বাংলায় মুসলিম শিক্ষার স্তর Stratification of Muslim Education in Bengal

১. প্রাথমিক শিক্ষা : বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনামলে মুসলমানদের মধ্যে প্রার্থমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ছিল। শিক্ষা ধর্মীয় কর্তব্য ও সামাজিক সম্মানের বিষয়রূপে পরিগণিত হতো। তাদের মধ্যে শিক্ষার জন্য গভীর স্পৃহা ছিল এবং এর জন্য ব্যয় করার ক্ষমতাও তাদের ছিল। সে সময়ে বাংলার স্বল্প-সংখ্যক অধিবাসী প্রচুর পরিমাণ উর্বর ভূমিতে সচ্ছল জীবন যাপন করতো। মুসলমানগণ বিশেষকরে শাসনকর্তা, রাজকর্মচারী, জায়গীরদার, আয়মাদার, ইজারাদার, লাখেরাজদার ও সৈনিকগণ সমৃদ্ধশালী ছিলেন। ফলে, তাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করাটা তাদের পক্ষে কোন সমস্যা ছিল না। এমন কি, সামান্য সম্পদের অধিকারী মুসলমানরাও মসজিদ-সংলগ্ন মক্তবে তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠাতে পারতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মক্তবের ব্যয়ভার হয়ত রাষ্ট্র থেকে নয়ত স্থানীয় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের জমিদান ইত্যাদি থেকে বহন করা হতো ।
মুসলমান ছেলেমেয়েদের শিক্ষা শুরু হতো মক্তবে। এসব প্রতিটি মসজিদ এবং এমনকি ধনী ব্যক্তিদের বাড়ি সংলগ্ন ছিল। ফলে, প্রত্যেক শহর, এমনকি গ্রামেও প্রাথমিক বিদ্যালয় বিদ্যমান ছিল। হিন্দু কবি মুকুন্দরামের উক্তি থেকে জানা যায় যে, হিন্দু এলাকায় ক্ষুদ্র মুসলমান পাড়ায়ও মুসলমান ছেলেমেয়েদের জন্য মক্তব ছিল। কৰি তার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বলেন, “মুসলিম মহল্লায় মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে সমস্ত মুসলমান ছেলেমেয়েকে ধর্মপ্রাণ মৌলবীগণ শিক্ষা দিতেন।” প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘মক্তব’ বাংলাতে পাঠশালা নামেও অভিহিত হতো। বালক বালিকারা একত্রে একই বিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাস করতো। মুসলমান কবিদের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহশিক্ষার প্রচলন ছিল। দৌলত উজীর বাহরাম খান তার ‘লাইলী মজনু' কাব্যে লিখেছেন, যে লায়লী ও মজনু বাল্যকালে একই পাঠশালায় পড়তো এবং অন্যান্য বহু বালক-বালিকাও সেই পাঠশালায় পড়াশুনা করতো।
সাধারণত পাঁচ বছর বয়সে মুসলমান বালক-বালিকাদের শিক্ষা শুরু হতো। ছেলেমেয়েদের এ বয়সের পূর্বে এবং পরেও শিক্ষা আরম্ভ করা দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাহরাম থেকে জানা যায় যে, মজনুকে সাত বছর বয়সে পাঠশালায় পাঠানো হয়। কিন্তু মুসলমানদের বিশেষত উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে চার বছর চার মাস এবং চার দিন বয়সে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা শুরু করার সাধারণ রীতি প্রচলিত ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে শিশুদের এই আনুষ্ঠানিক প্রবেশ ‘বিসমিল্লাহ-খানি' অনুষ্ঠান নামে পরিচিত শিল্প। বাংলাসহ সমগ্র মুসলিম ভারতে এ অনুষ্ঠান পালন করা হতো। একজন জ্যোতিষীরসঙ্গে পরামর্শ করে একটি বিশেষ নির্ধারিত সময়ে শিক্ষকের নিকট শিশু তার প্রথম পাঠ গ্রহণ করতো এবং শিক্ষক কুরআন শরীফ থেকে নির্বাচিত একটি ‘আয়াত’ পাঠ করতেন এবং শিশু তা পুনরাবৃত্তি করতো। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য মুসলমান পিতামাতা যে বিরাট গুরুত্ব আরোপ করতেন তা ‘বিসমিল্লাহ-খানি' অনুষ্ঠানে প্রতিফলিত হয়েছে ।
