ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস


উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ লক্ষ্য করা যায়। ১৮৫০-এর পরবর্তী সময়ে
বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সভা-সমিতি গঠিত হয়। যদিও ঐক্যবদ্ধ সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম
হতে আরও অনেক দিন বাকি ছিল, তথাপি এসব নতুন নতুন সংগঠনের কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রথম
জাতীয়তাবোধের সূচনা হয়। ১৮৫৩ খ্রি. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্টার নবায়নের প্রাক্কালে শিক্ষিত ও
সচেতন ভারতীয়দের মধ্যে সংগঠন গড়ার প্রবণতা দেখা যায়। এর কারণ ছিল ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া
কোন সংস্থার মাধ্যমে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করার তাগিদ। অর্থাৎ এই সময়ে ভারতীয়দের মধ্যে
রাজনীতি-সচেতনতা এবং দেশাত্মবোধের জন্ম হয়। কাজেই ১৮৮৫ খ্রি. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত
হওয়ার পটভ‚মি ছিল পূর্ববর্তী ত্রিশ বছর সময়ে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন স্থানীয় এবং শ্রেণীভিত্তিক সংগঠন ও
সেগুলোর কার্যক্রম সূচিত হওয়া।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ন্যাশনাল এসোসিয়েশন এবং অক্টোবর মাসে বৃটিশ ইন্ডিয়ান
এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয় সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন। প্রথমটি সম্পর্কে
খুব বেশি কিছু জানা যায় না। কিন্তু দ্বিতীয়টি যথেষ্ট প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। বৃটিশ ইন্ডিয়ান
এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব। ১৮৬৭ খ্রি. তাঁর মৃত্যু পরবর্তী দু'বছর প্রসন্নকুমার
ঠাকুর সভাপতির পদে কর্মরত ছিলেন। ১৮৬৯ থেকে ১৮৭৯ খ্রি. পর্যন্ত দ্বারকানাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা
রমানাথ ঠাকুর এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৫২ খ্রি. এই সংগঠন শাসন সংস্কার সম্পর্কিত এক দীর্ঘ
আবেদনপত্র বৃটিশ পার্লামেন্টের নিকট প্রেরণ করে। পরবর্তীকালে কংগ্রেস পার্টির অনেক দাবি-দাওয়ার
মধ্যে উক্ত আবেদনপত্রের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। শাসনকার্যে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের পথ সুগম
করাই ছিল এই আবেদনের প্রধান উদ্দেশ্য।
উনিশ শতকের শেষার্ধে জাতীয়তাবোধ আরো প্রসার লাভ করে। ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার, যোগাযোগ
ব্যবস্থার (বিশেষত রেল ও ডাক যোগাযোগ) উন্নয়ন, সংবাদপত্রের মাধ্যমে বৃটিশ শাসনের ভালমন্দ সম্পর্কে
আলোচনা ইত্যাদি ছিল এর প্রধান কারণ। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় চেতনা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত
এবং শহুরে শ্রেণীর মধ্যে সীমিত ছিল। আলোচ্য সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত সংগঠন ছিল ওহফরধহ
অংংড়পরধঃরড়হ বা ভারতসভা। ১৮৭৬ খ্রি. সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং আনন্দমোহন বসু এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
সুরেন্দ্রনাথ একে “শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক সচেতনতার প্রথম সংঘবদ্ধ রূপ” বলে উল্লেখ
করেন। পূর্বোল্লেখিত সংগঠনসমূহের তুলনায় ভারতসভার কর্মসূচি ছিল ব্যাপকতর এবং এটা ছিল আরো



বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল। এর উদ্দেশ্যাবলি ছিল: (১) দেশে জনমত গঠন করা; (২) রাজনৈতিক
