পুণ্ড্রনগর (মহাস্থান) Pundranagara (Mahasthan) পাহাড়পুর Paharpur

প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহ : পুণ্ড্রনগর (মহাস্থান), পাহাড়পুর, ময়নামতী
প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পুণ্ড্রনগর (মহাস্থান), পাহাড়পুর, ময়নামতি ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো ।
৩.১ পুণ্ড্রনগর (মহাস্থান)
Pundranagara (Mahasthan)
পুণ্ড্রনগর বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগরকেন্দ্র, এর প্রাচীনত্ব চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বলে ধরে নেওয়া হয়। এ নগরের সর্বপ্রথম উল্লেখ (পুদ্‌গল) পাওয়া গেছে মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপিতে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এ স্থানের প্রাচীনত্বের নিঃসন্দেহ প্রমাণ পাওয়া যায়। পুণ্ড্রনগরের (গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগে ‘পুণ্ড্রবর্ধনপুর নামে উল্লিখিত) ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করা হয়েছে বগুড়া জেলার মহাস্থানে আবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে। এই শনাক্তীকরণের ভিত্তি হচ্ছে উপযুক্ত ব্রাহ্মী লিপি, সপ্তম শতাব্দীর চৈনিক পর্যটক ও তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং এর বিবরণ এবং আদি মধ্যযুগের সাহিত্য করতোয়া- মাহাত্ম্য। সেন আমল পর্যন্ত না হলেও মৌর্য যুগ হতে পাল আমলের শেষ অবধি পুণ্ড্রবর্ধন বিভাগের প্রশাসনিক সদর দফতর হিসেবে পুণ্ড্রবর্ধনের অবস্থান অব্যাহত ছিল। গুপ্তযুগে বাংলায় এটি ছিল তাদের শাসনের কেন্দ্র এবং পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী।
করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত পুণ্ড্রনগরের সঙ্গে জল ও স্থল পথে বাংলার অন্যান্য অংশের বেশ ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল এবং সমগ্র প্রাচীন যুগে এটি ব্যবসায়- বাণিজ্যের গুরুত্বপুর্ণ কেন্দ্র হিসেবে সমৃদ্ধ ছিল। মুসলিম যুগের প্রথম দিকেও বিখ্যাত দরবেশ শাহ সুলতান বলখী মাহীসওয়ার এর বাসস্থান হিসেবে এ নগরের গুরুত্ব অব্যাহত ছিল । শাহ সুলতান বলখী প্রাচীন নগরের দক্ষিণ-পূর্বাংশে তাঁর খানকাহ নির্মাণ করেছিলেন। নগরটি তখন সম্ভবত প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় ছিল ।
পুণ্ড্রবর্ধন প্রাচীন বাংলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদ। এর নামকরণ হয়েছে পুণ্ড্র জনগোষ্ঠীর নামানুসারে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী) প্রথমবারের মতো উপজাতি গোষ্ঠীরূপে পুণ্ড্রের উল্লেখ রয়েছে। অন্ধ্র, শবর, পুলিন্দ ও মুতিব জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে পুণ্ড্ররা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিচিত লাভ করে। অন্যান্য সাহিত্যসূত্রেও নামটি পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের বৈদিক সাহিত্যে পুণ্ড্র জাতি ও তাদের আবাসস্থল বৈদিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের বাইরে অবস্থিতির কারণে অপবিত্র হিসেবে ধিকৃত হয়।
একটি জনগোষ্ঠীর নামানুসারে গঠিত পুণ্ড্র ক্রমশ রাষ্ট্রীয় এককে পরিণত হয় । লেখতাত্ত্বিক বিচারে মৌর্য যুগের (আনু. খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক) মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপির আবিষ্কার করতোয়া নদীর ডান তীরস্থ বগুড়া জেলার মহাস্থানের সঙ্গে পুণ্ড্রনগরের শনাক্তীকরণ নিশ্চিত করেছে। পুণ্ড্রনগর ছিল একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্ৰ ।
গুপ্তযুগের পুণ্ড্রবর্ধন বা পৌণ্ড্রবর্ধন একটি গুরুত্বপুর্ণ ভুক্তি বা রাষ্ট্রীয় বিভাগে পরিণত হয়। উত্তর বঙ্গ থেকে প্রাপ্ত গুপ্ত যুগীয় লেখতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি কয়েকটি বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। বিষয়গুলো আবার কয়েকটি করে বীথি ও মণ্ডলে বিভক্ত ছিল। গুপ্ত সম্রাট কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত একজন উপরিক বা উপরিকমহারাজের (প্রাদেশিক শাসনকর্তা) উপর এ ভুক্তির শাসনভার ন্যস্ত ছিল।
দক্ষিণে পদ্মা, পশ্চিমে গঙ্গা এবং পূর্বে হয় করতোয়া অথবা যমুনা দ্বারা পরিবেষ্টিত পুণ্ড্র, পুণ্ড্রবর্ধন বা পৌণ্ড্রবর্ধন নামে আখ্যায়িত অঞ্চলটি বাংলাদেশের রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর (ভারত বাংলাদেশ উভয়ের অন্তর্গত) এবং প্রাচীন বরেন্দ্র নিয়ে গঠিত ছিল বুধগুপ্তের রাজত্বকালের (আনু. ৪৭৬-৯৪ খ্রিস্টাব্দে) দামোদরপুর তাম্রশাসন অনুসারে পুণ্ড্রবর্ধনের উত্তর-সীমা ছিল হিমালয় (হিমাবচ্ছিখর)।
পাল যুগে পুণ্ড্রবর্ধনের প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রসার লাভ করে। পাল, চন্দ্র ও সেন যুগে উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক সীমানার অতিক্রান্ত অঞ্চলসমূহ পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত হয়। শ্রীচন্দ্র এর ধুল্ল তাম্রশাসনে পুণ্ড্র ভুক্তির খদিরবিল্লি বিষয়ের বল্লিমুন্দ খণ্ডলে একটি ভূমিদানের উল্লেখ রয়েছে। বল্লিমুন্দ ও খদিরবিল্লিকে যথাক্রমে মাণিকগঞ্জ জেলার বল্লিসুদ ও কল্লি গ্রামের সাথে শনাক্ত করা হয়।
