স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠা ঃ ইলিয়াস শাহ


স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠার পটভ‚মি
শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের পর তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর লখনৌতির সিংহাসন অধিকার করেন।
গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর কর্তৃক সিংহাসন অধিকার তাঁর ভাইদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। সর্বকনিষ্ঠ ভাই
নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই আহŸানে দিল্লির
সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলাকে পদানত করার সুযোগ পেলেন। তিনি সুযোগের পূর্ণসদ্ব্যবহার করে
১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতি আগমন করেন। লখনৌতিতে পৌঁছাবার পূর্বে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ত্রিহুত জয়
করেন ও সেখানে নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাঁর পালকপুত্র
বাহরাম খানের নেতৃত্বে লখনৌতির বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। যুদ্ধে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর পরাজিত হন
এবং পালিয়ে পূর্ব বাংলার দিকে যাবার সময় ধরা পড়েন। বাংলার মুসলিম রাজ্যের ওপর পুনরায় দিল্লির
শাসন প্রবর্তিত হয়।
বাংলা ত্যাগ করার পূর্বে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলার মুসলিম রাজ্যকে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগে
ভাগ করেন। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলার প্রশাসনিক কেন্দ্র হলো লখনৌতি। তিনি নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিমকে
এই বিভাগের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার শাসনকেন্দ্র স্থাপন করা হল সাতগাঁও-এ
এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করা হলো সোনারগাঁও-এ। উভয় বিভাগের যুক্ত
শাসনভার অর্পণ করা হয় সুলতান গিয়াসউদ্দিনের পালক পুত্র বাহরাম খানের ওপর। এভাবে প্রশাসনিক
ব্যবস্থা করে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক দিল্লির উদ্দেশ্যে লখনৌতি ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনি দিল্লিতে
পৌঁছাতে পারেননি। দিল্লির অদূরে আফগানপুরের দুর্ঘনায় সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যু হয়।
নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম কয়েক বৎসর দিল্লির অধীন শাসনকর্তা হিসেবে লখনৌতি শাসন করেন এবং সুলতান
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ও মুহাম্মদ বিন তুঘলকের নামে মুদ্রা প্রকাশ করেন। কিন্তু মুহাম্মদ বিন তুঘলক
রাজ্যভার গ্রহণ করার অল্পকাল পরেই শাসন ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন করেন। তিনি গিয়াসউদ্দিন
বাহাদুরকে মুক্তি দেন ও তাঁকে সোনারগাঁও-এর বাহরাম খানের সাথে যুগ্ম শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। যুগ্ম
শাসনকর্তা নিয়োগের মূল কারণ এই ছিল যে, একজন অপরজনকে দমিয়ে রাখতে পারবে। সুলতান মুহাম্মদ
বিন তুঘলক লখনৌতি এবং সাতগাঁও কেন্দ্রেও শাসনকর্তা পরিবর্তন করেন। লখনৌতিতে পাঠানো হয়
মালিক পিন্দর খলজীকে এবং সাতগাঁওতে পাঠানো হয় ইজ্জ্উদ্দিন ইয়াহিয়াকে। এভাবে বাংলার তিনটি
প্রশাসনিক বিভাগে ভিন্ন ভিন্ন শাসনকর্তা নিয়োগ করে হয়তো সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক বিদ্রোহের
আশঙ্কা দূর করতে চেয়েছিলেন।
গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর দিল্লির আনুগত্য মেনে কিছুদিন শাসন করেন। তিনি সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের
নামে ৭২৮ হিজরিতে (১৩২৭-২৮ খ্রি:) মুদ্রা জারি করেন। কিন্তু তিনি তাঁর নিয়োগের অন্য শর্ত অর্থাৎ
পুত্রকে দিল্লিতে প্রেরণ করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। এই বিষয়ে দিল্লির সুলতান চাপ দিলে তিনি ঐ
বৎসরই অর্থাৎ ৭২৮ হিজরিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৭২৮ হিজরিতে স্বনামে মুদ্রা জারিই তাঁর স্বাধীনতা
ঘোষণার কথা প্রমাণ করে। বিদ্রোহ ঘোষণার সাথে সাথেই বাহরাম খান তাঁর বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা
করেন। বাহাদুর পরাজিত ও নিহত হন।


ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ
বাহরাম খান যতদিন বেঁচে ছিলেন বাংলায় সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের শাসন তেমন সমস্যার সম্মুখীন
হয়নি। কিন্তু ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাহরাম খানের মৃত্যু হলে তাঁর সিলাহদার (বর্মরক্ষক) ফখ্রা স্বাধীনতা
ঘোষণা করেন এবং সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ উপাধি ধারণ করে সোনারগাঁও-এর সিংহাসন
অধিকার করেন। ফখরুদ্দিন কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণাই বাংলায় স্বাধীন সুলতানির সূচনা করে। সুলতান
মুহাম্মদ বিন তুঘলক সেই সময় তাঁর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় সুদূর
বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিতে পারেননি। তাই এর পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহ বাংলার স্বাধীনতাকে
অব্যাহত রাখে এবং ধীরে ধীরে সোনারগাঁও ছাড়া অন্যান্য কেন্দ্রেও স্বাধীনতার সূচনা করে।
ফখরুদ্দিনের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খান ও সাতগাঁওএর শাসনকর্তা ইজ্জ্উদ্দিন ইয়াহিয়া মিলিতভাবে সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। ফখরুদ্দিন পালিয়ে আত্মরক্ষা
করেন। কদর খান বহু ধনসম্পদ ও হাতি ঘোড়া হস্তগত করে সোনারগাঁও অধিকার করেন ও সেখানে থেকে
যান। ফখরুদ্দিন বর্ষার আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। বর্ষাকালে তিনি পাল্টা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে কদর
খান পরাজিত ও নিহত হন। ফখরুদ্দিন সোনারগাঁও পুনরুদ্ধার করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। মুদ্রা
প্রমাণে বলা যায় যে, ৭৩৯ হিজরি (১৩৩৮ খ্রি:) হতে ৭৫০ হিজরি (১৩৪৯ খ্রি:) পর্যন্ত ফখরুদ্দিন মোবারক
শাহ সোনারগাঁও-এ রাজত্ব করেন।
কদর খানের মৃত্যুর পর লখনৌতিতে তাঁর সেনাধ্যক্ষ (আরিজ) আলী মোবারক সুলতান আলাউদ্দিন আলী
শাহ উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুলতান ফখরুদ্দিন মুখলিস নামক তাঁর এক
সেনাপতিকে লখনৌতি আক্রমণ করতে পাঠান। কিন্তু আলী মোবারক তাকে পরাজিত করেন। এরপর প্রায়
প্রতি বছরই সোনারগাঁও ও লখনৌতির মধ্যে যুদ্ধ লেগে ছিল। কিন্তু সুলতান ফখরুদ্দিনের লখনৌতি
অধিকারের চেষ্টা সফল হয়নি। ৭৪৩ হিজরিতে (১৩৪২ খ্রি:) ইলিয়াস শাহ লখনৌতি অধিকার করেন।
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তাঁর রাজ্যসীমা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বর্ধিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সময়ই
সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম অঞ্চল মুসলমানদের শাসনাধীনে আসে। শিহাবউদ্দিন তালিশ তাঁর ইতিহাসে উল্লেখ
করেছেন যে, ফখরুদ্দিন চাঁদপুর হতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ তৈরি করেছিলেন। ফখরুদ্দিন ৭৫০
