বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠন : সুলতানদের ভূমিকা, সুফিদের ভূমিকা, উলামাদের ভূমিকা Formation of the Muslim Society in Bengal : Role of the Sultans, Role of the Sufis, Role of the Ulema

মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতানদের ভূমিকা
Role of the Sultans in formation of the Muslim society ৮.২ মুসলিম সমাজ গঠনে সুফিদের ভূমিকা
Role of the Sufis in formation of the Muslim society ৮.৩ মুসলিম সমাজ গঠনে উলামাদের ভূমিকা
Role of the Ulema in formation of the Muslim society
১৫০ বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠন সুলতানদের ভূমিকা, সুফিদের ভূমিকা, উলামাদের ভূমিকা
বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতান, সুফিও উলামাদের ভূমিকা ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতান, সুফি ও উলামারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নিম্নে মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতান, সুফি ও সুলতান সম্পর্কে
আলোচনা করা হলো :
৮.১ মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতানদের ভূমিকা
Role of the Sultans in Formation of the Muslim Society
বাংলাদেশে মুসলিম সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে মুসলমান বিজেতা এবং সুলতান কৃতিত্বের অংশীদার। এ ব্যাপারে তাঁদের কৃতিত্ব সুফিদরবেশদের অবদানের তুলনায় ততটা তাৎপর্যপূর্ণ না হলেও উল্লেখযোগ্য। বহুক্ষেত্রে, তাদের কার্যাবলি সেইসব মহান আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিজয়ে এবং প্রদেশে মুসলমান শাসন সংহতকরণে সাহায্য করেছে মুসলিম বিজেতা এবং শাসনকর্তাগণ। তাঁদের মহান ব্রতের অগ্রগতির জন্য নানাভাবে সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছেন। ধর্মান্তরিত লোক সংগ্রহে এবং ধর্মের প্রতি মুসলমানদের অনুরাগ সৃষ্টিতে, বাস্তবিকই রাজকীয় শক্তির সহযোগিতা ও সমর্থন ধর্মীয় নেতাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে সহায়তা করেছিল।
মুসলিম বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে মুসলমান সৈনিক, কর্মচারী ও অন্যান্যের সমাবেশ হয়। এই বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু সংখ্যক পীর-দরবেশ, উলামা, শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারক বাংলায় আগমন করেন এবং তারা ধর্মীয় প্রচারমূলক কার্যাবলি পরিচালনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। এভাবে এই বিজয় সুফিদের প্রচার কার্যের জন্য ব্যাপক সুযোগ এনে দেয়। ফলে, তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের প্রজাসাধারণের মধ্যে ধর্মপ্রচারে নিজেদেরকে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট করেননি সত্য কিন্তু তারা পীর দরবেশদেরকে সর্বরকম সুযোগ সুবিধা দান করেছেন এবং সকল সম্ভাব্য উপায়ে উলামা ও ধর্মপ্রচারকদেরকে সর্বরকম সুযোগ সুবিধা দান করেছেন এবং সকল সম্ভাব্য উপায়ে উলামা ও ধর্মপ্রচারকদেরকে তাদের আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় প্রচারমূলক ও সাংস্কৃতিক কার্যাবলিতে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। ধর্মের প্রতি শাসনকর্তাগণ নিজেরা অনুরক্ত ছিলেন এবং স্বভাবতই তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় এর উন্নতি বিধান করতে আগ্রহী ছিলেন। তারা অনুভব করেন যে, মুসলমান সম্প্রদায় বাংলাদেশে শক্তিশালী থাকলে তা প্রদেশে মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষে একটা সমর্থনের উৎস হবে এবং একে শক্তি জোগাবে। সুতরাং তাঁরা উলামা ও পীর দরবেশদেরকে যথেষ্ট সম্মান দিতেন এবং ইসলামের উন্নতিকল্পে তাদেরকে সমর্থন দান করতেন।
