১২৬ প্রাচীন বাংলার শিল্প ও স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্প, পোড়ামাটির শিল্প, বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য

ঢাকা জেলার আসরফপুর গ্রামে রাজা দেবখড়েগ এর তাম্রশাসনের সাথে দে ব্রঞ্জ বা অষ্টধাতুনির্মিত একটি স্তূপ পাওয়া গেছে, তাই সম্ভবত বাংলায় সর্বপ্রাচীন স্তূপের নিদর্শন। এর চতুষ্কোণ অধোভাগ ও হর্মিকা এবং গোলাকার মেধির চতুর্দিকে নানা দেবদেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ। স্তূপটির মেধি ও অন্ড একটি ঘন্টার মতো দেখায়। পাহাড়পুরে ও চট্টগ্রামের অন্তর্গত ঝেওয়ারিতে আরো দুইটি ধাতুনির্মিত স্তূপ পাওয়া গেছে।
১০১৫ অব্দে লিখিত একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে বরেন্দ্রের মৃগস্থান স্তূপের একটি চিত্র আছে। চীনদেশীয় পরিব্রাজকগণ সপ্তম শতাব্দীতেও এই স্তূপটি দেখেছিলেন। এই চিত্র হতে সেকালের স্তূপের আকৃতি বেশ বুঝা যায়। এই স্তূপের অধোভাগ ছয়টি স্তরে বিভক্ত এবং প্রতিটি স্তরের আকার একটি প্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায়। অন্ড অংশ ঈষৎ দীর্ঘাকৃতি এবং এর চতুর্দিকে চারটি কুলুঙ্গির অভ্যন্তরে চারটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপিত। চতুষ্কোণ হর্মিকার উপর বহুসংখ্যক ছত্র ।
বৌদ্ধগণের পুঁথিতে বাংলার আরো দুই তিনটি স্তূপের ছবি আছে। এর একটি ‘তুলাক্ষেত্রে বর্ধমান স্তূপ'। এর অধোভাগ নানা কারুকার্যে শোভিত ও চারটি স্তরে বিভক্ত। এর মেধি ঊর্ধ্ব ও অধোমুখ দুইদলে বিকশিত পদ্মের আকৃতি ।
পাহাড়পুর ও বহুলাড়ায় (বাঁকুড়া) বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইষ্টক স্তূপের অধোভাগ আবিষ্কৃত হয়েছে এগুলো গোল, চতুষ্কোণ, অথবা ক্রসের মতো। বিহারের প্রাচীন স্তূপ ও পূর্বোক্ত বাংলার স্তূপের চিত্রের অধোভাগের সাথে এদের অনেকের নিকট সাদৃশ্য দেখা যায়। সুতরাং এই অধোভাগগুলোর উপর যে সকল স্তূপ নির্মিত হয়েছিল, তা দেখতে বিহারের স্তূপ এবং মৃগস্থাপন অথবা বর্ধমান স্তূপের ন্যায় ছিল, এরূপ অনুমান করা যেতে পারে।
যোগী-গুফা নামক স্থানে পাথরের একটি ছোট স্তূপ পাওয়া গেছে। এর মেধি ও অন্ড অংশের উচ্চতা তাদের ব্যাসের তিন গুণ। সুতরাং মেধি, অন্ড ও ছত্রাবলী মিলে এটি একটি সুদীর্ঘ চূড়ার ন্যায় দেখায়, স্তূপ বলে প্রথমে কিছুতেই মনে হয় না। বাংলার স্তূপের শেষ বিবর্তন বলে এই স্তূপটিকে গ্রহণ করা যেতে পারে।
২. বিহার : সপ্তম শতাব্দীর পূর্বেই যে বাংলায় বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের বাসের জন্য অনেক বিহার ছিল এবং এর কোন কোনটি বেশ বড় ও কারুকার্য খচিত ছিল, চীনদেশীয় পরিব্রাজকগণের বিবরণ হতেই তা জানা যায়। স্তূপের ন্যায় এগুলোও ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু নওগাঁর অন্তর্গত পাহাড়পুর নামক স্থানে একটি বিশাল বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ায় প্রাচীন বাংলার এই শ্রেণির স্থাপত্যের সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা সম্ভবপর হয়েছে।
একখানি তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে, পঞ্চম শতাব্দীতে এখানে একটি জৈন বিহার ছিল। সম্ভবত কালক্রমে এটি নষ্ট হয়ে যায়। অষ্টম শতাব্দীতে ধর্মপাল এখানে যে প্রকাণ্ড বিহার নির্মাণ করেন, সোমপুর মহাবিহার নামে তা ভারতের সর্বত্র এবং বহির্ভারতের বৌদ্ধজগতেও বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই প্রকাণ্ড বিহারের চতুষ্কোণ
অঙ্গনটি প্রতি দিকে ৩০০ গজ দীর্ঘ ছিল। অঙ্গনটি উচ্চ প্রাচীরে ঘেরা ছিল এবং অঙ্গনের চারদিকেই এই প্রাচীরগাত্রে ভিক্ষুগণের বাসের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কক্ষ নির্মিত হয়েছিল। এই কক্ষগুলোর সংখ্যা ছিল ১৭৭। প্রতি কক্ষ প্রায় সাড়ে তেরো ফুট দীর্ঘ ছিল। কক্ষগুলোর সম্মুখ দিয়ে আট-নয় ফুট প্রশস্ত বারান্দা সমস্ত অঙ্গনটি ঘিরে বিস্তৃত ছিল। চারদিকে চারটি সিড়ি দিয়ে বারান্দা হতে অঙ্গনে নামা যেত। প্রাচীরের উত্তর দিকে ছিল। এই বিহারের প্রধান প্রবেশপথ অথবা সিংহদ্বার। এর পশ্চাতেই ছিল একটি প্রকাণ্ড গুপ্তযুক্ত প্রশস্ত দালান । এই দালান হতে আরেকটি ক্ষুদ্রতর স্তম্ভ যুক্ত দালানের মধ্য দিয়ে পূর্বোক্ত কক্ষশ্রেণির সম্মুখস্থ বারান্দায় পৌঁছান যেত। দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম বারান্দার ঠিক মধ্যস্থলে অঙ্গনে নামবার সিঁড়ির পশ্চাতেও এরূপ কয়েকটি অতিরিক্ত কক্ষ ছিল। প্রতিটি কক্ষ হতে জল নিঃসরণের জন্য পয়ঃপ্রণালির ব্যবস্থা ছিল। বিস্তৃত অঙ্গনের ঠিক মধ্যস্থলে একটি প্রকাণ্ড মন্দির ছিল। এই মন্দির ও চতুষ্পার্শ্বস্থ কক্ষগুলোর মধ্যবর্তী বিস্তৃত আঙ্গিনায় ছোট ছোট স্তূপে, মন্দির, কূপ, স্নানাগার, রন্ধনশালা, ভোজনালয় প্রভৃতি ছিল। ভারতবর্ষে এ পর্যন্ত যত বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে এই সোমপুর বিহারই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। এই বিহারটি যখন অক্ষ ছিল তখন এর বিশালত্ব ও সৌন্দর্য লোকের মনে নিশ্চয়ই বিস্ময় উৎপাদন করতো একখানি সমসাময়িক লিপিতে এটি ‘জগতাং নেত্রৈবিশ্রাম-ভূ' (জগতে নয়নের একমাত্র বিরামস্থল অর্থাৎ দর্শনীয় বস্তু) বলে বর্ণিত হয়েছে। এর ‘মহাবিহার' নাম সার্থক ছিল ।
কুমিল্লার নিকটবর্তী ময়নামতী নামক অনুচ্চ পর্বতমালায় কয়েকটি বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এটির খনন কার্য সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষার ফলে একজন পুরাতত্ত্ববিদ সিদ্ধান্ত করেছেন যে, পাহাড়পুরের বিহার ও মন্দির অপেক্ষাও বৃহত্তর বিহার ও মন্দিরাদি এখানে ছিল। জগদ্দল মহাবিহারও একটি প্রসিদ্ধ বিহার ছিল। মালদহ জেলার অন্তর্গত ‘জগদ্দল' নামে একটি গ্রাম সম্ভবত এরই স্মৃতি রক্ষা করে আসছে। এখানে এবং পার্শ্বস্থ অনেক গ্রামে প্রাচীন স্থানের ও মন্দিরাদির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এরূপ আরো অনেক বিহারের উল্লেখ আছে। এই সকল ধ্বংসাবশেষ হতে প্রাচীন বাংলার বিহার সম্বন্ধে কতক ধারণা করা যায় ।
৩. মন্দির : বাংলার প্রাচীন কালের মন্দিরগুলো প্রায় সকলই ধ্বংস হয়েছে এ কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। কিন্তু কোন কোন বৌদ্ধগ্রন্থের পুঁথিতে কয়েকটি প্রাচীন মন্দিরের ছবি আছে। কতকগুলো প্রস্তরমূর্তিতেও মন্দির উৎকীর্ণ হয়েছে৷ এই প্রতিকৃতি গুলোর সাহায্যে বাংলার প্রাচীন মন্দিরের গঠনপ্রণালি আলোচনা করলে ছাদের আকৃতি অনুসারে এটি নিম্নের বর্ণিত চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় :
১. এক শ্রেণির মন্দিরের ছাদ উপর্যুপরি কতকগুলো সমান্তরাল চতুষ্কোণ স্তরের সমষ্টি। প্রতি দুই স্তরের মধ্যবর্তী ভাগ অন্তর্নিহিত থাকায় এই স্তরগুলো বেশ পৃথক পৃথক দেখা যায়। স্তরগুলো যত ঊর্ধ্বে উঠতে থাকে, ততই ক্ষুদ্রাকার
১২৮ প্রাচীন বাংলার শিল্প ও স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্প, পোড়ামাটির শিল্প, বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য
