খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন


প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষাবলম্বন করে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এটা নিশ্চিতভাবে প্রতীয়মান হয় যে,
জার্মানির ও তার মিত্রদের পরাজয় কেবল সময়ের ব্যাপার। তুরস্কের এই অবশ্যম্ভাবী পরাজয় ভারতীয়
মুসলমানদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে তাদের সম্মুখে দেখা দেয় উভয় সংকট; বৃটেনের যুদ্ধ
প্রচেষ্টার সমর্থন এবং মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে বিবেচিত তুর্কি সুলতানের প্রতি ধর্মীয় আনুগত্য।
ভারতীয় মুসলমানদেরকে আশ্বস্ত করার জন্যে যুদ্ধকালীন সময়ে বৃটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, তুরস্কের
ধ্বংস সাধন করা বৃটেনের উদ্দেশ্য নয়; তুর্কি জাতি অধ্যুষিত তুরস্কের মূল ভ‚খন্ডের ঐক্য ও স্বাধীনতা অক্ষুন্ন
রাখা হবে। কিন্তু ভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁদের ইচ্ছা ছিল যুদ্ধের পর আরব
ভ‚-খন্ড সহ সমস্ত উসমানীয় সাম্রাজ্য যাতে টিকে থাকে; কারণ একমাত্র সেই পরিস্থিতিতে তুর্কি সুলতান
মুসলিম বিশ্বের খলিফা ও পবিত্র স্থানসমূহের তত্ত¡াবধায়করূপে স্বীয় মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হবেন।
তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই একথা নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, অন্যান্য পরাজিত শক্তির মত তুরস্কের
ওপরও একটা কঠোর শান্তিচুক্তি চাপিয়ে দেওয়া প্রায় অনিবার্য। এধরনের সম্ভাবনা থেকে তুরস্ককে রক্ষা
করা এবং সুলতানের পদমর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে যুদ্ধোত্তর সময়ে ভারতে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়।
চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বৃটেনকে পরাজিত তুরস্কের প্রতি উদারতা প্রদর্শনে বাধ্য করাই ছিল এই
আন্দোলনের লক্ষ্য। মুসলমান সম্প্রদায়ের বৃটিশ বিরোধী মনোভাব কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে
তোলার লক্ষ্যে মহাত্মা গান্ধী খিলাফতের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। তিনি তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ
আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফত আন্দোলনকে একই ধারায় প্রবাহিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের অব্যবহিত পরপরই সারা ভারতে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হয়
এবং খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের কতিপয় মুসলিম নেতা কর্তৃক খিলাফত কনফারেন্স নামক
একটি সংগঠন স্থাপিত হয়। সেই বছরের ২৩ এবং ২৪ নভেম্বর দিল্লিতে এর সভা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়
দিনের সভায় সভাপতিত্ব করেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর উপদেশ অনুযায়ী সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে,
তুরস্কের ব্যাপারে ভারতীয় মুসলমানদের দাবি অনুসারে যদি ব্যবহার করা না হয় তবে বৃটিশ ভারতীয়
সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করা হবে না। ডিসেম্বর মাসের শেষ নাগাদ চারটি সংগঠন অমৃতসরে নিজ নিজ



অধিবেশনে মিলিত হয়। এই সংগঠনগুলো ছিল কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, খিলাফত কনফারেন্স এবং নবগঠিত
জমিয়ত-ই-উলামা-ই-হিন্দ। কংগ্রেস-লীগ সহযোগিতার যে ধারা লখ্নৌ চুক্তির (১৯১৬ খ্রি.) মাধ্যমে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অমৃতসরেও তার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন
হাকিম আজমল খান যিনি ছিলেন কংগ্রেসের একজন প্রথম সারির নেতা। অপরদিকে কংগ্রেস সম্মেলনে
গৃহীত প্রস্তাবের মাধ্যমে বৃটিশ সরকারকে অনুরোধ জানানো হয় যাতে ভারতীয় মুসলমানদের মতানুসারে
তুর্কি সমস্যার সমাধান করা হয়। লীগের উদ্বোধনী সভায় গান্ধী, মতিলাল নেহরু, মদনমোহন মালব্য প্রমুখ
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন। মুসলিম লীগের অধিবেশনে খিলাফতের ব্যাপারে বৃটিশ মনোভাবের প্রতি
