বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস ফারসি ও আরবি সাহিত্য বিদেশি পর্যটক ও ভূগোলবেত্তাগণ

মৌলিক অথবা অনূদিত কিছু সংখ্যক আরবি ও ফারসি গ্রন্থ বাংলার মুসলমান শাসনামলে লিখিত হয়। অতীন্দ্রীয়বাদের উপর ভিত্তি করে একখানা সংস্কৃত পুস্তক ‘অমৃতকাণ্ড' ফারসি ও আরবি ভাষায় অনূদিত হয়। ‘মাকামাত’, ‘নাম-ই-হক', 'সফর নামা,' 'হেদায়েত-ই-রুমি এবং কবি ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের অন্যান্য রচনাবলি সেকালের শিক্ষা-সংস্কৃতির অগ্রগতি প্রতিভাত করে। জ্ঞান ও শিক্ষা সম্পর্কিত অধ্যায়ে এ সমস্ত গ্রন্থের গুরুত্ব আলোচিত হয়েছে।

বিদেশি পর্যটক ও ভূগোলবেত্তাগণ
বিদেশি পর্যটক ও ভূগোলবিদগণের বর্ণনাসমূহ বাংলার সামাজিক ইতিহাস পুনর্গঠনে অত্যাবশ্যক। সমসাময়িক মুসলমান ঐতিহাসিকগণ যেখানে প্রধানত রাজনৈতিক বিষয়গুলোই লিপিবদ্ধ করেন, সে স্থলে বিদেশি ভূগোলবিদ ও পর্যটকদের বেশির ভাগই ছিলেন বিচক্ষণ ও লাভজনক ব্যবসায়ের ভিত্তিতে অভিজ্ঞতার পরিমাপকারী। তাঁরা প্রদেশের বাজার-বন্দর ও উৎপন্ন দ্রব্যাদির বর্ণনায় অত্যন্ত আগ্রহ প্রদর্শন করেন। এরূপভাবে তাঁরা সামাজিক ইতিহাসের একটি প্রধান দিক অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র রেখে গেছেন। সকল ক্ষেত্রে তাঁদের বর্ণনা সঠিক নাও হতে পারে, কেননা তাঁরা সামান্য কয়েকটি স্থানমাত্র পরিদর্শন করেন এবং তাদের অবস্থানের সময়ও ছিল সংক্ষিপ্ত। এতদসত্ত্বেও তাদের বর্ণনাগুলো তথ্যের ভাণ্ডার খুলে দেয়, যা সতর্কতার সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করলে অর্থনৈতিক জীবন চিত্রণের কাঠামো নির্মাণে উপকরণাদির ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করে। এসব বর্ণনায় সে যুগের বাংলার সামাজিক অবস্থাও প্রতিফলিত হয়েছে। বিদেশিদের বর্ণনার মূল্য নিরূপণ করতে গিয়ে এটা বলা অতিরঞ্জিত হবে না যে, বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস এদের তাৎপর্যপূর্ণ রোজনামচাগুলো ব্যতিরেকে অলিখিত না থাকলেও অসম্পূর্ণ থেকে যেত ।
ভূগোলবিদদের বেশির ভাগই ছিলেন আরব ও পারস্যবাসী, যাদের বাংলা সম্পর্কে জ্ঞান প্রধানত পরোক্ষ উৎস থেকে, বিশেষত তাদের বণিক সম্প্রদায় থেকে আহৃত। তাদের বর্ণনায় আমাদের প্রধান ঔৎসুক্য এই যে, যদিও অস্পষ্ট এবং মাঝে মাঝে বিভ্রান্তিকর, তথাপি এগুলোতে বাংলার কিছুসংখ্যক সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে প্রাথমিক যুগের আরবীয়দের ব্যবসায় বাণিজ্য সম্বন্ধে বহু তথ্য পাওয়া যায়। সোলায়মান তাজির ও আবু জায়েদ শিরাফীর সিসিলাহ্ আল-তাওয়ারিখ', খুরদেবার কিতাব আল- মাসালিক', মাসুদীর ‘মুরুজ্জসাল জাহার' এবং ইদ্রিসীর ‘নুজহাত আল-মুশতাক' প্রভৃতি গ্রন্থ আমাদের গবেষণার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এগুলো এই প্রদেশের সঙ্গে প্রাথমিক যুগের আরবদের সংযোগ সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত করে। এ ছিল মুসলিম বাংলার সামাজিক জীবনের একটি প্রথম অধ্যায় যা এতকাল অজানার অন্ধকারে ঢাকা পড়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বর্ণনা হলো ইবনে বতুতা ও চীনদেশীয় দূতগণের, যারা এদেশ পরিভ্রমণ করে কেবল জ্ঞান আহরণের জন্য লোকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন সম্বন্ধে বহু মূল্যবান সংবাদ পরিবেশন করে গেছেন। মুর দেশীয়
১২ বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদান পরিব্রাজক ১৩৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দে কয়েক মাসের জন্য বাংলায় বসবাস করেন এবং তৎকালীন বাজার বন্দরে দেখা জীবনধারণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রাচুর্য ও সুলভ অবস্থার কথা বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রিত করে যান।
