১। লর্ড ডালহৌসির আমলে ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস বিবৃত করুন।
২। লর্ড ডালহৌসি কর্তৃক প্রবর্তিত সংস্কারগুলো পর্যালোচনা করুন।


অসাধারণ উদ্ভাবনী ও সংগঠনী শক্তির অধিকারী লর্ড ডালহৌসির শাসনকাল ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের
ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর শাসনকাল
ভারতে বৃটিশ শাসনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল
রূপে ভারতে আসার পূর্বে লর্ড ডালহৌসি বোর্ড অব ট্রেডের সভাপতি হিসেবে বৃটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য
ছিলেন। তিনি যখন ভারতে আসেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৬ বৎসর। তিনি তৎকালীন সময় পর্যন্ত গভর্নর
জেনারেলদের মধ্যে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। মাত্র ৮ বৎসরের শাসনে ভারতে ইংরেজ শাসনের আকৃতি ও
প্রকৃতিতে তিনি স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছেন।
ভারতের ইতিহাসে লর্ড ডালহৌসির অন্যতম প্রধান কীর্তি হলো ভারতে ক্ষমতার সম্প্রসারণ।তাঁর সম্প্রসারণ
নীতির মূল লক্ষ্য ছিল রাজ্য জয় এবং বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যে উপায় অবলম্বন
করা হয়েছিল তা সৎ ছিল না।ভারতের জনসাধারণের জন্য তা মঙ্গলকর বা অমঙ্গলকর কিনা সে বিষয়ে
চিন্তা-ভাবনা করা ঘোর সাম্রাজ্যবাদী লর্ড ডালহৌসির নিকট একেবারে গৌণ ছিল। অর্থাৎ তাঁর সাম্রাজ্যবাদী
নীতির একমাত্র কারণ ছিল ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার সাধন করা। প্রধানত এই সাম্রাজ্য লিপ্সাকে
কার্যে পরিণত করার জন্য তিনি তিনটি নীতি অনুসরণ করেছিলেনÑ (১) প্রত্যক্ষ যুদ্ধের দ্বারা রাজ্য বিস্তার,
(২) স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা রাজ্য দখল, (৩) কুশাসন ও অরাজকতার অভিযোগে দেশীয় রাজ্য অধিকার।
১. প্রত্যক্ষ যুদ্ধের দ্বারা রাজ্য বিস্তার
দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধ (১৮৪৮Ñ৪৯ খ্রি.)
১৮৪৬ খ্রি. লর্ড হার্ডিঞ্জ ও শিখদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি (লাহোর চুক্তি) অনুযায়ী আটজন শিখ সর্দার নিয়ে
গঠিত অভিভাবক সভা পাঞ্জাবস্থ বৃটিশ রেসিডেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী পাঞ্জাবের নাবালক মহারাজা দলীপ
সিংহের পক্ষে শাসনভার পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করলে মহারাজা সম্পূর্ণরূপে বৃটিশ প্রভাবাধীন হয়ে
পড়েন। হার্ডিঞ্জ-এর এই ব্যবস্থায় শিখরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ব্রিটিশ রেসিডেন্টের কর্তৃত্ব তাদের কাছে
অসহ্য হয়ে ওঠে। তাছাড়া শিখ নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাদের পরাজয় বরণ (প্রথম শিখ যুদ্ধ,
১৮৪৬ খ্রি.) করতে হলেও তারা নিজেদের সম্পূর্ণভাবে পরাভ‚ত বলে মেনে নিতে পারেনি। কাজেই তারা
নতুন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সুযোগ খুঁজতে থাকে। বৃটিশ রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের



অভিযোগে কোম্পানি পাঞ্জাবের রাণীমাতা ঝিন্দনকে চুনার দুর্গে নির্বাসিত করলে শিখদের মনে গভীর
অসন্তোষ দেখা দেয়। রাণীমাতা ঝিন্দনের প্রতি কোম্পানির এ অপমানজনক আচরণ শিখ জাতির
আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। এসঙ্গে জলন্ধর দোয়াবে চড়া হারে ভ‚মি রাজস্ব প্রবর্তন করায় স্থানীয় শিখ
সর্দারগণের মধ্যেও অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। উপরন্তু পাঞ্জাবে নিযুক্ত ইংরেজ কর্মচারীদের উদ্ধত আচরণ,
শিখ পুনরুদ্ধারগুলোর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন এবং শিখ রমনীদের নির্যাতন শিখদের ধর্মবিশ্বাস ও
আত্মাভিমানে আঘাত দেয়। এভাবে যখন শিখদের মনে ইংরেজ বিরোধী মনোভাব তীব্র হয়ে ওঠে ঠিক সেই
সময় মুলতান ও হাজারার শাসনকর্তাগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
দেওয়ান মুলরাজ ছিলেন মুলতানের শাসনকর্তা। তিনি আইনত পাঞ্জাবের মহারাজার অধীন হলেও এক
প্রকার স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন। ব্রিটিশ রেসিডেন্ট প্রভাবিত পাঞ্জাবের অভিভাবক সভা
মুলরাজকে মুলতানের শাসন সংক্রান্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব নিকাশ দাখিল করতে নির্দেশ দিলে তিনি পদত্যাগ
