বাংলায় শিক্ষা: সুলতানি ও মুঘল আমল Education in Bengal : Sultanate and Mughal Period

বাংলায় মুসলিম শিক্ষার প্রসার
Expansion of Muslim education in Bengal
মুসলিম পণ্ডিতগণ ও তাদের রচিত গ্রন্থাবলি
Muslim scholars and their written Books বাংলায় মুসলিম শিক্ষার স্তর
Stratification of Muslim education in Bengal
মুসলিম নারী শিক্ষা
Muslim woman education
বাংলার মুসলিম শিক্ষা কেন্দ্ৰসমূহ
বাংলায় হিন্দু শিক্ষার প্রসার
Muslim education centers in Bengal
Expansion of Hindu education in Bengal
বাংলায় হিন্দু শিক্ষার স্তর
Stratification of Hindu education in Bengal
লেখার দ্রব্যাদি
Materials of writing
শিক্ষকদের অবস্থা
Condition of teachers
১১.১০ বাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান
Contribution of Muslims in the education of Bengal
সুলতানি ও মুঘল আমলে বাংলার অতি পি
এ আমলের শিক্ষাকে বাংলার ইতিহাসে শিক্ষাও বলা হয়। এসময় বাংলার ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ব্যাপক
মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষা ও তাদের
রচিত গ্রন্থাবলি মুসলিম সমাজে জ্ঞানার্জনের শুরা ভারত করে। বাংলার বিভিন্ন অসংখ্য মুসলিম শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠ নারী শিক্ষারও প্রসার ঘটে। সমাজে শিক্ষকদের
আমলে বাংলায় যে মুসলিম শিক্ষার গোছা
থাকে। সেজন্য সুলতানি ও মুঘল আমঙ্গোর শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক কোন পার্থক্য তেঁ বললেই চলে। নিম্নে সুলতানি তুলে ধরা হলো :
বাংলায় মুসলিম শিক্ষার প্রসার
Expansion of Muslim Education in Bengal
সুলতানি ও মুঘল আমলে বাংলার শিক্ষার প্রসার ঘটে। ইসলাম সত্যিকারভাবে মানব জীবনে অগ্রগতির ধর্ম। ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে ইসলাম নতুন চিন্ত মূল্যবোধের জন্ম দিয়েছে। ইসলাম সমানভাবে মানব ইতিহাসে একটি বিরটি বুদ্ধিবৃতি ও সাংস্কৃতিক শক্তিরও সৃষ্টি করেছে। ইসলাম শিক্ষা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে যেরূপ জোর তাগিদ দিয়েছে, বোধ হয় আর কোনো ধর্মে সেরূপ দেয়া হয়নি। মানুষের দেহ ও মন উভয়ের উন্নতি, আধ্যাত্মিক ও পার্থিব অতি এবং বিকাশের উপরও
ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে।
কুরআন ও রাসূলুল্লাহর শিক্ষা মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞানস্পৃহার সঞ্চার করেছে রসূল জ্ঞান অর্জনের জন্য তাঁর অনুগামীদেরকে উপদেশ দিয়েছেন এবং এমনকি, বিদ্যা শিক্ষা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন। পবিত্র কুরআনে শিক্ষাকে বারবার করে প্রশংসা করা হয়েছে; উদাহরণস্বরূপ কুরআন থেকে নিম্নের অংশগুলো উদ্ধৃত করা হলো :
আল্লাহ মোমেনদেরকে একটি নেয়ামত দান করেছেন তাদের মধ্য থেকে একজনকে দূত হিসেবে প্রেরণ করে, যিনি (দূত) আল্লাহর বাণী তাদের নিকট পাঠ করেন এবং তাদেরকে জ্ঞান দান করেন ও অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। যাদের জ্ঞান আছে তারা কি, যাদের জ্ঞান নেই তাদের সমাन?
রসূলের বাণীতে দেখা যায়, শিক্ষালাভ করাকে তিনি প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্যরূপে, এমনকি, আল্লাহর প্রতি গভীর অনুরাগ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। “প্রত্যেক মুসলমান- নারী পুরুষ সকলের জন্য জ্ঞান আহরণ একটি নৈতিক দায়িত্ব। “জ্ঞান অন্বেষণ কর, যদি সেজন্য এমনকি, চীনেও যেতে হয়।" "মাতৃক্রোড় থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ কর।” মুসলমানগণ তাদের মহান নবীর শিক্ষা অনুসরণ করে চলেছে। মুসলমানদের গৌরবদীপ্ত বৃদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুগে শিক্ষা-সংস্কৃতির অভূতপূর্ব উন্নতি-এই সত্যের উজ্জ্বল প্রমাণ।
মুসলমানরা খেলাফত যুগের খ্যাতনামা পূর্বসূরিদের নিকট থেকে একটি
মূল্যবান শিক্ষাপদ্ধতি
ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে। যেখানেই
তারা গিয়েছে, সেখানেই তারা শিক্ষা ও জ্ঞানের ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গে, এ উপমহাদেশে তারা তাদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারাও নিয়ে আসে। এন. এন. ল, মন্তব্য করেন, "ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ভারত আক্রমণ কেবল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রেও এটা যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে।” প্রকৃতপক্ষে, মুসলমানগণ এ উপমহাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বজনীনতা ও উদারতার আদর্শ তুলে ধরে। এমনকি, ভারতে মুসলমান সুফি-দরবেশগণও যারা কেবল মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি বিধানে ব্যাপৃত ছিলেন, তারাও তাদের শিষ্যদের শিক্ষার প্রতি জোর দিয়েছেন এবং যথার্থভাবে শিক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে তাঁর শিষ্যত্বে বরণ করেননি। শেখ আখী সিরাজ উসমানকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করার সময়ে শেখ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার মন্তব্য এর সাক্ষ্য বহন করে। শিক্ষা ও জ্ঞানের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা মুসলমানদের পার্থিব ও পারমার্থিক প্রয়োজনের জন্য সকল যুগে সকল দেশে স্বীকৃত হয়েছিল, এতে তাই প্রমাণ হয় ৷