গভীর হতাশা ব্যক্ত করা হয় এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অঙ্গীকার করা হয়। লীগ সেই বছরের
কোরবানীর ঈদে গরুর পরিবর্তে যথাসম্ভব অন্যান্য পশু জবাই করার জন্যে মুসলমানদের প্রতি আহŸান
জানায়। এভাবে খিলাফতকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ভিত্তি রচনায় রাজনৈতিক দলসমূহ সচেষ্ট
হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐ বছরের (১৯১৯ খ্রি.) এপ্রিল মাসে সংঘটিত জালিয়ানওয়ালাবাগ
হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করে। এই সমস্ত কর্মকান্ডে মহাত্মা গান্ধীর
ভ‚মিকা ছিল সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। পরবর্তী সময়ে গান্ধী বলেছিলেন যে, খিলাফত এমন এক সুযোগ করে
দেয় যা আর একশত বছরেও আসবে না; সেটা হচ্ছে এই প্রমাণ করা যে মুসলমান হিন্দুর ভাই। তিনি
আরো বলেন যে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা একটা শূন্যগর্ভ বক্তব্য থেকে যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত হিন্দুরা
মুসলমানের স্বার্থ বিপন্ন হতে দেখেও দূরে সরে থাকবে।
১৯ জানুয়ারি (১৯২০) পঁয়ত্রিশ জনের একটি খিলাফত প্রতিনিধিদল ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ডাঃ
এম.এ. আনসারী ছিলেন দলের নেতা। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী, শওকত
আলী, আবুল কালাম আযাদ, ডঃ সাইফুদ্দীন কিচলু এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। স্বভাবতই ভাইসরয়ের পক্ষে
তুরস্কের ব্যাপারে কোন আশার বাণী শোনানো সম্ভব ছিল না। ফেব্রুয়ারি মাসে মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে
এক প্রতিনিধি দল ইউরোপ যাত্রা করে। ১৭ মার্চ এই দল বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জের সঙ্গে
সাক্ষাত করে। লয়েড জর্জ প্রতিনিধিদলকে বলেন যে, তুরস্কের সঙ্গে অন্যান্য পরাজিত খ্রিস্টান দেশসমূহের
চাইতে ভিন্ন রকম ব্যবহার অসম্ভব। অর্থাৎ সোজা কথায় যুদ্ধে পরাজয়ের মাশুল অন্যান্যদের মত তুর্কি
সুলতানকেও দিতে হবে। মোহাম্মদ আলী ও তাঁর দলের ইউরোপ অবস্থানকালীন সময়েই সেভ্রে চুক্তির
(ঞৎবধঃু ড়ভ ঝবাৎবং) শর্তাবলী প্রকাশিত হয় (১৫ মে, ১৯২০ খ্রি.)। এই চুক্তির মূলকথা ছিল তুর্কি সাম্রাজ্য
ভেঙ্গে দেওয়া হবে এবং আরবদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তুতি হিসেবে ম্যান্ডেট শাসনাধীনে রাখা হবে।
স্মারণা (ঝসুৎহধ) এবং থ্রেস (ঞযৎধপব) গ্রিসকে দেওয়া হয়, কন্স্টান্টিনোপল তুরস্কের অধীনে রাখা হয়।
মোহাম্মদ আলী তুর্কি সুলতানের নিকট প্রেরিত এক আবেদনের মাধ্যমে অনুরোধ করেন যাতে সুলতান
উপর্যুক্ত শর্তসমূহ গ্রহণ না করেন।
জুন (১৯২০) মাসের ১, ২ এবং ৩ তারিখে এলাহাবাদে কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির উদ্যোগে সর্বদলীয়
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেভ্রে চুক্তির মোকাবেলায় কি করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করা ছিল এই
সম্মেলনের উদ্দেশ্য। ২ জুন একটা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই কর্মসূচি
বাস্তবায়নের জন্যে একটি সাব-কমিটি গঠিত হয়- যার সদস্য ছিলেন গান্ধী এবং ছয় জন মুসলিম নেতা।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে খিলাফত আন্দোলনের এক করুণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংঘটিত হয়। প্রায় ১৮,০০০
মুসলমানÑ যাদের বেশির ভাগ ছিল সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসীÑ বৃটিশ ভারত ত্যাগ
করে মুসলিম দেশ আফগানিস্তানে হিজরত করার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু আমীর আমানুল্লাহ তাদেরকে


আফগানিস্তানে প্রবেশের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। এদের অধিকাংশ যাতায়াতের রাস্তার পাশে
মুত্যুবরণ করে।
১ আগস্ট (১৯২০) খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এই আন্দোলনের প্রতি হিন্দু
