নীল বিদ্রোহ


বাংলার কৃষকেরা ১৮৫৯Ñ৬২ খ্রি. ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটন করে।
তারা সকলে একতাবদ্ধ হয়ে নীল চাষ বর্জন করার আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে
কৃষকেরা সাফল্যের সাথে ইংরেজদের নীলভিত্তিক অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছিল। এই বিদ্রোহের ফলে নীল
শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাংলার নীলকরেরা তাদের কুঠি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব দ্রুতগতিতে বিকাশ লাভ করতে থাকলে ইংল্যান্ডের
শিল্পোৎপাদনের জন্য সুলভে কাঁচামালের সরবরাহ আর পণ্য বাজারজাতকরণের সমস্যা তীব্র আকার ধারণ
করে। ইংল্যান্ড এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের উপনিবেশ ভারতবর্ষকে।
ভারতবর্ষ শিল্পোন্নত ইংল্যান্ডের কাঁচামালের সরবরাহস্থল ও পণ্য বিক্রির বাজার হিসেবে অসাধারণ গুরুত্ব
লাভ করে। এই সময়েই ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পের বিস্ময়কর অগ্রগতির সাথে সাথে বস্ত্র রং করার জন্য নীলের
চাহিদা বেড়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডে নীল সরবরাহ করে বিপুল মুনাফা অর্জনের পথ হিসেবে
বাংলায় নীলের ব্যবসা আরো সম্প্রসারিত করার আয়োজন করে। কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে
বাণিজ্যিকভাবে নীল চাষের সূচনা হয় এ সময়ে। নীল চাষের একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল এদেশে কোম্পানির
অর্জিত টাকা ইউরোপে পাঠানো। নগদ টাকার বদলে এদেশে উৎপন্ন বাণিজ্যিক পণ্য ও কাঁচামাল রপ্তানির
মাধ্যমে অর্থ পাঠানো ছিল বেশি লাভজনক ও বাস্তবসম্মত। এভাবেই কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপীয়
নীলকরেরা এখানে নীল চাষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কলিকাতার বিভিন্ন এজেন্সি হাউজ নীল উৎপাদন ও
এর রপ্তানি বাণিজ্যে পুঁজি সরবরাহ করে।
১৮৫৯ খ্রি. বাংলায় নীল খামারের সংখ্যা ছিল ১৪৩। প্রায় পাঁচশ নীলকর এসব খামার নিয়ন্ত্রণ করতো।
বাংলার মোট নীল উৎপাদনের অর্ধেক আসতো দু'টো জেলাÑ নদীয়া ও যশোর থেকে। এই দুই জেলার প্রায়
অর্ধেক কৃষি জমি নিয়ন্ত্রণ করতো নীলকরেরা। নীল চাষীরা বেশিরভাগই ছিল সাধারণ কৃষক। এই কৃষক
রায়তরা জমিতে যে কোন ধরনের ফসল ফলানোর অধিকার রাখতো। ভ‚স্বামীর নির্দেশে বিশেষ কোন ফসল
ফলাতে তারা বাধ্য ছিল না। অর্থনৈতিক কারণেই রায়তেরা প্রথমে নীল চাষ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু পরে
যখন দেখা গেল নীল চাষ অপেক্ষাকৃত কম লাভজনক, তখন এই রায়তেরা নীলচাষে অনীহা দেখাতে শুরু
