বাংলার মুসলিম শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ Muslim Education Centers in Bengal

জ্ঞানার্জনে মুসলমানদের গভীর অনুরাগ, ইসলামি শিক্ষার উন্নয়নে শেখ উলেমার উদ্যম, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান শাসনকর্তাদের পণ্ডিত, কবি, বিশ্বান ব্যক্তি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি উদার পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদির ফলে বাংলাদে
উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ আসে। শহর ও প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলো উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মসজিদগুলোকে কেন্দ্র করে বহু মাদ্রাসা গড়ে উ সুলতান ও আমির-ওমরাহ্ মাদ্রাসা স্থাপন ও এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত অর্থ প্রদর্শন করেন এবং প্রচুর দানের ব্যবস্থা করেন। এমন কি খ্যাতনামা আলেমগণ মাদ্রাসা এবং শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত সুফি-পণ্ডিতদের কয়েকটি 'খানকা শিক্ষার এক একটি উজ্জ্বলকেন্দ্রে পরিণত হয়।
এটা উল্লেখযোগ্য যে কয়েকটি ‘খানকাহ্’ উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র ছিল। এ ব্যাপার বাংলাদেশে কিংবা এ উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে, প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মতাত্ত্বিক উলেমা এবং মরমীবাদী সুফিদের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থব লি না। উভয় শ্রেণির ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দ শিক্ষার প্রতি সমান গুরুত্ব আরো করতেন। হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়া ও শেখ আলী সিরাজউদ্দিন উসমানের দৃষ্টান্ত থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। অবশ্য এটা বলাও সঙ্গত নয় যে, ঐ সময়ের সুফির ‘শরিয়ত’ সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেছেন এবং নিজেদেরকে সর্বতোভাবে ‘মারিফাতে সমর্পণ করে দিয়েছেন। প্রায় সকল সুপরিচিত সুফিরা, যেমন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, মাওলানা শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা, মখদুম শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী, শেখ আলাউল হক ও হযরত নূর কুতব আলম পারিবারিক জীবনযাপন করেছেন এবং রাষ্ট্রে ও সমাজে যাতে কুরআন ও সুন্নাহর বিধি-নিষেধগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় সেদিকে তাদের লক্ষ্য ছিল। এজন্য শাসনের উচ্চ ও দায়িত্বপূর্ণ পদে হিন্দুদের নিয়োগের বিরুদ্ধে শেখ আলাউল হক সিকান্দর শাহের নিকট প্রতিবাদ জানিয়েছেন। হযরত মুজাফফার শামস্ বলখীও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর নীতি অনুসরণের জন্য উপদেশ দিয়েছেন এবং শাসনের দায়িত্বপূর্ণ কাজে অমুসলমানদেরকে বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন। অবশ্য এটাও উল্লেখযোগ্য যে, বিখ্যাত সুফিদের অনেকেই ঐ যুগের প্রসিদ্ধ আলেমও ছিলেন এবং তারা তাদের বিদ্যাবত্তার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অধিকন্তু, যখন তাঁরা তাঁদের শিষ্যদের আধ্যাত্মিক জীবনের অগ্রগতির জন্য নিয়োজিত থাকতেন, তখন একই সময়ে আবার তাঁরা লোকদের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। পরবর্তী আলোচনায় এ সত্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা তথা ভারতের অন্যান্য অংশে সুফি ও উলেমার মধ্যকার ব্যাপক পার্থক্য আরো পরবর্তীকালের সৃষ্টি। এটা ষোড়শ শতকে শুরু হয়-