স্বার্থের ভিত্তিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করাঃ (৩) হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের
মধ্যে মৈত্রীর প্রসার; এবং (৪) রাজনৈতিক আন্দোলনে অশিক্ষিত জনসাধারণের যোগদানের ব্যবস্থা করা।
সর্বভারতীয় অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ ছিলেন
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।
১৮৭৭ খ্রি. সৈয়দ আমীর আলী ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন।জাতীয়তাবাদী
ভাবধারার উন্মেষকাল থেকেই ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদ এর একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দেয়।শিক্ষা-দীক্ষা,
ব্যবসা-বাণিজ্য, পেশা, চাকরি ইত্যাদি যাবতীয় ব্যাপারে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা এবং সর্বভারতীয়
পর্যায়ে এই সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘিষ্ঠতা এই স্বাতন্ত্র্যবাদের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল।তবে ইন্ডিয়ান
এসোসিয়েশন এবং ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশনের মধ্যে কোন প্রকার বৈরী সম্পর্ক ছিল না।১৮৮৩
খ্রি. ইলবার্ট বিল সম্পর্কিত আন্দোলনে এই দুই সংগঠন পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে।
এভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভ‚মি তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা এবং ভ‚মিকা
সম্পর্কে মানুষ ধীরে ধীরে অবহিত হয়, যার পেছনে উল্লেখিত সংগঠনসমূহের বিরাট অবদান ছিল।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনের উদ্যোক্তা ছিলেন স্কটল্যান্ডের অধিবাসী অবসরপ্রাপ্ত সিভিলিয়ান অ্যালান
অক্টাভিয়ান হিউম (অষষধহ ঙপঃধারধহ ঐঁসব)। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি
সিমলায় বসবাস করতে থাকেন। একটা রাজনেতিক দল গঠনের পরিকল্পনার পশ্চাতে সক্রিয় ছিল ভারতের
প্রতি তাঁর অকৃত্রিম মমত্ববোধ। সে সঙ্গে ছিল বৃটিশ শাসনের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার চিন্তা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের
সিপাহী বিদ্রোহের মত আর কোন রক্তক্ষয়ী ঘটনা যেন সংঘটিত না হয় সেটাও তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য
ছিল। তিনি শাসক ও শাসিতের যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজন অনুভব করেন। একটা সর্বভারতীয়
রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া এই যোগাযোগ সম্ভবপর ছিল না। তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ জাতীয়
সংগঠন স্থাপনের জন্যে হিউম-এর মতো একজন ব্যক্তির দরকার ছিল। পরবর্তী সময়ের প্রখ্যাত কংগ্রেস
নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলেন, রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া, বিক্ষোভ ইত্যাদি কারণে সে সময় সরকারি
মহলে ভারতীয়দের প্রতি যে সন্দেহ বিরাজ করছিল তাতে কোন ভারতবাসীর পক্ষে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান
গঠনের উদ্যোগ নেওয়া অসম্ভব ছিল। শুধুমাত্র একজন মহান ইংরেজ (আসলে স্কট) এবং প্রাক্তন উচ্চপদস্থ
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে হিউম একাজে ব্রতী হতে পেরেছিলেন।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ চারদিন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বোম্বাইতে
অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়Ñ যিনি ড.ঈ.