চীনা সম্রাটের পক্ষ থেকে কয়েকটি মিশন পঞ্চদশ শতকের প্রথম পাদে ১৪০৬ থেকে ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাণ্ডুয়ায় মুসলমান রাজদরবার পরিদর্শন করেন। প্রথমে চীনা দূতাবাসের সঙ্গে জড়িত মাহুয়ান নামক একজন মুসলমান দোভাষী এদেশের আকর্ষণীয় বস্তুনিচয় এবং অধিবাসী ও রাজদরবার ইত্যাদি সম্পর্কে বহু কিছু লিপিবদ্ধ করে গেছেন। পাণ্ডুয়া রাজদরবারে প্রেরিত চীনা মিশনগুলোর তথ্যের উপর ভিত্তি করে চীনদেশীয় লেখকগণ বাংলাদেশ সম্পর্কে নিম্নলিখিত গ্রন্থাবলি প্রণয়ন করেন।
ক. 'Ying Yai Sheng Lan' ১৪২৫ ও ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাহুয়ান
কর্তৃক রচিত ।
খ. 'Sing Cha Sheng Lan' ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দে ফা -সিন কর্তৃক প্রণীত । গ. 'Sia Yang Ch'ao Kung Tien Lu', ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে হুয়াং সিং টো ইং
কর্তৃক লিখিত ৷
ঘ. 'Shu Yu Chou Tseu La' ইয়েন কর্তৃক ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে লিখিত। চীনাদের সবগুলো বর্ণনার মধ্যে এটিই সবচেয়ে সুসম্পূর্ণ গ্রন্থ। এগ্রন্থ কেবল মিশনগুলোর তথ্যের উপরই নয় বরং অন্যান্য উৎসের উপরও ভিত্তি করে লিখিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
ঙ. 'Ming She' ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হয়। এ গ্রন্থটি একটি সরকারি
সংকলন ।
চ. "Tao-Yi-Che-Leu' ওয়াং তা-ইউয়ান কর্তৃক প্রায় ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রণীত। প্রাক-মিশন কালের একখানা প্রাথমিক গ্রন্থে, বাংলার সঙ্গে চীনদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লিখিত হয় ।
ইউরোপীয় পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বারথেমা, বারবোসা, সীজার ফ্রেডারিক ও র‍্যালফ ফিচের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইতালীয় বণিক বারথেমা ১৫০৩-১৫০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তেনাসেরিম থেকে আগমন করে বাঙ্গেলাহ-শহর পরিদর্শন করেন; সেখানে তিনি বড় বড় বণিক, প্রচুর পণ্যদ্রব্য ও ব্যাপক পরিমাণ বৈদেশিক বাণিজ্য অবলোকন করেন। পর্তুগীজ বণিক বারবোসা, যিনি ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে উপকূল বেয়ে উড়িষ্যার দিক থেকে বাংলায় প্রবেশ করেন, তিনিও বাংলাদেশে বহু সমুদ্র বন্দর ও নদী বন্দরের অস্তিত্বের উল্লেখ করেছেন। বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক হলো সুতীবস্ত্র ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যে রপ্তানি বাণিজ্যের সমৃদ্ধশালী কেন্দ্ররূপে 'বেঙ্গলাহ' শহর ও বন্দর সম্পর্কে তাঁর বর্ণনা। সীজার ফ্রেডারিক ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন এবং ইংরেজ ব্যবসায়ী র‍্যালফ ফিচ ব্যবসায়ের সম্ভাবনা অনুসন্ধানের জন্য ১৫৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে এই প্রদেশে ব্যাপক সফর করেন। কৃষি ও শিল্পদ্রব্য, শহর-বন্দর, রপ্তানি বাণিজ্য এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক স্বার্থসংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পর্কে এঁদের বর্ণনা পূর্ণাঙ্গ ছিল। এসব বর্ণনায় সামাজিক অবস্থা, প্রথা পদ্ধতি, যেমন বাল্যবিবাহ, দাসপ্রথা ইত্যাদিরও আনুষঙ্গিক উল্লেখ দেখা যায়।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