যখন সুফিবাদ হিন্দু অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনের প্রভাবে পতিত হয় এবং বহু অশিক্ষিতি ব্যক্তি বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন রকম ভাবধারা আমদানি করে তা সুফিতত্ত্ব বলে চালিয়ে দিতে শুরু করে। বাংলার বাউলরা পথভ্রষ্ট সুফিদের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বহন করছে। বাস্তবিকই প্রথম যুগের সুফিগণ, যাদের অধিকাংশই উলেমা ছিলেন, তারা বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে শাসনকর্তা, উলেমা, পীর-দরবেশ, এবং অভিজাত ও অবস্থাপন্ন মুসলমানদের আগ্রহ ও উৎসাহের ফলে বহু সংখ্যক মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল । এসব প্রতিষ্ঠান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১. লক্ষ্মণাবতী (গৌড়) : বাংলার মুসলিম বিজয়ের সময় থেকে, গৌড় নামে সুপরিচিত লক্ষ্মণাবতী বঙ্গদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে উন্নীত হয়। তাবাকাত-ই-নাসিরী প্রণেতা মিনহাজ থেকে জানা যায় যে, মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং তিনি শেখ ও উলেমাকে সাধ্যমত সাহায্য করেন। তাঁর এই মহান দৃষ্টান্ত প্রদেশের পরবর্তী শাসকর্তাদের দ্বারা অনুসৃত হয়। কয়েকটি মাদ্রাসা ভবনের ধ্বংসাবশেষ মুসলিম বাংলার প্রথম যুগের রাজধানী শহরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, গিয়াসউদ্দিন আওয়াজ খলজি ( ১২১২-২৭ খ্রি.) লক্ষ্মণাবতীতে একটি সুন্দর মসজিদ, একটি মহাবিদ্যালয় এবং একটি সরাইখানা নির্মাণ করেন। তিনি শিক্ষায় উৎসাহ দেন এবং বিদ্বান ব্যক্তিদেরকে প্রচুর পরিমাণ বৃত্তিদান করেন। প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক জরিপের ফলে, গৌড় অঞ্চলে ওমরপুর গ্রামের সন্নিকটে ‘দরাসবাড়ী' নামক স্থানে একটি মাদ্রাসার নিদর্শন পাওয়া গেছে। 'দরাসবাড়ী' নামের অর্থ পাঠশালা, তাছাড়া দালানটির পরিকল্পনা দৃষ্টে মনে হয়, এটি মুসলমান আমলের একটি মাদ্রাসা ছিল। একই অঞ্চলে 'দরাসবাড়ী' মসজিদ নামে পরিচিত একটি মসজিদও বিদ্যমান। বড় ও ভারী ওজনের একটি উৎকীর্ণ শিলালিপি ঐ স্থানে পাওয়া গেছে। এতে ৮৮৪ হিজরি (১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দ) সুলতান শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ কর্তৃক একটি ‘জাম-ই-মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ আছে। এই মসজিদ ‘দরাসবাড়ী মসজিদ' নামে পরিচিত। ফলে, সেখানে যে একটি মাদ্রাসা ছিল তার সমর্থন পাওয়া যায়। এই মসজিদটি মাদ্রাসার বহু সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষকদের জুমার নামাজ পড়ার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল।
গৌড়ের ছোট সাগর-দিঘির পার্শ্বে একটি বড় দালানের ধ্বংসাবশেষ থেকে মুসলমান শাসনকর্তাদের রাজধানী শহরে আর একটি মসজিদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। স্থানীয় একটি জনশ্রুতি অনুসারে দালানটি 'বেলবাড়ী মাদ্রাসা' নামে পরিচিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৃহ ছিল। মাদ্রাসাসমূহ কেবল রাজধানী শহরেই গড়ে ওঠেনি; এর নিকটবর্তী প্রধান প্রধান স্থান এবং শহরের উপকণ্ঠেও যে মাদ্রাসা শিক্ষার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল, তার বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। মালদহের আধুনিক ‘ইংলিশ বাজারের’ একটি মসজিদের গায়ে ৯০৭ হিজরি/১৫০২ খ্রিস্টাব্দের একটি উৎকীর্ণ শিলালিপি অনুসারে, “ধর্মবিজ্ঞান শিক্ষাদান এবং যা সত্য কেবল সেই মতবাদ অনুসরণের উপদেশ দান” করার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ একটি চমৎকার মাদ্রাসা নির্মাণ করেন।
মুসলিম বিজয়ের প্রারম্ভকাল থেকে কয়েকটি মাদ্রাসা স্থাপন, একটি শিক্ষিত সংস্কৃতি সম্পন্ন অভিজাত শ্রেণির অস্তিত্ব এবং বহু উলেমা, পীর দরবেশ, ধর্ম