হয়। গুপ্তযুগের ভাস্কর্যে এই শ্রেণির মন্দির উৎকীর্ণ হয়েছে। এর পরিণতি দেখা যায় উড়িষ্যার মন্দিরের সম্মুখস্থ জগমোহনে। উড়িষ্যায় এই প্রকার
2
ছাদযুক্ত মন্দির ‘ভদ্র' অথবা 'নীড়-দেউল' নামে অভিহিত হয়েছে।
দ্বিতীয় শ্রেণির মন্দিরের ছাদ উড়িষ্যার মন্দিরের ন্যায় শিখরে ঢাকা। চতুষ্কোণ গর্ভগৃহের প্রাচীরগাত্র হতে উচ্চ শিখরের চারটি ধার উঠে ঈষৎ বাঁকা হতে হতে অবশেষে প্রায় সংলগ্ন হয়ে যায়। এই সংযোগস্থল একটি গোলাকার প্রস্তরখণ্ডে (আমলক শিলা) আবদ্ধ করা হয় এবং শিখরের গাত্রে কারুকার্য খচিত অনেক লম্বালম্বি পংক্তি থাকে। এই শ্রেণির মন্দির 'রেখ- দেউল' নামে অভিহিত হয়েছে।
৩-৪. প্রথম শ্রেণির ভদ্র দেউলের সর্বোচ্চ স্তরের উপর একটি স্তূপ বা শিখর স্থাপিত করে এই অপর দুই শ্রেণির মন্দিরের সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন স্থলে এই স্তূপ বা শিখর কেবল সর্বোচ্চ স্তরের উপর নয়, প্রতি স্তরের কোণে এবং সম্মুখ ভাগেও দেখা যায় ।
বৌদ্ধ পুঁথির চিত্র ও প্রস্তরমূর্তি হতে জানা যায় যে, প্রাচীন বাংলায় এই চার শ্রেণিরই মন্দির ছিল। তবে শেষোক্ত দুই শ্রেণির কোন প্রাচীন মন্দির এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে নির্মিত দিনাজপুরের অন্তর্গত কান্তনগরের মন্দির চতুর্থ শ্রেণির মন্দিরের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলে গণ্য করা যেতে পারে। ব্রহ্মদেশে এরূপ মন্দির আছে। বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর মন্দিরের অঙ্গনে নন্দীর যে ক্ষুদ্র একটি মন্দির আছে, প্রথম শ্রেণির মন্দিরের তাই একমাত্র নিদর্শন। এতদ্ব্যতীত বাংলায় যে কয়েকটি প্রাচীন মন্দির আছে, তা সকলই দ্বিতীয় শ্রেণির। এর মধ্যে বর্ধমানের অন্তর্গত বরাকরে একটি ও বাঁকুড়ার অন্তর্গত দেহারে দুইটি মোট তিনটি প্রস্তরে গঠিত, অবশিষ্ট কয়েকটি ইষ্টকনির্মিত। এই মন্দিরগুলোর শিখর পূর্বোক্ত বর্ণনানুযায়ীও উড়িষ্যার মন্দিরের অনুরূপ । হিন্দুযুগে এই শ্রেণির মন্দির উত্তর ভারতের সর্বত্র দেখা যেত ।
বরাকরের ৪নং মন্দিরটি এদের মধ্যে সর্বপ্রাচীন। এর অপেক্ষাকৃত উচ্চ গর্ভগৃহ, অনুচ্চ শিখরভাগ এবং আমলক শিলার আকৃতি অনেকটা ভুবনেশ্বরের প্রাচীন পরশুরামের মন্দিরের ন্যায়, সম্ভবত এটি ঐ সময়ে অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দে নির্মিত ।
বড় বড় মন্দিরের অনুকরণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্দিরও নির্মিত হতো। রাজশাহী জেলার অন্তর্গত নিমদীঘি এবং দিনাজপুরের অন্তর্গত বাণগড়ে এরূপ প্রস্তর নির্মিত দুইটি এবং চট্টগ্রামের অন্তর্গত ঝেওয়ারিতে ব্রঞ্জনির্মিত একটি মন্দির পাওয়া গেছে। এগুলোর গঠনপ্রণালি একই রকমের এবং সম্ভবত বরাকর মন্দিরের অনতিকাল পরেই এসব মন্দির নির্মিত হয়। এই যুগের বৃহৎ শিখরযুক্ত মন্দির কিরূপ কারুকার্যখচিত ছিল, এই মন্দিরগুলো দেখলে তা অনেকটা অনুমান করা যায়। গর্ভগৃহের চতুর্দিকে চারটি ত্রিভঙ্গিম খিলানযুক্ত কুলুঙ্গি, শিখরগাত্রে অলঙ্কাররূপে চৈত্য-গবাক্ষের ব্যবহার এবং শিখরের উপরিভাগে চার কোণে চারটি সিংহমূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস। পরবর্তী কালের মন্দিরগুলোতে খোদিত কারুকার্য অনেক বেশি। শিখরের কোণগুলো পালিশ করায় এটি অধিকতর গোলাকার দেখা যায় এবং শিখরগাত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিখরের প্রতিমূর্তি উৎকীর্ণ করা হয়। মন্দিরের প্রবেশপথের সম্মুখস্থ পুরু দেওয়ালের মধ্যে একটু ছোট নাটমন্দিরের মতো কক্ষ যোগ করাও এগুলোর আর একটি বিশেষত্ব। দেউলিয়ার (বর্ধমান) মন্দির, বহুলাড়ার (বাকুড়া) সিদ্ধেশ্বর মন্দির, সুন্দরবনের জটার দেউল এবং দেহারের (বাঁকুড়া) সরেশ্বর ও সল্লেশ্বরের মন্দির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম তিনটি ইষ্টক ও শেষোক্ত দুইটি প্রস্তরে নির্মিত। সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের কারুকার্য বাংলার মন্দিরশিল্পের
সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন বলে গ্রহণ করা যেতে পারে ।
পাহাড়পুরের বিহারের অঙ্গনের ঠিক কেন্দ্রস্থলের একটি বিশাল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর ঊর্ধ্বভাগ বিলুপ্ত হওয়ায় এই মন্দিরটি কোন শ্রেণির অন্তর্গত ছিল, তা জানবার উপায় নেই। কিন্তু এর নিচের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা ভারতবর্ষের অন্যান্য মন্দির হতে সম্পূর্ণ পৃথক ।
মন্দিরটি ত্রিতল। এর কেন্দ্রস্থলে একটি চতুষ্কোণ বর্গাকৃতি অংশ সোজা উপরে উঠে গেছে। এর চারধারের প্রাচীর অতিশয় স্থূল ও দৃঢ় এবং প্রাচীরের অভ্যন্তরস্থ স্থান ফাঁকা হলেও সেখানে প্রবেশ করবার কোন উপায় নেই। ত্রিতলে এই বর্গাকৃতি অংশের প্রতিটি প্রাচীরের সম্মুখভাগে একটি নাটমন্দির ও মণ্ডপ এমনভাবে নির্মিত হয়েছে, যাতে এর দুই পার্শ্বে প্রাচীরের খানিক অংশ মুক্ত থাকে। এর ফলে এই চারটি প্রসারিত অংশের মধ্যে বর্গাকৃতি অংশের চারটি কোণ বের হয়ে আছে এবং সমস্তটা একটি ক্রুসের আকার ধারণ করছে। এই ক্রুসের সীমারেখা অনুযায়ী একটি প্রদক্ষিণপথ ও তার আবেষ্টনী মন্দিরের চারদিকে ঘিরে আছে। দ্বিতলের পরিকল্পনা ত্রিতলেরই অনুরূপ কিন্তু এর প্রতিদিকের সম্মুখভাগ খানিকটা প্রসারিত করে আরো দুটি কোণের সৃষ্টি করা হয়েছে। একতল দ্বিতলের অনুরূপ, কেবল এর উত্তর দিকের একটু অংশ বাড়িয়ে সিঁড়ির জায়গা করা হয়েছে। সমগ্র মন্দিরটি উত্তর-দক্ষিণে ৩৫৬ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৩১৪ ফুট দীর্ঘ। যে অংশ অবশিষ্ট আছে তার উচ্চতা ৭০ ফুট।
এই বিশাল মন্দিরের উপরিভাগ কিরূপ ছিল তা জানবার উপায় নেই । কেউ কেউ অনুমান করেন, বর্গাকৃতি অংশের উপরে মূল মন্দির ছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, সাধারণ মন্দিরের গর্ভগৃহের ন্যায় কোন কক্ষ এই মন্দিরে ছিল না। কেবল বর্গাকৃতি অংশের সম্মুখস্থ চারটি নাটমন্দিরে চারটি দেবমূর্তি ছিল। জৈন চতুর্মুখ মন্দির ব্রহ্মদেশের কোন কোন মন্দিরে এরূপ ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায় ।
সম্ভবত বর্গাকৃতি অংশের উপর এক উচ্চ শিখর ছিল এবং যাতে এই বিশাল শিখরের ভার বহন করতে পারে, সেজন্যই বর্গাকৃতি অংশ এমন সুদৃঢ়ভাবে একেবারে নিচ হতে গেঁথে তোলা হয়েছিল। এই বিশাল মন্দিরের উপযোগী উচ্চ শিখর যখন বিদ্যমান ছিল, তখন এটি বহুদূর হতে গিরিচূড়ার ন্যায় দেখা যেত। এর সৌন্দর্য, বিশালতা ও গাম্ভীর্য লোকের মনে কিরূপ বিস্ময় উৎপাদন করতো, আজ আমরা কেবল কল্পনায় তা অনুভব করতে পারি। মন্দিরটি ইট-কাদার গাঁথুনিতে তৈরি অথচ সহস্রাধিক বছর পরে আজ এই ইটের দেওয়াল ৭০ ফুট উঁচু পর্যন্ত অবশিষ্ট আছে, এটিই আশ্চর্যের বিষয়। দেওয়ালের মাঝে মাঝে কারুকার্য খোচিত ইটের কার্নিশ এবং দেওয়ালের গায়ে আবদ্ধ তিনটি সারিতে সাজনো পোড়া মাটি ও প্রস্তরভাস্কর্যের ফলকগুলোও এখনো এর অতীত শিল্পকলার নিদর্শনরূপে বর্তমান। মন্দিরটি অষ্টম শতাব্দে নির্মিত কিন্তু এর পাত্রসংলগ্ন কোন কোন ভাস্কর্য গুপ্তযুগের। সম্ভবত কোন প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ হতে এগুলো
আহত হয়ে পরবর্তী কালের মন্দিরগাত্রে সংলগ্ন করা হয়েছে।
