ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন


ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন
১৭৫৭ খ্রি. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাংলার নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের পর থেকে আস্তে
আস্তে বাংলার অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব পড়তে থাকে। প্রতিটি
ক্ষেত্রে কোম্পানি হস্তক্ষেপ করে বা নতুন নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ফলে অনেকক্ষেত্রেই এদেশের বিভিন্ন
শ্রেণীর অধিবাসীরা এতোদিন ধরে যেসব অধিকার বা সুযোগ পেয়ে আসছিল, তাতে আঘাত আসে।
এসবের বিরুদ্ধেই তারা গড়ে তোলে বিভিন্ন আন্দোলন বা বিদ্রোহ।
ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ ছিল বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়
অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ। ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রি.Ñ এই দীর্ঘ সময় ধরে চলে ফকিরসন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ।
এই ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিলেন বাংলারই অধিবাসী। ফকিরেরা ছিলেন সুফি সম্প্রদায়ের মাদারিয়া শ্রেণীভুক্ত।
আর সন্ন্যাসীরা ছিলেন বৈদান্তিক হিন্দু যোগী। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা মুঘল সাম্রাজ্যের সৈন্যদল
থেকে বাদ পড়া সদস্য, আবার অনেকে ছিলেন ভ‚মিহীন কৃষক। তবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, এই
ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিলেন এদেশেরই স্থায়ী অধিবাসী। ধর্মীয় দিক থেকে ফকির-সন্ন্যাসীদের মধ্যে পার্থক্য
থাকলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ফকির-সন্ন্যাসীদের মধ্যে মিলনের
সাধারণ ক্ষেত্র তৈরি করে এবং তারা একই পতাকাতলে সমবেত হন।
বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল এবং এটি ছিল সে সময়কার বাংলায়
কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া। অনেক
ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কোম্পানি কর্তৃক লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি ফকিরসন্ন্যাসীদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে বাংলায় কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ফকির ও
সন্ন্যাসীদের কার্যকলাপ ছিল মুক্ত ও স্বাধীন। তবে কোম্পানি শাসনের শুরু থেকেই তাদের স্বাধীন গতিবিধি
বাধা পায়। তারা বাধা পেতে থাকে বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে। ধর্মস্থান বা তীর্থস্থান পর্যটন
ভারতবর্ষের একটি অতি প্রাচীন সামাজিক ও আত্মিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ফকিরেরা যেমন
বাংলার বিভিন্ন দরগা বা মাজার জিয়ারত করতেন, তেমনি সন্ন্যাসীরাও পূণ্যকর্ম করার অভিলাষে বাংলার
বিভিন্ন তীর্থস্থানগুলোতে ঘুরে বেড়াতেন। কোম্পানির স্থানীয় প্রশাসন প্রথমে ফকির-সন্ন্যাসীদের তীর্থযাত্রায়



বাধা দেয় এবং পরে আইন করে এই নিষেধাজ্ঞাকে দৃঢ় করা হয়। সামাজিক ও আত্মিক অধিকার হরণের
পাশাপাশি ফকির-সন্ন্যাসীদের অর্থনৈতিক অধিকার হরণের অভিযোগও এর সাথে সংযোজিত হয়।
কোম্পানি শাসনপ্রসূত অর্থনৈতিক দূরবস্থার কারণে ফকির-সন্ন্যাসীরা বঞ্চিত হন তাদের চিরাচরিত ভিক্ষা
সংগ্রহের অধিকার হতে। নি¤œশ্রেণীর রায়তদের অবলুপ্তির ফলে ফকির-সন্ন্যাসীদের দাবী অগ্রাহ্য হয় এবং
তারা জমিদারদের বাড়ি, কাছারি ও কোম্পানির কুঠি আক্রমণ করেন।
ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রাথমিক প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত হয়। ১৭৬৩ থেকে