শিক্ষকদের সমাগম ইত্যাদির ফলে স্বভাবতই লক্ষ্মণাবতীতে শিক্ষাদীক্ষার উদ্দীপনা পরি হয়েছিল এবং এই রাজধানী শহর মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কে উন্নীত হয়েছিল। এমন কি মুসলিম শাসনের প্রথম পর্যায়েও শিক্ষা ও সংস্কৃতির কে হিসেবে এর খ্যাতি কামরূপের হিন্দু রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছেছিল এবং এটা ি জ্ঞানান্বেষণকারীদের আকৃষ্ট করেছিল। এভাবেই হিন্দু অতীন্দ্রিয়বাদী ও বের
দার্শনিকগণ এখানে আসেন; এদের মধ্যে ছিলেন ভোজের ব্রাহ্মণ ও অন্তনাথ।
জন আলী মর্দন খলজির রাজত্বকালে আগমন করেন এবং এই ব্রাহ্মণের সঙ্গে মুসলমান পণ্ডিত কাজী রুকনউদ্দিন সমরকন্দীর ধর্মীয় ও দার্শনিক আলোচনা হয়। ফলে, ি ইসলামের উচ্চতর ভাবধারা অনুধাবন করে মুসলমান হয়ে যান। বেদান্ত ব্রাহ্মণ অম্ভুনাথের বেলায়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ভোজের ব্রাহ্মণের সাহায্যে মুসলিম পণ্ডিতগণ সংস্কৃত থেকে হিন্দু দর্শন ও অতীন্দ্রিয়বাদের উপর লিখিত “অমৃত কালো অনুবাদ করে আরবি ও ফারসি ভাষায়। এ ধরনের ধর্মীয় ও দার্শনিক আলোচনা এক হিন্দু অতীন্দ্রিয় বিষয়ক গ্রন্থের অনুবাদ ইত্যাদি বাংলার মুসলিম রাজধানীর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবনে একটি সুদূর-প্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর দ্বারা লক্ষ্মণাবতীয়ে মুসলমানদের উচ্চপর্যায়ের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিচয় বিধৃত হয়েছে। এতে অন্যান জাতির জ্ঞান সম্বন্ধেও বাংলার মুসলমান পণ্ডিতদের অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ পেয়েছে।
কাজী রুকনউদ্দিন সমরকন্দী ছাড়াও লক্ষ্মণাবতীতে অন্যান্য বহু পণ্ডিত তাদের জ্ঞানানুরাগ প্রদর্শন করেন। সুবিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা মিনহাজ দু'বছর কাল (১২৪২-৪৪ খ্রিঃ) বাংলার এই রাজধানীতে বসবাস করেন। খ্যাতনামা ধর্মতাত্ত্বিক জালালউদ্দিন গজনবীও এই শহরে কয়েক বছর অবস্থান করেন এবং সুলতান গিয়াসউদ্দিন আওয়াজ খলজির সভাকক্ষে ভাষণ দান করেন। বিশিষ্ট কবি ও পণ্ডিত শামসউদ্দিন দবীর এবং কাজী আসির নাসির উদ্দিন বুগরা খানের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন।
২. মহিসুন : বর্তমানে মহিসনতোষ নামে পরিচিত রাজশাহী জেলার অন্তর্গত মহিসুন ছিল মুসলমানদের প্রথম যুগের অন্যতম জ্ঞানকেন্দ্র। মাওলানা তকিউদ্দিন আরাবী নামে বিখ্যাত পণ্ডিত এখানে একটি জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র পরিচালনা করেন। তার পাণ্ডিত্য-খ্যাতি ও আলোচনাচক্রের সুনাম ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্ডিত ও ছাত্রদের আকৃষ্ট করতো। বিখ্যাত সুফি-পণ্ডিত মখদুম শরফউদ্দিনের পিতা এহিয়া মানেরী মাওলানা তকিউদ্দিন আরাবীর মহিসুন শিক্ষাকেন্দ্র থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। এ তথ্য মখদুম শরফউদ্দিন মানেরীর জ্ঞাতিভ্রাতা শাহ শো'য়েব কর্তৃক রচিত 'মানাকির আল-আসফিয়া' থেকে জানা যায়। এতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ত্রয়োদশ
শতকের মধ্যভাগে মহিসুন উচ্চশিক্ষার একটি কেন্দ্র ছিল ।
৩. সোনারগাঁও
: অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী মাওলানা শরফউদ্দিন আৰু