পাহাড়পুরের মন্দিরের পরিকল্পনা ভারতবর্ষের আর কোনোও স্থানে দেখা যায় না, কিন্তু যবদ্বীপ ও ব্রহ্মদেশের কোন কোন মন্দির অনেকটা এরূপ এবং এরই অনুকরণে নির্মিত হয়েছে বলে মনে হয়। পূর্বোক্ত বাংলার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মন্দিরের শিখরও ব্রহ্মদেশে দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং বঙ্গদেশের অধুনাবিলুপ্ত মন্দির শিল্প সুদূর প্রাচ্যের হিন্দু উপনিবেশগুলোতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল, এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত।
বাংলায় প্রাচীন মন্দির খুব বেশি নেই, কিন্তু এসব মন্দিরের অংশবিশেষ শুনু চৌকাঠ প্রভৃতি নানাস্থানে পাওয়া গেছে। দিনাজপুর রাজবাড়ীতে কারুকার্য খচিত একটি প্রস্তর স্তম্ভ আছে। এর গাত্রে উৎকীর্ণ লিপি হতে জানা যায় যে, স্তম্ভটি গৌড়াধিপতি প্রতিষ্ঠিত একটি শিবমন্দিরের অংশ। এই মন্দিরটি নবম শতাব্দে নির্মিত হয়েছিল। বীরভূম জেলার অন্তর্গত পাইকোরে দুইটি এবং পাবনা জেলার হান্ডিয়াল গ্রামে চারটি বিচিত্র কারুকার্য শোভিত প্রস্তরস্তম্ভ পাওয়া গেছে। দিনাজপুরের গরুড় স্তম্ভ ও কৈবর্ত স্তম্ভও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
বিক্রমপুরের নানাস্থানে প্রস্তর ও কাষ্ঠের স্তম্ভ পাওয়া গেছে। কাষ্ঠের স্তম্ভগুলো জীর্ণ হলেও তার গাত্রে উৎকীর্ণ বিচিত্র কারুকার্য এখনো দেখতে পাওয়া যায় এবং এর শিল্পকলা অতিশয় উচ্চশ্রেণির। এরূপ কয়েকটি কাষ্ঠের স্তম্ভ, ব্রাকেট প্রভৃতি ঢাকা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। এগুলো প্রাচীন বাংলার কারু-শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এটি হতে আরো প্রমাণিত হয় বাংলায় কাষ্ঠনির্মিত অনেক মন্দির ছিল। কালক্রমে সেগুলো ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু তার যে দুই একটা ক্ষুদ্র অংশ প্রায় সহস্র বছর পরেও টিকে আছে, তা হতেই এই মন্দিরগুলোর সৌন্দর্য সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা যেতে পারে। স্ত গুগুলো বাস্তবিকই বাংলার বিলুপ্ত মন্দির শিল্পের স্মৃতিস্তম্ভ ।
বাণগড়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আবিষ্কৃত একটি বিশাল কারুকার্য খচিত পাথরের চৌকাঠ এখন দিনাজপুর রাজবাড়ীতে আছে। প্রাচীন গৌড়ে ও রাজশাহী জেলায় কয়েকটি পাথরের চৌকাঠের অংশ পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর কারুকার্যও খুব উঁচু দরের। স্তম্ভের ন্যায় এই সমুদয় চৌকাঠও প্রাচীন মন্দির-শিল্পের স্মৃতি বহন করছে। ভাস্কর্য শিল্প
Sculptural Art
ভারতবর্ষে চিরকাল দেবমন্দিরই স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল। প্রাচীন বাংলায় বহু মন্দির ছিল, সুতরাং ভাস্কর্যেরও প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। মন্দিরের সঙ্গে সঙ্গে এর অধিকাংশই লুপ্ত হয়েছে। কিন্তু অনেক স্থলে মন্দির বিনষ্ট হলেও তন্মধ্যস্থ দেবমূর্তি রক্ষিত হয়েছে। বাংলার যে বহুসংখ্যক দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে, পূর্বেই তার উল্লেখ করা হয়েছে। এই মূর্তিসমূহ হতে বাংলার প্রাচীন চারুশিল্পের কতক পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এর অধিকাংশই নবম শতাব্দীর পরবর্তী কালের। এর পূর্বে একমাত্র পাহাড়পুর মন্দিরগাত্রেই অনেক ভাস্কর্যের নিদর্শন একত্রে পাওয়া যায়। যে সমস্ত ভাস্কর্যের নিদর্শন এরও পূর্ববর্তী কালের বলে নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা যায়, তার সংখ্যা খুবই অল্প ।
চন্দ্রবর্মার রাজধানী পুষকরণা (বাঁকুড়া জেলার পোকর্ণা) ও সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন নগরী তাম্রলিপ্তিতে প্রাপ্ত কয়েকটিতে একটি যক্ষিনীর মূর্তি আছে। এর গঠনপ্রণালি ও বসন- ভূষণ শুঙ্গযুগের মূর্তির অনুরূপ (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দী)। মহাস্থানে একটি পোড়ামাটির মূর্তি কেউ কেউ মৌর্যযুগের বলে মনে করেন, কিন্তু এটি এতই অস্পষ্ট যে এ সম্বন্ধে কোন সঠিক ধারণা করা কঠিন। মহাস্থানের আর একটি পোড়ামাটির মূর্তি সম্ভবত শুঙ্গযুগের।
বসিরহাটের নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড় (অথবা বেড়াচাঁপা) নামক গ্রামে সূর্যমূর্তি এবং মালদহ জেলার হকিবাইল গ্রামের বিষ্ণুমূর্তির পোশাকপরিচ্ছদ ও গঠনপ্রণালী কুষাণযুগের মূর্তির অনুরূপ । বাণগড়ে প্রাপ্ত কয়েকটি পোড়া-মাটির মূর্তিতে কুষাণ অথবা তার অব্যবহিত পরবর্তী যুগের শিল্পলক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় ।
বিহারৈলের বুদ্ধমূর্তি সারনাথের গুপ্তযুগের মূর্তির অবিকল অনুকরণ বললেও চলে। কাশীপুর (সুন্দরবন) ও দেওরার (বগুড়া) সূর্যমূর্তি দুইটিতেও গুপ্তযুগের শেষকালের (ষষ্ঠ শতাব্দী) শিল্পলক্ষণ বিদ্যমান। এদের মধ্যে কাশীপুরের মূর্তিটি অধিকতর সৌষ্ঠবসম্পন্ন। গুপ্তযুগে পূর্বভারতীয় মূর্তিগুলোতে যেরূপ সংযম ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে কমনীয়তা ও ভাবপ্রবণতার অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়, এই মূর্তিটিতে তা বেশ ফুটে উঠেছে। মহাস্থানের নিকটবর্তী বলাইধাপভিটার সোনার পাতে ঢাকা অষ্টধাতু নির্মিত একটি মঞ্জুশ্রী মূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূর্তিটি প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। এর গঠনপ্রণালি গুপ্তযুগের আদর্শের অনুযায়ী। এই মূর্তির কমনীয় অথচ শান্ত সমাহিত ভাবে পরিপূর্ণ মুখশ্রী, অঙ্গ প্রতঙ্গের লাবণ্য ও সুষমা, করাঙ্গুলি ও অধরযুগলের ব্যঞ্জনা ও দেহের ভাবপ্রবণতা দেখলে প্রাচীন বাংলায় চারু শিল্পের কতদূর উৎকর্ষ হয়েছিল, তার ধারণা করা যায়।
এই সকল মূর্তি হতে প্রমাণিত হয় যে, খ্রিস্টাব্দের আরম্ভ বা তার পূর্ব হতে বাংলায় ভাস্কর্যের চর্চা ছিল এবং বাংলার শিল্পী গুপ্তযুগ পর্যন্ত ভারতের সাধারণ শিল্পধারার সাথে যোগ রক্ষা করে চলত। ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে বাংলার ভাস্কর্যে কোন বিশিষ্ট প্রণালি বা পরিকল্পনার পরিচয় পাওয়া যায় না। এই পরিচয় প্রথম পাওয়া যায় দেবখড়েগর রানী প্রভাবতীর লিপিযুক্ত শর্বাণী ও তার সাথে প্রাপ্ত একটি ক্ষুদ্র সূর্যমূর্তিতে। এই দুইটি সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত। গুপ্তশিল্পের প্রভাব থাকলেও, এতে পরবর্তী পালযুগের শিল্প-বৈশিষ্ট্যের সূচনা দেখতে পাওয়া যায়। চব্বিশ-পরগণার অন্তর্গত মণিরহাটে প্রাপ্ত একটি শিবমূর্তিও এই শ্রেণির অন্তর্গত। এই তিনটি মূর্তিই ধাতুনির্মিত।
পাহাড়পুরের মন্দিরগাত্রে খোদিত যে প্রস্তর ও পোড়ামাটির ফলক আছে তা হতে সর্বপ্রথমে বাংলার নিজস্ব ভাস্কর্য শিল্পের বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। বিষয়বস্তু ও শিল্পকৌশলের দিক দিয়ে বিচার করলে, পাহাড়পুরের ভাস্কর্য দুই বা তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । প্রথমটি লোক-শিল্প এবং দ্বিতীয়টি অভিজাত-শিল্প । তৃতীয়টি এ দুইয়ের মাঝামাঝি ।