লড়হচন্দ্রের ময়নামতি ও দামোদরদেবের (১২৩৪ অব্দ) মেহর তাম্রফলক থেকে জানা যায় যে, সমতট মণ্ডল পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। শ্রীচন্দ্রের (৯৩০ অব্দ) পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্গত শ্রীহট্ট মণ্ডলের আওতাধীন গরল, পোগর ও চন্দ্রপুর বিষয়সমূহে ভূমিদানের প্রমাণ রয়েছে। অতএব বঙ্গের উত্তর পূর্ব প্রান্তে সিলেট অঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাল-সেন যুগের ভূমিদানের দলিল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভৌগোলিক দিক থেকে পূর্ববঙ্গের প্রায় সমগ্র অঞ্চলের সঙ্গে সমবিস্তৃত বঙ্গ প্রশাসনিক একক পুণ্ড্রবর্ধনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল (পৌণ্ড্রবর্ধনভুক্ত্যন্তঃ পাতিবঙ্গে বিক্রমপুরভাগে) পরবর্তীকালের রাঢ় ও দণ্ডভুক্তি সমন্বয়ে গঠিত বাংলার পশ্চিমাঞ্চল ব্যতীত প্রায় সমগ্র বাংলা পুণ্ড্রবর্ধন বা পৌণ্ড্রবর্ধনের আখ্যাধীন চলে আসে। লেখতাত্ত্বিক সূত্রের তুলনামূলক গবেষণা থেকে এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। ভাগীরথীর পূর্বাঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধনরূপে উল্লিখিত হলেও এ পশ্চিমাঞ্চল অনুরূপ নামে উল্লিখিত নয় ৷
পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি দ্বারা যখন বৃহত্তর অঞ্চল বুঝাত তখনও উত্তরবঙ্গ যে পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তিরই অন্তর্গত ছিল তা বুঝা যায়। বর্মণরাজের একটি লিপিতে কৌশি অষ্টগচ্ছ খণ্ডলের (রাজশাহীর নিকটস্থ কুসুম্ব) উল্লেখ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায় ৷
চীনের সঙ্গে মগধের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলের উপর পুণ্ড্রবর্ধনের অবস্থিতি এর গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দেয়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এতদঞ্চলে আগমনকারী চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণও এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। হিউয়েন সাং ক-চু-উ-খি-লো (রাজমহলের নিকটে কজঙ্গল) থেকে পূর্ব দিকে এক
যাত্রা শুরু করে, গঙ্গা পেরিয়ে পুন-ন-ফ-তন-ন (পুণ্ড্রবর্ধন) অঞ্চলে পৌছান। সেখান। থেকে আরো পূর্ব দিকে গমন করেন এবং কিয়-মো-লু-পো (কামরূপ) পৌঁছাতে বিশাল নদী অতিক্রম করেন। তাই কজঙ্গল থেকে পুণ্ড্রবর্ধন হয়ে কামরূপ পর্যন্ত একটি। পথ ছিল। সুতরাং মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাতে পুণ্ড্রবর্ধনের অবস্থিতি
ছিল খুব অনুকূল।
করতোয়ামাহাত্ম্য থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পুণ্ড্রনগর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থল হিসেবে বিদ্যমান ছিল। মধ্যযুগে পুণ্ড্রনগর এবং এর সঙ্গে সঙ্গে পুণ্ড্রবর্ধনও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। এ সময় অঞ্চলটি মাহস্থান নামে আখ্যায়িত হয় । প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে এ স্থানটি ইতিহাসে বিখ্যাত ।
৩.২ পাহাড়পুর
Paharpur
পাহাড়পুর প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। নিম্নে এ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তুলে ধরা হলো :
১. পাহাড়পুর প্রত্নস্থলের খননকার্য : পাহাড়পুর নওগাঁ জেলার বদলগাছি থানার অধীনস্থ পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল । পাকা সড়কের মাধ্যমে গ্রামটির নিকটস্থ রেলস্টেশন জামালগঞ্জ, জেলা শহর নওগাঁ এবং জয়পুরহাট শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষিত হচ্ছে। এ প্রত্নস্থল উত্তরবঙ্গের প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। বিস্তীর্ণ একটানা সমভূমির মাঝে এক সুউচ্চ (পার্শ্ববর্তী ভূমি থেকে প্রায় ২৪মি. উঁচু) প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ স্বভাবতই একে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। স্থানীয়ভাবে পাহাড় নামে পরিচিত লাভকারী এ ধ্বংসাবশেষের অবস্থান থেকে পাহাড়পুর নামের উৎপত্তি হয়েছে।
পূর্বভারতে জরিপ কাজ পরিচালনাকালে ১৮০৭ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে বুকানন হ্যামিল্টন সর্ব প্রথম প্রত্নস্থলটি পরিদর্শন করেন। পরবর্তীকালে ওয়েস্টম্যাকট পাহাড়পুর পরিভ্রমণে আসেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে এ স্থান পরিদর্শন করেন। তিনি এই চিবিতে ব্যাপক আকারে খনন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ জমির মালিক বলিহারের জমিদার কর্তৃক তিনি বাধাগ্রস্ত হন। ফলে বিহার এলাকার সামান্য অংশে এবং কেন্দ্রীয় ঢিবির শীর্ষভাগে সীমিত আকারে খননের কাজ চালিয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শেষোক্ত এলাকায় তিনি চারপাশে উদ্‌গত অংশযুক্ত ২২ ফুট বর্গাকার একটি ইমারত আবিষ্কার করেন। প্রত্নস্থলটি ১৯০৪ সালের পুরাকীর্তি আইনের আওতায় ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ কর্তৃক ১৯১৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ, বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক যৌথভাবে ১৯২৩ সালে সর্বপ্রথম ব্যাপক আকারে খনন শুরু হয়। এ যৌথ কার্যক্রম প্রথমে দিঘাপতিয়ার জমিদার বংশের কুমার শরৎ কুমার রায় এর
অর্থানুকূল্যে এবং ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের পশ্চিম অঞ্চলের প্রাক্তন সুপারিনটেনডেন্ট প্রফেসর ডি. আর ভাণ্ডারকরের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ সময়ে খনন কাজ বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের কয়েকটি ভিক্ষু কক্ষে এবং পার্শ্ববর্তী প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ থাকে। পরে ১৯২৫-২৬ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় ডিবির উত্তরাংশে খনন করেন। পরবর্তী মৌসুম (১৯২৬-২৭) থেকে (১৯৩৩-৩৪) সাল পর্যন্ত কাশীনাথ দীক্ষিতের নেতৃত্বে পাহাড়পুরে খনন কাজ অব্যাহত থাকে। তবে মধ্যবর্তী দুই মৌসুমে (১৯৩০-৩২) জি. সি. চন্দ্র খনন পরিচালন করেন। সর্বশেষ মৌসুম দুটিতে (১৯৩২-৩৪) কেন্দ্রীয় মন্দির থেকে ৩৬৪ মি পূর্বে সত্যপীর ভিটায় খনন করা হয়। পাকিস্তান আমলে রফিক মুগল বিহারটির পুর্ববাহুর কয়েকটি কক্ষে গভীর উৎখনন করেন। কিন্তু কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।
