প্রতিক্রিয়া : চৈতন্য ও ভক্তি আন্দোলন Reaction of the Hindu Society to Islamization: Chaaitanya and Bhakti Movement


Chaaitanya ১০.২ ভক্তি আন্দোলন
Bhakti Movement
চৈতন্য
Chaaitanya
সুলতানি আমলের উদারনৈতিক শাসনের সুযোগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মেও কঠোরতার মধ্যে শ্রীচৈতন্য বাংলায় তাঁর বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। ইতোপূর্বেই বৈষ্ণব দার্শনিক রামানুজ ও বৈষ্ণব ধর্মের সংস্কারক রামানন্দের হাত ধরে সারা ভারতে বৈষ্ণব ।
ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি বাংলায়ও প্রাচীনকাল থেকেই এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। হিন্দু |
দেবতা বিষ্ণুর নামানুসারে বৈষ্ণব কথাটির উৎপত্তি। বিষ্ণুর আরেক রূপ শ্রীকৃষ্ণ শ্রীকৃষ্ণের ভক্তরা বৈষ্ণব নামে খ্যাত। বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পর্বতের গুহায় উঠ চন্দ্রবর্মার একটি শিলালিপি থেকে প্রাচীনবাংলায় বিষ্ণু পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়
পাহাড়পুর মন্দিরে কৃষ্ণের বাল্যলীলার দৃশ্যাবলি খোদিত আছে। একে রাধাকৃষ্ণে |
যুগল মূর্তি মনে হয়। আরো মনে হয় সেনযুগের শেষের দিকে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রাধান্য বিস্তার করে। রাজা লক্ষ্মণসেন তাঁর পিতামহ বিজয়সেন এবং পিত বল্লালসেনের শৈবধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি পরম বৈষ্ণব উপাধি গ্রহণ করেন। বিখ্যাত সংস্কৃত কবি জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণসেনের সভাকবি। জয়দেবের মধুর বৈষ্ণব পদাবলি এখনো ভারতের ঘরে ঘরে অম্লান রয়েছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ ও বাঙালি কবি চণ্ডীদাস ও মিথিলার বিদ্যাপতি ঠাকুরের পদাবলি রাধাকৃষ্ণের মরমীবাদ জনপ্রিয় করে তুলেছিল বলে মনে হয়। বাঙালি বৈষ্ণববাদ ধারণাকে একটি নিয়মতান্ত্রিক রূপ প্রদান করে। মধ্যযুগে বাংলায় ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি বৈষ্ণব ধর্মেরও অস্তিত্ব ছিল। চণ্ডীদাসের (বড়ুচণ্ডীদাস) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন এবং মালাধর বসুর (গুণরাজ খান) ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' কাব্যদ্বয় থেকে বাংলায় বৈষ্ণ ধর্মের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে । দ্বাদশ শতকে শঙ্করাচার্যের অনুসারী একজন যোগী শ্রীধর স্বামী বাংলায় অদ্বৈতবাদ বা ‘একসেবা দ্বিতীয়ম' প্রচার করেন। শ্রীচৈতন্যদেব হুসেনশাহী শাসকদের ধর্মীয় উদারতার সুযোগে নতুন করে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মকে জনপ্রিয় কর তোলেন। তাঁর কারণে সারা ভারতেই বৈষ্ণব মতবাদ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং বৈষ্ণব ধর্ম শ্রীচৈতন্যের নামেই পরিচিতি লাভ করে।
বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ হলো হিন্দু ধর্ম ও সমাজকে রক্ষা করা। ইসলাম ধর্মের সাম্যের কারণে নির্যাতিত হিন্দুরা স্বধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। শ্রীচৈতন্যসহ চিন্তাশীল হিন্দুগণ ইসলামের আদর্শে হিন্দুধর্মের সংস্কার ও সকলের নিকট একে গ্রহণীয় করে তুলবার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। সামাজিক নির্যাতন ও শোষণ বন্ধকল্পে হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা দূর করে ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শে সামাজিক জীবন পুনর্গঠন করে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করা যেতে পারে। সাম্যের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত এরূপ হিন্দু সমাজ সমভাবে মুসলমান সমাজের মোকাবিলা করতে পারবে এবং এর ফলে হিন্দুদের স্বধর্ম ত্যাগ করে
নক ধর্ম