হিজরি (১৩৪৯ খ্রি:) পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং পরবর্তী সুলতান খুব সম্ভবত তাঁর পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজি
শাহ ৭৫৩ হিজরি (১৩৫২ খ্রি:) পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন বলে মুদ্রা প্রমাণ পাওয়া যায়। মুদ্রা প্রমাণে
একথাও বলা যায় যে, ঐ বৎসরই (১৩৫২ খ্রি:) ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও অধিকার করেন।
ইবনে বতুতা
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে ১৩৪৫-৪৬ খ্রি: মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায়
আসেন। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশসমূহ সফর করে তিনি প্রথমে দিল্লি ও পরে দিল্লি হতে
বাংলায় আসেন। তাঁর বাংলায় আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল সিলেট গিয়ে হযরত শাহজালালের (রা:) সাথে
সাক্ষাত করা। সিলেটে কিছুদিন অবস্থান করে তিনি নদীপথে সোনারগাঁও আসেন এবং সেখান থেকে চীনা
নৌযান যোগে জাভার পথে যাত্রা করেন।
ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তে তদানীন্তন বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। বাংলার প্রাচুর্য ও
অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ইবনে বতুতাকে অবাক করেছিলেন। তিনি বাংলার খাদ্য সামগ্রীর অল্পমূল্যে ও
সল্পব্যয়ে জীবন যাপনের কথা উল্লেখ করেছেন। আবার বাংলাদেশের হাট-বাজারে দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয়ের
কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেও এক স্বর্ণ দিনার দিয়ে আশুরা নামে একজন সুন্দরী দাসী ক্রয় করেন।
ইবনে বতুতার বর্ণনায় নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখ আছে। দেশে সুফি সাধক ও ফকিরদের বেশ
সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক দ্রব্যাদির প্রাচুর্য ও স্বল্পমূল্য আর মনোরম প্রাকৃতিক


দৃশ্যাবলী ইবনে বতুতাকে আকৃষ্ট করলেও এদেশের আবহাওয়া তাঁর পছন্দ হয়নি। অতিবৃষ্টি ও তার ফলে
আর্দ্রতা, বর্ষাকালের কর্দমাক্ত পথঘাট এবং বন্যাজনিত প্লাবনকে তিনি পছন্দ করতে পারেননি। তাই তিনি
বাংলাকে ‘দোজখপুর-আয-নিয়ামত' বা ধনসম্পদে পূর্ণ নরক বলে অভিহিত করেছেন।
ইলিয়াস শাহের উত্থান
১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করে হাজী ইলিয়াস ‘সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস
শাহ' উপাধি ধারণ করে ফিরোজাবাদের সিংহাসন অধিকার করেন। উল্লেখ্য যে, আলাউদ্দিন আলী শাহ
লখনৌতিতে ক্ষমতা দখল করে তাঁর রাজধানী ফিরোজাবাদে (পান্ডুয়া) স্থানান্তরিত করেন। ৭৪২ ও ৭৪৩
হিজরিতে (১৩৪১Ñ৪২ খ্রি:) ফিরোজাবাদ টাকশাল হতে জারিকৃত তাঁর মুদ্রা পাওয়া যায়। একই টাকশাল
হতে ৭৪৩ হিজরিতে মুদ্রিত ইলিয়াস শাহের মুদ্রাও পাওয়া গেছে। তাই বলা যায়, আলী শাহকে অপসারিত
করে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে হাজী ইলিয়াস ফিরোজাবাদের সিংহাসন অধিকার করেন। সুলতান শামসউদ্দিন
ইলিয়াস শাহের পূর্ব পরিচয় বা প্রথম জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ক্ষমতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত
তাঁর সম্বন্ধে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তার মধ্যে ঐক্য না থাকায় সঠিক ইতিহাস উদ্ধার করা কঠিন। আরবের
দুজন সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবনে হজর এবং আল-সাখাওয়াভীর মতে তিনি পূর্ব ইরানের সিজিস্তানের
অধিবাসী ছিলেন। সেখান হতে তিনি বা তাঁর পরিবার কিভাবে এই উপমহাদেশে এসেছিলেন তার কোন
উল্লেখ নেই। গোলাম হোসেন সলিম রচিত “রিয়াজ-উস-সালাতীন' গ্রন্থে তাঁর বাংলায় আগমনের কাহিনী