ইড়হহবৎলর নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন স্থান হতে আগত বাহাত্তর জন প্রতিনিধিসহ প্রায়
শতাধিক লোক এই অধিবেশনে যোগদান করেন। তবে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রধান পুরুষ সুরেন্দ্রনাথ
ব্যানার্জী এই সভায় উপস্থিত ছিলেন না। ঠিক একই সময়ে তিনি কলিকাতায় জাতীয় সম্মেলনের (ঘধঃরড়হধষ
ঈড়হভবৎবহপব) অধিবেশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবে কংগ্রেসের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে সুরেন্দ্রনাথ যোগদান
করেন এবং পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। সেই সঙ্গে তাঁর উদ্যোগে গঠিত জাতীয়
সম্মেলনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়।
হিউম আশা করেছিলেন যে, কংগ্রেস হবে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পরে
সামাজিক প্রশ্নে এই সংগঠনকে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ, তাতে মতানৈক্যের সম্ভাবনা
বিদ্যমান ছিল। প্রথম অধিবেশনে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় সেগুলো ছিলÑ
(১) বৃটিশ ভারতীয় সরকারের কার্যাবলি তদন্তের জন্যে একটি রাজকীয় (জড়ুধষ) কমিশন গঠন;
(২) ভারত সচিবের পরিষদ বিলুপ্ত করা;
(৩) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদসমূহের সংস্কার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা;


(৪) সিভিল সার্ভিসের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা একই সঙ্গে ইংল্যান্ড এবং ভারতে নেওয়ার ব্যবস্থা করা
এবং পরীক্ষার্থীর বয়স অনধিক ২৩ বছর নির্ধারণ করা। অন্যান্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্যে ভারতে
পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা;
(৫) সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি অনাবশ্যক এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করা।
উক্ত দাবিগুলোতে ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। একই সঙ্গে বৃটিশ
সরকারের প্রতি আনুগত্যহীনতার কোন ইঙ্গিত এই প্রস্তাবসমূহে পাওয়া যায় না।
কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। এবার প্রতিনিধির
সংখ্যা ছিল ৪৩৪। এই অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় দাদাভাই নওরোজী। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে
বৃটিশ সরকারের প্রতি ভারতবাসীদের আনুগত্য ঘোষণা করেন। তাঁর ভাষণে তিনি প্রশ্ন করেন, “এই
কংগ্রেস কি বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের আস্তানা?” (সভাস্থলে ‘না' ‘না' ধ্বনি শোনা যায়)
“নাকি এই কংগ্রেস সরকারের স্থিতিশীলতার ভিত্তিমূলে আর একটি প্রস্তরখন্ড?” (সভাস্থলে ‘হ্যাঁ' ‘হ্যাঁ' ধ্বনি
শোনা যায়।) প্রকৃতপক্ষে, বৃটিশরাজের প্রতি আনুগত্য ছিল কংগ্রেসের প্রথম বিশ বছরের মূলনীতি। অনেক
বৃটিশ পর্যবেক্ষক দাদাভাই-এর ভাষণকে শুধুমাত্র মুখের বুলি বলে অগ্রাহ্য করলেও কংগ্রেসের এ সময়কার
প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ (উমেশচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ, দাদাভাই নওরোজী এবং ফিরোজ শাহ মেহতা প্রমুখ) এবং
তাঁদের অনুসারীগণ ভিক্টোরীয় যুগের উদারনীতির আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এই আদর্শের জন্মভ‚মি
বৃটেনের প্রতি তাঁদের আনুগত্যে কোন ভেজাল ছিল বলে মনে হয় না।
প্রথম থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রধানতম দুর্বলতা ছিল মুসলমান সম্প্রদায়কে দলে টানার
অক্ষমতা। যে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন তাঁরা
সবাই পশ্চিম ভারতের (বিশেষত বোম্বাইয়ের) ব্যবসায়ী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। নিজেদের আর্থিকসামাজিক অবস্থানকে তাঁরা হিন্দুদের তুলনায় হীন ভাবতেন না বলেই কংগ্রেসের রাজনীতিতে আকৃষ্ট
