ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির উপর ভৌগোলিক প্রভাব
Geographical Influences on History, Society, Culture and Economy

দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে Strategic অবস্থিত বাংলা প্রাচীন যুগ থেকে ছিল একটি রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃাতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান পাদপীঠ । তিন দিকে স্থল এবং একদিকে জল (সমুদ্র) বেষ্টিত এই অঞ্চলটি ছিল একটি boiling couldron অর্থাৎ, বহু জাতির সংমিশ্রণে ক্ষেত্র এবং এজন্যই এটিকে বলা হয় melting pot অর্থাৎ, সংমিশ্রণের উপযুক্ত চারণক্ষেত্র। যুগ যুগ ধরে বিজয়ীর বেশে বহু জাতি বাংলায় এসেছে। আর্যদের আগমন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলায় প্রাক- মুসলিম ও মুসলিম যুগে যে শাসকগোষ্ঠী শাসন করেন তারা কেউই স্থানীয় জনগোষ্ঠী ছিলেন না, পাল ও সেনগণ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতবর্ষ থেকে এসেছিলেন। মুসলিম আমলে আরব, তুর্কি, আফ্রিকার হাবসী, আফগান ও মধ্য-এশিয়ার মুঘল শাসকগণ বিজাতীয় ছিলেন। একমাত্র দিনাজপুরের গণেশ বংশকে স্থানীয় বংশোদ্ভূত বলা যায়। যাহোক, জাতিগত দিক থেকে প্রকৃত বাঙালির পরিচয় দেয়া কঠিন। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তারা বাংলার মাটিতে নিজেদেরকে মানিয়ে (adjust) নিয়েছিলেন এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। এই অবদান জলবায়ু ও ভৌগোলিক প্রভাব বিশেষভাবে ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলার অধিকাংশ ভূভাগই অপেক্ষাকৃত নতুন বা নবভূমি, তবু এই নতুনের মাঝে হটুকু ঠিক নতুন নয়। আবার পশ্চিমাংশে বেশ কিছুটা প্রাচীন বা পুরাভূমিও বিদ্যমান । বাংলার পশ্চিমাংশের পুরাভূমি রাজমহলের দক্ষিণ থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত | রাজমহল, সাঁওতাল পরগণা, মানভূম-সিংভুম-ধলভূমের জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য এই পুরাভূমির অন্তর্গত। মেদিনীপুর-বাকুড়া-বর্ধমান-বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের উচ্চতর লালমাটি অঞ্চলও পুরাভূমির অংশ। বাঁকুড়া-মেদেনীপুরের কিয়দংশ রাণীগঞ্জ- আসানসোলের অংশ বিশেষ এই পুরাভূমিরই নিম্নাঞ্চল ।
বিস্তৃত
আবার এই পুরাভূমিরই একটি শাখা রাজমহলের উত্তরে গঙ্গা পেরিয়ে উত্তর বাংলার বিস্তৃত হয়েছে। বীরভূম মুর্শিদাবাদের মতোই এখানকার মাটিও লাল, স্কুল হালুময়। মালদহ-রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুরের ভিতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে তার দুই তীর যেয়ে আসামের পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়েছে লালমাটির এই রেখা। এ যেন পলিমাটি দিয়ে গড়া বাংলাদেশের উর্বর ভূমি বেষ্টন করে অনুর্বর পুরাভূমির একটা বন্ধনী। উত্তর বাংলায় এই পুরাভূমির একটা অংশ অপরাংশের চেয়ে কিছুটা উঁচু। বগুড়া, উত্তর রাজশাহী, পূর্ব দিনাজপুর আর রংপুরের পশ্চিমাঞ্চল ব্যাপী অপেক্ষাকৃত উঁচু এই এলাকাই হলো ইতিহাস প্রসিদ্ধ বরেন্দ্রভূমির কেন্দ্রস্থল ৷
