সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ ও মুসলিম সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ


বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় শতাব্দী কাল বাংলার ইতিহাস দিল্লি ও
বাংলার মধ্যে বোঝাপড়ার ইতিহাস। দিল্লি বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করলেও প্রায়ই বাংলার শাসনকর্তাগণ
স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজীর স্বাধীনতা বা তুঘ্রিলের বিদ্রোহ এই ধারারই প্রকাশ।
দিল্লির সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশকে ইওয়াজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। তেমনি তুঘ্রিলের বিদ্রোহ
দমনে বাংলা অভিযানে আসতে হয়েছিল গিয়াসউদ্দিন বলবনকে। বলবন বিদ্রোহ দমন করে বাংলার
শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন তাঁর পুত্র বুঘরা খানকে। বাংলার এই বিদ্রোহ প্রবণতা লক্ষ করে সমসাময়িক
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারাণী লখনৌতিকে ‘বলঘাক্পুর' (বিদ্রোহের নগরী) বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
বুঘরা খান বলবনের মৃত্যুর (১২৮৬ খ্রি:) পর নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলেন, ঘোষণা করেছিলেন।
এই স্বাধীনতার সূত্র ধরেই সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের আবির্ভাব ঘটেছিল।
বাংলার ইতিহাসে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়কালের প্রথম
দিকে লখনৌতি সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের অধীনে স্বাধীন ছিল। দিল্লির খলজী সুলতানদের
আমলে লখনৌতি বরাবর স্বাধীনতা ভোগ করছিল। কিন্তু দিল্লিতে তুঘলক বংশ ক্ষমতা দখল করার পরে
তাঁরা লখনৌতি পুনরাধিকার করেন। আবার দিল্লিতে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের মধ্যভাগে
১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা স্বাধীন হয়ে যায়। আর বাংলার এই স্বাধীনতা দুইশত বৎসরকাল স্থায়ী হয়।
বংশ পরিচয়
শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের বংশ পরিচয় সম্বন্ধে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। শিলালিপি
ও মুদ্রার সাক্ষ্যে দেখা যায় যে, সুলতান রুকনউদ্দিন কায়কাউসের পর সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ
লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ১৩০১ থেকে ১৩২২ খ্রি: পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
লখনৌতি ও সোনারগাঁও টাকশাল থেকে ৭০১ হতে ৭২২ হিজরি অর্থাৎ ১৩০১ হতে ১৩২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
উৎকীর্ণ তাঁর অনেক মুদ্রা পাওয়া গেছে। তাছাড়া তাঁর রাজত্বকালের তিনটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে।
মুদ্রা ও শিলালিপিতে শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের নাম ও উপাধি পাওয়া যায় এবং তিনি নিজেকে
সুলতানরূপে দাবি করেন। কিন্তু তাঁর পিতার নাম বা তাঁর পিতাও যে সুলতান ছিলেন এমন কোন উল্লেখ
মুদ্রায় বা লিপিতে নেই। ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন যে, শামসউদ্দিন ফিরোজ নাসিরউদ্দিন বুঘরা খানের
পুত্র ছিলেন। অর্থাৎ তিনি রুকনউদ্দিন কায়কাউসের ভাই ছিলেন। আধুনিক পন্ডিতদের মধ্যে এডওয়ার্ড
টমাস সর্বপ্রথম এই বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি ইবনে বতুতার সাক্ষ্য গ্রহণ করে শামসউদ্দিন ফিরোজ
শাহকে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের পৌত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। হেনরী বøখম্যানও ইবনে বতুতার

সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন এবং টমাসের সঙ্গে একমত হয়েছেন। কিন্তু দেখা যায় যে, ইবনে বতুতার বিবরণে
যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রয়েছে। সুতরাং একমাত্র এই সূত্রের ওপর নির্ভর করে কোন সিদ্ধান্তই নির্ভুল বলে দাবি
করা যায় না।
এছাড়াও অন্যান্য সূত্র বিশ্লেষণে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সমসাময়িক
ঐতিহাসিক আমীর খসরু বুঘরা খানের মাত্র দুই ছেলের নাম উল্লেখ করেছেনÑ কায়কোবাদ, যিনি বলবনের
মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং কায়কাউস, যিনি বুঘরা খানের মৃত্যুর পর লখনৌতির
সিংহাসনে আরোহণ করেন। আমীর খসরু ফিরোজ শাহের কথা উল্লেখ করেননি। তাছাড়া ফিরোজ শাহের
মুদ্রায় বা শিলালিপিতে এমন কোন দাবি করা হয়নি যে, তিনি সুলতানের পুত্র ছিলেন। কায়কাউস নিজেকে
মুদ্রায় সুলতানপুত্র হিসেবে দাবি করেছেন এবং শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের পুত্রগণও নিজেদেরকে মুদ্রায়
সুলতানের পুত্র বলে দাবি করেছেন। শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ যদি সুলতান বুঘরা খানের পুত্র হতেন তবে
তা উল্লেখিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। তৃতীয়ত, সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন পারস্যের রীতিনীতি
আদব-কায়দা পছন্দ করতেন বলে পারস্যের সম্রাটদের নামের অনুকরণে পৌত্রদের নামকরণ করেন।
যেমনÑ কায়কোবাদ, কায়কাউস, কায়খসরু, কায়র্মুস ইত্যাদি। শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের নাম এই
নিয়মের ব্যতিক্রম। চতুর্থত: দেখা যায় যে, ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে কায়কোবাদ (বুঘরা খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র) ১৮
বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ফিরোজ শাহ যদি কায়কোবাদের তৃতীয় ভ্রাতা হন তাহলে
১৩০১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণকালে তাঁর বয়স ২৫/২৬ বৎসর হবে। কিন্তু শামসউদ্দিন ফিরোজ
শাহের রাজত্বকালের প্রথমদিকেই তাঁর দুই তিনজন পুত্র কর্তৃক শাসনকার্যে পিতাকে সাহায্য করতে দেখা
যায়। অর্থাৎ এই বয়সে তাঁর একাধিক প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র ছিল। সুতরাং শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের
কায়কোবাদের তৃতীয় ভ্রাতা হবার সম্ভাবনা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। উপর্যুক্ত কারণে মনে করা হয় যে,
শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ বলবনের বংশসম্ভূত ছিলেন না। বলবনের বংশের সাথে তাঁর সম্পর্কের কোন
প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ক্ষমতা দখল
আবশ্যকীয় উপকরণের অভাবে সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের বংশ পরিচয় হয়তো কোনদিন পাওয়া
যাবে না। কিন্তু প্রাপ্ত সূত্রগুলো থেকে শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ কিভাবে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ
করেন সে সম্বন্ধে পন্ডিতগণ অনুমান করেন যে, গিয়াসউদ্দিন বলবন বুঘরা খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত
করে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের সময় তাঁকে উপদেশ ও সাহায্যদানের জন্য দুজন বিচক্ষণ ব্যক্তিকে বাংলায়
রেখে যান। ইসামীর মতে, এই দুজনের নামই ছিল ফিরোজ। জিয়াউদ্দিন বারাণী একজনের নাম
শামসউদ্দিন বলে উল্লেখ করেছিলেন। অনুমান করা হয় যে, কায়কাউসের রাজত্বকালে বিহারের শাসনকর্তা
ফিরোজ ইতগীন খুব সম্ভবত এই দুইজনের মধ্যে একজন এবং তিনিই পরবর্তীকালে লখনৌতির সিংহাসন
অধিকার করেন। কায়কাউস হয় অপুত্রক অবস্থায় পরলোক গমন করেন এবং ফিরোজ শাহ ক্ষমতা দখল
করেন; কিংবা এমনও হতে পারে যে, কায়কাউসকে অপসারিত করে ফিরোজ শাহ ক্ষমতা দখল করেন।
তবে, একথা স্বীকার করতেই হবে যে, এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো উপাদানের অভাবে উপর্যুক্ত
উভয় সিদ্ধান্তই আনুমানিক।
মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার
বখতিয়ার খলজীর পর শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের সময়ে বাংলায় মুসলিম রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ
করে। ইতোপূর্বে বাংলার মুসলিম রাজ্য বিহার, উত্তর ও পশ্চিম বাংলা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায়
লখনৌতির পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। সুলতান রুকনউদ্দিন কায়কাউসের রাজত্বকালে রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা শুরু
হয়। হুগলী জেলার সাতগাঁও অঞ্চলে রাজ্য বিস্তার তাঁর সময়েই আরম্ভ হয়। কায়কাউস বঙ্গ অঞ্চলেও কিছু

সাফল্য অর্জন করেছিলেন। কিন্তু শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের সময়েই বঙ্গ এবং সাতগাঁও জয় সম্পূর্ণ হয়।
