পাল সাম্রাজ্যের দৈনন্দিন জীবন Everyday Life in Pala Empire

পাল সাম্রাজ্যের গৌরবময় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিকসমূহ
The glorious social, cultural and economic aspects of Pala empire
পাল সাম্রাজ্যের দৈ বিষয়ে দুর্নাম ছিল। ক্ষেষেন্দ্ৰ দশোপদেশ' নামক চারপাশ সাম্রাজ্যের দৈনন্দিন জীবন বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দীর্ঘ চার শতাব্দীব্যাপী পাল বংশের শাসন বাং জীবনে নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিল। গোপাল, ধর্মপাল, দেবপাপ, প্রথম মহীপাল, দ্বিতী মহিপাল, রামপাল প্রমুখ পাল রাজাদের রাজত্বকালে বাদীর পরিচ পাওয়া যায়। নিম্নে পাল সাম্রাজ্যের দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনা দেওয়া।
৫.১ পাল সাম্রাজ্যের দৈনন্দিন জীবন
Everyday Life in Pala Empire
পাল সাম্রাজ্যের সাধারণ বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোন স্পষ্ট বা বিস্তৃত বিবরণ জানার উপায় নেই । প্রাচীন বাংলায় লিখিত চর্যাপদগুলোতে এ বিষয়ে কিছু কিছু উল্লেখ আছে। কিন্তু এই পদগুলো অষ্টম শতাব্দী বা তার পরে রচিত। অন্যান্য যে সকল গ্রন্থে এর যে বিবরণ আছে, তা এরও পরবর্তী কালের রচনা। প্রাচীন পিপি ও বৈদেশিক ভ্রমণকারীর বিবরণী হতে এ বিষয়ে যে তথ্য সংগ্রহ করা যায় তাও অতিশয় হয়। এদের উপর নির্ভর করেই বাঙালির জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করছি।
সপ্তম শতাব্দীতে চীনদেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করে এর অধিবাসীদের সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন, তা বাঙালিমাত্রেরই শ্লাঘার বিষয়। “সমতটের লোকেরা স্বভাবতই শ্রমসহিষ্ণু, তাম্রলিপ্তির অধিবাসীরা দৃঢ় ও সাহসী, কিন্তু চঞ্চল ও ব্যস্তবাগীশ এবং কর্ণসুবর্ণবাসীরা সাধু ও অমায়িক”- তাঁর এই কয়েকটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে প্রাচীন বাঙালির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তা ছাড়া তিনি পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট ও কর্ণসুবর্ণে সর্বসাধারণের মধ্যে লেখাপড়া শিখার অদম্য আগ্রহ ও প্রাণপণ চেষ্টার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সহস্রাধিক বছর পরে আজও ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলায় স্কুল কলেজের সংখ্যাধিক্য বাঙালির জাতীয় জীবনের সেই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিচ্ছে।
বাংলায় সাধারণত বেদ, মীমাংসা, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, অর্থশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতিষ, কাব্য, তর্ক, ব্যাকরণ, অলঙ্কার, ছন্দ, আয়ুর্বেদ, অস্ত্রবেদ, আগম, তন্ত্র প্রভৃতির পঠনপাঠন প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের গ্রন্থাদিও পঠিত হত। ফাহিয়েন ও ইৎসিং উভয়েই বৌদ্ধ গ্রন্থের চর্চার জন্য তাম্রলিপ্তির বৌদ্ধবিহারে কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন।
জ্ঞানলাভের জন্য বাঙালি দূরদেশে এমনকি সুদূর কাশ্মীর পর্যন্ত যেত। কিন্তু বাঙালি ছাত্রদের কোন কোন লিখেছেন যে, গৌড়ের ছাত্ররা যখন প্রথম কাশ্মীরে আসে তখন তাদের ক্ষীণ দেহ দেখে মনে হয় যেন ছুইলেই ভেঙে পড়বে; কিন্তু এখানকার
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
জলবায়ুর গুণে তারা শীঘ্রই এমন উদ্ধত হয়ে উঠে যে, দোকানদার দাম চাইলে দাম। দেয় না, সামান্য উত্তেজনার বশেই মারার জন্য চুরি উঠায়। বিজ্ঞানেশ্বরও লিখেছেন যে,
গৌড়ের লোকেরা বিবাদপ্রিয় । 1