বাংলার পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলের পুরাভূমির বন্ধনীটুকু বাদ দিলে আর বাদ বাকি প্রায় সবটুকু (চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চল বাদ দিয়ে) হলো নবভূমি- গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও তার উপনদীসমূহের জলে সিঞ্চিত। পশ্চিমে লাল মাটির বুক ভেদ করে নেমে এসেছে ময়ূরাক্ষী, অজয়, রূপনারায়ণ, ইতিহাস প্রসিদ্ধ কপিশা (আধুনিক কসাই) গঙ্গার বিভিন্ন উপনদীসমূহ। এদের জলে উর্বর হয়েছে পুরাভূমি সংলগ্ন সমতল ভূমি, রুক্ষ লাল মাটি হয়েছে উধাও, দেখা দিয়েছে স্তরে স্তরে জমে ওঠা পলিতে উর্বর শস্যশ্যামল নবভূমি। উত্তরে ঠিক পশ্চিমের মতোই লাল মাটি অঞ্চলকে ঘিরে আছে আত্রাই-মহানন্দা-করতোয়ার জল আর পলিমাটি দিয় গড়া ভূভাগ। আর পূর্ব বাংলার তো কথাই নেই। সিলেটের পূর্বাঞ্চল, ময়মনসিংহের মধুপুর গড়, ঢাকার ভাওয়ালের গড়, পার্বত্য ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদ দিয়ে পূর্ব বাংলার সবটুকু নবভূমি। এর মাঝে ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, ত্রিপুরার সমতলভাগ ও সিলেটের অধিকাংশ ভূমি তুলনামূলকভাবে প্রাচীন। খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমতলভূমি অঞ্চল আরো নতুন। সে জন্যই এ অঞ্চলকে বলা হয় নাব্যমণ্ডল। মধ্য ও দক্ষিণ বাংলারও একই অবস্থা। সমুদ্রের নিকটবর্তী বিরাট নদীর জলে সিঞ্চিত, নদী-নালা-খাল-বিল- জলাভূমি সমাকীর্ণ নবভূমি বৃক্ষশ্যামল, শস্যবহুল জনপদ ।
২৩ বাংলার নদ-নদী
Rivers of Bengal
নদী বাংলাদেশের প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বড় বড় নদী। ছোট বড় অনেক উপনদী এসে এসব নদীতে মিশেছে। আবার এগুলো থেকে অসংখ্য স্রোতধারায় অগণিত শাখা প্রশাখা বের
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশ, ভূপ্রকৃতি জলবায়ু, আবহাওয়া স্বভাবতই এ অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনে এবং তাদের মন-মানসিকতায় অসামান্য প্রভাব ফেলেছে। নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত এবং আর্দ্র মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রভাবান্বিত বাংলার অধিবাসীদের প্রকৃতভাবে করেছে কোমল ও শান্ত স্বভাবের। ধনধান্যে পুষ্প ভরা বাংলার মাটিতে সোনা ফলে এবং নদীর জোয়ার-ভাটার মতো বাংলার মানুষের ভাগ্য উত্থান ও পতন এই নদীর সাথে জড়িত। একদিকে প্রচুর পলিমাটি জমার ফলে নতুন নতুন চাষোপযোগী চর জেগে উঠে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সহায়ক হয়; অন্য দিকে প্লাবন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মে যেমন প্রচণ্ড গরম পড়ে, বর্ষার মৌসুমে ( monsoon) মাত্রাধিক বর্ষণের বারিপাত তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেলে শস্যের ক্ষতি হয়। বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষকরে বীরভূম-বর্ধমানের পশ্চিমাংশে এবং মেদিনীপুরের কয়েকটি অঞ্চলে গ্রীষ্মেও তাপদাহ সহ্যসীমার বাইরে চলে যায়। ষড়ঋতুর দেশ বাংলায়, যাকে প্রকৃতির ‘রঙ্গমঞ্চ' বলা হয়ে থাকে, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড গরম পড়ে। খরা ও অনাবৃষ্টিতে একদিকে যেমন কৃষিকাজ ব্যাহত হয়, অন্যদিকে কালবৈশাখী (Nor' western) ও প্লাবন-বন্যা ফসলের ক্ষতি করে। বর্ষা ঋতুতে মৌসুমি বায়ু হিমালয়, গারো, খাসিয়া ও জৈয়ন্তিয়া পাহাড়ে প্রতিহত হয়ে উত্তর ও পূর্ববঙ্গে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বারিপাত মুষলধারায় হতে থাকলে জনজীবন বিপর্যস্তই হয় না, প্রচুর ফসলের ক্ষতি হয়। সিলেটে সর্বাধিক বারিপাত হয়, এখানে গড়ে ৮০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। সমুদ্রোপকূল (mangrove forest) ও পাহাড়ের নিকটবর্তী স্থানসমূহে বারিপাতের পরিমাণ ১৫০ ইঞ্চি, শীতের মৌসুমেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে এবং শৈত্যপ্রবাহও জীবন ও ফসল উৎপাদনকে বির্যস্ত করে। তখন তাপমাত্রা ৬৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নেমে আসে।
