মুসলিম সমাজ গঠনে উলামাদের ভূমিকা Role of the Ulema in Formation of the Muslim Society

উলামা বলতে ইসলামের বিভিন্ন অনুশাসন সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতবর্গকে বুঝায়। ‘আলিম' (জ্ঞানী) পদবাচ্যের বহুবচন 'উলামা'। জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় যে ব্যক্তিবর্গ ইসলাম বিষয়ক জ্ঞান অর্জন ও অপরকে শিক্ষাদানে ব্যাপৃত থাকেন এবং ব্যক্তি জীবনে এর অনুশীলন করেন তাঁরাই উলামা। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞানই আলিমদের শক্তি ও মর্যাদার প্রধান উৎস। তত্ত্বগতভাবে আলিমরা মুসলিম উম্মার নেতা এবং ইসলামি আইনের ব্যাখ্যা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের ন্যায় বাংলাদেশের আলিমগণও একটি বিশেষ গোষ্ঠী ৷
আলিমগণ মুসলিম সমাজে বিশেষ মার্যাদা ভোগ করে থাকেন। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতিতেও ছিল আলিমদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ইসলাম ধর্মশাস্ত্র মতে, একজন শাসক ততক্ষণই মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে যতক্ষণ তিনি নিজে ইসলামি জীবনবিধান অনুসরণ করেন এবং ইসলামি বিধান অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিচালনা করেন। ইসলামি আইনের ব্যাখ্যা প্রদান এবং ইসলামি বিধানমতে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হচ্ছে কি না তা দেখা ছিল আলিমগণের অন্যতম দায়িত্ব। আলিমদের জন্য নির্ধারিত কাযী, মুফতি প্রভৃতি পদ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন।
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান, রাজতন্ত্রের বিকাশ, মুসলমানদের মধ্যে খারেজি, মাতুষিলা, শিয়া, সুন্নি (চার মযহাবসহ) ও অন্যান্য গোষ্ঠী ও মতবাদের উদ্ভব এবং এসব মতবাদ ও গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ও বৈষয়িক বিরোধের কারণে আলিমদের বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভাজন, ইউরোপীয় শক্তি কর্তৃক মুসলিম প্রধান দেশসমূহে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা, মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব বৃদ্ধি এবং ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সমাজের আলিমদের প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করে।
বাংলাদেশে মুসলমানদের ওপর এক সময় আলিমদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের অবসান, এখানকার মুসলমানদের ওপর পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব, আলিমগণের মধ্যে মত-পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্ভব, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম ব্যাক্তিবর্গের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কারণে বাংলার আলিম সমাজের প্রভাব পূর্বের তুলনায় যথেষ্ট হ্রাস পেলেও নিঃশেষ হয়নি। বিভিন্ন মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্রের ন্যায় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মনিষ্ঠ বিধায় আলিমগণ এখনো এখানে যথেষ্ট প্রভাব ও মর্যাদার অধিকারী। এখানকার অধিকাংশ মুসলমান সুন্নি। তাই বাংলাদেশের উলামা গোষ্ঠী বলতে প্রধানত সুন্নি আলিম সমাজকেই বুঝানো হয়ে থাকে। বাংলা অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারে সুফি দরবেশগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুসলমানদের উপমহাদেশ ও বঙ্গ বিজয় এতদঞ্চলে ইসলামের প্রসার ত্বরান্বিত করে। মুসলিম শাসনামলে এবং বিশেষত বাংলা ও উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর ধর্মের নানা প্রশ্নের ব্যাখ্যা, ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় কোন ধরনের রাজনীতি অনুসৃত হওয়া উচিত, ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি প্রভৃতি প্রশ্নে আলিমগণের বিভাজন ও গোষ্ঠী সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রশ্নেও আলিমগণ ছিলেন নানা মতের অনুসারী, বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত। বাংলাদেশের আলিম সমাজ বর্তমানেও নানা বিষয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করেন।
উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাংলাদেশে প্রধানত ছয়টি সুফি তরিকার প্রভাব রয়েছে। এগুলি হচ্ছে— খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (র) প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা, শেখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী প্রতিষ্ঠিত সোহরাওয়ার্দী তরিকা, বুআলী কলন্দর প্রতিষ্ঠিত কলন্দরিয়া তরিকা, খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দি প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা, আবদুল কাদের জিলানী প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা এবং শেখ আহমদ সিরহিন্দীর মোজাদ্দেদিয়া তরিকা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান সুন্নি মযহারের অনুসারী। তারা ইসলামের প্রথম চার খলিফাকে মহানবী হযরত মুহাম্মদের (স) যথার্থ উত্তরাধিকারী মনে করেন এবং তারা চার মযহাবের ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের সুন্নি মুসলমানদের প্রায় সকলেই হানাফি মযহাবভুক্ত ।
উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাংলাদেশের মুসলমানদের অনেকেই ‘পীর’ বা ‘মুরশিদ’ অনুসারী। এই পীর-মুরশিদগণের অনেকেই আলিম শ্রেণির। বাংলাদেশের পীরদের প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা যায়, শরীয়াহ অনুসারী এবং তরীকত ও মারেফাত অনুসারী। শরীয়াহ অনুসারীরা মারেফাত অনুসারীদের তুলনায় শরীয়ার বিধিবিধান মেনে চলার উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করেন। পক্ষান্তরে মারেফাত অনুসারীরা শরীয়াহ অপেক্ষা মারেফাতী পীরদের প্রতি বেশি অনুরক্ত। পীর অনুসারীরা শরীয়াহ
অপেক্ষা মারেফাতী পীরদের প্রতি বেশি অনুরক্ত। পীর অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন নামে বাংলাদেশে অনেকগুলো সংগঠন গড়ে উঠেছে। পীরদের খানকা থেকে এসব সংগঠন পরিচালিত হয়। পীর সাহেব স্বয়ং অথবা তাঁর উত্তরাধিকারী (সাধারণত রক্ত সম্পর্কের) এসব সংগঠনের নেতৃত্বে থাকেন। একজন বিশেষ পীরের অনুসারীগণ পরস্পরকে 'পীর ভাই' বা 'পীর বোন' সম্বোধন করে নিজেদের নৈকট্য প্রদর্শন করেন । কোন পীরের অনুসারী আলিমগণ সংশ্লিষ্ট সংগঠনের প্রাণশক্তিরূপে কাজ
করে থাকেন ।
মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন ও হাদিসের ভাষা আরবি বিধায় ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থায় আরবি ভাষা বরাবরই প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রধানত পীর-দরবেশদের খানকা ও মক্তবই ছিল প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীকালে উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরও দীর্ঘদিন ফার্সি ছিল এখানকার অফিস আদালতের প্রধান ভাষা। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর ইংরেজগণ উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু করে।
১৭৮০ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা। ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ফার্সির স্থলে ইংরেজি অফিস আদালতের ভাষার মর্যাদা লাভ করে। উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাংলার মুসলমানগণও ব্রিটিশ শাসন এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে প্রদত্ত নতুন শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। মুসলমানরা তাদের নিজস্ব বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা সংরক্ষণ এবং ইসলামি ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য আরবি-উর্দু-ফার্সি ভাষাকেন্দ্রিক নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। এ লক্ষ্যেই ১৮৬৪ সালে উত্তর প্রদেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেওবন্দ অনুসারী শিক্ষাব্যবস্থা মুসলমানদের ধর্মীয় চাহিদা মোতাবেক হলেও জাগতিক চাহিদা পূরণে অক্ষম বিবেচনা করে সচেতন ও আধুনিকতাবাদী মুসলিম নেতৃবৃন্দ ১৮৯৪ সালে লখনৌতে নাদওয়াতুল উলামা এবং ১৯২০ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রথম দিকে কলকাত আলীয়া মাদ্রাসায় প্রধানত মুসলিম ধর্মশাস্ত্র, আরবি ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা দেয়া হতো। পরবর্তীকালে অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে কিছু কিছু জাগতিক বিষয় এ মাদ্রসার পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়। মুসলিম ছাত্রদের ধর্মীয় জ্ঞান, পাশ্চাত্য ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার সঙ্গে পরিচিত করার লক্ষ্যে ১৯০৮ সালে কয়েকজন যুগ-সচেতন আলিম কর্তৃক নিউ স্কীম নামের বিশেষ ধরনের মাদ্রাসা চালু হয়। এ জাতীয় মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার সুবিধার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয় ইসলামিক স্ট্যাডিজ এবং আরবি বিভাগ ।
১৭০ বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠন:সুলতানদের ভূমিকা, সুফিদের ভূমিকা, উলামাদের ভূমিকা