পীর দরবেশ ও উলামার প্রতি বাঙালি মুসলমান সুলতানদের সম্মান প্রদর্শন এবং বাংলাদেশে পীরদের ধর্মীয় প্রচারমূলক কার্যাবলির প্রতি তাদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। মুসলমান বিজয়ী ইখতিয়ারউদ্দিন
বিন বখতিয়ার খলজি শেখদের জন্য অনেক খানকাহ নির্মাণ করেন এবং তার এই দৃষ্টান্ত আমির ওমরাহও অনুসরণ করেন। মিনহাজের মতে গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি পীর দরবেশদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তারকৎ-ই-নাসিরীর এই লেখক ইওজ খলজির বাল্য জীবনের একটি কাহিনী বর্ণনা করেন। ইওজ খলজি যখন গুজের একজন সাধারণ লোক ছিলেন, সেই সময় তিনি একদা একটি গাধা চালিয়ে কোনো এক জায়গায় যাচ্ছিলেন, গাধার উপর জিনিসপত্র বোঝাই ছিল । পথে দুজন দরবেশ তার সঙ্গে কিছু খাদ্য সামগ্রী আছে কি না তা জানতে চাইলেন । ভ্রমণ পথে তার নিকট খাদ্য বলতে কয়েকখানা রুটি মাত্র ছিল। তবুও ইওজ তৎক্ষণাৎ মাটির উপর তার কাপড় বিছিয়ে দিয়ে সেই সামান্য খাদ্যই দরবেশদের সম্মুখে রাখেন। তিনি তাদের পানের জন্য পানি দেন এবং তাঁদের সেবার্তে দাড়িয়ে থাকেন। অতঃপর দরবেশদ্বয় ইওজ খলজিকে আশীর্বাদ করে বললেন, হুসামউদ্দিন তুমি হিন্দুস্তানে গমন কর, কেননা ইসলাম ধর্মের শেষ সীমান্তে অবস্থিত সে স্থান আমরা তোমাকে দান করলাম। এ ঘটনার মধ্যে যে সত্যই থাকুক না কেন, এতে অবশ্য সুফি দরবেশ ও ধর্মের প্রতি ইওজের গভীর শ্রদ্ধার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলার শাসনকর্তারূপে তিনি শেখ ও উলামার প্রতি অনুরূপভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং এভাবে মুসলমানদেরকেও উদ্বুদ্ধ করেন। মিনহাজের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, সুফি- দরবেশদেরকে বৃত্তি ও ভাতাদানের ব্যাপারে ইওজ খুব উদার ছিলেন। ধর্মপ্রাণ ও শিক্ষিত লোকের প্রতি গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির ভক্তি ও উদারতার আর একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন মিনহাজ। তার শাসনকালে খ্যাতনামা আলেম ও ধর্মপ্রচারক মাওলানা জালালউদ্দিন গজনবী লক্ষণাবতীতে আগমন করেন। ইওজ খলজি তাকে দরবার কক্ষে একটি ভাষণ দানের জন্যে আমন্ত্রণ জানান। বক্তৃতা শেষে, তিনি তাঁকে প্রায় দু'হাজার তংকা উপহার দেন এবং আমির, মালিক, মন্ত্রী ও অন্যান্যদেরকেও নির্দেশ দেন যেন তারা উদারভাবে উপহার দিয়ে মাওলানাকে সম্মানিত করেন। এভাবে, মাওলানা তিন হাজার স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা লাভ করেন। মিনহাজ লিখেছেন, লক্ষণাবতী থেকে মাওলানার স্বদেশাভিমুখে প্রত্যাবর্তনকালে আরো অতিরিক্ত পাঁচ হাজার মুদ্রা উপহার হিসেবে সংগৃহীত হয়। এভাবে, উদার প্রকৃতির এই খ্যাতনামা সুলতানের দৃষ্টান্তধর্মী ধর্মানুরাগের ফলে সেই ইমাম ও ইমামের পুত্র মাওলানা জালালউদ্দিন দশ হাজার মুদ্রা অর্জন করেন। লক্ষণাবতীতে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে মিনহাজ লিখেছেন যখন এই গ্রন্থের লেখক ৬৪১ হিজরীতে লক্ষণাবতী পৌঁছেন, তখন সেই সুলতানের বহু জনহিতকর কাজ ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে তিনি দেখতে পেয়েছেন।