কিন্তু বাংলার মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল। বাৎস্যায়ন তাদেরকে মৃদুভাষিণী, কোমলাঙ্গী ও অনুরাগবর্তী বলে বর্ণনা করেছেন। 'পবনদূতে' বিজয়পুরের বর্ণনা পড়ে। মনে হয়, সেকালে মেয়েদের মধ্যে অবরোধ প্রথা ছিল না, তারা স্বাচ্ছন্দ্যে বাইরে ভ্রমণ করতো। কিন্তু বাৎস্যায়ন লিখেছেন, রাজাস্তঃপুরের মেয়েরা পর্দার আড়াল হতে অনাত্মীয় পুরুষের সাথে আলাপ করতো। মেয়েরা লেখাপড়া শিখত। ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের ন্যায় বাংলায়ও মেয়েদের কোন প্রকার স্বাতন্ত্র্য্য বা স্বাধীনতা ছিল না। প্রথমে পিতা পরে স্বামীর পরিবারবর্গের অধীনে থাকতে হতো। এ বিষয়ে বাংলার বৈশিষ্ট্য ছিল- জীমূতবাহনের মতে, অপুত্রক স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবা তার সমস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হবে। এ বিষয়ে প্রাচীন কালে অনেক বিরুদ্ধ মত ছিল, যেমন পুত্রের অভাবে ভ্রাতা উত্তরাধিকারী এবং বিধবা কেবল গ্রাসাচ্ছাদনের অধিকারিণী হবে। জীমূতবাহন এই সমুদয় মত খণ্ডন করে বিধবার দাবি সমর্থন করে গিয়েছেন। সুতরাং বাংলাদেশে এই বিধি প্রচলিত ছিল এটা অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু এটি সত্ত্বেও সেকালের বিধবার জীবন এখনকার ন্যায়ই ছিল। কারণ জীমূতবাহনের মতে সম্পত্তির অধিকারিণী হলেও এর দান ও বিক্রয় সম্বন্ধে বিধবার কোন অধিকার থাকবে না । তাকে সতী-সাধ্বী স্ত্রীর ন্যায় কেবল স্বামীর স্মৃতি বহন করে জীবন ধারণ করতে হবে। স্বামীর পরিবারে সর্ববিষয়ে এমনকি সম্পত্তির ব্যবস্থা সম্বন্ধেও তাদের আনুগত্য স্বীকার করে থাকতে হবে। নিজের প্রাণধারণার্থে যা প্রয়োজন মাত্র তাই ব্যয় করে অবশিষ্ট স্বামীর পারলৌকিক কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে হবে। সেকালেও বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সর্ববিধ বিলাসবর্জন ও কৃচ্ছ্রসাধন করতে হতো। সধবা অবস্থায় তার ব্যক্তিগত প্রভাব ও প্রতিপত্তি কিরূপ ছিল ঠিক বলা যায় না। তবে পুরুষের বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল এবং অনেক স্ত্রীকেই সপত্নীর সাথে একত্রে জীবনযাপন করতে হতো। সহমরণ প্রথা সেকালেও প্রচলিত ছিল এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণে এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আছে ।
বাংলার অধিবাসীরা তখন বেশির ভাগ গ্রামেই বাস করতো। কিন্তু ধনসম্পদপূর্ণ শহরেরও অভাব ছিল না। রামচরিতে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বঙ্গভূমির এবং পাল রাজধানী রামাবতীর মনোরম বর্ণনা আছে। পবনদূতে সেন রাজধানী বিজয়পুরের বিবরণ পাওয়া যায়। অত্যুক্তিদোষে দূষিত হলেও এই সমুদয় বর্ণনা হতে সেকালের গ্রাম্য ও নাগরিক জীবনের কিছু আভাস পাওয়া যায়।
রামাবতীর বর্ণনাপ্রসঙ্গে কবি লিখেছেন- প্রশস্ত রাজপথের ধারে কনক পরিপূর্ণ ধবল প্রাসাদশ্রেণি মেরু শিখরের ন্যায় প্রতীয়মান হতো এবং এর উপর স্বর্ণকলস শোভা পেত; নানা স্থানে মন্দির, স্তূপ, বিহার, উদ্যান, পুষ্করিণী, ক্রীড়াশৈল, ক্রীড়াব্যাপী ও
পাল সাম্রাজ্যের দৈনন্দিন জীবন কপুরাদি
নানাবিধ পুষ্প, লতাতরু, গুল্ম নগরের শোভা বৃদ্ধি করতো। হীরক, বৈদূৰ্ষমাণ, মুক্তা, মরকত, মাণিক্য ও নীলমণি-খচিত আভরণ, বহুবিধ স্বর্ণখচিত তৈজসপত্র ও অন্যান্য গৃহপোকরণ, মহামূল্য বিচিত্র সূক্ষ্ম বসন, কম্বরী, কালাগুরু চন্দন, কুঙ্কুম ও গন্ধদ্রব্য এবং নানা যন্ত্রোখিত মন্ত্র মধুর ধ্বনির সাথে তানলয়বিশুদ্ধ সংগীত সেকালের নাগরিকদের ঐশ্বর্য, সম্পদ, রুচি ও বিলাসিতার পরিচয় প্রদান করতো। সন্ধ্যাকর নন্দী স্পষ্টই লিখেছেন- সেকালে সমাজে ব্যভিচারী ও সাত্ত্বিক, উভয় শ্রেণির লোকই ছিল। নগরে বিলাসিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা অবশ্য গ্রামের তুলনায় বেশি মাত্রায়ই ছিল।
বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে নৈতিক জীবনের খুব উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। একদিকে সত্য, শৌচ, দয়া, দান প্রভৃতি সর্ববিধ গুণের মহিমাকীর্তন এবং অপর দিকে ব্রহ্মহত্যা, সুরাপান, চৌর্য ও পরদারগমন প্রভৃতি মহাপাতক বলে গণ্য করে তার জন্য কঠোর শাস্তি ও গুরুতর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে এই আদর্শ কি পরিমাণ অনুসৃত হতো সে সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা যায় না। সামাজিক জীবনে কিছু কিছু দুর্নীতি ও অশ্লীলতার কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। ইন্দ্রিয় সংযম বা দৈহিক পবিত্রতার আদর্শ যে হিন্দুযুগের অবসানকালে অনেক পরিমাণে খর্ব হয়েছিল এরূপ সিদ্ধান্ত করার যথেষ্ট কারণ আছে। এই যুগের