প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে মসজিদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো । প্রত্যেক শহরে বহু মসজিদ ছিল এবং এমনকি ক্ষুদ্র গ্রামেও যেখানে স্বল্প সংখ্যক মুসলমান বাস করতো সেখানেও অন্তত একটি মসজিদ থাকতো। প্রার্থনাগৃহ মসজিদ ছিল ঐতিহ্যগতভাবে শিক্ষালাভের স্থান, বিশেষত ধর্মবিষয়ে। মুসলমানদের নামাজ পরিচালনার জন্য প্রত্যেক মসজিদে একজন করে ইমাম থাকতেন। ইমামসহ মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লাখেরাজ জমির ব্যবস্থা ছিল। প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য ইমামই ছিলেন শিক্ষক, বিশেষকরে তিনি ছেলেমেয়েদেরকে কুরআন পাঠ ও ধর্মের মূলনীতিসমূহ শিক্ষা দিতেন। বাংলাদেশে মসজিদকে ধর্মীয় শিক্ষায় প্রতিষ্ঠানরূপে ব্যবহার করার এই ঐতিহ্য মুসলিম শাসন অবসানের পরেও অব্যাহত থাকে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষার অবস্থা পর্যালোচনার সময় শিক্ষা কমিশনের বাংলার প্রাদেশিক কমিটি রিপোর্টে বলেন, “এ রকম একটিও মসজিদ কিংবা ইমামবাড়া ছিল না, যেখানে আরবি ও ফারসির অধ্যাপক রাখা হতো না। আবার পাঠশালার অনুকরণে মক্তবও গড়ে উঠেছিল— যেখানে মুসলমানদেরই সংখ্যা ছিল অধিক।”
মুসলিম বঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার সাধারণ প্রচলন সম্বন্ধে উইলিয়াম এডামের তদন্ত রিপোর্ট থেকে কোনো ধারণাই পাওয়া সম্ভব নয়। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শিক্ষার অবস্থা তদন্তের পর এডাম তার রিপোর্টে বলেন যে, ৪০,০০০,০০০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য বাংলা বিহারে প্রায় ১,০০,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল; ফলে সেখানে স্কুলে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের ৩০০ জনেরও অধিক অধ্যয়নরত ছেলেমেয়েদের জন্য একটি গ্রাম্য বিদ্যালয় থেকে থাকবে। তিনি মন্তব্য করেন যে, তার হিসাব কতকগুলো অনির্ভরযোগ্য উপরকণের উপর ভিত্তি করে হলেও, এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তখন বহুল পরিমাণে গ্রাম্য-স্কুল চালু ছিল এবং এমনকি দরিদ্র শ্রেণির পিতামাতার মনেও তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের বাসনা নিশ্চয়ই গভীর ছিল। মিঃ এডাম যে সময়ের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা বর্ণনা দিয়েছেন তখন মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যুগে অবশ্যই তাদের মধ্যে শিক্ষার অবস্থা আরো উন্নত ছিল। মুসলমান শাসনামলে এ
ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়, মক্তব ও পাঠশালার সংখ্যা নিশ্চয়ই আরো বেশি ছিল। সে সময়ে প্রত্যেক মুসলমানেরই তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করার অধিকতর সামর্থ্য ছিল। ফলে সে যুগে প্রত্যেক শিক্ষিত মুসলমানই রাজসরকারে অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির আশা করতে পারতো। মুসলিম শাসনামলে মুসলমানদের মধ্যে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, এটা অবশ্য স্বীকার্য। মুসলমানদের শিক্ষা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে এইচ জে, রলিনসন মন্তব্য করেছেন, “মুঘল ভারতের উন্নততর শিক্ষা সংস্কৃতি অধিক পরিমাণে এই উত্তম শিক্ষা পদ্ধতিরই ফলশ্রুতি। শিক্ষা ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে পরিগণিত হতো। যদি সে ধনী পিতা-মাতার পুত্র হতো, তাহলে চার বছর বয়সে বালককে কুরআনের একটি আয়াত উৎকীর্ণ করা পাথর বসান শ্লেট দিয়ে একজন শিক্ষকের হাতে তুলে দেয়া হতো; যদি সে গরিব পিতা-মাতার সন্তান হতো, তাহলে তাকে মৌলবী দ্বারা পরিচালিত মক্তব বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠান হতো, প্রতিটি মসজিদের সঙ্গে একটি মক্তব ছিল।”
