বাংলায় সুফিবাদ : সুফিদের অবদান:

শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মাজার : শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মাজার (কবরস্থান বা সমাধি) সম্বন্ধে পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রান্তি বিদ্যমান। শেখের একটি সমাধি সৌধ (৯ ফুট ৬ ইঞ্চি দীর্ঘ এবং ৬ ফুট ২ ইঞ্চি প্রস্থ) উত্তর বাংলার (হিন্দুস্থান) পান্ডুয়ায় অবস্থিত আছে, এবং এটি বড় দরগাহ ও বাইশ হাজারী দরগাহ নামেও পরিচিত; কেননা, দরগাহ সংলগ্ন সম্পত্তিতে বাইশ হাজার টাকা আয় হয়। দরগার মুতওয়াল্লিরা (রক্ষণাবেশক্ষণকারী) বলেন যে, শেখ জালাল উদ্দিন তাবরিজী প্রকৃতপক্ষে ঐ স্থানে সমাধিস্থ হননি, তিনি আওরঙ্গাবাদে (পুরাতন খিরকি) সমাধিস্থ হয়েছেন এবং পান্ডুয়ায় অবস্থিত মাজারটি ছিল কেবল একটি ‘জওয়াব' (অনুকরণ) সমাধি। ব্লকম্যান স্ট্যাপলটন ও অন্যরা বিশ্বাস করেন যে তিনি পান্ডুয়াতে সমাধিস্থ হননি। দাক্ষিণাত্যের সাধু দরবেশগণের জীবনচরিত এবং আওরঙ্গাবাদের গ্রন্থাদি ও কিংবদন্তীতে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী অথবা তার সমাধির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। এতএব, দরবেশ তাবরিজী যে আওরঙ্গাবাদে সমাধিস্থ হয়েছেন এই অভিমত গ্রহণ করা যায় না ।
মাওলানা জামালী এবং আবুল ফজলের মতে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীব সমাধি বন্দর দেওমহলে অবস্থিত ছিল। ব্লকম্যান ও অন্যরা মনে করেন যে, বন্দর দেওমহল, হয় গুজরাটের দিউ বন্দর অথবা মালদ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত ছিল। কিন্তু কোনো ঘটনাপুঞ্জি কিংবা কিংবদন্তীতে দিউ বা গুজরাটের সঙ্গে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর সম্পর্কের কোন উল্লেখ নেই ৷
মালদ্বীপের মূল নাম, ইবনে বতুতা বর্ণিত ‘দেওয়াত আল-মহল' ও আবদুর রাজ্জাক বর্ণিত ‘দেওমহল' বাহ্যিকভাবে এই মত সমর্থন করে যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী সেখানে সমাধিস্থ হয়েছেন। নামের এই বাহ্যিক সাদৃশ্য ব্যতিরেখে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর স্মৃতির সঙ্গে মালদ্বীপের আর কোনরূপ সম্পর্কের প্রমাণ নেই। ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইবনে বতুতার মালদ্বীপ পরিভ্রমণকালে সেখানে এই সিদ্ধপুরুষের কোনো সমাধি কিংবা তার নামের কোন কিংবদন্তীর অস্তিত্ব ছিল না। এ সবের কোনো অস্তিত্ব থাকলে এই দ্বীপে ইবনে বতুতা তাঁর আঠারো মাস অবস্থানকালে অবশ্যই তা লক্ষ করতেন। অন্যদিকে তিনি ‘দেওয়াত আল-মহলে’ (মালদ্বীপ) প্রচলিত একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ করেন যে, আবুল বারাকত নামক একজন বার্বার (উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী) এই দ্বীপে আসেন এবং তিনি পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে একটি দৈত্যের উৎপাত থেকে অধিবাসীদেরকে রক্ষা করেন। এই ঘটনায় আকৃষ্ট হয়ে মূর্তিপূজক রাজা ও তার লোকেরা তার নিকট ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করে। এতে দেখা যায় যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী ব্যতীত
অন্য একজন ধর্মপ্রচারক মালদ্বীপে ইসলাম প্রচার করেন।
সমসাময়িক কিংবা অন্যবিধ সমস্ত রকম উৎস থেকে জানা যায় যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী দিল্লি থেকে বাদায়ুনে এবং অতঃপর বঙ্গদেশের লক্ষণাবতীতে গমন করেন। তিনি বঙ্গদেশ থেকে অন্য কোথাও গমন করেছিলেন, এ-রকম কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। অতএব, দেওমহল বাংলার কোথাও একটি স্থান হবে। আবুল হুরুল লেখেন, “দিল্লি থেকে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী বাংলাদেশে গমন করেন। বন্দর দেওমহল তাঁর চির-নিদ্রার স্থান।" "সিয়ারুল আরেফিনের লেখক বলেন, “শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী যখন বঙ্গদেশে এসে পৌঁছান, তখন সে দেশের অধিবাসীরা তাঁর নিকট ভিড় জমায় এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এই স্থানে পুণ্যত্ম শেখ একটি খানকাহ' নির্মাণ করেন ও একটি লঙ্গরখানা (বিনামূল্যে খাবার স্থান) স্থাপন করেন। তিনি কিছু জমি ও বাগান ক্রয় করেন এবং তা লঙ্গরখানার খরচ নির্বাহের জন্যে দান (ওয়াকফ) করেন। সেখান থেকে তিনি আরো অগ্রসর হন এবং সে বন্দর দেওমহল নামে অভিহিত হয়। সেখানে একটি কুয়া আছে। জনৈক মূর্তিপূজক প্রচুর খরচে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। পুণ্যাত্মা শেখ সেই মন্দির ধ্বংস করেন এবং এর ঘরগুলোকে তাঁর ‘তাকিয়া' বা বিশ্রামের স্থানে পরিণত করেন। বহু অবিশ্বাসীদেরকে
পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তাঁর একমাত্র সমাধিসৌধ এখন সেই মন্দিরের স্থানে অবস্থিত আছে এবং সেই বন্দরের অর্ধেক আয় উল্লিখিত লঙ্গরখানার জন্য বরাদ্দ করা হয়।
এই বর্ণনায় প্রকাশ পায় যে, দেওমহল বন্দরের অর্ধেক আয় লঙ্গরখানার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই লঙ্গরখানা শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তাঁর সমাধিও সেখানে (দেওমহলে) ছিল। যেহেতু ঐ বন্দরের আয় থেকে লঙ্গরখানার ব্যয় নির্বাহ করা হতো সেহেতু এ দুটো জায়গার একটি অন্যটি থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত ছিল না। যখন নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, লঙ্গরখানাটি বঙ্গদেশে স্থাপিত হয়েছিল, তখন বন্দর দেওমহলও যে বাংলায় অথবা এর সন্নিকটে ছিল, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। সৈয়দ জালালউদ্দিন মকদুম জাহানিয়ার জাহান গাস্ত (১৩৮৩ খ্রি. ‘উচে' মৃত্যু) এর একটি উক্তি থেকে জানা যায় যে, তিনি স্বপ্নে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীকে সোনারগাঁয়ে তার মাজারে দর্শন করেন। সোনারগাঁয়ে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর কোনো দরগাহ বা মাজার নেই। যাহোক, এর ফলে, এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, শেখ তাবরিজী বাংলাদেশে সমাধিস্থ হয়েছিলেন।
জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শার্কীর নিকট লিখিত একটি পত্রে মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী বর্ণনা দেন যে, 'জালালীয়া' দরবেশগণ দেওতলায় সমাহিত আছেন। দেওতলা উত্তরবঙ্গে পান্ডুয়ার নিকট একটি জায়গা। বাংলা শব্দ 'দেওতলা' ফারসি 'দেবমহল' শব্দটির সমার্থক এবং উভয় অর্থই দৈত্যস্থান। 'আইন ই আকবরীতে উত্তরবঙ্গের কিছু সংখ্যক মহল ও অন্যান্য স্থানের নাম বর্ণিত হয়েছে;
বাংলায় সুফিবাদ : সুফিদের অবদান: কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সুফি এগুলোর শুরু 'দেও' (দেব) শব্দ দিয়ে, যেমন, দেবপুরা মহল, দেবীয়াপুর মহল, দেবীয়া মহল ও দেবকোট। এই নামগুলোর মধ্যে একটি লৌকিক বিশ্বাসের পরিচয় আছে যে, এই অঞ্চলে এক সময় দৈত্যদানবের উপদ্রব ছিল। আমির খসরু লিখিত 'আফজাল আল-ফাওয়াইদ' গ্রন্থের একটি কাহিনীতে এর সমর্থন মেলে যে, যখন শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী বাংলাদেশের একটি শহরে (লক্ষ্মাণাবর্তী) গমন করেন, সে সময়ে ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরা একটি দৈত্যের উৎপাতে খুবই অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল। দৈত্যটা প্রতিরাত্রেই মানুষ খেত। শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী দানবটাকে ধরে ফেলেন এবং বন্দী করে রাখেন। শেখের এই অলৌকিক ক্ষমতায় আকৃষ্ট হয়ে, সেখানকার হিন্দু শাসনকর্তা ও হিন্দু অধবাসীরা এই দরবেশের নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে একটি ‘খানকাহ' নির্মাণ করেন এবং অতঃপর আরো অগ্রসর হন।
উত্তরবঙ্গে পান্ডুয়ায় শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী প্রতিষ্ঠিত একটি লঙ্গরখানা অদ্যাবধি বিদ্যমান আছে এবং ‘বাইশ হাজারী’ নামে পরিচিত একটি বিরাট ভূসম্পত্তি এই লঙ্গরখানার নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল। দেওতলার ভূসম্পত্তি এই ওয়াকফ স্টেটের' অন্তর্ভুক্ত। ফলে, এখনো এর আয় পান্ডুয়ায় শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর প্রতিষ্ঠিত লঙ্গরখানার রক্ষণাবেক্ষণার্থে ব্যয় হয়। এ রকম প্রমাণ আছে যে, মূসলমানামলের প্রথম দিকে দেওতলা একটি প্রসিদ্ধ জায়গা ছিল এবং এটি বিখ্যাত দরবেশ তাবরিজীর স্মৃতি বহন করতো। দেওতলার একটি মসজিদে ৮৬৮ হিজরি/ ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দে একটি উৎকীর্ণ লিপিতে স্থানটিকে ‘কসবা তাবরিজাবাদ' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুলেমান কররানীর সময়ে একটি শিলালিপিতে পরিষ্কারভাবে “তাবরিজাবাদ ওরফে দেওতলা' রূপে স্থানটির উল্লেখ আছে, অর্থাৎ তাবরিজাবাদ দেওতলা নামে পরিচিত। এতে দেখা যায় যে, দেওতলা তাবরিজাবাদ বা তাবরিজীর এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। দরগার চিল্লাখানায় প্রাপ্ত সুলতানি নুসরৎ শাহের সময়ের ৯৩৪ হিজরি/১৫২৮ খ্রিস্টাব্দের আর একটি উৎকীর্ণ লিপিতে লিপিবদ্ধ আছে যে, শেখ জালালউদ্দিন মুহাম্মদ তাবরিজীর এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। অতএব, দেওতলা ছিল একটি কসবাহ (ক্ষুদ্র শহর) এবং দরবেশ তাবরিজীর নামানুসারে এর নাম হয় তাবরিজাবাদ। শিলালিপিতে এই মহাপুরুষের নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছে শেখ জালাল মুহাম্মদ তাবরিজীরূপে। দেওতলা দেবকোটের পথে সড়কের উপর অবস্থিত এবং দেবকোট তঙ্গা নদীর পার্শ্বেই বিদ্যমান। এতে অনুমান হয় যে, দেওতলা ছিল একটি নদী-বন্দর।