তাওয়ামার অধীনে কিভাবে সোনারগাঁও একটি ইসলামি শিক্ষার পাদপীঠরূপে গড়ে উঠে, তা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। মাওলানা শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা বোখারায় জন্মগ্রহণ করেন এবং খোরাসানে শিক্ষালাভ করেন। তিনি তাঁর পত চরিত্র ও অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সমগ্র পশ্চিম এশিয়া ও ভারতে সুপরিচিত ছিলেন। হানাফী ফিকাহ- শাস্ত্রবিদ ও মুহাদ্দিস মাওলানা শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা ইসলাম-বিষয়ক জ্ঞানে এবং সাধারণ বিজ্ঞানে, যেমন রসায়নবিদ্যা, প্রকৃতি-বিজ্ঞান ও যাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের বিরাট খ্যাতি নিয়ে তিনি দিল্লিতে আগমন করেন এবং সকল শ্রেণির মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেন ও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। অবশ্য তদানীন্তন সুলতানের (গিয়াসউদ্দিন বলবন) ঈর্ষার দরুন মাওলানা তদীয় ভ্রাতা মাওলানা হাফিজ জইনউদ্দিন ও পরিবার-পরিজন সমভিব্যাহারে বাংলায় যেতে বাধ্য হন। পথে তিনি কিছুদিনের জন্য মানেরে অবস্থান করেন। মাওলানা আবু তাওয়ামার অগাধ পাণ্ডিত্য তরুণ শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরীকে তাঁর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট করে এবং আবু তাওয়ামার অধীনে জ্ঞানলাভের উদগ্র বাসনা নিয়ে মানেরী সোনারগাঁয়ের পথে মাওলানার সঙ্গী হন। মাওলানা আবু তাওয়ামা সোনারগাঁয়ে বসতি স্থাপন করেন এবং সেখানে খানকাহ্ ও শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সুফি ও পণ্ডিত হিসেবে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার ফলে ভারতের সর্বত্র থেকে বহু শিষ্য ও ছাত্র তার নিকট আগমন করেন। ঐ যুগের এই বিখ্যাত পণ্ডিতের অধীনে ধর্মতত্ত্ব ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষারও অনুশীলন করা হতো। এর ফলে, সোনারগাঁও শুধু বঙ্গদেশেই নয়, সমগ্র ভারতেও শিক্ষার একটি প্রদীপ্ত কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করে। এখান থেকে বহু বিখ্যাত পীর-দরবেশ ও পণ্ডিত ব্যক্তির আবির্ভাব হয়। খ্যাতনামা সুফি-পণ্ডিত মখদুম শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরী ছিলেন মাওলানা আবু আওয়ামার সোনারগাঁও শিক্ষাকেন্দ্রের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। শতকের শেষপাদে শিক্ষাকেন্দ্ররূপে সোনারগাঁও বাংলাদেশের গৌরব ছিল। ‘মাকামাত' ও ‘নাম-ই-হক’-এর মতো জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ এবং শরফউদ্দিন এহিয়া মানেরীর মতো খ্যাতিমান শিষ্য মাওলানা আবু তাওয়ামার অগাধ পাণ্ডিত্য ও বিদ্যবত্তার সাক্ষ্য দেয়। মাওলানা আবু তাওয়ামা ও শরফউদ্দিন মানেরী একইভাবে বাংলার মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের গৌরব ছিলেন। বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক কৃতিত্বের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবু তাওয়ামা ৭০০ হিজরি/ ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এবং সোনারগাঁয়ে সমাধিস্থ হন।
সোনারগাঁও বাংলার প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্ররূপে এর বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের ঐতিহ্য অব্যাহত রাখে পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত সুফি ও পণ্ডিত শেখ আলাউল হক তাঁর নির্বাসনের সময়ে দু'বছর এখানে অবস্থান করেন। একইভাবে তাঁর পৌত্র শেখ বদর-ই-ইসলাম এবং প্রপৌত্র শেখ জাহিদী তাঁদের নির্বাসনকালে এখানে অতিবাহিত করেন। প্রসিদ্ধ সাধুপুরুষ ও বিদ্বান ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে স্বভাবতই সোনারগাঁয়ে ইসলামি শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার উদ্দীপনা অব্যাহত থাকে। নুসরৎ শাহের রাজত্বকালে ৯২৯ হিজরি (১৫২৩ খ্রিস্টাব্দ) সোনারগাঁয়ের একটি মসজিদে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে আয়েনউদ্দিনের পু মসজিদ নির্মাতা তাকিউদ্দিনকে একজন প্রসিদ্ধ ইসলামি আইনজ্ঞ ও মুহাদ্দিস, ফিকাহ, ও হাদিস শিক্ষাদাতাদের প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায় যে, I
সোনারগাঁও তার বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য ষোড়শ শতক পর্যন্ত অব্যাহত রাখে ।
-
৪. সাতগাঁও : মুসলিম-বিজয়ের সময় থেকে সাতগাঁও শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের কেন্দ্রে উন্নীত হয়। সাতগাঁয়ের ত্রিবেণীতে দুটো মাদ্রাসা স্থাপনের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি সুলতান রুকনউদ্দিন কাইকাউসের রাজত্বকালে ৬৯৮ হিজরিতে (১২৯৩ খ্রিস্টাব্দ) কাজী আল-নাসির মুহাম্মদ কর্তৃক নির্মিত হয়। তিনি একটি মাদ্রাসা তৈরির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন এবং এই ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থী শিক্ষকদের ব্যয় নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সাহায্যোর ব্যবস্থা করেন। মাদ্রাসার উৎকীর্ণ-লিপি মুসলমানদেরকে তাদের জীবনে জ্ঞানের গুরুত্ব সম্বন্ধে রসূলের বাণী স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে এর নির্মাতাকে যে উচ্চাদর্শ অনুপ্রাণিত করেছিল তা প্রকাশ পায়। জাফর খান কর্তৃক সুলতান শামসুদ্দিন ফিরুজ শাহের রাজত্বকালে ৭১৩ হিজরিতে (১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে) এই অঞ্চলে আর একটি মসজিদ নির্মিত হয়। এ মাদ্রাসা দারুল খায়রাত' নামে অভিহিত হয়। এ দুটো মাদ্রাসা সাতগাঁও অঞ্চলে ইসলাম বিষয়ক শিক্ষা ও জ্ঞানবিস্তারে সহায়তা করে এবং ঐ এলাকার মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. নগোর : বীরভূম জেলার অন্তর্গত নগোর ছিল পশ্চিম বাংলার আর একটি শিক্ষাকেন্দ্র। ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন' অনুসারে, সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ও বিখ্যাত সুফি পুরুষ হযরত নূর কুতব আলম বাল্যবয়সে নগোরের হামিদউদ্দিন কুঞ্জনসীনের (কোনো উপবেশনকারী) নিকটে শিক্ষলাভ করেন।
৬. মান্দারন : মান্দারন (বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর), আরো পূর্বের না হলেও, অন্তত সুলতান হোসেন শাহের আমল থেকে একটি ইসলামি শিক্ষা-কেন্দ্রে উন্নীত হয়। ৯০৭ হিজরি/ ১৫০২ খ্রিস্টাব্দের একটি উৎকীর্ণ লিপি সুলতান হোসেন শাহের আদেশে মান্দারনে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করে। মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাকাল স্মরণীয় করে রাখার জন্য উৎকীর্ণ শিলালিপির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
৭. পাণ্ডুয়া : নানা কারণে পাণ্ডুয়া এ উপমহাদেশে শিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ স্থানটি আধ্যাত্মিক জীবনের একটি বিখ্যাত কেন্দ্র ছিল। শেষ জালালউদ্দিন তাবরিজী, শেখ আখী সিরাজউদ্দিন উসমান, শেখ আলাউল হক, শেখ নূর কুতব আলম, শেখ জাহিদ ও অন্যান্য আরো বহু সুফি পণ্ডিত, উলেমা ও শিক্ষকদের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক কার্যাবলির কেন্দ্র ছিল এই পাণ্ডুয়া । ইলিয়াস শাহ, জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ, রুকনউদ্দিন বারবক শাহ, শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ ও
জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের মতো শিক্ষিত ও জ্ঞানী মুসলমান শাসকদের রাজধানীও ।
৯. রংপুর : ফিরিস্তা অনুসারে রংপুর মুসলিম বিজয়ের সময় থেকে মুসলমানদের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল । প্রথম বিজয়ীর কথা বলতে গিয়ে ফিরিস্তা লিখেছেন, “তিনি নদীয়ার পরিবর্তে রংপুর নামে একটি শহর নির্মাণ করেন এবং একে তিনি তার রাজধানী করেন। ইসলামের ইতিহাসে যা, সাধারণত হয়েছে সে নীতি অনুসরণ করে তিনি এই শহর ও অঞ্চলে মসজিদ, খানকাহ্ ও মাদ্রাসা দিয়ে সজ্জিত করেন।" ফিরিস্তাকে সমর্থনের এ রকম কোনো সমসাময়িক প্রমাণ নেই যে, মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। রংপুরে তার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সমসাময়িক সকল ঐতিহাসিকরাই লক্ষ্মণাবতীকে তাঁর রাজধানীরূপে উল্লেখ করে গেছেন। মিনহাজের বর্ণনা থেকে। দেবকোট খলজি সেনাপতির রাজধানী ছিল বলে ধরে নেয়া যেতে পারে, বিশেষত তার। সর্বনাশা তিব্বত অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে।
যদিও ফিরিস্তার সাক্ষ্য অনুসারে রংপুরকে রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করা যায় না, তথাপি এটা অবশ্য সম্ভব যে, মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার কর্তৃক সেখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । লক্ষ্মণাবতী নামটি কেবল রাজধানীর জন্যই নয় বরং সমগ্র উত্তরবঙ্গ অর্থে এটা ব্যবহৃত হতো। এভাবে রংপুর লক্ষ্মণাবতীর অন্তর্ভুক্ত। ‘তারকৎ-ই- নাসিরী'তে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার ও তার আমির ওমরাহ কর্তৃক লক্ষ্মণাবতীতে (এলাকায়) একাধিক মাদ্রাসা স্থাপনের বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। এতে অনুমিত হয় যে, ঐ সময়ে রংপুরে একটি মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছিল। মুসলমান আমলে ঘোড়াঘাট নামে পরিচিত রংপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ও ফৌজদার বা বিভাগীয় সেনানায়কের সদর দপ্তর ছিল। মুজাহিদ যোদ্ধা শাহ ইসমাইল গাজীর সঙ্গে সম্বন্ধ থাকায় ঘোড়াঘাট বিশেষ স্মরণীয় হয়ে আছে; তিনি সুলতান বারবক শাহের রাজত্বকালে ঐ স্থানের সেনাপতি ছিলেন। শহীদ হওয়ার পর তিনি ঘোড়াঘাট এলাকায় সমাধিস্থ হন। তাঁর সমাধিসৌধ লোকের তীর্থস্থান ছিল। এটা খুবই সম্ভব যে, সেখানকার মুসলমান পরিবারগুলোর প্রয়োজনার্থে এই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।
১০. চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাংলার বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর হিসেবে এর গুরুত্ব প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম বসতি স্থাপনের সময় থেকে এটা একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে সে যুগে চট্টগ্রাম একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। উচ্চপর্যায়ের একজন সেনাপতি এর শাসনকর্তা নিযুক্ত হতেন। একটি সমৃদ্ধ মুসলিম জনসংখ্যা ও উচ্চপদস্থ রজকর্মচারী অধ্যুষিত বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামে নিশ্চয়ই মাদ্রাসা অত্যাবশ্যক ছিল। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের প্রমাণাদি থেকে জানা যায় যে, শাসনকর্তা ও রাজকর্মচারীগণ উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কৃতি সম্বন্ধেও আগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। তারা তাদের দরবারে সাহিত্যসভা করতেন এবং সংস্কৃত ভাষা থেকে মহাভারতের বাংলা অনুবাদে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
264
বাংলায় শিক্ষা : সুলতানি ও মুঘল আমল
অধিকন্তু, চট্টগ্রামে বিপুল সংখ্যক পণ্ডিত ও কবিদের আবির্ভাব ঘটে। এ দৌলত উজীর বাহরাম খান, সাবিরিদ খান, সৈয়দ সুলতান, মুজাম্মিল, আফজাল আলী, মুকিম, শেখ মুত্তালিব, মুহাম্মদ খান, দৌলত কাজী ও আলাওলের নাম উল্লেখ করা। যেতে পারে। বাংলা ভাষায় রচিত তাঁদের কাব্যগ্রন্থরাজিতে আরবি, ফারসি সাহিত্য ও ইসলামি বিষয়াদিতে তাদের গভীর জ্ঞান প্রতিফলিত হয়েছে। এ থেকে ধারণা হয় যে,
মুসলমান আমলে চট্টগ্রাম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থান ছিল ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]