চারদিকে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক (natural barrier) থাকায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাংলা রক্ষা পায়। যেমন পাঞ্জাব আলেকজান্ডার থেকে সুলতান মাহমুদ পর্যন্ত বৈদেশিক আক্রমণের শিকার হয়। একসময় মোঙ্গল এবং তৈমুর লং, নাদির শাহ, আহমদ শাহ আবদালীর মতো বৈদেশিক আক্রমণকারী বাংলায় প্রবেশ করতে পারেনি । বাংলার প্রাকৃতিক সীমারেখা, নদ-নদী, জলাভূমি, বৃষ্টিপাত, দীর্ঘস্থায়ী বর্ষাকাল ও আর্দ্র আবহাওয়া বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে এদেশকে রক্ষা করেছে। এগুলো স্বাভাবিক প্রতিরক্ষার কাজ করেছে। এ কারণে বাংলাদেশের জনজীবন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ধারা প্রাচীনকাল থেকে অক্ষুণ্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন ছিল। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্ব ও উত্তরে সুউচ্চ পর্বত শ্রেণি তিন দিক থেকে বাংলার প্রতিরক্ষার দেয়াল হিসেবে কাজ করলেও পশ্চিমাঞ্চলের গিরিপথ-নদী পথে ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চল থেকে বহুবার অভিযান হয়েছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলের সাথে বাংলার যোগসূত্র স্থাপিত হয় প্রধানত দুটি পথে, একটি ত্রিহুত বা উত্তর বিহারের মধ্য দিয়ে এবং অপরটি রাজমহলের নিকটবর্তী তেলিয়াগর্হির সংকীর্ণ পথ দিয়ে। বাংলায় প্রবেশের পথ ছিল বলে ত্রিহুতকে দ্বারভাঙ্গা (বিহারের একটি স্থান) বলা হতো। দ্বারভাঙ্গা উৎপত্তি হয়েছে দ্বার-ই-বংগ বা বাংলায় প্রবেশের পথ থেকে। কিন্তু ত্রিহুত দিয়ে বাংলায় আগমন
৩৪ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির উপর এর প্রভাব
সহজসাধ্য ছিল না; কারণ বহিঃশত্রুকে বাংলায় আসতে হলে কুশী, গণ্ডক প্রভৃতি খরস্রোতা নদী পার হয়ে আসতে হতো। এ কারণে ত্রিহুতের স্থলে উত্তর ভারত থেকে অভিযান মূলত তেলিয়াগর্হির সংকীর্ণ পথ ধরে পরিচালিত হয়। তেলিয়াগর্হির পথ খুব সহজ ছিল না কারণ এর একদিকে (উত্তর) বিশাল গঙ্গা নদী এবং অপরদিকে (দক্ষিণ) রাজমহলের পাহাড়শ্রেণি, বীরভূম, সাঁওতাল পরগনা, ঝাড়খণ্ড ও ময়ূরভঞ্জের বিস্তীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। এ সমস্ত কারণে বাংলায় বহিঃশত্রুর অভিযান প্রতিহত করা সম্ভব ছিল। অবশ্য সব সময় তা সফল হয়নি। অন্যথায় পাল, সেন ও মুসলিম অভিযান কখনোই সম্ভবপর হতো না। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, বৈরী আবহাওয়া, জলাবদ্ধতা প্রভৃতি কারণে উত্তর ভারতের মুসলমানগণ বাংলায় আধিপত্য স্থাপন করতে পারেননি। তুঘলক বংশের সুলতান ফিরোজ শাহ দুবার বাংলায় অভিযান করেও সুলতান ইলিয়াস শাহকে পরাজিত করতে পারেননি। সুলতান ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গে অবস্থান করে দিল্লির আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার জন্য বাংলার শাসকগণ দিল্লির আধিপত্য অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। যেমন সুলতান বলবনের শাসনামলে মুগীসুদ্দীন তুঘরিল স্বীয় নামে মুদ্রা জারি করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক শাসনামলে ফকরুদ্দীন মুবারক শাহ বাংলায় স্বাধীন রাজ্য কায়েম করলে দিল্লির সালতানাত কোন বাধা দিতে পারেনি। বাংলার প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের সুযোগে প্রাদেশিক শাসকবর্গ প্রায় দিল্লির কর্তৃত্ব অস্বীকার করে উপটোকন পাঠাতেন না। এ কারণে জিয়াউদ্দিন বারানী বাংলাকে ‘বালগাকপুর বা বিদ্রোহীদের চারণক্ষেত্র বলে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য,
বাংলার জীবনযাত্রার প্রকৃতির প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। ইবনে বতুতা এবং চীনা পর্যটকগণ যখন বাংলায় আসেন তখন বাংলার প্রাচুর্য, সম্পদ ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ইবনে বতুতা বলেন যে, খোরাসানের লোকেরা বাংলাকে বলত, ‘দোজখাস্ত-ই-পুর নিয়ামত' অর্থাৎ নিয়ামতে ভরা দোজখ'। বলবনের পুত্র নাসিরুদ্দিন মাহমুদ যখন বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে আসেন তখন তিনি এখানকার মনোরম ও স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ায় মুগ্ধ হন। সম্রাট হুমায়ুন যখন শেরশাহের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করে বাংলায় এসে গৌড়ে অবস্থান করেন (১৩৩৮ খ্রি.) তখন এই নগরীর ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য নয়নাভিরাম পরিবেশ দেখে এর নাম দেন “জান্নাতাবাদ'। বাংলায় ইউরোপীয় পর্যটক বণিকগণ এসে সন্তোষজনক বিবরণ রেখে গেছেন। তারা বলেছেন যে, বাংলায় প্রবেশের সহস্রাধিক পথ আছে কিন্তু বের হবার কোন পথ নেই অর্থাৎ এই সম্পদশালী দেশ থেকে সহজে কেউ যেতে চায় না। কিন্তু কালক্রমে গৌড়সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অস্বাস্থ্যকর ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট হুমায়ুন বাংলা থেকে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে জাহিদ খান নামক এক রাজকর্মচারীকে গৌড়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি এক পর্যায়ে সম্রাটকে জানান, 'জাঁহাপনা, মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য আপনি কি বাংলা ছাড়া অন্য কোন স্থান খুঁজে পাননি?” সম্রাট আকবর দ্বিগুণ বেতন দিয়েও সৈন্যদের বাংলায় পাঠাতে চাইলে অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার জন্য তাদের অনেকে
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
সেখানে যেতে চাননি। মহামারী, জলাবদ্ধতা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য সুসমৃদ্ধ গৌড় ও পান্ডুয়া থেকে রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তরিত হয়। শাহসুজা যখন সুবাদার নিযুক্ত হন তখন তিনি ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর থেকে রাজধানী গৌড়ের স্থলে রাজমহলে স্থাপন করেন। সম্রাট আকবরের সেনাপতি মুনিম খান প্লেগে আক্রান্ত গৌড় থেকে রাজধানী তান্ডায় নিয়ে যান। কিন্তু তার বহু সৈন্য প্লেগে মৃত্যুবরণ করে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, প্রাক-মুসলিম যুগে মৌর্য ও গুপ্ত আমলে উত্তরবঙ্গ কয়েক বছর বৈদেশিক শাসনাধীন