হয়েছিলেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি বদরুদ্দীন তায়েবজী এই শ্রেণীর
মুসলমানের প্রতিনিধি ছিলেন। এ ব্যাপারে মুসলমান সম্প্রদায় স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতানুসারী ছিল
বলে মনে হয়। স্যার সৈয়দ স্বীয় সম্প্রদায়কে কংগ্রেস থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন। তিনি মনে করতেন
ঐ সময়ে রাজনীতি নিয়ে অধিক মাতামাতি মুসলমানদের ক্ষতির কারণ হবে। তাঁর ধারণা ছিল ইংল্যান্ডের
প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভারতে আমদানি করা অসম্ভব। কারণ, এখানে ব্যক্তি বা দল নয়,
সম্প্রদায়ই নির্বাচনে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়ে পরিণত হবে।
১৯০৫ খ্রি. বড়লাট কার্জন কর্তৃক বঙ্গবিভাগকে কেন্দ্র করে। বৃটিশ সরকারের প্রতি কংগ্রেসের আনুগত্যে
প্রথমবারের মত ফাটল ধরে। এর ফলে কংগ্রেস নেতৃত্বে চরমপন্থীদের আবির্ভাব ঘটে। তবে একই সময়ে
ইংল্যান্ডে উদারনৈতিকদের (খরনবৎধষং) ক্ষমতায় আসার কারণে কংগ্রেসী আনুগত্যবাদীগণ কিঞ্চিৎ আশানি¦ত
হন এই ভেবে যে উদারপন্থী সরকারের নীতি তাঁদের হাতকে শক্তিশালী করবে। কিন্তু অচিরেই তাঁরা হতাশ
হন; নতুন ভারত সচিব জন মর্লি ঘোষণা করেন যে, বঙ্গবিভাগ একটা প্রতিষ্ঠিত ঘটনা এবং এই সিদ্ধান্ত রদ
করা হবে না।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে উপদলীয় কোন্দলের আশঙ্কা আরো বেড়ে
যায়। নরমপন্থীরা সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যে পুনর্বার দাদাভাই নওরোজীকে সভাপতি মনোনীত করেন। তিনি
চরমপন্থীদেরকে খুশি করার জন্যে এবং সম্ভাব্য সংঘাত থেকে দলকে রক্ষা করার জন্য স্বরাজের পক্ষে দাবি
উত্থাপন করেন। কিন্তু এতেও উপদলীয় কোন্দল প্রশমিত হয়নি। দলের পরবর্তী (ডিসেম্বর, ১৯০৭)
সম্মেলন সুরাটে অনুষ্ঠিত হয়। সুরাট ছিল পার্সী সম্প্রদায়ভুক্ত উদারপন্থী নেতা ফিরোজ শাহ মেহতার
আবাসস্থল। এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ১৬০০ প্রতিনিধি। সভাপতি হিসেবে ডঃ রাসবিহারী ঘোষের


নাম প্রস্তাবিত হওয়ার সাথে সাথে গোলযোগ শুরু হয়। চরমপন্থীদের নিক্ষিপ্ত জুতা সুরেন্দ্রনাথ এবং
ফিরোজশাহ মেহতাকে আঘাত করে। এভাবেই সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে। কংগ্রেসের এই অন্তর্দ্বন্দ¡ ১৯১১ খ্রি.
বঙ্গবিভাগ রদ হওয়ার পর প্রশমিত হয়।
অতপর ১৯১৪ খ্রি. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বৃটেন মিত্রপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বৃটিশরাজের প্রতি যুদ্ধকালীন সময়ে আনুগত্যের নীতি গ্রহণ করে। একই সঙ্গে
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সঙ্গে কংগ্রেস একটি সমঝোতায় উপনীত হয়। এই সমঝোতা লখ্নৌ চুক্তি
(১৯১৬) নামে খ্যাত।
যুদ্ধের পরবর্তী বছরগুলোতে কংগ্রেসের নীতি, কর্মপদ্ধতি এবং লক্ষ্যের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়।
যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী। একই সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক এই দলের নেতৃত্ব গ্রহণও
এর অন্যতম প্রধান কারণ। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই দল ছিল শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগঠন।
যুদ্ধোত্তর সময়ে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষও কংগ্রেসের নেতৃত্বে
রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ শুরু করে। ধীরে ধীরে এই দল একটি গণ-সংগঠনের (সধংং ঢ়ধৎঃু) রূপ
নেয়।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের লাহোর অধিবেশনে ‘পূর্ণস্বরাজ' বা স্বাধীনতা কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসেবে স্থিরীকৃত হয়। তবে
মুসলিম লীগের উত্থান এবং ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফলে অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার
সম্ভাবনা দ্রুত নস্যাৎ হয়ে যায়। ১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকে রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা প্রকট
আকার ধারণ করে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র
প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগের স্বতন্ত্র আবাসভ‚মি তথা
পাকিস্তানের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া কংগ্রেস ও বৃটিশ সরকারের নিকট কোন বিকল্প ছিল না। সব আপোষপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে ১৯৪৭ খ্রি. আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু'টি স্বতন্ত্র দেশ
স্বাধীনতা লাভ করে।
সারসংক্ষেপ
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ লক্ষ্য করা যায়।
বিভিন্ন সভা-সমিতি ও সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীসমূহ নিজেদের দাবি-দাওয়া এবং
মতামত প্রকাশ করতে শুরু করে। সংবাদপত্রের প্রসার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে
সর্বভারতীয় ধ্যান-ধারণা প্রচারে সুবিধা হয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৮৮৫ খ্রি. অবসরপ্রাপ্ত বৃটিশ সিভিলিয়ান
অ্যালনে অক্টাভিয়ান হিউমের উদ্যোগ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম বৈঠক বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে বৃটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের নীতি অনুসরণ করলেও ধীরে ধীরে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মাধ্যমে এই দল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পুরোভাগে এসে যায়। তা সত্তে¡ও
মুসলিম সম্প্রদায়ের পূর্ণ আস্থা অর্জনে এই দল ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত জাতীয়তাবাদী
ভাবধারার ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম
হয়।


সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস (আধুনিক যুগ), কলিকাতা, ১৯৯৮।
২. ঝ.গ. ইঁৎশব ধহফ ঝধষরস অষ-উরহ ছঁৎধরংযর, ঞযব ইৎরঃরংয জধল রহ ওহফরধ: অহ ঐরংঃড়ৎরপধষ জবারব,ি
উযধশধ, ১৯৯৫.
৩. ঝঁসরঃ ঝধৎশধৎ, গড়ফবৎহ ওহফরধ, ১৮৮৫-১৯৪৭, উবষযর, ১৯৮৩.
৪. ঐঁময ঞরহশবৎ, ঝড়ঁঃয অংরধ: অ ঝযড়ৎঃ ঐরংঃড়ৎু., খড়হফড়হ১৯৬৬.
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। বৃটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন গঠিত হয় কোন খ্রিস্টাব্দে?
(ক) ১৮৩৮ (খ) ১৮৫১
(গ) ১৮৫৯ (ঘ) ১৯৫৯।
২। ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেনÑ
(ক) প্রসন্নকুমার ঠাকুর (খ) রাধাকান্ত দেব
(গ) সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী (ঘ) কোনটিই নয়।
৩। জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম উন্মেষ ঘটে কোন শ্রেণীর মধ্যে?
(ক) মধ্যবিত্ত শ্রেণী (খ) জমিদার শ্রেণী
(গ) কৃষক শ্রেণী (ঘ) উচ্চবিত্ত শ্রেণী।
৪। কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ছিলেনÑ
(ক) উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় (খ) আনন্দমোহন বসু
(গ) অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম (ঘ) কোনটিই নয়।
৫। কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ দাবি করে কোন খ্রিস্টাব্দে?
(ক) ১৯০৫ (খ) ১৯২৯
(গ) ১৯৩৫ (ঘ) ১৯৪০।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ কখন এবং কিভাবে সাধিত হয়?
২। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাথমিক লক্ষ্যসমূহ কি ছিল?
৩। ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় কংগ্রেস ব্যর্থ হয় কেন?
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভ‚মি বর্ণনা করুন।
২। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে কংগ্রেসের ভ‚মিকার মূল্যায়ন করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]