ধর্মীয় শিক্ষা তথা শিক্ষার নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের আলিম সমাজের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। পাঠ্যক্রম, সরকারি অনুমোদন ও অনুদান গ্রহণ বা বর্জন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পদ্ধতি প্রভৃতি প্রশ্নে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত। এর এক অংশ হচ্ছে সরকারি অনুমোদন ও মঞ্জুরী প্রাপ্ত মাদ্রসা এবং অপর ভাগে রয়েছ সরকারি প্রভাবমুক্ত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আর্থিক আনুকূল্যে পরিচালিত মাদ্রাসা। সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত মাদ্রাসাকে সরকারি মাদ্রাসা এবং সরকারের যথাসম্ভব প্রভাবমুক্ত মাদ্রাসাকে ক্বওমী মাদ্রসা (দারসে নিজামী) বলা হয়। বাংলাদেশে আরো বিভিন্ন নাম ও ধরনের মাদ্রাসা থাকলেও এই দুটি ধারাই প্রধান ।
ধর্মের বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যা, ধর্মীয় শিক্ষা পদ্ধতি প্রভৃতির ন্যায় ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিভিন্ন প্রশ্নে বাংলাদেশের আলিম সমাজ বহু ভাগে বিভক্ত। তবে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম আলিমগণই সর্বপ্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। দিল্লির শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র)কে (১৭০৩-১৭৬২) এ আন্দোলনের প্রবক্তা বলা যায়। শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুত্র শাহ আব্দুল আযীম (১৭৪৬-১৮২৩) ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব ঘোষণা দিয়ে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। শাহ আবদুল আযীযের সাগরেদ রায়বেরেলীর সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬১৮৩১) তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া আন্দোলন শুরু করেন। উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাংলার আলিম সমাজও ব্যাপকভাবে এ আন্দোলনে অংশ নেন। সৈয়দ আহমদের অনুসারী বাংলার হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৭৯-১৮৪০) ও মীর নিসার আলী তীতুমীরের (১৭৮২- ১৮৩১) আন্দোলনেও বাংলার আলিম সমাজ অংশগ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ ও জমিদারদের প্রজা বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধে অবদান রাখেন।
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যর্থতা উপমহাদেশের সচেতন আলিম সমাজের একাংশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তনে অনুপ্রাণিত করে। কয়েকজন খ্যাতনামা আলিম ব্রিটিশের সঙ্গে সাময়িক সহযোগিতা করে মুসলিম স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একলা চলো নীতি পরিবর্তন করে উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করার পক্ষেও আলিমদের একটি অংশ অবস্থান নেন। এঁদেরই উদ্যোগে ১৯১৯ সালে ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ' গঠিত হয়। বাংলার আলিমদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষকরে দেওবন্দ মাদ্রাসায় অধ্যয়নকারী আলিমগণের এক বড় অংশ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন পরিচালনার পক্ষে কাজ করতে থাকেন। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার প্রশ্নে অবশ্য দেওবন্দী আলিমগণ ঐকমত্য পোষণ করতে পারেননি। অনেক খ্যাতনামা দেওবন্দী আলিম মুসলিম লীগের
আন্দোলনের সপক্ষে মত প্রকাশ করেন। অপরদিকে, দেওবন্দী আলিমগণের ধর্ম ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন বেরেলভী আলিম বলে পরিচিত একটি গোষ্ঠী। এঁরা ছিলেন প্রধানত অরাজনৈতিক আলিম এবং পীর-বুজর্গের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী। এছাড়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ বিরোধিতা করে ১৯৪১ সালে মওলানা সাইয়িদ আবুল আলা মওদুদীর (১৯০৩-৭৯) নেতৃত্বে গঠিত হয় জামায়াতে ইসলাম-ই-হিন্দ ।
স্বল্পসংখ্যক আলিম কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গেও সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাংলার আলিম সমাজও তৎকালীন রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে কতিপয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, তীর ব্রিটিশ বিরোধিতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা, ইসলাম ও আধুনিকতার সমন্বয়, মুসলিম স্বার্থে অন্ধ ব্রিটিশ বিরোধিতা পরিহার এবং প্রয়োজনে সমর্থন দান, কংগ্রেসের পরিবর্তে মুসলিম লীগের আন্দোলনে সমর্থন দান করে ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থ রক্ষা, ইসলামি পুনর্জাগরণ ও ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ বিরোধিতা প্রভৃতি নীতিগত প্রশ্নে উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাংলার আলিমগণও বিভক্ত ছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর অখণ্ড ভারতকেন্দ্রিক উলামা সংগঠনগুলো ভারত ও