কাব্যে ইন্দ্রিয়ের উচ্ছৃঙ্খলতা যেভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে তা কেবল কবির কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যে যুগের স্মার্ত পণ্ডিতগণ প্রামাণিক গ্রন্থে অকুণ্ঠিত চিত্তে লিখেছেন- শূদ্রাণীকে বিবাহ করা অসঙ্গত, কিন্তু তার সাথে অবৈধ সহবাস করা তাদৃশ নিন্দনীয় নয়, সে যুগের কবি রাজপ্রশস্তিতে রাজার কৃতিত্বের নিদর্শনস্বরূপ গর্বভরে বলেছেন- রাজপ্রাসাদে (অথবা রাজধানীতে) প্রতি সন্ধ্যায় ‘বেশবিলাসিনীজনের মঞ্জীর-মঞ্জুম্বনে আকাশ প্রতিধ্বনিত হয়, সে যুগের কবি মন্দিরের একশত দেবদাসীর রূপ-যৌবন বর্ণনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছেন যে, এরা ‘কামিজনের কারাগার ও সংগীতকেলিশ্রীর সঙ্গমগৃহ' এবং এদের দৃষ্টিমাত্রে ভস্মীভূত কাম পূনরুজ্জীবিত হয়, সে যুগের কবি বিষ্ণু-মন্দিরে লীলাকমলহস্তে দেবদাসীগণকে লক্ষ্মীর সাথে তুলনা করতে দ্বিধা বোধ করেননি- সে যুগের নরনারীর যৌনসম্বন্ধের ধারণা ও আদর্শ বর্তমান কালের মাপকাঠিতে বিচার করলে খুব উচ্চ ও মহৎ ছিল এরূপ বিশ্বাস করা কঠিন। এ বিষয়ে পূর্বেও বাঙালির যে খুব সুনাম ছিল না তারও কিছু কিছু প্রমাণ আছে। বাৎসায়ন গৌড় ও বঙ্গের রাজান্ত ঃপুরবাসিনীদের ব্যভিচারের উল্লেখ করেছেন। বৃহস্পতি ভারতের বিভিন্ন জনপদের আচার-ব্যবহার বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, পূর্বদেশের দ্বিজাতিগণ মৎস্যাহারী এবং তাদের স্ত্রীগণ দুর্নীতিপরায়ণা ৷
ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, ফলমূল, দুগ্ধ এবং দুগ্ধজাত নানাপ্রকার (ক্ষীর, দধি, ঘৃত ইত্যাদি) দ্রব্য বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল। বাংলার বাইরে ব্রাহ্মণেরা সাধারণত মাছ-মাংস খাইতেন না এবং এটি নিন্দনীয় মনে করতেন। কিন্তু বাংলায়
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
ব্রাহ্মণেরা আমিষ ভোজন করতেন এবং ভবদেব ভট্ট নানাবিধ যুক্তিপ্রয়োগে এর সমর্থন। করেছেন। বৃহদ্ধর্মপুরাণে রোহিত, শকুল, শফর এবং অন্যান্য শ্বেত ও শকযুক্ত মৎস্য ভক্ষণের ব্যবস্থা আছে। সেকালে ইলিশ মৎস্য এবং পূর্ববঙ্গে শুটকী মৎস্যের খুব আদর
। নানারূপ মাদক পানীয় ব্যবহৃত হতো। ভবদেবভট্টের মতে সুরাপান সকলের পক্ষেই নিষিদ্ধ কিন্তু এই ব্যবস্থা কতদূর কার্যকরী ছিল বলা কঠিন। চর্যাপদে শৌভিকালয়ের উল্লেখ আছে।
পাহাড়পুরের মূর্তিগুলো দেখলে মনে হয় যে, সেকালের বাঙালি নরনারী সাধারণত এখনকার মতই একখানা ধুতি বা শাড়ী পরত। পুরুষেরা মালকোছা দিয়ে ধুতি পরত এবং অধিকাংশ সময়ই এটি হাঁটুর নিচে নামত না। কিন্তু মেয়েদের শাড়ী পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছত। ধুতি ও শাড়ী কেবল দেহের নিম্নার্ধ আবৃত করতো। নাভির উপরের অংশ কখনো খোলা থাকত, কখনো পুরুষেরা উত্তরীয় এবং মেয়েরা ওড়না ব্যবহার করতো। মেয়েরা কদাচিৎ চৌলি বা স্তনপট্ট এবং বডিসের ন্যায় জামাও ব্যবহার করতো। উৎসবে বা বিশেষ উপলক্ষে সম্ভবত বিশেষ পরিচ্ছদের ব্যবস্থা ছিল
পুরুষ ও মেয়েরা উভয়েই অঙ্গুরী, কানে কুণ্ডল, গলায় হার, হাতে কেয়ূর ও ব কটিদেশে মেখলা ও পায়ে মল পরত। শঙ্খ-বলয় কেবল মেয়েরাই ব্যবহার করতো। পুরুষ ও মেয়ে উভয়ই একাধিক হার গলায় দিত এবং মেয়েরা অনেক সময় এখনকার পশ্চিমদেশীয় স্ত্রীলোকের ন্যায় হাতে অনেকগুলো চুড়ি ও বালা পরত। ধনীরা সোনা, রুপা, মণিমুক্তার অনেক আভরণ ব্যবহার করতো ।
পুরুষ বা স্ত্রী কেহই কোনরূপ শিরোভূষণ ব্যবহার করতো না। কিন্তু উভয়েরই সুদীর্ঘ কুঞ্চিত কেশদাম নিপুণ কৌশলে বিন্যস্ত হতো। পুরুষদের চুল বাবরির ন্যায় কাঁধের উপর ঝুলে পড়ত, মেয়েরা নানা রকম খোঁপা বাঁধত ৷
সেকালের সাহিত্যে চামড়ার জুতা, কাঠের খড়ম এবং ছাতার উল্লেখ আছে। বাংলার প্রস্তর-মূর্তিতে কেবল যোদ্ধাদের পায়ে কখনো কখনো জুতা দেখা যায়। মনে হয় সাধারণত এর ব্যবহার হতো না। কয়েকটি মূর্তিতে ছাতার ব্যবহার দেখা যায় ।
মেয়েরা বিবাহ হলে কপালে সিন্দুর পরত। তাছাড়া চরণদ্বয় অলক্তক ও নিম্নাধর সিন্দুর দ্বারা রঞ্জিত করতো। কুঙ্কুমাদি ও নানা গন্ধদ্রব্যের ব্যবহার ছিল ।