বাংলার মুসলমানগণ তাদের প্রথম যুগের মুসলমানদের শিক্ষার আদর্শ অনুসরণ করে। যদিও শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের সাফল্য তাদের পূর্বসূরিদের মতো অতটা উল্লেখযোগ্য ছিল না, তথাপি তারা যে, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মূল্যবান মনে করতো এবং তাদের জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিল- তার প্রমাণ আছে। মুসলমান শাসনকর্তাগণ, আমির ওমরাহ, রাজকর্মচারী ও অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন এবং সর্ব উপায়ে শিক্ষার উন্নতি ও বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। উলেমা ও সুফি-দরবেশগণ বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার উন্নতি বিধান করেন। ফলে, শহরে এবং প্রধান প্রধান স্থানসমূহে বহুসংখ্যক মাদ্রাসা, শিক্ষাকেন্দ্র ও বিদ্যালয় গড়ে উঠে। মুসলমানদেরকে তাদের মানসিক ও নৈতিক উন্নতিতে শিক্ষার গুরুত্ব অবহিত করার জন্য রসূলের বাণী খোদিত করে দেয়া হয়েছিল। ৬৯৮ হিজরির (১২৯৮ খ্রিঃ) তারিখযুক্ত সুলতান রুকনউদ্দিন কাইকাউসের সময়ে ত্রিবেণীর মাদ্রাসার একটি উৎকীর্ণ লিপি একটি হাদিসের উল্লেখ করে। হাদিসটি হলো : “তোমরা জ্ঞানর্জন কর, কেননা, জ্ঞানর্জনই প্রকৃত আত্মনিবেদন, এর অনুসন্ধানই ভক্তি এবং এর চর্চাতেই প্রকৃত গৌরব।” শিক্ষাকে “ধর্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে,” কেননা, “যে সকল অনিষ্ট বর্মীধারীর সহায়তায়ও এড়ানো যায় না, শিক্ষারূপ বর্মদ্বারা তা পরিহার করা যায় ।
শেখ ও উলেমার ধর্মপ্রচার এবং মাদ্রাসা ও মসজিদের গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপিসমূহ সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এই উপলব্ধির সঞ্চার করে যে, শিক্ষা একটি ধর্মীয় কর্তব্য এবং নৈতিক ও পার্থিব প্রয়োজনের নিমিত্ত একান্ত দরকার। অতএব দেখা যায় যে, এমনকি বাংলার সাধারণ মুসলমানরাও তাদের সন্তান-
সন্ততিদের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন স্বীকার করে। বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় যে, যুগের সমাজে শিক্ষা ও শিক্ষিতদেরকে উচ্চ সম্মান দেয়া হতো। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজের অলংকাররূপে পরিগণিত হতেন। শিক্ষা ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে পূর্ণাঙ্গ মান করা হতো না। এই সত্য ষোড়শ শতকের একজন মুসলমান কবির রচনায় বিধৃত হয়েছে। কবি তার 'লায়লী মজনু' নামক বাংলা কাব্যে লিখেছেন যে, পিতা নিজেকে একজন সম্মানিত ব্যক্তি মনে করতেন যদি তার পুত্র জ্ঞানের সকল শাখার ব্যুৎপরি অর্জন করতো। শিক্ষাকে মানব জীবনের অলংকার, তার গলার হার ও মাধার পাগড়ীস্বরূপ গণ্য করা হতো। বিদ্যাহীন একজন সুপুরুষকেও অযোগ্য ব্যক্তি মনে কর হতো।” শিক্ষার প্রতি এরূপ স্পৃহা এ প্রদেশে মুসলমান শাসনামলে বাঙালি সমাজকে পরিচালিত করেছে। যে যুগের সমাজজীবনে শিক্ষার এত উচ্চমর্যাদা ছিল সেই যুগের প্রত্যেক পিতামাতা স্বাভাবিক ভাবেই তার ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষিত কর তুলতে আগ্রহী ছিল।
সপ্তদশ শতকের মুসলমান পণ্ডিত-কবি আলাওলও বাংলার মুসলিম সম শিক্ষার প্রতি লোকের গভীর অনুরাগের কথা উল্লেখ করেছেন। কবি তাঁর 'তোহফাহ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “শিক্ষক যখন শিশুকে “বিসমিল্লাহ' শিক্ষা দেন, তখন শিক্ষক, পিতামাতা ও শিশুর নিকট বেহেস্তের দুয়ার খুলে যায়।” কবি আরো বলেন, “হাজার ভক্তের চেয়ে একজন বিদ্বান ব্যক্তি শ্রেয়।” শয়তান বিদ্বান ব্যক্তির ভরে এত বেশি ভীত যে, সে তার সম্মুখে আসতে সাহস পায় না; অথচ বহু অশিক্ষিত লোককে শয়তান বিভ্রান্ত করে ও কুপথে নিয়ে যায়। রসূলের হাদিসে বলা হয়েছে যে, “যিনি সাতদিন কোনো বিদ্বান ব্যক্তির সেবা করেন, তিনি স্রষ্টার নিকট এবং হাজার শহিদের পুণ্য অর্জন করেন। একজন তাপস কেবল স্বীয় মুক্তি সাধন করেন; কিন্তু একজন বিদ্বান ব্যক্তির সান্নিধ্যে শত শত লোক তাদের মুক্তি খুঁজে পায়। অতএব, তোমাদের উচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে বিদ্বানের সেবা করা। এর দ্বারা তোমরা নরক থেকে রক্ষা পাবে এবং বেহেস্তে দাখিল হবে।”
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাঙালি মুসলমানগণ শিক্ষাকে খুব গুরুত্ব দিত, কেন না একে তারা ধর্মীয় কর্তব্যের একটি অংশ একে একটি অনুধ্যান এবং স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার ও মুক্তি লাভের পন্থা হিসেবে গণ্য করতো। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার প্রতি তারা বিরাট সামাজিক সম্মান দান করতো। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজে পরিবারের সম্মান বৃদ্ধি করতেন। মুসলিম সমাজ কর্তৃক জ্ঞানর্জনকে এরূপ বিশেষ গুরুত্ব দান করার আরো কারণ ছিল। এ জগতে উন্নতির সোপান হলো শিক্ষা। বাংলায় মুসলমানদের শাসনামলে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা ছিল। সে যুগে প্রত্যেক মুসলমান যুবকেরই চাকরি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল এবং তা কেবল শিক্ষাগত যোগ্যতার দ্বারাই সম্ভব হতো।