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পথ রুদ্ধ হবে। অর্থাৎ ধর্মান্তর রোধ করা বৈষ্ণব ধর্মের প্রान লক্ষ্য ছিল। ভক্তি আন্দোলনের উদ্দেশ্যও একই ছিল। এভাবে চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম। ছিল প্রধানত একটি প্রতিরক্ষামূলক আন্দোলন। তাই কিছু পার্থক্য সত্ত্বেও চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মকে ভক্তিবাদেরই অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১. শ্রীচৈতন্যের উপর ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সুফিদের প্রভাব : শ্রীচৈতন্যের উপর মুসলিম সুফিবাদের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ে তা বলাই বাহুল্য। চৈতন্যের জন্ম নবদ্বীপে। বাংলা জয়ের পর নবদ্বীপ বা নদীয়া মুসলিম উপনিবেশে পরিণত হয়। এখানে বহু মুসলমানদের বসতি গড়ে উঠে। অনেক হিন্দু ব্রাহ্মণ মুসলমানদের সংস্পর্শে আসে। যেমন জগাই ও মাধাইয়ের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। তাদের উপর মুসলমান সমাজ ও আদর্শের প্রভাব পড়ে। শ্রীচৈতন্যের জন্ম এবং বেড়ে উঠা এমনট মুসলিম প্রভাবিত সমাজে ।
হিন্দু সমাজের অধঃপতন ও মুসলমান আদর্শের নিকট এর পরাজয়ের কারণে তার মনে বিরূপভাবের জন্ম হয়। ইসলামের অগ্রগতির মুখে হিন্দু সমাজকে রক্ষার জন্য তিনি সমাজজীবন থেকে সবরকম অনাচরের মূলোৎপাটন ও একে উদারমতের ভিত্তিতে পুনর্গঠন করার প্রয়াস চালান। তিনি এ সমস্যার সমাধানের জন্য হিন্দু যোগীদের আস্তানার পাশাপাশি মুসলমান পীর দরবেশদের খানকায় যেতেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত থেকে জানা যায় যে, বৃন্দাবন থেকে ফেরার পথে জনৈক পীরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং ধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়। এতে প্রমাণ হয় তাঁর উপর একদিকে ইসলামের ধর্মীয় আদর্শ, অন্যদিকে পীর দরবেশদের প্রভাব পড়ে। চৈতন্যের প্রধান শিষ্য হরিদাস ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিলেও সে একটি মুসলিম পরিবারে পালিত পালিত হন। তাঁর সাহচর্যও চৈতন্যকে সুফিবাদ ও ইসলামি ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানলাভে সহায়তা করে।
ইসলাম ধর্মে যেমন স্রষ্টা এক অদ্বিতীয়, তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান, চরম সত্য, পরম সত্তা এবং সবকিছুর মালিক। মুসলমান সুফিরা স্রষ্টা আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আল্লাহর প্রেম ও ভক্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে।
ইসলামের আদর্শ অনুসরণ করে চৈতন্য এক ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করেন। তার
শিক্ষানুসারে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান এবং সর্বোত্তম সত্য।
সুফিদের খোদা প্রেমের (ঈশক) ধারণার সঙ্গে চৈতন্যের ‘রাধা' মতবাদের সাদৃশ্য
বিদ্যমান। তিনি রাধাকে কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্মতার “শক্তি' (প্রেম) হিসেবে ভাবেন-যার মাধ্যমে কৃষ্ণকে পাওয়া যেতে পারে। চৈতন্যের আবেগদীপ্ত প্রেম ছিল তাঁর বৈষ্ণব
ধর্মের একটি নতুন বৈশিষ্ট্য। এতে বাংলার বৈষ্ণব ধর্মের গুরুত্বের উপর ইসলামি আধ্যাত্মিকবাদের প্রভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এখানে সুফিদের প্রেম কিন্তু আত্মার অনুভূতির মাধ্যমে প্রেমময় আল্লাহর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ ।
২২২ ইসলামিকরণে হিন্দু সমাজের প্রতিক্রিয়া : চৈতন্য ও ভক্তি আন্দোলন চৈতন্য ধর্ম সভায় ‘সংকীর্তন বা নামকীর্তনের রীতি (ঈশ্বরের নামকীর্তন) করেন- এটি সম্ভবত মুসলমান সুফিদের ‘জিকরের' অনুসরণে। হিন্দু ধর্ম প্রবন আধ্যাত্মবাদের এটা একটি নতুন রীতি। এ রীতিতে চিশতিয়া ও সাহরাওয়ার্দী সুফিদের 'সামার' (স্বর্গীয় প্রেম নির্দেশক আধ্যাত্মিক গান যার মাধ্যমে আধ্যাত্মক প্রেমিক স্রষ্টার সঙ্গে সংযোগ উপলব্ধি করেন) প্রভাবের সুস্পষ্ট প্রমাণ! সামার ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করেন এবং মোহাবিষ্ট অবস্থায় নাচেন। শ্রীচৈতন্য ও অনুসারীরা বাদ্যযন্ত্র সহকারে কৃষ্ণের নামকীর্তন ও আবেগের সাথে নৃত্য করে সুফিদের মতো তারা একই দৈহিক ও মানসিক অবস্থা-'দশা' ও 'হাল' আধ্যাত্মিক মোহাবিশিষ্টতা প্রাপ্ত হন। তিনি হিন্দু সমাজের ঘূর্ণিত জাতিভেদ বিরোধিতা করেন। সকল বর্ণের মানুষকে তিনি সমান মার্যাদা দেন এবং বৈষ্ণব ধ