সেকালে নানাবিধ ক্রীড়া কৌতুক ছিল। পাশা ও দাবা খেলা এবং নৃত্যগীত অভিনয়ের খুব প্রচলন ছিল। চর্যাপদে নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রের নাম আছে। পাহাড়পুরের খোদিত ফলকে নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, করতাল, ঢাক, ঢোল প্রভৃতি তো ছিলই এমনকি মাটির ভাণ্ডও বাদ্যযন্ত্ররূপে ব্যবহৃত হতো। পুরুষেরা শিকার, মল্লযুদ্ধ, ব্যায়াম ও নানাবিধ বাজীকরের খেলা করতো। মেয়েরা উদ্যানরচনা, জলক্রীড়া প্রভৃতি ভালবাসত ।
গরুরগাড়ি ও নৌকা স্থল ও জলপথের প্রধান যানবাহন ছিল। ধনী লোকেরা হয়, অশ্ব, অশ্ব-শকট প্রভৃতি ব্যবহার করতো। বিবাহের পর গরুরগাড়িতে বধূকে নিয়ে বাড়ি । ফিরতেন। গরুর গাড়ি কিংশুক ও শাল্মলী কাষ্ঠে নির্মিত হতো। গ্রামের লোকেরা ফেলা।
বাংলার ইতিহাসের যুগান্তকারী পথপ্রদর্শক স্বনামধন্য ঐতিহাসিক ড. আবদুল মমিন চৌধুরী পাল যুগের গৌরব ও দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে বলেন যে, পাল যুগ প্রাচীন ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায়। পালবংশ প্রায় চারশত বছর বাংলা শাসন করে। একই রাজবংশের এত দীর্ঘ কালের শাসন ইতিহাসে বিরল। এই দীর্ঘ শাসনকালের মধ্যে চড়াই-উত্রাই লক্ষ করা যায় বটে, কিন্তু বিপর্যয়ের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে পালরাজারা তাঁদের শাসন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই দীর্ঘ শাসনে বাংলার কৃতিত্ব অবশ্যই পাল যুগের গৌরব। বিস্তৃত সাম্রাজ্য, সাম্রাজ্যে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা, প্রজাবৎসল শাসন-নীতি, বিভিন্ন শিল্পকলার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ সাধন এবং সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চা এ সবই পাল যুগের কৃতিত্ব ও গৌরব।
পালবংশের শাসন প্রতিষ্ঠার পর উদীয়মান প্রতিপত্তির যুগে পাল সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। সমগ্র উত্তর-ভারত তাঁদের শাসনাধীনে না আসলেও কেনৌজ পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করে পালশক্তি উত্তর-ভারতের রাজনীতিতে দৃঢ় পদক্ষেপের চিহ্ন রাখতে সমর্থ হয়েছিল নবম শতাব্দীর প্রথমার্ধে। পালদের অধীনেই উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বাংলার প্রথম সাফল্যজনক বিস্তৃতি ঘটে। বাংলার রাজবংশগুলোর মধ্যে এই গৌরবের দাবি কেবল পালরাই করতে পারে। স্বল্পকালের জন্য হলেও পালরাই বাংলার আঞ্চলিক শক্তিকে উত্তর ভারতীয় শক্তিতে পরিণত করেছিল। অবশ্য উত্তর ভারতে পালদের প্রতিপত্তি দীর্ঘকাল বজায় থাকেনি। তবে একথা বলতেই হয় যে, পালশাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে যে শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল তা দীর্ঘকাল ধরে পাল সাম্রাজ্যকে উত্তর ভারতীয় শক্তিবলয়ে প্রভাব বিস্তার করতে সামর্থ্য এবং দশম-একাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন উত্তর ভারতীয় শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাফল্যজনক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো শক্তি যুগিয়েছিল। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, দশম ও একাদশ শতাব্দীতে উত্তর-ভারতীয় শক্তিগুলোর আগ্রাসনে পাল সাম্রাজ্য আক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েকবার, কিন্তু প্রতিবারই প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পালদের ছিল। বহিঃশত্রুর আক্রমণে পাল সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হয়নি। সুতরাং শশাঙ্কের পর সামরিক ক্ষেত্রে শৌর্য- বীর্যের প্রদর্শন ও শক্তি সঞ্চারের কৃতিত্ব পালদেরই।