সুলতান বলবনের সময়ে, বাংলার শাসনকর্তা মুগীমুদ্দিন তুমিল পীর দরবেশদের প্রতি এতবেশি অনুরক্ত ছিলেন যে, তিনি কলন্দরিয়া সম্প্রদায়ের দরবেশদেরে মণ স্বর্ণ দান করেন। ইবনে বতুতার মতে, ফকির ও সুফি দরবেশদের প্রতি ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের গভীর ভক্তি ছিল। মরক্কোর এই পরিব্রাজক মন্তব্য করেন, ফকিরদের প্রতি ফখরুদ্দিনের এত বেশি ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল যে, তিনি সৈয়দনা নামে একজন কলন্দর দরবেশকে সাদকাওয়ানে (চট্টগ্রামে) তার প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। তিনি ফকিরদের ভ্রমণের সুবন্দোবস্ত করেন এবং ঐ ভ্রমণকালে তাদের ভরণপোষণেরও ব্যবস্থা করেন ইবনে বতুতা লিখেছেন, সুলতান ফখরুদ্দিন নির্দেশ দেন যে, নদীপথে ফকিরদের নিকট থেকে কোনরূপ ভাড়া নেয়া হবে না এবং যাদের নিকট কোনো কিছু নেই তাদেরকে ভ্রমণ পথে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। যখন কোনো ফকির গ্রামে আগমন করেন, তখন তাঁকে অর্ধ দিনার দেয়া হয় ।
ধার্মিক সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ পীর দরবেশকে খুব সম্মান করতেন যখন তিনি গোরক্ষপুর অঞ্চল জয় করেন তখন তিনি বাহরাইচে অবস্থিত শেখ মাসুদ গাজীর মাজার শরীফ জিয়ারত করবেন এবং এই বিখ্যাত দরবেশের প্রতি তার শুঙ্কা নিবেদন করবেন। যখন সুলতান ইলিয়াস শাহ সুলতান ফিরুজ শাহ তুগলকের সৈন্যবাহিনী কর্তৃক একডালা দুর্গে অবরুদ্ধ হন, সে সময় পান্ডুয়ায় শেখ রাজা বিয়াবানী মৃত্যুবরণ করেন। সুলতান ইলিয়াস শাহ এই দরবেেেশর খুব অনুরক্ত ছিলেন। দরবেশের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ইলিয়াস শাহ ফকিরের ছদ্মবেশে একডালা দুর্গ থেকে বের হয়ে আসেন এবং নিজের জীবন বিপন্ন করেও তিনি প্রিয় শেখের জানাজায় অংশ গ্রহণ করেন ।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের ধর্মানুরাগ, পাণ্ডিত্য এবং পীর দরবেশেদের প্রতি প্রীতির জন্য খ্যাতি ছিল। তিনি নূর কুতব আলমকে খুব সম্মান করতেন। সুলতান * বাল্যকালে তার সহপাঠী ছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে শেখ নূর কুতব আলমকে উপহার ও আহার্য সামগ্রী পাঠাতেন। এই সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই পণ্ডিত কৰি শাহ মুহাম্মদ সগীর আরবি ও ফারসি ভাষায় অনভিজ্ঞ সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামি বিষয়সমূহ জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় তার 'ইউসুফ জুলেখা' কাব্য রচনা করেন। জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ শেখদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি নির্বাসিত সুফি-দরবেশ শেখ জাহিদকে সোনারগাঁও থেকে পান্ডুয়ায় ফিরিয়ে আনেন এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তিনি প্রায়ই নিজে পীরের নিকট হাজির হতেন। বাংলার আফগান শাসক সুলেমান কররানী ১৫০ জন শেখ ও উলেমার সঙ্গে ধর্মীয় ও দার্শনিক আলোচনায় সারারাত কাটিয়ে দিতেন। সম্রাট আকবর তার ধর্মীয় ও দার্শনিক আলোচনায় এই আফগান শাসকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন।
মুসলমান সভাসদবর্গ ও রাজকর্মচারীগণ শেখদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে শাসনকর্তা ও সুলতানদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন। পীর দররবেশদের মাজার জিয়ারতের ব্রত গ্রহণ করা তাদের মধ্যে খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল। বাহারিস্তান থেকে জানা যায় যে, মীর্জা নাথন তার পিতার অসুস্থ অবস্থায় শপথ করেন যে, তার রোগমুক্তির পর তিনি পবিত্র সুফি দরবেশ শেখ নূর কুতব আলমের মাজার শরীফ পরিদর্শন করবেন। ঘোড়াঘাট থেকে মীর্জা নাথন পান্ডুয়ায় গমন করেন এবং প্রথমেই তিনি শাহ মুকাম নামে পরিচিত কুতব আলমের বংশধর ও উত্তরাধিকারী শেখ আল ইসলাম আল মুসলেমীন মিয়ান শেখ মাসুদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর পর তিনি প্রথম দিন শেখ নুর কুতব আলমের মাজার জিয়ারত করেন। সেখানে তিনি আরও দুটো দিন অবস্থান করেন এবং তৃতীয় দিনে তিনি ভোজের ব্যবস্থা করেন ও দান খয়রাত করেন। এ কয়দিনে তিনি দিনে দুবার এবং রাত্রে একবার মাজার জিয়ারতে যেতেন। এভাবে তিনি তার অকৃত্রিম ভক্তি ও নিষ্ঠার দ্বারা পরম আশীর্বাদ লাভ করেন।