দীক্ষিত করেন। এর মধ্যে অবশ্যই ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ রয়েছে। সুফিদের গভীর
পরিশেষে বলা যায় মধ্যযুগে হিন্দুধর্ম ও সমাজকে রক্ষার জন্য চে বৈষ্ণববাদ বা ভক্তি আন্দোলনের উপর অবশ্যই ইসলাম ধর্ম ও প্রভাব পড়েছিল ।
শ্রীচৈতন্য ১৪৮০
২. চৈতন্যের পরিচয় ও তাঁর বৈষ্ণব ধর্মীয় মতবাদ : খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি নবদ্বীপের (নদীয়ার) মায়াপুরী গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবার জন্মগ্রহণ করেন । তিনি প্রথমে সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণ করেন। শ্রীচৈতন্য নিমাই, গৌরত আদীনাথ, বিশ্বম্বর প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বয়স যখন ২২ বছর তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। তাঁর বাবার শ্রাদ্ধ উপলক্ষে তিনি যখন গয়া কাঁশিতে গ করেন, তখন তার জীবনের মোড় পরিবর্তন হয় । সেখানে তিনি ঈশ্বরপুরী নাম একজন সাধুর নিকট কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন । এরপর তিনি গৃহত্যাগ করে বিচ্ছি তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করেন, বিভিন্ন হিন্দু সাধু ও মুসলিম সুফির সংস্পর্শে আসেন মাধবেন্দ্রপুরী ও ঈশ্বরপুরী চৈতন্যের প্রথম দিককার ধর্মীয় চিন্তাকে প্রভাবিত করে। ঈশ্বরপুরী বাঙালি ছিলেন। অবশেষে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি শ্রীচৈতন্য নামে অভিহিত হন। এ সময় থেকে তিনি তাঁর মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। তবে কতিপয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণববাদকে ভক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে পুরীতে এ বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর মৃত্যু হয়। সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দীন হুসেন শাহের রাজত্বকালে রাষ্ট্রীয় অনুকূল পরিবেশে শ্রীচৈতন্য দেব তাঁর মূল উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। হিন্দু ধর্মের সংস্কার এবং একে রক্ষা করা ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। তিনি যোগ্যতার সাথে সে সময় একাজ করে সম্ভাব্য সংকট। থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করেন।
শ্রীচৈতন্যের ধর্মীয় দর্শন : শ্রীধর স্বামীর ভক্তিবাদ ও তার সংসারত্যাগী আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব মতবাদ ছিল এই মহান সাধকের নিজেরই সৃষ্টি ।
শ্রীচৈতন্য বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করেন। এজন্য তাঁকে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের প্রবক্তা বলা হয়। ভারতের অন্যান্য বৈষ্ণব সম্প্রদায় তাঁকে। গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের নিকটও শ্রীমদভাগবত শিক্ষার উৎস ছিল। বাঙালি বৈষ্ণব ধর্ম উত্তর ভারতের মাধবের বৈষ্ণব মতবাদ থেকে ভিন্ন। মাধবী সম্প্রদায় অধিকতর অনুধ্যান পরায়ণ এবং এতে রাধা কিংবা শ্রীকৃষ্ণের বৃদ্ধাবনলীলার তেমন গুরুত্ব নেই। অন্যদিকে, বাংলার চৈতন্যবাদ আবেগদীপ্ত এবং তাদের সাধনায় রাধা ও বৃন্দাবনলীলা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।