বর্ণিত আছে। আলী মোবারকের (যিনি লখনৌতিতে আলাউদ্দিন আলী শাহ উপাধি ধারণ করে স্বাধীনতা
ঘোষণা করেছিলেন) ধাত্রীপুত্র বা দুধ ভাই ছিলেন হাজী ইলিয়াস। উভয়েই দিল্লিতে মালিক ফিরোজ বিন
রজবের (পরে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক নামে খ্যাত) অধীনে চাকুরি করাকালীন হাজী ইলিয়াস
কোন অপকর্ম করে পালিয়ে যান। মালিক ফিরোজ ইলিয়াসকে ধরে আনার জন্য আলী মোবারককে আদেশ
দেন। আলীমোবারক ইলিয়াসকে ধরে আনতে ব্যর্থ হলে মালিক ফিরোজ তাঁকেও তাড়িয়ে দেন।আলী
মোবারক বাংলায় চলে আসেন এবংলখনৌতির শাসনকর্তা কদর খানের অধীনে চাকুরি গ্রহণকরেন। পরে
তিনি আলাউদ্দিন আলী শাহ উপাধি গ্রহণ করে লখনৌতির ক্ষমতা দখলকরেন। কিছুদিন পর হাজী ইলিয়াস
বাংলায় আসলে আলী মোবারক তাঁকে বন্দি করেন। ইলিয়াসের মাতার অনুরোধে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয় ও
পরে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করা হয়।
হাজী ইলিয়াস অল্পদিনের মধ্যেই আলী মোবারকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং সৈন্যবাহিনীকে নিজের
পক্ষে টেনে নেন। খোজাদের সাহায্যে আলী মোবারককে হত্যা করে তিনি নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেন
ও সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণ করেন। বুকাননের পান্ডুলিপিতে এই কাহিনীর প্রতিধ্বনি
পাওয়া যায়। তবে এই কাহিনীর সত্যতা নিরূপণ সম্ভব নয়। তাঁর নামের পূর্বে হাজী উল্লেখ থাকায় মনে হয়
তিনি আগেই হজ্ব করেছিলেন।
ইলিয়াস শাহ ফিরোজাবাদের সিংহাসন অধিকার করে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম বাংলার অধীশ্বর হলেন। কিন্তু
পূর্ব বাংলা (যার কেন্দ্র সোনারগাঁও) এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা (যার কেন্দ্র সাতগাঁও) তখনও তাঁর রাজ্যভুক্ত
হয়নি। এই দুই অঞ্চলে সে সময়ে যথাক্রমে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ও দিল্লির শাসন চলছিল। খুব সম্ভবত
ইলিয়াস শাহ প্রথমে সাতগাঁও-এর দিকে রাজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা করেন। ৭৪৭ হিজরিতে (১৩৪৬ খ্রি:)
সাতগাঁও টাকশাল হতে প্রকাশিত তাঁর মুদ্রা পাওয়া যায়। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, ১৩৪৬
খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কোন এক সময়ে ইলিয়াস শাহ দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা তাঁর রাজ্যভুক্ত করেন।
এরপর ইলিয়াস শাহ পূর্ব বাংলার দিকে রাজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা না করে পশ্চিম দিকে মনোনিবেশ করেন।
খুব সম্ভবত নদীমাতৃক পূর্ব বাংলা জয় সহজসাধ্য হবে না বলে এবং সেখানে ফখরুদ্দিনের সুপ্রতিষ্ঠিত শাসন
বহাল থাকায় তিনি সেই দিকে নজর দেননি। তাই পশ্চিম সীমান্তে রাজ্যজয়ে সচেষ্ট হন।


নেপাল আক্রমণ
১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ কর্তৃক নেপালে অভিযান প্রেরণের প্রমাণ পাওয়া যায়। নেপাল
রাজবংশাবলীতে ৪৬৯ নেওয়ারী সম্বৎ-এ (১৩৪৯ খ্রি:) পূর্ব দেশীয় সুলতান শামসউদ্দিনের নেপাল
আক্রমণের উল্লেখ আছে। কাঠমন্ডুর নিকটস্থ স্বয়ম্ভূনাথের মন্দিরে প্রাপ্ত শিলালিপিতে এই আক্রমণের প্রমাণ
পাওয়া যায় এবং এই লিপিতে আক্রমণের তারিখ ৪৭০ নেওয়ারী সম্বৎ (১৩৫০খ্রি:) বলে উল্লেখ আছে।
এই আক্রমণের কোন বিস্তারিত বিবরণ কোন সূত্রে নেই। এই আক্রমণের ফলে ইলিয়াস শাহ স্বরাজ্যসীমা
বৃদ্ধি না করলেও প্রচুর ধন-সম্পদ হস্তগত করে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
নেপাল জয়ের পূর্বেই হয়তো ইলিয়াস শাহ ত্রিহুতের (উত্তর বিহার অঞ্চল) কিছু অংশ জয় করেন। সেখানে