১৩
পর্তুগীজ ধর্মপ্রচারক ও পর্যটক সিবাস্তিন মনরিক্, ফরাসি চিকিৎসক ফ্রাঙ্কো বার্নিয়ার এবং ইতালীয় নাগরিক নিকোলাই মানুচীর বর্ণনা থেকে মূল্যবান তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এ দেশের সামাজিক বিধিব্যবস্থা সম্বন্ধে এদের বর্ণনায় প্রায়শই বিদ্বেষ প্রকাশ পেলেও, তা সেকালের সামাজিকতা ও অর্থনৈতিক শক্তি সামর্থ্যের উপর যথেষ্ট আলোকপাত করে। সিবাস্তিন মনরিক ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে একটি পর্তুগীজ মিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ছ'বছর কাল আরাকানে অবস্থান করেন। ১৬৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর ইউরোপ যাত্রার পথে বাংলার ও উত্তর-ভারতের মধ্য দিয়ে কান্দাহার শহর পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেন। তিনি ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে ইটিনেরারিও (ভ্রমণবৃত্তান্ত) নামে একখানা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সিবাস্তিন মনরিক্ বাংলাদেশের অধিবাসীদের ঐশ্বর্য, জমির উর্বরতা ও খাদ্য-সামগ্রীর প্রাচুর্য এবং সুলভতা দেখে হতবাক হয়ে যান। সবচেয়ে জনপ্রিয় বর্ণনা হলো উচ্চশিক্ষিত ফরাসি চিকিৎসক ও বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক ফ্রাঙ্কো বার্নিয়ারের। বার্নিয়ার ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আগমন করেন এবং এই দেশে তাঁর দীর্ঘ বারো বছর কাল অবস্থানের সময়, তিনি কয়েকজন মুঘল যুবরাজ ও আমির ওমরাহগণের অধীনে চাকরি করেন, চিকিৎসকরূপে সেবা করেন, ব্যাপকভাবে উপমহাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং সারা বাংলাদেশ ঘুরে ফিরে দেখেন। ইতালীয় নিকোলাই মানুচী বার্নিয়ারের সমসাময়িক ছিলেন এবং ১৬৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে আগমন করেন। অনেক ক্ষেত্রে তার বর্ণনা বাংলা ও উত্তর ভারতের জীবনধারা সম্বন্ধে বার্নিয়ারের পর্যবেক্ষণের পরিপূরক।
8
সাধু-দরবেশদের জীবন ও কাহিনী সংক্রান্ত সাহিত্য
সুফিদের ‘মালফুজাত’ ও ‘মাকতুবাত’ জীবনচরিত সমসাময়িক সাধু পুরুষদের জীবন ও কাহিনী সম্বন্ধীয় সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। এতে তৎকালীন বাংলার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক জীবন প্রতিফলিত। এসব সাহিত্য এই প্রদেশের মুসলমান সমাজের অগ্রগতিতে সাধু দরবেশগণের বিরাট অবদান উদ্ঘাটন করে। শাহ্ শুয়েবের ‘মনাকিব আল-আফিয়া' গ্রন্থে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের প্রারম্ভকাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিসংক্রান্ত জাগরণের ধারা প্রকাশিত হয় । তাকিউদ্দিন আরাবি এবং মাওলানা শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার আলোচনা কেন্দ্রগুলো (Seminaries) যথাক্রমে মাহিসুন ও সোনারগায়ে ইয়াহিয়া মানেরী ও শরফউদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরীর মতো প্রসিদ্ধ সুফি পণ্ডিত ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটায়। এই প্রদেশে যে সমস্ত সুফিরা ইসলামের সেবা করেন, তাঁদের বর্ণনা বৃত্তান্ত পওয়া যায় আমির খুরদের 'সিয়ার আল-আউলিয়া', (হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার একজন শিষ্য) মৌলানা জামালীর ‘সিয়ার আল- আরিফিন' (সম্রাট হুমায়ুনের সময়কার একজন সুফিপণ্ডিত), সেখ আব্দুল হক দেহলভীর আখবার আল আখিয়ার, (সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের সময়কার একজন পুণ্যাত্মা ও অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তি), আবদুর রহমান চিন্তীর ‘মীরা’ত আল-আসরার' প্রভৃতি গ্রন্থগুলোতে। মানদুবী ছিলেন একজন শাত্তারী মতের পণ্ডিত ব্যক্তি, যিনি এই উপমহাদেশের পীরদরবেশগণের জীবনী সংক্রান্ত উক্ত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। প্রথম যুগের উৎসগুলোর উপর ভিত্তি করে লিখিত গোলাম সারওয়ারের ‘খাজিনাত আল- আসাফিয়া' এবং অপেক্ষাকৃত অন্যান্য আধুনিক জীবনী গ্রন্থসমূহও সুফিদের জীবন ও
