মধ্যযুগে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ইতিহাসের উপাদানসমূহ Sources of Social, Cultural and Economic History of Bengal in the Middle Age

বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস-গবেষণা বাস্তবিকই চমকপ্রদ । কিন্তু এর সংকলন কার্য খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কোনো রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে গবেষণা কার্য চালানোর সময় একত্রে অসংখ্য উপাদান মেলে; কিন্তু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালাবার জন্য এ রকম কোনো সুবিধা নেই । ইতিহাসবেত্তা ও ঘটনাপঞ্জি লেখকগণ অতীতের ন্যায় এমনকি বর্তমানেও তাদের বিষয়গুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক অপেক্ষা রাজনৈতিক ইতিহাস এবং ঘটনাপঞ্জির আলোচনাতেই অধিকমাত্রায় আগ্রহ প্রদর্শন করেন। তারা শাসকগোষ্ঠী, তাঁদের রাজদরবার ও সামরিক কৃতিত্ব সম্বন্ধে লেখেন। কেবল দৈবাৎ, তারা লোকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উল্লেখ করেন। সামাজিক ইতিহাস পুনর্গঠন করার উপাদানগুলো বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। সামাজিক জীবনের উপর কোনো গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য বৃহৎ পুস্তকাদি থেকে মালমশলাগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করার নিমিত্ত সহিষ্ণুতা ও অধ্যবসায় সহকারে অনুসন্ধান চালান অত্যাবশ্যক।
অবশ্য এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের জন্য উপকরণাদি সামান্য বা অপ্রচুর । এক্ষেত্রে একজন গবেষকের জন্য নানারকম উপকরণ- উৎস রয়েছে। এগুলো বাস্তবিকপক্ষে সমকালীন ঘটনাপঞ্জির অপ্রতুলতা অনেকটা পূরণ করে। বিদেশি ভূগোলবিদ, পর্যটক, ব্যবসায়ী ও লেখকদের বর্ণনা তাদের সমকালীন বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর প্রচুর আলোকপাত করে। সেকালের আরবি, ফারসি এবং বিশেষত বাংলা সাহিত্য মুসলমান আমলে বাংলার সামাজিক বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদান জীবন প্রতিফলিত করে। 'মাকতুবাত' (পত্রাবলি) ও 'মালফুজারত' (সুফিদের বাণীসমূহের সংকলন) যেমন আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষেত্রে একটি অন্তর্দৃষ্টি দান করে, তেমনি সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার উপরও কৌতূহলজনক পরোক্ষ আলোকসম্পাত করে। উৎকীর্ণলিপি, মুদ্রা ও প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ ইত্যাদিও সামাজিক ইতিহাস সংকলনের ব্যাপারে মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে। বাংলা লোকসাহিত্য যার প্রতি সম্প্রতি পণ্ডিত ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে, সেই লোকসাহিত্যও প্রচুর প্রয়োজনীয় তথ্যের যোগান দিতে পারে। বর্তমান গ্রন্থ প্রস্তুতিতে বহু প্রকারের সমসাময়িক উৎস-উপকরণ হতে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে; স্বতন্ত্রভাবে এসব গ্রন্থের গুণাগুণ পর্যালোচনা করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে। উৎস- উপকরণসমূহের মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে এগুলোকে অবশ্য সুবিধাজনকভাবে কয়েকটি ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা চলে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কয়েকটির বিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- ফারসি ইতিহাসাবলি ও ঘটনাপঞ্জিসমূহ, ফারসি ও আরবি সাহিত্য, পর্যটক ও ভূগোলবিদদের বর্ণনা, সাধু-পুরুষদের জীবন ও কাহিনী সম্বন্ধীয় সাহিত্য, বাংলা, হিন্দি ও সংস্কৃত সাহিত্য, উৎকীর্ণলিপি বা শিলালিপি ও মুদ্রা ইত্যাদি ও আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান সংক্রান্ত রিপোর্টসমূহ।
১. ফারসি ইতিহাসাবলি ও ঘটনাপঞ্জিসমূহ
আলোচ্য যুগের জন্য ফারসি ইতিহাসাবলি ও ঘটনাপঞ্জিসমূহের উৎস- উপকরণাদির পর্যালোচনায় কয়েকটি সত্য স্মরণে রাখতে হবে। যদিও প্রায় পৌনে চার শতাব্দী জুড়ে আমাদের আলোচ্যকালের পরিধি বিস্তৃত, তথাপি এই শ্রেণির যথার্থ সমকালীন গ্রন্থের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বিশেষত মুঘল-যুগ ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলি রচনায় সমৃদ্ধশালী এবং এসব ইতিহাস প্রাক-মুঘল যুগের বাংলাদেশ সম্বন্ধে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য সরবরাহ করে। যেহেতু এ উপমহাদেশে মুঘলরাজত্বের তিন পুরুষ বাংলার স্বাধীন শাসকদের রাজত্বের শেষ শতাব্দীর সমকালীন অথবা নিকটবর্তী সময়ের, সেহেতু মুঘলদের সময়কার সংকলিত গ্রন্থাদি বাংলার স্বাধীন শাসনকর্তাদের সমসাময়িকরূপে গণ্য করা যেতে পারে। এ যুগের গ্রন্থসমূহের ঐতিহাসিক সাদৃশ্য এবং এগুলোর সময়ানুক্রমিক পর্যায়ের প্রতি লক্ষ রেখে গ্রন্থগুলোকে প্রধানত দুটো শ্রেণিতে ভাগ করা যায় : (১) প্রাক-মুঘল উৎস (২) আদি-মুঘল উৎসসমূহ। এ সকল সুপরিচিত সংকলিত গ্রন্থের কয়েকটির নাম নিম্নে দেয়া গেল ।
ক. প্রাক মুঘল উৎস : তাবাকৎ-ই-নাসিরী
: আবু উমর মিনহাজউদ্দিন শিরাজউদ্দিন আল-জুয়্যানী ।
ওসমান বিন্
কিরান আল-সাদাঈন
: আমির খসরু।
তারিখ-ই-ফিরূজ শাহী
:
জিয়াউদ্দিন বারনী ।
তারিখ-ই-ফিরূজ শাহী
:
শামস্ শিরাজ আফিফ
1
ফুতুহ্ আল-সালাতিন
:
ইসামী।
তারিক-ই-মুবারক শাহী
: ইয়াহিয়া বিন্‌ আহমদ সিরহিন্দী।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
মালতা আল-সাদাঈন
T
আবদাল রাজ্জাক।
মাসালিক আল-আফসার : ফজলুল্লাহ্ আল-উমর।
খ. আদি মুঘল-উৎস :
ওকিয়াত-ই-বাবুরী : জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবুর বাদশাহ্। তাজকিরাত-আল-ওকিয়ত : জওহর আবতাবচী ।
অকিয়ত-ই-মুশতাকী : রিজউল্লাহ মুশতাকী ।
তারিখ-ই-হুমায়ুন তারিখ-ই-শেরশাহী :
:
বায়াজিদ বিয়াত ।
আব্বাস খান শরওয়ানী।
তারিখ-ই-আকবরী : নিজামউদ্দিন আহমদ বখুশি।
আকবরনামা
25
আল্লামা আবুল ফজল।
আইন-ই-আকবরী
মুন্তাখাব আল-তাওয়ারিন : রাউদাত আল-তাহিরিন : তারিখ-ই-দাউদী
2
আল্লামা আবুল ফজল।
মোল্লা আবদুল কাদির বাদায়ুনী । তাহির মুহাম্মদ ।
:
আবদুল্লাহ।
তারিখ-ই-সালাতিন-ই-
আফগান
আমদ ইয়াজগার