কায়কাউসের সময় বঙ্গের রাজস্ব থেকে মুদ্রা জারি করা হয়। কিন্তু ফিরোজ শাহের সময়ে বঙ্গ স্থায়ীভাবে
মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং সোনারগাঁও-এ একটি টাকশাল স্থাপিত হয়। সোনারগাঁও টাকশাল হতে ৭০১
হিজরি (১৩০১ খ্রি:) হতে মুদ্রা প্রকাশ করা হয়েছিল। সোনারগাঁও এবং সাতগাঁও ছাড়াও ফিরোজ শাহের
শাসনামলে ময়মনসিংহ এবং সিলেট অঞ্চল মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।এককথায় বলা যায় যে, প্রত্যন্ত
এলাকা ছাড়া প্রায় সমগ্র বাংলা সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের সময়ে মুসলমানদের অধিকারে আসে।
সাতগাঁও জয়
সাতগাঁও বিজয়ের সুস্পষ্ট ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা কষ্টসাধ্য। সুলতান রুকনউদ্দিন কায়কাউসের রাজত্বকালে
উৎকীর্ণ এক শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, জাফর খান নামক তাঁর একজন শাসনকর্তা সাতগাঁও জয়
করেন এবং তিনি সেখানে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। শামসউদ্দিন ফিরোজের রাজত্বকালে ১৩১৩
খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ আর একটি শিলালিপি হতে জানা যায় যে, তিনি এ সময়ে (১৩১৩খ্রিস্টাব্দে) ‘দার-উলখয়রাত' নামক একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ত্রিবেণীস্থ জাফর খানের সমাধিভবনের রক্ষক খাদেমদের কাছে
প্রাপ্ত কুরছিনামায় এক জাফর খান গাজির উল্লেখ আছে যিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন।
কুরছিনামায় বলা হয়েছে যে, জাফর খান গাজি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য বাংলায় আগমন করেন। তিনি
রাজা মান নৃপতিকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। কিন্তু হুগলীর রাজা ভুদেবের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত
হন। সুতরাং বোঝা যায় যে, মুসলমানদের সাতগাঁও জয়ের সঙ্গে জাফর খানের নাম জড়িত। সাতগাঁও
বিজয়ের সাথে শাহ সফিউদ্দিন নামক অন্য এক সুফির নামও জড়িত আছে। জনশ্রুতি আছে যে, শাহ
সফিউদ্দিন সুলতান ফিরোজের শ্যালক ছিলেন এবং তিনি বাংলায় ইসলাম প্রচার করেন। তিনি হুগলীতে
পান্ডব রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধে তিনি সুলতানের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন এবং জাফর
খান গাজি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। উপর্যুক্ত জনশ্রুতিতে কয়েক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেমনÑ
সুলতান ফিরোজ শাহ, পান্ডব রাজা, জাফর খান গাজি এবং শাহ সফিউদ্দিন। শিলালিপি সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়
যে, জাফর খান গাজি সাতগাঁও জয় করেন এবং যেহেতু শিলালিপিগুলো ১২৯৮ হতে ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দের
মধ্যে উৎকীর্ণ সেহেতু নিশ্চিতভাবে শাহ সফিউদ্দিনের সময়কাল ঐ সময়ের মধ্যে নিরূপণ করা যায়। একই
সূত্রে, সুলতান ফিরোজ শাহকেও সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা যায়।
উপর্যুক্ত সূত্রসমূহ হতে মুসলমানদের সাতগাঁও বিজয়ের ঐতিহাসিক প্রমাণ করা সম্ভব। যতদূর প্রমাণ পাওয়া
যায় তাতে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, রুকনউদ্দিন কায়কাউসের সময়ে ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দ বা তার কয়েক বছর
আগে মুসলমান বিজয় শুরু হয়। জাফর খান নামক একজন মুসলমান সেনাপতি সাতগাঁও আক্রমণ করেন।
ইতোপূর্বে জাফর খান দিনাজপুর অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। সুতরাং কায়কাউস এই জাফর
খানকেই সাতগাঁও জয় করতে পাঠিয়েছিলেন। জাফর খান প্রথমেই কিছু সাফল্য লাভ করেন এবং
সাতগাঁওÑএ একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। কিন্তু সম্পূর্ণ সাতগাঁও এলাকা জয় করতে তাঁর আরও কিছুদিন
সময় লাগে। অন্তত: ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন এবং এই সময়ের মধ্যেই তিনি সাতগাঁও
বিজয় সম্পূর্ণ করেন। এই সময়ে ‘দার-উল-খয়রাত' নামে একটি মাদ্রাসা তৈরি করেন বা পূর্বের মাদ্রাসাকে
তিনি পরিবর্ধিত করেন। শাহ সফিউদ্দিনও জাফর খানকে সাতগাঁও বিজয়ে সাহায্য করেন। অবশ্য শাহ