১৪ বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদান। কর্ম পর্যলোচনায় প্রয়োজনীয় উপকরণাদি সরবরাহ করে। পীর মুহাম্মদ শাত্তারীর 'রিসালাত আল-সুহাদা শাহ্ ইসমাইল গাজীর জীবন কাহিনী চিত্রিত করে। মহিউদ্দিন খাদিমের 'রিসালাহ্, জনৈক অজ্ঞাতনামা লেখকের 'রওজাত আল-সালাতিন' এবং নাসিরুদ্দিন হায়দরের 'সুহায়েল-ই-ইয়ামন' প্রভৃতি গ্রন্থাদি সিলেটের শেখ শাহজালালের
ধর্ম প্রচারকমূলক ও জনহিতকর কার্যাবলি সম্পর্কে কিছুটা উপকরণ যোগায়।
বিখ্যাত সুফিদের 'মুলফুজাত' বা ধর্মীয় উপদেশাবলি যা তাদের শিষ্যদের দ্বারা
শিক্ষার জন্য
সংকলিত হয়েছিল, সেগুলোও মুসলমানদের প্রসিদ্ধ আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দের মূল্যবান উৎসরূপে পরিগণিত। হাসান সিদ্দীর 'ফাওয়াইদ আল ফায়াদ' (শেষ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মালফুজাত) হামিদ কলন্দরের 'খায়ের আল-মজলিস' (শেষ নাসিরুদ্দিন মাহমুদ চিরাগ-ই-দিল্লির মালফুজাত), আমির খরসরুর 'আফজাল আ ফাওয়াইদ' এবং 'রফিক আল-আরিফিন' (শেখ হুসামউদ্দিন মানিকপুরীর মালফুজাত) প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ থেকে বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
কিছুসংখ্যক সুফি, কাজী, আত্মীয়-স্বজন ও শিষ্য শাগরেদের নিকট লিখিত শেখ নূর কুতবুল আলমের কয়েকখানি মাকতুবাত (পত্রাবলি) রয়েছে। এগুলো সেকালের মুসলমান সমাজের মহান আধ্যাত্মবাদ প্রতিফলিত করে। জৌনপুরের সুলতানের নিকট লিখিত হযরত মীর আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর পত্রাবলি জীবনের এই বিশেষ দিকটির প্রতি আলোকপাত করে।
e. বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য
মুসলমান আমলের বাংলা গ্রন্থাবলি সেকালের সামাজিক জীবনের উপর প্রচুর আলোকসম্পাত করে থাকে। এতে মুসলমান শাসনাধীনে বাংলাদেশে শিক্ষা ও সাহিত্যের ব্যাপক উন্নতি প্রতিফলিত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের বিরাট অবদানের কথাও এতে প্রকাশ পায়। অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবনযাপন প্রণালি ইত্যাদি প্রতিফলিত করে এ রকম বেশ কিছু পরিমাণ মূল্যবান উপকরণ এই সমস্ত গ্রন্থাবলিতে পাওয়া যায়। এই যুগে মুসলমান কবিগণ কর্তৃক বিপুল সংখ্যক পুস্তক রচিত হয়। এসব গ্রন্থাবলির মধ্যে কিছু সংখ্যকের নামোল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা', জৈনদ্দিনের 'রছুল বিজয়', মুহাম্মদ কবীরের ‘মধুমালতী' ও সৈয়াদ হুসেনের ‘ওফাতে রছুল’। এসব গ্রন্থ থেকে মুসলমানের জীবন ও তাদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সে যুগের হিন্দু কবিরা বহুসংখ্যক পুস্তক প্রণয়ন করেন। এগুলোকে সুবিধাজনকভাবে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়, যেমন- মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যকাব্য ও চণ্ডীকাব্য । এ ধরনের কাব্যে হিন্দুদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন চিত্রিত হয়েছে। মুসলমান শাসনাধীনে অর্থনৈতিক অবস্থা ও মুলমানদের সামাজিক জীবন সম্পর্কেও তা মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে থাকে। বাস্তবিক, বাংলা সাহিত্য সামাজিক ইতিহাসের উপকরণের এক মহাভাণ্ডার। বিজয়গুপ্ত, বংশীবদন, ক্ষেমানন্দ ও বিপ্রদাসের 'মনসামঙ্গল' কাব্যগুলো এবং মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ হরিরাম ও অন্যদের চণ্ডীকাব্যসমূহ মুসলমান যুগের বাংলা সমাজ সম্বন্ধে গবেষণার জন্য অপরিসীম মূল্য বহন করছে।