সুফিদের প্রতি শাসক আমির, ওমরাহ ও কর্মচারীদের অনুরূপ ভক্তি শ্রদ্ধার আরো বহু দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। তারা পীর দরবেশদের মাজারে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছেন এবং তাঁদের দরগাহ ও লঙ্গরখানাসমূহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লাখেরাজ জমি ইত্যাদির সংস্থান করেছেন ।
শেখ ও উলেমার প্রতি শাসনকর্তাদের ভক্তির ফলে তাঁদের পক্ষে এই নব বিজিত প্রদেশে ধর্মীয় প্রচারমূলক কার্যাবলি পরিচালনার পক্ষে সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হয়। মুসলমানদেরকে প্রভাবিত করে এবং তাদের মধ্যে ধর্ম ও ধর্মীয় নেতাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে দেয় ।
মোটামুটি বলা যায় যে, প্রথম যুগের মুসলমান সুলতানগণ কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক তাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারনের চেষ্টা করেছেন। তাদের কেউ কেউ শরিয়তি শাসন কায়েম করার ব্যাপারে এতদূর সচেতন ছিলেন যে, এটা বাস্তবিকই খোলাফায়ে রাশেদীনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসলামি আইনের প্রতি তাদের গভীর অনুরাগের ফলে, একজন সামান্য নারী বা পুরুষ, এমনকি একজন শক্তিশালী সুলতানের বিরুদ্ধেও নালিশ করতে পারত এবং অধিনস্থ কর্মচারী কাজী সুলতানকে পর্যন্ত একজন সাধারণ আসামীরূপে বিচারালয়ে ডেকে পাঠাতে পারেন। কথিত আছে যে, একদা সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ যখন তীর নিক্ষেপ অভ্যাস করছিলেন তখন আকস্মিকভাবে একটি তীর এক বিধবার পুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয় এবং সে মারা যায়। পুত্র-হারা মা কাজীর দরবারে সুলতানের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনয়ন করে। কাজী সুলতানকে তলব করেন। তলব মান্য করে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ একজন সাধারণ বিবাদীর মতো কাজীর বিচারালয়ে হাজির হন। কাজী সাধারণ অপরাধীর মতোই সুলতানের বিচার করেন এবং তার বিরুদ্ধে রায় দান
১৫৪ বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠন সুলতানদের ভূমিকা, সুবিদের ভূমিকা, উলামাদের ভূমি
করেন। এতে বিধবা সম্ভষ্ট হয় এবং প্রতিদানের এ রকম ক্ষেত্রে আইনানুনোদিত ি স্বর্ণ গ্রহণ করে সে সুলতানকে অভিযোগ থেকে অব্যাহত দান করে। পরিষদের আনুশাসন বিশ্বস্তভাবে অনুসরণের জন্য সুলতান কাজীকে প্রশংসা করেন এবং তাঁর উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করেন। এই ঘটনা আমাদেরকে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের নিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় খলিফা স্বীয় অপরাধের জন্য তারই কাজীর দরবারে হাজির হয়েছিলেন এবং বিচারের রায় অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী সামান্য উষ্ট্রচালককে জরিমানা দিয়েছিলেন। এ থেকে প্রকাশ পায় কতো নিষ্ঠুর হত মুসলমান শাসক ও কাজীরা তাদের ব্যক্তিগত তথা রাজনৈতিক জীবনে ইসল আইনের নির্দেশ মেনে চলতেন ।