প্রস্তরের কয়েকটি ও পোড়া মাটির সমস্ত ফলকগুলো প্রথম শ্রেণির অথবা লোকশিল্পের অন্তর্গত। রামায়ণ মহাভারতের অনেক কাহিনী এতে খোদিত হয়েছে। কৃষ্ণের জন্মকথা এবং যে সকল লীলা বাঙালির চিরপ্রিয় এবং বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে পরিচিত, তার বহুদৃশ্য এতে আছে । পঞ্চতন্ত্র ও বৃহৎকথার জনপ্রিয় গল্প এর হাস্যরসের আধার যোগিয়েছে। সাধারণত মানুষের সুখ-দুঃখ ও জীবনযাত্রার দৈনন্দিন কাহিনী এতে বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। মেয়েরা নানা ভঙ্গিতে নৃত্য করছে, শিশুকে ক্রোড়ে নিয়ে জননী কূপ হতে জল তুলছে অথবা জলের কলসীসহ গৃহে ফিরছে, কৃষক লাঙ্গল কাঁধে করে মাঠে যাচ্ছে, বাজিকর কঠিন কঠিন বাজি দেখাচ্ছে, শীর্ণকায় সাধু-সন্ন্যাসী কাঁধের উপর কাষ্ঠখণ্ডের সাহায্যে তৈজসপত্র বহন করে লম্বা দাড়ি ঝুলে ন্যুব্জদেহে চালাচ্ছে, পরচুলপরা দারোয়ান লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে। প্রেমালাপে মত্ত যুবক-যুবতী, পুরুষ ও স্ত্রী বাদ্যকরগণ এবং তাদের বাদ্যযন্ত্র, পূজানিরত ব্রাহ্মণ, অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত পুরুষ ও নারী, ধনুর্বাণহস্তে রথারোহী যোদ্ধা, পূর্ণমাত্র পরিহিত শবর স্ত্রী-পুরুষের প্রেমালাপ, ধনুহস্তে শবর, মৃত জন্তু হস্তে লয়ে বীরদর্পে পদক্ষেপকারিণী শবর রমণী- এরূপ অসংখ্য দৃশ্য শিল্পী খোদাই করেছে। সুপরিচিত পশুপক্ষী, পত্রপুষ্প গাছপালাও শিল্পীর দৃষ্টি এড়ায়নি। দৃশ্যমান জগতের বাইরেও শিল্পীর কল্পনা বিস্তার লাভ করছে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, গণেশ, বোধিসত্ত্ব, পদ্মপাণি, মঞ্জুশ্রী, তারা প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি আছে, কিন্তু এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। দৈত্য, দানব, নাগ, কিন্নর, গন্ধর্ব ও বহু কাল্পনিক জীবজন্তু শিল্পীর হস্তে মূর্তি পরিগ্রহ করেছে।
যে সকল ভাস্কর এই সমুদয় দৃশ্য খোদিত করেছিল, তাদের শিক্ষা ও সমাজ খুব উচ্চ শ্রেণির নয়। উৎকীর্ণ পুরুষ ও নারীমূর্তির গঠন অতি সাধারণ এমন কি কুৎসিত বলাও চলে। তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সৌষ্ঠবহীন এবং অনেক সময় অস্বাভাবিক, পরিধেয় বসন-ভূষণ অতিশয় সংক্ষিপ্ত ও সাধারণ; তাদের গতি বা ভঙ্গির মধ্যে কোন লাবণ্য বা সুষমা নেই এবং অন্তর্নিহিত কোন ভাব বা চিন্তা তাদের মুখশ্রীতে ফুটে উঠেনি। যে সূক্ষ্ম সৌন্দর্যানুভূতি উচ্চশিল্পের প্রাণ এই মূর্তিগুলোতে তার সম্পূর্ণ অভাব। কিন্তু উচ্চাঙ্গের সৌন্দর্যবোধ বা প্রকাশের ক্ষমতা না থাকলেও সংসার ও সমাজের সাথে এসব ভাস্করের ঘনিষ্ঠ পরিচয়, নিকট সম্বন্ধ ও নিবিড় সহানুভূতি ছিল, তাদের শিক্ষা-দীক্ষা অপরিণত হলেও পুরুষানুক্রমে লব্ধ কৌশল ও স্বাভাবিক নিপুণতার সাহায্যে তারা এর সরল ও সঠিক পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছে। সংখ্যায় অগণিত যে সকল সাধারণ শ্রেণির নরনারী উচ্চতর শিল্প বা সৌন্দর্যবোধের দাবি করতো না, এই শিল্প রচনা তাদের জন্যই। তারা যে এই দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পরিচিত দৃশ্যাবলি এবং কাল্পনিক ও বাস্তব জগতের চিত্র বিশেষভাবে উপভোগ করতো, তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। এই হিসেবে পাহাড়পুরে প্রাপ্ত দৃশ্যাবলি বাংলার প্রাচীন লোকশিল্পের চমৎকার দৃষ্টান্ত বলে গ্রহণ করা যেতে পারে।
কিন্তু বাংলায় যে উচ্চশ্রেণির শিল্পী ছিল পাহাড়পুরের দ্বিতীয় শ্রেণির পাথরের ফলকে উৎকীর্ণ মূর্তিগুলো তার প্রমাণ। এগুলোর সংখ্যা খুব বেশি নয়। এরা প্রধানত কৃষ্ণ, বলরাম, শিব, যমুনা প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি। এর মধ্যে পুরুষ ও নারীর একটি প্রণয় চিত্রকে অনেকেই রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি বলে ব্যাখ্যা করেছেন। মূর্তিটির মস্তকের পশ্চাদ্দেশে দিব্য জ্যোতির চিহ্ন আছে বলে এটি সাধারণ মনুষ্যমূর্তি নয়। কৃষ্ণের জীবনের অনেক দৃশ্য এই মন্দির গাত্রে আছে। তাই মনে হয় এটি কৃষ্ণ ও তাঁর প্রেয়সীর মূর্তি। কিন্তু এই প্রেয়সী যে রাধা, এরূপ মনে করবার বিশেষ কোন কারণ নেই। কৃষ্ণ-রাধার প্রেমের কাহিনী মহাভারত ও প্রাচীন পুরাণাদিতে পাওয়া যায় না এবং এটি যে এই সময়ও প্রচলিত ছিল তারও কোন সন্তোষজনক প্রমাণ নেই । সুতরাং অনেকে মনে করেন এটি কৃষ্ণের পার্শ্বে রুক্মিণী অথবা সত্যভামার মূর্তি।
এই মূর্তির সাথে পূর্বোক্ত প্রথম শ্রেণির অন্তর্গত অনুরূপ কয়েকটি প্রণয়ী যুগলের মূর্তি তুলনা করলেই শিল্প হিসেবে এ দুইয়ের প্রভেদ বুঝতে পারা যাবে। মুখশ্রী, দাঁড়াবার ভঙ্গি, নারীমূর্তির ঈষৎ বক্র লীলায়িত দৃষ্টিভঙ্গি ও সলাজ হাস্যস্ফুরিত অধর, হস্তপদাদির গঠনসৌষ্ঠব, পরিধেয় বসনের রচনারীতি, সর্বোপরি নর-নারীর প্রেমের যে একটি মাধুর্য ও মহিমা এই মূর্তির মধ্যে দিয়ে ফুটেছে, এই বিষয়গুলো বিবেচনা করলে এই মূর্তি শিল্পীর শিক্ষা-দীক্ষা ও সৌন্দর্যানুভূতি যে পূর্বোক্ত শিল্পীগণের অপেক্ষা অনেক উচ্চস্তরের, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। বলরাম ও যমুনার মূর্তির সাথে যম, অগ্নি প্রভৃতির এবং দক্ষিণ প্রাচীরস্থিত শিব-মূর্তির সাথে অন্যান্য শিবমূর্তির তুলনা করলেও স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে যে, পাহাড়পুরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ভাস্কর্যের মধ্যে ব্যবধান
১৩৪ প্রাচীন বাংলার শিল্প ও স্থাপত্য: ভাস্কর্য শিল্প, পোড়ামাটির শিল্প, বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য
গুরুতর ও প্রকৃতিগত। দ্বিতীয় শ্রেণির মূর্তিতে গুপ্তযুগের গঠন-সৌষ্ঠব, অঙ্গের লাবণ্য ও সুষমা, গতিভঙ্গির বৈচিত্র্য ও সাবলীল ভাব, অন্তর্নিহিত ভাবের বিকাশে উদ্ভাসিত মুখশ্রী, প্রভৃতির স্পষ্ট নিদর্শন দেখা যায়। বাংলার যে শিল্পীদল এগুলো গড়ে ছিল, গুপ্তযুগের। শিল্পই তাদের আদর্শ ছিল। স্বাভাবিক প্রতিভা ও কঠোর সাধনা দ্বারা তারা তদনুযায়ী | শিক্ষা লাভ করেছিল। প্রথম শ্রেণির শিল্পীদের শিক্ষা ও আদর্শ ছিল সম্পূর্ণরূপে পৃথক। । বাংলার পল্লিতে পল্লিতে প্রাচীনকাল হতে যে শিল্পধারা সহজ ও স্বাভাবিক বিবর্তনের । ফলে গড়ে উঠেছিল, শিল্পীরা শিশুকাল হতেই অভ্যস্ত হয়ে তাকে রূপ দিয়েছিল।
পাহাড়পুরে কতকগুলো খোদিত প্রস্তর আছে, যাতে প্রথম শ্রেণির অপটুতা ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষা ও সৌন্দর্যবোধ উভয়ই আংশিকভাবে বর্তমান। কৃষ্ণের কয়েকটি বাল্যলীলা, কয়েকটি দেবদেবী ও দিকপালের মূর্তি এই শ্রেণির অন্তর্গত। কৃষ্ণের কেশীবধ এর একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। বালকৃষ্ণের মূর্তি এবং এর সাবলীল গতিভঙ্গি দ্বিতীয় শ্রেণির শিল্পীর অনুযায়ী, কিন্তু এর মুখ-চোখের গঠনে পরিপাটির যথেষ্ট অভাব। ইন্দ্রের মূর্তির মধ্যেও যথেষ্ট সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্য আছে কিন্তু এর চোখ ও মুখের গঠন অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এসব বিচার করলে এই খোদিত প্রস্তরগুলো একটি পৃথক বা তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সম্ভবত বাংলার প্রাচীন শিল্প ও গুপ্তযুগের নূতন আদর্শ, এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এর উৎপত্তি হয়েছিল ।