করে। এবার নীলকরেরা তাদের নীল চাষের জন্য বাধ্য করে। প্রাথমিক পর্যায়ে রায়তেরা নীল চাষে আকৃষ্ট
হয়েছিল দাদন বা আগাম দেওয়ার ব্যবস্থার কারণে। নীলকর রায়ত কৃষককে আগাম অর্থ দিতো। খাজনা
শোধ করা, বীজ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও গবাদি পশু কেনার কাজে ব্যবহার করা হতো এই আগাম টাকা।
রায়তদের হাতে নগদ টাকা ছিল না। তারা নগদ টাকার প্রয়োজনে এই আগাম গ্রহণ করতো। কিন্তু নীল



চাষ করে তাদের লাভ কিছুই হতো না। একবিঘা জমিতে নীল উৎপাদন করতে খরচ হতো দুই থেকে তিন
টাকা, আবার ঐ পরিমাণ জমিতে আয়ও হতো দুই থেকে তিন টাকা। তাই পরবর্তী সময়ে এই নীল চাষীরা
আর নীল চাষে আগ্রহ দেখাতো না। কিন্তু দাদন বা আগামের টোপ যারা একবার গ্রহণ করেছিলো, তাদের
পক্ষে আর এর বেড়াজাল থেকে বের হওয়া সম্ভব হতো না। হিসেবের হেরফেরে এই ঋণ তার পরিবারে
বংশানুক্রমিক হয়ে পড়তো। ছেলেকে উত্তরাধিকারসূত্রে বাবার দাদনের হিসেব টানতে হতো। অনেক সময়
নীলকরেরা সাদা স্ট্যাম্প কাগজে রায়তের সই নিতো, শর্তগুলো পরে পূরণ করে নেওয়া হতো। আবার
অনেক ক্ষেত্রে শর্ত লেখা থাকলেও নীলের জমির সীমানা তাতে উল্লেখ করা হতো না। এতে করে
নীলকরেরা যে কোন ভাল দামি বা ধানের জমি নীল চাষের জন্য চিহ্নিত করতে পারতো। আগাম চুক্তির
শর্তানুযায়ী নীল চাষ করতে ব্যর্থ হলে নীলকর আগাম গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারতো।
এমনি অবস্থায় রায়তেরা অনিচ্ছা সত্তে¡ও নীল চাষ করতে বাধ্য হতো। নীলচাষ করতে গিয়ে তারা ধান বা
খাদ্য শস্য উৎপাদনে সময় দিতে পারতো না, আবার অনেক সময় ধানের জমিতে বাধ্য হয়ে নীল চাষ
করতে হতো। নীল চাষে অর্থনৈতিকভাবে লাভ তো ছিলই না, এরপরও ছিল কুঠির কর্মচারীদের ঘুষ দেয়ার
বিড়ম্বনা। আর কোন রায়ত যদি নীলচাষ ছেড়ে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করতো, তাহলে তার ওপর শারীরিক
নির্যাতন করা হতো বা আদালতে মামলা করে হয়রানি করা হতো। নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের অভিযোগ
ছিল অসংখ্য। এর মধ্যে রয়েছে দেশীয় লোকদের খুন, জখম, গুম, দুগামে আটকে রাখা, কৃষকদের ঘরে
আগুন দেওয়া বা লুটপাট করা, নীলচাষে বাধ্য করার জন্য রায়তদের আটকে রাখা, লাঠিয়াল দিয়ে গ্রাম
আক্রমণ করা প্রভৃতি। নীলকরদের বিরুদ্ধে এসব নানা অভিযোগের মধ্যে আরেকটি ছিল কৃষক কন্যা ও
বধুদের অবমাননা, অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ। কিন্তু এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা সত্তে¡ও
ইংরেজ নীলকরদের কোন বিচার হতো না বা বিচার হলেও শুধু জরিমানা করা হতো। জেলে আটক করার