করবেন বলে জানান। ফলে পাঞ্জাবের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড কিউরি কাহান সিং মানকে তাঁহার স্থলে
মুলতানের দেওয়ান নিযুক্ত করেন।নবনিযুক্ত দেওয়ানকে সহযোগিতা করার জন্য ভ্যান্স এগ্নিউ ও এন্ডারসন
নামে দুজন ইংরেজ কর্মচারীকে মুলতানে প্রেরণ করেন। মুলরাজ উক্ত দু'জন ইংরেজ কর্মচারীকে হত্যা করে
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় মুলতানে নিজ প্রভুত্ব স্থাপন করেন। এই সঙ্গে সমগ্র মুলতান ইংরেজ বিরোধী
বিদ্রোহে জ্বলে ওঠে। মুলতানের বিদ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবের শিখ সৈন্যগণও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
পেশওয়ার পুনরুদ্ধারের আশায় আফগান জাতিও এই বিদ্রোহে শিখদের পক্ষে যোগদান করে। এই অবস্থায়
লর্ড ডালহৌসি শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় শিখযুদ্ধ নামে অভিহিত। ইংরেজ
সেনাপতি লর্ড হিউ গাফ্ বিশ হাজার সৈন্য এবং একশত কামানসহ পাঞ্জাব অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁকে
সাহায্য করার জন্য বোম্বে থেকেও একদল সৈন্য আনা হয়। ইতোমধ্যে সেনাপতি হারবার্ট এডওয়ার্ডস্
মুলতান আক্রমণ করলে মুলরাজ মুলতানের দুর্গে আশ্রয় নেন। লাহোর হতে বৃটিশ রেসিডেন্ট স্যার হেনরি
লরেন্স শের সিংহের নেতৃত্বে আরও একদল সৈন্য মুলরাজের বিরুদ্ধে পাঠান। কিন্তু শের সিংহ মুলরাজের
পক্ষে যোগদান করে বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ফলে সেনাপতি লর্ড গাফ্ প্রথমে শের সিংহের বিরুদ্ধে
যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং রামনগর নামক স্থানে শের সিংহকে আক্রমণ করেন। কিন্তু শের সিংহ পালিয়ে যেতে
সক্ষম হন। অতপর ঝিলাম নদীর তীরে চিলায়ানওয়ালায় শিখদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয় (১৮৪৯ খ্রি.)।
যুদ্ধের প্রথম দিকে ইংরেজ বাহিনী সাময়িক সাফল্য লাভ করলেও শেষ দিকে শিখ বাহিনীর হস্তে যথেষ্ট
ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু শিখরা পরাজিত ইংরেজ বাহিনীর পশ্চাৎধাবন না করে লুটতরাজে ব্যস্ত থাকার সুযোগে
ইংরেজ বাহিনী পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে মুলতান আক্রমণ করে। মুলতানের শিখ বাহিনী বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ
করেও অবশেষে আত্মসমর্পন করে। মুলরাজ বন্দি হন। মুলরাজকে সামরিক আদালতের বিচারে নির্বাসিত
করা হয়।
মুলতান অধিকারের পর তথাকার ইংরেজ বাহিনী এবং লর্ড গাফ্-এর মিলিত সৈন্যবাহিনী চিনাব নদীর তীরে
গুজরাট নামক এক শহরের উপকণ্ঠে শিখদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় (ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৯খ্রি.)। এই যুদ্ধে
শিখরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়ে আফগানিস্তানের দিকে পালিয়ে যায়। শের সিংহ আত্মসমর্পন করতে বাধ্য
হয়। এভাবে দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধের অবসান ঘটে।
অতপর লর্ড ডালহৌসি পাঞ্জাব অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। বৃটেনের পরিচালক সভার অনুমতির অপেক্ষা না
করেই পাঞ্জাব অধিগ্রহণের ঘোষণা পত্র জারি করেনÑ (১) সমগ্র পাঞ্জাব বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয় এবং
মহারাজা দলীপ সিংহকে পদচ্যুত করে ইংল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়, (২) দলীপ সিংহকে বাৎসরিক পঞ্চাশ
হাজার পাউন্ড বৃত্তি বা পেনশন দানের ব্যবস্থা করা হয়, (৩) খালসা বাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হয়, (৪) পাঞ্জাব
অধিকারের ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমা আফগান রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত বর্ধিত হয়, (৫) হেনরি লরেন্সকে
চীফ কমিশনার করে পাঞ্জাবের শাসনভার তাঁর হস্তে অর্পণ করা হয়, (৬) এই প্রদেশের পুনর্গঠনের কাজ শুরু
হয় এবং নানাবিধ সামাজিক শাসনসংক্রান্ত সংস্কার প্রবর্তিত হতে থাকে, (৭) ইংরেজ কর্মচারীদের সুদক্ষ


শাসন পরিচালনের ফলে শিখরা কিছুকালের মধ্যেই পরাজয়ের গøানি বিস্মৃত হয়ে ইংরেজদের অনুগত হয়ে
পড়ে। এ আনুগত্যের প্রমাণ মিলে দ্বিতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধে ও সিপাহী বিদ্রোহের সময়।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধ (১৮৫২ খ্রি.)