সফিউদ্দিনের সঙ্গে হিন্দুদের সংঘর্ষ প্রথমে সংঘটিত হয় কিনা বলা যায়না। তবে, বাংলায় ইসলাম প্রচারে
সুফিদের ভ‚মিকা আলোচনা করলে দেখা যায় যে, সুফিরা প্রথমে ধর্ম প্রচারে বের হতেন। তাঁরা হিন্দুদের
সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সুলতানের সাহায্য প্রার্থনা করতেন। শাহ সফিউদ্দিনের সম্পর্কে জনশ্রুতিতে এরূপ
ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সুলতান ফিরোজ শাহের পক্ষে জাফর খানই শাহ সফিউদ্দিনকে সাহায্য করেন। পরে
জাফর খানের মৃত্যু হলে প্রথম মুসলমান বিজয়ী হিসেবে লোকস্মৃতিতে দরবেশে পরিণত হয়ে জাফর খান
গাজি রূপে খ্যাতি লাভ করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ছিলেন এবং শামসউদ্দিন

ফিরোজ শাহের সিংহাসন আরোহণের সময় জাফর খান তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বলে বিনিময়ে ফিরোজ
শাহ তাঁকে ‘খান জাহান মুঈন-উল-মুলক ওয়াল সালাতীন' উপাধি দেন।
ময়মনসিংহ জয়
ফিরোজ শাহের ময়মনসিংহ বিজয় সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। তাঁর ছেলে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর
গিয়াসপুর টাকশাল থেকে মুদ্রা প্রচলন করেন। গিয়াসপুরকে ময়মনসিংহের প্রায় ১৫ মাইল দূরে অবস্থিত ঐ
নামের একটি গ্রামের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়। তাছাড়া ফিরোজ শাহ কর্তৃক সিলেট বিজয়ের অকাট্য
প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং সিলেট জয়ের আগে তিনি ময়মনসিংহও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন।
সিলেট জয়
সিলেটে শাহজালালের দরগাহে প্রাপ্ত শিলালিপি হতে জানা যায় যে, সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের
সময়ে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট বিজিত হয়। সাতগাঁও বিজয়ের সঙ্গে যেমন জাফর খান গাজি এবং শাহ
সফিউদ্দিনের নাম যুক্ত, তেমনি সিলেট বিজয়ের সঙ্গেও শাহজালাল ও নাসিরউদ্দিনের নাম জড়িত। কথিত
আছে যে, বুরহানউদ্দিন নামক একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান সিলেটের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে বাস করতেন। ঐ
সময়ে গৌর গোবিন্দ ছিলেন সিলেটের রাজা। বুরহানউদ্দিন তাঁর পুত্রের জন্ম উপলক্ষে একটি গরু জবেহ্
করেন। ঘটনাক্রমে একটি চিল এক টুকরো মাংস নিয়ে সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দের মন্দিরে নিক্ষেপ
করে। এতে রাজা গৌর গোবিন্দ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এবং অনেক অনুসন্ধানের পর বুরহানউদ্দিনকে
ধরে তাঁর ডান হাত কেটে দেন ও তাঁর পুত্রকে হত্যা করেন। বুরহানউদ্দিন অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে শামসউদ্দিন
ফিরোজ শাহের শরণাপন্ন হলেন এবং গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থনা করেন। সুলতান তাঁর ভাগ্নে
সিকান্দার খান গাজিকে সসৈন্যে গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু সিকান্দার খান গাজি দুবার
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন। এ সময় শাহজালাল তুরস্কের কুনিয়া শহর হতে ৩১৩ জন শিষ্যসহ
বাংলায় আসেন। তিনি প্রথমে সাতগাঁও-এ আসেন এবং পরে সিলেটের দিকে রওয়ানা হয়ে সিকান্দার খান
গাজির সঙ্গে যোগ দেন। সৈয়দ নাসিরউদ্দিনকে তাঁর শিষ্যদের সিপাহ্সালার বা সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।
রাজা গৌর গোবিন্দ এবার আর বাঁধা দিতে পারলেন না। তিনি সিলেট ত্যাগ করে জঙ্গলে আশ্রয় নিলেন
এবং সিলেট মুসলমানদের অধিকারে আসে। শাহজালাল মৃত্যু অবধি সিলেটে অবস্থান করেন এবং তিনিই
ঐ অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারের অগ্রনায়ক। বুরহানউদ্দিন কর্তৃক গরু জবেহ্র কাহিনী কতখানি সত্য তা বলা
যায় না। কাহিনীর সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, সিলেট
জয়ের সাথে শাহজালাল জড়িত ছিলেন এবং শিলালিপি প্রমাণে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে
সিলেট সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।
সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে বাংলার মুসলিম রাজ্যের এই বিস্তৃতি এক উল্লেখযোগ্য