১৮০০ খ্রি. পর্যন্ত চলতে থাকা তাদের এই সশস্ত্র আন্দোলন ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর,
ময়মনসিংহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভ‚ম, মালদহ ও পূর্ণিয়া জেলায় সম্প্রসারিত হয়েছিল। ফকির-সন্ন্যাসীদের
আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও নায়েব-গোমস্তাদের বাড়ি।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দেশীয় সহযোগীদেরকেও ফকির-সন্ন্যাসীরা শত্রু হিসেবে মনে করেন এবং
তাদের ওপর আক্রমণাত্মক তৎপরতা পরিচালনা করেন। এছাড়া কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের সহযোগী
দেশীয় বেনিয়াদের নৌকা আক্রমণ, সৈন্যবাহিনীর রসদ পরিবহন বন্ধ করা এবং যোগাযোগে বিঘœ সৃষ্টি
করাÑ এগুলোও ছিল কোম্পানির বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের গৃহীত ব্যবস্থা।ফকির-সন্ন্যাসীরা অস্ত্র হিসেবে
বর্শা, তরবারি ও গাদা বন্দুক ব্যবহার করতেন। মূলত নেতৃস্থানীয়রা ব্যবহার করতেন ঘোড়া। ফকিরদের
নেতা ছিলেন মজনু শাহ। পরবর্তী সময়ে তার উত্তরাধিকারীরা ছিলেন মুসা শাহ, পরাগল শাহ, চেরাগ আলী
শাহ, সোবাহান শাহ, মাদার বক্স, জরি শাহ, করিম শাহ প্রমুখ। সন্ন্যাসীদের নেতা ছিলেন ভবানী পাঠক।
১৭৬৩ খ্রি. সর্বপ্রথম বাকেরগঞ্জে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কুঠি ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণের
লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় এবং সন্ন্যাসীরা সেখানকার ফ্যাক্টরি প্রধান কেলিকে ঘেরাও করে রাখেন। ঐ বছরই
ফকিরেরা ঢাকা ফ্যাক্টরি আক্রমণ করেন; আক্রমণের তীব্রতা দেখে এই ফ্যাক্টরির প্রধান লেস্টার কর্মস্থল
ত্যাগ করে পালিয়ে যান।পরে অবশ্য ক্যাপ্টেন গ্রান্ট ফ্যাক্টরিটি পুনরুদ্ধার করেন। সন্ন্যাসীরা ১৭৬৩
খ্রিস্টাব্দেই রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ায় কোম্পানির কুঠি আক্রমণ করেন। ১৭৬৯ খ্রি. উত্তরবঙ্গে ফকিরসন্ন্যাসীদের তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য ক্যাপ্টেন ডি. ম্যাকেনজিকে একদল সৈন্যসহ রংপুরে পাঠানো
হয়। ১৭৭০ খ্রি. বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের (যা ছিয়াত্তরের মন¦ন্তর হিসেবে পরিচিত) সময় ও মন¦ন্তর পরবর্তী
সময়ে ফকির-সন্ন্যাসীদের আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ায় এই
আন্দোলনের তীব্রতা লক্ষ্য করা যায়। ১৭৭২ খ্রি. রাজশাহী জেলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতার প্রচন্ডতা
দেখা যায়। ঐ বছরই রংপুরে সন্ন্যাসীদের হাতে নিহত হন রংপুরের সুপারভাইজার পালিং। ১৭৭৬ খ্রি.
আবার উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুরে ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। ১৭৮২
খ্রিস্টাব্দের দিকে ময়মনসিংহের আলাপসিংহ পরগণায় এদের তৎপরতা তীব্র আকার ধারণ করে। ১৭৮৫
খ্রিস্টাব্দের দিকে মজনু শাহ মহাস্থানগড়ের দিকে অগ্রসর হন। ১৭৮৬ খ্রি. মজনু শাহের সাথে কোম্পানির
সৈন্যদলের পরপর দু'টি সংঘর্ষ ঘটে। এ সময়ের সংঘর্ষে মজনু শাহ তাঁর বহুসংখ্যক অনুসারীকে হারান।
১৭৮৭ খ্রি. মজনু শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য উত্তরসূরীরা পুরো আঠারো শতক
পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তবে আস্তে আস্তে এর গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। কোম্পানির
উন্নততর রণকৌশল, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সামরিক প্রযুক্তির কাছে ফকির-সন্ন্যাসীদের পরাজয় ছিল
অনিবার্য। অন্যদিকে যথোপযুক্ত ও শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের অভাব শেষ পর্যন্ত ফকিরসন্ন্যাসীদের পরাজয় এবং বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]