রায় দেয়ার ক্ষমতা মফস্বলের ম্যাজিস্ট্রেটের ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের সে ক্ষমতা থাকলেও এবং দু'একটি
মামলায় ইংরেজরা অভিযুক্ত হলেও প্রভাব খাটিয়ে তারা খালাস পেয়ে যেতো।
নীল চাষীদের অসহায় অবস্থা ও তাদের প্রতি অবিচারের সুযোগ করে দিয়েছিলো ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের চতুর্থ
আইন। এই আইনে যে কোন ব্রিটিশ প্রজা স্থায়ীভাবে ও যে কোন মেয়াদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে কোন
অঞ্চলে জমির মালিক হতে পারতো। তখন থেকে নীলকরেরা জমিদারী কিনে তাদের জমি বৃদ্ধি করতে
থাকে। ১৮৫৯-৬০ খ্রি. জিনিসপত্রের দাম পূর্ববর্তী কয়েক বছরের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ বেড়ে গেলেও
নীলের দাম বাড়েনি। বছরের পর বছর নীল চাষ করেও রায়তদের দাদনের টাকা অনাদায়ী পড়ে থাকতো।
প্রজার হিসেবে দেনাই বাড়তো।
নীল চাষের এ সকল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রায়তেরা যাবতীয় অত্যাচার ও অভিযোগের আইনসম্মত
প্রতিকারে বঞ্চিত হয়ে হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। তখন তাদের প্রতি দয়াশীল কয়েকজন প্রশাসকের
পর্যায়ক্রমিক কিছু কার্যকলাপে উৎসাহিত হয়ে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের হেমন্তের দিকে তারা নীলচাষে সম্পূর্ণ
অস্বীকৃতি জানায়। রায়তদের অনুক‚লে সরকার পক্ষের এই ধরনের অনুকম্পা প্রথম লক্ষ্য করা যায়
কলিকাতার কাছে বারাসাত জেলায়। এর আগে বারাসাতেই তিতুমীরের নেতৃত্বে জমিদার ও নীলকরদের
বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কলিকাতার কাছাকাছি বলে বারাসাতের রায়ত শ্রেণী ছিল বেশি
অধিকার সচেতন। এছাড়া একই কারণে যেসব অফিসার এখানে নিযুক্ত হয়েছিলেন তারাও প্রভাবশালী ও
স্বাধীনচেতা ছিলেন। নির্যাতিত রায়তদের পক্ষে প্রথম যে সরকারি আমলা এগিয়ে আসেন, তিনি ছিলেন
কলারোয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৌলভি আবদুল লতিফ। ১৮৫৪ খ্রি. তিনি রায়তদের ওপর নীলকরের
নির্যাতন বন্ধ করার জন্য এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করেন। এছাড়া রায়তদের ওপর আইনানুগ আচরণ
করার জন্য তিনি নীলকরদের ওপর হুকুম জারি করেন। অন্যদিকে নীলকরের বেআইনি অত্যাচারের বিরুদ্ধে
অভিযোগ পেশ করার জন্য তিনি নির্যাতিত রায়তদের উৎসাহিত করেন। এসব কারণে তিনি নীলকরদের
বিরাগভাজন হন এবং প্রভাবশালী মহলের চাপে তাকে বদলি করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় প্রশাসক যিনি
বারাসাতের রায়তদের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তিনি হলেন বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট জে.এইচ.