পালদের সামরিক কৃতিত্বের চাইতে অধিকতর প্রশংসনীয় কৃতিত্ব তাঁদের সাম্রাজ্যে বিরাজমান সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা। পালদের তাম্রশাসনসমূহে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রাম পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত স্তরীভূত সুবিন্যস্ত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েচিল পাল সাম্রাজ্যে। তবে একথা বলা ঠিক হবে না যে, এই শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের একক কৃতিত্ব পালদের। গুপ্ত শাসনাধীন বাংলায় এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পালদের কৃতিত্ব এই যে, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ব্যবস্থাকে তাঁরা করে তুলেছিলেন অনেক বেশি কার্যকর। যোগ করেছিলেন অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য। রাজস্ব ছাড়াও বিভিন্ন কর ও শুল্ক আদায়ের এবং ভূমি প্রশাসনের ছিল সুবিন্যস্ত অবকাঠামো। তাম্রশাসনসমূহে রাজকর্মচারীদের যে দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যায় তা থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল সর্বব্যাপী। খেয়াঘাটের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে নদীপথ, স্থলপথ, ব্যবসায় বাণিজ্য, নগর-বন্দর, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কোন ক্ষেত্রই প্রশাসন যন্ত্রের আওতাবহির্ভূত ছিল না। এমনকি বন এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর ছিল তাঁদের সুষ্ঠু সুবিন্যস্ত শাসনব্যবস্থা।
বাংলার দীর্ঘ পালশাসনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিক তাঁদের প্রজাবৎসল শাসননীতি। পালসম্রাটগণ ছিলেন বৌদ্ধ, কিন্তু প্রজাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু । পালসম্রাট ধর্মপাল ধর্মীয় সম্প্রীতির নীতি গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি সকল শাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞাত এবং যাতে সব ধর্ম-বর্ণ তাদের কার্যকলাপ বজায় রাখতে পারে সেদিকে তিনি তৎপর থাকবেন। প্রজাদের ধর্ম-কর্ম সম্পর্কে সচেতনতার এই ঘোষণা দীর্ঘ পাল শাসনামলে অনুসৃত হয়েছিল বলেই মনে হয়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, পাল সম্রাটগণ বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু দেব- দেবতা বা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় সম্রাটদের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে। রাজকীয় উচ্চপদসমূহে অধিষ্ঠিত দেখা যায় ব্রাহ্মণদের। ধর্মপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ এবং এই মন্ত্রীপরিবার তিন পুরুষ ধরে পালরাজাদের শাসনের সাথে জড়িত ছিল। পাল রাজাদের যতগুলো ভূমিদান সংক্রান্ত তাম্রশাসন আজ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে তার দু'একটি ছাড়া সবকয়টিতেই স্থান লাভ করেছে হিন্দু- দেব-দেবতার মন্দির বা ব্রাহ্মণ। পালসম্রাট ধর্মপাল ভূমিদান করেছিলেন নারায়ণের উপাসনার জন্য নারায়ণপাল, প্রথম মহীপাল এবং নয়পাল পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিলেন শৈর সন্ন্যাসীদের আর স্থাপন করেছিলেন শৈব মন্দির, যেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁর ভূমিদান করেছিলেন। প্রথম মহীপাল বারাণসির পশুপত গুরু শ্রীবামরাশীর ভক্ত ছিলেন আর তাঁর পায়ে আরাধনা করতে বারাণসিতে গিয়েছিলেন। বাংলার জনজীবনে হিন্দু- বৌদ্ধের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান পাল যুগের সমাজ জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ।
দীর্ঘ শাসনকালে এই সামাজিক সম্প্রীতি পাল যুগকে অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনে অবশ্যই সাহায্য করেছিল। পালসম্রাটদের প্রজাহিতৈষণারও দৃষ্টান্ত রয়েছে। পালসম্রাট ধর্মপাল বহু সহস্র দ্রম্ম (রৌপ্য মুদ্রা) খরচ করে খনন করিয়েছিলেন কয়েকটি দিঘি। সম্রাট প্রথম মহীপালের বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দিঘি খনন ও নগর প্রতিষ্ঠা সর্বজনবিদিত। বাংলার জনমনে যে তিনি স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বহুল প্রচলিত প্রবাদবাক্য 'ধান ভানতে শিবের গীত' পরিণত হয়েছিল 'ধান ভানতে মহীপালের গীত'-এ। তাছাড়া পালসম্রাটদের জনস্বার্থে বহু নির্মাণের ধ্বংসাবশেষ তাঁদের কল্যাণমুখী শাসনের পরিচয় বহন করে। বাংলার জনজীবনে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার যে ঐতিহ্য পাল যুগে সৃষ্টি হয়েছিল সেনযুগে তা বিঘ্নিত হওয়ার ফলেই হয়তো পরবর্তীকালে বাংলার সমাজ জীবনে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল । বাংলারা ধর্মজীবনে হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ের যে ধারা সুদীর্ঘ পাল-শাসনামলে সূচিত হয়েছিল, সৃষ্টি হয়েছিল সহজিয়া ও তান্ত্রিক মতাদর্শের, তার সুদূরপ্রসারি প্রভাব বাংলার জনজীবনে পরিলক্ষিত হয় মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগেও। বলা যায় বাংলার ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতিতে যে সমন্বয়ের ঐতিহ্য পাল যুগে সৃষ্টি হয়েছিল, তা বাংলার এক শাশ্বত অর্জন, গর্ব করার মতো অর্জন। এই অর্জনকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে প্রাচীন বাংলার ‘ব্যক্তিত্ব’।
পাল যুগে বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভ করেছিল তিব্বত, জাভা, সুমাত্রা ও মালয়েশিয়াতে। বাংলার বৌদ্ধবিহারগুলো থেকে বহু বৌদ্ধপণ্ডিত ঐসব দেশে গিয়ে বৌদ্ধধর্মের প্রচারে এবং প্রসারে ভূমিকা রেখেছিলেন।
পাল যুগের গৌরবের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক শিল্পকলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে। শিল্পকলার মাধ্যমেই প্রকাশ ঘটে পাল যুগের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অভিব্যক্তির। স্থাপত্য, পোড়ামাটির ফলক, ভাস্কর্য আর চিত্রকলায় পাল যুগের বিশেষ কৃতিত্ব পরিলক্ষিত হয়। পালসম্রাট ধর্মপালের স্থাপত্য কীর্তির নিদর্শন পাহাড়-পুরের সোমপুর মহাবিহার। বাংলায় উদ্ভাবিত বৌদ্ধ-বিহার স্থাপত্য পরিকল্পনায় নির্মিত এই বিহারটির ধ্বংসাবশেষ সগৌরবে ঘোষণা করছে স্থাপত্যশিল্পে বাংলার উৎকর্ষ অর্জনের কথা। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ বিহার। বর্গাকার ক্ষেত্র, প্রতি বাহু প্রায় এক হাজার ফুট, চার দিকে বৌদ্ধ শ্রমণদের অসংখ্য আবাসকক্ষ, আর প্রাঙ্গণের মাঝে ক্রুশাকৃতির ক্রমশ হ্রাসমান অবয়বে দাঁড়িয়ে থাকা কেন্দ্রীয় মন্দির বা উপাসনা সৌধ। আজ ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও এ স্থাপত্যকীর্তি অবলোকনকারীকে আকর্ষণ করে, এর বিশালতা কিছুটা অবাক করে। বিপুলশ্রীমিত্রের নালন্দালিপিতে এটিকে 'জগতাম নেত্রৈকবিশ্রাব ভু' (জগতের চোঁখে তৃপ্তিদায়ক বা দৃষ্টিনন্দন) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে উদ্ঘাটিত প্রত্নস্থলটি বর্তমানে ইউনেস্কোর অর্থানুকূল্যে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত হচ্ছে। এই বিহারের স্থাপত্য পরিকল্পনা,
বিশেষকরে এর কেন্দ্রীয় সৌধটির নিকটবর্তী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মায়ানমারে ও ইন্দোনেশিয়ার প্রভাব ফেলেছিল বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। এই পরিকল্পনা অনুসরণ করে মায়ানমারে ও ইন্দোনেশিয়াতে ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে কয়েকটি বৌদ্ধ স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল ।
পাহাড়পুরে প্রাপ্ত অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক পাল যুগে এই শিল্পের উৎকর্ষের প্রমাণ বহন করে। দেয়াল গাত্রালংকারে ব্যবহৃত এই ফলকসমূহ বাংলার মৃৎশিল্পীদের অনন্য সৃষ্টি বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। ধর্মীয় বিষয়বস্তু ছাড়াও এই ফলকসমূহে স্থান পেয়েছে বাংলার জনজীবনের অনেক দৃশ্য। তাই শৈল্পিক মূল্য ছাড়াও ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে এদের মূল্য অপরিসীম। পাহাড়পুরের ফলকসমূহ শৈল্পিক গুণগতমানে অত্যন্ত আকর্ষণীয় । বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প যে পাল যুগে উৎকর্ষের উচ্চ শিখরে উঠেছিল সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