মাখজান-ই-আফগান : নিয়ামতউল্লাহ ।
তারিখ-ই-ফিরিস্তা
: আবুল কাসিম হিন্দ শাহ ফিরিস্তা ।
তারিখ-ই-গুজরাট : আবদুল্লাহ্ আহমদ বিন উমর আল মক্কী ওরফে
তুজুখ-ই-জাহাঙ্গিরী ইকবালনামা-ই-জাহাঙ্গিরী : বাহারিস্তান-ই-গায়েবী
সুবা-ই-সাদিক
মিরাত-ই-আমদী
মিরাত-ই-সিকান্দরী
হাজী দবির (১৬১১)।
:
সম্রাট জাহাঙ্গীর
1
মুতামিদ খান ।
মীর্জা নাথন । মুহাম্মদ সাদিক।
আলী মুহাম্মদ খান ।
: সিকান্দর মঞ্জু।
উৎসসমূহের যথার্থ মূল্য নিরূপণ করার উদ্দেশ্যে সমসাময়িক ইতিহাসসমূহ ও ঘটনাপঞ্জিগুলোকে, এ সবের লেখকদের ভৌগোলিক সম্বন্ধীকরণের ভিত্তিতে তিনটি শ্রেণিতে পুনর্বিভাগ করাটা খুবই উপকারে আসবে। (১) এগুলোর বেশিরভাগই দিল্লির; (২) সামান্য কিছুসংখ্যক গ্রন্থ প্রদেশ বা বিদেশ থেকে; (৩) কয়েকখানি গ্রন্থ লেখা হয় বাংলাদেশে। বাংলার বিবরণ সম্বলিত দিল্লির ইতিহাসগুলোর কিছু লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। এই প্রদেশের ইতিহাস পর্যালোচনায় এসব ইতিহাস সম্রাটের মতামতই তুলে ধরেছে। সার্বভৌমত্ব ও উত্তর ভারতের সুলতানাতের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়ই এ সত্য অগ্রাহ্য হয়েছে যে, বাংলাদেশ তার এলাকার মধ্যে একটি স্বাধীন কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল ।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদান
দৃষ্টান্তস্বরূপ, বারনী ও আফিফের 'তারিখ-ই-ফিরুজ শাহী' এই সত্য গোপন করে যে, সুলতান ফিরুজ শাহ তুগলক সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে দমন করতে অসমর্থ হন। তাঁরা প্রকাশ করেন যে দিল্লি-সুলতান একডালা দুর্গের লোকদের দুঃখ- কষ্টের জন্য সহানুভূতির বশবর্তী হয়ে ইলিয়াস শাহ কর্তৃক কর দানে অঙ্গীকার করায়, তিনি তার সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করে বাংলা থেকে ফিরে যান। কিন্তু ভিজাগাপত্তম এলাকার শাসনকারী কনরাজবংশের দ্বিতীয় কোদার প্রতি উৎসর্গীকৃত একটি সংস্কৃত শ্লোক থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। কনরাজ সম্ভবত উড়িষ্যার গঙ্গ শাসকদের একজন করদ-রাজা ছিলেন। তিনি পাণ্ডুয়ার শাসনকর্তার সাহায্যার্থে আসেন এবং দিল্লির সুলতানকে পরাজিত করেন। এই অভিমত পোষণ করা হয় যে, ইলিয়াস শাহ উড়িষ্যার গঙ্গ-শাসক ও তদীয় অধীন সামন্তরাজ্য দ্বিতীয় কোদার সাহায্যপ্রাপ্ত হন এবং এদের সহায়তায় তিনি সুলতান ফিরূজ শাহ ও তার সৈন্যবাহিনীকে বাংলা পরিত্যাগ করে যেতে বাধ্য করেন। দিল্লির সমসাময়িক ব্যক্তিরাও সুলতান সেকান্দর শাহকে একজন বিদ্রোহীরূপে উল্লেখ করেন, যদিও তার পিতা শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময় থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ভোগ করে আসছিল। ‘আকবরনামা' ও অন্যান্য মুঘল ইতিহাস সুলতান সোলায়মান কররানী এবং বিশেষকরে তদীয় পুত্র দাউদখান কররানীর নিন্দা করে। অথচ বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না এবং এদেশ জয় করা তখনো বাকি ছিল।