ঘটনা। ফিরোজ শাহ এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বাংলার মুসলিম রাজ্য রক্ষা করেছিলেন। তিনি কোন
রাজবংশজাত লোক ছিলেন না। কিন্তু একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবে তিনি বলবন বংশের সেবা করেন
এবং দিল্লির খলজীদের আক্রমণ হতে লখনৌতির মুসলিম রাজ্যকে রক্ষা করেন। সিংহাসনে আরোহণের পর
তিনি মুসলিম রাজ্য চতুর্দিকে বৃদ্ধি করেন এবং প্রত্যন্ত এলাকা ছাড়া বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
ফিরোজ শাহের আমলে শুধু যে মুসলমান রাজ্যের বিস্তার ঘটে তাই নয় বরং বাংলায় ইসলাম প্রচারও বৃদ্ধি
পায়। সাতগাঁও এবং সিলেট বিজয়ের সঙ্গে দুজন বিখ্যাত সুফির নাম জড়িত। শাহ সফিউদ্দিনের প্রচারের
ফলে সাতগাঁও এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সিলেটে শাহজালালের (রা:) প্রভাব এখনও
লক্ষণীয়। এমনকি সারা বাংলাদেশে শাহজালালের (রা:) প্রভাব রয়েছে। বাংলায় ফিরোজ শাহের নাম খুবই
জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলার দুটি শহর ফিরোজ শাহের নাম বহন করে ঃ মালদহ জেলার পান্ডুয়া এবং
হুগলী জেলার পান্ডুয়া। তাঁর নামানুসারে দুটি শহরের নামকরণ করা হয়েছিল ফিরোজাবাদ। দুর্ভাগ্যবশত,

শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের সমসাময়িক কোন ইতিহাস এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয়নি। পরবর্তী ইতিহাসেও তাঁর
সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। মুদ্রা এবং শিলালিপির ভিত্তিতেই তাঁর ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা হয়।
সমসাময়িক ইতিহাস পাওয়া গেলে এই মহান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কূটনীতিবিদ সুলতান সম্বন্ধে অনেক কিছুই
জানা সম্ভব হতো। তবে বাংলার মুসলিম রাজ্য বিস্তারে এবং এর সুপ্রতিষ্ঠায় তাঁর যে বিশেষ ভ‚মিকা ছিল সে
বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং বাংলায় স্থায়ীভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই
ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে থাকবেন।
সারসংক্ষেপ
বাংলার ইতিহাসে ১৩০০ থেকে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল গুরুত্বপুর্ণ। শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ
এ সময়কালের প্রথমদিকে রাজত্ব করেন। তিনি সম্ভবত কায়কাউসকে অপসারিত করে ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত হন। ফিরোজ শাহ সমগ্র বাংলাকে মুসলিম অধিকারে আনেন। তাঁর আমলে ইসলাম প্রচারও
বৃদ্ধি পায়। ফিরোজাবাদ তাঁরই নামের স্মৃতিবাহী শহর। ফিরোজ শাহের রয়েছে বাংলার মধ্যযুগের
ইতিহাসে মর্যাদাপূর্ণ স্থান।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের রাজত্বকাল ছিলÑ
(ক) ১৩০৩ থেকে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (খ) ১৩০১ থেকে ১৩২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
(গ) ১৩০২ থেকে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (ঘ) ১৩০০ থেকে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
২। ‘দার-উল-খয়রাত' মাদ্রাসা নির্মিত হয়Ñ
(ক) ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৩১৪ খ্রিস্টাব্দে।
৩। রাজা গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে ফিরোজ শাহ কোথায় যুদ্ধ করেন?
(ক) ময়সনসিংহে (খ) সাতগাঁও
(গ) চট্টগ্রাম (ঘ) সিলেট।
৪। বাংলার স্বাধীন সুলতানি শুরু হয় কত সালে?
(ক) ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৩১৮ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ বলবন বংশসম্ভূত ছিলেন নাÑ ব্যাখ্যা করুন।
২। গৌর গোবিন্দ সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের ভ‚মিকা মূল্যায়ন করুন।
২। সাতগাঁও এবং সিলেট জয়ের বিশেষ উল্লেখপূর্বক ফিরোজ শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।

১। আবদুলকরিম, বাংলার ইতিহাস : সুলতানি আমল।
২। ঔধফঁহধঃয ঝধৎশধৎ (বফ.), ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ, ঠড়ষ.ওও
৩। আবদুলমমিন চৌধুরী ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
৪। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ)।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]