শি
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
এ প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ঐ যুগের মুসলমানরা ছিল তুলনামূলকভাবে অধিক ধনী ও সমৃদ্ধশালী। ফলে, তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধাও সেই পরিমাণে বেশি ছিল। এসব কারণে, বাংলার মুসলমানদের মধ্যে, শিক্ষার উন্নতি ত্বরান্বিত হয় । মুসলিম পণ্ডিতগণ ও তাদের রচিত গ্রন্থাবলি প্রভূত
Muslim Scholars and their Written Books
ঐ যুগে
বাঙালি মুসলমান সমাজে জ্ঞানার্জন স্পৃহা বিদ্যমান ছিল। শাসনকর্তা ও অবস্থাপন্ন ব্যক্তিগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পরিমাণে সাহায্য করেন। তারা বিদ্বান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আলেমগণও তাঁদের নিজেদের গৃহে মাদ্রাসা ও শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করতেন। সুফি-পণ্ডিতদের খানকাহগুলোকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠে। এর ফলে, মুসলিম বঙ্গে শিক্ষা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। সে যুগে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় একদল বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা, পণ্ডিত ও খ্যাতনামা সুফি- দরবেশের আবির্ভাব হয়। ধর্মীয় জ্ঞান, মরমীবাদ এবং আরবি ও ফারসি শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলিম আমল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায় যে, নানা বিষয়ের উপর লিখিত বহু সংখ্যক গ্রন্থ বাংলাদেশের বিখ্যাত মুসলমান পণ্ডিতগণ সংকলন করেছিলেন। এপর্যন্ত তাদের লিখিত সেই সব গ্রন্থাবলির সামান্য কিছু আমার হস্তগত হয়েছে। এগুলো থেকে শিক্ষার অগ্রগতিতে বাঙালি পণ্ডিতদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পরিচয় পাওয়া যায়।
কাজী রুকনউদ্দিন সমরকন্দী বঙ্গে মুসলমান শাসনের প্রথম যুগের খ্যাতনামা বিশিষ্ট পণ্ডিতদের অন্যতম ছিলেন। তিনি ছিলেন আলী মর্দন খলজির (১২১০-১৩ খ্রিঃ) রাজত্বকালে লক্ষ্মণাবতীর কাজী। ‘অমৃতকাণ্ড' নামক অতীন্দ্রিয় বিষয়ক সংস্কৃত গ্রন্থের আরবি অনুবাদ থেকে জানা যায় যে, ভোজের ব্রাহ্মণ নামে জনৈক ব্রাহ্মণ যোগী কামরূপ থেকে লক্ষ্মণাবতীতে আগমন করেন এবং তার সঙ্গে ধর্মীয় ও দার্শনিক আলোচনায় লিপ্ত হন। ইসলামের উচ্চতর আদর্শ অনুধাবন করে এই হিন্দুযোগী ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা করেন। তিনি ইসলামি শাস্ত্রে এতদূর পারদর্শী হন যে, মুসলমান ধর্মনেতাগণ তাকে মুফতীর মর্যাদা দেন এবং ধর্ম বিষয়ে ফতোয়া দেবার অধিকার প্রদান করেন। তিনি হিন্দু অতীন্দ্রিয়বাদের উপর লিখিত একখানি সংস্কৃত পুস্তক ‘অমৃতকাণ্ড’ কাজী রুকনউদ্দিন সমরকন্দীকে উপহার দেন। এই যোগীর সহযোগিতায় কাজী রুকন এ গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে আরবি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি নিজেও যোগশাস্ত্র অধ্যয়ন ও অভ্যাস করেন। পরবর্তীকালে অল্লাহ নাথ নামে অন্য একজন ব্রাহ্মণ যোগীর সহায়তায়, জনৈক অজ্ঞাতনামা লেখক কর্তৃক ‘অমৃতকাণ্ড' পুনরায় আরবিতে অনূদিত হয়। এ যোগীও
ভোজের ব্রাহ্মণের ন্যায় কামরূপের অধিবাসী ছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ব্লকম্যান এই অজ্ঞাতনামা লেখককে দামেস্কোর বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে আল আরাবি
বলে মনে করেন।
1
কাজী রুকনউদ্দিনের ফারসি অনুবাদ ছাড়াও ‘অমৃতকাণ্ডের দ্বিতীয় ফারসি সমালোচনামূলক সংস্করণ বের হয়েছিল। 'বাহারুল হায়াত' নামে পরিচিত এই ফারসি। অনুবাদ গোয়ালিয়রের বিখ্যাত শাত্তারীয়া তরীকার সুফি শেখ মুহাম্মদ গউসীর বলে মনে করা হয়; গউসী ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার অনুরোধে তদীয় শিষ্য মুহাম্মদ
খতিরুদ্দিন সমালোচনামূলক গ্রন্থ লেখেন ।
কাজী রুকনউদ্দিন সমরকন্দীকে সমরকন্দের বিখ্যাত হানাফী আইনজ্ঞ ও সুফি কাজী রুকনউদ্দিন আবু হামিদ মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ আলীর সাথে অভিন্ন ব্যক্তি বঙ্গে মনে করা হয়। ‘আল-সমরকন্দী' সম্বন্ধে বর্ণনায় ব্লকম্যান লিখেছেন, তিনি বাংলার রাজধানী লক্ষ্মণাবতী বা গৌড়ের কাজী ছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন কিতাবুল ইরশাদের' লেখক এবং ‘আল-খিলাফি-ওয়া-জাদল' (দার্শনিক বিরোধিতা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা । ইনি ৬১৫ হিজরিতে (১২১৯ খ্রিস্টাব্দে) বুখারায় পরলোকগমন করেন।
কাজী রুকনউদ্দিন সমরকন্দী কিছুকাল আলী-মর্দন খলজির সরকারে লক্ষ্মণাবতীর কাজীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। অতঃপর তিনি তাঁর আদি নিবাস বুখারায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১২১৮ খ্রিস্টাব্দে সেখানে ইহলোক
ত্যাগ করেন।