প্রথম ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের (১৮২৬ খ্রি.) পর ইয়ান্দাবুর সন্ধির শর্তানুসারে ক্রাউফোড ব্রহ্মদেশে ইংরেজ
রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বর্মী সরকারের সাথে এক চুক্তি সম্পাদিত করে ইংরেজ বণিকদের জন্য
কিছু বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করেন। কিন্তু বর্মী সরকার স্থায়ীভাবে ইংরেজ রেসিডেন্ট রাখতে
অসম্মতি জ্ঞাপন করলে ক্রাউফোডের পর তিন বৎসরের মধ্যে আর কোন ইংরেজ রেসিডেন্ট ব্রহ্মদেশে
ছিলেন না।১৮৩০ খ্রি. লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক মেজর হেনরি বার্নেটকে ব্রহ্মদেশে প্রেরণ করলে তিনি ব্রহ্ম
সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করেন। কিন্তু
১৮৩৭ খ্রি. ব্রহ্মদেশের নতুন রাজা থারাবাডি ইয়ান্দাবুর সন্ধির শর্ত পালন করতে অস্বীকৃতি জানান এবং
ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ শত্রুতা শুরু করেন। ফলে ইংরেজ কোম্পানি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে রেসিডেন্সি বন্ধ করে
দিতে বাধ্য হন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে কয়েকজন ইংরেজ বণিক বর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেই
সংবাদ লর্ড ডালহৌসির নিকট পৌঁছামাত্র তিনি তৎক্ষণাৎ এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। তিনি ব্রহ্ম সরকারের
নিকট এর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে কমোডোর ল্যাম্বার্টকে একটি রণতরীসহ ব্রহ্মদেশে প্রেরণ
করেন। ব্রহ্মরাজ যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই তিনি ইংরেজ কোম্পানিকে সন্তুষ্ট করার জন্য রেঙ্গুনের
গভর্নরকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু কমোডোর ল্যাম্বার্ট এতে সন্তুষ্ট না হয়ে ব্রহ্ম সরকারের একটি রণতরী দখল
করে নিলে ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে কোম্পানির বাহিনী মার্তামান ও বেসিন অধিকার করে। রেঙ্গুনের প্রসিদ্ধ
প্যাগোডার ওপর গোলাবর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয়। ঐ বৎসরের অক্টোবর মাসে জেনারেল গড্উইন প্রোম
ও অপরাপর কয়েকটি শহর অধিকার করে নেন। কোম্পানির সাথে ব্রহ্মরাজ সন্ধি করতে অস্বীকৃতি জানালে
ডালহৌসি সমগ্র পেগু অধিকার করে তা বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত বলে ঘোষণা করেন। এভাবে ব্রহ্মদেশের
উপক‚ল অঞ্চল বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ায় চট্টগ্রাম হতে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সমগ্র উপক‚ল অঞ্চল যেমন বৃটিশ
অধিকারভুক্ত হলো, তেমনি সমুদ্রপথের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার জন্যে ব্রহ্মদেশ বৃটিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে
পড়ল।
সিকিম রাজ্যের অংশবিশেষ অধিকার
কোম্পানির সাম্রাজ্যের উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে নেপাল ও ভুটানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল সিকিম রাজ্য।
সেখানে বিদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ডক্টর
ক্যাম্পবেল নামে জনৈক ইংরেজ কর্মচারী এবং ডক্টর হুকার নামে অপর একজন ইংরেজ উপস্থিত হলে
সিকিম রাজ্যের রাজা তাদের বন্দি করেন। এর প্রতিশোধ নিতে লর্ড ডালহৌসি ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সিকিম
আক্রমণ করে এই রাজ্যের একাংশ অধিকার করে নেন।
২. স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ দ্বারা রাজ্য অধিকার
বৃটিশ ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারে লর্ড ডালহৌসির অন্যতম প্রধান কৌশল ছিল স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ। ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রবর্তিত এই নীতির প্রয়োগের দ্বারা ডালহৌসি অনেক দেশীয় রাজ্য অধিকার করে
নিয়েছিলেন।এই নীতির মূল বক্তব্য হলো, বৃটিশের অধীন অথবা বৃটিশ-শক্তি কর্তৃক সৃষ্ট কোন দেশীয়
রাজ্যের রাজার কোন সন্তান অর্থাৎ কোন স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী না থাকলে সেই রাজ্য সরাসরি বৃটিশ
সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়বে। কোন দত্তকপুত্রকে এসব রাজ্যের উত্তরাধিকার দেওয়া যাবে না। বৃটিশ সরকার