ধর্মীয় শিক্ষাদানই ছিল প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি। বালক-বালিকা নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমান শিশু সন্তানকে ধর্মের মূলনীতিসমূহ ও নৈতিক শিক্ষা দেয়া হতো। কবি বিপ্রদাস বলেন যে, মুসলমান ছেলে-মেয়েদেরকে মক্তবে ওজু করা ও নামাজ পড়া শেখান হতো। মুকুন্দরাম লিখেছেন যে, মুসলমান ছেলেমেয়েরা মক্তবে মৌলবীর (মখদুম) নিকট শিক্ষা লাভ করতো। মক্তবের শিক্ষক একজন মৌলবী হওয়ায় (ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত) ইসলামি শিক্ষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল, এটা নিশ্চিত বলা যায়।
ধর্মীয় বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়াদিও মক্তবে পড়ান হতো। রলিনসন মন্তব্য করেন, “এখানে (মক্তবে) সে (শিশু) কলেমা বা ধর্মবিশ্বাস ও কুরআন থেকে কিছু আয়াত মুখস্থ করতো-যা তার দৈনন্দিন প্রার্থনায় প্রয়োজন হতো। কুরআন মুখস্থ করার একটি সাধারণ রীতিও প্রচলিত ছিল। এরই সঙ্গে রাসূলুল্লাহর হাদিস, ফারসি ভাষা ও অন্যান্য বিষয় শিক্ষা দেয়া হতো। সুচারু লিখন-পদ্ধতির চর্চা করা হতো এবং বালক যদি শিল্পকলার শিক্ষালাভে আগ্রহী হতো, তাহলে তাকে একজন ওস্তাদ বা শিক্ষকের নিকট শিক্ষানবিশীর জন্য প্রেরণা করা হতো।”
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে আরবি, ফারসি ও বাংলা- এই তিনটি ভাষা শিক্ষা করতে হতো। কুরআন ও হাদিস শিক্ষার জন্য আরবি ভাষা শেখা একান্ত প্রয়োজন ছিল। সমগ্র মুসলমান শাসনামলে ফারসি ছিল রাজ দরবারের ভাষা ও শিক্ষার বাহন। সুতরাং রাজ-সরকারে অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি বাকরির জন্য ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন অত্যাবশ্যক ছিল। বাংলা ভাষা বহু মুসলমান ও অমুসলমানের মাতৃভাষা ছিল। ফলে, বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে যে চীনদেশীয় দূত বাংলায় আগমন করেছিলেন, তিনি বাংলাদেশে ফারসি ও
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
বাংলা- এ দুটো ভাষা দেখতে পেয়েছিলেন। মাহুয়ান বলেন, “অধিবাসীদের ভাষা বাংলা। ফারসিরও কিছু কিছু প্রচলন আছে এখানে।” ফারসি ছিল রাজভাষা এবং বাংলা ছিল সাধারণভাবে অধিবাসীদের মাতৃভাষা। চৈনিক বর্ণনায় দেখা যায় যে, ঐ যুগের সমাজে বাংলা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, মুসলমান শাসনকর্তাগণ এ ভাষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। বহু বহিরাগত মুসলমান, যারা বহু পূর্বেই বাংলাদেশে বসতি-স্থাপন করেছিলেন, তারা এ দেশকে তাদের নিজ দেশ ও বাংলা ভাষাকে নিজেদের হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমান শাসনকর্তাগণ বাংলা সাহিত্যের উন্নতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বহু মুসলমান কবি বাংলা ভাষায় তাদের গ্রন্থ রচনা করেন। ধর্মীয় বিষয়ের উপরও তাঁরা একই ভাষায় তাঁদের গ্রন্থাদি রচনা করেন। তাঁদের লেখা থেকে প্রকাশ পায় যে, বেশির ভাগ মুসলমান আরবি ও ফারসি ভাষা বুঝতে অক্ষম ছিলেন এবং সেজন্য তারা বাংলা ভাষায় লিখতেন, যাতে সাধারণ লোকেরা পড়তে ও বুঝতে সক্ষম হন। এতে প্রমাণ হয় যে, সাধারণ লোকেরা ধর্মীয় ও অন্যান্য বিষয়ের উপর বাংলায় লিখিত পুস্তকাদি পড়তে ও বুঝতে পারতেন। সুতরাং, বাংলা পড়ান হতো এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে এই ভাষাই শিক্ষার মাধ্যমরূপে প্রচলিত ছিল ।