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মতো শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ধর্মর বিদ্যোৎসাহিতা ও শরিয়তের প্রতি নিষ্ঠার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। ফিরিস্তার মতে অনুসারে সুলতান আলেমদেরকে রাজদরবারে আমন্ত্রন জানান এবং ধর্মীয় প্রশ্নে নায় ও নিরপেক্ষ রায় দানের জন্যে তাদেরকে নির্দেশ দেন। তিনি তাদেরকে এই মর্মে স করে দেন যে, যদি তারা সঠিকভাবে তাদের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন। প্রায় বেশিরভাগ কঠিন মামলাসমূহ (অভিযোগ) সুলতান স্বয়ং নিষ্পত্তি করতেন। বিশেষত সেই সমস্ত মকদ্দমা যা কাজীর পক্ষে মীমাংসা করা সম্ভব হতো না। সমসাময়িক কালের একজন কবি জৈনুদ্দিন এই সুলতানের বিদ্যাবত্ত ও জ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি রসুল বিজয়ের বর্ণনা গভীর আগ্রহের সঙ্গে শ্রবণ করেন।
বাঙালি মুসলমান শাসকগন তাদের ধর্মনিষ্ঠা ব্যক্তিত্ব এবং শরিয়তের অনুশাসনের প্রতি অনুরাগের দ্বারা বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনকে প্রভাবান্বিত করেছিে তারা তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বেও ধর্মীয় চরিত্রের উপর খুব গুরুত্ব আরোপ করেন। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা এবং কায়রোর সুলতানের প্রতি তাদের আনুগত্য থেকে বুঝা যায় যে, বাংলার মুসলমান সমাজ দুনিয়ার বিশাল মুসলমান সম্প্রদায়ের একট অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং এর প্রধান ছিলেন খলিফা। বাঙালি সুলতানদের কারো কারো মুদ্রায় এর সাক্ষ্য বহন করছে। সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ কায়রোতে খলিফার নিকট উপহার প্রেরণ করে তাঁর নিকট থেকে খেতাব লাভ করেছিলেন।
সুলতানগণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবাদিতেও নেতৃত্ব দান করতেন এবং এভাবে তারা মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ সৃষ্টিতে সহায়তা করতেন। তারা মক্কা মদিনার পবিত্র শহরগুলোতে নিয়মিতভাবে উপহার উপঢৌকন প্রেরন করতেন এবং হজ পালনের জন্যে লোকদেরকে সুযোগ সুবিধা দান করতেন। বিহারের বিখ্যাত সুফি পুরুষ মখদুম শেখ শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরীর শিষ্য মাওলানা মুজাফফর শামস বলখী কতৃক সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের নিকট লিখিত কয়েকটি পত্র থেকে জানা যায় যে,
সুলতান হজের জন্য কয়েকখানি জাহাজের ব্যবস্থা করতেন। এসব জাহাজ হজযাত্রীদেরকে চট্টগ্রাম থেকে আরবে নিয়ে যেত। এমনকি, অন্যান্য স্থানের যেমন বিহার ইত্যাদি অঞ্চলের মুসলমানরাও মক্কায় হজে যাওয়ার জন্য সুলতানের দেয়া এ সকল সুযোগ সুবিধা লাভে সমর্থ হতো। সুলতানের নিকট একটি পত্রে মাওলানা মুজাফফর শামস লিখেন, এখন হজের মৌসুম আসছে মক্কায় যাবার উদ্দেশ্যে গরিব দরবেশদের একটি দল আমার নিকট জমায়েত হয়েছে, তাদেরকে প্রথম জাহাজেই জায়গা দানের নির্দেশ দিয়ে চাটগাঁয়ের কর্মচারীদের (কারকুন) নিকট অনুগ্রহপূর্বক একটি ফরমান জারি করার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। আর একটি পরে মাওলানা প্রথম হজ যাত্রীবাহী জাহাজে দরবেশদের জায়াগার বন্দোবস্ত করার জন্য চট্টগ্রামের কর্মচারীদেরকে আশীর্বাদ করেন।
বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মুসলমান শাসনকগণ যে বিপুল সংখ্যক মসজিদ নির্মাণ করেছেন সেগুলোতে তাদের ধর্মীয় আবেগ, ধর্মের প্রতি অনুরাগ ও মুসলামনদের মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টিতে তাদের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। মুসলমান শাসকগণ মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতিতে মসজিদগুলোর গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। সুলতানদের এই মহৎ দৃষ্টান্ত আমির, ওমরা, রাজকর্মচারীগণ এবং এমনকি, অবস্থাপন্ন মুসলমানগণ অনুসরণ করে চলেন। অসংখ্য মসজিদের ধ্বংসাবশেষ বহু শহর ও গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। মুসলমান শাসনকর্তাদের গভীর ধর্মীয় আবেগের