থেকে ‘বিশেষ অনুমতি' নিয়ে দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার লর্ড ডালহৌসি অস্বীকার করেন। ঘটনাচক্রে এই
সময়ে একই সঙ্গে বহু ইংরেজ-আশ্রিত দেশীয় রাজ্যের রাজা নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে ডালহৌসির
পক্ষে স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগের অপূর্ব সুযোগ আসে। তিনি এই নীতির দ্বারা এসব রাজ্য অধিকার করে
নেন। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বত্ববিলোপ নীতি ডালহৌসি উদ্ভাবন করেননি। ডাইরেক্টর সভা ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে
কোম্পানির অধীনস্থ দেশীয় রাজ্যের রাজাগণকে দত্তকপুত্র গ্রহণের অনুমতি যাতে সহজে দেওয়া না হয় সে
নির্দেশ প্রদান করেছিল। ১৮৪১ খ্রি. আরো নির্দেশ দিয়েছিল যে, সম্মানজনক এবং ন্যায্য পন্থায় কোম্পানি
যে কোন সম্পত্তি বৃটিশ অধিকারভুক্ত করার চেষ্টায় যেন কোন ত্রুটি না করে। কাজেই কুখ্যাত ‘স্বত্ববিলোপ
নীতি' লর্ড ডালহৌসির নামের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বস্তুত এই নীতি তিনি উদ্ভাবন করেননি। পূর্ববর্তী
গভর্নর জেনারেলগণ এই নীতি প্রয়োগ করা সমীচীন মনে করেননি। কিন্তু লর্ড ডালহৌসি ভারতবাসীর
চিরাচরিত রীতিনীতি ও ন্যায্য অধিকার উপেক্ষা করে ‘স্বত্ববিলোপ নীতির' ব্যাপক প্রয়োগের দ্বারা এই
কুখ্যাত নীতির সঙ্গে নিজের নাম জড়িত করেছিলেন।
লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে নিæলিখিত দেশীয় রাজ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেনঃ
সাঁতারা ঃ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানিই সাতারা রাজ্যটি সৃষ্টি করেছিল। ঐ বৎসর পেশোয়া পদের বিলুপ্তি
ঘটলে শিবাজীর এক বংশধরকে পেশোয়া রাজ্যের একাংশে সাঁতারা রাজ্যের রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা
হয়। সাঁতারা রাজ্যের রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা যাবার পূর্বে বৃটিশের অনুমতি ছাড়া এক দত্তকপুত্র গ্রহণ
করেছিলেন। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজার মৃত্যু হলে কোম্পানি দত্তকপুত্রের উত্তরাধিকার অগ্রাহ্য করে এবং
সাঁতারা বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়।
নাগপুর ও সম্বলপুর ঃ ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরের রাজা অপুত্রক দত্তকবিহীন অবস্থায় মারা গেলে লর্ড
ডালহৌসি নাগপুর বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন। এখানে উল্লেখ্য, নাগপুর কোম্পানি কর্তৃক সৃষ্ট কিনা সে
ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও নিছক সামাজ্য বিস্তারের কারণেও রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সাঁতারা
রাজ্যের অনুরূপ নীতি প্রয়োগ করে নাগপুর বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়েছিল।
ঝাঁসি, ভগৎ, উদয়পুর ও করৌলি ঃ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ঝাঁসির রাজা অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে
দত্তকপুত্রের দাবি অস্বীকার করে ঝাঁসি বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। একই কারণে লর্ড ডালহৌসি ভগৎ,
উদয়পুর, করৌলি প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যগুলোকে বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নিয়েছিলেন। অবশ্য পরবর্তী গভর্নর
জেনারেল লর্ড ক্যানিং ভগৎ ও উদয়পুর রাজ্য দু'টি এদের উত্তরাধিকারীদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ডাইরেক্টর সভা করৌলি রাজ্যের ক্ষেত্রে স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে সেই রাজ্যটিও এর
উত্তরাধিকারীর নিকট ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। করৌলি ছিল বৃটিশের মিত্ররাজ্য।
কর্ণাটক, তাঞ্জোর অধিকার ও ধন্দুপস্থর বৃত্তি বাতিল ঃ একই নীতি অনুসরণ করে লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৩
খ্রি. কর্ণাটকের নবাবীর বিলোপ সাধন করেন এবং ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তাঞ্জোর রাজ্য অধিকার করেন। ১৮৫৩
খ্রি. বাজীরাও-এর দত্তকপুত্র ধন্দুপস্থ নানাসাহেবের বৃত্তি বন্ধ করে দেন।