‘শমসের গাজীর পুঁথি' নামক বাংলা কাব্য থেকে জানা যায় যে, শমসের গাজী একটি তুলবা-ই-খানা (বিদ্যালয়) স্থাপন করেন এবং তার স্কুলের জন্য ঢাকা থেকে একজন মুনশী (ফার্সি শিক্ষক), হিন্দুস্তান থেকে একজন মৌলবী (আরবির শিক্ষক) ও জুগদিয়া থেকে একজন পণ্ডিত যথাক্রমে ফারসি, আরবি ও বাংলা শিক্ষা দেবার জন্য আনায়ন করেন। এতে প্রমাণ হয় যে, ফারসি আরবি ও বাংলা বঙ্গদেশের বিদ্যালয়সমূহে পাঠ্যতালিকাভুক্ত ছিল। ‘সারদা-মঙ্গল' নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে আরো একটি প্রমাণের দ্বারা এই ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ গ্রন্থে আছে যে, রাজা গোবিন্দ তার পুত্র লক্ষাদরকে পণ্ডিত গোরীদাসের তত্ত্বাবধানে রাখার সময়ে তাকে বলেছিলেন যে, বালককে বাংলা, নাগরী, (হিন্দী) ও উৎকল (উড়িয়া) ভাষা শিক্ষা দিতে হবে।
আকবরের শিক্ষা বিষয়ক নিয়ম-কানুন সেকালের বাংলা ও ভারতের অপরাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম বিষয়ের উপর আলোকপাত করে। বালকরা মক্তবে গদ্য- পদ্য পড়তে ও লিখতে শিখত এবং স্রষ্টার প্রশস্তিমূলক কবিতা ও নীতিমালা মুখস্থ করতো। তাকে অনেকগুলো বই পড়তে হতো। সম্রাট আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে, বালককে পদ্ধতিতে বহু বছর বৃথা সময় নষ্ট করে বুদ্ধিহীনের মতো না বুঝে অনেক বই পড়তে হয় এবং না দেখে অনেক বিষয় মুখস্থ করতে হয়। তিনি একটি নতুন পাঠ্য পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রয়াস পান, যার ফলে একটি বালক মাত্র দু'দিনে অক্ষর পরিচয়, সপ্তাহে শব্দ ও অতঃপর অল্প সময়ের মধ্যে কবিতা পাঠ করতে ও বুঝতে সমর্থ হয়। সম্রাট আশা করেন, “যদি শিক্ষার এ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়, তাহলে একটি বালক একমাস কিংবা একদিনে যা শিখবে, অন্যদের তাতে বহু বছর সময় লাগবে এবং
লোকে এই সহজ পদ্ধতি দেখে আশ্চর্যবোধ করবে।” এভাবে বাংলাদেশে প্রাথমিক পাঠ্য তালিকা আরবি, ফারসি ও বাংলা এবং ধর্ম, নীতিমালা, গদ্য-পদ্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গঠিত ছিল। প্রাথমিক শিক্ষার একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় ছিল অঙ্কশাস্ত্র। অক্ষের মৌলিক উপাদানগুলো, যেমন যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ এবং কাঠাকিয়া, গপ্তাকিয়া, ও
বিঘাকিয়া ইত্যাদি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষা দেয়া হতো ।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রসঙ্গে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো হিন্দু বালকরা, বিশেষকরে কায়স্থ পরিবারের ছেলেরা প্রায়ই মৌলবীদের নিকট মক্তবে শিক্ষা গ্রহণ করতো। ফারসি ছিল রাজভাষা এবং হিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায় রাজ-সরকারে চাকরি পাওয়ার আশা করতেন। প্রয়োজন বিধায় এ শ্রেণির হিন্দুরা ফারসি শিখতেন এবং তাদের সন্তানসন্ততিদেরকেও ফারসি শিক্ষা দিতেন। বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের প্রারম্ভকাল থেকে উচ্চ শ্রেণির বহু সংখ্যক হিন্দুকে মুসলিম রাষ্ট্রের বিভিন্ন চাকরিক্ষেত্রে দেখা যায়। রাজস্ব বিভাগের কাজ প্রায়ই কায়স্থদের দ্বারা পরিচালিত হতো। এসব