স্বাধীনতোত্তরকালে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক পাহাড়পুরে পুনরায় খনন কাজ পরিচালনা করা হয়। দুই পর্বের এ খননের ১ম পর্ব ১৯৮১-৮২ মৌসুমে শুরু হয় এবং ১৯৮৪-৮৫ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বিরতিসহ দ্বিতীয় পর্বের খনন কাজ ১৯৮৮- ৮১ থেকে ১৯৯০-৯১ পর্যন্ত চালু থাকে। প্রথম পর্যায়ের খননের উদ্দেশ্য ছিল দীক্ষিতে প্রতিবেদনে বর্ণিত বিহারের ভিক্ষু কক্ষে তিনটি নির্মাণ যুগের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিি হওয়া এবং প্রত্নস্থলের পূর্বের স্তরসমূহ আবিষ্কার করা। দ্বিতীয় পর্বের খনন বিহ/ অঙ্গনের সাংস্কৃতিক জঞ্জাল অপসারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ : স্বাধীনতা-পূর্ব যুগের খননের ফলে সোমপুর মহাবিহার শীর্ষক উত্তর-দক্ষিণে ২৭৪.১৫মি ও পূর্ব-পশ্চিমে ২৭৩.৭০মি পরিমাপ বিশিষ্ট এক বিরাট বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রকাণ্ড এই স্থাপনার চতুর্দিকের ১৭৭টি বাসোপযোগী কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশপথ, অসংখ্য নিবেদন-স্তূপ, ছোট ছোট মন্দির, পুষ্করিনী ও সংলগ্ন অন্যান্য নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে, মাঝে স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুউচ্চ একটি মন্দির। ধাপবিশিষ্ট এ মন্দির ক্রুশাকৃতি ভূমিপরিকল্পনায় নির্মিত। ক্রুশের প্রতি দুই বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে উদ্‌গত অংশ কৌণিকভাবে বিন্যস্ত। মন্দিরের দেয়াল গাত্রে কার্নিস, পোড়ামাটির ফলকচিত্র এবং প্রস্তর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত ।
২. বিহার : এক বিরাট চতুষ্কোণ ক্ষেত্র জুড়ে পাহাড়পুর বিহার আজ ভগ্নদশায় বিদ্যমান। বর্তমানে এর চারদিক ৫মি চওড়া এবং ৩.৬-৪.৪ মি. উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এ দেয়াল যদিও বর্তমানে বেশি উঁচু নয়; কিন্তু এদের পুরুত্ব এবং বিশালতা থেকে ধারণা করা যায় যে, সুউচ্চ কেন্দ্রীয় মন্দিরের সাথে সঙ্গতি রেখে সম্ভবত এগুলো বহুতলবিশিষ্ট ছিল। ভূমি পরিকল্পনায় এতে কক্ষসমূহ শ্রেণিবদ্ধভাবে বিন্যাস করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষের অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ৪.২৬ মি. x ৪.১১ মি.। এগুলোর সামনে আছে ২.৪৩-২.৭৪ মি. প্রশস্ত টানা বারান্দা এবং ভেতরের অঙ্গনের সাথে চারবাহুর প্রতিটির মধ্যবর্তীস্থান কক্ষগুলো ব্যতীত বিহারের ৪ বাহুতে মোট ১৭৭টি কক্ষ আছে। উত্তর বাহুতে ৪৫টি এবং অপর তিন বাহুর প্রতিটিতে ৪৪টি করে কক্ষ রয়েছে। পূর্ব পশ্চিম এবং দক্ষিণ বাহুর মধ্যবর্তী স্থান সিঁড়ি দিয়ে যুক্ত। প্রতিবাহুর মধ্যবর্তী স্থানের
৪৮ প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহ : পুণ্ড্রনগর (মহাস্থান), পাহাড়পুর, ময়নামতী
কক্ষগুলো ব্যতীত বিহারের ৪ বাহুতে মোট ১৭৭টি কক্ষ আছে। উত্তর বাহুতে ৪৫টি। এবং ৩ বাহুর প্রতিটিতে ৪৪টি করে কক্ষ রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিম এবং দক্ষিণ বাহুর মধ্যবর্তী স্থান বরাবর বহির্দেওয়ালে উদ্‌গত অংশ রয়েছে এবং অভ্যন্তরভাগে অঙ্গনের দিকে চতুর্দিকে পথসহ পাশাপাশি তিনটি কক্ষ এবং উত্তর বাহুতে একটি বিশাল আয়তনের হলঘর আছে। ৯৬নং কক্ষে তিনটি মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বশেষ (উপরের) মেঝেটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ সে.মি., দ্বিতীয়টি ১ মি. এবং সর্বনিম্নটি ৩ মি. নিচে উন্মুক্ত হয়েছে। ধারণা করা হয় যে, মেঝে ত্রয়ের এই অনুক্রম বিহারের সকল কক্ষেই বজায় রাখা হয়েছে। অবশ্য সর্বোচ্চ মেঝেটি অপসারণ করে দ্বিতীয় মেঝেটি সংরক্ষণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, বিহারের ৯২টি কক্ষে এই মেঝের উপর অলংকৃত বেদি নির্মিত হয়। মূলত কক্ষগুলো ভিক্ষুদের আবাসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু এত বেশিসংখ্যক বেদির অবস্থান থেকে ধারণা করা যায় যে, শেষ যুগে কক্ষগুলো পূজা বা প্রার্থনার জন্য ব্যবহৃত হতো। উত্তরদিকে প্রধান তোরণ ছাড়াও এ বাহুর পূর্ব কোণে অপর একটি আয়তাকারে প্রবেশ পথ ছিল। পশ্চিম ও দক্ষিণ বাহুতে অনুরূপ কোন পথের ব্যবস্থা না থাকলেও সম্ভবত পূর্ব বাহুর মধ্যস্থল বরাবর একটি ক্ষুদ্রাকার প্রবেশপথ ছিল।
কেন্দ্রীয় মন্দির ছাড়াও বিহারের উন্মুক্ত অঙ্গনে আরো অনেক ক্ষুদ্রাকার ইমারতাদির ধ্বংসাবশেষ আছে, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিভিন্ন আকার ও আয়তনের বেশ কিছু নিবেদন স্তূপ, কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি, পঞ্চমন্দির, রন্ধনশালা ও ভোজনশালা, পাকা নর্দমা এবং কূপ। কেন্দ্রীয় মন্দিরে ক্ষুদ্রাকৃতির প্রতিকৃতি বিহারের পূর্ব বাহুর কেন্দ্রীয় ব্লকের দক্ষিণে অবস্থিত। এ প্রতিকৃতিতে মন্দির পরিকল্পনাকে আরো নিখুঁত এবং সুসামঞ্জস্য করা হয়েছে। এ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলো একটি সোপান শ্রেণি। পূর্ব বাহুর কেন্দ্রস্থলে ৪মি প্রশস্ত এ সোপান শ্রেণি ৯.৭৫ মি. পর্যন্ত অঙ্গনের দিকে বিস্তৃত। এর শেষের ছয়টি সিঁড়ি পাথরের তৈরি। অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কক্ষে নং ৭৩ ও ৭৪ এর সম্মুখে বিভিন্ন আকৃতির ৫টি মন্দির দেখা যায়। মন্দিরগুলোর উপরিভাগ বিশেষভাবে কানিস রয়েছে। এগুলোর মধ্যে নক্ষত্রাকৃতির ষোল কোণ বিশিষ্ট একটি স্থাপত্য সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়। মন্দিগুলোর চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এর উত্তর দিকে একটি বড় পাতকুয়া আছে। এর অভ্যন্তরীণ ব্যাস ২.৫ মি.। রন্ধনশালা ও বৃহৎ ভোজনশালাও বিহারের এ অংশে অবস্থিত। ভোজনশালা ও রন্ধনশালার মধ্যে উত্তরদিকে প্রসারিত ৪৬মি দীর্ঘ একটি পাকা নর্দমা আছে এবং এর পশ্চিমে এক সারিতে তিনটি কূপ আছে। এগুলো সম্ভবত উভয়গৃহের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো। অঙ্গনের উত্তর-পশ্চিম অংশে কক্ষ নং ১৬২ থেকে ১৭৪ এর সম্মুখস্থ বারান্দা এলাকা থেকে ইটের দেয়াল পরিবেষ্টিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। বেষ্টনীর ভিতর থেকে পানি নির্গমনের জন্য নির্দিষ্ট ব্যবধানে বেষ্টনী দেয়ালে বেশ কিছু আয়তাকার নির্গমন গর্ত রয়েছে। এ অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি হলো একটি বর্গাকার ইটের কাঠামো যার নিম্নভাগে পানি