প্রথম শ্রেণির খোদিত পোড়ামাটি ও পাথরগুলো যে পাহাড়পুর মন্দিরের সমসাময়িক সে বিষয়ে সকলেই একমত। কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির খোদিত পাথরগুলো অপেক্ষাকৃত প্রাচীন। হয়ত এগুলো কোন মন্দির গাত্রে সংলগ্ন ছিল, পরে পাহাড়পুর মন্দিরে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এই বিভিন্ন শ্রেণির শিল্প যে বিভিন্ন যুগের নিদর্শন, তা নিঃসংশয়ে বলা কঠিন। কারণ একই সময়ে বাংলাদেশে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের শিল্প প্রচলিত ছিল, এটি অসম্ভব নয়। বাংলায় গুপ্তরাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর হতে গুপ্তশিল্পের প্রভাবও যে এ দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নয়। তার ফলে একদল সম্পূর্ণভাবে এই নতুন আদর্শ গ্রহণ করেছিল, আর একদল নতুন আদর্শ কতকাংশে গ্রহণ করলেও প্রাচীন পন্থা একেবারে ত্যাগ করে নি। এই দুই দল এবং অবিকৃত প্রাচীনপন্থীরা একই সময়ে বর্তমান থাকতে পারে, এরূপ কল্পনা একেবারে অযৌক্তিক নয় ।
৭.৩ পোড়ামাটির শিল্প
Terracotta
প্রাচীন বাংলায় পোড়ামাটির শিল্প খুবই উন্নতি লাভ করেছিল । পাহাড়পুর ব্যতীত আরো অনেক স্থানে, বিশেষকরে কুমিল্লার নিকটবর্তী ময়নামতি ও লালমাই পর্বতে অনেকগুলো পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিন্নর, বিদ্যাধর, বি-বধ ভঙ্গির নারীমূর্তি, অসি ও বর্ম হস্তে সৈনিক, ব্যাঘ্র শিকারী, ব্যায়ামকারী, পদ্ম, বাস্তব ও কাল্পনিক নানারূপ জন্তু ও দেবদেবীর মূর্তি প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর অধিকাংশই পাহাড়পুরের প্রথম শ্রেণির ন্যায় লোকশিল্পের নিদর্শন বলে গ্রহণ করা যায়। কিন্তু কয়েকটি রচনাভঙ্গি অপেক্ষাকৃত উচ্চাঙ্গের শিল্পজ্ঞানের পরিচায়ক। এটি ছাড়া
অনেক খোদিত ইটও পাওয়া গেছে।
প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও বহু পোড়ামাটির ফলক ও মূর্তি এবং কারুকার্য খোদিত ইট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গোবিন্দভিটায় প্রাপ্ত একটি ফলক অথবা চক্রকে খোদিত মিথুনমূর্তি উৎকৃষ্ট শিল্পকলার নিদর্শন।
গোলাকৃতি
প্রাচীন কোটিবর্ষ নগরীর ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও অনেকগুলো পোড়া মাটির ফলক পাওয়া গেছে। এগুলো মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত ও পালযুগের বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন। এর মধ্যে শুঙ্গযুগের কয়েকটি নারীমূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কোটি বর্ষের ধ্বংসস্তূপ বর্তমানে বাণগড় নামে পরিচিত ও দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এই স্থানে খনন কার্যের ফলে প্রাচীন মৌর্যযুগের স্তর পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্প্রতি এই খননকার্যের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন যুগের ভাস্কর্যের অনেক নিদর্শনের কথা বর্ণিত হয়েছে। চন্দ্রকেতুগড়, তমলুক ও আরো অনেক স্থানে পোড়ামাটির উৎকৃষ্ট ফলক পাওয়া গেছে ।
গৌড়ের প্রাচীন রাজধানী কর্ণসুবর্ণের ধ্বংসাবশেষ হতে কয়েকটি পোড়ামাটির মূর্তি ও আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি পলস্তারা (stucco) নির্মিত মূর্তি পাওয়া গেছে ।
বাংলায় প্রস্তর তেমন সুলভ না হওয়ায় মৃৎশিল্প খুব বেশি জনপ্রিয় ছিল এবং লোকশিল্প হিসেবে পালযুগে এবং সম্ভবত তার পূর্বেও বিশেষ উন্নতিলাভ করেছিল। মধ্যযুগেও বাংলার এই জাতীয় শিল্পপ্রতিভার কিছু কিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় ।
৭.৪ বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য
Characteristics of the Bengal Style
নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ এই চার শতাব্দের বাংলার শিল্পকে পালযুগের শিল্প নামেও অভিহিত করা যেতে পারে। কারণ হিসেবে বলা যায়, দ্বাদশ শতাব্দের সেন রাজগণ বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেও এবং বর্ম, চন্দ্র প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশও এই যুগে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করলেও এই চার শতাব্দের শিল্প মোটামুটি একই লক্ষণাক্রান্ত এবং পাল রাজ্যেই অভ্যুদয় ও বিকাশ ঘটেছিল। আর এসকল শিল্পে বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।
এই যুগে প্রস্তর ও ধাতুশিল্পের যতগুলো নিদর্শন এযাবৎ পাওয়া গেছে, তার বিষয়বস্তু কেবল দেবদেবীর মূর্তি। বাস্তব সংসার ও সমাজের সাথে এর প্রত্যক্ষ কোন সম্বন্ধ নেই। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে দেবদেবীর যে ধ্যান আছে, সর্বতোভাবে তারই অনুসরণ করে শিল্পীকে এই মূর্তি নির্মাণ করতে হতো। সুতরাং শাস্ত্রের অনুশাসন নিগড়পাশের
১৩৬ প্রাচীন বাংলার শিল্প ও স্থাপত্য: ভাস্কর্য শিল্প, পোড়ামাটির শিল্প, বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য
ন্যায় শিল্পীর স্বাধীন ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত করতো। শিল্পী বা শিল্পের কোন অব্যাহত গতি ছিল। না। প্রকৃত শিল্পবিকাশের পক্ষে নিশ্চয়ই এটি প্রধান অন্তরায়। তথাপি, সৃষ্ট মূর্তির মধ্য
দিয়ে শিল্পী যে তাঁর কলানৈপুণ্য ও সৌন্দর্যবোধ প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছেন, এটির তাঁর কৃতিত্ব ।
উপকরণ বিষয়েও শিল্পীর বিশেষ স্বাধীনতা ছিল না। অষ্টধাতু ও কালো কষ্টিপাথর সাধারণত এটিই ছিল মূর্তি নির্মাণের প্রধান উপাদান। রৌপ্য এবং স্বর্ণও মূর্তি নির্মাণে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু এরূপ মূর্তির সংখ্যা খুবই কম। কাষ্ঠনির্মিত মূর্তিরও মাত্র কয়েকটি
পাওয়া গেছে ।
শিল্পরীতির বিবর্তন সম্বন্ধে এবার কিছু আলোচনা করব। পালযুগের চারশত বছরে শিল্পের অনেক বিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু এই বিবর্তনের ইতিহাস সঠিকরূপে জানবার উপায় নেই । অধিকাংশ মূর্তিরই নির্মাণকাল মোটামুটিভাবেও জানা যায় না। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বহুশত মূর্তির মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে সময় বিজ্ঞাপক লিপি উৎকীর্ণ আছে। এর মধ্যে একটি দশম, দুইটি একাদশ ও দুইটি দ্বাদশ শতাব্দের। কোন এক শতাব্দীর বিশিষ্ট শিল্প লক্ষণ স্থির করা দুঃসাধ্য। কেবল শিল্পের ক্রমগতির সাধারণ রীতির দিক দিয়ে বিচার করা ছাড়া বাংলার এই যুগের শিল্প বিবর্তনের ইতিহাস জানবার আর কোন উপায় নেই। এই সাধারণ রীতিগুলো যথাযথভাবে স্থির করা সহজ নয়। অনেক সময়ে শিল্পীর ব্যক্তিত্ব ও অন্য অনেক বিশিষ্ট কারণে সাধারণ রীতির ব্যতিক্রম বা বিপর্যয় ঘটে। সুতরাং শুধু এই রীতি অবলম্বনে রচিত বিবর্তনের ইতিহাস সর্বদা নির্ভরযোগ্য নয়। বাংলার শিল্প সম্বন্ধে এরূপ ইতিহাস রচনার চেষ্টা খুব বেশি হয়নি। দুই একজন যাঁরা করেছেন, তাঁদের মতামত খুব স্পষ্ট নয় এবং সর্বসাধারণে গৃহীত হয়নি ৷