হিন্দুরা অবশ্যই ফারসি ভাষা শিখে থাকবেন, অন্যথায় তাদেরকে রাজ-সরকারের চাকরিতে নিয়োগ করা সম্ভব ছিল না। এমনকি অষ্টাদশ শতকেও শিক্ষিত ও সংস্কৃতিসম্পন্ন হিন্দু পরিবারগুলো ফারসি-জ্ঞান ব্যতিরেকে শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ ও নিরর্থক মনে করতেন। বিদ্যাসুন্দরের লেখক রামপ্রসাদ সেনকে তার পিতা একজন মৌলবীর নিকট প্রেরণ করেন এবং সেখানে তিনি ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। বাস্তব জীবনে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ফারসি এতবেশি আবশ্যক ছিল যে, এ ভাষাকে অবহেলা করে শুধু সংস্কৃত ও বাংলা শেখার জন্য প্রসিদ্ধ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছিলেন। শমসের গাজী তুলবাইখানায়, যার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, আরবি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা ছিল। হিন্দু বালকরা যে সেখানে অধ্যয়ন করতো, তার প্রমাণ এই যে, সেই বিদ্যালয়ে একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সংস্কৃত শিক্ষা দিতেন এবং একজন মৌলবী ফারসি ভাষা শিক্ষা দিতেন। বুকানন কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যেখানে “মুসলমান শিক্ষকরা হিন্দু- মুসলমান বালকদেরকে বিনা খরচে শিক্ষাদান করতেন।”
বালকদের শিক্ষা শুরু করার সময় মুসলমানদের মতো কায়স্থগণও 'বিসমিল্লাহ- খানি' অনুষ্ঠান পালন করতো। পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট মৌলবীর দ্বারা এই অনুষ্ঠান পরিচালিত হতো এবং দাওয়াত-পত্র ফারসিতে লেখা হতো। এই উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার সময় পর্যন্তও উত্তর ভারতে উক্ত নিয়ম প্রচলিত ছিল।
২. মাধ্যমিক শিক্ষা ও উচ্চতর শিক্ষা : মাদ্রাসাসমূহে মাধ্যমিক শিক্ষা দান করা হতো। উৎকীর্ণলিপি ও দলিল-পত্রাদিতে কিছু সংখ্যক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উল্লেখ আছে। সমসাময়িক ইতিহাস লেখকগণ উলেমা ও শেখদের প্রতি শাসক ও অভিজাত আমির- ওমরার পৃষ্ঠপোষকতা ও বাংলায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ প্রদেশে বহু সংখ্যক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বেশির ভাগ
মিটাবার জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। বহু মসজিদ ও ইমামবাড়া মাধ্যমিক শিক্ষার শহর ও গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান এলাকাসমূহে মুসলমান অধিবাসীদের শিক্ষাগত প্রয়োজন
কেন্দ্রস্বরূপ ছিল। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে এ সমস্ত মসজিদ ও ইমামবাড়াগুলোর কিছু কিছু মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানরূপে এমনকি উনিশ শতক পর্যন্তও চালু ছিল। আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে মুসলমান যুগে ভারতে মাধ্যমিক ; উচ্চশিক্ষার উন্নতি সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তিনি মন্তব্য করেন, “প্রত্যেক সভ্য জাতিরই যুবকদের শিক্ষার জন্য স্কুল রয়েছে এবং হিন্দুস্তান এর বিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রসিদ্ধ ।”