এরূপ বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে যে, সুফি-দরবেশ শেখ জালাল মুহাম্মদ তাবরিজী, যার পবিত্র মাজার আজও দেওতলায় বিদ্যমান। তিনিই বিখ্যাত শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী। একমাত্র এই তাবরিজী সুফি-দরবেশই সে যুগের মানুষের মনে ও কল্পনার রাজ্যে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সুতরাং এটা স্বাভাবিক যে লোকেরা তাঁর সম্মানে দেওতলার নামকরণ করেছিল তাবরিজাবাদ।
বিশেষরূপে 'মুহাম্মদ' শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, এর অর্থ 'প্রশংসিত ব্যক্তি' যেমন 'মুজাররদ' অর্থ ‘অবিবাহিত', এ বিশেষণটি যুক্ত করা হয়েছে সিলেটের
শেখ জালালের নামের সঙ্গে।
এখন সিদ্ধান্ত এই যে, শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী দেওতলায় মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তিনি সমাধিস্থ হন। শেখের মৃত্যু সম্বন্ধে প্রচলিত একটি কাহিনীতে এর সমর্থন পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, তার মৃত্যুর মুহূর্তে হাজী ইব্রাহীম নামে তাঁর একজন শিষ্য শেখের সমস্ত চিল্লাখানায় (চল্লিশ দিবসব্যাপী প্রার্থনা ও উপবাসের স্থানসমূহ) একই সময়ে উপস্থিত হয়ে শেখের মৃত্যু সংবাদ জ্ঞাপন করেন এবং তিনি। নিজে প্রতিটি জায়গায় মৃত্যুবরণ করেন। এতে ইঙ্গিত মেলে যে, শেখের বিভিন্ন চিল্লাখানাগুলো একটি অপরটির কাছাকাছি ছিল এবং এই কারণে তাঁর সমাধি একাধিক স্থানে দেখা যায়। শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী দেওতলায় মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তিনি সমাধিস্থ হন। তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে পান্ডুয়ায় তার সমাধি সৌধ নির্মিত হয়। ‘রিয়াজ আল-সালাতিন' অনুসারে, আলাউদ্দিন আলী শাহ কর্তৃক ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে শেখ তাবরিজীর সমাধি সৌধ নির্মিত হয়েছিল।
শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর আধ্যাত্মবাদ : শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী একজন বিখ্যাত সিদ্ধপুরুষ ছিলেন, তিনি উচ্চতম আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভ করেন। তিনি তাঁর ত্যাগ, সাধনা, নিষ্ঠা ও গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। এমনকি খ্যাতনামা সাধু দরবেশগণ, যেমন বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, ওয়াহিদউদ্দিন কিরমানী, ফরিদউদ্দিন গঞ্জ-ই-শকর, নিজামউদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু ও আমির হাসান সিবযী, সকলেই প্রগাঢ় শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম স্মরণ করতেন এবং তাঁদের দৈনন্দিন উপদেশে ও ‘মালফুজাতে' তার অসামান্য আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা উল্লেখ করতেন। সকল সমসাময়িক লেখকগণ, এমনকি সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ শেখ শুভোদয়ার হিন্দু লেখক শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর অলৌকিক ক্ষমতার কথা ভক্তি ভরে বর্ণনা করেছেন। যদিও তাঁর অলৌকিক শক্তি সম্বন্ধে তাঁদের অনেকগুলো কাহিনীই যুক্তি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না এবং ইতিহাসে গ্রহণ করা চলে না। তথাপি এসব ঘটনাবলি থেকে প্রতিভাত হয় যে তিনি তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্বের বলে সমাজের বুকে গভীর ছাপ রেখে গেছেন। বাস্তবিকই তিনি তাঁর আদর্শ জীবন ও আধ্যাত্মিক প্রতিভা দ্বারা এমন এক অভূতপূর্ব মর্যাদায় উন্নীত হয়েছিলেন যে, এমনকি তাঁর বন্ধু বিখ্যাত সুফি দরবেশ শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া তার জুতা বহন করতেন এবং বলতেন ‘শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর পাদুকা-ধূলি দিয়ে আমার চোখের কাজল তৈরি করা আমার নৈতিক দায়িত্ব।”
সমস্ত পার্থিব স্বার্থ-মুক্ত হয়ে শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী আল্লাহর আরাধনা ও মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি বলতেন, “যার রমণী ও সম্পদের প্রতি আসক্তি আছে, সে কখনো কোনরূপ মঙ্গল লাভ করতে পারে না।” তাঁর
বাংলার পুফিবাদ : পুাকদের অবদানঃ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সুফি
আধ্যাত্মিক জীবনের শিক্ষক শেখ সিহাবউদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর প্রতি তাঁর সেবা তদীয় আধ্যাত্মিক নিষ্ঠার একটি মহৎ দৃষ্টান্ত। গভীর নিষ্ঠার বলে তিনি তাঁর পীরের আশীর্বাদ লাভে সমর্থ হয়েছিলেন; এক সময় তার পীর বলেছিলেন, “শেখ জালালউদ্দিন সব কিছুই নিয়েছে।” তিনি তাঁর গভীর অনুধ্যানে আধ্যাত্মবাদের ঐশ্বর্য ব্যতিরেখে আর কিছুই দেখেননি। প্রার্থনায় তিনি অনেকক্ষণ মগ্ন থাকতেন এবং আল্লাহর আসন না।
দেখা পর্যন্ত তিনি সেজদায় যেতেন না।
বিরাট আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও মানব হিতৈষণামূলক কার্যাবলির দ্বারা শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজী বাংলাদেশের অলৌকিক কার্যাবলি সম্পন্ন করে গেছেন। এবং
অধঃপতিত ও উৎপীড়িত বৌদ্ধ ও হিন্দুরা মুক্তির জন্য তার নিকট ভিড় জমিয়েছিল ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেছিল। এভাবে তিনি উত্তরবঙ্গে একটি শক্তিশালী মুসলিম সম্প্রদায়ের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বঙ্গদেশে নব প্রতিষ্ঠিত মুসলমান শাসন সংহত ও মজবুত করার ক্ষেত্রেও তার অবদান ছিল যথেষ্ট। ধর্মান্তরকারী ও শিষ্য সংগ্রহ করে তিনি একটি অমুসলিম অধ্যুষিত দেশে মুসলিম শাসনকর্তার জন্য একটি শক্তির উৎস সৃষ্টি করেন। তাঁর ‘খানকাহ’ (আস্তানা) এবং লঙ্গরখানাগুলো আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবসেবামূলক কার্যের কেন্দ্র হিসেবে বাঙালি সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন উন্নত করে তোলে এবং দরিদ্র ও দুঃস্থ লোকদের নানাভাবে সাহায্য করে। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের উপর শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর প্রভাব ছিল অসামান্য। হিন্দুরা তাকে এতবেশি শ্রদ্ধা করতো যে, তাঁর মৃত্যুর বহু শতাব্দী পরেও, তারা তাঁর আশীর্বাদ কামনা করতো। মুসলিম সিদ্ধ পুরুষের প্রতি হিন্দুদের এই ভক্তির ফলশ্রুতিস্বরূপ কালক্রমে হিন্দু সমাজে ‘সত্য পীর’ পূজার উদ্ভব হয় এবং সেই সম্প্রদায়ের মধ্যে উদার মনোভাব সঞ্চারিত হয়ে তাদের সামাজিক উন্নতির অবস্থা সৃষ্টি হয়। সমাজ জীবনে শেখ তাবরিজীর অপরিসীম ও স্থায়ী প্রভাবের ফলে, তার স্মৃতি আজও বাংলার জনগণের মনে সমভাবে বিরাজ করছে।
৯. সিলেটের শাহ জালাল : সাধারণ্যে শাহ জালাল নামে পরিচিত শেখ জালাল বাংলার একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন। যদিও তিনি শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মতো অতটা ব্যাপক খ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন না। তথাপিও বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতির ক্ষেত্রে তাঁর একই নামের দরবেশ তাবরিজীর মতোই তাঁর মহৎ ভূমিকা ছিল। সিলেট অধিকার এবং উত্তর-পূর্ববঙ্গে ইসলাম বিস্তারের কৃতিত্ব তাঁকেই দেয়া হয় ৷
শাহ জালালের জীবন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে কোনো প্রামাণিক বিবরণ নেই। ইবনে বতুতা ও আলাউদ্দিন হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৭খ্রিস্টাব্দ) সময়কার দুটো শিলালিপিতে ঘটনাচক্রে তাঁর নাম উল্লিখিত হয়েছে। ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে একজন শাত্তারী সুফি তরীকার পণ্ডিত মুহাম্মদ গাউসী মান্দুবী কর্তৃক সংকলিত ‘গুলজার-ই-আবরার গ্রন্থে শাহ জালাল সম্বন্ধে কিছু কথা পাওয়া যায়। এই লেখক দাবি করেন যে, তথ্য সংগ্রহ করেছেন শেখ আলী শেরের রচিত “শারহ-ই-নুজহাতুল-আরওয়াহ” নামক
পূর্ববর্তী একটি গ্রন্থ থেকে। শেখ শের আলী শের সিলেটের শেখ জালালের শিষ্য ও সঙ্গী শেখ নূরুল হুদার একজন বংশধর। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে নাসিরউদ্দিন নামক জনৈক মুন্সেফ কর্তৃক রচিত 'সুহায়েল-ই-ইয়ামন' গ্রন্থে সিলেটের দরবেশের জীবন সম্বন্ধে কিছুটা বিস্তারিত তথ্য প্রদান করা হয়েছে। অবশ্য, এর বেশির ভাগই স্থানীয় প্রচলিত আখ্যানের উপর ভিত্তি করে লিখিত। এর লেখক খাদেম মুহীউদ্দিনের 'রিসালাহ' ও জনৈক অজ্ঞাতনামা লেখকের 'রওজাত আল-সালাতীন' নামক দুটি পূর্ববর্তী কালে রচিত গ্রন্থের উল্লেখ করেন এবং এদের থেকে সংগৃহীত তথ্যাদি তিনি তার গ্রন্থে ব্যবহার করেছেন। যদিও এর বর্ণনা অনেকটা কল্পনাপ্রসূত, তথাপি 'সুহায়েল-ই- ইয়ামনের কিছু কিছু ঘটনার সমর্থন অন্যান্য সমসাময়িক উল্লেখের মধ্যে পাওয়া যায়। সুতরাং নিছক কল্পনা বলে একে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়া যায় না।
শিলালিপি ও অন্যবিধ সকল রকম উৎস সিলেট বিজয়ের সঙ্গে শাহজালালের নাম জড়িত করে এবং তার জীবনী ও বাংলাদেশে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনায় এদের থেকে একই মতের প্রকাশ পাওয়া যায়। কেবল তাঁর বাল্যজীবন বর্ণনায় এদের মধ্যে বড় রকমের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। 'গুলজার-ই আবরার' এর মতে শেখ জালালউদ্দিন (শাহজালাল) মুজাররাদ ছিলেন। তুর্কীস্তান- জন্মজাত বাঙালি এবং সুলতান সৈয়দ আহমদ ইয়াসভীর শিষ্য। একটি উৎকীর্ণ লিপিতে তাঁকে কুনিয়ার শেখ জালাল মুজাররাদ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুটো উৎস থেকেই ইঙ্গিত মেলে যে, শাহজালাল মূলত তুরস্কের (এশিয়া মাইনর) কুনিয়া শহরের (ইকুনিয়াম বা রুম) অধিবাসী ছিলেন। অন্যদিকে ‘সুহায়েল ইয়ামন' গ্রন্থে তাঁকে কোরেশ বংশজাত একজন ইয়ামনবাসীরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর পিতার নাম ছিল মুহাম্মদ ও তাঁর মা ছিলেন একজন সৈয়দ বংশজাত মহিলা। তিনি ছিলেন তদীয় মামা ও শেখ জালালউদ্দিন বুখারীর বিশিষ্ট শিষ্য সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য। দুটো শিলালিপিও তাঁকে মুহাম্মদের পুত্র শেখ জালাল মুজাররাদ (অবিবাহিত) নামে উল্লেখ করে। কিন্তু অন্য কোনো উৎস থেকে শেখ জালাল যে একজন ইয়ামনী আরব ছিলেন, তার সমর্থন পাওয়া যায় না । এমন হতে পারে ঘটনাপঞ্জিতে সৈয়দ আহমদ কবিরকে সৈয়দ আহমদ ইয়াসভীর সঙ্গে ভুল করা হয়েছে; সৈয়দ আহমদ ইয়াসভী ছিলেন তুর্কিস্তানের খাজাদের (যা পরবর্তীকালে নকশবন্দিয়া সম্প্রদায়ে পরিণত হয়) একজন বিখ্যাত সুফি দরবেশ এবং তার সম্পর্কে মোল্লা হোসেন ওয়ায়েজ কাশিফীর ‘রাশহাত' উল্লেখ রয়েছে। তিনি ছিলেন হযরত আজীজান খাজা আলা রামতিনীর সমসাময়িক যিনি ৭১৫ হিজরি/১৩১৫- ১৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর, মুহাম্মদের পুত্র শেখ জালাল সৈয়দ আহমদ ইয়াসভীর নিকট থেকে 'খিলাফত' লাভ করেন। অতঃপর তিনি পীরের অনুমতি লাভ করে ইসলামের সেবার উদ্দেশ্যে ৭০০ শত শিষ্যসহ কুনিয়া ত্যাগ করেন। এই সময়ে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলরা মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম শাসন ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে চলেছিল।
অতএব, তিনি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা তাঁর পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করলেন। ইবনে বতুতার মতে, ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে যখন হালাকু খান শেষ আব্বাসীয় খলিফা মুস্ত কাসিম বিল্লাহকে হত্যা ও তার রাজধানী লুণ্ঠণ করেন তখন শেখ জালাল বাগদাদে। উপস্থিত ছিলেন। 'গুলজার-ই-আবরার' থেকে জানা যায় যে, পথে শেখ জালাল। শত্রুদের বিরুদ্ধে পবিত্র ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সাফল্য অর্জন করেন। লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচার ও শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি তার বিজিত এলাকার ভার তদীয় কয়েকজন শিষ্যের উপর ন্যস্ত করেন। ৩১৩ জন শিষ্য নিয়ে তাঁর সিলেটে আগমন এবং হিন্দু রাজা গৌরগোবিন্দের সঙ্গে যুদ্ধে তার জয়লাভের বিষয়ও এই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘সুহায়েল-ই-ইয়ামন' গ্রন্থে শেখ জালালের সিলেট বিজয় সম্বন্ধে আরো বিস্তৃত বর্ণনা আছে। এই গ্রন্থানুসারে তিনি দিল্লিতে এসে শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আউলিয়া তাকে একজোড়া কবুতর উপহার দেন। অতঃপর তিনি শিষ্যদের নিয়ে বাংলার দিকে অগ্রসর হন। একটি শিলালিপি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শেখ জালাল মুসলমান সেনাপতি সিকান্দর খান গাজীকে সিলেট বিজয়ে সাহায্য করেন। এই শিলালিপিতে উৎকীর্ণ আছে যে, ‘মুহাম্মদের পুত্র মহা দরবেশ শেখ জালাল মুজাররাদ (অবিবাহিত) এর কৃপায় শ্রীহট্ট শহর ও আরসাহ (এলাকা) ৭০৩ হিজরিতে (১৩০৩ খ্রিঃ) সুলতান পিরুজশাহ দেহলভীর রাজত্বকালে সিকান্দর খান গাজী কর্তৃক প্রথম বিজিত হয়। এই উৎকীর্ণ লিপির তারিখ ৯১৮ হিজরি (১৫১২ খ্রিঃ)। সুহায়েল-ই- ইয়ামনে বর্ণিত হয়েছে যে, সিলেটের রাজা গৌরগোবিন্দ কর্তৃক শেখ বুরহান উদ্দিন নামক জনৈক মুসলমানের প্রতি অবিচারের প্রতিবিধানার্থে নাসিরুদ্দিন বুগরা খানের (সুলতান বলবনের পুত্র) পুত্র ও বাংলার সুলতান শামসউদ্দিন ফিরুজশাহ ও তাঁর ভাগ্নে সিকান্দর গাজীকে সিলেটে প্রেরণ করেন। পথে সিকান্দর গাজী সোনারগাঁও দখল করেন, কিন্তু গৌরগোবিন্দের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি তিন বার বিফল হন। অতঃপর, সুলতান তাঁর সিপাহসালার ও সাতগাঁয়ের শাসনকর্তা নাসির উদ্দিনকে সিকান্দর গাজীর সাহায্যার্থে প্রেরণ করেন। সাতগাঁয়ের নিকটে ত্রিবেণীতে এই সৈন্যদের মধ্যে শেখ জালাল ও তাঁর ৩৬০ জন শিষ্যের পবিত্র উপস্থিতির ফলে সৈন্যদলের নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায় । সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী এইবার সিলেট বিজয়ে কৃতকার্য হয় ।
সিলেট বিজয়ের পর, শাহ জালাল সেখানে অবস্থান করেন এবং ধর্মপ্রচার ও মানব সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইবনে বতুতার বর্ণনায় তাঁর সংযম, নিষ্ঠা ও সেবাধর্মী জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। এই মুরদেশীয় পরিব্রাজক যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন তিনি খুবই বৃদ্ধ। তিনি ক্ষীণকায় ও লম্ব আকৃতির ছিলেন এবং তাঁর অল্প দাড়ি ছিল। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর একাধারে রোজা রাখেন এবং দশদিন অন্তর রোজা খুলতেন। তাঁর একটি গাভী ছিল এবং একমাত্র এর দুধই ছিল তাঁর খাদ্য। তিনি সারারাত উপাসনায় মশগুল থাকতেন।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস ইবনে বতুতা আরো বলেন যে, এই শেখের শ্রমের ফলে ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরা ইসলামে দীক্ষিত হয় এবং এজন্য তিনি তাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তিনি ‘খানকাহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ‘খানকাহ' ছিল সাধু-দরবেশ, পরিব্রাজক ও দুঃস্থ মানুষের আশ্রয়স্থল। হিন্দু মুসলমান সকলেই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা। করতো। তারা তার জন্য নানা প্রকার সামগ্রী উপহার আনত এবং এগুলো দিয়ে তাঁর আস্তানায় বহু লোককে খাওয়ানো হতো। শেখ জালাল সম্বন্ধে শোনা বহু অলৌকিক ঘটনা ও কাহিনী ইবনে বতুতা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কিংবদন্তীতেও শেখ সম্পর্কে এ রকম বহু অলৌকিক ঘটনার বিবরণ প্রচলিত আছে। বাস্তবিকপক্ষে, এ কাহিনীগুলোতে শাহজালালের মহান আধ্যাত্মবাদ ও মানব সেবার আদর্শ প্রতিফলিত হয়; তার এই আদর্শ জনগণের মনে এমন গভীরভাবে রেখাপাত করে যে, তারা তাঁকে একজন অসাধারণ মানুষ বলে মনে করতো।
শাহজালাল ছিলেন একজন খ্যাতনামা সাধুপুরুষ এবং মুসলিম বাংলার ইতিহাসে তার অবদান সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর-পূর্ব বাংলার মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠায় তার কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁর ধর্ম প্রচারের উদ্যম ও নিঃস্বার্থ সেবার ফলে এই সুদূর অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রসার লাভ করেছিল এবং এটা বাংলার অন্যতম মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে উন্নীত হয়েছিল। বাস্তবিকই শাহ জালাল তাঁর মহান কার্যাবলির দ্বারা মুসলিম বাংলার নির্মাতাদের মধ্যে উচ্চ আসন লাভের অধিকারী। আদর্শ জীবন, ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগ ও দুঃস্থ মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ সেবার জন্য তিনি বাংলার অমুসলমানদেরও ভক্তি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। ফলে, আজও তিনি সাধারণ লোকপ্রবাদে অমর হয়ে রয়েছেন এবং শত শত লোক-সংগীতে তাঁর স্মৃতি অদ্যাবধি উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৫০ বছর বয়সে ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে এই সুফি দরবেশ ইহধাম ত্যাগ করেন। সিলেটে তাঁর মাজার শরীফ আজও সর্ব শ্রেণির লোকের নিকট তীর্থস্থান।
১০. শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা : শেখ শরফউদ্নি আবু তাওয়ামা ছিলেন একজন বিখ্যাত সুফি দরবেশ ও পণ্ডিত, যিনি বাংলাদেশে মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। সোনারগাঁয়ে তার খানকাহ ও ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র থেকে একদা যে জ্ঞানের আলোক বিচ্ছুরিত হয়েছিল, তা শুধু বাংলাদেশকেই নয়, উত্তর-ভারতকেও আলোকিত করেছিল। এই সোনারগাঁও শিক্ষাকেন্দ্রে তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য ছিলেন বিখ্যাত সুফি ও পণ্ডিত মকদুম মাওলানা শরুফউদ্দিন এহিয়া মানেরী। শেখ আবু তাওয়ামা ছিলেন বাস্তবিকই সোনারগাঁও ও পূর্ব বাংলার গৌরবের প্রতিষ্ঠাতা ।
শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা বুখারায় জন্মগ্রহণ করেন এবং খোরাসানে শিক্ষালাভ করেন। অত্যাল্পকালের মধ্যে তিনি আধ্যাত্মিকতা ও পাণ্ডিত্যের জন্য খ্যাতিলাভ করেন। ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ, হাদীস প্রভৃতি শাস্ত্রে তিনি অসামান্য জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। রসায়নবিদ্যা, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও যাদুবিদ্যায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজত্বের প্রারম্ভে (১২৬০খ্রিঃ) তিনি দিল্লিতে আগমন করেন । শাহ শুয়েবের লিখিত 'মানাকিব-আল-আসফিয়া' নামক সমসাময়িক গ্রন্থ থেকে আবু তাওয়ামা তাঁর আধ্যাত্মিকতা, পুত চরিত্র ও জ্ঞানের দ্বারা জনসমাজে যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন “ঐ সময়ে মাওলানা আশরাফউদ্দিন (শরফউদ্দিন) তাওয়ামার আধ্যাত্মিক জ্ঞান, পাণ্ডিত্য ও পুস্ত চরিত্রের খ্যাতি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলগুলোতে এবং আরব, ইরান ও অন্যান্য দেশসমূহে। ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন; এমনকি, রসায়নবিদ্যা, প্রকৃতিবিজ্ঞান এবং যাদুবিদ্যায়ও তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বিদ্বান ব্যক্তির। ধর্ম-বিজ্ঞানে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং সাধারণ লোক থেকে শুরু করে আমির, মালিক সকলেই তাঁর প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিলেন। লেখক বলেন যে, শেখের প্রতি লোকের অনুরাগ দেখে সুলতান আশংকা করেন যে, শেখ হয়তো তার রাজ্য কেড়ে নিতে পারেন। সেজন্য সুলতান কৌশলে শেখকে সোনারগাঁয়ে যেতে সম্মত করেন। সে সময় বাংলাদেশ দিল্লির সুলতানের অধীন ছিল। শেখ সুলতানের উদ্দেশ বুঝতে পারেন এবং শাসনকর্তার আদেশ মান্য করা বিধেয় বিবেচনা করে তিনি সোনারগাঁয়ের দিকে যাত্রা করেন ৷
শাহ গুয়েব লিখেছেন যে, শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁও অঞ্চলে যাওয়ার সময় কিছুদিনের জন্য ‘মানেরে’ অবস্থান করেন। এখানে উত্তরকালের বিখ্যাত সিদ্ধপুরুষ ও পণ্ডিত শেখ শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই লোকের মতে, শেখ শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী তখন প্রাপ্ত বয়স্ক এবং ধর্মীয় শিক্ষায় বুৎপত্তি অর্জন করেছেন; তিনি শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার শিক্ষা ও জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হন এবং এমন একজন মহান জ্ঞানীর অধীনে ধর্মবিজ্ঞান অনুশীলনের প্রেরণা অনুভব করেন। শেখ আবু তাওয়ামাও শরফউদ্দিন মানেরীর প্রতিভা ও আদব- কায়দায় তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ধর্ম বিজ্ঞান শিক্ষায় তাঁকে যোগ্য শিষ্য বিবেচনা করেন। সুতরাং পিতামাতার অনুমতি নিয়ে শেখ শরফউদ্দিন মানেরী সোনারগাঁয়ের পথে শেখ আবু তাওয়ামার সঙ্গী হন।
কখন শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁয়ে আগমন করেন? তার আগমনের তারিখ সম্বন্ধে সঠিক কোনো প্রমাণ নেই। এটা অবশ্য জানা যায় যে শেখ শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। শরফউদ্দিন মানেরী ৬৬১
হিজরি/১২৬২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। শাহ সুয়েবের মতে, শরফউদ্দিন মানেরী ।
তখন প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন এবং ধর্মীয় শিক্ষায় বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু শরফউদ্দিন মানেরীর নিজের একটি উক্তি থেকে জানা যায় যে, তিনি তখনো বালক ছিলেন এবং তিনি স্বীয় প্রাথমিক শিক্ষা সন্তোষজনক বলে বিবেচনা করেননি। তিনি বলেন, “আমার বাল্যকালে তারা আমাকে ‘মাসাদির' ও 'মিফতাহ আল লুগাত
বইগুলো মুখস্থ করান।” এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যখন শেখ শরফউদ্দিন মানেরী শেখ আবু তাওয়ামার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার সঙ্গে সোনারগাও যান তখন তার বয়স ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ছিল। সুতরাং তারা ১২৭৪ থেকে ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সোনারগাঁয়ে আগমন করেন। কথিত আছে যে, শরফউদ্দিন মানেরী শেখ আবু তাওয়ামার নিকট বহু পছর পড়াশুনা করেন। তিনি জানতে পারেন যে, তার পিতা ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে ইহধাম ত্যাগ করেছেন। শেখ শরফউদ্দিন মানেরী ছাত্রাবস্থায় তদীয় শিক্ষকের কন্যাকে বিয়ে করেন এবং এর গর্ভে তার তিন পুত্র জন্মে; দুজন সোনারগায়ে মারা যায় ও অন্যজন সাহ জাকিউদ্দিন জীবিত ছিলেন এবং তিনি মানেরের পথে পিতার সঙ্গী হয়েছিলেন। এই সমস্ত তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার সোনারগাঁয়ে আগমনের তারিখ ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দের পরে নির্দিষ্ট করা যায় না।
শাহ শুয়েবের বর্ণনা থেকে প্রকাশ পায় যে, ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দের শেখ আবু ডাওয়ামার আগমনকালে সোনারগাঁও দিল্লি সালতানাতের অধীন ছিল। এই লেখক উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ দিল্লি সুলতানের শাসনাধীনে ছিল । প্রথমদিকে মুসলমান ঐতিহাসিকরা সোনারগাঁও সহ পূর্ববঙ্গ বুঝাতে 'বঙ্গ' বা ‘বাঙ্গালাহ' শব্দের ব্যবহার করতেন। উত্তরবঙ্গকে তারা লক্ষ্মণাবতী নামে অভিহিত করতেন। কেবল পূর্ববঙ্গে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকেই সমগ্র দেশ ‘বাঙ্গালাহ' নামে পরিচিতি লাভ করে। সুলতান বলবন যখন ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহী শাসনকর্তা তুগ্রিলকে শান্তিদানের উদ্দেশ্যে বাংলায় অভিযান করেন তখন সোনারগাঁয়ের হিন্দু শাসক দনুজ রায় তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেন এবং সুলতান সেই অঞ্চলে বিদ্রোহী তুগ্রিলের উপর দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করেন। এর থেকে মনে হয় যে, দনুজ রায় সুলতানের একজন সামন্ত ছিলেন। অধিকন্তু, সুলতান বলবন তদীয় পুত্র বুগরা খানকে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে রেখে যাওয়ার সময়ে এই বলে তাকে (বুগরা খাঁকে) সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, যদি কোনো শাসনকর্তা কখনো বিদ্রোহী হয় সে হিন্দুস্তান, সিন্ধু, মালব, গুজরাট, লক্ষ্মণাবতী কিংবা সোনারগাঁও যেখানকারই হোক না কেন, তাকে সাংঘাতিক রকমের শান্তি পেতে হবে। ঐ সময়ের সোনারগাঁও যে অধীনস্থ অঞ্চল ছিল তা এই বক্তব্যে সমর্থিত হয়। এতদ্ব্যতীত, মুদ্রাসংক্রান্ত প্রমাণও আছে যে, সুলতান রুকনউদ্দিন কাইকাউস বঙ্গের খারাজ (ভূমি রাজস্ব) থেকে ৬৯০ হিজরি/১২৯১ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রা প্রচলন করেন। এতে প্রমাণ হয় যে, ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও মুসলমান শাসনাধীন ছিল। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মুসলমানরা যে সোনারগাঁও জয় করেছিলেন, এ সম্পর্কে কোনো সঠিক প্রমাণ নেই। অথচ, মুদ্রা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে ঐ অঞ্চলের উপর মুসলিম আধিপত্য বিদ্যমান ছিল । কিভাবে তা হয়েছিল? এতে এই মত সমর্থিত হয় যে, বলবনের বাংলা অভিযানের পূর্ব থেকেই সোনারগাঁও বাংলার অধীনে ছিল । শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা পরিবার পরিজন নিয়ে সোনারগাঁয়ে বসতি করেন এবং ধর্মপ্রচার ও শিক্ষাদানে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের একটি খানকাহ (আস্তানা) ও ছাত্রদের জন্য একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এই বিখ্যাত সুফিপুরুষ ও পণ্ডিতের নিকট জ্ঞান লাভের নিমিত্ত বিপুল সংখ্যক শিষ্য ও শিক্ষার্থী সোনারগাঁয়ে সমবেত হয়। এভাবে সোনারগাঁও ধর্ম ও জ্ঞানের একটি প্রদীপ্ত কেন্দ্রে পরিণত হয়। শেখ আবু তাওয়ামার ‘খানকাহ' ও ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র থেকে ধর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে বহু জ্ঞানীগুণীর আবির্ভাব হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন। শেখ শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী। এভাবে আবু তাওয়ামা পূর্ববঙ্গে ইসলাম ধর্ম শিক্ষার উন্নতিসাধন করেন। তিনি ৭০০ হিজরি/১৩০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এবং সোনারগাঁয়ে সমাধিস্থ হন।
6
১১. মখদুম-উল-মূলক শেখ শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী : মখদুম-উল-মূলক শেখ শরফউদ্দিন ছিলেন বিহারের অন্তর্গত মানেরের শেখ এহিয়ার পুত্র। তিনি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাল্যকালে ইসলামি শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর জ্ঞানের পিপাসা এত প্রবল ছিল যে, মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি বিখ্যাত সুফি-সাধক ও পণ্ডিত শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার ছাত্র হয়ে সোনারগাঁয়ে আসেন। সোনারগাঁয়ে তিনি পড়াশুনায় এত গভীরভাবে নিমগ্ন থাকতেন যে তিনি বাড়ি থেকে প্রেরিত চিঠি পড়ার সময় পর্যন্ত পাননি। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর চিঠিগুলো খুলে তার একটির মধ্যে তিনি তাঁর পিতার মৃত্যুসংবাদ পান। শরফউদ্দিনমানেরী তাঁর শিক্ষকের অন্যান্য ছাত্র ও শিক্ষকদের সঙ্গে একত্রে খাদ্য গ্রহণ থেকেও বিরত থাকতেন; কেননা, এতে প্রচুর সময় ব্যয় হতো এবং তাঁর জ্ঞানার্জনের গভীরনিষ্ঠার বিঘ্ন সৃষ্টি করতো ।
শরফউদ্দিন দীর্ঘ পনেরো বছরকাল শেখ আবু তাওয়ামার অধীনে ইসলামি বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় জ্ঞানর্জন করেন এবং পূর্ণতা লাভ করেন। তাঁর প্রতিভা ও গুণাবলীল স্বীকৃতিস্বরূপ আবু তাওয়ামা স্বীয় কন্যার সঙ্গে তার বিয়ে দেন। বাস্তবিকই শরফউদ্দিন মানেরী ছিলেন তাঁর খ্যাতনামা শিক্ষকের যোগ্য শিষ্য এবং সোনাগরীও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জ্ঞানের নিদর্শন। বাংলাদেশ সত্যি সত্যি তাঁকে নিয়ে গর্ব করছে পারে। ওস্তাদের আশীর্বাদ নিয়ে শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী ১২৯৩ খ্রিস্টাব্দে মানেরে প্রত্যাবর্তন করেন এবং শিক্ষা দান ও ধর্ম প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। সুফি ও পণ্ডিত হিসেবে তাঁর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি পাণ্ডিত্য ও আধ্যাত্মিকজ্ঞানে হিন্দুস্তানে এক অপূর্ব সম্মান লাভ করেন। তিনি বহু সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেন। এসব গ্রন্থে তাঁর গভীর জ্ঞান ও অধ্যাত্মবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থরাজির প্রশংসা করতে গিয়ে শেখ আবদুল হক দেহলভী লিখেছেন। “শেষ শরফউদ্দিন মানেরী ভারতের বিখ্যাত সুফি পুরুষদের অন্যতম। তিনি প্রশংসার অতীত। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও উচ্চ প্রশংসিত। সুফি মতের মূলসূত্র ও
১২. শেখ রেজা বিরাবানী : শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের রাজত্বকালে (১৩৪২-
হয়েছিল; তাঁদের একজন ছিলেন আখী সিরাজউদ্দিন উসমান এবং অন্যজন ছিলেন। ৫৭ খ্রিঃ) দুজন খ্যাতনামা সিদ্ধপুরুষের পবিত্র উপস্থিতিতে তার রাজধানী ধন্য
শেখ রেজা বিয়াবানী। শেখ রেজা বিয়াবানীর প্রতি সুলতান ইলিয়াস শাহের এত গভীর শ্রদ্ধা ছিল যে, যদিও তিনি সুলতান ফিরুজ শাহ তুগলক কর্তৃক একডালা দুর্গে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন, তথাপি ঐ সময়ে এই মহান সুফির মৃত্যু হওয়ায়, সুলতান ফকিরের ছদ্মবেশ ধারণ করে দরবেশের জানাজায় যোগদান করেন ।
১৩. মখদুম জাহানীয়ান-ই-জাহান গান্ত : মখদুম জাহানীয়ান-ই-জাহান গাস্ত নামে সমধিক পরিচতি মীর সৈয়দ জালালউদ্দিন ছিলেন সৈয়দ জালালউদ্দিন বুখারীর দৌহিত্র ও আহমদ কবীরের পুত্র। 'ঝনঝনিয়া' নামে অভিহিত একটি মসজিদ আছে; সম্ভবত এ নামটি 'জাহানীয়ান-ই-জাহান গাস্ত' এর অপভ্রংশ। জন প্রবাদে তাঁর স্মৃতির সঙ্গে জড়িত আরো দুটো স্মারকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা ‘ঝাণ্ডা' (একটি দণ্ডের মাথায় বসানো কুলজীবিদ্যা সংক্রান্ত চিত্র) এবং 'কদম-রসূল' (রসূলের পায়ের ছাপ)। আরো কথিত আছে যে, তিনি শেখ আলাউল হকের জানাযায় ইমামতি করেছিলেন। এটা সত্য নয়, কেননা, শেখ আলাউল হকের মৃত্যুর প্রায় ১৫ বছর পূর্বে (৮০০ হিজরি) 'জাহানীয়ান-ইজাহান গাস্ত' ৭৮৫ হিজরি (১৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে উচ্চেতে সমাহিত করা হয়।
যেহেতু তিনি ব্যাপকভাবে সফর করেন, সেজন্য অবশ্য বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, 'জাহানীযান-ই-জাহান গাস্ত' বাংলাদেশও পরিভ্রমণ করেন এবং গৌড় ও পান্ডুয়ার কিছু সংখ্যক লোক তাঁর শিষ্যত্বে বরণ করেন।
১৪. শেখ আখী সিরাজউদ্দিন উসমান : বাংলাদেশের প্রথম যুগের চিশতীয়া সুফিদের মধ্যে শেখ আখী সিরাজউদ্দিন উসমান ছিলেন শ্রেষ্ঠতম। তিনি এ দেশের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গভীর প্রভাব রেখে গেছেন। শেখ আখী সিরাজ নিজে ছিলেন পরম আধ্যাত্মিক পূর্ণতাসম্পন্ন একজন সুফি; তিনি বঙ্গদেশে রেখে যান খ্যাতনামা চিশতী সুফি-পুরুষদের একটি সম্প্রদায়, আর রেখে যান তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারীদের নিকট মানব সেবামূলক কার্যাবলির আদর্শ। তিনি শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার (১২৩৬-১৩২৫ খ্রিঃ) একজন প্রিয় শিষ্য ছিলেন; তার খ্যাতনামা পীর তার আধ্যাত্মিক গুণাবলি ও পূর্ণজ্ঞানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্নেহসিক্ত চিত্তে তাঁকে “আয়না-ই- হিন্দুস্তান” (হিন্দুস্তানের আয়না) উপাধিতে ভূষিত করেন।
শেখ আলী সিরাজ ছিলেন বাঙালি। একজন আধুনিক লেখকের উক্তির উপর নির্ভর করে কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন যে, তিনি বাদায়ুনের অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু সমসাময়িক তথ্যাদি থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে তিনি বাংলার অধিবাসী ছিলেন।
শেখ
আখী সিরাজকে পান্ডুয়া-নিবাসী বলে উল্লেখ করেন। এতে ইঙ্গিত মেলে যে, তিনি
১. প্রথম যুগের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর অন্যতম “সিয়ার আল-আরেফিন”। বঙ্গদেশের অন্তর্গত পান্ডুয়ার অধিবাসী ছিলেন। উলেমা ও সুফি দরবেশগণ সাধারণত তাদের নামের সঙ্গে তাঁদের জন্মস্থানের নাম যুক্ত করতেন। এভাবে দেখা যায়। খাজা কুতুবউদ্দিন ‘উশী’, শেখ জালালউদ্দিন ‘তাবরিজী’ শেখ হামিদউদ্দিন ‘নাগোরী', শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া ‘বাদায়ুনী’, আমির হোসেন ‘সিবজী' ও শেখ আবদুল্লাহ “কিরমানী' ইত্যাদি নামে অভিহিত হতেন এবং এর প্রমাণস্বরূপ একটি দীর্ঘ তালিকা |
যোগ করা যেতে পারে।
২. সুফি দরবেশদের জীবনী সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘আল-আখিয়ার' গ্রন্থে সঠিকভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, শেখ আখী সিরাজ তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষক শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নিকট থেকে ‘খিলাফৎ’ ও ‘খিরকাহ’ লাভ করার পর, স্বদেশে (ওয়াতানে আসলি) যাত্রা করেন। তিনি নিঃসন্দেহে লক্ষণাবতীতে আগমন করেন এবং এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বাংলা তাঁর মাতৃভূমি ছিল ।
৩. ‘আখবার-আল-আখিয়ার থেকে আরো জানা যায় যে, শেখ আখী সিরাজ অল্প- বয়সে দাঁড়ি উঠার পূর্বে শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার একজন সেবকরূপে শিষ্যভুক্ত হন। কয়েক বছর পর তিনি তার মাকে দেখার জন্য লক্ষণাবতীতে তার বাড়িতে গমন করেন। গুলজার-ই-আবরার গ্রন্থের লেখক গউসী মাদুবীও বলেন যে, শেখ আখী সিরাজ তার মাকে দেখার জন্য বাংলাদেশে গমন করেছিলেন। তার বাড়ি লক্ষণাবতীতে না হলে, কেন তার মা সেখানে বসবাস করবেন, বিশেষত, যখন তার পিতা মৃত এবং তিনি (আখী সিরাজ) দিল্লিতে ছিলেন? ফলে, এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, তার পিতামাতা স্থায়ীভাবে বঙ্গদেশে বসতি স্থাপন করেছিলেন ।
৪. শেখ আখী সিরাজ যে বাংলার অধিবাসী ছিলেন ‘খাজিনাত আল-আসফিয়া' গ্রন্থের তথ্য থেকে তার সমর্থন পাওয়া যায়। এতে লেখা হয়েছে, “খিরকাহ প্রদানের পর আখী সিরাজকে তাঁর স্বদেশ (ওয়াতানে খোদ) প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এটা সঠিকভাবে জানা যায় যে, আখী সিরাজ বঙ্গদেশে বিখ্যাত আউলিয়ার একজন খলিফা নিযুক্ত হন এবং বাংলার রাজধানী পাণ্ডুয়াতেও আগমন করেন। সুতরাং শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার একজন আধ্যাত্মিক প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর কার্যস্থল ও স্বদেশভূমি ছিল বাংলা। রফিক আল-আরেফিন নামক একটি ‘মালফুজাত' এর সংকলনকারীরা শেখ আখী সিরাজকে ‘আউধী' হিসেবে উল্লেখ করেন। চিরাগ-ই-দিল্লি নামে পরিচিত আর একজন খ্যাতনামা সুফি শেখ নাসিরউদ্দিন আউধীর সঙ্গে বাংলার এই বিখ্যাত সাধু-পুরুষের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে এটা উল্লেখ করা হয়েছে। এরা দু'জনেই শেখ নিজাউদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য ছিলেন এবং উভয়ে ইমাম হাসানের একই পরিবার থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন। তাঁদের পূর্ব-পরুষগণ ভারতে আগমন করেন। শেখ নাসিরউদ্দিনের পিতা অযোধ্যায় বসতি স্থাপন করায়, তিনি ‘আউধী' হিসেবে পরিচিত
একজন ‘আউধী' হওয়ায় ‘মালফুজাতে’র
হয়েছিলেন। শেখ নাসিরউদ্দিন। সংকলনকারীরা তাঁর জ্ঞাতিভাই আখী সিরাজকেও একজন ‘আউধী' হিসেবে বর্ণনা। করেন। এটা বাস্তবিকই ভুলবশত হয়েছে। তিনি শেখ নাসিরউদ্দিনের মতো একই। পরিবারভুক্ত হলেও 'আউধের অধিবাসী ছিলেন না, তিনি বাংলার অধিবাসী ছিলেন; এটা পূর্বের আলোচনায় সঠিকভাবে দেখান হয়েছে, সে যুগের সবচেয়ে খ্যাতিমান সুফি সাধক শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য হওয়ার বাসনায়, শেখ আখী সিরাজ অতি তরুণ বয়সে দিল্লি গমন করেন এবং এই মহান চিশতীয়া সিদ্ধপুরুষের একজন সেবকরূপে শিষ্যভুক্ত হন। অতঃপর কয়েক বছর পরে, তিনি তাঁর মাকে দেখার জন্যে লক্ষণাবতীর বাড়িতে গমন করেন। শেখের সেবা করার জন্য তিনি আবার দিল্লিতে ফিরে আসেন। নিষ্ঠার বলে তিনি অল্পকালের মধ্যে তদীয় পীরের ‘খেলাফৎ’ (আধ্যাত্মিক প্রতিনিধিত্ব) লাভের উপযুক্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর যথেষ্ট শিক্ষা ছিল না। শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া মন্তব্য করেন, “আধ্যাত্মিক ব্রতের জন্য শিক্ষাই হলো প্রথম স্তর — কিন্তু তার (আখী সিরাজ) সেরূপ শিক্ষা নেই। ‘খাজিনাত আল-আসফিয়ার গ্রন্থকার লিখেছেন যে, শেখ বলতেন, “শিক্ষাহীন সুফি শয়তানের ভাঁড়স্বরূপ।”
শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার অন্যতম বিদ্বান শিষ্য মাওলানা ফখরউদ্দিন জারবাদী আখী সিরাজের শিক্ষার ভার গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের নির্বাচিত অংশগুলো সংকলন করে অল্প সময়ের মধ্যে শেখ আখী সিরাজকে শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা করেন। মাওলানা তাঁর নাম রাখেন উসমান এবং মাত্র ছ'মাসের মধ্যে তাঁকে সমস্ত রকম দরকারী জ্ঞানের বিষয় শিক্ষা দান করেন। আখী সিরাজ মাওলানা রুকনউদ্দিনের অধীনেও শিক্ষা লাভ করেন এবং কাফিয়া, মুফুসসল, কুদুরী ও মাজমা আল-বাহরাইন ইত্যাদি গ্রন্থাবলি অধ্যয়ন করেন। কথিত আছে যে, শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যুর (১৩২৫ খ্রিঃ) পরও তিনি বছরকাল বিদ্যশিক্ষার কাজ অব্যাহত রাখেন এবং সমস্ত রকম জ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেন। সিয়াল-আল আরেফিনের লেখক বলেন, “বিজ্ঞতা জ্ঞানে কেউই তাঁর (আখী সিরাজের) সমকক্ষ ছিলেন না কিংবা কেউ তাঁর সঙ্গে তর্ক করতে সাহস পর্যন্ত পেতেন না ।
মনে হয়, শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া কর্তৃক বাংলার খলিফা নিযুক্ত হয়েও কার্যত শেখ আখী সিরাজ বিখ্যাত আউলিয়ার মৃত্যুর তিন চার বছর পর পর্যন্ত বাংলায় গমন করেননি। কথিত আছে যে, খলিফা নিযুক্তির পর শেখ আখী সিরাজ তার পীরের নিকট বলেন যে, বাংলাদেশের শেখ আলাউল হক অত্যন্ত জ্ঞানী এবং এজন্য তিনি শেখ আলাউল হকের সম্মুখীন হতে দ্বিধাবোধ করছেন। শেখ নিজামউদ্দিন তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, শেখ আলাউল হক তাঁর অনুগত শিষ্য হবে। কার্যত ঠিক তাই হয়েছিল। শেখ আখী সিরাজের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানের পূর্ণতা এতবেশি ছিল যে, জ্ঞানীগৰ্ভী অভিজাত ও বিশিষ্ট আলেম শেখ আলাউল হক তাঁর একান্ত অনুগত শিষ্য হয়ে অহর্নিশি তাঁর অনুগমন করেছেন এবং তাঁর শেখের ভ্রমণকালে তাঁকে গরম
খাবার পরিবেশন করার জন্য খাবারের পাত্রসহ একটি জ্বলন্ত উনুন সঙ্গে সঙ্গে রেখেছেন। শেখ আখী সিরাজের পূত চরিত্র, গভীর জ্ঞান ও মানবতাবোধ লক্ষ্মণাবতীর রাজ-পরিবার, আমির-ওমরা এবং সকল শ্রেণির লোকদেরকে আকৃষ্ট করেছিল। লক্ষ্মণাবতীতে তিনি ‘খানকাহ' প্রতিষ্ঠা করেন। এই খানকাহ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও মানব সেবামূলক কার্যাবলির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং এর প্রভাব সারা দেশে বিস্তৃত হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ ও জ্ঞানানুরাগী ব্যক্তিরা এখানে সমবেত হতেন। শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার গ্রন্থাগারের কিছু সংখ্যক পুস্তক শেখ আখী সিরাজ লক্ষ্মণাবতীতে সঙ্গে করে এনেছিলেন এবং এগুলো কেন্দ্র করে এদেশে ইসলামি মরমীবাদ সংক্রান্ত প্রথম গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। তাঁর খানকায় অসহায় দীন-দুঃখী, বৃদ্ধ ও দুঃস্থ মানুষ আশ্রয় লাভ করতো এবং দাতব্য চিকিৎসালয় ও অনাথ আশ্রয় হিসেবে এ খানকাহগুলোতে তারা সেবাযত্ন পেতো। তিনি একটি লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে গরিব, ক্ষুধার্ত, ভিক্ষুক ও সাধু-ফকিরগণ সবসময় খাবার পেতো। শেখ আলাউল হক লঙ্গরখানার জন্য এত প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন যে, এটা তৎকালীন বাঙালি সুলতান সিকান্দর শাহের ঈর্ষার উদ্রেক করে। শেখ আলাউল হক বলতেন, লোকদের পাওয়াবার জন্য তাঁর পীর আখী সিরাজ যে অর্থ ব্যয় করতেন তিনি তার দশভাগের এক ভাগও ব্যয় করতেন না। শেখ আখী সিরাজ তাঁর আল্লাহ-প্রেম, মানবতাবোধ ও উদারগুণে সকলের এমন কি অমুসলিমদেরও অকৃত্রিম প্রীতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেন। এর ফলে বাংলাদেশে ইসলাম প্রসার ও সমঝোতাপূর্ণ পরিবেশ এবং সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয় ৷
কথিত আছে যে, শেখ আখী সিরাজ তাঁর পীর শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নিকট থেকে আনীত আলখাল্লা (পোশাক) সমাধিস্থ করেন এবং সেই আলখাল্লার কবরের পাদদেশে তাঁকে সমাধিস্থ করার জন্য শিষ্যদেরকে নির্দেশ দেন। তিনি ৭৫৯ হিজরি/১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইহধাম ত্যাগ করেন এবং তার নির্দেশ মোতাবেক তাঁকে সমাহিত করা হয় । তাঁর সমাধি-ফলকে দুটি শিলালিপি উৎকীর্ণ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি ৯৩১ হিজরি/১৫১০ খ্রিস্টাব্দের, আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময়কার এবং অন্যাটি ৯৪৪ হিজরি/১৫২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দের। সুলতান নূসরৎ শাহের রাজত্বকালের শেষোক্ত শিলালিপিটি এই সুফিদরবেশের সমাধি সৌধে একটি তোরণ নির্মাণের সাক্ষ্য বহন করছে। স্থানীয়ভাবে শেখ আখী সিরাজউদ্দিনকে “পুরানো পী” (পুরাতন পীর) বা “পীরানা পীর” (পীরদের পীর) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই সিদ্ধপুরুষের মাজার সাগর দিঘির উত্তর-পশ্চিম কোণে, ফিরিঙ্গী বাজারের প্রায় ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সাদুল্লাহপুরে অবস্থিত। প্রতি বছর একবার করে ঈদ-উল-ফিতরের উৎসবের দিনে সাগর দিঘিতে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। এই উপলক্ষে এই মহান সূফী- দরবেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্ত মখদুম জাহানীয়ান-ই-জাহান গাস্তের ঝাণ্ডা ও শেখ নূর কুতব আলমের পাঞ্জা এখানে পাঠান হয়ে থাকে। প্রতি বছর ঈদ-উল-ফিতর
ঈদ-উল-আযহা এই উভয় ঈদ-পর্ব উপলক্ষে এখানে একটি বিরাট মেলা বসে। স্থানীয় মৌলবীদের মতে, শেখ আখী সিরাজের দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিস পত্রাদি, যেমন কুরআন-শরীফ, তসবীহও রিহাল (কুরআন শরীফ রাখার তাক) প্রভৃতি তাঁর কবরের শীর্ষদেশে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ফলে, কবরটি অস্বাভাবিকরকম দীর্ঘাকৃতি হয়ে পড়েছে। শেখ আখী সিরাজের বহু শিষ্যের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন শেখ আলাউল হক। তিনি তাঁর মহান পীরের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও জনসেবার আদর্শ অনুসরণ করে চলেন এবং তার দেশের লোকদের নৈতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিতে যথেষ্ট অবদান রেখে যান ।
১৫. শেখ আলাউল হক : শেখ আলাউল হক ছিলেন শেখ আখী সিরাজউদ্দিনের সবচেয়ে খ্যাতনামা শিষ্য ও খলিফা। তিনি লক্ষণাবতীর একটি সংস্কৃতিবান ও প্রতিপত্তিশালী সমৃদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ‘মায়রিফ আল-ওলায়েত' নামক গ্রন্থের মতে, তার পরিবার বিখ্যাত কোরেশ বংশীয় সেনাপতি খালিদ বিন-ওয়ালিদের বংশধর। ‘আখবার আল-আখিয়া'র থেকে জানা যায় যে, তাঁর পিতা সুলতান সিকান্দর শাহের (১৩৫৭-৯২ খ্রিঃ) কোষাধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং শেখ আলাউল হকের আত্মীয়-স্বজনরাও ছিলেন বাদশাহের উজীর ও আমির-ওমরাহ। আজম খান নামে তাঁর এক পুত্র ছিলেন পাণ্ডুয়া রাজ-দরবারের উজীর। এভাবে শেখ আলাউল হক উচ্চ অভিজাত শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। আখবার আল-আখিয়ার তাঁকে ঐ সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম, জ্ঞানী ও ধনী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। ঐ যুগের আলেমগণ তাঁর সঙ্গে তর্ক করতে সাহস পেতেন না । এমনকি আখী সিরাজও প্রথমে শেখ আলাউল হকের সম্মুখীন হতে দ্বিধা বোধ করেছিলেন। বিখ্যাত তাপস শেখ নিজামউদ্দিন আওলিয়া যখন তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে আলাউল হক তাঁর শিষ্যত্ববরণ করবেন, কেবল তখনই তিনি তাঁর পীরের খলিফারূপে বাংলায় আসতে সম্মত হয়েছিলেন।
বাস্তবিকই মহান আউলিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছিল। আলাউল হক আখী সিরাজের আধ্যাত্মিকতায় আকৃষ্ট হন এবং তাঁর একান্ত অনুগত শিষ্য হন। তিনি সম্পদ প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদা পরিত্যাগ করে, সেবা ও সংযমের জীবন বেছে নেন। তিনি কৃচ্ছসাধন ও ত্যাগের জীবনের সমস্ত রকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নিষ্ঠার গুণে তিনি শেখ আখী সিরাজের আশীর্বাদ লাভ করেন এবং তার গুণগ্রাহী পীর তাঁকে ‘খিলাফৎ' দান করেন এবং আধ্যাত্মিক ব্রতে তাঁকে নিজের বিশিষ্ট সহকারীরূপে গ্রহণ করেন ।