সংস্কৃত মূল ‘অমৃতকাণ্ডের' কোনো প্রতিলিপি আজও পাওয়া যায়নি। এর আরবি অনুবাদ পাঠে বুঝা যায় যে, এটি হিন্দু মরমীবাদ ও দর্শনের উপর একখানা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। বাস্তবিকই এটি হিন্দুদের তপস্যা ও যোগতন্ত্রের উপর একখানা প্রামাণিক গ্রন্থ এবং তা মুসলিম বিশ্বের পণ্ডিত ও দার্শনিকদের মধ্যে সুপরিচিত ছিল। ফলে, দামেস্কের বিখ্যাত দার্শনিক ‘ইবনে আল-আরাবী' এ গ্রন্থ সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং রুকনউদ্দিনের প্রথম অনুবাদের বিশ বছরের মধ্যে তিনি এর অনুবাদ করেন। চতুর্দশ শতকের জনৈক মিশরীয় সুফি মুহাম্মদ আল-মিশরী অমৃতকাণ্ডের গুপ্তজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি এ গ্রন্থকে ভারতীয় সুফিবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে উল্লেখ করেন। ভারত এবং প্যারিস, লন্ডন, গোয়া, বার্লিন, কায়রো, ম্যানচেস্টার ও অন্যান্য স্থানের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে এর প্রচুর সংখ্যক আরবি পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান আছে। দার্শনিক ও মরমীদের মধ্যে ইবন আল আরবি অনূদিত গ্রন্থের জনপ্রিয়তা এই তথ্যের দ্বারা প্রমাণিত হয়।
অমৃতকাণ্ডের আরবি অনুবাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু থেকে এর সারাংশ সম্বন্ধে একটি ধারণা আমাদের মনে আসে। এতে মানব ও মানব মনের রহস্য সম্বন্ধীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা আছে। এতে মেলে যৌগিক অভ্যাস ও রিপুগুলোর প্রশমন সম্পর্কিত জ্ঞানের আলোচনা। এ গ্রন্থে জীবন ও মৃত্যু, বিভিন্ন স্তর এবং প্রাকৃতিক ও দার্শনিক শাস্ত্র সম্বন্ধীয় জগতের নানা বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা স্থান পেয়েছে।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস মরমীবাদ সম্পর্কিত এই সংস্কৃত পুস্তকের আরবি ও ফারসি অনুবাদ মুসলিম বাংলার সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাস্তবিকই এটি আরবি আরবি ও ফারসি ভাষায় জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, এই অনুবাদ ও ফারসি সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের একটি মূল্যবান অবদান। এর থেকে তাদের কার্যের মধ্যে অন্য জাতির জ্ঞানের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায়। হিন্দু মরমিয়া চিন্তাধারা যে মুসলিম সুফিবাদে সঞ্চারিত হয়েছে অমৃতকাণ্ডের অনুবাদের দ্বারা তা প্রকাশ পেয়েছে। এই সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদের সঙ্গে যে ঘটনাটি জড়িত আছে, তাতে প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু ঋখি ও দার্শনিকগণ ইসলামের মহান আদর্শ বুঝতে পেরেছিলেন এবং এর ফলে তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। দু'জন ব্রাহ্মণ যোগী ও পণ্ডিতের ইসলাম গ্রহণ-এই সত্যের উজ্জ্বল প্রমাণ ।
মাওলানা শরফউদ্দিন আবু তাওয়াম ছিলেন মুসলিম বাংলার প্রথম যুগের একজন খ্যাতনামা দরবেশ ও বিদ্বান ব্যক্তি। সোনারগাঁয়ে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঐ যুগের একটি আলোকোজ্জ্বল জ্ঞানকেন্দ্র ছিল। তিনি ধর্মীয় ও লৌকিক বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘মাকামাত' নামক ইসলামি মরমীবাদের উপর একখানা মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন; এ গ্রন্থ সম্পর্কে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। উক্ত গ্রন্থ এ ধরনের একটি অপূর্ব সৃষ্টি বলে পরিগণিত হয় এবং উপমহাদেশের গণ্ডিতমহলে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। “তারাসসুল আয়নাল মুলকী" নামক একটি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ সম্পর্কে দুটো পরে এটা প্রমাণিত হয়েছে। এই পত্রে উল্লিখিত হয়েছে যে, লাহোরের শাসনকর্তা সৈয়দ নাসিরউদ্দিন কোনো ব্যক্তির আবেদনক্রমে 'মাকামাতের' একখণ্ড সরবরাহ করেন। এই মূল্যবান গ্রন্থের কোনো নকল এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ফিকাহ এর উপর লিখিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ 'নাম-ই-হক' ইসলামি শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলিম বাংলার বিশেষ অবদানরূপে বিবেচিত হয়। জনৈক অজ্ঞাতনামা লেখক কর্তৃক সংকলিত হয়, তিনি তার নামোল্লেখ করেননি। গ্রন্থকার অবশ্য তার সংকলনকে শরফের (শরফউদ্দিন) স্মারক হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি এতে উল্লেখ করেন যে, শরফ’- যার খ্যাতি সারা পৃথিবীব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে, তিনি বুখারায় জন্মগ্রহণ করেন এবং খোরাসানে শিক্ষালাভ করেন। ডঃ সগীর হাসান মাসুমী এই খ্যাতনামা 'শরফ'কে বুখারার অধিবাসী খ্যাতনামা সুফি পণ্ডিত শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার সঙ্গে অভিন্ন ব্যক্তি মনে করেন। এই পুস্তক সম্ভবত তারই শিক্ষার ভিত্তিতে তার একজন শিষ্য কর্তৃক লিখিত হয়েছিল। লেখক বলেন, বইখানা রসূলের (সঃ) মৃত্যুর ৬৯৩ বছর পর লিখিত হয়েছিল। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে এ গ্রন্থ ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে সংকলিত হয়েছিল। হযরত মুহাম্মদের মৃত্যুর তারিখের উপর ভিত্তি করে লেখকের সংকলনের তারিখকরণ অসাধারণ ব্যাপার বলে মনে হয়। কারণ মুসলিম লেখকগণ সাধারণত হিজরি (শতক) সন উল্লেখ করেছেন। এটা হতে পারে যে, 'নাম-ই-হকের' লেখক- বাস্তবিকপক্ষে তার ৬৯৩ তারিখ বলতে হিজরি সনের উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে, তার গ্রন্থের প্রকাশনার তারিখ ছিল ১২৯৩ খ্রিস্টাব্দ।