প্রমাণস্বরূপ প্রথম যুগে নির্মিত কিছু সংখ্যক মসজিদ ধর্মীয় কেন্দ্রের গুরুত্ব নিয়ে আজও বিদ্যমান আছে । মসজিদগুলোতে পাওয়া শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নির্মাতাগণ ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা ও মুসলমানদের সংহতির উদ্দেশ্যে এগুলো নিৰ্মাণ করেছিলেন। প্রত্যেকটি উৎকীর্ণ শিলালিপি কুরমানের আয়াত অথবা রসুলের বাণী উদ্ধৃত ধর্মোপদেশ বহন করছে। ১৩৬৪-৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সুলতান সিকান্দার শাহ কর্তৃক পান্ডুয়ার আদিনায় নির্মিত বিরাট মসজিদটি এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য । ৫০৭ ফুট দীর্ঘ এবং ২৮৫ ফুট প্রস্থ বিশাল চিত্তাকর্ষক মসজিদটি এ উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় ভবন। আদিনা মসজিদটি এ উপমহাদেশে মুলসমানদের অত্যন্ত প্রিয় ও পবিত্র। আদিনা মসজিদ সুলতান সিকান্দর শাহের ধর্মীয় আবেগের মূর্ত প্রতীক এবং বিরাট জামাতের নামাজের মাধ্যমে মুসলমানদের সংহতির জন্য তাঁর আগ্রহের বাহ্যিক প্রকাশ ।
মুসলমান শাসক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নতিকল্পে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাদের অনেকেই ধর্মীয় জ্ঞানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ, সুলতান রুকনউদ্দিন বারবক শাহ ও শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এদের প্রত্যেকের বিদ্যাবত্তার খ্যাতি ছিল। একটি উৎকীর্ণ লিপি সুলতান জালাল উদ্দিন
ফতেহ শাহকে ঐ যুগের একজন বড় আলেমরূপে উল্লেখ করেন। তিনি কুরআনের ব্যাথায় পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করেন এবং ধর্মীয় জ্ঞানে ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে খ্যাতি অর্ণ করেন। সুলতান ও কর্মচারীগণ মুসলমানদের শিক্ষার প্রতি খুব গুরুত্ব আরোপ করেন সে যুগের মাদ্রাসাগুলোর উৎকীর্ণ লিপিতে এটা প্ৰকাশ পায়। ১৫০২ খ্রিস্টার মালদহের ফিরূজপুরে সুলতান হোসেন শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার একটি উত্তীর্ণ লিপি মুসলমানদের জীবনে শিক্ষার ভূমিকা সম্বন্ধে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। এই লিপি মুসলমানদেরকে শিক্ষা সম্বন্ধে বাণী স্মরণ করিয়ে দেয়, “জ্ঞানান্বেষণ কর, সেজনা যদি সুদূর চীনেও যেতে হয়।” এই উৎকীর্ণ লিপিতে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, ধর্মবিজ্ঞান বিষয়াদির অনুশীলন ও শিক্ষাদান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার এবং তার নিকট থেকে পুরস্কার লাভের একটি পন্থা। ত্রিবেনীতে ৬৯৮ হিজরি (১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে) সুলতান রুকনউদ্দিন কাইকাউসের জনৈক রাজকর্মচারী কাজী নাসিরউদ্দিন কর্তৃক নির্মিত একটি মাদ্রাসায় অন্য আর একটি শিলালিপিতে এই একই মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। এই উৎকীর্ণ লিপিতে রাসূলুল্লাহর বাণী উদ্ধৃত করা হয়েছে, “তোমাদের জ্ঞানার্জন কর উচিত; কেন না জ্ঞানার্জনই সত্যিকারের আত্মনিবেদন, এর অনুসন্ধানই ভক্তি এবং এর আলোচনাতেই গৌরব । ”
