে তিনি ইউরোপীয় সামরিক বাহিনীর অনুকরণে একটি সুশৃঙ´খল ও আধুনিক বাহিনী গঠন করেন।
ইংরেজরা টিপুকে দমনের জন্য মারাঠা ও নিজামের সাথে ‘ত্রিশক্তি মৈত্রী' গঠন করে। লর্ডওয়েলেসলি
টিপুকে অধীনতামূলক মিত্রতা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালে তিনি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে
উভয়পক্ষের মধ্যে চতুর্থঈঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা হয়।স্বাধীনচেতা টিপু বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণত্যাগ
করেন। অতপর তাঁর রাজ্য বিভক্ত করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন প্রতিরোধে টিপুর পরাজয়ছিল
নক্ষত্রের পতনের মতো।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিহাস পৃষ্ঠা ১৭৯
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (১২০০-১৮৫৭ খ্রি.)।
২. ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। টিপুর পিতা হায়দর আলী কত খ্রিস্টাব্দে মহীশূর রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হনÑ
(ক) ১৭৫৭ খ্রি. (খ) ১৭৬১ খ্রি.
(গ) ১৭৬৫ খ্রি. (ঘ) ১৭৭০ খ্রি.।
২। স্বাধীনতা প্রিয় টিপু কোথায় ‘স্বাধীনতা বৃক্ষ' রোপন করেনÑ
(ক) শ্রীরঙ্গপত্তমে (খ) হায়দ্রাবাদে
(গ) কলিকাতায় (ঘ) ঢাকায়।
৩। টিপুর বাহিনী যে বন্দুক ব্যবহার করতো তার নামÑ
(ক) থ্রি-নট-থ্রি (খ) চাইনিজ
(গ) মাস্কেট (ঘ) জি-থ্রি
৪। দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের অবসান হয় যে চুক্তি দ্বারা তার নামÑ
(ক) কর্ণাটক চুক্তি (খ) ঢাকা চুক্তি
(গ) কলিকাতা চুক্তি (ঘ) ম্যাঙ্গালোর চুক্তি।
৫। টিপুকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন যে ইংরেজ তার নামÑ
(ক) ক্লাইভ (খ) কর্নওয়ালিস
(গ) ওয়েলেসলি (ঘ) কার্জন।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। টিপুকে কেন ইংরেজরা ভয়ানক শত্রু মনে করেছিল?
২। টিপু তাঁর সেনাবাহিনীকে আধুনিক করার জন্যে কি কি পদক্ষেপ নেন?
৩। টিপুর কৃতিত্ব সংক্ষেপে মুল্যায়ন করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। টিপুর সাথে ইংরেজদের সংঘর্ষের কারণগুলোর বিবরণ দিন।
২। তৃতীয় ও চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের বিবরণ দিন।
৩। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে টিপু সুলতানের প্রতিরোধ যুদ্ধের একটি চিত্র অংকন করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত