বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান Contribution of Muslims in the Education of Bengal

বাংলার মুসলমানরা যে বিদ্যা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন তা উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়। এ উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে ও মুসলমানী ভাবধারা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মুসলমান পীর-দরবেশ ও পণ্ডিতগণ উচ্চ আসন লাভের যোগ্য। তারা ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরবি ও ফারসি ভাষায় বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন যা সমস্ত ভারতব্যাপী আদৃত হয়েছিল। বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলো থেকে বিচ্ছুরিত জ্ঞান-রশ্মি সকল অঞ্চলের বহু পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করেছিল। পূর্বেও উল্লিখিত হয়েছে যে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বহু পণ্ডিত ও ধর্মনেতা বাংলা সাধু-দরবেশদের নিকট থেকে জ্ঞানর্জন করেছেন।
এটা উল্লেখযোগ্য যে, উত্তর ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে বাংলার পণ্ডিতদের বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধের একজন খ্যাতনামা আলেম ও মেহেদী মতবাদের অন্যতম গুরু ‘শেখ আলাই' বাঙালি ছিলেন। তিনি বিয়ানায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। শেখ আলাই কুরআন, হাদিস, আইনশাস্ত্র ও ইসলামি শিক্ষার অন্যান্য বিষয়ে এরূপ অসামান্য ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন যে, তিনি ধর্মীয় ও দার্শনিক বিতর্কে সূর আফগান সাম্রাজ্যের সদর-ই সুদূর ও শেখ-উল ইসলাম এবং সেই যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমরূপে পরিচিত মাওলানা আবদুল্লাহ সুলতানপুরী ও উত্তর ভারতের বহু খ্যাতনামা উলেমাকে পরাজিত করেন। শেখ আলাই-এর পিতা শেখ হাসান ও চাচা শেখ নসরুল্লাহ, যাঁরা বাংলা থেকে বিয়ানায় আগমন করেন তাঁরাও তাঁদের পাণ্ডিত্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শেখ আলাই তাঁর পিতার নিকট শিক্ষালাভ করেন। এই তিনজন বাঙালি পণ্ডিত বিয়ানায় শিক্ষা ও ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন এবং স্থায়ীভাবে সেখানে বসতি স্থাপন করেন।
মুসলমানামলের শিক্ষা ও জ্ঞান-গরিমা নানাভাবে বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনকে উন্নত করে তোলে। ফলে, দেশে এক অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ দেখা দেয়। বাঙালি সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষার প্রসার ঘটে। জ্ঞানালোকদীপ্ত মুসলিম শাসন ও শাসকদের উদার শিক্ষানীতির প্রভাবে যুগ যুগ ব্যাপী বন্ধনদশা থেকে নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের বুদ্ধিবৃত্তির মুক্তি সম্ভব হয়। এতদ্ব্যতীত, মুসলমানগণ বহু নতুন নতুন শিক্ষাকেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার ফলে বাংলাদেশে শিক্ষার দ্রুত উন্নতি ও শিক্ষা বিস্তারের পথ সুগম হয়। তারাই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস প্রবর্তন করেন এবং লেখ্যবস্তু রূপে কাগজের প্রচলন করেন। পুস্তক নকল করে প্রচারের রীতি প্রবর্তন
করার জন্য বাংলাদেশ মুসলমানদের নিকট ঋণী। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদানের প্রশংসা করে স্যার যদুনাথ সরকার বলেন, “যখন প্রথম যুগের হিন্দু লেখকগণ সাধারণ রীতি অনুসারে তাদের রচিত পুস্তকাদি গোপন রাখতে ভালবাসতেন, সেই যুগে পুস্তক নকল করার এবং তা প্রচারের দ্বারা জ্ঞান বিস্তারের প্রথা প্রচলনের জন্য
আমরা মুসলমানদের নিকট ঋণী ।”