পাহাড়পুর ছাড়াও পাল যুগের অনেক কীর্তি বাংলা-বিহারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিক্রমশিল বিহার (বিহারের ভাগলপুর জেলায় পাথরঘাটায় অবস্থিত) ও ওদন্তপুর বিহার ধর্মপালের কীর্তি। বৌদ্ধ ধর্মচর্চা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার জন্য সোমপুর মহাবিহার ও বিক্রমশিল বিহারে বিভিন্ন বিষয়ে ১১৪ জন অধ্যাপক ছিলেন এবং তিব্বত থেকে বহু বিদ্যার্থী এখানে শিক্ষালাভের জন্য আসত। পাল যুগের অন্যান্য বিহারের মধ্যে ত্রৈকুটক, দেবিকোট, পণ্ডিত, ফুলবাড়ি ও জগদ্দল বিহারের নাম উল্লেখযোগ্য ৷ এই সূত্র ধরে একথাও বলা যায়, পালসম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা, বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানে চর্চা বাংলার কেন্দ্রে এতো প্রসার লাভ করেছিল যে, তদানীন্তন বিশ্বে বাংলার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। নিকটবর্তী ও দূরবর্তী বহু দেশ থেকে বিদ্যার্থীরা বাংলায় আসত। জাভা-সুমাত্রার শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজা বালপুত্রদেবের অনুরোধে পালসম্রাট দেবপাল পাঁচটি গ্রাম দান করেছিলেন নালন্দায় অধ্যয়নরত ঐ দেশীয় বিদ্যার্থীদের মঠের ব্যয় নির্বাহের জন্য। পাল যুগের বৌদ্ধ বিহারগুলো পার্শ্ববর্তী নেপাল, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে দূরদূরান্তে বৌদ্ধ-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছেন। এদের মধ্যে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য ।
পাল যুগের কোনো হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি। তবে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মন্দিরে ব্যবহৃত স্তস্ত বা দ্বারের অংশবিশেষ, ভাস্কর্যে মন্দিরের প্রতিকৃতি প্রভৃতি থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, পাল যুগে মন্দির স্থাপত্যেরও ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল এবং স্থাপত্যশিল্পের উৎকর্ষ এ ক্ষেত্রেও সাধিত হয়েছিল।
পাল যুগের শিল্পকলার মধ্যে ভাস্কর্য শিল্পের প্রভূত অগ্রগতি ঘটেছিল। গুপ্ত ভাস্কর্যের ধারাবাহিকতায় পাল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার ভাস্কর্য শিল্প এ যুগে এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে, যাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে 'পাল স্কুল অব স্কাল্পচারাল আর্ট' বলে। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাস্কর্যশিল্পে স্থানীয়
বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বাংলাতেও পাল যুগে ভাস্কর্যশিল্পে স্থানীয় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, যার অগ্রগতি দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। পাল যুগের অসংখ্য মূর্তি বাংলার বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া গিয়েছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন যাদুঘরে। প্রধান দ্রষ্টব্য বস্তুই অসংখ্যা মূর্তি। রাজমহলের কালো কষ্টি পাথরই ছিল ভাস্কর্যের প্রধান মাধ্যম। ভাস্করের শিল্প সাধনায় প্রস্তরখণ্ড যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাংলার ভাস্কর্য শিল্প স্থান করে নিয়েছিল সর্বভারতীয় শিল্পকলার আসরে। পাল যুগেই যেন পরিপূর্ণতা পেয়েছিল বাংলার দীর্ঘকালের শিল্প-প্রতিভা। প্রস্তর মূর্তির পাশাপাশি ধাতব মূর্তির সংখ্যাও কম নয়। মূর্তি নির্মাণে পিতল এবং ব্রোঞ্জ (অষ্ট ধাতু) ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলার ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিল্পরীতিতে প্রভাব ফেলেছিল বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
চিত্রকলার ক্ষেত্রেও পাল যুগ পিছিয়ে ছিল না। পাল যুগের পূর্বের কোনো চিত্রকলার নিদর্শন বাংলাতে পাওয়া যায়নি। মন্দির বা ধর্মীয় স্থাপত্যের অলঙ্করণে দেয়ালচিত্রেরও কোনো নিদর্শন আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত লামা তারনাথের গ্রন্থে পালসম্রাট ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকালের দুই বিখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী, ধীমান ও তাঁর ছেলে বীটপালের উল্লেখ রয়েছে। একাধারে প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত ভাস্কর্যে এবং চিত্রশিল্পে তাঁরা ছিলেন পারদর্শী। বজ্রযান ও তন্ত্রযান বৌদ্ধমতের বহু পান্ডুলিপিতে বৌদ্ধ দেব-দেবতার রূপ চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। দশম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত সময়ের ২৪টি চিত্রিত বৌদ্ধ পাণ্ডুলিপি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে-‘পঞ্চরক্ষা' 'অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা' পঞ্চবিংশতিসাহসিকা প্রজ্ঞাপারমিতা' প্রমুখ বৌদ্ধ গ্রন্থের। আর এসব পাণ্ডুলিপির চার শতাধিক চিত্রের মধ্যেই বিধৃত রয়েছে পাল যুগের চিত্রকলা। কেবল পাণ্ডুলিপি চিত্রের মধ্যেই পাল যুগের চিত্রকলার পরিচয় সীমাবদ্ধ হলেও গুণগত মানে তা শিল্পের উৎকর্ষের কথাই প্রমাণ করে। পরবর্তী কালের, এমনকি চতুর্দশ শতাব্দীর, পূর্ব- ভারতীয়, নেপালি এবং তিব্বতি চিত্রকলায় পাল যুগের চিত্রকলার প্রভাব লক্ষ করেছেন চিত্রকলার বিশেষজ্ঞগণ ।
সাহিত্য ক্ষেত্রে পাল যুগের কৃতিত্বের প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়, কারণ এ যুগের রচনা খুব বেশি সংখ্যায় আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। যে দু'একটি এসে পৌঁছেছে, তা থেকেই বুঝা যায় যে, সাহিত্য ক্ষেত্রেও প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। তবে পাল যুগের প্রাপ্ত অসংখ্য তাম্রশাসনে বিধৃত ‘প্রশস্তি' অংশে সংস্কৃত ভাষা চর্চার ও শৈল্পিকমানসম্পন্ন কাব্য রচনার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। নবম শতাব্দীর কবি অভিনন্দ কর্তৃক বৈদভী রীতিতে রচিত রামচরিতম মহাকাব্য সর্ব-ভারতীয় সাহিত্যাসরে সমাদৃত হয়েছিল। শেষ পালসম্রাট মদনপালের রাজত্বকালে সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়েছিল বরেন্দ্রের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম কাব্য। কবি এক বিরল কাব্যরীতি অনুসরণ করে এই দ্ব্যর্থবোধক কাব্যটিতে একদিকে বাল্মিকীর রামায়ণের কাহিনী অন্যদিকে পালসম্রাট রামপালের কাহিনী এক করে প্রকাশ করেছেন। ভাষার সৌকর্য, বিশেষ অর্থবহ শব্দের প্রয়োগ এবং ছন্দের মাধুর্যে সন্ধ্যাকর নন্দীর 'রামচরিতম' কাব্যটি সর্বভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে বেশ উপরের সারিতেই সেনযুগে সংকলিত কাব্য সংকলনগুলোর মধ্যে দশম-একাদশ শতাব্দীর বেশ কয়েকজন কবির রচনা স্থান পেয়েছে। আর এ কাব্য সম্ভার পাল যুগের সাহিত্যের উৎকর্ষেরই প্রমাণ বহন করে।
বিভিন্ন শাস্ত্র সম্বন্ধীয় লেখনীরও প্রমাণ পাওয়া যায়। দর্শন শাস্ত্রের মূল্যবান গ্রন্থ আগমশাস্ত্র নামে বহুল পরিচিত গৌড়পাদকারিকা রচনা করেছিলেন গৌড়পাদ, বর্ধমানের ভুরিশ্রেষ্টি গ্রামের শ্রীধর ভট্ট রচনা করেছিলেন ন্যায় কন্ডলি' বীরভূমের সিদ্ধল গ্রামের ভট্ট ভবদেব রচনা করেছিলেন 'কর্মানুষ্ঠানপদ্ধতি'। স্মৃতি শাস্ত্রেও ভবদেবের খ্যাতি ছিল। পালসম্রাট নয়পালের কর্মচারী নারায়ণ দত্তের পুত্র চক্রপাণি দত্ত চিকিৎসা শাস্ত্রের বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন-চিকিৎসা সংগ্রহ, আয়ুর্বেদদীপিকা; ভানুমতী, শব্দ চন্দ্রিকা ও দ্রব্য গুণসংগ্রহ। দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রণীত চিকিৎসা শাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ শব্দ প্রদীপ এর গ্রন্থকার সুরেশ্বর ছিলেন পাল-রাজপরিবারের চিকিৎসক, তাঁর পিতা ভদ্রেশ্বর ছিলেন সম্রাট রামপালের চিকিৎসক। সুরেশ্বরের অন্যান্য রচনা ‘বৃক্ষাযুর্বেদ' এবং ‘লোহপদ্ধতি’ বা ‘লোহসর্বস্ব'। ‘চিকিৎসা সার সংগ্রহ' এর প্রণয়নকারী বঙ্গসেন ও ‘সুশ্রত' শাস্ত্রের ব্যাখ্যাদানকারী গদাধরবৈদ্য পাল যুগের বলেই মনে করা হয়। ধর্মশাস্ত্রে অবদান রেখেছিলেন জীমূতবাহন তাঁর ‘দায়ভাগ’ ‘ব্যবহার- মাতৃকা’ ও ‘কালবিবেক' গ্রন্থত্রয়ের মাধ্যমে । একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীর কোনো সময়ে রাঢ়ের পারিভদ্র পরিবার তার প্রমাণ। উপরে উল্লিখিত গ্রন্থরাজি পালদের দৈনন্দিন জীবনে সাহিত্য জ্ঞান চর্চার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ।
উপসংহারে তাই বলা চলে যে, পাল শাসনের দীর্ঘ চার শতাব্দীকাল বাংলার জন্য বয়ে এনেছিল অনেক কৃতিত্ব। এই কৃতিত্বে গৌরব যেমন একদিকে শাসকগোষ্ঠীর তেমনি অন্যদিকে জনগণের। প্রাচীন বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে পাল যুগের গৌরব ও দৈনন্দিন জীবন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]