নেতৃবৃন্দের সমর্থন আদায় করার প্রয়োজন গান্ধী অনুধাবন করেন আন্দোলন শুরুর পরই। সেপ্টেম্বর মাসের
৪Ñ৮ তারিখে কংগ্রেস পার্টির কলিকাতায় অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনে তিনি এই চেষ্টায় লিপ্ত হন। মতিলাল
নেহরু ব্যতীত প্রায় সব খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন
অধিবেশনের সভাপতি লালা লাজপত রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিণ চন্দ্র পাল এবং মদনমোহন মালব্য। তবে
সম্মেলনে উপস্থিত হিন্দু-মুসলমান ডেলিগেটবৃন্দ গান্ধীকে সমর্থন করেন এবং তাঁর মতই গৃহীত হয়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল নি¤œরূপÑ
(ক) যে কোন অবৈতনিক (ঐড়হড়ৎধৎু) পদ এবং স্থানীয় সরকারসমূহের (খড়পধষ নড়ফরবং) মনোনীত
সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ;
(খ) কোন সরকারি দরবার, অনুষ্ঠান, চা-চক্র যা সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা বা তাদের সম্মানে অনুষ্ঠিত,
সে সমস্ত অনুষ্ঠান বর্জন;
(গ) সন্তানগণকে সরকারি স্কুল-কলেজ থেকে ক্রমান¦য়ে প্রত্যাহার করা এবং বিভিন্ন প্রদেশে জাতীয় শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান স্থাপন;
(ঘ) উকিল এবং মক্কেলগণ কর্তৃক বৃটিশ আদালত বর্জন এবং বেসরকারি সালিসী আদালত স্থাপন;
(ঙ) সামরিক বাহিনীর ভারতীয় সদস্যগণ, কেরাণীগণ এবং শ্রমিকগণ কর্তৃক মেসোপটেমিয়ায় কাজ করতে
অস্বীকার করা;
(চ) পরিষদের সদস্যপদ প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং কংগ্রেসের উপদেশ অগ্রাহ্য করে কেউ পদপ্রার্থী
হলে ভোটদাতাগণ কর্তৃক ভোটদানে অস্বীকৃতি;
(ছ) বিদেশী পণ্য বর্জন।
এই সময়ে এমন একটি ব্যাপারের সূত্রপাত হয় যা শুধুমাত্র খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকে প্রভাবিত
করেনি বরং পুরো হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। মূলত ঐ সময়ে গান্ধী ও
জিন্নাহ্র মধ্যকার সম্পর্কের ক্রমাবনতি এবং ভাঙ্গন ধরে। দুই নেতার মধ্যে প্রথম খোলাখুলি বিরোধের শুরু
হয় ৩ অক্টোবর (১৯২০ খ্রি.) বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত হোম রুল লীগ (ঐড়সব জঁষষ খবধমঁব)-এর বৈঠকে। হোম
রুল লীগের সভাপতি মিসেস এ্যানি বেসান্ত পদত্যাগ করলে মহাত্মা গান্ধী সেই পদে অধিষ্ঠিত হন এবং উক্ত
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এই সংগঠনকে চলমান আন্দোলনের আওতায় নিয়ে আসার জন্যে গান্ধী এর
নীতির পরিবর্তন সাধন এবং নতুন নামকরণের প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবিত নাম ছিল ‘স্বরাজ সভা'। জিন্নাহ্ এর
বিরোধিতা করেন। গান্ধী তাঁকে দেশের সম্মুখে আগত ‘নতুন জীবনে' অংশগ্রহণ করার জন্যে আহŸান
জানান। এর উত্তরে জিন্নাহ্র বক্তব্যের মধ্যে দু'জনের নীতিগত পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। জিন্নাহ বলেন, “
‘নতুন জীবন' বলতে যদি আপনি আপনার কর্মপদ্ধতি এবং কর্মসূচি বুঝিয়ে থাকেন তাহলে আমার আশঙ্কা
হচ্ছে আমি তা গ্রহণে অপারগ; কারণ আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ যে এর দ্বারা বিরাট বিপর্যয় ঘটে যাবে।
আপাতত আপনার চরম কর্মসূচি অনভিজ্ঞ, তরুণ, অজ্ঞ এবং অশিক্ষিতদের কল্পনাকে নাড়া দিতে সক্ষম
হয়েছে। এই সমস্ত কিছুর অর্থ হবে চরম অস্থিরতা ও বিশৃ´খলা।” উল্লেখযোগ্য যে, ঐ পর্যায়ে গান্ধী ও
জিন্নাহর মধ্যে অনেক বিষয়ে মতের মিল ছিল: দু'জনই স্বরাজের সমর্থক, উভয়েই চাইতেন তুর্কি সুলতানের


প্রাক-যুদ্ধকালীন মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকুক। তদুপরি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের জন্যে দায়ী ব্যক্তিগণ খুব
নগণ্য শাস্তির মাধ্যমে অব্যাহতি পেয়েছে দেখে দুই নেতাই বৃটিশ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। খিলাফতঅসহযোগের প্রশ্নেও তাঁদের মধ্যে অনেক মিল ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় মতানৈক্যের বিষয় ছিল
আন্দোলনের উপযুক্ত সময়।
জিন্নাহ মনে করতেন দেশ তখনও এত বড় আন্দোলনের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। অসময়ে আন্দোলন শুরু