ইসলামি ভাবধারা বিকাশে মাদ্রাসা ও মহাবিদ্যালয়সমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং এদের উন্নয়নের ব্যাপারে মুসলমান শাসক ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণ সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন, কারণ তারা মনে করতেন যে, মুসলমানদের উন্নতির জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের খুবই প্রয়োজন। মিনহাজ বলেন, মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার লক্ষ্মণাবতীতে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। সুলতান রুকনউদ্দিন কাইকাউসের রাজত্বকালে কাজী আল-নাসির মুহাম্মদ ৬৯৮ হিজরিতে (১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে) ত্রিবেনীতে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং শিক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। জাফর খান কর্তৃক ৭১৩ হিজরিতে (১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে) ত্রিবেনীতে আরো একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসাটি ‘দারুল খায়রাত' নামে পরিচিত হয়। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মালদহের ফিরূজপুরে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এন. এন. ল. এই মত পোষণ করেন যে, গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি লক্ষ্মণাবতীতে একটি মহাবিদ্যালয় স্থাপন করেন। বাংলার বিভিন্ন জায়গাতে বিভিন্ন সময়ে শাসক, সুলতান ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণ আরো অনেক মাদ্রাসা স্থাপন করেছেন। বিদ্যোৎসাহী বাঙালি সুলতানগণ এই প্রদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের তরীর জন্য বহু মাদ্রাসা ও কলেজ স্থাপন করেন। সুলতানদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ধর্ম ও ইসলামি শিক্ষার প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহ প্রদর্শন করেন, এমনকি মক্কায়ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। জানা যায় যে, সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ প্রচুর ব্যয়ে মক্কায় একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং শিক্ষক ও ছাত্রদের ভরণপোষণের জন্য বৃত্তির
ব্যবস্থা করেন। তিনি মদিনাতেও আর একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন এবং এর ব্যয় নির্বাহের বন্দোবস্ত করেন। আরো জানা যায় যে, সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহও মক্কায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার সুলতানদের এই সমস্ত মহান কার্যাবলি মুসলিম সমাজের উন্নতির প্রতি তাদের গভীর আগ্রহের পরিচায়ক।
বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতানদের ভূমিকা নিম্নোক্ত শিরোনামে উপস্থাপন করা যায়। বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতানদের ভূমিকা নিম্নোক্ত শিরোনামে
উপস্থাপন করা হলো :
মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক বাংলায় রাজ্যবিস্তারের সাথে সাথে মুসলিম সমাজের গোড়াপত্তন শুরু হয়। মুসলমান শাসনামলে বাংলা ছিল সুফি শাসক অধ্যুষিত এলাকা। ইসলাম বিস্তার ও মুসলমানদের মানসিক ও নৈতিক উন্নতি এবং উৎকর্ষ সাধনের জন্য সুফি এবং সুলতানদের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সব শ্রেণির মানুষকে প্রভাবিত করে; যা ইসলাম প্রচারে ও প্রসারে সাহয়ক ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠনের জন্য সুলতানদের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল কেননা, সেখানে অল্প সংখ্যক মুসলমান বিপুলসংখ্যক অমুসলিম জনগণের উপর তাদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। সমাজের বিকাশকে ত্বরান্বিতকরার জন্য সুলতানরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল ।
১. মাদ্রাসা স্থাপন : বাংলার সুলতান ও তাঁদের কর্মচারীদের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপন । রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কিছু মাদ্রাসা ছিল। যেমন- শেখ আবু তাওয়ামা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সোনারগাঁয়ের মাদ্রাসা। মসজিদের পাশেই সাধারণত মাদ্রাসাগুলো নির্মাণ করা হতো। মসজিদগুলো মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারত। বাংলার সুলতানরা এসব অট্টালিকা নির্মাণে সাহায্য করে মুসলমান সমাজের বিকাশে সহায়তা করেছেন এমন প্রমাণ শিলালিপিতে পাওয়া গেছে ।
