বাংলায় ও উত্তর-ভারতে সুফিবাদ Sufism in Bengal and North-India

বাংলার সুফিবাদ ছিল উত্তর-ভারত ও পশ্চিম-এশিয়ার সুফিবাদের বিস্তৃতি। ফলে এখানকার সুফিরা ঐ সমস্ত উৎস থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। কিন্তু কালক্রমে, এই সুফিবাদ পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশে সুফিরা হিন্দু ও বৌদ্ধদের মরমী চিন্তাধারার আরো অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে আসে। সংস্কৃত মরমী সাহিত্য অমৃতকাণ্ডের ফার্সি ও আরবি ভাষায় অনুবাদ এবং কৃচ্ছসাধন পরায়ণ হিন্দু ও বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ইসলাম গ্রহণ ইত্যাদির ফলে সুফিরা এই দেশের অধিবাসীদের আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন। তারা হিন্দুদের ‘যোগ’ নিয়মের তারিফ করেন এবং এর অভ্যাসের প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে বাংলার সুফিরা তাঁদের সম্প্রদায়ের উত্তর ভারতীয় সুফিদের তুলনায় অধিকতর উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন। যতই সময় অতিবাহিত হতে থাকে ততই তাদের কেউ কেউ ধর্মীয় প্রশ্নের মীমাংসার এতবেশি চরম উদারতার পরিচয় দেন যে, তাদের নিকট মুসলমান 'সুফি' ও হিন্দু কৃচ্ছসাধকের মধ্যকার প্রকৃত পার্থক্য কার্যত বিলীন হয়ে যায় এবং ‘বাউল' নামে পরিচিত মরমী সম্প্রদায়ে এসে এ দুটো আধ্যাত্মিক মতবাদ একটি মিলনের পথ খুঁজে পায়। বাউলরা তাদের মরমী মতবাদে হিন্দু-মুসলমান উভয় ভাবধারার সম্মেলন ঘটায়।
বাংলার সুফিবাদ উত্তর ভারতীয় সুফিবাদের আধ্যাত্মিক বিস্তৃতি; সেজন্য বাংলার সুফিরা আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তর ভারতের প্রাধান্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলায় ‘চিশতীয়া সিলসিলার' প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠাতা শেখ আঁখি সিরাজ ছিলেন বাস্তবিকই এই প্রদেশে তার বিখ্যাত পীর দরবেশ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার আধ্যাত্মিক আধিপত্যের একজন প্রতিনিধি। এই আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব বাংলার উপর উত্তর ভারতের রাজনৈতিক শাসন আরো সুদৃঢ় করে তুলতে সহায়তা করে। অতএব, দেখা যায় যে, সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক যখন ইলিয়াস শাহকে দমন করতে অগ্রসর হন, সে সময় তিনি অন্যদের সঙ্গে শেখদের প্রতিও বাংলার বিদ্রোহী শাসনকর্তাকে সমর্থন না করার জন্য এক আদেশ জারি করেন। পরবর্তীকালে, বাংলার ‘সুফি’রা উত্তর ভারতের
আধাত্মিক কর্তৃত্বাধীন থেকে সরে আসেন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাদের চিন্ত ধারায় এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তারা বাংলার স্বাধীন সালতানাতের সমর্থক হয়ে উঠেন। সুতরাং দেখা যায় যে, হযরত নূর কুতবুল আলম স্বীয় প্রভাবের বলে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহীম শার্কীকে এই প্রদেশ অধিকার করার পরিকল্পনা। পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন।
বাংলার সুফিরা উত্তর-ভারতীয় সুফিদের মতো নিজেদেরকে ধর্মীয়, শিক্ষা মূলক ও মানব সেবামূলক কার্যাবলিতে নিয়োজিত করেন। তাদের একাজে সুফি দরবেশগণ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে এবং তাদের শিক্ষা অধিবাসীদের বিশেষকরে অতিপ্রাকৃতের পূজায় অভ্যস্ত হিন্দু এবং কুসংস্কার ও জ্যোতিষ গণনায় বিশ্ববাসী জনসাধারণের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও বাঙালিদের মধ্যে মরমী মনের বিকাশ থেকে এ প্রদেশে সুফিদের সাফল্যের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় ৷
৯.৪ বাংলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সুফি
Some Important Sufis in Bengal
পুরুষানুক্রমে স্থানীয় লোকদের মনে সংরক্ষিত জনশ্রুতিতে মুসলিম পূর্ব বাংলায় কিছুসংখ্যক মুসলমান সুফির উল্লেখ আছে । কিন্তু এই কিংবদন্তী সমর্থনের পক্ষে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। অতএব, পারিপার্শ্বিক প্রমাণের আলোকে এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন ।
১. বাবা আদম শহীদ : ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার বিক্রমপুরে প্রচলিত একটি জনশ্রুতিতে বল্লাল সেন নামক একজন হিন্দু রাজার সঙ্গে বাবা আদম নামে একজন মুসলমান দরবেশের যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, বল্লাল সেন কর্তৃক বিক্রমপুরস্থ রামপালের জনৈক মুসলমানের প্রতি অত্যাচারের প্রতিকারার্থে এই সাধুপুরুষ মক্কা থেকে সাত হাজার শিষ্যসহ এখানে আগমন করেন। তিনি রামপালের নিকট আবদুল্লাহপুরে তাঁর আস্তানা স্থাপন করেন এবং গরু জবেহ করেন। এ সংবাদ পেয়ে বল্লাল সেন বল্লালবাড়ি নামে পরিচিত তাঁর রাজধানী থেকে আব্দুল্লাহপুরের দিকে অগ্রসর হন। তিনি বাবা আদমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু তিনি যুদ্ধে কোনরূপ সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হন। বাবা আদম তখন তাঁর নিজের তরবারি রাজাকে সমর্পণ করেন এই বলে যে, তাঁর তরবারি দিয়েই কেবল তাকে হত্যা করা যেতে পারে। বল্লাল সেন তখন ঐ তরবারি দিয়ে বাবা আদমকে হত্যা করেন। বাবা আদম শহীদের মৃত্যুর পর বল্লাল সেন অবশ্য বেশিদিন বেঁচে থাকেননি। ভাগ্যের পরিহাসে রাজাও সপরিবারে অগ্নিকাণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে জীবন বিসর্জন করতে বাধ্য হন। আনন্দ ভট্টের বল্লাল চরিত্র নামক সংস্কৃত গ্রন্থে জনশ্রুতির কাহিনীর মোটামুটি সমর্থন পাওয়া যায়। তবে ব্যতিক্রম এই যে, বল্লাল সেনের শত্রুর নাম দেয়া হয়েছে বায়াদুম ও তার পাঁচ হাজার ম্লেচ্ছ সৈন্যদল। “বায়াদুম' বাবা আদম এর অপভ্রংশরূপে অবশ্যই গ্রহণ করা চলে এবং ‘ম্লেচ্ছ' নামটি হিন্দুরা সাধারণত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকে ।
বিখ্যাত সেন রাজা বল্লাল সেনের উপর লিখিত আনন্দভট্টের 'বল্লালচরিতে'র যথার্থতা সম্বন্ধে কোনো কোনো পণ্ডিত সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, রামপালের বল্লালবাড়ি বল্লাল সেনের রাজধানী ছিল বা তিনি এখানে কোনদিন। বাস করেছেন। অধিকন্তু এও বিশ্বাস করা যেতে পারে না যে, মুসলমানাদের বাংলা বিজয়ের অর্ধ শতাব্দী পূর্বে পাঁচ হাজার মুসলমানের একটি দল ঢাকা জেলার অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করেছিলেন, বিশেষকরে রাজা বল্লাল সেনের রাজত্বকালে, যিনি বাংলার একজন শক্তিশালী হিন্দু রাজা ছিলেন। এন. এন. বসু উল্লেখ করেন যে, আনন্দভট্টের 'বল্লাল চরিতে' সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেনের কথা বলা হয়নি, বরং বল্লাল সেন নামের জনৈক বৈদ্য জমিদারের কথা বলা হয়েছে, চতুর্দশ শতকের শেষভাগে ইনি বিক্রমপুর অঞ্চলের প্রতিপত্তিশালী জমিদার ছিলেন। এ সময়ে পূর্ববঙ্গসহ সমগ্র বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেবল কয়েজন হিন্দু জমিদার তখন কোনো কোনো জায়গায় তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলেন। এতে মনে হয় যে, কিংবদন্তীর বল্লাল সেন যিনি বাবা আদম শহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন তিনি বিক্রমপুরের জমিদার ছিলেন।
রামপালে বাবা আদম শহীদের একটি সাদাসিধে ধরনের সমাধি রয়েছে। এটি একটি মসজিদের সম্মুখে অবস্থিত। সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহের রাজত্বকালে মালিক কাফুর নামে একজন মালিক কর্তৃক ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে এই সমাধিটি নির্মিত হয়েছিল। মসজিদের উৎকীর্ণ লিপিটিতে বাবা আদম শহীদের নামের কোন উল্লেখ নেই। এটা অবশ্য উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মসজিদের দালানটি এই সুফি দরবেশের মাজার সংলগ্ন ছিল। মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র জনসংখ্যা নিয়ে রামপাল ছিল একটি সামান্য গ্রাম মাত্র। এর বিশেষ কোনো গুরুত্ব না থাকলে একজন আবিসিনীয় সেনাপতি কখনো মসজিদ নির্মাণের জন্য এমন একটি গ্রাম নির্বাচন করতেন না। বাবা আদম শহীদের মাজার এ স্থানটিকে একটি ধর্মীয় পবিত্রতা ও গুরুত্ব দান করেছে। বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলমানগণ এই শহীদের পবিত্র মাজার জিয়ারত করতে সমবেত হতো। এই সমবেত মুসলমানদের নামাজ পড়ার সুবিধার জন্য ইলিয়াস শাহী সুলতানের অধীনস্থ আবিসিনীয় সেনাপতি মালিক কাফুর মসজিদটি নির্মাণ করেন। সুতরাং এই সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত যে, মসজিদের চেয়ে মাজারটি অনেক বেশি পুরাতন ছিল এবং বাবা আদম শহীদ ঐ স্থানে এত বেশি সুপরিচিত ছিলেন যে মসজিদে উৎকীর্ণ লিপিতে তার নামে কোনো বিশেষ উল্লেখের প্রয়োজন হয়নি।
২. শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী : সুফি দরবেশ শাহ মুহাম্মদ সুলতান
রুমী প্রাক মুসলমান যুগে বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন বলে কথিত আছে । ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্গত নেত্রকোণা জেলার মদনপুরে এই পুণ্যাত্মার মাজারশরীফ বিদ্যমান আছে। দরগাহের খাদেমের নিকট সংরক্ষিত ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দের একটি দলিল অনুসারে শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী মদনপুরে আগমন করেন ৪৪৫ হিজরি/১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
স্থানীয় একটি কিংবদন্তী আছে যে, শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমীর অসামান্য আধ্যাত্মিক শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে একজন কোচ রাজা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনি মদনপুর গ্রামখানি সুফি দরবেশকে দান করেন। সেন বংশের পতনের পর, কোচ রাজারা নেত্রকোণায় প্রভুত্ব স্থাপন করেছিলেন। এতে অনুমিত হয় যে সিদ্ধপুরুষ ভূমির অনুদান লাভ করেন ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগে । অতএব, তিনি ঐ সময়ে জীবিত ছিলেন।
৩. শাহ সুলতান মাহী সওয়ার : বগুড়া জেলার মহাস্থানে বিখ্যাত 'সুফি' শাহ সুলতান মাহী সওয়ারের মাজার শরীফ বিদ্যমান আছে। অনুমান করা হয় ইনি ছিলেন। বলখের যুবরাজ, যিনি রাজপ্রসাদের আরাম আয়েশ ত্যাগ করে কঠোর সংযমের জীবন অবলম্বন করেন এবং ইসলামের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। পার্থিবতা পরিহার করার পর তিনি দামেস্কের শেখ তৌফিকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অতঃপর শেখ তৌফিক তাঁকে ধর্মের সেবার জন্য বাংলার অমুসলিম অধ্যুষিত দেশে প্রেরণ করেন। কথিত আছে, শাহ সুলতান সন্দ্বীপ হয়ে সমুদ্র পথে বাংলায় উপস্থিত হন। যেহেতু তিনি মৎস্যাকৃতি নৌকাযোগে অথবা মাছের পিঠে চড়ে আগমন করেন, সে কারণে তিনি মাহী সওয়ার অর্থাৎ মৎস্যারোহণকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি হরিরামপুরে উপস্থিত হলে, সেখানকার হিন্দুরাজা বলরাম তাঁকে বাধা দেন, কিন্তু যুদ্ধে তিনি নিহত হন। ফলে, তদীয় মন্ত্রী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর এই মহাপুরুষ মহাস্থানের দিকে অগ্রসর হন ও সেখানে তিনি রাজা পরশুরাম ও তার ভগ্নী শীলাদেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে রাজা নিহত হন এবং শীলাদেবী করোতোয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
সৈয়দ মুহাম্মদ তাহির, সৈয়দ আবদুর রহমান ও সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাকে প্রদত্ত সম্রাট আওরঙ্গজেবের ১০৬৯ হিজরি/১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দের একটি সনদ আছে। এতে শাহ সুলতান মাহী সওয়ারের মাজার শরীফ সংলগ্ন খাজনা মুক্ত (লাখেরাজ) ভূমিতে তাঁদের অধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই সনদে পূর্ববর্তী সুলতানগণ কর্তৃক ভূমি মঞ্জুরীদানের কথাও উল্লিখিত হয়েছে। মাজার শরীফের জন্য পূর্ববর্তী মঞ্জুরীদানের ফরমানগুলো পাওয়া গেলে সুফি দরবেশ মাহী সওয়ারের সময় নির্ধারণে সেগুলো খুবই কাজে আসত। কিন্তু এ পর্যন্ত সেগুলোর কোনটাই পাওয়া যায়নি।
লোকপরস্পরায় প্রচলিত প্রবাদে প্রকাশ পায় যে, রাজা পরশুরাম অত্যাচারী ছিলেন এবং বিশেষকরে তিনি মুসলমান প্রজাদের উপর ছিলেন খুবই কঠোর। সুতরাং জনসাধারণ অসন্তোষে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। এ থেকে এইচ. বেভারিজ সিদ্ধান্ত করেন যে মাহী সওয়ার পরশুরামের অত্যাচার ও গোঁড়ামির বিরুদ্দে জনসাধারণের বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। এমনকি, নিম্নশ্রেণির হিন্দুরাও এই গণ বিপ্লবে যোগদান করেছিল। কিংবদন্তীতে আরো জানা যায় যে, হরপাল নামে পরশুরামের একজন ঝাড়ুদার রাজার অত্যাচারের বিষয় নিয়মিতভাবে সুফি দরবেশ মাহী সওয়ারকে সরবরাহ করতো।
৪. মখদুম শাহদৌলাহ শহীদ : জনশ্রুতি অনুসারে মখদুম শাহদৌলার পয়গম্বরের একজন সঙ্গী (সাহাবা) মুয়াজ বিন জাবালের পুত্র ছিলেন। পিতার
8
অনুমতিক্রমে তিনি এমেন ত্যাগ করেন এবং ভগ্নী ও ভগ্নীর সন্তান-সন্ততিসহ এবং শিষ্য সঙ্গে নেন। পথে তিনি জালালউদ্দিন বুখারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং এই দরবেশ তাকে দু'টো কবুতর দান করেন। অতঃপর তিনি পূর্বদিকে অগ্রসর হন এ পাবনা জেলার শাহজাদপুরের নিকটে পোতাজিয়ায় পৌঁছেন। মখদুম শাহদে তাঁর অনুচরবর্গ সেখানে বসতিস্থাপন করেন, মসজিদ নির্মাণ করেন ও ধর্মার র কার্যে আত্মনিয়োগ করেন। এই বসতি স্থাপনকারীদেরকে ধ্বংশ করার উদ্দেশ্যে হিন্দুরাজা তাদেরকে আক্রমণ করেন এবং যুদ্ধে মুখদুম শাহদৌলাহ ও তাঁর কয়েকজন অনুচর নিহত হন। হিন্দু রাজার হাতে অপমানিত হওয়ার আশংকার মখদুমের তী একটি পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মোৎসর্গ করেন। তখন থেকে সেই পুকুরের নাম হয় সতী বিবির ঘাট (সতীবিবির স্নানস্থান)। মুখদুমের দেহচ্যুত শির বিহারে নীত হয়। হিন্দুরাজা তাঁর শিরে স্বর্গীয় দ্যূতি দর্শন করে মুসলমানদেরকে ডেকে পাঠান এবং তাদের সাহায্যে এই শির সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেন। তিনি সেখানে একটি মসজিদও নির্মাণ করে দেন। খাজা নূর শাহ নামে মখদুমের এক ভাগ্নে জীবিত ছিলেন, তিনি শাহজাদপুরে তাদের নির্মিত মসজিদের সন্নিকটে এই সাধু পুরুষের মস্তকবিহীন দেহ সমাহিত করেন। তাঁর সমাধির পার্শ্বে পরে তাঁর ভাগ্নে ও অনুচরদেরকে কবর দেওয়া হয় । শাহজাদপুরে মখদুম শাহদৌলাহ ও তাঁর অনুসারীদের মোট একুশটি করে বিদ্যমান আছে। এরূপ কথিত আছে যে, মখদুম শাহদৌলাহর শাহজাদা উপাধি অনুসারে শাহজাদপুর নামকরণ হয়; তিনি এমেনের শাহজাদা ছিলেন।
কিংবদন্তী থেকে জানা যায় যে, শেখ শামসুদ্দিন তাবরিজী ছিলেন মখদুম শাহদৌলাহ শহীদের আধ্যাত্মিক জীবনের শিক্ষক। শামসুদ্দিন তাবরিজী বিখ্যাত সুফি কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমীরও (১২০৭-৭৩) শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১২৪৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন। প্রচলিত প্রবাদে আছে যে, মখদুম শাহদৌলাহ শেষ জালালউদ্দিন বুখারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। শেখ জালালউদ্দিন বুখারী তাঁর পবিত্র পাদস্পর্শে মূলতান ধন্য করেছিলেন এবং তিনি ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এখানে অবস্থান করেছিলেন। মুখদুম জাহানিয়া নামে সুপরিচিত শেখ জালালউদ্দিন বুখারীর তিনি ছিলেন পিতামহ এবং মখদুম জাহানিয়া ৭৮৫ হিজরি/ ১৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এ তথ্যগুলো যদি সত্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তাহলে বলা যায় যে, মখদুম শাহদৌলাহ ত্রয়োদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় আগমন করেন। কিংবদন্তীতে তাকে মুয়াজ বিন জাবালের পুত্র হিসেবেও উল্লেখ করে।