বাংলায় শিক্ষা : সুলতানি ও মুঘল আমল
মার্জিত ফারসি ভাষায় রচিত 'নাম-ই-হকে'র দশটি অধ্যায় এবং ১৮৩টি কবিতা আছে। তিনটি ভূমিকাসংক্রান্ত অধ্যায়ে 'হামদ' (আল্লাহর প্রশংসা) ও 'নাত' (পয়গম্বর ও খলিফাগণের প্রশংসা) রচনা স্থান পেয়েছে। বাকি দশটি অধ্যায় 'গুঞ্জ (পবিত্র স্নান), গোসল (স্নান), নামাজ (প্রার্থনা) এবং রমজান মাসের উপবাসের (আবশ্যকীয়), সুন্নত,
মূলনীতি ও নিয়মকানুনের বিষয় নিয়ে লিখিত। এতে ফরজ
ওয়াজিব (নৈতিক দায়িত্ব), মুজতাহাব (ইচ্ছাধীন) এবং মাকরুহ (অভিপ্রেত নয় (এমন) ইত্যাদি সম্বন্ধীয় আলোচনা রয়েছে এবং অত্যাবশ্যকীয় বিষয়সমূহ পালনের ক্ষেত্রে দোষত্রুটি সংশোধনের নিয়ম সম্পর্কে উপদেশ দেয়া হয়েছে। পয়গম্বরের শিক্ষানুযায়ী মুসলমানদের জীবযাপন নিয়মিত করার জন্য পথপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে
গ্রন্থখানা লিখিত হয়েছিল।
মাওলানা শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার খ্যাতনামা শিষ্য মখদুম শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী কর্তৃক ইসলামি সৃষ্টিতত্ত্ব ও মরমীবাদের উপর বহু সংখ্যক গ্রন্থ সংকলিত হয়েছিল। পূর্ববর্তী একটি অধ্যায়ে এই সমস্ত গ্রন্থ সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। রিফউদ্দিন এহিয়া এসব গ্রন্থ সোনারগাঁয়ের শিক্ষাকেন্দ্রে তার বিখ্যাত শিক্ষকের নিকট েেক অর্জিত মূল্যবান জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে রচনা করেছেন। হযরত পীর সৈয়দ মাশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী ছিলেন বাংলার আর এক মূল্যবান সৃষ্টি। তিনি তার জ্ঞান লাভ করেন প্রসিদ্ধ বাঙালি শিক্ষক শেখ আলাউল হকের নিকটে। আশরাফ জাহাঙ্গীরের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তদীয় শিষ্য হাজী গরীব এমেনী কর্তৃক ফারসি ভাষায় সুফিবাদ সংক্রান্ত বিশ্বকোষ জাতীয় গ্রন্থ “লাতায়েফ-ই-আশরাফী” সংকলিত হয়। এই গ্রন্থে ইসলামি মরমীবাদ ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে আবদুর রাজ্জাক কর্তৃক সংগৃহীত ‘মাকতুবাত’ (পত্রাবলি) তাঁর সাহিত্যক ও মরমী বিষয়ক বিদ্যার ব্যুৎপত্তির পরিচয় বহন করে। চতুর্দশ শতকের প্রারম্ভে ফিকাহ শাস্ত্রের উপর আর একখানি গ্রন্থ আরবি ভাষায় সংকলিত হয়। এই গ্রন্থের নাম “মাজমু-ই-খানি ফি ‘আয়নাল মা’নি”। এর লেখক নিজেকে করিমউদ্দিনের পুত্র 'কামাল-ই-করিম', বোধ হয় করিমউদ্দিনের পুত্র কামালউদ্দিন নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার পুস্তক বাংলার শাসনকর্তা উলুগ কুতলুগ ইজ্জতউদ্দিন বাহরাম খাঁর নামে উৎসর্গ করেছেন। এই বাহরাম খাঁ ওরফে তাঁতার খানের সঙ্গে অভিন্ন ব্যক্তি বলে মনে করা হয়- যাকে সুলতান ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে এ প্রদেশে অভিযান করার পর বাংলার শাসনকর্তারূপে রেখে যান। বাহরাম খান সোনারগাঁয়ে ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
মুহাম্মদ বিন ইয়াজদান বখশ সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সমকালীন একজন বিখ্যাত 'মুহাদ্দিস' (হাদিস সম্বন্ধে সুপণ্ডিত বা জ্ঞানী ব্যক্তি) ছিলেন এবং 'খাজাগী শিরওয়ানী' নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ‘একডালা'য় অবস্থান করে খ্যাতনামা হাদিসবিদ বুখারীর হাদিস সংগ্রহের তিন খণ্ড প্রতিলিপি প্রস্তুত করেন। এতে ইসলামি শিক্ষাক্ষেত্রে সেই যুগের মুসলিম সম্প্রদায়ের গভীর আগ্রহের পরিচয়
প্রতিফলিত হয়েছে। সিলেটের শেখ জালাল মুজাররের সঙ্গী ও শিষ্য শেখ নূরুল হুদার বংশধর শেখ আলী শের ছিলেন ফারসি ও ইসলামি মরমীবাদের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত। তিনি “শরপ-ই-নুযহাতুল আরয়াহ” (আত্মার সন্তুষ্টির উপর টীকা) নামক সুফিবাদের উপর একখানা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এ গ্রন্থের কোনো কপি আজও পাওয়া যায়নি। মুহাম্মদ গউসী মান্দুবী নামক শাত্তারীয়া মতের সুফি পণ্ডিত এ গ্রন্থের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং তার নিজস্ব গ্রন্থ “গুলজার-ই-আবরারের" সংকলনে এর উপকরণ ব্যবহার করেছেন। গউসীর মতে শেখ আলী শের বাঙালি ছিলেন এবং তিনি ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দের কিছু পরে মারা যান। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে গউসীর পীর-দরবেশদের জীবনী। অবলম্বনে তার জীবনীমূলক গ্রন্থখানা রচনা করেন। এটি ফারসিতে একখানা পূর্ণাঙ্গ মূল্যবান গ্রন্থ ।
হযরত নূর কতুব আলম চতুর্দশ শতকের প্রথমপাদের বিখ্যাত সাধু দরবেশদের অন্যতম ছিলেন। শেখ হুসামুদ্দিন মানিকপুরী শেখ কাকু লাহোরী শামসুদ্দিন তাহির আজমিরী, শেখ জাহিদ পাণ্ডুয়ানী এবং আরো অনেক খ্যাতনামা সুফি ও পণ্ডিত এই বাঙালি শিক্ষকের নিকট ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন। এ যাবত তাঁর যে সমস্ত ‘মাকতুবাত’ (পত্রাবলি) পাওয়া যায়। তার রচিত ‘আনিসুল গুরাবা’ হাদিসের ব্যাখ্যা সহ একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এতে তাঁর কুরআন, ইসলামি শিক্ষা ও ফারসি ভাষায় গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় মেলে। নূর কুতব আলম ফারসি ভাষায় একজন ভালো কবিও ছিলেন। তার কিছু কিছু কবিতা ‘সুবহ-ই-গুলশানে’ প্রকাশিত হয়েছে।