২. মসজিদ নির্মাণ : মসজিদ মুসলিম শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা নামাজ পড়ার জন্য নির্মিত হয় যা মুসলমান ধর্ম বিশ্বাসের অন্যতম মৌলিক উপাদান। বখতিয়ার খলজির সময় হতে বাংলার বিভিন্ন মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়। প্রাপ্ত শিলালিপি হতে জানা যায় যে, সুলতানদের নির্দেশে মসজিদগুলো নির্মিত হয়েছিল। সুলতানরা শুধু তাদের শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য মসজিদ নির্মাণ করেন নি। বরং ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের উপলব্ধি এবং বাংলায় একটি নতুনসমাজ গড়ে তোলার জন্য মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
৩. মুসলিম পণ্ডিত ও সুফিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান : মুসলিম পণ্ডিত ও সুফিদের প্রতি সুলতানরা নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তাঁদেরকে বৃত্তিদান ও উপহার প্রদান; যাতায়াত ভাড়া প্রদান থেকে রেহাই দান; গ্রন্থ রচনার জন্য কবি ও পণ্ডিতদের
১৫৮ বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠন সুলতানদের ভূমিকা, সুবিদের নিবন, উপানাদের নি দান; সুফিদের দরগাহের কাছে সরাইখানা নির্মাণ বা পুকুর খনন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভূমি দান; সমাধি সৌধ নির্মাণ বা সুফিদের মসজিদের মতো অন্যান্য ধর্মীয় অট্টালিকা নির্মাণ এবং সুদের পরিদর্শনের সুবিধা দান ।
৪. কর্মচারীদের জ্ঞান চর্চা : কোন কোন সুলতান ও তাদের কর্মচারীর কুরআন, হাদিস এবং শরিয়তে ব্যুৎপত্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। একটি forld. সিকান্দার শাহ নিজেকে জ্ঞানী ও মহান রাজা বলে দাবি করেছেন। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ফারসিতে কবিতা রচনা করতেন এবং তিনি ত সম্পূর্ণ অবগত ও এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন ।
৫. সুলতানদের জনহিতকর কার্যাবলি : জনগণের দুর্দশা মোচন ছিল সুলতানার জনহিতকর কার্যাবলির অন্যতম উদ্দেশ্য। সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইন্ডা লখনৌতি নগরী ও তার শহরতলীতে বন্যার জল থেকে রক্ষার জন্য বহু বীর করেন এবং উত্তরে দেবকোট ও দক্ষিণে লখনৌর পর্যন্ত দুটি রাজধানী লখনৌতির সাথে সংযুক্ত করে তিনি একটি সড়ক নির্মাণ করেন। পরবর কালে সুলতান রুকুন উদ্দীন বরবক শাহ লখনৌতির পার্শ্ববর্তী নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সুলতান আলাউদ্দীন হাস শাহ বহু কূপ ও দিঘি খনন করেন।
৬. ইসলামি চেতনার উন্নতি বর্ধন : মুসলমানদের সুবিধার্থে মক্কা ও মদিন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। তাছার হজযাত্রীদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হতো। এ প্রসঙ্গে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ এবং জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতানদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। তারা মানুষের নৈতিক ও মানসিক উন্নতিবিধানে সাহায্য করেছে। তাদের আদর্শগত চরিত্র ও নৈতিক বল এবং সুস্থ মানবতার জন্য তাদের গভীর প্রজানুভূতি ও সেবা অমুসলমান জনসাধারণকেও আকৃষ্ট করেছিল। বাংলার মুসলিম সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে সুলতানদের দান অপরিসীম।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]