রচনাবিন্যাস, গঠনপ্রণালি ও সৌন্দর্যবিকাশের দিক দিয়ে বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য বিচার করলে এই সকল মূর্তির মধ্যে অনেক শ্রেণিভেদ করা যায়। কিন্তু এই প্রভেদগুলো কতটা স্থান বা কালের প্রভাবে এবং কতটা শিল্পীর ব্যক্তিগত রুচি বা অন্য
শিল্পীর কাজিপা কোন কারণে ঘটেছে, তা নির্ণয় করা কঠিন। তাই এই কারণগুলো বিচার করে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত সম্ভব না হলেও বাংলার এ যুগের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই শিল্প বিবর্তনের দুই একটি মূল সূত্র অবলম্বন করেছেন। বিবর্তনের দিক দিয়ে মূল্য খুব বেশি না হলেও বিশ্লেষণের দিক হতে এগুলো শিল্পের ইতিহাস আলোচনায় প্রয়োজনীয় সন্দেহ নেই ।
সাধারণত মূর্তিগুলো একটি বড় প্রস্তরখণ্ডের মধ্যস্থল হতে কেটে বের করা হয়। মূল মূর্তিটি কেন্দ্রস্থলে, পারিপার্শ্বিক মূর্তিগুলোও বিভূষণাদি এর দুইপাশে এবং চালচিত্র উপরে থাকে । প্রথমে মূর্তিগুলোর গভীরতার একার্ধ মাত্রা পাষাণের উপর উৎকীর্ণ হতো, কিন্তু ক্রমেই এই গভীরতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পরিশেষে মূল মূর্তিটি প্রায় সম্পূর্ণ আকার
লাভ করে এবং এই উদ্দেশ্যে এর চতুষ্পার্শ্বস্থ পাথর কতকটা একেবারে কেটে ফেলে দেওয়া হয় । আবার প্রথম প্রথম মূল মূর্তিটিই শিল্পীর প্রধান লক্ষ্য থাকে ও দর্শকের প্রায় সমস্ত মনোযোগ আকৃষ্ট করে। ক্রমশ পারিপার্শ্বিক মূর্তিগুলো ও নানাবিধ কারুকার্যে বিভূষিত চালচিত্র অধিকতর প্রাধান্য লাভ করে এবং সুদক্ষ শিল্পীর হস্তে মূল মূর্তির শোভাবর্ধন করে। কিন্তু সর্বশেষে কোন কোন স্থলে এই পারিপার্শ্বিক মূর্তি ও অলংকারের প্রাচুর্য এত বৃদ্ধি পায় যে, মূল মূর্তিটিই অপ্রধান হয়ে পড়ে। অনেকেই মনে করেন, এই দুটি পরিবর্তনই খুব সম্ভব প্রধানত কাল প্রবাহের ফলে ঘটেছে; অর্থাৎ উৎকীর্ণ মূর্তির অতিরিক্ত গভীরতা এবং পারিপার্শ্বিক মূর্তি ও চালচিত্রে অলঙ্কারের অতিরিক্ত ও অযথা বাহুল্য শিল্পীর অপেক্ষাকৃত অপ্রাচীনতার প্রমাণ। কিন্তু, এটি যে একটি সাধারণ সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায় না, রাজা গোবিন্দচন্দ্রের নামাঙ্কিত লিপিযুক্ত বিষ্ণু ও সূর্যমূর্তির সাথে রাজা তৃতীয় গোপালের চতুর্দশ বছরে উৎকীর্ণ সদাশিব মূর্তির তুলনা করলে তা বুঝা যাবে। আর এতে বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়।
একজন প্রসিদ্ধ শিল্পসমালোচক বাংলার এই যুগের বাঙালি রীতি সম্বন্ধে আলোচনা করে ভিন্ন ভিন্ন শতাব্দের শিল্পের লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে নবম শতাব্দে দেহের কমনীয়তা, সুডৌল গঠন ও শান্ত সমাহিত মুখশ্রী, দশমে শক্তিব্যঞ্জক দৃঢ় বলিষ্ঠ দেহ, একাদশে ক্ষীণ তনু, সুকোমল ভাবপ্রবণতা, মুখমণ্ডলের অপার্থিব দিব্য ভাব ও দেহের ঊর্ধ্বভাগের লাবণ্য ও সুষমা এবং দ্বাদশে ভাবব্যঞ্জনাহীন মুখশ্রী, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কৃত্রিম আড়ষ্টতা ও বসনভূষণের প্রাচুর্য এটিই এই চারযুগের বাংলার শিল্প রীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। নিছক শিল্পবিচারে বাংলার মূর্তিগুলোকে মোটামুটি উপরোক্তরূপে শ্রেণিবদ্ধ করা সম্ভবপর, কিন্তু এই চারটি শ্রেণি যে পর পর চারটি শতাব্দের প্রতীক, এই মত গ্রহণ করাও কঠিন। পূর্বোক্ত গোবিন্দচন্দ্র ও তৃতীয় গোপালের সময়ের মূর্তির তুলনা করলে তা বুঝা যাবে। প্রথম মহীপাল ও গোবিন্দচন্দ্ৰ সমসাময়িক। কিন্তু এই দুই রাজার নামাঙ্কিত লিপিযুক্ত দুই বিষ্ণুমূর্তি উপরোক্ত শ্রেণি বিভাগে এক পর্যায়ে পড়ে না ।
কালানুযায়ী বাঙালি রীতির বিশ্লেষণ সম্ভবপর না হলেও পালযুগের শিল্পসম্বন্ধে সাধারণভাবে কয়েকটি সিদ্ধান্ত করা যায়। শিল্পীরা পাথরের বা ধাতুর উপর খোদাই করতে যে অসাধারণ দক্ষতা লাভ করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। লতাপাতা, জীব-জন্তু ও নানারূপ নকশার কাজ অনেক মূর্তিতে এমন নিপুণ ও সূক্ষ্মভাবে সম্পাদিত হয়েছে যে বহুবর্ষব্যাপী শিক্ষা ও সাধনা এবং পুরুষাণক্রমিক অভ্যাস ব্যতীত এটি কখনো সম্ভবপর হতো না। এই যুগের মূর্তিগুলো যত্নপূর্বক পরীক্ষা করলে বাংলার লুপ্ত চারুশিল্প সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যায় এবং বাংলাদেশে যে অন্তত পাঁচ-ছয় শত বছর একটি জীবন্ত ও উচ্চাঙ্গের শিল্পধারা অব্যাহতভাবে প্রবাহিত ছিল, এতে কোন সন্দেহ থাকে না । মনুষ্যমূর্তি গঠনই বাঙালি ভাস্কর্য শিল্পরীতির উৎকর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় ও প্রমাণ। ।
বাংলার শিল্পী এ বিষয়ে কতটা সফলতা লাভ করেছিল, তার বিচার করতে হলে বাংলার দেবদেবীর মূর্তিই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। সনাতন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির নিকট দেবদেবীর মূর্তি মাত্রই সুন্দর। রাধাকৃষ্ণের নাম সংবলিত কবিতা ও সংগীত মার যেমন এক শ্রেণির লোককে মুগ্ধ করে, দেবদেবীর যেকোন চিত্র বা মূর্তিই তেমনি অনেকের নিকট অপূর্ব সৌন্দর্যের আকর বলে প্রতীয়মান হয়; এমনকি কালীঘাটের পটের ছবিও কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত ভাষায় বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটি ভক্তের দৃষ্টি, শিল্পের অনুভূতি নয়। শিল্পের প্রকৃত বিচার করতে হলে তা কেবল ভাব ও সৌন্দর্যের অভিব্যক্তির দিক দিয়ে করতে হবে। দেবদেবীর মূর্তি গঠনই আমাদের অতীত ভাস্কর্য শিল্পের একমাত্র নিদর্শন এবং এটিই এই শিল্পের প্রকৃত ইতিহাস জানবার একটি অন্তরায়। কিন্তু এই অন্তরায় অগ্রাহ্য বা অস্বীকার না করে এর সাহায্যেই যতদূর সম্ভব শিল্পের পরিচয় দিতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশও দেবদেবীর মূর্তির মধ্য দিয়েই শিল্পের বিকাশ হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইউরোপীয় শিল্পীরাও দেবদেবীর মূর্তির মধ্য দিয়েই অনবদ্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে জগতে অমরত্ব লাভ করেছেন। প্রাচীন যুগের 'ভেনাস ডি মিলো' এবং মধ্যযুগের র‍্যাফেল ও টিসিয়ান অঙ্কিত ম্যাডোনা ও ভেনাসের মূর্তি দেবীরূপে কল্পিত হলেও ভাব ও সৌন্দর্যের অভিব্যক্তির জন্যই এটি শিল্পজগতে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছে।
