বাংলায় হিন্দু শিক্ষার প্রসার Expansion of Hindu Education in Bengal বাংলায় হিন্দু শিক্ষার স্তর
Stratification of Hindu Education in Bengal

মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার প্রভাবে শিক্ষার প্রতি হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সূচিত হয়। মুসলমানদের পূর্বে, বাংলাদেশে শিক্ষা প্রধানত, ব্রাহ্মণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং যে কোনো প্রকারের জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণগণ তাদের শাস্ত্রজ্ঞানের চর্চায় একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতেন। সুতরাং, শ্রীচৈতন্য যখন সকল শ্রেণির সাম্য ও সকলের জন্য সমান সুযোগ অবারিত ঘোষণা করলেন, ব্রাহ্মণগণ বৈষ্ণব গুরুর প্রি খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন এবং মুসলমান শাসকের নিকট চৈতন্যের বিরুদ্ধে নালিশ জানালেন। তারা শ্রীচৈতন্যের প্রচারিত মতবাদ ধর্মবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে বলেন, “চৈতন্য প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদীদের উত্তেজিত করে হিন্দুধর্মের সর্বনাশ করছেন। নিম্নশেণির লোকেরা কৃষ্ণের নাম সংকীর্তন করছে। এ পাপ (অধর্মের কাজ) নবদ্বীপের সর্বনাশ করবে। এটা সত্য যে, হিন্দুশাস্ত্রে ভগবানের নাম একটি যাদুমন্ত্র বিশেষ, কিন্তু প্রত্যেকেই যদি, একথা জানে, তাহলে এর ঈন্সিত ফলদানের ক্ষমতা লোপ পাবে।” মুসলমান শাসন প্রবর্তিত হওয়ার দরুন সুবিধাভোগী হিন্দুদের কবল থেকে ভাগ্যাহত ও বঞ্চিত হিন্দুরা মুক্তিলাভ করে এবং চিরকালের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। মুসলমান শাসনাধীনে অব্রাহ্মণদের পক্ষে শিক্ষা গ্রহণে ব্রাহ্মণদের অসন্তুষ্টি উৎপাদনের আর কোনো ভয় ছিল না। কেন না, এই শাসনব্যবস্থা মুসলমান অমুসলমান, উচ্চনিচ সর্বশ্রেণির লোকের নিকট পার্থিব, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির জন্য সমান সুযোগ এনে দেয়। এভাবে মুসলমান আমলে হিন্দু সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মধ্যেও শিক্ষার প্রসার হয় এবং বঞ্চিত ও অবহেলিত লোকেরা বিদ্যার্জন করে জীবনে উন্নতি করার সমান সুযোগ পায় ।
বঙ্গদেশে নিম্নশ্রেণির হিন্দুরা মুসলমান শাসনের সূচনাকাল থেকেই শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন শুরু করে। একজন হিন্দুকবির ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান' নামক কাব্য থেকে জানা যায় যে, মুসলিম আমলে হিন্দু সমাজের নিচ শ্রেণির হাড়ি ও সাহুরা (সাহা) দলিল-পত্রাদি পড়বার ও লিখবার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত ছিল। এমন কি নাপিত এবং
ঝাড়ুদারগণও বিদ্যা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করে। কড়চার লেখক কবি। গোবিন্দ দাস একজন স্বর্ণকার ছিলেন। ‘নলদয়মন্ত্রীর' কবি ‘মধুসূদন নাপিত' জাতিতে একজন ক্ষৌরকার ছিলেন। জনৈক গোয়ালার রামনারায়ণ গোপ ‘দেবায়ন উপাখ্যান' একলা করেন এবং একজন ধোপা ভাগ্যমন্তভূতি 'হরিবংশ' লিখে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন । শ্রী মাঝি কায়েত, গঙ্গাদাস সেন, কালিচরণ গোপ, রামপ্রসাদ দে, রাম দত্ত এবং নিম্নশ্রেণির অনেক হিন্দু সুশিক্ষিত ছিলেন এবং তাদেরকে বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচনা করতে দেখা যায়। এমনকি, নিম্নবর্ণের রমণীরাও যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন। 'চণ্ডীমঙ্গল কাব্য' থেকে জানা যায় যে, ব্যাধ রমণী ফুল্লরা, বিপুলা ও রাজুদেবীর হিন্দুশাস্ত্রের যথেষ্ট। জ্ঞান ছিল । জনৈক মালীর স্ত্রী হিসাবপত্র লিখতে পারত।