করলে সরকারের ক্ষতি হবে না, বরঞ্চ আন্দোলনকারীগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন এ জাতীয়
আন্দোলনের জন্যে যতেœর সঙ্গে প্রস্তুত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বর (১৯২০ খ্রি.) মাসে
কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে এই মতানৈক্য চরমে পৌঁছে। জিন্নাহ অধিবেশন থেকে চলে আসেন। এরপর
তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখেননি।
খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনের কয়েকটি পৃথক পর্যায়ক্রম ছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে মার্চ
পর্যন্ত সময়ে জোর দেওয়া হয় ছাত্রগণ কর্তৃক স্কুল-কলেজ বর্জন এবং আইনজীবীদের আদালত বর্জনের
ওপর। এই ‘বুদ্ধিজীবী' আন্দোলন প্রাথমিকভাবে কিছু সফলতা অর্জন করে; কলিকাতা এবং লাহোরে বিরাট
আকারে ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং মতিলাল নেহরু ও চিত্তরঞ্জন দাশের মত খ্যাতনামা আইনজীবীগণ আইন
ব্যবসা ত্যাগ করেন। তবে শীঘ্র এই পর্যায়ের আন্দোলনের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
এপ্রিল মাসে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বিজয়াওয়াদা বৈঠকে মত প্রকাশ করা হয় যে, দেশ তখনও
পর্যন্ত আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য ‘যথোপযুক্তরূপে সুশৃ´খল, সংগঠিত এবং পরিপক্ক ছিল না।' এই
বৈঠকে আর একটু কম সংগ্রামী কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; সেটা ছিল তিলক স্বরাজ ফান্ডের জন্যে এক
কোটি টাকা উত্তোলন, এর জন্য এক কোটি লোককে কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা
নেওয়া হয়। জুলাইয়ের শেষ দিকে কংগ্রেস কমিটি বোম্বাইতে মিলিত হয় এবং দলের সাধারণ কর্মীদের
চাপে কিছুটা জঙ্গি মনোভাব নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তী অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে ছিল বিদেশি কাপড় বর্জন
ও প্রকাশ্যে পোড়ানো এবং নভেম্বর মাসে প্রিন্স অফ ওয়েলসের ভারত ভ্রমণ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানাদি বর্জন।
অবশ্য খাজনা না দেওয়ার মাধ্যমে পুরাদস্তর আইন অমান্য আন্দোলন তখনও স্থগিত রাখা হয়। এই সভায়
গান্ধী আহŸান জানান যে, কংগ্রেস কর্মী ও আন্দোলনের সমর্থকগণ যেন স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হয়ে কারাবাস
বরণ করে; কারণ এটাই হবে আন্দোলনের এক বড় বিজয়। এই পর্যায়ে বোম্বাইতে অসহযোগ আন্দোলন
সহিংস আকারও ধারণ করে, যে জন্য গান্ধী খুব মর্মাহত হন।
আন্দোলনের শেষ পর্যায় ছিল নভেম্বর (১৯২১ খ্রি.) থেকে ফেব্রুয়ারি (১৯২২ খ্রি.) পর্যন্ত। এই সময়ে
আন্দোলনের তোড়ে সরকার বেশ বেকায়দায় পড়ে। নভেম্বর মাসে আলী ভ্রাতৃদ্বয়কে গ্রেফতার করা হয়।
তাঁদের অপরাধ ছিল এই যে, তাঁরা জুলাই মাসে করাচী খিলাফত কনফারেন্সের বৈঠকে মুসলমানদেরকে
সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের আহŸান জানান। এতে রাগানি¦ত হয়ে হসরত মোহানীর মত খিলাফত নেতা
পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান এবং অহিংস নীতি পরিত্যাগের আহŸান জানান।
শেষ পর্যন্ত গান্ধী শুধুমাত্র বারদোলিতে খাজনা বন্ধ করার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন, যা শুরু হওয়ার কথা
ছিল ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারিতে চৌরিচৌরায় সংঘটিত সহিংসতার ফলে তিনি
সম্পূর্ণ আন্দোলন হঠাৎ বন্ধ করে দেন। উত্তর প্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরিচৌরায় আন্দোলনরত
কৃষকগণ বাইশ জন পুলিশকে পুড়িয়ে মারে। এরূপ ভয়াবহ সহিংস রূপ ধারণ করছে দেখে গান্ধী খিলাফত
ও অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন।


গান্ধীর এই আকস্মিক এবং একতরফা সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিলেন কংগ্রেসের বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা। কিন্তু
গান্ধী তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। তাঁর পক্ষে বলা যায় যে, তিনি একটি অহিংস এবং নিয়মতান্ত্রিক
আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। শ্রেণী সংগ্রাম বা সমাজ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে তিনি মোটেই উৎসাহী
ছিলেন না। তাঁর একার কথায় আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাওয়াটাও এর দুর্বলতার পরিচায়ক। এর দ্বারা প্রমাণিত
হয় যে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হলেও বিকল্প এবং বিপ্লবী নেতৃত্বের অভাব ছিল। আন্দোলন
থেমে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খিলাফতী মুসলমানগণ। এই অবস্থায় তাদের কি করণীয় তাও
তারা বুঝতে পারছিল না। খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিও
দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এভাবে ভারত ধীরে ধীরে অনৈক্য এবং সংঘাতের দিকে এগিয়ে যায়।
সারসংক্ষেপ
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বছরগুলোতে বৃটিশ ভারতের প্রধান
রাজনৈতিক ঘটনা। যুদ্ধে জার্মানির পক্ষাবলম্বনের ফলে সৃষ্ট ভাগ্য বিপর্যয়ের হাত থেকে তুর্কি সাম্রাজ্যকে
রক্ষা করা এবং মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে সুলতানের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে খিলাফত
আন্দোলন শুরু হয়। মুসলমানদের বৃটিশ বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদ
বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে মহাত্মা গান্ধী খিলাফতের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। এর ফলে
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সৃষ্টি হয় যা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যরে একটা
অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করে। তবে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃবৃন্দের মধ্যে আপোষকামিতা এবং
দ্বিধাদ্বন্দ¡ লক্ষ্য করা যায়। তদুপরি খিলাফত রক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা উত্তরোত্তর তিরোহিত হওয়ার ফলে
হতাশার সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯২২ খ্রি. ৫ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত চৌরিচৌরা সহিংসতার ফলে গান্ধী
আকস্মিকভাবে আন্দোলন বন্ধ করার ঘোষণা দেন। এতে মুসলিম খিলাফতীগণ খুবই হতাশ হন এবং
হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১. ঝ.গ. ইঁৎশব ধহফ ঝধষরস অষ-উরহ ছঁৎধরংযর, ঞযব ইৎরঃরংয জধল রহ ওহফরধ: অহ ঐরংঃড়ৎরপধষ জবারব,ি
উযধশধ, ১৯৯৫.
২. ঝঁসরঃ ঝধৎশবৎ, গড়ফবৎহ ওহফরধ, ১৮৮৫-১৯৪৭, উবষযর, ১৯৮৩.
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্য নাম ছিলÑ
(ক) ফাতেমীয় সাম্রাজ্য (খ) সেলজুর সাম্রাজ্য
(গ) উসমানীয় সাম্রাজ্য (ঘ) কোনটিই নয়।
২। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক কোন দেশের পক্ষাবলম্বন করে?
(ক) রাশিয়ার (খ) আমেরিকার
(গ) জার্মানির (ঘ) চীনের।
৩। খিলাফত আন্দোলনে খ্যাতনামা মুসলিম নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেনÑ


(ক) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (খ) মোহাম্মদ আলী
(গ) লিয়াকত আলী (ঘ) সবাই।
৪। অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান কৌশল ছিলÑ
(ক) বিদেশী পণ্য বর্জন (খ) বিদেশী শাসককে আক্রমণ
(গ) জমির খাজনা বন্ধ করা (ঘ) কোনটিই নয়।
৫। চৌরিচৌরা কোথায় অবস্থিত?
(ক) বাংলায় (খ) বিহারে
(গ) উত্তর প্রদেশে (ঘ) উড়িষ্যায়।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। তুরস্কের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের সহানুভ‚তির কারণ কি?
২। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ওপর খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব কি ছিল?
৩। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হয় কেন?
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখুন।
২। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ভ‚মিকা পর্যালোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]