ফরায়েজি আন্দোলন


ফরায়েজি আন্দোলন
আঠারো শতকের শেষভাগে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়কে একটি সুসংহত শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে
প্রয়াসী হন ফরায়েজি নেতৃবৃন্দ। ফরায়েজি আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, কিন্তু এটি
সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের চরিত্র লাভ করে।


ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। তিনি ১৭৮১ খ্রি. বর্তমান বৃহত্তর ফরিদপুরের
মাদারীপুর জেলার শামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কলিকাতা ও হুগলীতে প্রাথমিক পড়াশোনার পর তিনি
আঠারো বছর বয়সে মক্কায় যান। সেখানে থাকাকালে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ ও আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট
হন। প্রায় কুড়ি বছর সেখানে অবস্থানের পর তিনি দেশে ফিরে ধর্ম সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
আদর্শগত দিক দিয়ে ফরায়েজি ও ওয়াহাবিদের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য দেখা যায় না। বরং বলা যায়,
ওয়াহাবি আন্দোলনেরই আরেকটি ধারা ফরায়েজি আন্দোলন। হাজী শরীয়তউল্লাহ বিশ্বাস করতেন, বিদেশী
বিধর্মীদের রাজত্বে ইসলামি জীবনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে না। এটি সম্ভব কেবলমাত্র ইসলামি রাষ্ট্রে।
ভারতবর্ষ যেহেতু বিদেশী বিধর্মী ইংরেজ জাতির শাসনাধীন, সে কারণে এই দেশটি ‘দারুল হারব'। শত্রু
শাসিত দেশে যেসব মুসলমান বসবাস করে তাদের পক্ষে নির্বিঘেœ ধর্মীয় রীতিনীতি ও অনুশাসনসমূহ
যথার্থভাবে পালন করা সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি স্বদেশের মুসলমানদের জুম'আ ও ঈদের নামাজ না
পড়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি পীর পূজা, পীরের দরগায় ওরস, মানত ও মহররম পালনের ঘোর
বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, এগুলো ইসলামের মূল বিধানের পরিপন্থী। ফরায়েজ আরবি শব্দ, এর অর্থ
অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ। পবিত্র কুরআনে যে পাঁচটি অবশ্য পালনীয় (ফরজ) মৌলনীতির কথা বলা
হয়েছে তা যথার্থভাবে পালনের ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এই পাঁচটি ফরজ হলোÑ ঈমান
বা আল্লাহ্র একাত্ম ও রিসালাত, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব ও যাকাত।
হাজী শরীয়তউল্লাহ ইসলামি সাম্যবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘোষণা করেন, সকল মুসলমান ভাই ভাই, অতএব
মুসলিম সমাজে অসাম্য ও বর্ণ বা শ্রেণীভেদের কোন স্থান নেই। এই মতাদর্শের ভিত্তিতে তিনি মুসলমান
সমাজে বিদ্যমান উচ্চ ও নিæ শ্রেণী অর্থাৎ আশরাফ ও আতরাফ-এর শ্রেণী বৈষম্য দূর করার চেষ্টা চালান।
তাই স্বাভাবিকভাবেই শোষিত আতরাফ মুসলমান পেশাজীবীর লোকেরা শরীয়তউল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হন।
দরিদ্র মুসলমান কৃষক, রায়ত, তাঁতি, জোলা সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর সাথে যোগ দেয়ায় ফরায়েজিদের
সংখ্যা বেড়ে যায়। অত্যাচারী নীলকর ও জমিদারদের উৎপীড়ন থেকে মুক্তি লাভের আশায় এই
আতরাফেরা হাজী শরীয়তউল্লাহর মধ্যে তাদের নেতাকে খুঁজে পেল। তাঁর মতবাদ পূর্ব বাংলায় ব্যাপক
সাড়া জাগায়। তিনি জমিদার ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকে প্রজাদের রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট
ছিলেন। অপরদিকে নির্যাতিত মুসলমানেরা একজন সুশিক্ষিত ধর্মনেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে দেখে
স্থানীয় জমিদারগণ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। মুসলমান রায়তদের ওপর জমিদারদের অত্যাচারের মাত্রা প্রবলভাবে
বৃদ্ধি পেতে থাকে। অপরদিকে শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ফরায়েজিদের প্রতিরোধ আন্দোলনও জোরদার হতে
থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শোষক শ্রেণীর প্রবল আক্রমণের মুখে ফরায়েজি আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত
হয়। ১৮৪০ খ্রি. হাজী শরীয়তউল্লাহ মারা যান।
আঠারো শতকের শেষ দিকে যেসব আন্দোলন বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বিপুলভাবে প্রভাব
বিস্তার করেছিল, ফরায়েজি আন্দোলন তন্মধ্যে অন্যতম। এটি ছিল মূলত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, কিন্তু
ঐতিহাসিক ঘটনাচক্রে ফরায়েজি আন্দোলন একটি রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নেয়। নীলকর ও
জমিদারদের অত্যাচারে মুসলমান শোষিত সম্প্রদায় যখন জর্জরিত, তখন এই সম্প্রদায়কে সংঘবদ্ধ ও
সুসংহত শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হাজী শরীয়তউল্লাহ এগিয়ে আসেন।
হাজী শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহাম্মদ মহসিন উদ্দিন আহমদ ওরফে দুদু মিয়া ফরায়েজি
আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৮১৯ খ্রি. দুদু মিয়ার জন্ম। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি পিতার কাছে কুরআন
ও হাদিস শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করেন। অপেক্ষাকৃত কম বয়সেই তিনি হজ্জ্ব করতে মক্কা যান এবং সেখানে
ওয়াহাবি ভাবধারার সংস্পর্শে আসেন। দেশে ফিরে তিনি পিতার মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। তবে তাঁর
সাংগঠনিক শক্তি ছিল অসাধারণ। এই কারণে তিনি অল্পদিনের মধ্যেই মুসলিম সমাজে নিজের প্রভাব বিস্তার
করতে সক্ষম হন।


দুদু মিয়ার নেতৃত্বেই ফরায়েজি আন্দোলন অনেক বেশি শক্তিশালী রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের চরিত্র
লাভ করে। পিতার মত তিনি কেবল ধর্মীয় সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেননি, বরং তিনি সমাজের নৈতিক
ও সামাজিক ব্যাধিসমূহ নির্মূল করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, সমাজের সকল
মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং দরিদ্রদেরকে শোষণ ও নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। তবে
কেবল মুক্তির বাণী প্রচারের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করা যায় না, তা করতে হলে আন্দোলন এমনকি প্রতিরোধ
সংগ্রামের পথে অগ্রসর হতে হবে।
দুদু মিয়া মনে করতেন, বিশ্বের মালিক ও প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ্। সুতরাং ভ‚সম্পত্তিসহ সকল প্রকার
পার্থিব সম্পত্তি ও সম্পদের মালিকও আল্লাহ্। তাই কর বা খাজনা যদি দিতে হয়, তবে তা আল্লাহ্র পথে
দিতে হবে, কোন ব্যক্তিকে নয়। সে সময়কার জমিদারেরা রায়তদের ওপর যে সমস্ত খাজনা ও কর আরোপ
করেছিল, দুদু মিয়া সেগুলোকে বেআইনি ও নীতি-বিরুদ্ধ বলে ঘোষণা দেন।
নিপীড়িত রায়ত ও চাষীদেরকে জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য দুদু মিয়া বাংলার
পুরনো ঐতিহ্যবাহী সংগঠন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি সাম্য ও ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে
সব ধরনের ঝগড়া-বিবাদ ও মামলা-মোকাদ্দমা সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করেন।
একজন সুদক্ষ সংগঠক হিসেবেও দুদু মিয়া কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ফরায়েজি আন্দোলনকে শক্তিশালী
করার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন তিনি। দুদু মিয়া ফরায়েজি সমাজ ব্যবস্থায় সুবিন্যস্ত
একটি খিলাফত পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ববঙ্গকে তিনি কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন এবং প্রতিটি অঞ্চলে
তাঁর প্রতিনিধি স্বরূপ একজন খলিফা নিযুক্ত করেন।আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা নিজ এলাকার ফরায়েজি
মতাবলম্বীদের ঐক্যবদ্ধ রাখা, তাদের ওপর যেকোন প্রকার অত্যাচার প্রতিহত করা ছাড়াও আন্দোলন
পরিচালনার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে তহবিল গঠন করতেন।