হিন্দু রাজবংশে অন্তর্বিরোধের সুযোগে ইলিয়াস শাহ খুব সম্ভবত এ অঞ্চলে কিছু সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
সোনারগাঁও জয়
১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ পূর্ব বাংলার দিকে সাফল্যজনক অভিযান করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া
যায়। সোনারগাঁও-এ ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের পর সুলতান ইখতিয়ারউদ্দিন গাজি শাহ রাজত্ব করেন
৭৫০ হিজরি হতে ৭৫৩ হিজরি (১৩৪৯Ñ১৩৫২ খ্রি:) পর্যন্ত। ৭৫৩ হিজরিতেই (১৩৫২ খ্রি:) ইলিয়াস শাহ
সোনারগাঁও অধিকার করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঐ বৎসরে সোনারগাঁও টাকশাল হতে জারিকৃত
তাঁর মুদ্রা হতে। সোনারগাঁও অধিকারের পর তিনি সমগ্র বাংলার অধিপতি হন। ইতোপূর্বে বাংলার অন্য
কোন মুসলমান সুলতান সমগ্র বাংলার সুলতান হবার গৌরব লাভ করতে পারেননি। এ কারণেই হয়তো
ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফীফ ইলিয়াস শাহকে “শাহ-ই-বাঙালাহ্' উপাধিতে ভ‚ষিত করেছেন।
সমগ্র বাংলা অধিকারের ফলে ইলিয়াসের শক্তি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। তিনি রাজ্যসীমা বাংলার বাইরে
বৃদ্ধিকল্পে অভিযান প্রেরণ করার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। “তারিখ-ই-ফিরিশতা” ও “তাবাকাৎ-ইআকবরী”র সাক্ষ্যে মনে হয় ইলিয়াস শাহ জাজনগর (উড়িষ্যা) আক্রমণ করেছিলেন। তিনি চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত
অগ্রসর হয়ে ৪৪টি হাতিসহ প্রচুর ধনসম্পদ হস্তগত করেছিলেন। এই সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর পশ্চিম
সীমান্তবর্তী প্রদেশ বিহার আক্রমণ করেন। দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক সে সময় সাম্রাজ্যের
অন্যান্য স্থানে বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে ইলিয়াস শাহ কর্তৃক পার্শ্ববর্তী প্রদেশ আক্রমণ করা
খুবই স্বাভাবিক। ত্রিহুত আক্রমণ এই সময়ে সংঘটিত হওয়াও অসম্ভব নয়।
বিহারের সাফল্য ইলিয়াস শাহের উদ্যম ও অভিলাষ বৃদ্ধি করে। তিনি আরো পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে
চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশী জয় করে এক বিরাট ভ‚-খন্ড রাজ্যভুক্ত করেন এবংবাহরাইচের শেখ মাসুদ
গাজির সমাধিতে গিয়ে দুবার নিজের শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন।
ফিরোজ তুঘলকের বাংলা অভিযান
তবে ইলিয়াস শাহের এই সাফল্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ
করে বাংলা আক্রমণ করেন। ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি এই অভিযান শুরু করেন এবং ১৩৫৪
খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরোজ তুঘলকের বাংলা অভিযানের বিবরণ
বারাণীর তারিখ-ই-ফিরোজশাহী, অফিফের তারিখ-ই-ফিরোজশাহী ও সিরাত-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থে পাওয়া
যায়। এসব সমসাময়িক সূত্রে কিছু কিছু বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও মোটামুটিভাবে যুদ্ধের বিবরণ প্রায়
একই রকম। তবে জায়গায় জায়গায় দিল্লির ঐতিহাসিকদের পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক এক বিরাট সৈন্যবাহিনী ও নৌবহর সঙ্গে নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন।
অযোধ্যা, চম্পারণ ও গোরক্ষপুরের ভিতর দিয়ে কুশী নদী অতিক্রম করে ফিরোজ বাংলায় আসেন। ফিরোজ
শাহের আগমনের খবর পেয়ে ইলিয়াস শাহ সীমান্তে বাধা প্রদানের কোন প্রকার চেষ্টা না করে ত্রিহুতের
দিকে চলে আসেন এবং পরে ত্রিহুত ত্যাগ করে রাজধানী ফিরোজাবাদে (পান্ডুয়া) আসেন। দিল্লি বাহিনী