শেখ আখী সিরাজের মৃত্যুর পর, শেখ আলাউল হক তার মহান শিক্ষকের ধর্মীয় এত অনুসরণ করে চলেন এবং নানাভাবে ইসলামের উন্নতি সাধন করেন। তিনি পাণ্ডুয়াতে একটি খানকাহ ও একটি লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করেন; এগুলো ভক্ত, জ্ঞানী, ঈশ্বরান্বেষণকারী ও আশ্রয়হীন অনাথদের আশ্রমে পরিণত হয়েছিল। তিনি এগুলোর ব্যয় নির্বাহের জন্য মুক্তহাতে দান করেন। বাস্তবিকই শেখ আলাউল হক তাঁর আদর্শ
জীবন ও মানব-সেবামূলক কার্যাবলির দ্বারা মানুষের মনে এতবেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে, সুলতান সিকান্দর শাহ পর্যন্ত তার প্রতিপত্তিতে শংকিত হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সুলতানের সঙ্গে শেখের মতানৈকতাও বিদ্যমান ছিল। ইলিয়াস শাহ্ (১৩৪২-৫৭ খ্রিঃ) ও সিকান্দর শাহের আমলে রাষ্ট্রের উচ্চ পদগুলোতে হিন্দুদের নিয়োগ করা হতো। শেখ আলাউল হক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে এভাবে হিন্দুদের নিয়োগ করা অসংগত বলে উল্লেখ করেন। জনসাধারণের উপর শেখের প্রভাব- প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে সুলতান পূর্বেই ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিলেন এবং রাজকার্যে তার হস্তক্ষেপ তিনি পছন্দ করেননি। ফলে সুলতান তাকে রাজধানী থেকে নির্বাসিত করেন। অতঃপর শেখ আলাউল হক সোনারগাঁয়ে বসবাস করেন। এখানেও তিনি 'খানকাহ' ও লঙ্গরখানা স্থাপন করেন এবং ধর্ম ও জ্ঞানের সেবায় আত্মনিয়ে করেন। এমনকি সেই নির্বাসিত স্থানেও তিনি তার সেবা ও নিষ্ঠার দ্বারা লোকদের চিত্ত জয় করতে পেরেছিলেন। সম্ভবত ১৩৯২ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দর শাহের মৃত্যুর পর তিনি পাণ্ডুয়ায় ফিরে আসেন।
শেখ আলাউল হকের সুগভীর পাণ্ডিত্য ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য পাণ্ডুরা সময়ে ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই মহান তাপসের খ্যাতি দূরদূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে এবং জ্ঞান ও ঈশ্বরান্বেষণকারী লোকদেরকে আর করে। তাঁর নিকট ইসলামের ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্যে মধ্য-এশিয় থেকে মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী, মানিকপুর থেকে শেখ নাসিরউদ্দিন এবং আরো অনেকে দূরবর্তী দেশ থেকে আগমন করেন। নূর কুতুব-উল-আলম, জাহাঙ্গীর সিমনানী ও নাসিরউদ্দিন মানিকপুরী প্রমুখ সুফি ছিলেন তাঁর খ্যাতনাম শিষ্যদের মধ্যে কয়েকজন। শেখ হোসেন জুক্কার পোষ, যিনি তাঁর পবিত্র পদধূলিতে পূর্ণিয়া ধন্য করেছিলেন, তিনিও এই বিখ্যাত বাঙালি সুফি-পুরুষের শিষ্য ছিলেন। জাহাঙ্গীর সিমনানীর মতে, আলাউল হকের শিষ্যগণ তাঁদের মহান শিক্ষনে নামানুসারে চিশতীয়া তরীকার মধ্যে ‘আলাই' নামে একটি সুফি সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। আলাউল হকের সুযোগ্য শিষ্যগণ তাঁদের গুরুর ঐতিহ্য বজায় রাখেন এবং তাদের মতবাদের গৌরব ও মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ আলাউল হক ৮০০ হিজরি ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে পাণ্ডুয়াতে মৃত্যুবরণ করেন।
১৬. হযরত নূর কুতুব আলম : হযরত নূর কুতুব আলম (কুতুব-উল-আলম) ছিলেন বিখ্যাত সুফি দরবেশ শেখ আলাউল হকের সুযোগ্য পুত্র ও সার্থক আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী। পিতার মতো তিনিও ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও বিদ্যাবত্তায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সহপাঠী ছিলেন এবং তারা উভয়ে শেখ হামিদউদ্দিন গঞ্জনসিন (কুঞ্জনসীন) নাগরীর নিকট শিক্ষালাভ করেন। (বীরভূম জেলার নাগর)। দুর কুতুব আলমের শিষ্য হুশামউদ্দিন মানিকপুরীর মালফুজাত 'রফিক আল আরেফিন'। থেকে জানা যায় যে, তার পীর ও গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মধ্যে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ।
বাল্যকাল থেকেই এর কুতুব আলমকে তাঁর পিতা আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষা দেন এবং কঠোর তপস্যা, নিষ্ঠা ও সংযমী জীवन ान অত্যন্ত করে তোলেন। যে বালিক ঐশ্বর্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিল, আকির মিসকিনের কাপড়-চোপড় ধোয়া থেকে শুরু করে তাদের অযু করার পানি গরম করা, খানকাহ ঝাড় দেয়া এবং খানকাহ সংলগ্ন পায়খানা পরিষ্কার করা ই সকল রকম কাজ করতে হয়েছিল। কথিত আছে যে, একদা তিনি যখন একজন রুগ্ন ভিক্ষাজীবী ফকিরকে পায়খানা যেতে সাহায্য করছিলেন, তখন তার সমস্ত কাপড় চোপড় ও শরীর মল লেগে অপবিত্র হয়ে যায়। পিতা তাঁর এ সেবার কাজে সম্ভই হয়ে তাঁকে লঙ্গরখানার জন্যে জ্বালানি কাঠ বহন করার কাজে নিযুক্ত করেন। ভ্রাতা রাজ দরবারের উজীর আজম খান একদা তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে পেলেন এবং তাঁকে এরকম নিচ শ্রেণির কাজ পরিত্যাগ করে তার নিকট আসতে বলেন, যাতে তিনি রাজ-দরবারের ঐশ্বর্য ও আঁকজমকপূর্ণ জীবন অপেক্ষা খানকাতে জ্বালানি কাঠ বহন করা শ্রেয়তর মনে করেন।
এমনি ধরনের কঠোর জীবন ও জনসেবার আদর্শ অনুসরণ করে নূর কুতুব আলম তাঁকে পিতার যোগ্য আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারীরূপে পরিগণিত হন। তিনি তাঁর মহান পিতার আধ্যাত্মিক সাধনার আদর্শকে মূল্যবান সম্পদ মনে করতেন এবং একে নানা উপায়ে সমৃদ্ধ করে তোলেন। তিনি ধর্মবিজ্ঞানে বুৎপত্তি লাভ করেন এবং সুফিবাদের জ্ঞান ও ব্যবহারিকতায় সমান পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি সুফি তরীকার ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন এবং ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক ও জনহিতকর কার্যাবলিতে এক নব উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। ফলে, তাঁর সময়ে পাওয়া এমন একটি প্রাণবন্ত ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হয় যে, এই উপমহাদেশে এর সমতুল্য খুবই বিরল ছিল। এই জ্ঞানকেন্দ্রের সুখ্যাতি ভারতের সকল স্থান থেকে শিক্ষার্থী ও শিষ্য আকৃষ্ট করে। ঐ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সুফি-পুরুষের শিষ্যত্ব লাভের আশায় মানিকপুরের হুসামউদ্দিন (১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু), লাহোরের শেখ কাকু (১৪১৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু), আজমীরের শামসুদ্দিন (১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু) এবং আরো অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি পাণ্ডুয়াতে সমবেত হন। নূর কুতুব আলমের খ্যাতিমান শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন তার পুত্রদ্বয় রিফাতউদ্দিন ও শেখ আনোয়ার এবং তদীয় দৌহিত্র শেখ জাহিদ। তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে পাওয়া কেন্দ্র থেকে ইসলামি শিক্ষা ও মরমী জ্ঞানসাধনা সারা হিন্দুস্থানে বিস্তার লাভ করে। নূর কুতুব আলমের শিষ্য ও খলিফা হিসেবে হুসামউদ্দিন মানিকপুরী মানিকপুর তাঁর শিক্ষকের জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক ব্রতের প্রচারকেন্দ্রে পরিণত করেন। ‘অহদাতুল ওজুদ' মতবাদ (মূলের ঐক্য) ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট লিখিত নূর কুতুব আলমের পত্রগুলো থেকে পাওয়ার এই প্রসিদ্ধ সুফি-পুরুষের মরমী জ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি একটি মাদ্রাসা, একটি চিকিৎসালয় ও একটি লঙ্গরখানার ব্যয় নির্বাহ করেন। জানা যায় যে, সুলতান হোসেন শাহ এই মর্যাদা ও চিকিৎসালয়ের জন্য ভূমিদান করেছিলেন।
নূর কুতুব আলমের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও মানুষের প্রতি তার নিঃস্বার্থ সেবা তাকে ঐ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নৈতিক শক্তিতে পরিণত করে। জনসাধারণের উপর তার প্রভূত প্রভাব ছিল। এসব সত্ত্বেও তিনি শাসকদের যথেষ্ট সম্মান করতেন। 'রফিক- আল-আরেফিনের' মতে হযরত নূর কুতুব আলম একদা মন্তব্য করেন “যে তার শাসককে শ্রদ্ধা করে, সে তাঁকে শ্রদ্ধা করে; আমরাও রাজা ও আমির-ওমরাহকে সম্মান করি, যাতে আমাদের সন্তান-সন্ততিরা আমাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে পারে। একজন সুফি সহ- সাধককে লিখিত একখানা পত্রে শেখ নূর কুতুব আলম রাজাদের আদেশ মান্য করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি লিখেছেন “পয়গম্বরের ঐতিহ্য ও বাণী এবং চিশতীয়া সুফি- দরবেশদের উপদেশ অনুসরণ করে তোমার উচিত লোকদের মন থেকে সন্দেহ দূর করা এবং রাজার অনুগত হতে তাদেরকে উপদেশ দেন ৷