ম্যাংগল্স। তিনি ১৮৫৮ খ্রি. মত প্রকাশ করেন যে, রায়তকে দাদন নিতে বাধ্য করা এবং ইচ্ছের বিরুদ্ধে


নীল চাষে বাধ্য করা যাবে না। এর ফলে চাষীরা সে বছর নীল চাষ করতে অস্বীকার করে। ম্যাংগল্স-এর
এই বক্তব্য প্রদানের জন্য সে সময়কার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে তাকে তিরস্কার করেন। নীলকরদের
চাপের মুখে ম্যাংগল্সকেও অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। ম্যাংগল্সের পর বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট
এ্যাসলি ইডেন তাঁর উদারতা, সহনশীলতা ও মানবিকতার জন্য প্রজাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং
তাঁর এই নীতির ফলে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের হেমন্তের দিকে প্রজারা নদীয়া-বারাসাতে নীল বিদ্রোহ শুরু করে।
ইডেন নীলকরদের প্রতি আহŸান জানান, তারা যেন রায়তদের প্রতি মানবিক আচরণ করে এবং নীল চাষের
জন্য আরও বেশি মূল্য প্রদান করে।
তবে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের শেষদিক থেকেই রায়তদের অসন্তোষ বিদ্রোহে রূপ নিতে শুরু করে। বিদ্রোহের শুরু
হয় বারাসাত থেকে এবং দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে নদীয়া, পাবনা, মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য নীলচাষভুক্ত এলাকায়।
১৮৬০ খ্রি. নীল বোনার মৌসুম শুরু হলে একযোগে সকল চাষী নীল চাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
অন্যদিকে নীলকরেরাও গ্রামে গ্রামে লাঠিয়াল পাঠিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙ্গে, শারীরিক নির্যাতন ও আদালতে
হয়রানিমূলক মামলা করে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে।
নীল বিদ্রোহের নেতৃত্বে রায়ত, জমিদার ও শহরভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী সবাই সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে প্রমাণ
পাওয়া যায়। তবে ভ‚স্বামী শ্রেণী নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য রায়তকে নীলকরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে
তুলেছিল। নীল প্রজাদের ওপর জমিদারের পূর্ব নিয়ন্ত্রণ পুনপ্রতিষ্ঠা করাও ছিল ভ‚স্বামী শ্রেণীর একটি
অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়া এর আগে নীলকরদের সাথে ব্যবসা করে বা নীলকরদের অধীনে কাজ করে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এমন অনেকে ভ‚স্বামীদের সাথে যোগ দিয়েছিল। নীল বিদ্রোহের মাধ্যমে তারা
নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়। নীল বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী অন্যতম দুজন দিগম্বর বিশ্বাস ও
বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছিল নীলকুঠির প্রাক্তন কর্মচারী। তারা গ্রামবাসীদের আহŸান জানায় নীল চাষ বন্ধ রাখতে।
তারা প্রজাদের দাদন মিটিয়ে দেয় এবং লাঠিয়াল এনে রায়তদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। তবে লক্ষণীয়
যে, বিদ্রোহ চলাকালে আঞ্চলিক নেতৃত্ব একই ব্যক্তির হাতে থাকেনি।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে নীল বিদ্রোহ তুঙ্গে ওঠে। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে সরকার বিব্রত হয়ে পড়েন।
কেননা নীলচাষের সাথে নীলশিল্প ছাড়াও জড়িত ছিল রপ্তানি বাণিজ্য ও কলিকাতার অনেক বাণিজ্যিক
প্রতিষ্ঠানের ভাগ্য। এসব এজেন্সি হাউজ নীল চাষে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল। এদের চাপের মুখে বাংলার
লেফটেন্যান্ট গভর্নর পীটার গ্রান্ট গভর্নর জেনারেলের কাছে নীল শিল্পকে রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় আইন
প্রণয়ন করার প্রস্তাব করেন। নীলশিল্পে জড়িত বাণিজ্যিক গোষ্ঠী এবং নীলকরদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৮৬০
খ্রিস্টাব্দের একাদশ আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের অধীনে চুক্তি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী
মামলা দায়ের করার অধিকার দেওয়া হয়। এই আইনের ধারা অনুযায়ী যদি কোন রায়ত ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের
২৪ মার্চের পর নীলচাষের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েও নীলচাষ না করে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীর অভিযোগ
সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে পারবেন এবং অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে বিবাদীকে দাদনের পাঁচগুণ
পর্যন্ত জরিমানা এবং তিন মাসের কারাদন্ড দিতে পারবেন। এই আইনের আরেক ধারায় নীলচাষের বিরুদ্ধে
উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। আইনে বলা হয়,
ম্যাজিস্ট্রেটের রায় চূড়ান্ত এবং তার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না। তবে এই আইনে গোটা নীল
ব্যবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করে দেখার জন্য একটি কমিশন গঠন করার ব্যবস্থা করা হয়। এবং এই আইনটি
মাত্র ছয় মাসের জন্য বলবৎ থাকবে বলে বিধান করা হয়। কিন্তু নিপীড়িত রায়ত শ্রেণী সরকারের ওপর যে
ভরসা স্থাপন করেছিল, একাদশ আইনের ফলে তাতে সন্দেহ আর অবিশ্বাস জন্ম নেয়। স্বাভাবিকভাবেই
তারা মনে করতে থাকে যে, সরকার নীলকরদের দোসর। তাই রায়ত শ্রেণীর সংগ্রাম শুরু হয় নীলকর এবং
সরকার উভয়ের বিরুদ্ধে। যাইহোক, ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর এই ঘৃণ্য একাদশ আইনের মেয়াদ শেষ
হয়।


নীল কমিশন তিন মাসের মধ্যে সরকারের কাছে রিপোর্ট দাখিল করে। কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার
পর আইন করা হলো যে, কোন নীলকরই আর রায়তের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর জবরদস্তিপূর্বক রায়তদের
দিয়ে নীলচাষ করাতে পারবে না; নীলের চাষ করা সম্পূর্ণভাবে চাষীদের ইচ্ছাধীন।
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি নাগাদ নীল বিদ্রোহ থেমে যায়। তবে নীল চাষের আগের অবস্থা আর ফিরে
আসেনি। বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে যশোর, নদীয়া এবং অন্যান্য বেশিরভাগ জেলায় নীলের চাষ হয়নি।
এর মধ্যে অনেক কুঠি নীল ব্যবস্থা গুটিয়ে ব্যবসা পরিবর্তন করে ফেলে; আবার অনেকে কুঠি বন্ধ করে চলে
যায়। এরপর কৃত্রিম নীলের আবিষ্কারের পর নীলচাষ এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়।
নীল চাষীদের পক্ষে সে সময় বাংলায় অবস্থানরত কয়েকজন খ্রিস্টান মিশনারি কাজ করেছেন। এঁরা ছিলেন
লুথারপন্থী প্রটেস্ট্যান্ট। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রেভারেন্ড জেমস লঙ। মানবিক কারণে তিনি
নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। নিজে ইংরেজ হয়েও তিনি ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণের
বীভৎসতা তুলে ধরে একটি পুস্তিকা লেখেন। এজন্যে তাঁকে আদালতে কারাদন্ডের মুখোমুখি পর্যন্ত হতে
হয়েছিল।
নীলচাষের নিপীড়িত রায়তের পক্ষে সামনে এগিয়ে এসেছিল হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র
মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন উৎপীড়িত রায়তের প্রকৃত বন্ধু। নীলচাষীদের প্রকৃত অবস্থা সরেজমিনে জেনে
খবর পরিবেশনের জন্য তিনি নীল জেলাগুলোতে সাংবাদিক পাঠান। সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন
শিশিরকুমার ঘোষ এবং মনমোহন ঘোষ। এরা মফস্বলের সরকারি কর্মচারিদের অযোগ্যতা ও নীলকরদের
প্রতি পক্ষপাতিত্বের ঘটনা তুলে ধরেন। শিশিরকুমার ঘোষ নীল বিদ্রোহের সময় যশোর হতে বিদ্রোহের খবর
নিয়মিতভাবে হিন্দু প্যাট্রিয়টে পাঠাতেন। নীল কমিশন গঠনে এদের প্রতিবেদনের প্রভাব ছিল সবচেয়ে
বেশি। ১৮৬০ খ্রি. দীনবন্ধু মিত্রের যুগান্তকারী নাটক ‘নীল দর্পণ' নীলকরদের অত্যাচার ও কৃষকদের দুর্দশা
সাহিত্য মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কলিকাতায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলে তুলে ধরে। পরবর্তী সময়ে এর
ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে ইংরেজ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
নীল বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে অন্যতম সফল গণবিদ্রোহ। বাংলার সকল কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে নীল
বিদ্রোহ সামাজিক গুরুত্বে, ব্যাপকতায়, সংগঠনে, দৃঢ়তায় ও পরিণতিতে ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। এই নীল বিদ্রোহই
সর্বপ্রথম দেশের লোকদের রাজনৈতিক আন্দোলনে সংঘবদ্ধ হতে শিখিয়েছিল। কলিকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত
শ্রেণীকে আলোড়িত করেছিল এই বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহে ধনী জমিদার থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, ভ‚স্বামী,
রায়তÑ সবাই ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার প্রয়াস পান। এই বিদ্রোহ বাঙালি
জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছিল এবং নীল বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী
আন্দোলনের প্রথম বহিপ্রকাশ ঘটে।
সারসংক্ষেপ
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে কাঁচামাল সংগ্রহের একটি ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয় ব্রিটেনের বাংলা
উপনিবেশ। বস্ত্র শিল্পের রঞ্জক হিসেবে নীলের চাষ ও তা ইংল্যান্ডে রপ্তানি করে প্রচুর মুনাফার সম্ভাবনা
সূত্র খুঁজে পায় নীলকরেরা। রায়তদের জোর করে নীল চাষে বাধ্য করে তারা। কিন্তু অলাভজনক
হওয়ায় রায়তেরা নীলচাষে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। নীলকরদের অত্যাচারে ঐক্যবদ্ধ কৃষক সমাজ ১৮৫৯-
৬২ খ্রি. পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত সময়ে নীল বিদ্রোহ গড়ে তোলে। সরকার ১৮৬০ খ্রি. নীল কমিশন গঠন করে।
কমিশনের সুপারিশে রায়তের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে নীলচাষে বাধ্য করাকে আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা
হয়।


সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১। বেøয়ার বি. ক্লিং, নীল বিদ্রোহ, বাংলায় নীল আন্দোলন, ১৮৫৯-৬২(অনুবাদ), ঢাকা, ১৯৯৫।
২। সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদক), বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, প্রথম খন্ড, ঢাকা, ১৯৯৩।
৩। সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, কলকাতা, ১৯৯০।
৪। সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসীর মামুন (সম্পাদক), বাংলাদেশের সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন,
ঢাকা, ১৯৮৬।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয় কোন সময়ে?
(ক) ১৮৩১-৩৪ খ্রি. (খ) ১৮৫৯-৬২ খ্রি.
(গ) ১৮৪৯-৫২ খ্রি. (ঘ) ১৮৫১-৫৪ খ্রি.।
২। দাদন অর্থ কি?
(ক) বকেয়া (খ) নগদ
(গ) ঋণ (ঘ) আগাম।
৩। নীল বিদ্রোহের সূচনা হয় কোথায়?
(ক) বারাসাত (খ) হুগলি
(গ) কুমিল্লা (ঘ) ঢাকা।
৪। নীলচাষীদের পক্ষ নিয়ে কোন ম্যাজিস্ট্রেট এগিয়ে আসেন?
(ক) সৈয়দ আমীর আলী (খ) মৌলভি আবদুল লতিফ
(গ) সৈয়দ আহমদ খান (ঘ) মীর মোশাররফ হোসেন।
৫। হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এর সম্পাদক কে ছিলেন?
(ক) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (খ) দীনবন্ধু মিত্র
(গ) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (ঘ) শিশিরকুমার ঘোষ।
৬। নীল দর্পণের নাট্যকার কে?
(ক) মাইকেল মধুসূদন দত্ত (খ) মীর মোশাররফ হোসেন
(গ) দীনবন্ধু মিত্র (ঘ) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। ভারতবর্ষে নীলচাষের কারণ কি ছিল?
২। নীলচাষে রায়তদের অনীহার কারণ উল্লেখ করুন।
৩। একাদশ আইন সম্পর্কেএকটি টীকা লিখুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। নীল বিদ্রোহের কারণসমূহ আলোচনা করুন।
২। নীল বিদ্রোহের বিবরণ দিন। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব কি ছিল?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]