৪. এক ঈশ্বরবাদ : শ্রীচৈতন্য এক ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করেন। বহু ঈশ্বরে তাঁর আস্থা ছিল না। তাঁর শিক্ষানুসারে, শ্রীকৃষ্ণ ভগবান এবং সর্বোত্তম সত্য। জগৎ তাঁর মধ্যে এবং তিনি জগতের মধ্যে (সৃষ্টির মধ্যে) বিরাজমান। যদিও তিনি সকল সৃষ্ট বস্তু মধ্যে বিরাজিত তবুও তিনি এক। তিনি ঈশ্বরকে কৃষ্ণ বা হরি নামে ডাকেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন যে, কৃষ্ণের ইচ্ছায় জগতের সৃষ্টি হয়েছে, তিনি এক এবং তাঁর কোনো দুই দেহ নেই ।
৫. কৃষ্ণপ্রেম ও গুরু ভক্তি : চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম কৃষ্ণের প্রতি ভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কৃষ্ণ সাধনা চিরন্তন সুখ লাভের প্রকৃষ্ট উপায় বলে মনে করা হয়। এতে গুরু বা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষানবিসকে শিষ্য হিসেবে কোনো গুরুর সাহচর্যে থাকতে হয়। গুরু তার নিষ্ঠার গুণাবলির দ্বারা সন্তুষ্ট হলে তিনি তাকে সর্বোত্তম ঈশ্বর ও একমাত্র ত্রাণকর্তা বিষ্ণু তথা কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণের অধিকার দান করেন। এমনকি চণ্ডালসহ মিশ্র ও নিম্নবর্ণের লোকদেরকেও চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মে শিষ্যত্ব গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। শ্রীচৈতন্যের শিক্ষা, যদি কেউ কৃষ্ণের আরাধনা ও গুরুর সেবা করে তাহলে তার মহামুক্তি ঘটে এবং সে কৃষ্ণপদ লাভ করে। তিনি প্রেমকে মুক্তির একমাত্র উপায় বলে বর্ণনা করেন। প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমেই ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ সম্ভব। কৃষ্ণ হলো আরাধনার
মুখ্য বিষয়। তবে তিনি শ্রীরামসহ অন্য দেবতাদের শ্রদ্ধা করতেন। কৃষ্ণপ্রেম তথা কৃষ্ণভক্তি বলতে শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিলীন হওয়া বুঝায়। ভক্ত যদি নারীও হন তবু তাকে বিলীন হতে হবে। যেমন স্ত্রী স্বামীর সাথে বিলীন হন। কৃষ্ণপদে সম্পূর্ণ
আত্মসমর্পণ মোক্ষ বা মুক্তি লাভের একমাত্র উপায়। চৈতন্যের মতে মানুষের দেহের বিলুপ্তি ঘটে, কিন্তু আত্মা বিনষ্ট হয় না।
২২৪ ইসলামিকরণে হিন্দু সমাজের প্রতিক্রিয়া : চৈতন্য ও ভক্তি আন্দোলন
৬. কীর্তন : বৈষ্ণববাদের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কীর্তন। কৃষ্ণপ্রেমের জন্য শ্রীচৈতন্য দলবদ্ধভাবে বাদ্যযন্ত্রসহকারে নাচ ও গানের মাধ্যমে যে সংকীর্তন বা নামকীর্তন প্রথার প্রচলন করেন তাকে কীর্তন বলে। এর অর্থ নেচে গেয়ে ঈশ্বর তথ্য কৃষ্ণের সাথে একীভূত হওয়া। বৈষ্ণবরা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কৃষ্ণের নামে কীর্তন করেন এবং
আবেগের বশে নৃত্য করেন ।
৭. বর্ণপ্রথার বিরোধিতা : শ্রীচৈতন্যদেব হিন্দুদের প্রচলিত সামাজিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের শ্রেণি ও কৌলিন্য প্রথার বিরোধিতা করেন। চৈতন্য বর্ণপ্রথা রহিত করেন এবং ব্রাহ্মণ ও হিন্দু সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মধ্যকার সকল রকম বৈষম্য দূর করেন। তিনি সকল বর্ণ ও ধর্মের মানুষকে তাঁর বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং তাদের সমান মর্যাদা দেন। ‘দাস' অর্থাৎ সেবক একই উপাধি লাভ করেন। বস্তুত বৈষ্ণব ধর্মের এই সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। চৈতন্য শিক্ষা দেন, “চণ্ডাল (নিম্নশ্রেণির হিন্দু) চণ্ডাল নয়, যদি সে কৃষ্ণ নাম জপ করে; ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ নয়, যদি সে অধর্মের পথ অনুসরণ করে।”
৮. শ্রীচৈতন্যের অনুসারীদের জন্য কতিপয় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক কাজের নির্দেশ- ক. কৃষ্ণ ভক্তকে যোগাসনে বসে কৃষ্ণের আরাধনা করতে হবে। খ. ভক্তকে নিয়মিত কৃষ্ণের মন্দিরে যেতে হবে।
গ. মন্দিরে ভোগ দিতে হবে এবং প্রসাদ খেতে হবে।
ঘ. ফুল ও তুলসী পাতার ঘ্রাণ গ্রহণ করতে এবং তুলসী পাতা কানে রাখতে
হবে।
ঙ. কীর্তনের অনুষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থিত হতে হবে ।