এ সময়ে মুসলমানদের উদ্যোগে বাংলা পদ্যে কয়েকখানা ধর্মীয় ও সুফিবাদ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ সংকলিত হয়েছিল। এসব গ্রন্থে গ্রন্থকারদের আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা ও ইসলামি বিষয়াদিতে গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থকারগণ কুরআন, হাদিস, এবং ধর্মীয় ও মরমী বিষয়ক গ্রন্থগুলোকে তাদের সংকলনের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেন। আরবি ও ফারসি ভাষায় অনভিজ্ঞ সাধারণ লোকেরা যাতে সহজে বুঝতে পারে, তার জন্য ধর্মীয় বিষয়াদি তারা বাংলায় লিখেন। তাঁদের লেখায় প্রতীয়মান হয় যে, গ্রন্থকারগণ উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুসলিম সমাজে বিভিন্ন রকমের মিশ্র ভাবধারার অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য ইসলামি ভাবধারা জনপ্রিয় করে তোলা প্রয়োজন। ইসলামের বিধি-ব্যবস্থা সঠিকভাবে তুলে ধরে মুসলমানদের সংহতি বজায় রাখা এবং তাদের জীবন সুনিয়ন্ত্রিত করতে সাহায্য করার ব্রত তারা গ্রহণ করেছিলেন। তাদের রচনায় এটিও প্রতিফলিত হয়েছে যে, সমসাময়িক মুসলিম সমাজ রক্ষণশীল ছিল এবং সমাজে এরূপ ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, ধর্মীয় বিষয়াদি কেবল আরবি ও ফারসি ভাষাতেই লিখিত হতে পারে। কিছু সংখ্যক পণ্ডিত ও কবি অবশ্য সমাজের এই ধরনের রক্ষণশীলতা পরিহার করে সাধারণ মানুষের উপকারার্থে বাংলায় ধর্মীয় বিষয়সমূহ লিপিবদ্ধ করার কথা চিন্তা করেন। প্রতিভাশালী কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর- যিনি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) রাজত্বকালে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি এ ভাবধারারই রূপদান করেছেন। তিনি তার “ইউসুফ জুলেখা" নামক গ্রন্থে বলেন যে অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ধর্মীয় বিষয় বাংলায় লিখলে অপরাধ হয়- এ রকম চিন্তা করার কোনো যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই। তিনি বরং বাংলায় ধর্মের বিষয় লেখা পুণ্যের কাজ বলে মনে করেন। এর ফলে, মুসলমানদের অতীতের মহান ঐতিহ্য সাধারণ মানুষের নিকট প্রকাশিত হবে। মুসলমানদের প্রতি সেবার এই স্পৃহা নিয়েই শাহ মুহাম্মদ সগীর সাধারণ
মুসলমানের ভাষা বাংলায় তার স্মরণীয় গ্রন্থ “ইউসুফ জুলেখা” রচনা করেন।
সুলতান নুসরৎ মাহ (১৫১৯-৩২ খ্রিঃ) ও তদীয় পুত্র ফিরোজ শাহের (১৫৩২- ৩৪ খ্রি.) রাজত্বকালে একজন বিদ্বান ও দরবেশ চরিত্রের লোক ছিলেন কবি আফজল
আলী। তিনি তার ধর্মীয় গ্রন্থ ‘নসিহত নামা’ বাংলায় রচনা করেন। নাম থেকে বুঝা যায়, কবি ধর্ম বিষয়ে মুসলমানদেরকে উপদেশ দানের উদ্দেশ্যে এ গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই পুস্তক রচনায় কবি কুরআন ও হাদিস থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেন।
পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগের প্রতিভাবান বাঙালি কবি মুজাম্মেল ইসলামি বিষয়ে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সুফিমতের লোক এবং বিখ্যাত সাধুপুরুষ বদর-ই- আলমের শিষ্য, যিনি কিছু কালের জন্যে চট্টগ্রামে আগমন করেন। শাহ মুহাম্মদ সগীরের ন্যায় কবি মুজাম্মেলও ইসলামের রীতিনীতি অনুসারে মুসলমানদের জীবন-ধারা সুনিয়ন্ত্রিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাভাষায় ধর্মীয় গ্রন্থাদি লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তার ‘নীতিশাস্ত্র' নামক গ্রন্থে কবির এই অনুভূতি প্রতিফলিত হয়েছে। নৈতিকতা ও সৎ জীবনযাত্রার উপর ‘নীতিশাস্ত্র’ পুস্তকখানা লিখিত। কবির আর একটি রচনা ‘সায়াৎ-নামা' । এ গ্রন্থখানা প্রধানত সুফিবাদের উপর লিখিত যদিও এতে কিছু কিছু স্থানীয় ভাবধারাও আলোচিত হয়েছে। কবি মুজাম্মেল আরবি ও ফারসি সূত্র থেকে তাঁর কাব্যের উপকরণ সংগ্রহ করেন ।
ফয়জুল্লাহ ছিলেন অন্য আর একজন পণ্ডিত ও কবি। ইনিও ধর্মীয় পুস্তক বাংলা ভাষায় রচনা করেন । তার ‘গাজী বিজয়’ সুলতান রুকনউদ্দিন বারবক শাহের সেনাপতি মুজাহিদ দরবেশ ইসমাইল গাজীর জীবন কাহিনী অবলম্বনে লিখিত। শহিদ ইমাম হোসেনের পুত্র ইমাম জয়নাল আবেদীনের দুঃখ ও কারবালার করুণ কাহিনীর উপর ভিত্তি করে তিনি আর একখানা কাব্য ‘জয়নালের চৌতিষা' রচনা করেন। যদিও এ গ্রন্থগুলোর খুব বেশি ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই, তথাপি এগুলো মুসলমান সাধুপুরুষ, বীর ও নেতাদেরকে জনসমাজে পরিচিত করে দিয়েছে এবং অন্যদিকে বাংলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত হিন্দু দেবদেবী সম্বন্ধীয় ভাবধারা দূরীকরণে সহায়তা করেছে। ফয়জুল্লাহ ষোড়শ শতকের মাঝামাঝিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ধর্মীয় বিষয়ের উপর লিখিত আর একখানা গ্রন্থ 'রসূল বিজয়' পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধের কবি জৈনুদ্দিন কর্তৃক রচিত হয়। এ গ্রন্থখানায় আজগুবী ও চমকপ্রদ কাহিনী আছে এবং এর
ঐতিহাসিক ভিত্তি খুবই সামান্য। তার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তিনি ইলিয়াস শাহী