বাংলায় হিন্দু শিক্ষার স্তর
Stratification of Hindu Education in Bengal
১. প্রাথমিক শিক্ষা : হিন্দু বালক-বালিকাদেরকে পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা দান করা হতো এবং এসব পাঠশালা সাধারণত ধনী ব্যক্তিদের গৃহসংলগ্ন ছিল কিংবা গুরুগৃহের কোনো বৃক্ষতলে অবস্থিত ছিল। গুরু একখানা টুলে আসন গ্রহণ করতেন এবং বালক-বালিকারা তাদের নিজেদের মাদুরে বসত। মুনসী (মুসলমান শিক্ষক) ভোরে শিক্ষাদান করতেন এবং পণ্ডিত (গুরু) বিকালে ছাত্রদের শিক্ষাদান করতেন । ধনী হিন্দুরা পাঠশালার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। ‘মনসামঙ্গল' কাব্যের কবি বিজয়গুপ্ত বলেন যে, চাঁদ সওদাগর একটি বৃহৎ পাঠশালার ব্যয়ভার বহন করতেন এবং সেখানে সোমাই পণ্ডিত নামক গুরুর নিকট তাঁর ছয় পুত্র শিক্ষা গ্রহণ করে ।
হিন্দু বালিকারাও পাঠশালায় অধ্যয়ন করতো। জনৈক রাজকন্যা ময়নামতী তার পিতার গৃহ-সংলগ্ন পাঠশালায় গুরুর নিকট বিদ্যাশিক্ষা করে। সপ্তদশ শতকের বাংলা কাব্যগ্রন্থে সারদামঙ্গলে একটি পাঠশালায় পাঁচটি রাজকন্যার অধ্যয়নের উল্লেখ আছে এবং সেখানে একজন রাজপুত্রসহ বহু বালকও শিক্ষা গ্রহণ করতো। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তখন নারীশিক্ষা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সহ-শিক্ষার প্রচলন ছিল। সাধারণ মেয়েরা যে লেখাপড়া জানতো এ রকম বহু দৃষ্টান্ত আছে। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে উল্লিখিত হয়েছে যে, লীলাবতী নাম্নী এক রমণী ধনপতি নামে এক বণিকের স্ত্রী লহনার নিকট এমন একটি চাতুর্যপূর্ণ পত্র লিখেছিল যাতে লহনা মনে করেছিল যে, সে চিঠি তার স্বামী তাকে লিখেছে।
হিন্দুসমাজে শিক্ষিত রমণীদের সম্পর্কে বহু উল্লেখ আছে। কবি চণ্ডীদাসের প্রেয়সী ধোপা রমণী রামী বাংলায় পদাবলী রচনা করেন। চৈতন্যের শিষ্য মাধবী সুশিক্ষিতা ছিলেন। তিনি অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করেন। কবি বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রবতী ষোড়শ শতকের বাংলা সাহিত্যের একজন স্বভাব-কবি ছিলেন। খনা
নাম্নী হিন্দু নারী খুব বিদুষী ও গুণবতী ছিলেন। তাঁর জ্যোর্তিবিদ্যার ভূয়োদর্শনমূলক উক্তিসমূহ বাংলার গৃহ-প্রবাদে পরিণত হয়েছে। ইনি এই প্রদেশে মুসলিম শাসনের প্রথম যুগের মহিলা ছিলেন। বিদ্যাবত্তায় পারদর্শিনী বহু রমণী হিন্দু সমাজে ছিলেন, যাদের কথা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের “বিদ্যাসুন্দর' কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। এ কাব্যের নায়িকা রাজকন্যা ‘বিদ্যা’ এরূপ অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারিণী ছিলেন যে, তিনি বহু রাজপুত্র ও পণ্ডিত ব্যক্তিদেরকে সাহিত্য সম্বন্ধীয় বিতর্কে পরাজিত করেন। ফলে, তার খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ছ'বছরের বেশি সময় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হতো। কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে জানা যায় যে, কবি এগারো বছর বয়সে তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং বারো বছর বয়সকালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য গমন করেন ।