সরকার ও অবস্থাশালী ব্যক্তিরা মাদ্রাসা ও মসজিদগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উদারভাবে লাখেরাজ জমি দান করেছেন। কাজী নাসির উদ্দিন ত্রিবেণীতে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও ছাত্রদের ব্যয়ভার বহন করার জন্য সুব্যবস্থা করেছিলেন। বাঘার মাদ্রাসার জন্য ৪২টি গ্রাম দান করা হয়েছিল। শিক্ষা ছাড়াও ছাত্ররা বিনা খরচে আহার, বাসস্থান, কাপড়-চোপড়, তেল, প্রসাধনী দ্রব্যাদি এবং মূল গ্রন্থ ব্যবহারের প্রয়োজনে পাণ্ডুলিপি কল করার জন্য দরকারী জিনিসপত্রসহ সবকিছু পেতো। বীরভূমের বিদ্যালয়গুলোর কথা উল্লেখ করে মিঃ এডাম বলেন যে, এগুলো ধর্মীয় দানের দ্বারা পরিচালিত হতো এবং বিনা খরচে ছাত্রদের শিক্ষা, আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বৃত্তি লাভ করতো। ব্রিটিশ সরকারের লাখেরাজ বাজেয়াপ্তির বিবরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে মুসলমান শাসনামলে, ধর্মীয় ও শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মপ্রাণ ও বিদ্বান ব্যক্তিদের জন্য অসংখ্য নিষ্কর জমির ব্যবস্থা ছিল।
মিঃ এডাম তাঁর রিপোর্টে বর্ণনা দেন যে, সম্পদশালী মুসলমানগণ ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য তাদের গৃহে শিক্ষক রাখতেন এবং বিনা খরচে স্থানীয় গরিব ছেলেমেয়েরা তাদের নিকট শিক্ষালাভ করতো। তিনি লিখেছেন, “পাণ্ডুয়ায় কোনো কোনো প্রসিদ্ধ স্থানে প্রতিবেশী গরিব ছেলেমেয়েদের উপকারার্থে মুসলমান জমিদারগণ নিজেদের খরচে শিক্ষক রাখতেন বলে জানা যায়। একজন ধনী গৃহস্থ বা গ্রাম্য প্রধান শিক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহে শিক্ষকের ব্যবস্থা করেননি, এ রকম দৃষ্টান্ত প্রায় বিরল বলা যায়।” মিঃ এডাম মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পতন যুগের শিক্ষার অবস্থা বর্ণনা করেছেন। মুসলমানদের রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যুগে তাদের শিক্ষার অবস্থা নিশ্চয়ই আরো উন্নত ছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
কুরআন, হাদিস, ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র ও অন্যান্য ইসলামি বিষয়াদি মাধ্যমিক পাঠ্য-তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। লোকায়ত সাধারণ বিজ্ঞান, যেমন- যুক্তিবিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতিবিদ্যা, জ্যামিতি এবং অন্যান্য বিষয়ও মাদ্রাসায় পড়ান হতো। পাঠ্য তালিকার কথা বলতে গিয়ে আবুল ফজল লিখেছেন, “প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই নীতিশাস্ত্র, গণিত, কৃষি, পরিমাপ শাস্ত্র, জ্যামিতি, জ্যোতিষশাস্ত্র,
চরিত্র-নির্ণয়বিদ্যা, গার্হস্থ্যবিদ্যা, সরকারি আইন-কানুন, চিকিৎসাবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, উচ্চতর অঙ্কশাস্ত্র, বিজ্ঞানসমূহ, ইতিহাস ইত্যাদি পাঠ করা উচিত; এসবগুলোর প্রত্যেকটি বিষয়ই ক্রমে ক্রমে আয়ত্ত করা যেতে পারে। আবুল ফজলের বক্তব্য দৃষ্টে মনে হয় যে, ঐ সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ সমস্ত বিষয়গুলো শিক্ষা দেয়া এবং ছাত্রদেরকে পাঠ্য বিষয় নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হতো। একজন ছাত্রকে উপরোক্ত সবগুলো বিষয়ই পড়তে হতো না, বরং নির্বাচিত কয়েকটি বিষয় তাকে পড়তে হতো। প্রকৃতপক্ষে, আবুল ফজল সম্রাট আকবরের মতামতই প্রকাশ করেছেন যে, প্রত্যেক ছাত্রেরই উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে এই সমস্ত বিষয় শিক্ষা করা উচিত।
আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্য-তালিকা বিস্তৃত ও ভারী ছিল। সম্রাট আকবর পাঠ্যতালিকার ক্ষেত্রে আরো উন্নত ও উচ্চমানের কর্মসূচি প্রবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ইউরোপীয় পর্যটক বার্নিয়ার ও মানুচি সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রাক্তন শিক্ষক মোল্লা সালিহর সঙ্গে সম্রাটের একটি চমকজন বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেন যে, সম্রাট ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সরকারি কৌশল প্রভৃতি পাঠের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। যদিও সম্রাট আওরঙ্গজেব ও মোল্লা সালিহর সাক্ষাৎকার সন্দেহজনক, কেননা, তিনি যে কখনো যুবরাজ আওরঙ্গজেবের শিক্ষক ছিলেন, এ রকম কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই; তাথাপি এ দু'জন সমসাময়িকের ভাষণ থেকে বুঝা যায় যে, সে যুগের মুসলমান শাসকগণ ইতিহাস ও রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয় অধ্যয়নের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতেন ।
ভারত উপমহাদেশের মুসলমানরা বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি ও পাঠ্য-তালিকাসমূহ এখানে প্রবর্তন করেন। তারা প্রয়োজন অনুযায়ী কিছুটা রদবদল করে কিংবা না করেই মাদ্রাসা শিক্ষায় সর্বত্র তা অনুসরণ করেন। বাংলার মুসলমান শাসনকর্তাগণ ও উলেমা সম্প্রদায়, যারা এই একই শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষালাভ করেছিলেন স্বভাবতঃই তাঁরা তা বাংলাদেশেও প্রবর্তন করেন। বোখারা থেকে আগত শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁও শিক্ষাকেন্দ্রে তার ছাত্রদেরকে ধর্মীয় ও সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুসলিম শাসনামলে এ প্রদেশে পীর-দরবেশ, উলেমা ও শিক্ষকদের অধিকাংশই আরব ও পারস্য থেকে এসেছিলেন।
উচ্চশিক্ষা পর্যালোচনা করতে গিয়ে এটা উল্লেখযোগ্য যে, এ উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের মতো বাংলাদেশের মাদ্রাসাসমূহে রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র ও লোকায়ত বিজ্ঞান বিষয়াদি শিক্ষা দেয়া হতো। এই প্রদেশে ‘গ্রিক' ও ‘ইরানী’ চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যয়ন করা হতো এবং এই শাস্ত্রমতে চিকিৎসা চালান হতো। ‘শফরনামা' গ্রন্থে আমির সাহাবুদ্দিন হাকিম কিরমানী নামক চতুর্দশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি ‘চিকিৎসকদের গৌরব' আখ্যায় আখ্যায়িত হয়েছে। সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ চিকিৎসাবিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। মীর্জা নাথনের সময়ে কবিরাজ শ্রেণির চিকিৎসক ছাড়াও, বহু চিকিৎসককে এই প্রদেশে চিকিৎসা ব্যবসায় নিয়োজিত দেখা যায়। বাহারিস্থানের লেখক বলেন যে, তার পিতা ইহতিমাম খান ঘোড়াঘাটে দারুণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার নিরাময়ের জন্য বহু চিকিৎসক ডাকা হয়। মুহাম্মদ সাদিকের 'সুব-ই-সাদিক' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী মীর আলাউল মুলক চিকিৎসাবিদ্যা ও অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয়াদিতে পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন এবং উল্লিখিত গ্রন্থাকারের সময়ে তিনি জাহাঙ্গীর নগরের অধিবাসী ছিলেন।