সারনাথে রক্ষিত মূর্তিগুলোর প্রভাব পালযুগের শিল্প রীতিতে দেখা গেলেও তাদের মধ্যে অনেক গুরুতর প্রভেদ আছে। প্রথমত, গুপ্তযুগের সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভঙ্গির পরিবর্তে বাংলার মূর্তিগুলোর কতকটা আড়ষ্ট ভাব ও জড়তা বিশেষভাবে লক্ষ করবার বিষয়। দ্বিতীয়ত, গুপ্তযুগের মূর্তিতে একটি আত্মসমাহিত অতীন্দ্রিয় ভাবের অভিব্যক্তিই শিল্পীর প্রধান লক্ষ্য, দেহের সুষমা এবং লাবণ্য অপ্রধান এবং এই ভাবেরই দ্যোতকমাত্র ৷ বাংলার মূর্তিগুলোতে এই আধ্যাত্মিক ভাব অপেক্ষা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দ ও ভোগের ছবিই যেন বেশি করে ফুটে উঠেছে। একের আদর্শ শান্ত সমাহিত অন্তদৃষ্টি, অন্যের আদর্শ কান্ত ও কমনীয় বাহ্য রূপ। বাংলার মূর্তিতে আধ্যাত্মিক ভাবের বিকাশ যে নেই, তা নয়; কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গিতে সাধারণত অন্তরের সংযম অপেক্ষা ভাবপ্রবণতার উচ্ছ্বাসই বেশি বলে মনে হয়। তবে পালযুগের শ্রেষ্ঠ মূর্তিগুলোতে এই দুই আদর্শের সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায়। এই মূর্তিগুলো “কোমল অথচ সংযত, ভাবপ্রবণ অথচ ধ্যানস্থ, লীলায়িত অথচ দৃঢ়প্রতিষ্ঠ।” বাংলার শিল্প গুপ্তযুগের শিল্প অপেক্ষা নিকৃষ্ট হলেও সমসাময়িক পশ্চিম মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের শিল্প অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । কারণ এই শিল্পসমূহে সাধারণত গুপ্তযুগের আধ্যাত্মিক ভাব এবং পালযুগের সৌন্দর্য ও লাবণ্য উভয়েরই অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে মধ্যযুগের এই মূর্তিগুলো প্রাণহীন ও অসুন্দর ধর্মগত ও ধর্মানুষ্ঠানের পাষাণময় রূপ ব্যতীত শিল্প হিসেবে এর বিশেষ কোন
সার্থকতা নেই । অবশ্য উপরোক্ত অঞ্চলেও কদাচিৎ সুন্দর মূর্তি দেখা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ এলিফান্টা দ্বীপের মূর্তিগুলোর উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে এই স্থানগুলোতে মধ্যযুগের মূর্তিগুলো শ্রীহীন। কেবল বিহার ও উড়িষ্যার শিল্পে বাংলার ন্যায় সৌন্দর্যের আদর্শ বর্তমান দেখা যায়। বাংলার পালযুগের শিল্পের প্রভাব এই দুই প্রদেশে এমন কি যবদ্বীপ ও পূর্ব ভারতীয় অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জেও বিস্তৃত হয়েছিল।
এ পর্যন্ত যে সকল আলোচনা করা হয়েছে, তা এই যুগের শিল্পসম্বন্ধে সাধারণভাবে প্রযোজ্য । কোন কোন মূর্তিতে যে এর ব্যতিক্রম দেখা যাবে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, কোন দেশের অথবা কোন যুগের শিল্পই কয়েকটি সাধারণ নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। পালযুগের শিল্পসম্বন্ধে সঠিক ধারণা করতে হলে এই যুগের মূর্তির সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় আবশ্যক । বর্তমান গ্রন্থে মূর্তিগুলোর বিস্তৃত বিবরণ বা আলোচনা সম্ভবপর নয় বলেই আমরা সংক্ষেপে এই যুগের শিল্পের গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সাধারণ মন্তব্য করেছি। এখন এই সকল মন্তব্য বিশদ ও পরিস্ফুট করবার জন্য কয়েকটি মূর্তির উল্লেখ করেছি।
শিল্পের দিক থেকে দেখতে গেলে বিষ্ণু ও পারিপার্শ্বিক দেবদেবীর মূর্তিগুলোই প্রাধান্য লাভ করে । শিয়ালদির বিষ্ণুমূর্তির মুখে শিল্পী বেশ একটু নতুনত্ব ও বৈশিষ্ট্য ফুটিয়েছেন। বিষ্ণুর উপরের দুই হস্তের অঙ্গগুলোর বক্রভাব কোমলতা ও কমনীয়তাসূচক, যদিও চক্র ও গদা এই দুই সংহারকারী অস্ত্র ধরবার সাথে তার সামঞ্জস্য নেই। এটি হতে বুঝা যায়, দুইটি স্তম্ভের ন্যায় সমান্তরাল পদযুগলের উপর দণ্ডায়মান সরলরেখার মতো দেহগঠন শিল্পীর কৌশলের অভাব নয়, তা কঠোর নিয়মানুবর্তিতাই সূচিত করে। পার্শ্বচারিণী দুইজনের বঙ্কিম দেহভঙ্গি হতেও এটি প্রমাণিত হয়। এই দুই পার্শ্বচারিণীর মূর্তি লাবণ্য ও সুষমার সাথে গাম্ভীর্য ও ভক্তির সংমিশ্রণে অপরূপ শোভা ধারণ করেছে। বজ্রযোগিনীর মৎস্যাবতার মূর্তিতে বিষ্ণুর মুখের কমনীয় কান্তি, অধরযুগলের হাসিরেখা ও দেহের সুডৌল গঠন এমন কৌশলে সম্পাদিত হয়েছে যে, বিষ্ণুর অধোভাগ মৎস্যের আকার হলেও এই অসঙ্গতি শিল্পের সৌন্দর্যের হানি করেনি। বাঘাউরার প্রস্তরনির্মিত এবং সাগরদীঘি, রংপুর ও বগুড়ার ধাতুনির্মিত বিষ্ণুমূর্তিও উচ্চশ্রেণির শিল্পকলার নিদর্শন। মূর্তিগুলোর দাঁড়াবার কৃত্রিম ভঙ্গির সাথে পার্শ্বচারিণীগণের সহজ ও সাবলীল ভাব বিশেষভাবে তুলনীয়। দেওরা ও বাণগড়ের বিষ্ণুমূর্তিও উচ্চাঙ্গের শিল্পকলার নিদর্শন। মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত ঝিল্লীর বরাহ অবতারের মূর্তিটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূর্তির মুখ বরাহের হলেও মনুষ্যাকৃতি অধোভাগে শিল্পী অনবদ্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছেন। বিক্রমপুর ও বীরভূমের অন্তর্গত পাইকোরে প্রাপ্ত দুইটি নরসিংহমূর্তিও কেবল দেহসৌষ্ঠবের গুণেই উচ্চশ্রেণির শিল্পে পরিণত হয়েছে।
১৪০ প্রাচীন বাংলার শিল্প ও স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্প, পোড়ামাটির শিল্প, বাঙালি রীতির বৈশিষ্ট্য
আনুমানিক সপ্তম শতকের বৈষ্ণব দেবদেবীসমন্বিত লাল বেলে পাথরের একটি ফলক বর্ধমান জেলার সাঞ্জোরা গ্রামে পাওয়া গেছে। ঐ জেলার বহরপুর গ্রামের একটি । বেণুগোপালের প্রস্তরমূর্তি, হুগলি জেলার মহনদ গ্রামের একটি বিষ্ণুর কূর্ম অবতার । মূর্তি, মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রাপ্ত ব্রঞ্জ ধাতু নির্মিত দুইটি মূর্তি এবং নদীয়া জেলায় প্র
একটি ঋষির মূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখ করবার মতো।
বাঘরার বলরাম-মূর্তির মুখে শিল্পী একটি স্বাত্রজ্য ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের স্থ দিয়েছেন। এর সরল অনাড়ম্বর পশ্চাদপটে মূলমূর্তির এবং তার পার্শ্বচারিণী ও বাহরে মূর্তি কয়টির সৌন্দর্য উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। ছাতিনা গ্রামের সরস্বতী মূর্তিদ অঙ্গসৌষ্ঠব, বসবার ভঙ্গি ও অপূর্ব মুখশ্রী ছাড়াও তার পারিপার্শ্বিক মূর্তিগুলোও বিভূষণাদি উচ্চশ্রেণির শিল্পের পরিচায়ক। নাগইল ও বিক্রমপুরে প্রাপ্ত দুইটি এবং কলকাতার যাদুঘরে রক্ষিত গরুড়মূর্তিতে শিল্পী যে দাস্য ও ভক্তির মাধুর্য প্রকটিত করেছেন, তা যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচায়ক
শিবমূর্তির মধ্যে শঙ্করবাঁধার নটরাজ শিবের মূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শিবের তাণ্ডব নৃত্যের সাথে ঊর্ধ্বমুখ বৃষের উদ্দাম নৃত্যভঙ্গি শিল্পীর অপূর্ব সৃজনশক্তির পরিচায়ক । নৃত্যের গতিভঙ্গি ও উদ্দামতা এই মূর্তির মধ্য দিয়ে অপরূপ রূপ পরিগ্রহ করেছে। বরিশালে প্রাপ্ত ব্রঞ্জের শিবমূর্তিতে শিল্পী একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটিয়ে সে সময়ে ধাতু মূর্তি নির্মাণের কৌশল যে কতদূর উন্নতি লাভ করেছিল, তার যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছেন। গণেশপুরের শিবমূর্তির অঙ্গসৌষ্ঠবে, কমনীয় মুখশ্রীতে এবং হস্তধৃত প্রস্ফুটিত পদ্মের স্বাভাবিক আকৃতিতে শিল্পী তাঁর সূক্ষ্ম সৌন্দর্যানুভূতি ও স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলায় চলিত কথায় কার্তিকই সৌন্দর্যের আদর্শ। উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত একটি ময়ূরবাহন কার্তিকে শিল্পী এই সৌন্দর্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। শেষোক্ত দুইটি মূর্তিতেই অলঙ্কারের বাহুল্য দেখা যায়। এ বাহুল্য শিল্পীর কুশলতায় মূর্তিদ্বয়ের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করেছে। অক্ষম শিল্পীর সৃষ্ট এই প্রাচুর্যে কিন্তু সৌন্দর্যের হানি ঘটে থাকে।
ঈশ্বরীপুরীর গঙ্গামূর্তি এই যুগের বাংলার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এর স্বাভাবিক লীলায়িত পদক্ষেপ ও বিশিষ্ট মুখশ্রী এবং পার্শ্বচর মূর্তি দুটির সুন্দর সরল দেহভঙ্গি সমগ্র মূর্তিটিকে অপরূপ সুষমা প্রদান করেছে।