পাকিস্তানের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন নামে পুনর্গঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী আলিমগণও নতুন রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পাকিস্তানে ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়ন ও নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির কার্যক্রমে ব্যাপৃত হন। ভারতে বসবাসকারী আলিমগণের অধিকাংশকে হিন্দুপ্রধান ভারতের বাস্তববতা অনুসারে কার্যপন্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়। পাকিস্তানে নেযামে ইসলামসহ বিভিন্ন নামে আরো কয়েকটি আলিম-প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সংংগঠনভুক্ত না হয়েও খ্যাতনামা কয়েকজন আলিম ও পীর পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আলিমগণের মধ্যে বহু প্রশ্নে মতানৈক্য থাকলেও পাকিস্তানকে ইসলামি আদর্শানুসারী রাষ্ট্রে পরিণত করার ব্যাপারে আলিমগণ সাধারণত একমত ছিলেন। এ কারণে পাকিস্তান সরকারকে বিভিন্ন সময়ে ইসলামি আদর্শানুসারী অবস্থান গ্রহণ করতে হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ধর্ম ও রাজনীতিকে যথাসম্ভব পৃথকীকরণের লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় আদর্শরূপে গৃহীত হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি হয় নিষিদ্ধ । ১৯৭৭ সালে ধর্মীয় রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে আলিমগণ বিভিন্ন নামে অনেক সংগঠন গড়ে তোলেন। লোক
বাংলাদেশের আলিম সমাজের এক বড় অংশ সক্রিয় রাজনীতিতে নিরুৎসাহী। আবার, যেসব আলিম রাজনীতিতে উৎসাহী তাঁরা রাজনীতির প্রশ্নে ঐতিহ্যবাদী, নয়া ঐতিহ্যবাদী, ইসলামি আধুনিকতাবাদী ইত্যাদি নানা ভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাদী আলিমগণকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগের আলিমগণ ইসলামের প্রথম যুগের গৌরব ও ঐতিহ্য লালনের সঙ্গে সঙ্গে শরীয়াহ ভিত্তিক জীবনযাপনের ওপর খুবই গুরুত্ব দেন। কুত্তমী মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণকারী এবং দেওবন্দ অনুসারী আলিমগণ এ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অতিমাত্রায় পীর ও মাযার ভর্তির এঁরা বিরোধী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন প্রশ্নে প্রধানত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ অনুসারী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাদী আলিমগণ রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। শরীয়াহ প্র প্রায় অভিন্ন মত পোষণ করলেও দেওবন্দী আলিমগণের একটি অংশ (মওলানা আশরাফ আলী থানভীর অনুসারী) সাধারণত রাজনীতিতে সক্রিয় নন। ঐতিহ্যবাদী আলিমগণের দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের বেরেলভী আলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। মাঝে মধ্যে রাজনীতিতে সরব হলেও সাধারণভাবে এ গোষ্ঠীর আলিমগণকে রাজনীতি নিরাসক্ত বলা যায় ।
বাংলাদেশের আলিম সমাজের একটি অংশ তাবলীগ আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। দেওবন্দী আলিমগণ দিল্লিতে তাবলীগ আন্দোলনের গোড়াপত্তন করলেও পরবর্তীকালে ভিন্ন গোষ্ঠীর আলিমগণও এ আন্দোলনে যোগ দেন। বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু লোকের মধ্যেও অরাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলন হিসেবে তাবলীগের জনপ্রিয়তা রয়েছে।
ইসলাম প্রচারের সূচনাকাল থেকে অদ্যাবধি বাংলার মুসলমানদের ওপর পীর, দরবেশ, আউলিয়া বলে খ্যাত আলিমদের বেশ প্রভাব রয়েছে। বিশেষ বিশেষ পীরের অনুসারীদের সাংগঠনিক কাঠামোতে ঐক্যবদ্ধ হতে দেখা যায়।
বাংলাদেশে হাজার হাজার মসজিদ ও বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে। ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হয়। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মাদ্রাসার শিক্ষক পদে লক্ষ লক্ষ আলিম কাজ করছেন। এদেশের প্রায় সকল ধরন ও পর্যায়ের আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার কাজে আলিমগণ নিয়োজিত রয়েছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তৃত। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আলিমগণ নানাভাবে যুক্ত রয়েছেন কাজী হিসেবে পরিচিত মুসলিম বিবাহ নিবন্ধকের পদটি নিরঙ্কুশভাবে আলিমগণের জন্য সংরক্ষিত। এভাবে দেখা যায় যে, আলিম সমাজ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের আলিমগণ বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও সামগ্রিকভাবে তারা সমাজে প্রভাব ও মর্যাদার অধিকারী। তাই মুসলিম সমাজ গঠনে আলেম-উলামদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]