গোলাম হোসেন তাবাতাবাঈ বাংলার নবাবদের আমলের অনেক চিকিৎসকের নামোল্লেখ করেছেন। হেকিম তাজউদ্দিন ছিলেন সেই আমলে একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক। অবশ্য ঐ যুগের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ছিলেন নবাব আলিবর্দী খানের দরবারের চিকিৎসক হেকিম হাদী আলী খান। তিনি হাশেমীয় বংশের লোক ছিলেন এবং ইস্পাহান থেকে এদেশে আগমন করেন। গোলাম হোসেনের ভাষায় হেকিম হাদী খান ছিলেন চিকিৎসকদের প্রতীক ও পূর্ণ রূপ, দার্শনিক ও শারীরবিদ্যার জ্ঞানভাণ্ডার, তার সময়ের গ্যালেন।” তিনি আরো বলেন, “এটা স্বীকার করতেই হবে যে, এই (প্লেটো হেকিম হাদী আলী খান) হযরত ঈসার মতো রোগমুক্ত করার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং রোগ নিরাময় করার ব্যাপারে সে যুগে তার সমকক্ষ আর কেউ ছিল না ।
ইউরোপীয় পর্যটনকারীদের বর্ণনা থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যবহারের ও রোগ- নিরাময়ের ক্ষেত্রে মুসলমান চিকিৎসকদের দক্ষতা সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। বার্নিয়ার স্বয়ং সপ্তদশ শতকের ইউরোপীয় পদ্ধতির একজন চিকিৎসক ছিলেন; তিনি এ উপমহাদেশের মুসলমান চিকিৎসকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং শব- ব্যবচ্ছেদ বিদ্যায় হিন্দুদের অজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি বলেন যে, আবু সিনাহ ও ইবনে রুশদ এর পদ্ধতি প্রয়োগ করে ব্যাধিদুষ্ট স্থান থেকে প্রচুর রক্তপাত ঘটানোর অনুশিক্ষা মুসলিম চিকিৎসকগণ গ্রহণ করেছিলেন এবং ফলে গ্যালেনের পদ্ধতি অনুযায়ী প্রায় অঙ্কুরেই রোগ বিনাশের ব্যবস্থা হতো। হিন্দু চিকিৎসকগণ মাংস ভক্ষণের ব্যাপারে বিরত থাকার উপর জোর দিতেন এবং শুধু বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে রক্তপাত ঘটাতেন। বার্নিয়ার আরো বলেছেন, “হিন্দু চিকিৎসকেরা কখনো মানুষ কিংবা পশুর দেহ কেটে উন্মোচন করেননি। দেহের ভিতরে কিভাবে রক্ত চলাচল করে এবং পেফকুয়েত (pefquet) কর্তৃক আবিষ্কৃত নালী (vessels) সমূহের ভিতর দিয়ে কেমন করে অম্লরস (Chyle) দক্ষিণ হৃদপ্রকোষ্ঠে প্রবাহিত হয় ইত্যাদি এসব কিছু আমার ‘আগা’কে বুঝাবার জন্য যখনই আমি কোনো জীবন্ত ছাগল বা ভেড়ার দেহচ্ছেদ করেছি, তখনো বাড়ির হিন্দু-চিকিৎসকেরা ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেছেন।” বার্নিয়ারের মতে যদিও মুসলিম চিকিৎসকেরা চিকিৎসাক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের নতুন নতুন আবিষ্কারের কথা জানতেন না, তথাপিও প্রথম মুসলিম যুগের দার্শনিক ও চিকিৎসক ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ প্রদর্শিত পদ্ধতিতে রোগের চিকিৎসা ও নিরাময়ে তাঁরা যথেষ্ট সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।
বার্নিয়ার ভারতের মুসলিম চিকিৎসকদের সম্বন্ধে সাধারণভাবে এই মন্তব্য প্রকাশ করেন। সুতরাং এটা সমানভাবে বাংলার মুসলিম চিকিৎসকদের প্রতিও প্রযোজ্য। চিকিৎসাশাস্ত্র অনুশীলনে এবং রোগচিকিৎসার ক্ষেত্রে তারা ইবনে সিনাহ ও ই রুশদ-এর পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। মিঃ এডাম এমনকি উনিশ শতকের প্রথম দিকেও বাংলা মাদ্রাসাগুলোতে চিকিৎসা-শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে দেখেছেন। তিনি আরো ব করেন যে, ইসলামি বিষয়াদি ছাড়াও প্রকৃতি বিষয়ক দর্শন ও সাধারণ দর্শন শাস্ত্রের গ্রন্থাদির সঙ্গে অনূদিত ইউক্লিডের ক্ষেত্রবিদ্যা (geometry) এবং টলেমীর জ্যোতিষশাস্ত্র কিছু সংখ্যক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করা হতো। 'টোপে' অনু
পাঠ্যতালিকার সঙ্গে তুলনা করে এডাম মন্তব্য করেন যে, মুসলমানদের অনুসৃত পাঠ পদ্ধতি বাংলার বিদ্যালয়সমূহে (টোল) প্রচলিত বিষয়গুলো অপেক্ষা অধিক ব্যাপক ও উদার ছিল এবং এই তালিকানুসারে শিক্ষিত ব্যক্তিরা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]