নিষ্কাশনের জন্য তিনটি খাত রয়েছে। খাতগুলো দেয়াল দ্বারা বিভক্ত এবং উপরিভাগ ক্রমশপূরণ পদ্ধতির মাধ্যমে (করবেল) ইট দ্বারা বন্ধ । এরূপ কাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। এখান থেকে আরো পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত উত্তম অবস্থায় বিদ্যমান একটি পাতকূয়া আছে ।
৩. কেন্দ্রীয় মন্দির : পাহাড়পুর মহাবিহারে বিশাল উন্মুক্ত অঙ্গনের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে সুউচ্চ কেন্দ্রীয় মন্দির। ২৭ বর্গমিটার স্থান জুড়ে বিস্তৃত এ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনো ভূপৃষ্ঠ থেকে ২১মি উঁচু। মন্দিরটি ক্রুশাকৃতির ভূমি পরিকল্পনায় এবং ক্রমহ্রাসমান ঊর্ধ্বগামী তিনটি ধাপে নির্মিত হয়েছে। সর্বোচ্চ কাঠামোর আকার আকৃতি সম্পর্কে আজও জানা যায়নি। ধাপের উপরিস্থিত ঊর্ধ্বমুখী শূন্যগর্ভ বর্গাকার কক্ষটিকে কেন্দ্র করেই বিশাল মন্দিরটি তার আকর্ষণীয় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে উঠেছে। এ কেন্দ্রীয় কক্ষটির চতুর্দিকের দেয়ালের গায়ে (কক্ষের চার কোণের কিছু অংশ বাদ দিয়ে) আড়াআড়ি ভাবে নতুন দেয়াল যুক্ত করে দ্বিতীয় ও প্রথম ধাপের চারদিকে ৪টি কক্ষ ও মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে। এ মন্দির পরিকল্পনার সমান্তরালে চারদিকে দেয়াল বেষ্টিত প্রদক্ষিণ পথ নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে মন্দিরটি ক্রুশের আকার ধারণ করে এবং ক্রুশের প্রতি দুই বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে অতিরিক্ত উদ্‌গত কোণসমূহের সৃষ্টি হয়। ভিত্তি পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে মন্দিরের চতুর্দিকে একটি বেষ্টনী দেয়াল আছে। এ দেয়াল কেবল উত্তর দিকের সিঁড়ির কাছে ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। মন্দিরের ভিত্তিভূমি থেকে শীর্ষদেশ পর্যন্ত সমস্ত পরিকল্পনাটি অন্যান্য যুগের ইতস্তত সংস্কার, সংযোগ বা পরিবর্তনের কাজগুলো মন্দিরের মৌলিক পরিকল্পনাকে তেমন ব্যাহত করেনি।
মন্দিরের ভিত্তিভূমির দেয়াল ৬৩টি প্রস্তর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত। মূর্তিগুলো উদ্‌গত অংশের কোণে এবং এর মধ্যবর্তী অংশে বিশেষভাবে নির্মিত কুলুঙ্গিসমূহে সংস্থাপিত হয়েছে। মন্দিরের দেয়াল ইট ও কাদার সমন্বয়ে গঠিত। দেয়ালগাত্রের বহির্ভাগ অলঙ্কৃত ইটের (পাকানো দড়ি, ধাপকৃত পিরামিড, পদ্ম পাপড়ি) উদ্‌গত কার্নিস এবং পোড়মাটির ফলকচিত্রের সারি দ্বারা অলঙ্কৃত। ভিত্তিভূমির চতুর্দিকে এর সারি এবং উপরের দুই ধাপের প্রদক্ষিণ পথের দেয়ালের চতুর্দিকে দুই সারি করে পোড়ামাটির ফলকচিত্র মন্দিরকে সুশোভিত করেছে।
পাহাড়পুরের মন্দিরের ধরনকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত বলে প্রায়শই বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে ‘সর্বোতভদ্র' হিসেবে অভিহিত এক ধরনের মন্দিরের উল্লেখ দেখা যায়। চতুর্দিকে চারটি প্রবেশপথসহ প্রতিদিকে একটি করে মণ্ডপ বিশিষ্ট একটি বর্গাকৃতির মন্দির ‘সর্বোতভদ্র' মন্দির নামে পরিচিত। পাহাড়পুর খননে আবিষ্কৃত মন্দিরটি তাই সার্বিকভাবে সর্বোতভদ্র শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত।
৪. বিহারের বহির্ভাগের স্থাপনাসমূহ : বিহারের দক্ষিণ দেয়াল থেকে ২৭ মি. দূরে ৩২ × ৮ মি. পরিমাপের একটি উন্মুক্ত মঞ্চ অবস্থিত। মঞ্চটি বিহারের বহির্দেয়ালের সমান্তরালে প্রসারিত। এটি সংলগ্ন ভূমি হতে প্রায় ৩.৫ মি. উঁচু এবং
৫০ প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহ: পুরুনগর (মহাস্থান), পাহাড়পুর, ময়নামতী
বিহারের ১০২ নং কক্ষ থেকে একটি উঁচু বাধানো পথ দিয়ে এতে যাওয়া যায়। এই উঁচু পদটি ৫ মি. প্রশস্ত। এই উঁচু পথ ও বিহার দেয়ালের মাঝখানের দেয়াল সমান্তরালে একটি ধনুকাকৃতির খিলান পথ আছে। সম্ভবত বিহারের বহির্ভাগে অবাধে যাতায়াতের জন্য এ পথ ব্যবহার করা হতো। এ যুগে ধনুক আকৃতির খিলান নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রাচীনতম ধনুক আকৃতির খিলান নির্মাণের একটি দুর্লভ উদাহরণ। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের আগমনের পূর্বের প্রাচীন ভারতে খিলান নির্মাণ কৌশল জানা ছিল। মঞ্চের দক্ষিণ দিকে ১.২ মি. ব্যবধানে সারিবদ্ধভাবে ৩০ সেনি চওড়া ও ১.৩০ মি. লম্বা অনেকগুলো পানি নিষ্কাশনী রয়েছে। মঞ্চটি সম্ভবত শোচাপার ও স্নানাগার উভয় রূপেই ব্যবহৃত হতো। স্নানঘাট বিহারের দেয়াল হতে প্রায় ৪৮ ি দূরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি স্নানঘাট আছে। এ ঘাট বিহারের দক্ষিণ দেওয়ালের হুবহু সমান্তরাল নয়, কিছুটা উত্তরমুখী। ঘাটের দুই পাশের সমান্তরাল দুটি দেয়ালে খাড়া ইট ব্যবহার করা হয়েছে এবং তা কংক্রিট দিয়ে মজবুত করা হয়েছে। ঘাটটি ৩৫ মি. প্রশস্ত এবং সর্বোচ্চ ধাপে ইটের গাঁথুনীর সাথে বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডও ব্যবহার করা হয়েছে। ঘাট ক্রমে চালু হয়ে প্রায় ১২.৫ মি. নিচে নেমে গেছে এবং সর্বশেষ স্তর চুনা পাথর দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। ঘাটে বালির এক পুরু স্তর দেখা যায়। বালির এই স্তর অতীতে এখানে কোন নদীর অস্তিত্ব নির্দেশ করে। স্থানীয় প্রবাদ এই যে, রাজা মহিদলনের কন্যা সন্ধ্যাবতী প্রতিদিন এই ঘাটে স্নান করতেন। তিনি এই ঘাটে ঐশ্বরিক উপায়ে বিখ্যাত সত্যপীরকে গর্ভে ধারণ করেন।