নিকটবর্তী হলে ইলিয়াস শাহ রাজধানী প্রতিরক্ষার কোন ব্যবস্থা না করেই একডালা দুর্গেআশ্রয় নিলেন
এবংআত্মরক্ষার প্রস্তুতি করতে লাগলেন। একডালা দুর্গের অবস্থিতি সম্বন্ধে পন্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ
ছিল। তবে বর্তমানে প্রায় সকলেই মেনে নিয়েছেন যে, এই দুর্গ পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ধনজর পরগণাস্থ
একডালা গ্রামে অবস্থিত ছিল। মনে করা হয় যে, একডালা দুর্গ বিরাট এলাকা জুড়ে কাদামাটির দেয়াল দ্বারা
পরিবেষ্টিত ছিল এবং অন্যদিকে ছিল ঘন অরণ্য। ইলিয়াস শাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে, জল ও জঙ্গল ঘেরা
একডালা দুর্গ জয় করতে দিল্লির সৈন্যদের পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে এবং বর্ষাকালে এই রকম অঞ্চলে তাদের
সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম।
অতি সহজে ফিরোজ শাহ পান্ডুয়া দখল করলেন। পান্ডুয়া দখলের পর সুলতান ফিরোজ শাহ একডালা দুর্গ
অবরোধ করেন। কিন্তু জল বেষ্টিত কাদামাটি দ্বারা প্রস্তুত এই দুর্গটি জয় করা ফিরোজ শাহের সৈন্যদের
পক্ষে সহজ বলে প্রতীয়মান হল না। ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গের অভ্যন্তর হতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা
জোরদার করতে লাগলেন এবং বর্ষাকাল পর্যন্ত দিল্লির সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখলেন। তিনি জানতেন
বর্ষাকালের প্রবল বৃষ্টিপাত এবং মশার দংশন দিল্লির সৈন্যগণ সহ্য করতে পারবে না এবং বাংলা জয়ের
আশা ত্যাগ করে ফিরে যেতে বাধ্য হবে।
উভয়পক্ষের মধ্যে ছোট ছোট খন্ডযুদ্ধ হয়। কিন্তু সেগুলোর তেমন কোন চূড়ান্ত ফলাফল ছিল না। এদিকে
বর্ষাকাল সমাগত প্রায়। ফিরোজ শাহের সৈন্যরা বাংলার অবিরাম বৃষ্টিপাত এবং মশার আক্রমণে অসহ্য
যন্ত্রণার কবলে পড়ল। একদিন সুলতান ফিরোজ শাহ তাঁর সৈন্যদেরকে শিবির তুলে নিতে আদেশ করেন।
ফিরোজ শাহের সৈন্যদল পশ্চাদপসারন করেছে ভেবে ইলিয়াস শাহ তাঁর সৈন্যদল সহ দুর্গের বাইরে চলে
আসেন এবং দিল্লির বাহিনীকে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য যাত্রা করেন। ফিরোজ শাহ একডালা
দুর্গ হতে সাত ক্রোশ দূরে অবস্থান করছিলেন এবং ইলিয়াস শাহের আসার সংবাদ পেয়ে তাঁর সৈন্যদের
যুদ্ধের জায়গায় সারিবদ্ধ করেন। উভয়পক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। ইলিয়াস শাহ তেমন সাফল্য অর্জন করতে না
পেরে পুনরায় একডালায় আশ্রয় নেন।
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক একডালা দুর্গ দখল করার জন্য পুনরায় অবরোধ করেন। কিন্তু যুদ্ধে তেমন
কোন চূড়ান্ত ফলাফলের আশা না থাকায় উভয় পক্ষ সন্ধিতে সম্মত হয়। ইলিয়াস শাহের সাথে সন্ধি স্থাপন
করে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক দিলি তে ফিরে যান, পরবর্তীকালে উভয়ের মধ্যে দূত ও উপহার -
বিনিময় হয়।
ত্রিপুরা ও কামরূপ অভিযান
ইলিয়াস শাহ এর পর বিনা বাঁধায় আরো কয়েক বৎসর রাজত্ব করেন। এসময় তিনি রাজ্য বিস্তারেও প্রয়াসী
হন। এবার তিনি পূর্ব সীমান্তে মনোযোগ দেন। তিনি এ সময় ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে
সমর্থ হয়েছিলেন।
ইলিয়াস শাহ তাঁর রাজত্বের শেষদিকে কামরূপরাজকে পরাজিত করে কামরূপের কিছু অংশ জয় করেছিলেন
বলে মনে হয়। সিকান্দর শাহের রাজত্বের শুরুতেই অর্থাৎ ৭৫৯ হিজরিতে জারিকৃত একটি মুদ্রার টাকশালের
নাম ‘আওয়ালিস্তান ওরফে কামরু' পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায় সিকান্দর শাহের রাজত্বের শুরু