বাংলার জলবায়ু ও স্বাস্থ্য এবং এর অধিবাসীদের সামাজিক জীবন ও রীতিনীতি সম্বন্ধে দিল্লি-ইতিহাসগুলোর বর্ণনা অনেক ক্ষেত্রেই ভ্রান্তিপূর্ণ। তাতে এই প্রদেশ সম্পর্কে তাদের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবই সূচিত করে। তারা বাংলাকে নরকরূপে ও মড়ক উৎপাদনকারী জলবায়ু পরিপূর্ণ, কারাগার-গহ্বররূপে চিত্রিত করেন। বাঙালিদেরকে তারা এমন একটি জাতি হিসেবে ভাবতেন, যাদের অদ্ভুত প্রথা- পদ্ধতি ও আচার-আচরণ ছিল। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলা যদি নরকরূপে বসবাসের অযোগ্য হয়ে থাকে যেমন সমসাময়িকদের কেউ কেউ আমাদেরকে বিশ্বাস করতে বলেন, তাহলে কিভাবে এই প্রদেশ উপমহাদেশের সবচেয়ে জনাকীর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়? যদি এর প্রকৃতি ও জলবায়ু সারাবছরব্যাপী কেবল মহামারীই সৃষ্টি করে থাকে, কিভাবে আমরা এ সত্যের কারণ নির্ণয় করতে পারি যে, সম্রাট হুমায়ুন বাংলার রাজধানী গৌড়কে জান্নাতাবাদ বা স্বর্গ নামে অভিহিত করেন। এটা উল্লেখযোগ্য যে সম্রাট হুমায়ুন বাংলার সৌন্দর্যে এতবেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, যখন তিনি এখানে বসবাস করেন, সে সময়ে তার সাম্রাজ্যের উত্তরপ্রান্তের রাজনৈতিক সমস্যাবলির কথা তিনি বেমালুম বিস্মৃত হয়ে যান। এই প্রদেশকে “বালগাক-খানা” বা দ্বন্দ্বগৃহরূপে উল্লেখ করে বারনী বাঙালিদেরকে কোন্দুলে স্বভাবের লোক বলে অভিহিত করেন। অথচ বাবরের মতে, বাংলার অধিবাসীরা তাদের বিনয় ও শান্তভাবের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। স্পষ্টতই এ বক্তব্য পরস্পর-বিরোধী এবং ভ্রমাত্মকও বটে। দিল্লির ইতিহাসগুলোর (দিল্লিতে প্রণীত) এই ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ তথ্য পরিবেশন একটা সাধারণ ঘটনা। অতএব এদের সাক্ষ্য প্রমাণের যথার্থ পরীক্ষা প্রয়োজন ।
দিল্লি ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ অবশ্য বাংলা পরিদর্শন করে প্রদেশ সম্পর্কে ব্যক্তিগত জ্ঞান অর্জন করেন। মালিকআইজুদ্দিন তুলি তুঘান খানের শাসনকর্তারূপে কাজ করার সময়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক মিনহাজ দু'বছরের জন্য (১২৪২-১২৪৪) লক্ষ্মণাবতীতে বসবাস করেন এবং ‘তবাকাত-ই-নাসিরী' রচনার উপকরণ সংগ্রহ করেন। সুতরাং ভূগোল সম্পর্কে তাঁর বর্ণনা ও অধিবাসীদের সম্বন্ধে তাঁর কিছু কিছু উল্লেখ মূল্যবান। আমীর খসরু দুবার লক্ষ্মণাবতী পরিভ্রমণ করেন। প্রথমে তিনি ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবনের অভিযানকালে নাসিরুদ্দিন বঘরা খানের অনুচরবর্গের দলে আগমন করেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে বসবাস করা পছন্দ করেননি এবং এদেশকে কারাগার গহ্বররূপে অভিহিত করেন, যদিও তার পৃষ্ঠপোষক-যুবরাজ শাসনকর্তারূপে লক্ষ্মণাবতীতে থেকে যান এবং তার সহচর কবি ও বন্ধুরা তার দরবারে অবস্থান করেন। আমির খসরুর বাংলাদেশে থাকার অনিচ্ছাটা তার গৃহকাতরতারই ফলশ্রুতি। এই প্রদেশের জলবায়ু সম্পর্কে তাদের ভীতির জন্য সেকালের উত্তর ভারতীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের (Up-country People) বাংলাদেশে বসবাস করার প্রতি একটা স্বাভাবিক বিরূপতাও এতে প্রকাশ পায়। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, প্রদেশের জলবায়ু অতটা খারাপ ছিল না, যতটা উত্তরাঞ্চলীয় সমসাময়িকরা কল্পনা করেছিল এবং এ সম্বন্ধে তাদের ভীতিও ছিল সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। আমির খসরু অবশ্য দ্বিতীয়বার বাংলা পরিভ্রমণ করেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলকের অনুচরবর্গের দলে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে। অন্য আরেকজন ইতিহাসবেত্তা, যার এই প্রদেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল, তিনি ছিলেন ‘খান খানান মুনীম খানে'র সেবক ও অনুচর বায়াজিত বিয়াত। তিনি সেখানে তাঁর রাজপ্রতিভূর মৃত্যুকাল ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বসবাস করেন। প্রধানত রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও দিল্লির ঐতিহাসিকগণ মাঝে মধ্যে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনেরও উল্লেখ করেন। এই প্রদেশের অর্থনৈতিক জীবন সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তারা এর প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির প্রশংসা করেন ও প্রদেশকে একটি অবিশ্বাস্য রকমের সম্পদশালী দেশ রূপে অভিহিত করেন। তারা রাজকর্মচারী এবং এমনকি, সাধারণ সৈনিকদেরকেও বছরখানেক কিংবা এ রকম একটা সময় পর্যন্ত চাকরি করার পর প্রচুর সোনা ও মূল্যবান দ্রব্যাদি নিয়ে উত্তর ভারতে ফিরে যেতে দেখেছেন। তাদের সাক্ষ্য প্রমাণসমূহের বেশির ভাগই পরোক্ষ উৎসের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও সমসাময়িক অন্যান্য বর্ণনায় এসবের সমর্থন মেলে। অন্যান্য প্রদেশে ও বিদেশে রচিত ইতিহাসগুলো যে-কোনো রকম রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত। কিন্তু এসব গ্রন্থের লেখকদের বাংলাদেশ সম্বন্ধে ব্যক্তিগত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা ছিল না, ফলে তাদের মন্তব্যগুলো সত্য প্রমাণিত হয়। সুলতান আলাউদ্দিন হাসানের পৃষ্ঠপোষকতাধীনে বানী রাজধানীতে রচিত ইসলামির ‘ফুতুহ-আল- সালাতিন' ও আবদুর রাজ্জাকের মালতা সাদাইন সেকালের সামাজিক জীবন সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে। তারিখ-ই-ফিরিস্তায় বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে সামান্য কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য পরিলক্ষিত হয়। গুজরাটের
১০ বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদান আরবি ইতিহাসে সামান্য সংখ্যক উল্লেখ মেলে, যা পঞ্চদশ শতকের এই প্রদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রস্ফুটিত করে। আমাদের আলোচা যুগের পক্ষে এটি একটি (বিলম্ব লিখিত গ্রন্থ হলেও) উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। এর বর্ণনা অবশ্য পূর্ববর্তী কিছু সংখ্যক সংকলনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, বর্তমানে যার অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ইবনে ফজলুল্লাহ আল উমরী কর্তৃক পারস্যদেশে লিখিত ‘মাসালিক আল আফসার’ গ্রন্থে কিছু আলোচনা পরিলক্ষিত হয়; এসব আলোচনায় জাহাজ-নির্মাণে, জলযাত্রা ও সমুদ্রে চলাচল সংক্রান্ত কার্যাবলিতে বাঙালিদের খ্যাতি প্রতিফলিত হয়েছে।