বিশ্ব সূত্রে জানা যায় যে, জাবাল ১৭ কিংবা ১৮ হিজরি (৬৪০ খ্রিস্টাব্দে) প্রাণত্যাগ করেন। এটা ছয় শতাব্দীর ব্যবধানের ব্যাপার। এতে মনে হয় যে, মুখদুম শাহদৌলাহ মুয়াজ বিন জাবালের পুত্র ছিলেন না, তিনি হয়তো তার একজন বংশধর ছিলেন।
শাহজাদপুরে তাঁর মাজারে আজও শত শত দর্শকের সমাগম হয় এবং তা বাংলাদেশে ইসলামের জন্য তাঁর মহান আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দরগাহ সংলগ্ন মসজিদের জন্য মুসলমান শাসকরা ৭২২ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেছেন।
৫. মখদুম শাহ মাহমুদ গজনবী : সুফি দরবেশ মখদুম শাহ মাহমুদ গজনবীর দরগাহ বর্ধমান জেলার মঙ্গল কোটে বিদ্যমান আছে। তিনি সাধারণত রাহাপীর নামে পরিচিত। স্থানীয় প্রবাদ অনুসারে বিক্রমকেশরী নামক একজন হিন্দুরাজার রাজত্বকালে তিনি মঙ্গলকোটে আগমন করেন এবং ইসলাম প্রচার করেন। ধর্মান্ধ হিন্দুরাজা তাকে এবং অন্যান্য মুসলমানাদেরকে নির্যাতন করেন। সিদ্ধপুরুষ তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে দিল্লির সুলতানের নিকট পত্র লিখেন। দিল্লি থেকে একদল মুসলিম সৈন্য মঙ্গলকোটে পাঠানো হয়। সিদ্ধপুরুষ তাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং যুদ্ধে বিক্রমকেশরী পরাজিত হন। হিন্দুরাজা পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান এবং ফলে মঙ্গলকোট মুসলমানাদের হস্তগত হয় ।
রাজা বিক্রমকেশরীর উল্লেখ ‘শেক শুভোদয়া' নামক সংস্কৃত গ্রন্থে এবং প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায় ৷ এ থেকে মনে করা হয় যে, মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের প্রাক্কালে বিক্রমকেশরী মঙ্গলকোট অঞ্চলের একজন ক্ষুদ্র রাজা ছিলেন। অনুমিত হয় যে, মঙ্গলকোট বিজয়ে সিদ্ধপুরুষ ‘রাহাপীর' কিছুটা ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে জীবিত ছিলেন ও ধর্মপ্রচার করেছিলেন।
৬. বায়েজিদ বোস্তামী ও শেখ ফরিদ : লোকপরম্পরায় প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে বিখ্যাত সুফি বায়েজিদ বোস্তামী (মৃত্যু ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেছিলেন। চট্টগ্রামের সন্নিকটে নাসিরাবাদে এই বিখ্যাত সাধকের একটি মাজার শরীফ বিদ্যমান। কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, বায়েজিদ বোস্তামী কখনো তাঁর জীবিতকালে বাংলা পরিভ্রমণে এসেছিলেন।
সুফি-দরবেশ, শেখ ফরিদের নাম বাংলার ঘরে ঘরে লোকের মুখে উচ্চারিত হয়। চট্টগ্রামের একটি পাহাড়ের পাদদেশে চাশম শেখ ফরিদ নামে একটি ঝর্নাও আছে। এ থেকে মনে করা হয় যে, শেখ ফরিদউদ্দিন-গঞ্জ-ই-শকর শেখ জালাল উদ্দিন তাবরিজীর মৃত্যুকালে উপস্থিত ছিলেন। পান্ডুয়ার নিকট দেওতলায় শেখ জালাল উদ্দিন তাবরিজীর মৃত্যু হয় ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে। যদি রাহাত-আল-কুলুবে এর সাক্ষ্য সত্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে বলা যায় যে, শেখ ফরিদউদ্দিন-গঞ্জ-ই-শকর উত্তর বাংলা পরিভ্রমণ করেছিলেন। উত্তর বাংলা পরিদর্শন করে থাকলে এটা অসম্ভব নয় যে, তিনি চট্টগ্রাম এবং এমনকি ফরিদপুরে আগমন করেছিলেন; ফরিদপুর নামকরণ এই বিখ্যাত সিদ্ধপুরুষের নামানুসারে করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয় ।
৭. শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী : বাংলাদেশে আগত প্রথমদিকের সুফি দরবেশদের মধ্যে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান। এই প্রদেশে মুসলিম শাসনের প্রথমদিকে উত্তরবঙ্গে ইসলাম প্রসার ও মুসলমান
সম্প্রদায়ের তরক্কী তার ধর্মীয় উদ্যম ও অসাধারণ আধ্যাত্মিকতার নিকট দায়ী। ছিল। বাস্তবিকই আল্লাহ ভক্তি, আদর্শ চরিত্র এবং মানব কল্যাণমূলক কার্যাবলির দ্বারা শেখ জালাল উদ্দিন তাবরিজী মানুষের মনে ও সমাজের নৈতিক জীবনে এমন গভীর। ছাপ রেখে গেছেন যে তার পুণ্যস্মৃতি লক্ষ লক্ষ বাঙালির হৃদয়ে চিরদিনের উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
জন্য
৮. তাবরিজী ও শাহজালাল শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর বাংলাদেশ আগমনের সময় সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। কোনো কোনো পণ্ডিত শ্রীহট্ট বিজয়ের সঙ্গে জড়িত শাহ জালালের সঙ্গে তাঁকে অভিন্ন ব্যক্তিরূপে উল্লেখ করেছেন। ডঃ মেহেদী হোসেন তার ইবনে বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্তের অনুবাদ গ্রন্থে এই দুই সুফি দরবেশকে একই ব্যক্তি বলে মনে করেছেন। স্ট্যাপলটন, আবিদ আলী এবং স্টোরী এই একটি অভিমত প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক গিব তাঁর ইবনে বতুতার অনুবাদে এ বিষয়ের উপর কোনো রকম মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন। কোনো কোনো মহলে এ রকম একটি অস্পষ্ট ধারণাও আছে যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী এবং শাহ জালাল দু'জন ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধপুরুষ । কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে কোনো প্রত্যক্ষ ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ উপস্থিত এখনো করা হয়নি। শেখ জালাল উদ্দিন তাবরিজীর জীবন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এই প্রচলিত বিভ্রান্তির পূর্বেই মীমাংসা করে নেয়া আবশ্যক।
শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী ও শেখ শাহ জালাল একই ব্যক্তি, এই অভিমত অপ্রত্যাশিত নয়; তার কারণ এই যে, প্রত্যক্ষ ও সমকালীন তথ্যের উপর এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। ইবেন বতুতা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের শ্রীহট্টে শাহ জালালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি এই সুফি দরবেশকে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী নামে উল্লেখ করেছেন দ্বিতীয়ত শেখ ‘শুভোদয়া' নামক সংস্কৃত পদ্য গ্রন্থ যা লক্ষণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র লিখেছেন বলে মনে করা হয়, সেই গ্রন্থে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীকে মখদুম শেখ শাহ জালাল তাবরিজী নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে দুজন সিদ্ধপুরুষের নাম একত্র করে এক করা হয়েছে। তৃতীয়াত শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মৃত্যুর স্থান ও তারিখ সম্বন্ধে কোনো নির্ভারযোগ্য ও সমকালীন প্রমাণ নেই। কেবল উনিশ শতকের লেখকরাই তাঁর মৃত্যু তারিখ সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারা বিভিন্ন তারিখের কথা বলেছেন, অথচ তাদের বর্ণনার সমর্থনে সমকালীন কোনো প্রমাণ প্রদর্শন করা হয়নি।
ইবনে বতুতার প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য বাস্তবিকই খুব জোরালো ও গুরুত্বপূর্ণ। এই বিখ্যাত মূর দেশীয় মুসলমান পরিব্রাজক ব্যক্তিগত ভাবে শেখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর খানকায় (আস্তানায়) কিছুদিন অতিথি হিসেবে অবস্থান করেন। অতএব, সিলেটের শেখই যে শেখ জালাল উদ্দিন তাবরিজী ছিলেন- তার এই সাক্ষ্য একটি অস্পষ্ট সাধারণ ধারণার দ্বারা বা ভাসাভাসা উক্তির সাহায্যে উড়িয়ে দেয়া চলে না। এই প্রত্যক্ষ প্রমাণ একশত পরোক্ষ প্রমাণের চেয়ে বেশি মূল্যবান। সুতরাং ইবনে বতুতার প্রত্যক্ষ ও সমসাময়িক প্রমাণের অনির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করতে বেশ কয়েকটি জোরালো অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের প্রয়োজন। ইবনে বতুতার 'ভ্রমণ বৃত্তান্ত' সামান্য কিছু পাঠ করলেই দেখা যাবে যে, তার বর্ণনা প্রায়ই ভ্রান্তিপূর্ণ ও স্ব-বিরোধী এবং এগুলোর উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করা যায় না। আরো দেখা যাবে যে, তিনি শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীকে সিলেটের শাহ জালালের সঙ্গে ভুল করে ফেলেছেন এবং এভাবে তাঁর পাঠকদেরকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছেন।
১. ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু করে সাধু দরবেশদের যে সমস্ত 'মালফুজাত' ও জীবনচরিত লিখিত হয়েছে, তাতে স্বীকৃত হয়েছে যে, সাধু হিসেবে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর উত্তর ভারতে বিশেষকরে মুলতান, দিল্লি ও বাদায়ুনে অধিকতর খ্যাতি ছিল। ইবনে বতুতা প্রায় ছ'বছর দিল্লিতে বসবাস করেন এবং বিভিন্ন সিদ্ধপুরুষ ও সুফিদের সঙ্গে মেলামেশা করেন। খুব সম্ভবত ঐ সময়ে তিনি শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর নাম শুনে থাকবেন। অতঃপর তিনি চীনে যাবার পথে জনসাধারণ্যে শাহ জালাল নামে পরিচিত শেখ জালালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। চীন ও এশিয়ার বহু স্থান পরিভ্রমণ করে তিনি তার স্বদেশভূমি মরক্কোতে ফিরে যান এবং শাহ জালালের সঙ্গে সাক্ষাতেরও পঁচিশ বছর পরে তিনি তার অভিজ্ঞতাসমূহ লিপিবদ্ধ করেন। জানা যায় যে, ইবনে বক্তৃতা তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত নিজে লেখেননি। বরং ফেজের রাজদরবারে সেগুলোর বর্ণনা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, এসব বর্ণনা তিনি প্রদান করেছিলেন তাঁর অতীত দিনের স্মৃতির পাতা থেকে। তার বর্ণনাসমূহ মুহাম্মদ ইবনে জওজী নামক রাজসভার সচিব কর্তৃক লিখিত হয়েছিল। বহুকাল আগে সংঘটিত ঘটনাবলির স্মৃতি কিংবা বিশ বছর পূর্বে দেখা কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো কিছু লিখতে বা বর্ণনা করতে গেলে, বর্ণনাকারীর পক্ষে তারিখ ও নাম বিশেষকরে সাদৃশ্যমূলক নামের মধ্যে ভুল করা স্বাভাবিক। এ ধরনের ভ্রান্তিতে পতিত হয়ে ইবনে বতুতা শেখ জালালের (শাহ জালাল) নামের সঙ্গে আল তাবরিজী আখ্যা জুড়ে দিয়েছেন।
ইবনে বতুতা যে এই দুই সাদৃশ্যমূলক নামের দ্বারা ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছেন তা আরো প্রমাণিত হয় এ কারণে যে, তিনি তার বৃত্তান্তের এক জায়গায় একই সিদ্ধপুরুষের নামোল্লেখ করেছেন শেখ জালালউদ্দিন আল তাবরিজীরূপে- যার সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন এবং অন্য এক জায়গায় শেখ জালালউদ্দিন 'বারসামী' নামে; কোনো কোনো পণ্ডিত বারসামী শব্দটি শিরাজী বলে মনে করেছেন। একই ব্যক্তি একই সময়ে তাবরিজ ও শিরাজের অধিবাসী হতে পারেন না। কেন না, একস্থান অন্য স্থান থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। এটা পরিষ্কারভাবে বিভ্রান্তিজনক। ইবনে বতুতার বর্ণনার বিভ্রান্তি তার অন্যান্য প্রত্যক্ষ প্রমাণের ভিত্তি অনেকটা দুর্বল করে দিয়েছে এবং এ কারণে তার বিবৃতির সারবত্তা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ দেখা দিয়েছে।