দুদু মিঞা ইংরেজ প্রশাসনের সাহায্যপুষ্ট জমিদার, জোতদার ও নীলকরদের নিযুক্ত ভাড়াটিয়া লাঠিয়ালদের
মোকাবিলায় ফরায়েজি লাঠিয়াল বাহিনীও প্রবর্তন করেন। প্রত্যেক ফরায়েজি গ্রাম থেকে বলিষ্ঠ জোয়ানদের
বাছাই করে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এই লাঠিয়াল বাহিনীর সাহায্যে দুদু মিয়া ১৮৪০ থেকে ১৮৪৮
খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফরিদপুরের রায়ত ও চাষীদেরকে স্থানীয় জমিদার ও নীলকরদের হয়রানি থেকে বিরত
রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৫৭ খ্রি. সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকার দুদু মিয়াকে রাজনৈতিক
বন্দি হিসেবে কারাগারে আটক করে। ১৮৬২ খ্রি. (মতান্তরে ১৮৬০ খ্রি.) তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর
এই আন্দোলন অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের সাথে বিলীন হয়ে যায়। বাংলার সামাজিকরাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুদু মিয়া যে অবদান রেখেছেন তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রধান
নেতা হয়েও তিনি নির্যাতিতদের দুর্দশা দূর করতে এগিয়ে আসেন।আর এর জন্য তিনি প্রতিরোধ
আন্দোলনের পথ গ্রহণ করেছিলেন।
সারসংক্ষেপ
বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের সহযোগী নীলকরদের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের
আন্দোলন এ অঞ্চলে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ আন্দোলন। এছাড়া
আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া হাজী শরীয়তউল্লাহ ও পরবর্তী সময়ে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে
ফরায়েজি আন্দোলন মূলত একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এটি প্রতিরোধ এবং
সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের চরিত্র লাভ করে।


সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১। সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদক), বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪Ñ১৯৭১, প্রথম খন্ড, ঢাকা, ১৯৯৩।
২। সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, কলিকাতা, ১৯৯০।
৩। আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (১২০০Ñ১৮৫৭ খ্রি.), ঢাকা, ১৯৯২।
৪। সৈয়দ মকসুদ আলী, রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তায় উপমহাদেশ, ঢাকা, ১৯৯২।
৫। ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঢাকা, ১৯৮৭।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। ফকির আন্দোলনের নেতা কে ছিলেন?
(ক) হাজি শরীয়তউল্লাহ (খ) দুদু মিয়া
(গ) মজনু শাহ (ঘ) তিতুমীর।
২। সন্ন্যাসী আন্দোলনের অন্যতম নেতা কে ছিলেন?
(ক) ভবানী পাঠক (খ) দেবী চৌধুরাণী
(গ) রাজ বল্লভ (ঘ) মজনু শাহ।
৩। ফকিরেরা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন?
(ক) মাদারিয়া (খ) ওয়াহাবি
(গ) বেদান্ত (ঘ) তবলীগ।
৪। ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা কে ছিলেন?
(ক) তিতুমীর (খ) দুদু মিয়া
(গ) সৈয়দ আহমদ বেরেলভি (ঘ) হাজী শরীয়তউল্লাহ।
৫। হাজি শরীয়তউল্লাহ কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
(ক) মাদারীপুর (খ) খুলনা
(গ) ময়মনসিংহ (ঘ) হুগলি।
৬। দুদু মিয়ার প্রতিনিধিদের কি বলা হতো?
(ক) সুলতান (খ) খলিফা
(গ) মাতবর (ঘ) মোড়ল।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের আন্দোলনের কারণ কি ছিল?
২। ফকিরদের আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
৩। ফরায়েজি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি ছিল?
৪। দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনকে সংগঠিত করতে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন?
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের বর্ণনা দিন।
২। ফরায়েজি আন্দোলনের বর্ণনা দিন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]