৩. কুশাসন ও অরাজকতার অভিযোগে দেশীয় রাজ্য অধিকার
অযোধ্যা ঃ লর্ড ডালহৌসির রাজ্য বিস্তারের তৃতীয় নীতি ছিল কুশাসনের অভিযোগে দেশীয় রাজ্য গ্রাস।
এই নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করেন যে, রাজার বাস্তব ক্ষমতাহীন দায়িত্ব কোম্পানির ওপর
মানুষের বিশ্বাসকে নষ্ট করে দেবে। এই নীতির প্রথম প্রয়োগ হলো অযোধ্যায়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড
ডালহৌসি কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের নির্দেশে অযোধ্যা রাজ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। অযোধ্যায়
দুর্নীতি ও কুশাসন বহুদিন থেকে চলে আসছিল। কিন্তু এর জন্য সামগ্রিকভাবে লর্ড ওয়েলেসলির
‘অধীনতামূলক মিত্রতা' চুক্তি বহুলাংশে দায়ী। শাসনব্যবস্থায় নবাবের প্রকৃত অধিকার ছিল না। সুতরাং তাঁর


দায়িত্ববোধও দিন দিন কমে আসতে থাকে। এরূপ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ অবস্থার অধপতন অনিবার্য ছিল।
কিন্তু এর জন্য মূলত কোম্পানি দায়ী হলেও কোম্পানি রাজ্যটি গ্রাস করে। স্যার হেনরি লরেন্স কোম্পানির
এই কর্মকান্ডকে “জাতীয় বিশ্বাসের অমার্জনীয় লংঘন” বলে অভিহিত করেছেন।
বেরার অধিকার ঃ অতপর ডালহৌসি হায়দ্রাবাদের নিজামের প্রতি দৃষ্টি দেন।লর্ড ওয়েলেসলির
অধীনতামূলক চুক্তির দ্বারা নিজামকে তাঁর রাজ্যে নিজ খরচায় বৃটিশ সৈন্য রাখতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু
নিজাম এই অর্থ নিয়মিত প্রদান করতে অসমর্থ হলে বেরার রাজ্যটি লর্ড ডালহৌসি বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে
নেন।বেরার বোম্বাই প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। ফলে মাদ্রাজের সঙ্গে বোম্বাইয়ের স্থলপথে কোম্পানির
রাজ্য সংযুক্ত হয়।
লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির প্রতিক্রিয়া
লর্ড ডালহৌসি বৃটিশ শাসনের সুব্যবস্থায় চরম আস্থাবান ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, দেশীয় রাজ্যের
দুর্নীতি ও কুশাসন দূর করে যদি সর্বত্র বৃটিশ শাসন প্রবর্তন করা যায় তাহলে জনসাধারণের সুখ ও উন্নতি
বিধান সম্ভব হবে। এই বোধ থেকেই তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির উদ্ভব হলেও কার্যত তাঁর নীতি ভারতবর্ষে
চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ডালহৌসি ভারত ত্যাগ করেন। একবৎসর পরেই ভারতে
এক মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) আরম্ভ হয়। অনেক সমালোচক তাঁর অনুসৃত নীতিকেই এই বিদ্রোহের কারণ
বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর স্বত্ববিলোপ নীতি তথা দত্তকপুত্র গ্রহণে বাধাদানের নীতি দেশীয়
রাজন্যবর্গের মনে বৃটিশ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করেছিল। ঝাঁসির রাণী, ধন্দুপস্থ নানাসাহেব প্রমুখ ১৮৫৭
খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধে ও ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্য প্রেরণ
হিন্দু সিপাহীদের ধর্মীয় সংস্কারে আঘাত করেছিল। অযোধ্যার নবাবকে মসনদচ্যুত করা হলে অযোধ্যার
প্রায় ষাট হাজার সৈনিক বেকার হয়ে পড়ে। তাছাড়া নবাবের মসনদচ্যুতিতে সৈনিকদের জাতীয় চেতনাও
আহত হয়েছিল। অযোধ্যার সৈন্যগণ বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন অজুহাতে
লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি ভারতীয় রাজন্যবর্গকে বিশেষভাবে আশঙ্কিত করে তুলেছিল। তাঁরা
অনুভব করেছিলেন যে, বৃটিশ শক্তির প্রতি যতদূর সম্ভব আনুগত্য প্রদর্শন করা সত্তে¡ও তাঁদের রাজ্যগুলোর
বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবার প্রবল সম্ভাবনা রয়ে গেছে।তাঁরা লর্ড ডালহৌসির প্রত্যেকটি রাজনৈতিক
কার্যকলাপকে সন্দেহ করতে থাকেন। তৃতীয়ত, ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদ নীতি দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে
দারুন আতঙ্ক ও সন্দেহের সৃষ্টি করার ফলে জনসাধারণের মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল তা
সম্পূর্ণ না হলেও অংশত মহাবিদ্রোহের জন্য দায়ী।
লর্ড ডালহৌসির সংস্কারসমূহ
ভারতবর্ষের ইতিহাসে লর্ড ডালহৌসি একজন বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারকারী হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর সাম্রাজ্যবাদী