ছিল। অনুরূপভাবে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়ের পর লক্ষ্মণাবতীতে মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে দিল্লি থেকে শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেও শাসকগণ প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। মাত্র দুবার দিল্লির সুলতান বিদ্রোহী শাসনকর্তাদের শায়েস্তা করার জন্য অভিযান করেন। গিয়াসউদ্দিন বলবন মুগীসউদ্দিন তুঘরিলের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করেন (১২৮০ খ্রি.) এবং গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ত্রিহুত ও বাংলার অভিমুখে অভিযান করেন (১৩২৪ খ্রি.)।
বাংলার ভূপ্রকৃতির উর্বর জমি, আবহাওয়া ও আর্দ্রতা বাঙালিদের জীবনে অসামান্য প্রাধান্য বিস্তার করেছে যুগ যুগ ধরে। বর্ষণের ফলে জমি উর্বর হয়েছে এবং এই উর্বর পলিমাটির জন্য ফসল বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর ভাঙা ও গড়ার খেলায় বহু নতুন চর জন্মে যেখানে পর্যাপ্ত ফসল হয়। বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছে তার জন্য বাংলার মাটি দায়ী না, দায়ী কৃত্রিম কারণ, মানুষের সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। যাহোক, সুজলা, সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলা সব সময় ছিল ফসল উৎপাদানের উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। এ কারণে চার্লস স্টুয়ার্ট বলেন, “উর্বর জমি মানুষ ও পশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল খাদ্য উৎপন্ন করে থাকে। ফসল এতে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় যে এক বছরের উৎপাদন দিয়ে এ দেশের জনগণ দুই বছর পর্যন্ত চালাতে পারে। ফলে এদেশ অতিরিক্ত উৎপাদিত দ্রব্য ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ করতে সক্ষম। অতীতে মিশর যেমন পাশ্চাত্যের শস্যাগার ছিল; বাংলাদেশও তেমনি প্রাচ্যের শস্যাগার। এখানে পশুপক্ষী ও ফলমূল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। জীবনের আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও এখানে প্রচুর মিলতো।” কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন যে, বাংলায় খনিজ পদার্থ ছিল প্রচুর যেমন সোনা, কয়লা, লোহা। কিন্তু অত্যধিক প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য এবং আর্দ্রতা বাঙালিদের অলসপ্রিয় ও অকর্মণ্য করে তোলে। তারা ক্রমে আরামপ্রিয় ও শৌখিন হয়ে পড়ে। এর ফলে বাঙালি জাতি অন্যান্য জাতিদের মতো কষ্টসহিষ্ণু ও কর্মক্ষম হতে পারেনি। বাংলার প্রাচুর্য, উর্বরতা, উৎপাদন ক্ষমতা (ধান, গম, চা, কার্পাস, তামাক, ইক্ষু) এবং অফুরন্ত অনুৎপাদিত সম্পদ যুগ যুগ ধরে বিদেশিদের এদেশে আকর্ষণ করেছে। এর ফলে পরবর্তীকালে ইউরোপীয় বণিকগণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এ দেশে আসতে থাকে এবং একসময় বণিকদের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ড থেকে এদেশে এভাবেই রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে সাম্রাজ্য স্থাপন করে।
৩৬ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির উপর এর প্রভাব
1
বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ সাহিত্যচর্চা ও শিল্পকলার উন্মেষে বিশেষ ভূমিকা। পালন করে। প্রাকৃতিক কারণে বাঙালিগণ মরমীবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে এবং প্রকৃতি ও নদীর সাথে তাদের যে আধ্যাত্মিক যোগসূত্র স্থাপিত হয় তার ফলে জারি, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বাউল গানের উৎপত্তি হয়। নদীর সাথে নৌকার সম্পর্ক নিবিড়। কারণ জলযান হিসেবে নৌকাই একমাত্র সম্বল । মাঝি-মাল্লারা যখন নদীর উত্তাল তরঙ্গে নৌকা চালায় তখন তারা বদরগাজীর স্মরণ করেন। নদী বাংলার কবি ও সাহিত্যিককে প্রভাবান্বিত করেছে বিধায় অমর সাহিত্য রচিত হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বজরায় বসে প্রাকৃতিক শোভাই উপভোগ করতেন না, কবিতাও রচনা করতেন। জাতীয় কবি নজরুল প্রকৃতপ্রেমিক ছিলেন। বাংলার ফলমূল, ফুল, লতা-পাতা ও প্রকৃতির শোভা কবি ও সাহিত্যিকদের যুগ যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করেছে। চিত্রকরদের বাংলার প্রাকৃতিক শোভা মুগ্ধ না করলে তারা অমর প্রকৃতির চিত্র (Landscape painting) অঙ্কন করতেন না। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন প্রকৃতি-প্রেমিক ছিলেন। তিনি ব্রহ্মপুত্র নদীর অনেক চিত্র অঙ্কন করে যশস্বী হয়েছেন। অন্যদিকে প্রকৃতির ধ্বংসলীলাও তাদের ব্যথিত করে। এ কারণে তারা বিশেষকরে জয়নুল আবেদীন জলোচ্ছ্বাসে (tidalbore) মৃত মানব সন্তানদের চিত্র অঙ্কন করেন তার মনপুরা স্কুলে। মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার বলেন, “যুগে যুগে এদেশে বহু সাধক পুরুষ, কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেছে। ষড়ঋতুর নানা বৈশিষ্ট্য ও রূপ ভরে দিয়েছে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। অসংখ্য নদ-নদীর প্রবহমানতা সমৃদ্ধ করেছে বাংলার সংগীতকে। বসন্তের দক্ষিণা বাতাস, শরতের মেঘমালা, শীতের কুহেলী, কালবৈশাখীর প্রমত্ত ঝড়, বর্ষার লীলায়িত ছন্দ এদেশের কবি ও সাহিত্যিককে প্রভাবিত করেছে।
শিল্পকলা, বিশেষভাবে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও অলঙ্করণের ক্ষেত্রে বাংলার প্রকৃতির অসামান্য প্রভাব লক্ষ করা যায়। দিল্লি, আগ্রা, লাহোর ও ফতেহপুর সিক্রিতে মুঘল স্থাপত্যের মূল উৎস ছিল পাথর ও মার্বেল। যার ফলে সেখানে অনিন্দ্যসুন্দর সৌধ, অট্টালিকা, মসজিদ, দুর্গ নির্মিত হয়েছে, যা আজও দর্শকদের বিমোহিত করে। কিন্তু বাংলাদেশের (অবিভক্ত) কোথাও পাথরের পাহাড় নেই। এ কারণে এদেশে গড়ে উঠেছে ইটের তৈরি ইমারত Brick and Terracotta Architecture বা পোড়া ইট ও পোড়ামাটির অলঙ্করণ বাংলার স্থাপত্যকলাকে সমৃদ্ধ করেছে। এর কারণ প্রচুর পরিমাণে যে পলিমাটি পাওয়া যায় তা দিয়ে ইট তৈরি হয়। লাল পোড়া মাটির ইটের স্থায়িত্ব বেশি দিনের না থাকায় বহু স্থাপত্য কীর্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও প্রাক- মুসলিম ও মুসলিম যুগের স্থাপত্যকলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, মহাস্থান পাহাড়পুর, ময়নামতিতে যে বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহারের যে ধ্বংস্তূপ রয়েছে তা ইটের তৈরি। পলিমাটি কাদায় নকশাকৃত ফর্মার ছাপ দিয়ে নানা ধরনের পোড়ামাটির ফলক তৈরি করা হতো, যা এখনো মহাস্থান, ময়নামতি ও পাহাড়পুরে শোভা পাচ্ছে। ইটের সাহায্যে বিশালকার যে ইমারত তৈরি করা যায় তার দৃষ্টান্ত রয়েছে মালদার

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]