২. উচ্চ শিক্ষা (টোলে শিক্ষা) : প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর হিন্দু বালকগণ, যারা উচ্চশিক্ষা লাভের আকাঙ্ক্ষা করতো, তারা সাধারণত টোলে প্রবেশ করতো। এই সমস্ত টোল ছিল সংস্কৃত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান । কেবল ব্রাহ্মণ ছাত্রদেরকে টোলে শিক্ষা দেয়া হতো। অর্থ 13 প্রতিপত্তির সাহায্যে কখনো ধনী বণিকগণ সেখানে তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতেন। কোনো কোনো ‘টোলে’ বাংলা এবং ফারসিও শিখান হতো। ছয় শাস্ত্র, কাব্য, ব্যাকরণ, জ্যোতিষশাস্ত্র, ছন্দ নিরুক্ত (বৈদিক অভিধান বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ) ও দর্শন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়রূপে পরিগণিত ছিল। ইতিহাস অনুশীলনও পাঠ্য- তালিকায় প্রবর্তিত হয়েছিল। কালীদাসের গ্রন্থাবলি, বিজয় রক্ষিতের চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থের টীকা (মধুকোষ), অমর কোষ (অমর সিংহের বিশ্বকোষ), পাণিনির ব্যাকরণের টীকা এবং রামায়ণ ও মহাভারত সংস্কৃত বিদ্যালয়ে প্রধান পাঠ্য বিষয় ছিল ।
মুসলমানামলে বাংলাদেশে সংস্কৃত শিক্ষার কয়েকটি কেন্দ্র ছিল। তন্মধ্যে নবদ্বীপের কেন্দ্রটিই ছিল সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। এটি ছিল হিন্দু আমলের একটি বিরাট শিক্ষাকেন্দ্র। মুসলমান যুগে এ প্রতিষ্ঠানটি দর্শনের একটি নতুন মতবাদের (নব্যন্যায়) উজ্জ্বল কেন্দ্রে উন্নীত হয় এবং ভারতের সকল অংশ থেকে ছাত্রদেরকে আকৃষ্ট করে। কোনো কোনো পণ্ডিত এ কেন্দ্রকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে অভিহিত করেছেন। সংস্কৃত শিক্ষার উজ্জ্বল কেন্দ্ররূপে নবদ্বীপের খ্যাতির কথা বৈষ্ণব কবি বৃন্দাবন দাসের “চৈতন্যভাগবতে’ সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে। নবদ্বীপে বহু টোল ছিল এবং সেখানে হাজার হাজার খ্যাতনামা পণ্ডিত, অধ্যাপক ও বিদ্বান ব্যক্তির বসবাস ছিল। তাঁরা তাঁদের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের দ্বারা শিক্ষাকেন্দ্রকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন।
বরিশাল জেলার কবি বিজয়গুপ্তের বসতগ্রাম 'ফুল্লশ্রী' ষোড়শ শতকে হিন্দু শিক্ষার একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল। বিজয়গুপ্ত তাঁর ‘পদ্মপুরাণে” বলেন, ফুল্লশ্রীতে ব্রাহ্মণদের বসতি ছিল; তারা চার বেদ ও নানা বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন এবং চিকিৎসাবিদ্যায় তাদের বিশেষ নৈপুণ্য ছিল। কায়স্থগণ লেখার কাজে দক্ষ ছিল এবং অন্যান্য লোকেরা তাদের নিজ নিজ পেশায় চতুর ছিল।”
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস।
সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় যে, সাতগাঁও ছিল অন্য একটি সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র। বিপ্রদাসের মতে, পঞ্চদশ শতকে সপ্তগ্রামে বহু হিন্দু যোগী ও সন্ন্যাসীর। আশ্রম ছিল এবং পারদর্শী বহু পণ্ডিত সে স্থানে বসবাস করতেন।
হিন্দু শিক্ষার অন্যান্য কেন্দ্র ছিল, যেমন- সিলেট, চট্টগ্রাম ও বিষ্ণুপুর (বাকুড়া জেলা)। এ যুগে প্রচুর সংখ্যক সংস্কৃত পুস্তক রচিত হয়েছিল। কোনো কোনো মুসলমান শাসক সংস্কৃত শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। কিছু সংখ্যক মুসলমান। সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেছেন এবং এ ভাষায় গ্রন্থ রচনাও করেছিলেন বলে জানা গেছে। এভাবে মুসলিম রাষ্ট্রে উদারনৈতিক ও বিদগ্ধ পরিবেশে সংস্কৃত শিক্ষার উন্নতি। সাধিত হয় । অনুমান হয়, ব্রাহ্মণগণ তাদের রাজনৈতিক প্রাধান্য হারিয়ে সংস্কৃত চর্চার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। ফলে নবদ্বীপ ও অন্যান্য অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
টোলের 'গুরু' সাধারণত রাষ্ট্র-প্রদত্ত নিষ্কর জমির আয় থেকে নিজের ভরণপোষণ করতেন। তিনি ছাত্রদের নিকট থেকে কোনো রকম বেতন নিতেন না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা গুরুর সংসার কার্যে সাহায্য করতো এবং টোলে তাদের শিক্ষাজীবন সমাপন করে গুরুকে দক্ষিণা দিতো। হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এদের মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণদের একশ্রেণি চিকিৎসাশাস্ত্রের অনুশীলন ও রোগ-নিরাময় কৌশল আয়ত্ত করতেন। তাদেরকে বৈদ্য' (উত্তর ভারতের বৈদ্য) বা কবিরাজ (চিকিৎসক) বলা হতো। ষোড়শ শতকের হিন্দু কবি দ্বিজ হরিরামের বর্ণনা থেকে তাদের জীবন সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, “কেউ কেউ চিকিৎসা দর্পণ পড়তেন (চিকিৎসাবিদ্যা ও নিরাময় বিজ্ঞান); কেউ বা নিদান (যোগ নিরূপণ বিদ্যা) অধ্যয়ন করতেন, আবার কেউ কেউ রক্ষিতের ঔষধ সম্বন্ধীয় টীকার অনুশীলন করতেন। কেউ ‘চক্রদত্ত' (একাদশ শতকের চক্রদত্তের ঔষধ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ) পড়তেন এবং কেউ অধ্যয়ন করতেন ব্যবহারিক রসায়নবিদ্যা।” এ যুগের বৈদ্য' বা কবিরাজগণ সুনিপুণ চিকিৎসক ছিলেন। মীর্জা নাথন লিখেছেন যে, তার পিতার গুরুতর পীড়ায় কোনো মুসলমান চিকিৎসকই তাকে নিরাময় করতে সক্ষম হননি। অবশেষে জনৈক কবিরাজ কিছু বনজ ঔষধি প্রয়োগে চিকিৎসা করে তাকে নিরাময় করেন।
জ্যোতিষশাস্ত্র ও ফলিত জ্যোতিষবিদ্যার চর্চা এক শ্রেণির ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এঁদেরকে দৈবজ্ঞ' বলা হতো। কবি দ্বিজ হরিরামের বর্ণনায় এই দৈবজ্ঞদের জীবন চিত্রিত হয়েছে। কবি লিখেছেন, “কেউ কেউ ‘ভাস্বতি দীপিকা' নামে পরিচিত জ্যোতিষশাস্ত্রের ব্যাখ্যামূলক টীকা পড়েন এবং কেউ অধ্যয়ন করেন রাশিচক্র।
কেউ-বা আবার সূর্য-সিদ্ধানেরতর গ্রন্থ পর্যালোচনা করে গ্রহের ছবি অঙ্কন করে। কেছু
বা আবার নববর্ষের পঞ্জিকায় পূর্বাভাস সম্বন্ধে আলোচনা করেন, কেউ-বা
সতর্কতার সঙ্গে রাশিচক্রে সৌরমলের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করেন। এদের মধ্যে কে কেউ কুষ্ঠিনামা আঁকেন; তাঁরা বন্ধ্যা বা সন্তানহীন রমণীর হাত দেখেন এবং তাদের
ধান, চাল ও টাকা পয়সা নিয়ে আসতে পরামর্শ দেন।
লেখার দ্রব্যাদি
Materials of Writing
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ আরম্ভকারীরা বালি ও ধুলার উপর লেখা অনুস করতো। এরপর তারা মেঝেতে খড়িমাটি নিয়ে লেখার চেষ্টা করতো। পরবর্তী পর্যায়ে তারা তালপাতা, কলাপাতা ও ভোজপাতায় লিখতো। খড়ের বা নলখাগড়ার টুকর বাঁশের কঞ্চি, পাখি, ময়ূর ও হাঁসের পালক ইত্যাদি কলমরূপে ব্যবহৃত হতো। খোঁ পেন্সিল ও ব্লাকবোর্ড তখন অজ্ঞাত ছিল। ছাত্ররা মেঝেতে অথবা তাদের নিজেদে আনা মাদুরের উপর উপবেশন করতো ।
মুসলমানদের প্রথম যুগে বাংলাদেশে কাগজের ব্যবহার প্রথম প্রবর্তিত হয়। এটা ছিল তুলোট অথবা গন্ধকচূর্ণ রঙিন কাগজ । চীনা রাষ্ট্রদূত ও লেখক মাহুয়ান বাঙালিদের কাগজ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, তারা হরিণের চামড়ার মতে তেলতেলা মসৃণ এক ধরনের সাদা কাগজ গাছের ছাল থেকে তৈরি করতো। গোবিন্দচন্দ্র রাজার গানে লেখাবস্তু হিসেবে কাগজের উল্লেখ দেখা যায়। কাগজ সাধারণত বই-পুস্তক, দলিল-পত্রাদি এবং এমনি ধরনের নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হতো।