গন্ধেশ্বরী মন্দির স্নানঘাট থেকে প্রায় ১২.২ মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত স্থাপত্য নিদর্শনটিকে স্থানীয়ভাবে গন্ধেশ্বীর মন্দির বলা হয়। মন্দিরের সম্মুখ দেয়ালে ব্যবহৃত ইটে পদ্ম ও অন্যান্য ফুলের প্রতিকৃতি এবং গাঁথুনীতে ব্যবহৃত উপাদান থেকে মনে হয় মুসলমান যুগের প্রথমদিকে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি ৬.৭ মি. দীর্ঘ ৩.৫ মি. প্রস্থ বিশিষ্ট একটি চতুষ্কোণ হলঘর এবং হলঘরের প্রায় মধ্যস্থলে ইট নির্মিত অষ্ট কোণাকার একটি স্তম্ভের নিম্নাংশ রয়েছে। মন্দিরটি পশ্চিম দেয়াল থেকে বাইরের দিকে বাড়ানো ১.৫ মি. বর্গাকৃতির ছোট কক্ষটি পূজার স্থান ছিল। তাছাড়া হলঘরের চারটি কুলঙ্গিতেও মূর্তি স্থাপনের ব্যবস্থা আছে। মন্দিরের সামনে ৭.৩ মি. ব্যস বিশিষ্ট একটি চতুর আছে। এই চত্বরের মেঝে খাড়া দিয়ে গাঁথা।
৫. স্বাধীনতোত্তর কালের খনন : বিহারের কক্ষে দীক্ষিতের আবিষ্কৃত মেঝে ছাড়াও স্বাধীনতোত্তর কালের খননে দুটি নতুন এবং অপ্রত্যাশিত নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে। প্রথমত দীক্ষিতের মূল বিহারের নিচে অপর এক যুগের বিহারের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা সম্ভবত বিহারের প্রথম যুগের সাথে সম্পৃক্ত। ধারণা করা হয় যে, বিহারের আয়তন একই ছিল এবং বহির্দেয়াল ও সম্মুখ দেয়াল একই সারিতে বিদ্যমান ছিল। নির্মাতারা বেশ কিছু সময় প্রথমযুগে এ বিহার ব্যবহার করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে প্রথম যুগের মেঝে অপসারণ করে ও কক্ষ বিভাজিকা দেয়াল নষ্ট করে নুতন দেওয়াল নির্মাণ এবং ভিক্ষু কক্ষসমূহের বিন্যাসে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এ
পুনর্নির্মাণকালে তারা পূর্ববর্তী বিভাজিকা (পার্টিশন) দেয়াল ধ্বংস করে সম্পূর্ণ নতুন দেয়াল নির্মাণ করে অথবা পুরাতন দেয়ালের উপরের অংশ অপসারণ করে নিম্নাংশের উপর নতুন দেয়াল নির্মাণ করে। পূর্ববর্তী যুগের কক্ষগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ছিল ৪.৮৭×৩.৯৬ মি.। ফলে সম্পূর্ণরূপে প্রতিভাত হয় যে মূল বিহারের কক্ষগুলো আয়তনে পরবর্তী কালের বিহার বা দীক্ষিতের প্রথম যুগের বিহারের কক্ষগুলোর চেয়ে বড় ছিল। ফলে পরবর্তীকালে বিহারের কক্ষ সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ।
দ্বিতীয়ত, সামান্য কিছু এলাকায় বিহার এবং মন্দিরের নিচে স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ (ইটের দেয়াল, পোড়ামাটির কুয়া) এবং সাংস্কৃতিক দ্রব্যাদি (প্রচুর পরিমাণ মৃৎপাত্রের টুকরা) উন্মোচিত হয়েছে। দেয়ালগুলোর সাথে মন্দির বা বিহারের স্থাপত্যিক কাঠামোর কোন সম্পর্ক নেই। খুবই সীমিত পরিসরে দেয়ালগুলো উন্মোচিত হওয়ায় এদের প্রকৃতি সম্পর্কে কোন ধারণা করা যায় না। উল্লেখ্য যে, দীক্ষিত বিহারে ভিক্ষু কক্ষগুলোতে তিনটি এবং কেন্দ্রীয় মন্দিরে চারটি যুগের নিদর্শন আবিষ্কার করেছিলেন। সাম্প্রতিক খননে বিহারে আরো একটি যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ায় বিহারের ৪ যুগের সাথে মন্দিরের ৪ যুগের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হলো সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত প্রথম যুগের বিহার এবং দীক্ষিতের আবিষ্কৃত বিহারের মধ্যে কোনটি ধর্মপাল নির্মাণ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা খুবই প্রয়োজন যে, দীক্ষিত মনে করতেন মূলত পাহাড়পুরে একটি জৈন বিহার ছিল যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। এই জৈন প্রতিষ্ঠানটির উপর পরবর্তীকালে ধর্মপাল কর্তৃক সোমপুর মহাবিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। দীক্ষিতের এই মত পরবর্তী অনেক গবেষক সমর্থন করেছেন। সুতরাং দীক্ষিতের আবিষ্কৃত বিহারের নিচে সম্প্রতি উন্মোচিত ধ্বংসাবশেষ জৈন বিহারের অংশ কি না তা বিহারের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক খননের পরই নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে ।
৬. অস্থাবর প্রত্নবস্তু : পাহাড়পুর বিহার থেকে আবিষ্কৃত অস্থাবর প্রত্নবস্তুসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রস্তর ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, তাম্রশাসন, উৎকীর্ণ লিপিসহ প্রস্তরখণ্ড, মুদ্রা, চুনাবালির মূর্তি, ধাতব মূর্তি, মৃৎপাত্রের টুকরা ইত্যাদি ।
ক. প্রস্তরমূর্তি : মন্দিরের চতুর্দিকে বেষ্টন করে ৬৩টি প্রস্তর মূর্তি আছে। বৌদ্ধ দেবতা পদ্মপাণির মূর্তি ছাড়া আবিষ্কৃত অন্য সব মূর্তিগুলো হিন্দু দেবদেবীর। এই বিরাট বৌদ্ধ বিহারে এতগুলো ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর মূর্তির উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। মনে হয় এ স্থানের পূর্বের কোন বা পার্শ্ববর্তী কোন স্থাপনা থেকে মূর্তিগুলো সংগ্রহ করে প্রধান মন্দিরের ভিত্তিভূমিতে স্থাপন করা হয়েছিল। পীর প্রস্তর মূর্তিগুলো বিভিন্ন সময়ের এবং গঠনশৈলী ও শৈল্পিক উৎকর্ষতার ভিত্তিতে এগুলোকে মোটামুটি তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মূর্তিতে কৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য স্থান পেয়েছে। তাছাড়া রামায়ণ ও মহাভারত-এর অতীব জনপ্রিয় উপাখ্যান এবং জনজীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলি চিত্রিত হয়েছে। এ সমস্ত প্রস্তর ভাস্কর্য বৈশিষ্ট্য এবং বাহ্যিক রূপ স্থূল এবং কখনো কখনো
বাংলার অধিকাংশ ভূভাগই অপেক্ষাকৃত নতুন বা নবভূমি, তবু এই নতুনের মাঝে হটুকু ঠিক নতুন নয়। আবার পশ্চিমাংশে বেশ কিছুটা প্রাচীন বা পুরাভূমিও বিদ্যমান । বাংলার পশ্চিমাংশের পুরাভূমি রাজমহলের দক্ষিণ থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত | রাজমহল, সাঁওতাল পরগণা, মানভূম-সিংভুম-ধলভূমের জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য এই পুরাভূমির অন্তর্গত। মেদিনীপুর-বাকুড়া-বর্ধমান-বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের উচ্চতর লালমাটি অঞ্চলও পুরাভূমির অংশ। বাঁকুড়া-মেদেনীপুরের কিয়দংশ রাণীগঞ্জ- আসানসোলের অংশ বিশেষ এই পুরাভূমিরই নিম্নাঞ্চল ।