কার্যক্রমের ফলে তাঁর যৌক্তিক ও জনহিতকর সংস্কারগুলো সাম্রাজ্যবাদী কুখ্যাতির আড়ালে চাপা পড়ে
গেছে। বস্তুত, তিনি যেমন ছিলেন একজন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী তেমনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ শাসক ও
সংস্কারক। তিনি শাসনক্ষেত্রে নানা সংস্কার প্রবর্তন করে অনন্যসাধারণ কৃতিত্বের উদাহরণ স্থাপন
করেছিলেন। ঐতিহাসিক হান্টার মন্তব্য করেন যে, ওয়েলেসলির আমলের স্থানু ভারতবর্ষকে তিনি বর্তমান
যুগের প্রগতিশীল ভারতবর্ষে পরিণত করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, “শাসন ও অন্যান্য বিভাগে এমন
কোন ক্ষেত্র ছিল না যেখানে ডালহৌসি তাঁর ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখে যাননি।”
শাসন সংস্কার


বাংলার প্রশাসনিক দায়িত্ব তখন পর্যন্ত গভর্নর জেনারেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল। লর্ড ডালহৌসি গভর্নর
জেনারেলকে বাংলার শাসন পরিচালনার দায়িত্ব থেকে মুক্ত করেন। তাঁর সময়কাল থেকে বাংলার জন্য
একজন লেফটেনান্ট গভর্নর নিযুক্ত করেন। কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগ করার জন্য তাঁর সময়
থেকে সর্বপ্রথম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণ আরম্ভ হয়। এভাবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের ভিত্তি
স্থাপিত হয়। তাঁর শাসনকালীন সময়ে যেসব নতুন রাজ্য কোম্পানির অধিকারভুক্ত হয় সেগুলোর ওপর
কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। এই ব্যবস্থা ‘নন্-রেগুলেশন' ব্যবস্থা নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় নতুন
অধিকৃত অঞ্চলগুলো পরিচালনার জন্য কমিশনার পদ সৃষ্টি করা হয়। কমিশনারগণ প্রশাসনিক কাজ
পরিচালনার জন্য সরাসরি গভর্নর জেনারেলের নিকট দায়ী থাকতেন।
শিক্ষা সংস্কার
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে লর্ড ডালহৌসি অমর কীর্তির অধিকারী। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই
মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনস্থ বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত
সুপারিশ ভারত সরকারের নিকট প্রেরণ করেন। লর্ড ডালহৌসি স্যার চার্লস উডের শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশ
কার্যকরী করতে তৎপর হন। তাঁরই ঐকান্তিক চেষ্টায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক
কাজ শুরু হয়। প্রতিটি প্রেসিডেন্সিতে এবং পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের জন্য শিক্ষা অধিকর্তার (উ.চ.ও.)
পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ে ইংল্যান্ডের আদর্শে উচ্চ শিক্ষার জন্য
তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন তাঁর শাসন আমলের অন্যতম কীর্তি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপাতত কলেজ
ও উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষা গ্রহণ ও ডিগ্রি প্রদানের দায়িত্ব পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন-ইঞ্জিনিয়ারিং
বিভাগ খোলা হয়। এসঙ্গে সাহিত্য ও বিজ্ঞান গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়। উচ্চ বিদ্যালয়ে গ্রান্টস-ইন-এইড
নামক আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বিদ্যালয়সমূহে ইংরেজি, মাতৃভাষা ও সংস্কৃত বা
ফার্সি এই ত্রিভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
রেলপথ নির্মাণ
ডালহৌসিকে ভারতীয় রেলপথের জনক বলা হয়ে থাকে। ভারতে রেলপথ নির্মাণের জন্য তিনি তাঁর বিখ্যাত
‘রেলপথ স্মারকলিপি' রচনা করেন।এই স্মারকলিপিকে ভারতের ভবিষ্যতের ‘রেলপথ নির্মাণের নীল নকশা'
বলা হয়। তাঁর শাসনকালে রেল ব্যবস্থার অভ‚তপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই থেকে থানে
পর্যন্ত সর্বপ্রথম রেলপথ স্থাপিত হয়। পরের বৎসর কলিকাতা-রাণীগঞ্জ রেলপথ তৈরি হলে কলিকাতার
কারখানা ও পাটকলগুলোতে কয়লা পরিবহনের সুবিধা হয়। রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব লর্ড ডালহৌসি শাসন
কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত না করে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ওপর অর্পণ করেন। এর ফলে ভারতে বৃটিশ