থেকেই কামরূপ বা তার কিয়দংশ তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিকান্দর শাহ সিংহাসনে আরোহণ করার
সঙ্গে সঙ্গে কামরূপ জয় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঐতিহাসিকদের ধারণা, সুলতান ইলিয়াস শাহই
কামরূপের কিছু অংশ জয় করেছিলেন।
কিভাবে ইলিয়াস শাহের মৃত্যু হয় সে সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। সিরাত-ই-ফিরোজ শাহী, তারিখ-ই-
মোবারকশাহী ও রিয়াজ-উস-সালাতীন-এর মতে ৭৫৯ হিজরিতে (১৩৫৮ খ্রি:) ইলিয়াস শাহের মৃত্যু হয়।
মুদ্রা প্রমাণে এই তথ্য সত্য বলে মনে হয়। ৭৫৮ হিজরি পর্যন্ত ইলিয়াস শাহের মুদ্রা পাওয়া গেছে এবং
৭৫৯ হতে তাঁর পুত্র সিকান্দর শাহের মুদ্রা পাওয়া যায়।


মূল্যায়ন
সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের নাম বাংলার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল। তিনি নিঃসন্দেহে একজন উচ্চ
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। সমরনায়ক হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয়
দিয়েছিলেন। সামান্য অবস্থা হতে স্বীয় বুদ্ধি ও সমরনীতির গুণে তিনি বাংলায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী
হয়েছিলেন। মুসলমান সুলতানদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলার অধিপতি হবার গৌরব অর্জন
করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র সমগ্র বাংলাকে এক শাসনাধীনেই আনেননি, পশ্চিম সীমান্তে সম্প্রসারণ নীতি
অনুসরণ করে তিনি ত্রিহুত, নেপাল, উড়িষ্যায় সাফল্যজনক অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি দিল্লি সাম্রাজ্যের
অধিকারে হস্তক্ষেপ করার মতো ক্ষমতা সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিহার জয় করে তিনি চম্পারণ,
কাশী ও গোরক্ষপুর পর্যন্ত ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের
আক্রমণকালে তিনি একডালা দুর্গে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং বাংলার প্রাকৃতিক অবস্থার পূর্ণ
সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। ফিরোজ শাহের সাথে যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা সঠিক না জানা গেলেও এটা স্পষ্ট যে,
ফিরোজ শাহ তাঁকে পদানত করতে পারেননি। বরঞ্চ সন্ধি স্থাপন করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ইলিয়াস শাহ তারপর যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন উভয়ের মধ্যে উপঢৌকন বিনিময় হয়েছে। দিল্লির
আক্রমণ প্রতিহত করার পর ফিরোজ শাহ তুঘলকের সাথে আমরণ মিত্রতা রক্ষা তাঁর রাজনৈতিক
দূরদর্শিতার প্রমাণ বহন করে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ত্রিপুরা রাজ্যে স্বীয় প্রভাব বিস্তার করেন এবং কামরূপ
রাজ্যের কিছু অংশ জয় করেছিলেন বলে মনে হয়। সুতরাং তাঁর অধীন বাংলায় যে নতুন উদ্যম সঞ্চারিত
হয়েছিল তার প্রভাব কেবল মাত্র বাংলার পশ্চিম সীমান্তেই পড়েনি, পূর্ব সীমান্তেও পড়েছিল।
ইলিয়াস শাহ নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তিনি সুফি ও দরবেশদের খুব সম্মান করতেন। বিশিষ্ট সুফি শাহ
শায়খ আলাউল হকের সম্মানে তিনি একটি মসজিদ তৈরি করেছিলেন। রিয়াজ-উস-সালাতীন-এ বলা
হয়েছে যে, ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক একডালা দুর্গ অবরোধকালে শায়খ বিয়াবানীর মৃত্যু হয়। ইলিয়াস
শাহ তাঁকে এতই ভক্তি করতেন যে, তিনি নিজের জীবনের প্রতি খেয়াল না করে ছদ্মবেশে দুর্গের বাইরে
আসেন এবং শায়খ বিয়াবানীর দাফনে যোগদান করেন।
স্বাধীন সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে
আছেন। সমগ্র বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তিনি রাজ্যসীমা ও প্রভাব বিস্তার
করেছিলেন। দিল্লির আক্রমণের বিরুদ্ধে স্বীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে তিনি শৌর্য ও বীর্যের প্রমাণ
দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দিল্লির সাথে সৌহার্দ্য বজায় রেখে তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইলিয়াস শাহ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান তাঁর প্রতিদ্বন্দি¡ শক্তি দিল্লির ঐতিহাসিকদের ওপর
একান্তভাবে নির্ভরশীল। ফলে তাঁর কৃতিত্বের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়, তবে নিঃসন্দেহে তাঁর পনর
বৎসরের শাসন তাঁর যোগ্যতারই পরিচয় বহন করে।
সারসংক্ষেপ
ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় স্বাধীন সুলতানির সূচনা করেন। ক্রমে সোনারগাঁও
ছাড়াও অন্যান্য কেন্দ্রেও স্বাধীনতার সূচনা হয়। ফখরুদ্দিনের রাজত্বকালে বাংলায়আসেন বিখ্যাত
পর্যটক ইবনে বতুতা। মধ্যযুগে বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায় এই পর্যটকের
ভ্রমণবৃত্তান্তে। তিনি বাংলাকে বলেন ‘ধনসম্পদে পূর্ণ নরক'। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহই
সর্বপ্রথম সমগ্র মুসলিম বাংলাকে এক শাসনের অধীনে আনেন। তিনি নেপাল, সোনারগাঁও, উড়িষ্যা
ইত্যাদি স্থানে অভিযান পরিচালনা করেন। দিল্লির সমকালীন ঐতিহাসিক তাঁকে ‘শাহ-ই-বাঙালাহ্'
উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৩-৫৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাংলা
আক্রমণকরলে ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ শাহ তাঁকে পদানত করতে
পারেননি। উভয়ের মধ্যেসন্ধি স্থাপিত হয়। এরপর ত্রিপুরা ও কামরূপেও তাঁর অভিযান চলে। স্বাধীন
সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইলিয়াস শাহ ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে
আছেন।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। কার সময়ে মুসলিম বাংলা সুস্পষ্টভাবে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগে ভাগ হয়?
(ক) মুহাম্মদ বিন তুঘলক (খ) গিয়াসউদ্দিন তুঘলক
(গ) বলবন (ঘ) আলাউদ্দিন খলজী।
২। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ কোন প্রশাসনিক কেন্দ্রে স্বাধীনতার সূচনা করেন?
(ক) সাতগাঁও (খ) সোনারগাঁও
(গ) লখনৌতি (ঘ) ফিরোজাবাদ।
৩। ইলিয়াস শাহ কোন সময়ে সোনারগাঁও অভিযান করেন?
(ক) ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দে।
৪। একডালা দুর্গকোথায় অবস্থিত?
(ক) দিনাজপুরে (খ) পান্ডুয়ায়
(গ) চট্টগ্রামে (ঘ) সিলেটে।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের বাংলা অভিযানের বর্ণনা দিন।
২। একডালা দুর্গ সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বাংলায় স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের ভ‚মিকা মূল্যায়ন করুন।
২। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের উত্থান আলোচনা করুন। কেন তাঁকে বাংলায় স্বাধীন সুলতানির
প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়?
৩। বাংলায় স্বাধীন সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইলিয়াস শাহের অবদান মূল্যায়ন করুন।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাসের দু'শো বছর ঃ স্বাধীন সুলতানের আমল।
২। আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস, সুলতানি আমল।
৩। ঔ.ঘ. ঝধৎশধৎ (বফ), ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ, ঠড়ষ-২.
৪। আবদুল মমিন চৌধুরী ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]