বিস্তৃত
আবার এই পুরাভূমিরই একটি শাখা রাজমহলের উত্তরে গঙ্গা পেরিয়ে উত্তর বাংলার বিস্তৃত হয়েছে। বীরভূম মুর্শিদাবাদের মতোই এখানকার মাটিও লাল, স্কুল হালুময়। মালদহ-রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুরের ভিতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে তার দুই তীর যেয়ে আসামের পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়েছে লালমাটির এই রেখা। এ যেন পলিমাটি দিয়ে গড়া বাংলাদেশের উর্বর ভূমি বেষ্টন করে অনুর্বর পুরাভূমির একটা বন্ধনী। উত্তর বাংলায় এই পুরাভূমির একটা অংশ অপরাংশের চেয়ে কিছুটা উঁচু। বগুড়া, উত্তর রাজশাহী, পূর্ব দিনাজপুর আর রংপুরের পশ্চিমাঞ্চল ব্যাপী অপেক্ষাকৃত উঁচু এই এলাকাই হলো ইতিহাস প্রসিদ্ধ বরেন্দ্রভূমির কেন্দ্রস্থল ৷
বাংলার পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলের পুরাভূমির বন্ধনীটুকু বাদ দিলে আর বাদ বাকি প্রায় সবটুকু (চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চল বাদ দিয়ে) হলো নবভূমি- গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও তার উপনদীসমূহের জলে সিঞ্চিত। পশ্চিমে লাল মাটির বুক ভেদ করে নেমে এসেছে ময়ূরাক্ষী, অজয়, রূপনারায়ণ, ইতিহাস প্রসিদ্ধ কপিশা (আধুনিক কসাই) গঙ্গার বিভিন্ন উপনদীসমূহ। এদের জলে উর্বর হয়েছে পুরাভূমি সংলগ্ন সমতল ভূমি, রুক্ষ লাল মাটি হয়েছে উধাও, দেখা দিয়েছে স্তরে স্তরে জমে ওঠা পলিতে উর্বর শস্যশ্যামল নবভূমি। উত্তরে ঠিক পশ্চিমের মতোই লাল মাটি অঞ্চলকে ঘিরে আছে আত্রাই-মহানন্দা-করতোয়ার জল আর পলিমাটি দিয় গড়া ভূভাগ। আর পূর্ব বাংলার তো কথাই নেই। সিলেটের পূর্বাঞ্চল, ময়মনসিংহের মধুপুর গড়, ঢাকার ভাওয়ালের গড়, পার্বত্য ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদ দিয়ে পূর্ব বাংলার সবটুকু নবভূমি। এর মাঝে ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, ত্রিপুরার সমতলভাগ ও সিলেটের অধিকাংশ ভূমি তুলনামূলকভাবে প্রাচীন। খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমতলভূমি অঞ্চল আরো নতুন। সে জন্যই এ অঞ্চলকে বলা হয় নাব্যমণ্ডল। মধ্য ও দক্ষিণ বাংলারও একই অবস্থা। সমুদ্রের নিকটবর্তী বিরাট নদীর জলে সিঞ্চিত, নদী-নালা-খাল-বিল- জলাভূমি সমাকীর্ণ নবভূমি বৃক্ষশ্যামল, শস্যবহুল জনপদ ।
২৩ বাংলার নদ-নদী
Rivers of Bengal
নদী বাংলাদেশের প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বড় বড় নদী। ছোট বড় অনেক উপনদী এসে এসব নদীতে মিশেছে। আবার এগুলো থেকে অসংখ্য স্রোতধারায় অগণিত শাখা প্রশাখা বের
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশ, ভূপ্রকৃতি জলবায়ু, আবহাওয়া স্বভাবতই এ অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনে এবং তাদের মন-মানসিকতায় অসামান্য প্রভাব ফেলেছে। নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত এবং আর্দ্র মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রভাবান্বিত বাংলার অধিবাসীদের প্রকৃতভাবে করেছে কোমল ও শান্ত স্বভাবের। ধনধান্যে পুষ্প ভরা বাংলার মাটিতে সোনা ফলে এবং নদীর জোয়ার-ভাটার মতো বাংলার মানুষের ভাগ্য উত্থান ও পতন এই নদীর সাথে জড়িত। একদিকে প্রচুর পলিমাটি জমার ফলে নতুন নতুন চাষোপযোগী চর জেগে উঠে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সহায়ক হয়; অন্য দিকে প্লাবন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মে যেমন প্রচণ্ড গরম পড়ে, বর্ষার মৌসুমে ( monsoon) মাত্রাধিক বর্ষণের বারিপাত তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেলে শস্যের ক্ষতি হয়। বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষকরে বীরভূম-বর্ধমানের পশ্চিমাংশে এবং মেদিনীপুরের কয়েকটি অঞ্চলে গ্রীষ্মেও তাপদাহ সহ্যসীমার বাইরে চলে যায়। ষড়ঋতুর দেশ বাংলায়, যাকে প্রকৃতির ‘রঙ্গমঞ্চ' বলা হয়ে থাকে, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড গরম পড়ে। খরা ও অনাবৃষ্টিতে একদিকে যেমন কৃষিকাজ ব্যাহত হয়, অন্যদিকে কালবৈশাখী (Nor' western) ও প্লাবন-বন্যা ফসলের ক্ষতি করে। বর্ষা ঋতুতে মৌসুমি বায়ু হিমালয়, গারো, খাসিয়া ও জৈয়ন্তিয়া পাহাড়ে প্রতিহত হয়ে উত্তর ও পূর্ববঙ্গে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বারিপাত মুষলধারায় হতে থাকলে জনজীবন বিপর্যস্তই হয় না, প্রচুর ফসলের ক্ষতি হয়। সিলেটে সর্বাধিক বারিপাত হয়, এখানে গড়ে ৮০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। সমুদ্রোপকূল (mangrove forest) ও পাহাড়ের নিকটবর্তী স্থানসমূহে বারিপাতের পরিমাণ ১৫০ ইঞ্চি, শীতের মৌসুমেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে এবং শৈত্যপ্রবাহও জীবন ও ফসল উৎপাদনকে বির্যস্ত করে। তখন তাপমাত্রা ৬৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নেমে আসে।
চারদিকে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক (natural barrier) থাকায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাংলা রক্ষা পায়। যেমন পাঞ্জাব আলেকজান্ডার থেকে সুলতান মাহমুদ পর্যন্ত বৈদেশিক আক্রমণের শিকার হয়। একসময় মোঙ্গল এবং তৈমুর লং, নাদির শাহ, আহমদ শাহ আবদালীর মতো বৈদেশিক আক্রমণকারী বাংলায় প্রবেশ করতে পারেনি । বাংলার প্রাকৃতিক সীমারেখা, নদ-নদী, জলাভূমি, বৃষ্টিপাত, দীর্ঘস্থায়ী বর্ষাকাল ও আর্দ্র আবহাওয়া বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে এদেশকে রক্ষা করেছে। এগুলো স্বাভাবিক প্রতিরক্ষার কাজ করেছে। এ কারণে বাংলাদেশের জনজীবন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ধারা প্রাচীনকাল থেকে অক্ষুণ্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন ছিল। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্ব ও উত্তরে সুউচ্চ পর্বত শ্রেণি তিন দিক থেকে বাংলার প্রতিরক্ষার দেয়াল হিসেবে কাজ করলেও পশ্চিমাঞ্চলের গিরিপথ-নদী পথে ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চল থেকে বহুবার অভিযান হয়েছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলের সাথে বাংলার যোগসূত্র স্থাপিত হয় প্রধানত দুটি পথে, একটি ত্রিহুত বা উত্তর বিহারের মধ্য দিয়ে এবং অপরটি রাজমহলের নিকটবর্তী তেলিয়াগর্হির সংকীর্ণ পথ দিয়ে। বাংলায় প্রবেশের পথ ছিল বলে ত্রিহুতকে দ্বারভাঙ্গা (বিহারের একটি স্থান) বলা হতো। দ্বারভাঙ্গা উৎপত্তি হয়েছে দ্বার-ই-বংগ বা বাংলায় প্রবেশের পথ থেকে। কিন্তু ত্রিহুত দিয়ে বাংলায় আগমন