বংশের সুলতান ইউসুপারের (GB) কবি ছিলেন। দৌলত উজীর ছিলেন। তিনি পারস্যের প্রেমকাব্য ' ' नাংলা অনুবাদের দ্বারা নিজেকে বাহরাম খান ষোড়শ শতকের দ্বিবিখ্যাত কবি বিদ্বান ব্যক্তি
অমর করে রেখেছেন। এ বাংলা সাহিত্যের একটি রচনা বলে বিবেচিত হয়। ১৫৬০ থেকে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটি রচিত হয়েছিল। তাঁর রচিত কাব্য বাংলার মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম পৌরাণিক কাহিনী ও ইসলামি ভাবধারা জনপ্রিয় করে তোলে । মূল্যবান
বাংলায় লিখিত এসব ধর্মীয় গ্রন্থাবলি প্রদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো ছিল স্থানীয় ভাষায় রচিত ইসলামি শিক্ষার উপর প্রাথমিক গ্রন্থাদি এবং এগুলো রচিত হয়েছিল সেই ভাষায় যে ভাষা সাধারণ লোকের নিকট গ্রহণযোগ্য ও বোধগম্য ছিল। বর্তমানকালে, প্রত্যেক স্থানীয় ভাষায় ধর্মীয় পুস্তক রচনা ও ধর্মোপদেশ দানের গুরুত্ব স্বীকার করেন। মুসলিম যুগে বাংলার শিক্ষিত মুসলমানেরা, এমনকি পঞ্চদশ শতকের প্রারকোল থেকেই এই গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং উপমহাদেশের অন্যান্য প্রদেশের লোকেরা এ বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করবার প্রায় কয়েক শতাব্দী পূর্বেই তারা ইসলামি শিক্ষার উপর মূল্যবান গ্রন্থরাজি প্রণয়ন করেছিলেন। তাদের রচিত গ্রন্থাবলি ইসলামকে যথার্থরূপে ফুটিয়ে তোলে এবং সাধারণভাবে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি বিষয়গুলো জনপ্রিয় করে দেয়। এতে মুসলমান সমাজে অনৈসলামিক ভাবধারা প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং মুসলানদের মানসিক ও নৈতিক চরিত্র ইসলামি ভাবধারার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। এর ফলে ইসলামি শিক্ষার প্রসার হয় এবং বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধিত হয়। বাংলার মুসলমান কবিদের এসব ধর্মীয় গ্রন্থাবলি তাদের পাণ্ডিত্যের প্রমাণ বহন করে এবং বাংলার মুসলিম সমাজ গঠনে তাদের মূল্যবান অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
প্রাথমিক যুগের ফারসি অভিধানগুলোর অন্যতম একটি অভিধান রচনার ক্ষেত্রেও উপমহাদেশে মুসলিম বাংলা গৌরবের অধিকারী। ইব্রাহিম কাওয়াম ফারুকী 'ফারহাঙ্গ- ই-ইব্রাহিম' নামক একখানি ফারসি অভিধান সংকলন করেন। এ গ্রন্থ মখদুম শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরীর নামানুসারে 'শরফনামা' নামে অধিকতর পরিচিত 'গ্রন্থাকার শেখ শরফউদ্দিনের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে এটি উৎসর্গ করেছেন। এ পুস্তক থেকে জানা যায় যে, এ গ্রন্থ আবুল মুজাফফর বারবক শাহের রাজত্বকালে লিখিত হয়েছিল। লেখক জৌনপুরকে তার আবাসস্থান বলে উল্লেখ করেছেন। এই প্রমাণের উপর নির্ভর করে অনুমান করা হয় যে, এটি সুলতান বাহলুল লোদীর পুত্র ও জৌনপুরের শাসনকর্তা বারবক শাহের শাসনকালে সংকলিত হয়েছিল। কিন্তু এটা উল্লেখযোগ্য যে, বারবক লোদী তার পিতার রাজত্বকালে রাজকীয় সার্বভৌম ক্ষমতাপ্রাপ্ত হননি, কিংবা তিনি 'আবুল মুজাফফর' এই রাজকীয় উপাধি ধারণ করেছিলেন কি না তাও জানা
যায়নি। বাংলার ইলিয়াস শাহী সুলতান বারবক শাহ ‘আবুল মুজাফফর' উপাধি ধারণ করেছিলেন। সুতরাং এটা সিদ্ধান্ত করা যুক্তিসঙ্গত যে, জৌনপুরের অধিবাসী ইব্রাহিম কাওয়াম ফারুকী ইলিয়াস শাহী বংশীয় বারবক শাহের (১৪৫৯-৭৪ খ্রিঃ) রাজত্বকালে
বাংলাদেশে অবস্থানকালে তার গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন।
ফারসি ভাষায় 'শরফনামা' একখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ; শুধু বাংলায় নয়, স উপমহাদেশের মধ্যে ফারসি সাহিত্য ও জ্ঞানের উন্নতির ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ বড় রকমের কৃতিত্বের দাবিদার। এ গ্রন্থখানা আর একটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। এতে লেখকের সমকালীন বাংলার কিছু কিছু পণ্ডিত ও কবিদের নাম পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে অসামান্য প্রতিভাশালী লেখক ও যশস্বী চিকিৎসক আমির শাহাবুদ্দিন হাকিম কিরমানীর উল্লেখ পাওয়া যায়। “ফারহাঙ্গ-ই-আমির শাহাবুদ্দিন কিরমানী” নামক একখান অভিধান রচনার কৃতিত্বের সঙ্গেও তিনি জড়িত। ইব্রাহিম কাওয়াম ফারুকী এ অভিধান থেকে ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত করেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, ‘শরফনামা” রচনার কয়েক বছর পূর্বে বঙ্গদেশে ফারসিতে আর একখানা শব্দকোষ রচিত হয়েছিল। আমির শাহাবুদ্দিনের অভিধানের কোনো অস্তিত্বের সন্ধান কোথাও পাওয়া যায়নি।
বাংলার মুসলমান পণ্ডিতদের আগ্রহ কেবল ইসলামি শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা জ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও অবদান রেখে গেছেন। যুদ্ধবিদ্যা কৌশলে তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) সৈয়দ মীর আলবী নামে সুপরিচিত মুহাম্মদ বু-দাই ‘হেদায়েত-ই-রামী’ নামে ধনুবিদ্যার উপর একখানা পুস্তক রচনা করেন। তিনি তার পৃষ্ঠপোষক বাঙালি সুলতানকে গ্রন্থখানি উৎসর্গ করেন; সুলতান হিন্দুদের যুদ্ধবিদ্যা কৌশল সম্বন্ধে আগ্রহী ছিলেন। বিশেষকরে তীর-ধনুকের সাহায্যে হিন্দুদের যুদ্ধবিদ্যা পদ্ধতি সম্বন্ধে লেখক আলোচনা করেছেন এবং হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত ধনুক নিক্ষেপের বিভিন্ন পদ্ধতি তিনি চিত্রসহ তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন ৷