চ. সাধ্যমত মন্দিরে দান করতে হবে। যে কোনো ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা
করতে পারবে।
৯. বৈষ্ণব ধর্মের বিস্তার : বৈষ্ণব গুরু চৈতন্যদেব সন্ন্যাস তন্ত্রে দীক্ষালাভের পর অদ্বৈত, নিত্যানন্দ, জয়ানন্দ, বৃন্দাবন দাসসহ অনেকে শিষ্যত্ব লাভ করেন। এ সকল শিষ্যদের সহায়তায় তাঁর ধর্মমত প্রচার শুরু করেন। এতে অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং শংকরাচার্যের অনুসারী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মুসলমানদের মধ্যেও তাঁর শিষ্য ছিল। এম.আর তরফদারের মতে, অনেক মুসলমান শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব মতবাদ গ্রহণ করেছিল। এরূপে চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম বাংলাসহ সারা ভারতে বিস্তার লাভ করে। বৃন্দাবন পর্যায়ে চৈতন্যের শিষ্য লোচন দাস, বৃন্দাবন দাস, জয়ানন্দ প্রমুখ তাঁর মতাদর্শকে ছড়িয়ে দিয়েছিল।
তবে মনে রাখতে হবে যে, শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণব ধর্মের স্রষ্টা নন, তিনি এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা এবং পরবর্তীতে তাঁর নামেই বৈষ্ণব ধর্মের পরিচিতি লাভ করে। তবে তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের প্রবর্তক।
১০. শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণববাদের প্রভাব : শ্রীচৈতন্যের ধর্মসংস্কার হিন্দু সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নৈতিক সংস্কার সাধনের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। চৈতন্যের বৈষ্ণববাদ সংকীর্তন শোভাযাত্রার মাধ্যমে নিম্ন বর্ণের ঘরে ঘরে ধর্মের বাণী পৌঁছে দিয়ে সামাজিক ভাবে তাদের উন্নয়ন ঘটান। চৈতন্যের এ মতাদর্শ ধর্ম, বর্ণ সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকায় পূর্বের বঞ্চিত ও অবহেলিত জনগণ জ্ঞান ও ধর্ম-সাধনার জগতে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। ফলে পরবর্তীতে তাদের ঘরে জন্ম নেয় বহু বৈষ্ণব সাধক, কবি, পণ্ডিত ও চিন্তাশীল ব্যক্তি। শ্রীচৈতন্যের শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে জীবে দয়া বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। এখনো বৈষ্ণবরা গুরু ভক্তি, তুলসী পাতার ব্যবহার, প্রসাদ বিতরণ প্রভৃতি কর্ম নিষ্ঠার সাথে করে থাকে।
ইতিহাস
চৈতন্যবাদ মধ্যযুগের বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ
অবদান রাখে।
১১. সমালোচনা : চৈতন্যের বৈষ্ণব দর্শন বাংলার সমাজ জীবনকে নাড়া দিলেও এর বিরুদ্ধে সমালোচনাও আছে। চৈতন্য রাধা-কৃষ্ণের কীর্তনে যে প্রেম-লীলার কথা বলেছেন তাকে অনেকে লজ্জাকর ব্যাপার বলে সমালোচনা করেছেন। সন্ন্যাস ও সন্ন্যাসীদের একত্রে বসবাসকে অনেকে যৌনতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, চৈতন্যের মতাদর্শ উড়িষ্যাকে করেছে মেয়েলি ভাবাপন্ন আর বাংলাকে করেছে বিবেক বর্জিত। আবার কেউ কেউ শ্রীচৈতন্যের প্রেম ও ভক্তির ধর্মকে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্টের জন্য দায়ী করেছেন।
কারণ তাঁর ধর্মাদর্শের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের অগ্রগতি রোধ করা ৷
যাহোক পরিশেষে আমরা বলতে পারি শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন একজন মহান সংস্কারক, যিনি বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর বৈষ্ণব ধর্ম হিন্দু সমাজে একটি উন্নত ধরনের নৈতিক জীবনের আদর্শ তুলে ধরে। তিনি মানুষে মানুষে প্রেমের আহ্বান জানান, জাতিভেদ প্রথা রহিত করেন, সমাজের রীতি-প্রথা অনেকটাই শিথিল করেন এবং এভাবে সম্ভাব্য সংকট থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করেন। ষোলো শতকের ইতিহাসে শ্রীচৈতন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয়-সামাজিক জীবনে গভীরভাবে ভাব বিস্তার করেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]