সহজসাধ্য ছিল না; কারণ বহিঃশত্রুকে বাংলায় আসতে হলে কুশী, গণ্ডক প্রভৃতি খরস্রোতা নদী পার হয়ে আসতে হতো। এ কারণে ত্রিহুতের স্থলে উত্তর ভারত থেকে অভিযান মূলত তেলিয়াগর্হির সংকীর্ণ পথ ধরে পরিচালিত হয়। তেলিয়াগর্হির পথ খুব সহজ ছিল না কারণ এর একদিকে (উত্তর) বিশাল গঙ্গা নদী এবং অপরদিকে (দক্ষিণ) রাজমহলের পাহাড়শ্রেণি, বীরভূম, সাঁওতাল পরগনা, ঝাড়খণ্ড ও ময়ূরভঞ্জের বিস্তীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। এ সমস্ত কারণে বাংলায় বহিঃশত্রুর অভিযান প্রতিহত করা সম্ভব ছিল। অবশ্য সব সময় তা সফল হয়নি। অন্যথায় পাল, সেন ও মুসলিম অভিযান কখনোই সম্ভবপর হতো না। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, বৈরী আবহাওয়া, জলাবদ্ধতা প্রভৃতি কারণে উত্তর ভারতের মুসলমানগণ বাংলায় আধিপত্য স্থাপন করতে পারেননি। তুঘলক বংশের সুলতান ফিরোজ শাহ দুবার বাংলায় অভিযান করেও সুলতান ইলিয়াস শাহকে পরাজিত করতে পারেননি। সুলতান ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গে অবস্থান করে দিল্লির আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার জন্য বাংলার শাসকগণ দিল্লির আধিপত্য অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। যেমন সুলতান বলবনের শাসনামলে মুগীসুদ্দীন তুঘরিল স্বীয় নামে মুদ্রা জারি করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক শাসনামলে ফকরুদ্দীন মুবারক শাহ বাংলায় স্বাধীন রাজ্য কায়েম করলে দিল্লির সালতানাত কোন বাধা দিতে পারেনি। বাংলার প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের সুযোগে প্রাদেশিক শাসকবর্গ প্রায় দিল্লির কর্তৃত্ব অস্বীকার করে উপটোকন পাঠাতেন না। এ কারণে জিয়াউদ্দিন বারানী বাংলাকে ‘বালগাকপুর বা বিদ্রোহীদের চারণক্ষেত্র বলে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য,
বাংলার জীবনযাত্রার প্রকৃতির প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। ইবনে বতুতা এবং চীনা পর্যটকগণ যখন বাংলায় আসেন তখন বাংলার প্রাচুর্য, সম্পদ ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ইবনে বতুতা বলেন যে, খোরাসানের লোকেরা বাংলাকে বলত, ‘দোজখাস্ত-ই-পুর নিয়ামত' অর্থাৎ নিয়ামতে ভরা দোজখ'। বলবনের পুত্র নাসিরুদ্দিন মাহমুদ যখন বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে আসেন তখন তিনি এখানকার মনোরম ও স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ায় মুগ্ধ হন। সম্রাট হুমায়ুন যখন শেরশাহের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করে বাংলায় এসে গৌড়ে অবস্থান করেন (১৩৩৮ খ্রি.) তখন এই নগরীর ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য নয়নাভিরাম পরিবেশ দেখে এর নাম দেন “জান্নাতাবাদ'। বাংলায় ইউরোপীয় পর্যটক বণিকগণ এসে সন্তোষজনক বিবরণ রেখে গেছেন। তারা বলেছেন যে, বাংলায় প্রবেশের সহস্রাধিক পথ আছে কিন্তু বের হবার কোন পথ নেই অর্থাৎ এই সম্পদশালী দেশ থেকে সহজে কেউ যেতে চায় না। কিন্তু কালক্রমে গৌড়সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অস্বাস্থ্যকর ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট হুমায়ুন বাংলা থেকে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে জাহিদ খান নামক এক রাজকর্মচারীকে গৌড়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি এক পর্যায়ে সম্রাটকে জানান, 'জাঁহাপনা, মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য আপনি কি বাংলা ছাড়া অন্য কোন স্থান খুঁজে পাননি?” সম্রাট আকবর দ্বিগুণ বেতন দিয়েও সৈন্যদের বাংলায় পাঠাতে চাইলে অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার জন্য তাদের অনেকে
সেখানে যেতে চাননি। মহামারী, জলাবদ্ধতা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য সুসমৃদ্ধ গৌড় ও পান্ডুয়া থেকে রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তরিত হয়। শাহসুজা যখন সুবাদার নিযুক্ত হন তখন তিনি ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর থেকে রাজধানী গৌড়ের স্থলে রাজমহলে স্থাপন করেন। সম্রাট আকবরের সেনাপতি মুনিম খান প্লেগে আক্রান্ত গৌড় থেকে রাজধানী তান্ডায় নিয়ে যান। কিন্তু তার বহু সৈন্য প্লেগে মৃত্যুবরণ করে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, প্রাক-মুসলিম যুগে মৌর্য ও গুপ্ত আমলে উত্তরবঙ্গ কয়েক বছর বৈদেশিক শাসনাধীন ছিল। অনুরূপভাবে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়ের পর লক্ষ্মণাবতীতে মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে দিল্লি থেকে শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেও শাসকগণ প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। মাত্র দুবার দিল্লির সুলতান বিদ্রোহী শাসনকর্তাদের শায়েস্তা করার জন্য অভিযান করেন। গিয়াসউদ্দিন বলবন মুগীসউদ্দিন তুঘরিলের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করেন (১২৮০ খ্রি.) এবং গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ত্রিহুত ও বাংলার অভিমুখে অভিযান করেন (১৩২৪ খ্রি.)।