ছাত্ররা তাদের নিজেদের কালি নিজেরাই তৈরি করতো। হরিতকি ও দেশীয় প্রদীপের নির্বাপিত ফুলকা দিয়ে কালি বানানো হতো। এই কালি অবিশ্বাস্য রকম দীর্ঘস্থায়ী এমন কি কয়েক শতাব্দীকালব্যাপী টিকে থাকতো। সপ্তদশ শতকের কবি জনার্দন রায় উত্তম রকমের কালি প্রস্তুতের প্রণালি সম্বন্ধে কবিতা লিখেছেন বাস্ত বিকই লেখাদৃষ্টে প্রমাণিত হয় যে, এ প্রণলিতে প্রস্তুত কালি এমন কি কয়েক শতাব্দী পরেও নতুন মনে হয় ।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
শিক্ষকদের অবস্থা
Condition of Teachers
শিক্ষকরা সমাজে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ গ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিলেন। পিতামাতা মৌলবী অথবা গুরুর নিকট তাদের ছেলেমেয়েদের পৌঁছে দিয়ে নিজেরা সন্তান-সন্তুতির শিক্ষা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। দৌলত উজীর বাহরাম খানের কাব্যগ্রন্থ 'লায়লী মজনু'তে এ মনোভাবই পরিস্ফুট হয়েছে। শিক্ষকের প্রতি ছাত্রদেরও গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল এবং ছাত্ররা পরম ভক্তির সঙ্গে গুরুর সেবা করতো। রাজসরকার ও সমাজ কর্তৃক শিক্ষকদেরকে প্রচুর পরিমাণ পারিশ্রমিক দেয়া হতো। মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরকে লাখেরাজ সম্পত্তি ও বৃত্তি দানের ব্যবস্থা ছিল। রাষ্ট্র ও অবস্থাপন্ন মুসলমান কর্তৃক প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে মঞ্জুরি দেয়া হতো। প্রায় সবগুলো টোলই কোনো না কোনো উৎস থেকে ভূমি মঞ্জুরি ভোগ করতো। আজকের দিনের শিক্ষকদের চেয়ে সে-যুগের মক্তব ও পাঠশালার শিক্ষকদের অবস্থা অনেক বেশি সচ্ছল ছিল। অবস্থাপন্ন মুসলমানগণ তাদের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষার জন্য মৌলবী ও মুনশীদেরকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দানের ব্যবস্থা করতে পারতেন। নানারকম শস্য, শাকসবজি ও জীবনধারণের অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়ে সাধারণত শিক্ষকের পারিশ্রমিক দানের ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাপরায়ণ ছাত্ররা তার সাংসারিক কাজকর্মেও তাঁকে সাহায্য করতো। গ্রাম্য মুসলমানদের ধর্মকর্মে, অনুষ্ঠান ও উৎসবাদিতে শিক্ষক ছিলেন তাদের পথ-প্রদর্শক ও ইমাম। তিনি বিয়ে-সাদী ইত্যাদি বহু রকম অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। এর জন্য তিনি লোকদের নিকট থেকে উপহার সামগ্রী লাভ করতেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর ছাত্ররাও গুরুকে উপঢৌকন দিতো।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর ছাত্রদেরকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করতেন। অনিয়মিত উপস্থিতি, পাঠে অমনোযোগ, পড়া তৈরি করতে না পারা, বেয়াদবী ও দুষ্টমীর জন্য ছাত্রদেরকে নানা ধরনের শারীরিক শাস্তি দেয়া হতো। সপ্তদশ শতকের কবি দয়াময় বলেন, “যদি কোনো ছাত্র তার পড়া শিখতে অপারগ হতো, তাহলে গুরু তাকে একগাছিল দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন ও তার বুকের উপর চড়ে বসতেন। অনিয়মিত ও দুষ্ট ছাত্রদের জন্য বেত্রাঘাত ও অন্যান্য প্রকারের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।” বাস্তবিকই মক্তব ও পাঠশালায় শাস্তিটা অত্যন্ত কঠোর ছিল এবং বেত মারা না হলে ছেলে খারাপ হয়, শিক্ষক এই প্রবাদটি অনুসরণ করে চলতেন। এডাম ১৮৩৫-৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রিপোর্টে বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রচলিত নানা ধরনের শাস্তির বর্ণনা করেছেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]