মুসলমান রাজত্বের প্রথম দিকে বাংলাদেশে কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে বলে জানা যায় না। আফগান ইতিহাসবেত্তা আবদুল্লার ‘তারিখ-ই-দাউদী' দাউদ খান কররানীর রাজদরবারে বসে লিখিত হয়েছিল বলে স্বীকার করা হলেও এই গ্রন্থটিকে সমসাময়িক কালের ধরা যেতে পারে। অন্য একজন আফগান ঐতিহাসিক আহমদ ইয়াজগার কর্তৃক প্রণীত (তারিখ-ই-শাহী নামেও অভিহিত) ‘তারিখ-ই- সালাতিন-ই-আফগানা' বাংলাদেশে লিখিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এ সমস্ত গ্রন্থে বাংলার সামাজিক জীবন সম্বন্ধে তথ্য অতি সামান্যই পাওয়া যায়। বাংলায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সৈন্যবাহিনীর একজন সাধারণ কর্মচারী মীর্জা নাথন কর্তৃক লিখিত ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের রাজত্বকালে যদিও বাংলা এবং পূর্বাঞ্চলীয় ছোট ছোট রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযানের বর্ণনাই প্রধানত এতে স্থান পেয়েছে, তথাপি যদি সতর্কতার সঙ্গে অনুসন্ধান চালিয়ে এর ইতস্ততবিক্ষিপ্ত মন্তব্যগুলো সংগ্রহ করা যায়, তাহলে ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী' সামাজিক ইতিহাসের জন্য একটি মূল্যবান উৎসরূপে প্রমাণিত হবে। সম্রাট শাহজাহানের সময়ে বাংলাদেশে আর একখানি পুস্তক প্রণীত হয়। মুহম্মদ সাদিক কর্তৃক লিখিত এ গ্রন্থটির নাম ছিল ‘সুবাহ-ই-সাদিক'। অসাধারণ বিদ্বান ও ব্যাপক ভ্রমণাভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন মুহম্মদ সাদিক-যিনি ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলায় বসবাস করেন এবং তার গ্রন্থ প্রণয়ন সম্পূর্ণ করেন ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে। বাংলার সুবাদার যুবরাজ সুজাকে উৎসর্গীকৃত তার এই গ্রন্থখানা বাংলা প্রদেশের শিক্ষা, পাণ্ডিত্য ও উচ্চ-সরকারি পদমর্যাদার জন্য খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের বর্ণনা সম্বলিত একটি অধ্যায়সহ একখানা সর্বজনীন ইতিহাস ।
আরো অন্যান্য কয়েকখানা ইতিহাস যেমন, আজাদ আল হুসেনীর ‘নওবাহার-ই- মুর্শীদকুলীখানী', করম আলীর ‘মুজাফ্ফর নামা', ইউসুফ আলীর ‘আউয়াল-ই- মহবতজঙ্গ', সলিমুল্লাহর ‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা; গোলাম হুসেন তাবাতাবাঈর ‘সিয়ার আল-মুতখেরীন' ও গুলামে হুসেন সলিমের 'রিয়াদ আল সালাতিন' ইত্যাদি বাংলাদেশে লিখিত হয়েছিল। অবশ্য এ সমুদয় গ্রন্থই পরবর্তীকালের মুর্শিদাবাদ নবাবদের আমলে অথবা এ প্রদেশের ব্রিটিশ শাসনের প্রথম যুগে লিখিত। অনেক ক্ষেত্রে, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে তাদের তথ্যসমূহ সমসাময়িক উৎসগুলোর সাক্ষ্যপ্রমাণের পরিপূরক।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]