২. সংস্কৃত কাব্য ‘শেক শুভোদয়ায়’ দু'জন সুফি-দরবেশের নাম এক করে 'মখদুম শেখ শাহ জালাল তাবরিজী' বলে উল্লেখ করা হয়েছে; এই গ্রন্থের সমসাময়িকতা সম্বন্ধেই কেবল সন্দেহ প্রকাশ করা হয়নি, এমনকি এটা কৃত্রিম বলে গণ্য করা হয়েছে। এই সংস্কৃত কাব্যের রচনায় আরবি ও ফারসি শব্দের কৃত্রিম প্রয়োগ এবং বাংলা পদ্য রীতির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, এ গ্রন্থ লিখিত হয়েছিল যখন বাংলার হিন্দুরা আরবি ফারসি শব্দের সঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়েছে এবং বাংলা ভাষাও যথেষ্ট পরিমাণে উন্নত হয়েছে। পঞ্চদশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা ভাষার এরূপ উন্নতি লাভ ঘটেনি; অতএব, লক্ষ্মণ সেনের সময়ে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছে করে থাকার করা যায় না। এমন হতে পারে যে, এই দু'জন সুফির নাম (যাঁরা অনেক পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন) বাংলার লোক কথায় পরিণত হয় এবং নাম দু'টো সাদৃশ্যমূলক হওয়ায় কালক্রমে তারা একটি অভিন্ন নামে রূপান্তরিত হয়ে সাধারণ লোক প্রবাদে স্থান লাভ করে। শেখ শুভোদয়া'র লেখক এই দু'জন সিদ্ধপুরুষের ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত অভিন্ন নামের এ ঐতিহ্যই বজায় রেখেছেন।
৩. ইবনে বতুতার অন্যান্য বর্ণনার আলোকে এবং সুহেল ই ইয়মেনে লিখিত কিংবদন্তী অনুসারে শাহ জালালের জীবন পর্যালোচনায় দেখা যাবে যে, তিনি সিলেটের সিদ্ধপুরুষ শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী থেকে ভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন।
ক. ইবনে বতুতার বর্ণনানুসারে জানা যায় যে, তিনি ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে শেখের সঙ্গে সিলেটে সাক্ষাৎ করেন এবং পরবর্তী বছর চীনের রাজধানী 'খানবালিকে (পিকিং) বুরহানউদ্দিন সাগরেদের নিকট শেখের মৃত্যু সংবাদ পান। এই পরিব্রাজক আমাদেরকে আরো জানান যে, তিনি পরবর্তী সময়ে শেখের শিষ্যদের নিকট জানতে পারেন যে, শেখ ১৫০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ১৫০ বছর বয়স একটি অসাধারণ দীর্ঘ জীবন ।
সুহেল-ই-ইয়মেন থেকে জানা যায় যে, শেখ শাহজালাল ৬২ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। ইবনে বতুতার বক্তব্য যদি গ্রহণীয় হয়, তাহলে এই সিদ্ধপুরুষ ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫০ বছর বয়সে ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
ক. ইবনে বতুতা আরো জানান যে শেখ তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহকে দেখেছেন এবং তার নিহত হওয়ার সময় তিনি সেই শহরে উপস্থিত ছিলেন। শেষ আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসীন বিল্লাহ মোঙ্গল সেনাপতি হালাকু খান কর্তৃক ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন।
খ. শাহ জালাল সিলেট বিজয়ের সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে জড়িত। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চল বিজিত হয়। উপরোক্ত আলোচনায় শাহ জালালের জীবনে চারটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ পাওয়া যায়; তিনি ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন; তিনি ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে ছিলেন; তিনি ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে গমন করেন এবং সেখানে তিনি ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। সমকালীন বর্ণনার আলোকে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনি শাহজালালের জন্ম তারিখ ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দের অন্তত ৩৫ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। শাহজালালের মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দীকাল পূর্বে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মৃত্যু হয়েছিল, এই সিদ্ধান্তের পক্ষে জোরাল প্রমাণ রয়েছে।
শেখ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ‘মালফুজাত', 'ফাওয়াইদ আল-ফায়াদ' তদীয় সুযোগ্য শিষ্য আমির হোসেন সিয়জী কর্তৃক রচিত হয় এবং এটা খুবই নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়। গ্রন্থখানা ১৩১৫ খ্রিস্টাব্দে এই বিখ্যাত আওলিয়ার জীবনকালে লিখিত হয়েছে। এবং এতে প্রায়শই শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর উল্লেখ করা হয়েছে। এর উল্লিখিত তথ্যসমূহ সমসাময়িক মালফুজাত ও সুফিদের জীবন চরিত দ্বারাও সমর্থিত হয়েছে। এই সমস্ত উল্লেখের উপর ভিত্তি করে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী সম্বন্ধে নিম্নলিখিত
তথ্যসমূহ পাওয়া যায় ।
১. শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী ছিলেন শেখ আবু সৈয়দ তাবরিজীর শিষ্য। তার শেষের মৃত্যুর পর, তিনি সাত বছর কাল বাগদাদে সিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর (১১৪৪-১২৩৫খ্রিস্টাব্দ) সেবা করেন এবং তাঁর শিষ্যত্বে খ্যাতি অর্জন করেন।
২. আরো জানা যায় যে, খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (১১৪২-১২৩৬ খ্রি.) ভারতে আসার পূর্বে শেখ সিহাবউদ্দিন সোহরাওয়ার্দী ও আবু সৈয়দ তাবরিজীর সঙ্গে তার সাহচর্যে ছিলেন এবং বাগদাদে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতীর সঙ্গে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর পরিচয় হয়েছিল।
খাজা সিহাবউদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্বে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজ আধ্যাত্মিক পূর্ণতা (কামালিয়াত) অর্জন করেন এবং খাজা মঈনউদ্দিন চিশতীর ভারতে আগমনের পূর্বে তার সঙ্গে বাগদাদে তাবরিজী সুফির পরিচয় হয়েছিল। আবুল ফজলের মতে, মুহাম্মদ ঘোরীর দিল্লি ও আজমীর বিজয়ের সময়ে অর্থাৎ ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে খাজা এ উপমাহাদেশে আগমন করেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন এবং তখন তাঁর বয়স ছিল অন্তত ৩০ বছর। সুতরাং শাহজালালের জন্মকালে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী অন্তত ৩৫ বছর বয়স্ক ছিলেন।
৩. সমসাময়িক সূত্র থেকে আরো জানা যায় যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী ব্যাপকভাবে আরব, ইরান ও ইরাক সফর করেন এবং নিশাপুরে ফরিদউদ্দিন আত্তারের সঙ্গে (৫১২-৬২ হিজরি/ ১১১৪-১২২৯ খ্রি.) সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তিনি প্রথমে মুলতানে আগমন করেন এবং সেখানে তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ অনুসঙ্গী শিষ্য শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া (১১৬৯-১২৬৬ খ্রি.) ও খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার উসীর (মৃত্যু ১২৩৫ খ্রি.) সাহচর্যে কিছুদিন অতিবাহিত করেন। সে সময়ে নাসিরউদ্দিন কুবাচা মুলতানের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি ১২০৬ থেকে ১২১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুলতান শাসন করেন।
৪. শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মুলতান ত্যাগের সময়েও নাসিরউদ্দিন কুবাচা অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি দিল্লিতে আগমন করেন এবং সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ তাকে সসম্মানে গ্রহণ করেন। সুলতান নিজে একজন সুফি প্রকৃতির লোক ছিলেন এবং তিনি সাধু দরবেশদের প্রতি খুবই সম্মান প্রদর্শন করতেন। ইলতুতমিশ
১২১০ থেকে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সুলতান ইলতুতমিশ কর্তৃক নাসিরউদ্দিন কুবাচা মুলতান থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী দিল্লিতে আগমন করেন; সুতরাং এই বিখ্যাত দরবেশের দিল্লিতে আগমনের তারিখ
১২১১-১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ধরা যেতে পারে।
৫. দিল্লিতে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী তাঁর বন্ধু খাজা কুতবউদ্দিন উনার সাহচর্যে বাস করেন; কুতবউদ্দিন উসী পূর্বেই মুলতান থেকে দিল্লিতে আগন করেছিলেন। তাবরিজী স্বল্পকাল দিল্লিতে অবস্থান করেন। সিদ্ধপুরুষ হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ও তার প্রতি সুলতানের শ্রদ্ধা শেক উল-ইসলাম শেখ নিজামউদ্দিন সুগরাকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে। ফলে, তিনি তাঁর (শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর) বিরুদ্ধে কয়েকটি মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন করেন। এসব অভিযোগের অনুসন্ধানের নিমিত্ত শেষ ও উলেমা সম্প্রদায়ের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া মুলতান থেকে আগমন করেন ও এ সম্মেলনে যোগদান করেন। অনুসন্ধানের ক অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ঈর্ষাপ্রসূত বলে প্রমাণিত হয়। সুলতান ইলতুতমিশ শেখ উল ইসলামের পদ থেকে শেখ নিজামউদ্দিন সুগরাকে বরখাস্ত করেন।
উপর্যুক্ত ঘটনার পর শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী খুব সম্ভবত ১২১২ খ্রিস্টাব্দে সূক্ষ্মণাবতীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, দিল্লিতে তার অবস্থান খুবই স্বল্পস্থায়ী ছিল। তিনি পথে বাদায়ুনে থামেন; সেখানে তিনি একটি বালককে আশীর্বাদ করেন, এই বালক ছিলেন উত্তরকালের শেখ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার শিক্ষক মাওলানা আলাউদ্দিন উসুলী। বাদায়ুনে তিনি এক হিন্দু ডাকাতকেও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন; ইনি পরবর্তীকালে ‘খাজাআলী' নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ১২১৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী লক্ষ্মণাবতীতে এসে পৌঁছান এবং পান্ডুয়ায় একটি হিন্দু মন্দিরের নিকটে তাঁর ‘আস্তানা' ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন।