রাজশাহীর ইন্দ্রাণী, বিক্রমপুরের মহাপ্রতিসরা এবং খালিকৈরের বৌদ্ধ তারাও এই শ্রেণির এক সুন্দর মূর্তি। কঠিন পাথরের মধ্য দিয়ে রক্তমাংসের দেহের কমনীয়তা ও নমনীয়তা ফুটে উঠেছে। হুগলি জেলায় প্রাপ্ত বরাহী (নবম শতক) ও মহিষমর্দিনীর (দশ শতক) মূর্তি দুইটি এবং জলপাইগুড়ি জেলার দোমোহনই গ্রামে প্রাপ্ত ভৈরবমূর্তিটি (একাদশ-দ্বাদশ শতক) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলায় অনেকগুলো সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে। এর কয়েকটিতে উচ্চাঙ্গ ও বিশিষ্ট। শিল্পজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। যাত্রাপুরের সূর্যের মুখশ্রী এবং কোটালিপাড়া ও চন্দ্রগ্রামের সূর্যমূর্তির রচনা বিন্যাস ও শান্ত সমাহিত ভাব অবিস্মরণীয়। এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি সুন্দরবন অঞ্চলে প্রাপ্ত ও কলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত সুন্দর সূর্যমূর্তি দুইটিরও
উল্লেখ করতে হয় ।
বিহারৈলের বুদ্ধমূর্তিতে বাংলায় যে শিল্পধারার সূচনা দেখা যায়, পালযুগে তার কিরূপ বিকাশ হয়েছিল, ঝেওয়ারিতে প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তি তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। সম্ভবত ব্রহ্মদেশের প্রভাবে বুদ্ধমূর্তির কিরূপ পরিবর্তন হয়েছিল, ঝেওয়ারির আর একটি বুদ্ধমূর্তি হতে তা জানা যায় ৷ প্রাচীন মগধের শিল্পধারার সাথে বাংলার শিল্পীগণ কিরূপ সুপরিচিত ছিল শিববাটির বুদ্ধমূর্তি তার চমৎকার দৃষ্টান্ত। ভগবান বুদ্ধ শান্ত- সমাহিতভাবে মন্দিরমধ্যে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট। মূর্তির চতুষ্পার্শ্বে বুদ্ধের জীবনের প্রধান প্রধান ঘটনাবলি পৃথক পৃথক ভাবে ক্ষুদ্রাকারে উৎকীর্ণ। গুপ্তযুগের সারনাথ শিল্পের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হলেও এরূপ রচনাপ্রণালি মগধ ও বঙ্গের একটি বিশিষ্ট শিল্পকৌশল বলে গণ্য হবার যোগ্য ।
কিন্তু কোন কোন বৌদ্ধমূর্তিতে বিদেশীয় প্রভাব কিছু কিছু বর্তমান থাকলেও বাংলার শিল্পী অনেক সময়ই বাংলার নিজস্ব শিল্পধারা অব্যাহত রেখে সুন্দর বৌদ্ধ মূর্তি গড়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ কলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত অবলোকিতেশ্বর এবং ময়নামতিতে প্রাপ্ত মঞ্জুবর বোধিসত্ত্বের উল্লেখ করা যেতে পারে। পূর্বোক্ত খালিকৈরের তারামূর্তির ন্যায় এই মূর্তি দুইটির অনবদ্য মুখশ্রী, সাবলীল দেহভঙ্গি ও রচনা বিন্যাস উৎকৃষ্ট শিল্পের নিদর্শন। যা স্বকীয় বাঙালি রীতির পরিচয় বহন করে।
গৌড়ের প্রাচীন রাজধানী কর্ণসুবর্ণের ধ্বংসাবশেষ হতে নবম ও দশম শতকের প্রস্তরনির্মিত বৌদ্ধ তারামূর্তি এবং পলস্তারা (stucco) নির্মিত অবলোকিতেশ্বরের সুন্দর মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রথমটি আছে আশুতোষ মিউজিয়মে ও দ্বিতীয়টি কলকাতায় সরকারি পুরাতত্ত্ব বিভাগের সংগ্রহালয়ে রক্ষিত হয়েছে।
পালযুগের পূর্বেকার কোন চিত্র অদ্যাবধি বাংলায় আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু খুব প্রাচীনকাল হতেই যে এদেশে চিত্রাঙ্কনের চর্চা বর্তমান ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ফা-হিয়ান তাম্রলিপ্তির বৌদ্ধবিহারে অবস্থানকালে বৌদ্ধমূর্তির ছবি আঁকতেন। সুতরাং তখন তাম্রলিপ্তিতে যে চিত্রশিল্প দীর্ঘকাল হতেই সুপরিচিত ছিল, এরূপ অনুমান করা যেতে পারে ।
সাধারণত মন্দির ও বৌদ্ধবিহার প্রভৃতির প্রাচীরগাত্র চিত্রদ্বারা শোভিত হতো। পরবর্তী কালের শিল্পশাস্ত্রে এরূপ স্পষ্ট অনুশাসন আছে এবং ভারতের অনেক স্থানে এর চিহ্ন এখনো পাওয়া যায়। বাংলার অনেক মন্দিরে ও বিহারে সম্ভবত এই প্রকার চিত্র বহু ছিল, মন্দির এবং বিহারের সঙ্গেই তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দে লিখিত কয়েকখানি বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে অঙ্কিত বজ্রযান-তন্ত্রযান-মতোক্ত, দেবদেবীর ছবি ব্যতীত প্রাচীন বাংলার আর কোন ছবি এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে রামপালে রাজত্বের ৩৯শ বর্ষে হরিবর্মার ১৯শ বর্ষে লিখিত দুইটি অষ্টসাহসিকা এবং হরিবর্মার ৮ম বর্ষে লিখিত একটি পঞ্চবিংশতি-সাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথি বাংলার প্রাচীন চিত্রবিদ্যা সম্পর্কে
আলোচনার প্রধান অবলম্বন ।
রেখাবিন্যাস ও বর্ণসমাবেশ- এই দুইয়ের উপরই চিত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠা এবং এই দুইটির প্রাধান্য অনুসারেই চিত্রের প্রধান দুই শ্রেণিবিভাগ কল্পিত হয়েছে। অজন্তা ও এলোরার চিত্রশিল্পে এই দুই শ্রেণিরই চিত্র দেখা যায় এবং পরবর্তীকালে ভারতের সর্বত্রই এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিম ভারতের চিত্রে রেখাবিন্যাসই প্রাধান্য লাভ করেছে। কিন্তু বাংলার চিত্রশিল্পে বর্ণসমাবেশ ও রেখাবিন্যাস উভয়েরই প্রভাব পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। পশ্চিম ভারতের চিত্রের সাথে তুলনা করলে এটিও বুঝা যায় যে, বাংলার শিল্পী রেখাবিন্যাসে অধিকতর দক্ষতা দেখিয়েছেন এবং তার সাহায্যে যে সৌন্দর্য ও মাধুর্যের অবতারণা করেছেন, পশ্চিম ভারতের চিত্রে তা দুর্লভ। বাংলার এই চিত্রশিল্পের প্রভাব আসাম, নেপাল ও ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
পরিকল্পনার দিক থেকে বাংলার চিত্র ও প্রস্তরে উৎকীর্ণ মূর্তির মধ্যে বড় বেশি প্রভেদ নেই। উভয়েরই বিষয়বস্তু ও রচনাপদ্ধতি এমন কি ভঙ্গি ও অঙ্গসৌষ্ঠব প্রায় একই প্রকারের। কেন্দ্রস্থলে মূল দেবদেবী, দুই পার্শ্বে আনুষঙ্গিক মূর্তিগুলো ও কদাচিৎ অলঙ্কাররূপে ব্যবহৃত দৃশ্যাবলি। কেবল দুই-এক স্থলে মূল মূর্তিটি এক পার্শ্বে উপবিষ্ট। এসব চিত্রের প্রায় এক অর্থে কেবল মূল মূর্তিটি অপরাপর পারিপার্শ্বিক মূর্তির সমাবেশ করে মূল মূর্তির প্রাধান্য সূচিত হয়েছে।
রাজা রামপালের রাজত্বের ৩৯শ বর্ষে লিখিত অষ্টসাহসিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথিখানিতে যে কয়েকটি ছবি আছে, তা বাংলার চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। সাধারণত কয়েকটি বর্ণ এবং সূক্ষ্ম রেখাপাতের সাহায্যে এই চিত্রগুলোর মধ্যে একটি লীলায়িত মাধুর্য ও অনবদ্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে মধ্যযুগের শিল্পজগতে শিল্পী উচ্চস্থান অধিকারের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বাংলার চিত্রশিল্পের নমুনা মুষ্টিমেয় হলেও এটি যে স্বর্ণমুষ্টি, তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। কেবল রেখার সাহায্যে চিত্র অঙ্কনে বাংলার শিল্পীগণ কতদূর পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন, সুন্দরবনে প্রাপ্ত ডোম্মনপালের তাম্রশাসনের অপর পৃষ্ঠে উৎকীর্ণ বিষ্ণুর রেখাচিত্র তার দৃষ্টান্ত। প্রাচীন বাংলার তাম্রপটে উৎকীর্ণ এরূপ আরও দুইটি রেখাচিত্র পাওয়া গেছে। এর সবকটিতে বাঙালি রীতির স্বকীয়বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]