নূর কুতুব আলম তাঁর বিরাট নৈতিক শক্তির বলে মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজকে মহা বিপদের কবল থেকে রক্ষা করেন। তিনি একজন সংসারত্যাগী দরবেশ ছিলেন এবং সাধারণত তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন। কিন্তু যখন এক মহা সংকটের দরুন মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে, তখন তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেননি, মুসলমানদেরকে রক্ষার জন্য তাকে নানারূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। নূর কুতুব আলমের একটি পত্রে জানা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে তখন অনৈক্য ছিল। তিনি লিখেছেন, এটা আপনার নিকট স্পষ্ট যে, ইসলাম এখন একটা সংকটের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত রকম দুর্যোগ ও দুর্ভাগ্য থেকে আল্লাহতায়ালা এই শহরকে রক্ষা করুন। এই সময় মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি এবং ইমামের প্রতি অবাধ্যতা থাকলে বিভ্রান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি হবে।” সরকারি ক্ষেত্রে হিন্দুদেরকে বিশ্বস্ত ও দায়িত্বপূর্ণ পদে উন্নীত করার যে নীতি ইলিয়াসশাহী সুলতানগণ গ্রহণ করেন, তারই ফলে পাণ্ডুয়ার মুসলমানদের মধ্যে এই বিভেদ ও অনৈক্য দেখা দেয়। একদল মুসলমান সুলতানদের এই নীতি পছন্দ করেননি এবং তারা রাষ্ট্রের ভালোমন্দের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। ইলিয়াস শাহী সুলতানদের এই অতিরিক্ত উদারনীতির সুযোগ নিয়ে এবং মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও উদাসীনতার দরুন পাণ্ডুয়ার রাজদরবারের একজন হিন্দু কর্মচারী রাজা কংস রাষ্ট্রীয় শাসন কার্যে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন এবং তিনি মুসলমানদের, বিশেষকরে উলেমা ও শেখদের উপর অত্যাচার করেন। ফলে মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজ এক মহা দুর্দিনের সম্মুখীন হয় ৷
আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে মুসলিম রাষ্ট্র রক্ষার জন্য নূর কুতুব আলম মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি স্থাপনের জরুরি প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সুতরাং তিনি সকল সম্ভাব্য উপায়ে মুসলমানদের ভিতরকার বিভেদ দূর করে পুনরায় তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং ইসলাম ও মুসলমান শাসকদের প্রতি তাদেরকে অনুগত করে তুলতে চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রে রাজা কংস ও তার হিন্দু সহকারীদের কর্তৃত্ব এবং
মুসলমানদের উপর তাদের অত্যাচারের দরুন হযরত নূর কুতুব আলম বাধ্য হয়ে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শাহ শাকীর সাহায্যের আবেদন করে তার নিকট পত্র লিখেন (মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর)। সিমনানী ও অত্যাচারী রাজা কংসের শাস্তি। বিধানের জন্য ও বাঙালি মুসলমানদেরকে রক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে সুলতানের নিকট পত্র লেখেন। বাংলার সীমান্তে ইব্রাহীম শাহ শার্কীর আগমনে ভীত হয়ে রাজা কংস বিপদ এড়াবার জন্য বিনীতভাবে হযরত নূর কুতুব আলমের মধ্যস্থতা প্রার্থনা করেন। তিনি তার পুত্র যদুকেও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য অর্পণ করেন। তদনুযায়ী যদু ইসলামে দীক্ষিত হন এবং জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ উপাধি ধারণপূর্বক সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। অতঃপর নূর কুতুব আলম সুলতান ইব্রাহীম শাহ শাকীকে তাঁর অভিযান পরিত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। এর ফলে, চরম সংকটের মুখ থেকে মুসলিম রাজ্য ও সমাজ এবং বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা পায়। এভাবে নূর কুতুব আলম মুসলিম বাংলার ত্রাণকর্তা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন।
কথিত আছে যে, ইব্রাহীম শাহ শার্কী ও তাঁর সেনাবাহিনী ফিরে যাবার পর, রাজা কংস রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব কেড়ে নেন, এবং তদীয় পুত্রকে ‘শুদ্ধি' অনুষ্ঠানের দ্বারা পুনরায় হিন্দুত্বে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু হিন্দুরা এর পরেও যদুকে একজন সমাজ পরিত্যক্ত ব্যক্তিরূপে গণ্য করে। রাজা কংসও পুনরায় মুসলিম পীর-দরবেশ ও উলেমার প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করেন। তিনি নূর কুতুব আলমের পুত্র ও দৌহিত্র যথাক্রমে শেখ আনোয়ার ও শেখ জাহিদকে অবরুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে সোনাওগাঁয়ে নির্বাসিত করেন। রাজা কংসের আদেশে শেখ আনোয়ার নিহত হন। একই বছরে রাজা কংসেরও মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর যদু পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এভাবে একটি প্রভাবশালী হিন্দু পরিবার ইসলামে দীক্ষিত হয়।
হযরত নূর কুতুব আলমের মৃত্যু তারিখ সম্পর্কে মতদ্বৈধতা আছে। সিরা’ত আল আসরার অনুসারে, তিনি ৮১৮ হিজরি/১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাজকিরাত আল-আফতাব-এর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে 'খাজিনাত আল-আসফিয়া'র লেখক উল্লেখ করেন যে, শেখ ৮৫১ হিজরি/১৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইহধাম ত্যাগ করেন। সুলতান প্রথম মাহমুদ শাহের সমকালীন একটি উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে, কুতুব আলম ৮৩৫ হিজরি/১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। সিরা'ত আল-আসরার থেকে জানা যায় যে, জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৫-৩২ খ্রিস্টাব্দ) এবং তদীয় পুত্র ও উত্তরাধিকারী আহমদ শাহ (১৪০২-৩৫ খ্রি.) নূর কুতুব আলমের শিষ্য ছিলেন। স্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
পাণ্ডুয়ায় পিতার সমাধির নিকট হযরত নূর কুতুব আলম সমাধিস্থ হন। শেখ আলাউল হক ও কুতুব আলমের মাজার “ছোট দরগাহ” নামে এবং শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজীর মাজার “বড় দরগাহ” নামে পরিচিত। “ছোট দরগাহ” সংলগ্ন ভূসম্পত্তিকে
'দশ-হাজারী স্টেট বলা হয়, যেহেতু এতে ছ'হাজার টাকা আয় হয়। কুতুব আলমের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এবং সমাজের প্রতি তাঁর মহান সেবার জন্য তিনি বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় সুফি দরবেশ হিসেবে পরিগণিত হন। তাঁর ‘দরগাহ’ রাজা-বাদশাহ ও সকল শ্রেণির লোকের তীর্থস্থান। এই সিদ্ধপুরুষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার জন্য প্রতি বছর হোসেন শাহ পদব্রজে ‘একডালা' থেকে পাণ্ডুয়ায় আসতেন। তিনি এই মহান সুফি-দরবেশের প্রতিষ্ঠিত লঙ্গরখানা-রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত ৪৭ খানা গ্রাম দান করেছিলেন। বাহারিস্তান-ই-গায়বীর লেখক মীর্জা নাথন তাঁর প্রতিজ্ঞা পুরণার্থে মাজারটি পরিদর্শন করেছিলেন। শাহ সুজা কুতুব আলমের বংশধর শেখ কবীরকে ভূমিদান করেন ১০৫৮ হিজরিতে (১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে)।
১৭. খান জাহান সাধারণ্যে 'খান জাহান খান' ও ‘খানজাহান আলী' নামে পরিচিত। খান জাহান ছিলেন বাংলার মুজাহিদ দরবেশগণের অন্যতম। তিনি বঙ্গদেশে মুসলিম শাসন সম্প্রসারণ ও ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। জনপ্রবাদে তাঁকে আধুনিক খুলনা জেলার দুর্গম অঞ্চলগুলো জয়ের এবং ঐ এলাকাসমূহ আবাদি গড়ে তোলার কৃতিত্ব দান করে। এই অঞ্চলসমূহ আয়ত্তাধীনে আনয়ন করার পর, তিনি লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। বাগেরহাটে তার সমাধিস্তম্ভে যে উৎকীর্ণ লিপিসমূহ পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর সঙ্গে জনপ্রবাদ বর্ণিত ঘটনাবলির সমর্থন পাওয়া যায়। এই উৎকীর্ণ লিপিতে তাঁকে মহৎ খান জাহান, ইহকাল ও পরকালের শিক্ষাদাতা, সৈয়দদের প্রেমিক, ধার্মিকদের অনুরাগী, বিদ্বান, ইসলাম ও মুসলমানদের সাহায্যকারী এবং অবিশ্বাসী ও বিধর্মীদের শত্রুরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তাঁর স্মৃতির সম্মানার্থে ৮৬৩ হিজরি (১৪৫৮-৫৯ খ্রিস্টাব্দে) তাঁর সমাধির উপর একটি সৌধ নির্মাণের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। পীর আলী নামে সুপরিচিত তাঁর একজন অনুরাগী শিষ্য মুহাম্মদ তাহির কর্তৃক সমাধি-স্তম্ভটি নির্মিত হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। পীর আলী প্রথমে একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরে খান জাহানের হাতে ইসলামে দীক্ষিত হন। খান জাহান তাঁর জীবিতকালে একজন সিদ্ধপুরুষ হিসেবে শ্রদ্ধা লাভ করেন এবং আজ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান সমভাবে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম স্মরণ করে থাকে। প্রতি বছর চৈত্র-পূর্ণিমা উপলক্ষে (এপ্রিল) এই কামেল পুরুষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিমিত্ত হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হয়। এই সময় তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]