বহু সংস্কৃত গ্রন্থ প্রণীত হয় মুসলমানামলে। এতে মুসলমান শাসনাধীনে হিন্দু শিক্ষার অগ্রগতি প্রকাশ পেয়েছে। ‘বাংলা ভাষার উন্নতিশীর্ষক অধ্যায়ে সে যুগের সংস্কৃত গ্রন্থাবলির আলোচনা স্থান পাবে ।

উৎকীর্ণ লিপি, মুদ্রা ইত্যাদি
মুদ্রাগুলো মাঝে মাঝে ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায় উদ্ঘাটন করে দেয়। পাহাড়পুর ও ময়নামতীতে প্রাপ্ত প্রথম যুগের আরবি মুদ্রাগুলো এ প্রদেশে মুসলিম-বিজয়ের বহু শতাব্দীকাল পূর্ব থেকে বাংলার সঙ্গে মুসলমান সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম শাসনামলে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার অস্তিত্ব সে-যুগে বাংলার সমৃদ্ধির পরিচায়ক। উৎকীর্ণ লিপিগুলো বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানাদির প্রতিষ্ঠার কথা লিপিবদ্ধ করে- তাতে মুসলিম বাংলার ব্যাপক ধর্মীয় ও শিক্ষা সংক্রান্ত জীবনের প্রমাণ পওয়া যায়। গৌড় পাণ্ডুয়া ও অন্যান্য স্থানের স্মৃতিসৌধগুলো সেকালের স্থাপত্যকীর্তির নৈপুণ্য, দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা ও উন্নতি এবং নির্মাতাদের মহানুভবতার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন

I
আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান-বিষয়ক রিপোর্টসমূহ
বাংলার মুসলমান অধিবাসীদের পর্যালোচনায় ১৮৭২ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আদমশুমারির রিপোর্টসমূহ খুবই দরকারী। এগুলো বাংলার মুসলমান জনসংখ্যার উৎপত্তি ও প্রদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ সংক্রান্ত সমস্যাবলি সমাধানে সাহায্য করে থাকে। ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার ও গ্রামবাংলার বর্ষানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত ঘটনাপঞ্জিগুলো স্থানীয় ঐতিহ্যসমূহকে সযত্নে সংরক্ষণ করেছে, অন্যথায় সামাজিক ইতিহাসের কৌতূহলী গবেষক পণ্ডিতের সম্মুখ থেকে সবই বিলুপ্ত হয়ে যেত।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অতি সংক্ষেপে বলা যায় যে, বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস (নির্বাচিত বিষয়) মধ্যযুগ পর্যন্ত। তাই আলোচনার সুবিধাতে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদানসমূহ প্রাচীন ও মধ্যযুগ এ দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ছিল ভিন্ন রকমের। প্রাচীন যুগে শশাঙ্ক থেকে লক্ষ্মণসেন পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের মূল উপাদান হলো প্রাচীন লিপিমালা, কিছু কিছু ধর্ম ও সাহিত্য গ্রন্থ, বৈদেশিক বিবরণী। অন্যদিকে মধ্যযুগে অর্থাৎ সুলতানি ও মুঘল আমলে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের মূল উপাদান হলো-ফারসি ইতিহাসাবলি ও ঘটনাপঞ্জিসমূহ, ফারসি ও আরবি সাহিত্য, পর্যটক ও ভূগোলবিদদের বর্ণনা, সাধুপুরুষদের জীবন ও কাহিনী সম্বন্ধীয় সাহিত্য, বাংলা, হিন্দি ও সংস্কৃত সাহিত্য, উৎকীর্ণ লিপি বা শিলালিপি ও মুদ্রা এবং আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান সংক্রান্ত রিপোর্টসমূহ । এগুলো বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]