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পরিশেষে অতি সংক্ষেপে বলা যায় যে, ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার (১২০৪-১২০৬) পর থেকে ইংরেজ রাজত্বের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ সুলতানি ও মুঘল আমল বাংলা দিল্লি শাসকের একটি প্রদেশ এবং কখনও কখনও স্বাধীন রাজ্য হিসেবে শাসিত হয়েছে। সুবাহদার, স্বাধীন শাসক এবং নওয়াবরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হতো। পক্ষান্তরে, মাদ্রাসা ছিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার পীঠস্থান। মুসলিম শাসনামলে বাংলায় মাদ্রাসার বিস্তার ঘটে। এগুলো রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত হতো। দানশীল অনেক ব্যক্তি নিজস্ব উদ্যোগে মাদ্রাসা স্থাপন করতেন। মুসলিম বাংলায় বহু বিদগ্ধজন প্রশাসক এবং কর্মকর্তা মাদ্রাসা ডিগ্রিধারী ছিলেন। শাহ মুবারকের স্কুলে তাঁর পুত্র ফাইজি এবং আবুল ফজল, ইতিহাসবিদ বদাউনী এবং অন্যান্য বিদ্বজন পড়াশোনা করেন। সোনারগাঁয়ে শরফ উদ্দিন আবু তাওয়ামা পরিচালিত মাদ্রাসায় বৈষয়িক ও ধর্মীয় বিষয়াদি পড়ানো হতো। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে, জাহাঙ্গীরনগরের মাদ্রাসাগুলো বিজ্ঞান, ঈশ্বরতত্ত্ব, দর্শন এবং গণিত শাস্ত্র শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত ছিল। সে সময়ে সমাজে শিক্ষকদের ছিল উচ্চ মর্যাদা। মাদ্রাসার পাঠক্রমে সাধারণত ধর্মীয় বিষয়সমূহ, যেমন কুরআন হাদিস, ঈশ্বরতত্ত্ব এবং অন্যান্য ইসলামিক বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকত। বৈষয়িক বিষয়, যেমন ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা, ভূগোল, বীজগণিত, জোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র ও অন্যান্য কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাগত বিষয়ের ওপর কোন কোন কেন্দ্রে বেশি জোর দেওয়া হতো। তৎকালে ফার্সিতে পাঠ দেওয়া হতো। তবে মুসলমান ছাত্রদের জন্য আরবি অবশ্য পাঠ্য ছিল। মুসলমান আমলে ইতিহাসপাঠ ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর ফলে এসব শিক্ষকেন্দ্র উপমহাদেশে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ইতিহাসবিদ তৈরি করেছিল। সম্রাট আকবর হিন্দুদের মাদ্রাসায় পড়াশোনার নীতি গ্রহণ করেন।
মুসলমান শাসনামলে পর্দা প্রথার কারণে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বাদশাহের হারেমে বাদশাহ, নওয়াব এবং রাজকর্মচারীদের স্ত্রী, কন্যা, ভগ্নি এবং অন্যান্য অভিজাত শ্রেণির মেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এদের কেউ কেউ জ্ঞানের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জন করেন। তবে, বেশির ভাগ মুসলমান মহিলা গৃহকর্ম
বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষণ ব্যতীত খুব সামান্যই পড়াশোনা করতেন। ব্রিটিশ আমলেও মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রথা অব্যাহত থাকে, তবে এর প্রকৃতি ও চরিত্র অনেকখানি বদলে যায়। ঊনিশ শতকের গোড়ায় এদেশে বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা ছিল। এসব মাদ্রাসায় ব্যাপকভিত্তিক বিষয়াদি পড়ানো হতো, যেমন ব্যাকরণ, বাগ্মিতা, যুক্তিবিদ্যা, আইন, ইসলামি মতবাদ, জোতির্বিদ্যা, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং সাহিত্য। শিক্ষকের প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্রকে এসব বিষয়ে নিজের অর্জিত জ্ঞান দান করা। সমাজে শিক্ষকদের অবস্থান অত্যন্ত সম্মানজনক ছিল ।
মুসলিম শাসনের অবসানের সময় সম্পদশালী ও অভিজাত শ্রেণির নিকট থেকে আর্থিক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং সরকারি ভাষা ফার্সি থেকে ইংরেজিতে পরিবর্তন হওয়ায় মাদ্রাসা শিক্ষা একটি রক্ষণশীল চরিত্র ধারণ করে। কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশে এখনো অব্যাহত রয়েছে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]