মূলধন নিয়োগের পথ উন্মুক্ত হয়। উদ্যোক্তাদেরকে রেলের জন্য জমি কোম্পানি বিনামূল্যে অর্পণ করে।
রেলপথের দ্বারা ভারতের দূর-দূরান্ত সংযুক্ত হলে পরোক্ষভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের পথ প্রশস্ত
হয়।
সামরিক সংস্কার
ডালহৌসির শাসনামলে ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে পাঞ্জাব এবং সিন্ধুদেশ পর্যন্ত
বিস্তৃত হয়।এই বিস্তৃত সাম্রাজ্যের ওপর কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনীকে নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সর্বদা প্রস্তুত
অবস্থায় মোতায়েন রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই কারণে বাংলার গোলন্দাজ বাহিনীকে কলিকাতা
থেকে মীরাটে স্থানান্তরিত করা হয়। তিনি সৈন্যবাহিনীতে ভারতীয় সৈনিকদের আনুপাতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা
হ্রাস করতে সচেষ্ট হন এবং ইউরোপীয় সৈনিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে তৎপর হন। ডালহৌসি ইউরোপীয়
সৈন্যবাহিনীকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের মূলভিত্তি বলে উল্লেখ করেন। ডালহৌসি পাঞ্জাবের শাসনকর্তার অধীনে


একটি নতুন সৈন্যদল গঠন করেন। এই সৈন্যদলের শিক্ষা, নিয়মানুবর্তিতা এবং বেতনের হার ভারতীয়
সৈন্যবাহিনী থেকে পৃথক ধরনের করা হয়। তিনি গুর্খাদের নিয়ে একটি সৈন্যদল গঠন করেন। এবং এই
সৈন্যদলের সংখ্যা যাতে বৃদ্ধি পায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন। লর্ড ডালহৌসির দ্বারা সৃষ্ট পাঞ্জাব রেজিমেন্ট
ও গুর্খা রেজিমেন্ট ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ দমনে বৃটিশ শাসকদের অশেষ বীরত্বের সঙ্গে সহায়তা
করে এবং আনুগত্যে অবিচল থাকে।
বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার প্রবর্তন
লর্ড ডালহৌসিকে ভারতীয় তার বিভাগের জন্মদাতা বলে উল্লেখ করা যায়।তাঁর শাসনামলে বৈদ্যুতিক
টেলিগ্রাফ লাইনের দ্বারা কলিকাতাকে পেশোয়ার, বোম্বাই ও মাদ্রাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বৈদ্যুতিক
তারের দ্বারা সংবাদ আদান-প্রদান অতি সহজ সাধ্য হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থা যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে
প্রকৃতই বিপ্লব সৃষ্টি করে। ১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সময়কালে বৈদ্যুতিক তারে দ্রুত সংবাদ
প্রেরণে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ বিশেষ সুবিধা লাভ করে। এই কারণে বিদ্রোহে যোগদানের জন্য প্রাণদন্ড প্রদানকালে
সিপাহীগণ চিৎকার করে বৈদ্যুতিক তারকে অভিসম্পাত দেয় এবং বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ বলে উল্লেখ
করে।
ডাক বিভাগের সংস্কার
আধুনিককালের ডাক বিভাগের প্রবর্তন লর্ড ডালহৌসির অপর এক কীর্তি। তিনি ডাক চলাচল ব্যবস্থা
সুসংহত করবার জন্য ডাইরেক্টর জেনারেল-এর পদ সৃষ্টি করেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত
পত্র প্রেরণের জন্য দু-পয়সার ডাক টিকেট প্রবর্তন করেন। ডাক ব্যবস্থা সুসংবদ্ধ হবার ফলে সরকারি
রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
পূর্ত বিভাগের উন্নতি সাধন
লর্ড ডালহৌসি পূর্ত বিভাগকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। এই বিভাগকে তিনি খাল খনন, রাস্তা ও সেতু
নির্মাণের দায়িত্ব অর্পণ করেন। পূর্ত বিভাগের এসব কাজের জন্য বিরাট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেন। তিনি
গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সংস্কার সাধন করেন এবং বহু রাস্তা তৈরি করে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ
করেন। তাঁর শাসনকালে বহুসংখ্যক খাল খনন করা হয়। মোট ব্যয় হয় চৌদ্দ লক্ষ পাউন্ড। তন্মধ্যে লর্ড
ডালহৌসির আমলে ব্যয় হয় বার লক্ষ ত্রিশ হাজার পাউন্ড। এই খালগুলো দ্বিমুখী দায়িত্ব পালন করে।
খালগুলোর সাহায্যে একদিকে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর হয়, অপরদিকে কৃষিক্ষেত্রে সেচের পানি
সরবরাহের ব্যবস্থা হয়।
বাণিজ্যিক সংস্কার
ডালহৌসির সংস্কারসমূহের মধ্যে বাণিজ্যিক সংস্কার উল্লেখযোগ্য।তিনি অবাধ বাণিজ্যের নীতি অনুসরণ