মুসলিম-বাংলা ফারসি সাহিত্যে বহু প্রতিভাশালী কবির জন্ম দিয়েছে। তারা তাদের প্রতিভা বিকাশে বাংলার সুলতানদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন। তাদের অবদান তুলে ধরার জন্য কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের পুত্র ও বাংলা শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন বুগরা খান খুব শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ছিলেন। তিনি কবি ও বিদ্বান ব্যক্তিদের সাহচর্য ভালোবাসতেন। লক্ষ্মণাবতীতে তাঁর দরবারে বহু কবি ও বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন, এদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলেন শামসউদ্দিন দবীর ও কাজী আসির। এঁদের উভয়ই বিখ্যাত কবি- পণ্ডিত আমির খসরু ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বলবনের বাংলা অভিযানে তার সঙ্গী হয়েছিলেন। বাদায়ুনী আবেগদীপ্ত ভাষায় শামসউদ্দিন দবীরের সাহিত্যিক ও কাব্যিক প্রতিভার কথা বলেছেন। তিনি বলেন শামসউদ্দিন দবীর তার চমৎকার কাব্যিক রচনাবলির জন্য বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি দিল্লির সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের (১২৪৬-৫৬ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে দবীরকে দেখাতেন এবং তার মতামত গ্রহণ করতেন। আমির খসরু তাঁর ‘গুরাতুল কামাল' কাব্যের মুখবন্ধে ও হাস বেহেস্ত' কাব্যের শেষ অংশে তার বন্ধু ও উপদেষ্টা শামসউদ্দিন দবীরের গুণাবলির কথা উল্লেখ করেছেন। সুলতান বলবন তার সাহিত্যিক কৃতিত্ব ও গুণরাজির কথা
নিয়োগ করেন। বাদায়ুনী শামসউদ্দিন দবীরের কবিতার কিছু পংক্তি উদ্ধৃত করেছেন। করে তাকে তদীয় পুত্র ও বাংলার শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন বুগরা খানের সচিব পদে
শামসউদ্দিন দবীরের কয়েকটি কবিতা বাদায়ুনী উদ্ধৃত করেছেন। আমির খসরুর উদ্দেশ্যে লেখা একটি কবিতায় (স্তবকে) তিনি বলেন, “হে খসরু"। শামসুদি কথাবার্তায় পারদর্শী ও দক্ষ তোমার একজন সচিব। তিনি নিষ্কর্মা নথিপত্র নকলকারী ত অনভিজ্ঞ লেখকদের মতো একজন সামান্য লেখক মাত্র নন। তিনি নিজে অভিজ্ঞ এবং তার কবিতা বিশুদ্ধ স্বর্ণের ন্যায় এবং খাকানীর উক্তির ন্যায় তার লেখনী তরবারি অশাণিত নয়।”
আমির খসরু তাঁর গুর্রাতুল কামালে বলেন, “মালিক শামসউদ্দিন দবীর ও কাজী আসির তাকে (আমির খসরুকে) তার পোশাকের প্রান্ত ধরে লক্ষ্মণাবতীতে টেনে রাখতে চেয়েছিলেন।” তিনি আরো বলেন, “কিন্তু (দিল্লিতে) আমার বন্ধুদের থেকে আমার বিচ্ছেদ আমার জামার কলার ধরে ফেলেছে। আমি ইউসুফের মতো বন্দিখানা (বাংলাদেশ) ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম এবং রাজধানীর দিকে পা বাড়ালাম।” এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, আমির খসরু কেবল স্বল্পকালের জন্য বাংলায় নাসিরউদ্দিন বুগরা খানের দরবারে ছিলেন; অন্যদিকে, শামসউদ্দিন দবীর ও কাজী আসির স্থায়ীভাবে লক্ষ্মণাবতীতে বুগরা খানের দরবারে অবস্থান করেছিলেন।
সুলতান বারবক শাহের (১৪৫৯-৮৪ খ্রিঃ) রাজত্বকালে লিখিত ইব্রাহিম কাওয়াম ফারুকীর ‘শরফ-নামা' গ্রন্থে কয়েকজন খ্যাতনামা পণ্ডিত, কবি ও বিজ্ঞান ব্যক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। আমির শাহাবুদ্দিন হাকিম কিরমানীর নাম পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমির জৈনুদ্দিন হারবী ছিলেন সভাকবি। মনসুর সিরাজী, মালিক ইউসুফ বিন হামিদ, সৈয়দ জালাল সৈয়দ মুহাম্মদ রুকন ও সৈয়দ হাসান এঁরা সকলেই সুকবি ছিলেন। শেখ ওয়াহিদ একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, তিনি 'হাবল মতিন' নামে একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ‘শরফ-নামায়’ এঁদের রচনাবলির কিছু কিছু দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। কিন্তু এঁদের কোনো গ্রন্থের সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। মীর্জা নাথন 'আগাহী' নামে একজন কবির নামোল্লেখ করেছেন- যিনি যশোরে মুঘল রাজকর্মচারীদের একটি মজলিশে বসে যশোরের জলবায়ুর প্রশংসা করে 'কাসিদা' রচনা করেন। তিনি তাঁর এ কবিতা মাওলানা উরফীর কবিতার অনুকরণে রচনা করেন যাতে কাশ্মীরের জলবায়ুর প্রশংসা করা হয়েছিল। মীর্জা নাথন আরো জানান যে, ‘কাসিদা’ সকলের নিকট সমাদৃত হয়েছিল।
উপরোল্লিখিত পণ্ডিত ও কবিদের ছাড়াও সে সময়ে আরো বহু বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। আমরা যথাস্থানে তাদের কারো কারো সম্বন্ধে আলোচনা করার সুযোগ পাব। যাহোক, উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাঙালি মুসলমান পণ্ডিত। কবিগণ ইসলামি শিক্ষায় এবং আরবি ও ফারসি সাহিত্যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। রেখে গেছেন। বাস্তবিকই এ প্রদেশে ইসলামি ভাবধারা সৃষ্টিতে এবং জ্ঞান ও সংস্কৃতির উন্নতি বিধানে তাদের কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]