৬. শেখ জালাউদ্দিন তাবরিজী যদি শাহ জালাল হন তবে তিনি নিশ্চয়ই খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহর হত্যার সময় ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণাবতী থেকে পুনরায় বাগদাদে গিয়ে থাকবেন। অতঃপর মুসলমানদের সিলেট বিজয়ে সাহায্য করার জন্য ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে তাঁর বাংলাদেশে ফিরে আসা প্রয়োজন হয় ।
যদি তাই হতো তাহলে সমসাময়িক সাধু দরবেশগণ ও মালফুজাতসমূহের লেখকগণ, যেমন শেখ ফরিউদ্দিন গঞ্জ-ই-শাকর, মাওলানা আলাউদ্দিন উসুলী, খাজা আলী, শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু ও আমির হাসান এ বিষয় উল্লেখ করতেন; এদের সকলেরই খুব ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর অসামান্য আধ্যাত্মিক গুণের জন্য। বিশেষকরে, শেখ নিজাম উদ্দিন আউলিয়া তদীয় শিষ্যদের প্রতি তাঁর দৈনন্দিন উপদেশে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী কামালিয়াত ও কামামত সম্পর্কে প্রায়ই উল্লেখ করতেন। তিনি কখনো বলেননি যে, তিনি শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীকে দেখেছেন কিংবা সেই বিখ্যাত সিদ্ধপুরুষ জীবিত আছেন। অপরপক্ষে, তাঁর উল্লেখে এই ধারণা হয় যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী অনেক পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
আমির খসরু শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার একজন ভক্ত শিষ্য ছিলেন এবং তার শিক্ষকের নিকট থেকে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছেন। তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলকের সঙ্গে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আগমন করেন। তিনি তাঁর 'মালফুজাত' আফজাল আলফাওয়াইদ গ্রন্থে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর অলৌকিক ঘটনাবলি ও তাঁর নিকট হিন্দুদের দীক্ষা গ্রহণ সম্বন্ধে বহু বিবৃতি উদ্ধৃতি করেছেন কিন্তু তিনি কখনো বলেননি যে, তাঁর বঙ্গদেশ ভ্রমণকালে দরবেশ তাবরিজী সিলেটে বসবাস করছিলেন।
এই সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদি অনুসারে দেখা যায় যে, শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার জীবিতকালে (১২৩৫-১৩২৫) ও শেখ ফরিদউদ্দিন গঞ্জ-ই-শাকরের মৃত্যু (মৃত্যু ১২৬৯ খ্রিস্টাব্দ) বহু পূর্বে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। অনুমান করা হয়, ‘রাহাত আল-কুলুব' নামে একটি 'মালফু’জাত জনৈক নিজামউদ্দিন আহমদ কর্তৃক ৬৫৫ হিজরি/১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে লিখিত হয়। এই লেখক নিজেকে খাজা ফরিদউদ্দিন- গঞ্জ-ই শাকরের শিষ্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি একটি মজলিশে তার পীরের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন যে, তিনি (শেখ ফরিদ) শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মৃত্যুকালে তার নিকট উপস্থিত ছিলেন এবং শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী মৃত্যুর মুহূর্তে হাসছিলেন। জনৈক বন্ধু প্রশ্ন করেন, ‘এটা কি রকম ব্যাপার যে, একজন মৃত্যুপথযাত্রী হাসছেন? উত্তর হলো এটা হচ্ছে আল্লার রহস্যে গভীর জ্ঞানের নিদর্শন। এর ফলে এই সিদ্ধান্ত সমর্থিত হয় যে, শেখ ফরিদউদ্দিন তাবরিজী ইহলোক ত্যাগ করেন। এই ‘মালফুজাত থেকে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মৃত্যুসংবাদ পাওয়া যায়, এটা ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। এমতাবস্থায় বলা যায় যে, শেখ তাবরিজী এই তারিখের পূর্বে পরলোকগমন করেন। ‘খাজিনাত আল আসফিয়ায়' উল্লেখ পাওয়া যায় যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী ৬৪২ হিজরি/১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। যদিও এই গ্রন্থ অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে রচিত হয়েছে এবং এর তথ্যের উৎসমূহ উল্লেখ করা হয় নি, তথাপি এর উক্তি থেকে এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, দরবেশ তাবরিজী ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন।
উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে অন্তত ৩৫ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন এবং সিলেটের শাহ জালালের মৃত্যুর অন্তত এক শতাব্দী কাল পূর্বে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। এর ফলে বিভ্রান্তি দূর হয় এবং তারা দু'জন যে ভিন্ন ভিন্ন সুফি দরবেশ ছিলেন সে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
শাহজালালের দরগায় প্রাপ্ত সুলতান হোসেন শাহের আমলে ৯১৮ হিজরি/১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের তারিখযুক্ত একটি শিলালিপিতে শেখ জালাল মুজাররাদ- বিন-মুহাম্মদ নামে সিলেটের শেখের উল্লেখ রয়েছে। এই একই রাজত্বকালে উৎকীর্ণ ৯১১ হিজরি/১৫০৫ খ্রিস্টাব্দের অন্য একটি শিলালিপিতে শাহজালালকে শেখ জালাল মুজাররাদ কুনিয়ারী অর্থাৎ 'কুনিয়ারদরবেশ শেখ জালাল' নামে উল্লেখ করা হয়েছে। শাহজালাল ও শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী যে এক ব্যক্তি ছিলেন না এই শিলালিপির সাক্ষ্য থেকে সে ধারণা দৃঢ়ীভূত হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]