করে ভারতের বন্দরগুলো বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।এসঙ্গে কলিকাতা, বোম্বাই, করাচী প্রভৃতি
বন্দরের উন্নতি সাধন করেন এবং বন্দরগুলোতে যাতে সহজে সমুদ্রগামী জাহাজ আসতে পারে তার জন্য
বহুসংখ্যক বাতিঘর বা লাইট হাউজ নির্মাণ করেন। ভারত থেকে তুলা, পাট, শন, চা প্রভৃতি পণ্য বিপুল
পরিমাণে রপ্তানির ব্যবস্থা করেন। ভারতীয় তুলা, পাট, শন প্রভৃতি সস্তা কাঁচামাল ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কশায়ার ও


মানচেষ্টারের কারখানাগুলোতে ব্যবহৃত হয়।এসব কারখানাজাত উৎপন্ন দ্রব্য ভারতে উচ্চমূল্যে অবাধে
বিক্রয় করে ইংল্যান্ডের শিল্পপতিরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে।
সামাজিক সংস্কার
লর্ড ডালহৌসি সামাজিক ক্ষেত্রে বিবিধ সংস্কার করেন। ধর্মান্তরিত হবার অপরাধে হিন্দুদের সম্পত্তি থেকে
বঞ্চিত হওয়ার ব্যবস্থা তিনি রদ করেন।বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় তাঁর শাসনকালে হিন্দু বিধবাদের
পুনর্বিবাহের আইন প্রবর্তিত হয়।


সারসংক্ষেপ
লর্ড ডালহৌসি ছিলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গভর্নর জেনারেল। তিনি ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী। তাই
তিনি যে কোন প্রকারে সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষ যুদ্ধের দ্বারা পাঞ্জাব,
পেগু সহ ব্রহ্মদেশের উপক‚ল অঞ্চল এবং সিকিম রাজ্যের একাংশ বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। কুখ্যাত
স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে সাঁতারা, নাগপুর, সম্বলপুর, ঝাঁসি, ভগৎ, উদয়পুর, করৌলি এবং
কুশাসন ও অরাজকতার অভিযোগে অযোধ্যা, অধীনতামূলক মিত্রতার শর্তানুযায়ী হায়দ্রাবাদের নিজাম
অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হলে বেরার বৃটিশ অধিকারভুক্ত করে নেন।তবে তিনি সাম্রাজ্যবাদী হলেও শাসনক্ষেত্রে
বহুবিধ সংস্কার সাধন করে ভারতবর্ষে আধুনিক যুগের সূচনা করেছিলেন। তিনি নতুন অধিকৃত অঞ্চল
শাসনের জন্য কমিশনার-এর পদ সৃষ্টি, সিভিল সার্ভিসের ভিত্তি স্থাপন ও ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা
প্রসারের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি এবং কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ
করেন।এছাড়া তিনি রেলপথ নির্মাণ, বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার প্রবর্তন, ডাক বিভাগ ও পূর্ত
বিভাগের উন্নতি সাধন, বাণিজ্যিক, সামাজিক ও সামরিক সংস্কার সাধন করেন। তাই শাসক ও
সংস্কারক হিসেবে লর্ড ডালহৌসি কৃতিত্বের দাবিদার।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১. অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস (মুঘল ও ব্রিটিশ ভারত), দ্বিতীয় খন্ড।
২. এ.কে.এম. আবদুল আলীম, ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস।
৩. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (১২০০-১৮৫৭ খ্রি.)
৪. ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। চিলায়ানওয়ালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়Ñ
(ক) ১৮১৯ খ্রি. (খ) ১৮২৯ খ্রি.
(গ) ১৮৩৯ খ্রি. (ঘ) ১৮৪৯ খ্রি.।
২। ঝাঁসি রাজ্যটি বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়Ñ
(ক) ১৮৪০ খ্রি. (খ) ১৮৫০ খ্রি.
(গ) ১৮৫২ খ্রি. (ঘ) ১৮৬০ খ্রি.।
৩। উচ্চশিক্ষার জন্যডালহৌসি কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেনÑ
(ক) ৩টি (খ) ৫টি
(গ) ৬টি (ঘ) ৭টি।


সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন।
২। দ্বিতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের ঘটনাবলী সংক্ষেপে বর্ণনা করুন।
৩। স্বত্ববিলোপ নীতির প্রবর্তক কে? এই নীতির বিষয়বস্তু কি?
৪। লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা দিন।
৫। লর্ড ডালহৌসির শিক্ষা সংস্কারের বর্ণনা দিন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। লর্ড ডালহৌসির আমলে ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস বিবৃত করুন।
২। লর্ড ডালহৌসি কর্তৃক প্রবর্তিত সংস্কারগুলো পর্যালোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]