বাংলার ভূপ্রকৃতির উর্বর জমি, আবহাওয়া ও আর্দ্রতা বাঙালিদের জীবনে অসামান্য প্রাধান্য বিস্তার করেছে যুগ যুগ ধরে। বর্ষণের ফলে জমি উর্বর হয়েছে এবং এই উর্বর পলিমাটির জন্য ফসল বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর ভাঙা ও গড়ার খেলায় বহু নতুন চর জন্মে যেখানে পর্যাপ্ত ফসল হয়। বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছে তার জন্য বাংলার মাটি দায়ী না, দায়ী কৃত্রিম কারণ, মানুষের সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। যাহোক, সুজলা, সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলা সব সময় ছিল ফসল উৎপাদানের উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। এ কারণে চার্লস স্টুয়ার্ট বলেন, “উর্বর জমি মানুষ ও পশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল খাদ্য উৎপন্ন করে থাকে। ফসল এতে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় যে এক বছরের উৎপাদন দিয়ে এ দেশের জনগণ দুই বছর পর্যন্ত চালাতে পারে। ফলে এদেশ অতিরিক্ত উৎপাদিত দ্রব্য ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ করতে সক্ষম। অতীতে মিশর যেমন পাশ্চাত্যের শস্যাগার ছিল; বাংলাদেশও তেমনি প্রাচ্যের শস্যাগার। এখানে পশুপক্ষী ও ফলমূল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। জীবনের আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও এখানে প্রচুর মিলতো।” কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন যে, বাংলায় খনিজ পদার্থ ছিল প্রচুর যেমন সোনা, কয়লা, লোহা। কিন্তু অত্যধিক প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য এবং আর্দ্রতা বাঙালিদের অলসপ্রিয় ও অকর্মণ্য করে তোলে। তারা ক্রমে আরামপ্রিয় ও শৌখিন হয়ে পড়ে। এর ফলে বাঙালি জাতি অন্যান্য জাতিদের মতো কষ্টসহিষ্ণু ও কর্মক্ষম হতে পারেনি। বাংলার প্রাচুর্য, উর্বরতা, উৎপাদন ক্ষমতা (ধান, গম, চা, কার্পাস, তামাক, ইক্ষু) এবং অফুরন্ত অনুৎপাদিত সম্পদ যুগ যুগ ধরে বিদেশিদের এদেশে আকর্ষণ করেছে। এর ফলে পরবর্তীকালে ইউরোপীয় বণিকগণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এ দেশে আসতে থাকে এবং একসময় বণিকদের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ড থেকে এদেশে এভাবেই রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে সাম্রাজ্য স্থাপন করে।
বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ সাহিত্যচর্চা ও শিল্পকলার উন্মেষে বিশেষ ভূমিকা। পালন করে। প্রাকৃতিক কারণে বাঙালিগণ মরমীবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে এবং প্রকৃতি ও নদীর সাথে তাদের যে আধ্যাত্মিক যোগসূত্র স্থাপিত হয় তার ফলে জারি, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বাউল গানের উৎপত্তি হয়। নদীর সাথে নৌকার সম্পর্ক নিবিড়। কারণ জলযান হিসেবে নৌকাই একমাত্র সম্বল । মাঝি-মাল্লারা যখন নদীর উত্তাল তরঙ্গে নৌকা চালায় তখন তারা বদরগাজীর স্মরণ করেন। নদী বাংলার কবি ও সাহিত্যিককে প্রভাবান্বিত করেছে বিধায় অমর সাহিত্য রচিত হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বজরায় বসে প্রাকৃতিক শোভাই উপভোগ করতেন না, কবিতাও রচনা করতেন। জাতীয় কবি নজরুল প্রকৃতপ্রেমিক ছিলেন। বাংলার ফলমূল, ফুল, লতা-পাতা ও প্রকৃতির শোভা কবি ও সাহিত্যিকদের যুগ যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করেছে। চিত্রকরদের বাংলার প্রাকৃতিক শোভা মুগ্ধ না করলে তারা অমর প্রকৃতির চিত্র (Landscape painting) অঙ্কন করতেন না। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন প্রকৃতি-প্রেমিক ছিলেন। তিনি ব্রহ্মপুত্র নদীর অনেক চিত্র অঙ্কন করে যশস্বী হয়েছেন। অন্যদিকে প্রকৃতির ধ্বংসলীলাও তাদের ব্যথিত করে। এ কারণে তারা বিশেষকরে জয়নুল আবেদীন জলোচ্ছ্বাসে (tidalbore) মৃত মানব সন্তানদের চিত্র অঙ্কন করেন তার মনপুরা স্কুলে। মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার বলেন, “যুগে যুগে এদেশে বহু সাধক পুরুষ, কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেছে। ষড়ঋতুর নানা বৈশিষ্ট্য ও রূপ ভরে দিয়েছে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। অসংখ্য নদ-নদীর প্রবহমানতা সমৃদ্ধ করেছে বাংলার সংগীতকে। বসন্তের দক্ষিণা বাতাস, শরতের মেঘমালা, শীতের কুহেলী, কালবৈশাখীর প্রমত্ত ঝড়, বর্ষার লীলায়িত ছন্দ এদেশের কবি ও সাহিত্যিককে প্রভাবিত করেছে।
শিল্পকলা, বিশেষভাবে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও অলঙ্করণের ক্ষেত্রে বাংলার প্রকৃতির অসামান্য প্রভাব লক্ষ করা যায়। দিল্লি, আগ্রা, লাহোর ও ফতেহপুর সিক্রিতে মুঘল স্থাপত্যের মূল উৎস ছিল পাথর ও মার্বেল। যার ফলে সেখানে অনিন্দ্যসুন্দর সৌধ, অট্টালিকা, মসজিদ, দুর্গ নির্মিত হয়েছে, যা আজও দর্শকদের বিমোহিত করে। কিন্তু বাংলাদেশের (অবিভক্ত) কোথাও পাথরের পাহাড় নেই। এ কারণে এদেশে গড়ে উঠেছে ইটের তৈরি ইমারত Brick and Terracotta Architecture বা পোড়া ইট ও পোড়ামাটির অলঙ্করণ বাংলার স্থাপত্যকলাকে সমৃদ্ধ করেছে। এর কারণ প্রচুর পরিমাণে যে পলিমাটি পাওয়া যায় তা দিয়ে ইট তৈরি হয়। লাল পোড়া মাটির ইটের স্থায়িত্ব বেশি দিনের না থাকায় বহু স্থাপত্য কীর্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও প্রাক- মুসলিম ও মুসলিম যুগের স্থাপত্যকলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, মহাস্থান পাহাড়পুর, ময়নামতিতে যে বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহারের যে ধ্বংস্তূপ রয়েছে তা ইটের তৈরি। পলিমাটি কাদায় নকশাকৃত ফর্মার ছাপ দিয়ে নানা ধরনের পোড়ামাটির ফলক তৈরি করা হতো, যা এখনো মহাস্থান, ময়নামতি ও পাহাড়পুরে শোভা পাচ্ছে। ইটের সাহায্যে বিশালকার যে ইমারত তৈরি করা যায় তার দৃষ্টান্ত রয়েছে মালদার

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]