বাংলা ভাষা ও সাহিত্য: এর উদ্ভব ও বিকাশ Bangla Language and literature: its Origin and Development

বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ
Origin and development of Bangla language
বাংলা লিপি ও ধ্বনিবিন্যাস পদ্ধতি
System of Bangla alphabet and phonetics
বাংলা লিপি
Bangla alphabet
প্রাচীন যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
Bangla language and literature in ancient age
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য
Bangia literature in middle age
আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্য
Bangla literature in modern age
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব
ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১২.১ বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ
Origin and Development of Bangla Language অসমিয়াকে বাদ দিলে ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাবংশের পূর্বদিকের সবচেয়ে প্রান্তিক ভাষা বাংলা। নব্য ভারতীয় আর্যগোষ্ঠীর এই ভাষা ঐতিহাসিক সূত্রে আইরিশ, ইংরেজি, ফরাসি, গ্রিক, রুশ, ফারসি ইত্যাদি ভাষার দূরবর্তী জ্ঞাতিভঙ্গী। বর্তমান বাংলাদেশে বাংলা প্রায় একমাত্র এবং ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহৃত প্রধান ভাষা। এর পশ্চিমে ওড়িয়া, মাগধি, মৈথিলি এবং পূর্বে অসমিয়া ভাষার সীমান্ত। এছাড়া সাঁওতালি, মুণ্ডারি, খাসি ইত্যাদি অস্ট্রিক গোত্রের ভাষা এবং কাছারি, বোড়ো, গারো, ত্রিপুরী ইত্যাদি ভোট-বর্মী গোত্রের ভাষাও বাংলাকে ঘিরে রেখেছে, কখনো বা তার অঞ্চলে প্রবিষ্টও হচ্ছে।
বিহার, উড়িষ্যা এবং আসামের কাছাড় জেলায় বহুসংখ্যক বঙ্গভাষী মানুষ বাস করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এখানে প্রায় ১৬ কোটি লোক এই ভাষা বলে। একই সঙ্গে এ ভাষা পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার প্রশাসনিক ভাষা এবং আসামের কাছাড় জেলার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তালিকাবদ্ধ আঠারোটি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। বর্তমানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় তেইশ কোটি। ২০৫০ সাল নাগাদ কেবল ১৪-২৫ বছর বয়স্ক বাংলাভাষীর সংখ্যাই ৩১ কোটি ৬০ লক্ষে দাঁড়াবে বলে পরিসংখ্যানবিদদের অনুমান। ভাষা সংখ্যার বিচারে বাংলা এখন পৃথিবীর সপ্তম ভাষা। এর স্থান কেবল চীনা, ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু, স্প্যানিশ, আরবি ও পর্তুগিজের পরে। আর বাংলাই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, যার প্রতি ভালোবাসা ও মর্যাদাবোধ থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।
ইতিহাস মাগধি প্রাকৃতের (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০- খ্রিস্টাব্দ ৬০০) পরবর্তী স্তর মাগধি অপভ্রংশ এবং তৎপরবর্তী স্তর অবস্থানের মধ্য দিয়ে ১০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্বাধীন নব্যভারতীয় আর্যভাষারূপে বাংলার উদ্ভব হয় । এর সঙ্গেই উদ্ভূত হয় পূর্বমাগধীয় আরো দুটি ভাষা উড়িয়া ও অসমিয়া। তবে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা ও অসমিয়ার ভাষাগত পার্থক্য ছিল সামান্য।
মধ্য বাংলার
তুচ্ছ করার মতো নয়। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ একটি সুস্পষ্ট আদি স্তর নির্দেশ করে। কারণ মধ্য বাংলার পরবর্তী রূপের সঙ্গে এই বাংলার দূরত্ব কম নয়। পরবর্তী মধ্য বাংলার নিদর্শন পাওয়া যায় রামায়ণ-মহাভারত- ভাগবতের অনুবাদে, বৈষ্ণব পদাবলি ও চৈতন্যচরিত কাব্যগুলোতে, নানা মঙ্গলকাব্যে, আরাকান-রোসাঙ্গ অমাত্যসভার মানবিক গাঁথাসাহিত্যে, শাক্ত পদাবলি এবং পূর্ববঙ্গ- গীতিকায় । এ পর্বে ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের বেশ প্রবেশ ঘটেছে। আধুনিক বাংলার ক্ষেত্রে সাহিত্যে গদ্যভাষার ব্যাপক ব্যবহার, সংস্কৃত (তৎসম) শব্দাবলির ঋণগ্রহণ এবং ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি শব্দের ঋণও বিশেষ লক্ষণীয়।
এই তিন পর্যায়ের ভাষাগত লক্ষণগুলোকে মোটামুটি সংক্ষেপে এভাবে নির্দেশ করা যায়। প্রাচীন বাংলা ধ্বনিগত : (ক) যুক্তব্যঞ্জন থেকে যেসব যুগ্মব্যঞ্জন উৎপন্ন হয়েছিল সেগুলো সরল হয়ে একক ব্যঞ্জন হয়, আর তার আগের স্বরধ্বনিটি পৃথক প্রলম্বনের (compensatory lengthening) ফলে দীর্ঘ হয়; (খ) অন্ত অ বজায় থাকে এবং অন্ত ইঅ ঈ-তে পরিণত হয়। রূপগত: (ক) সম্বন্ধ বিভক্তিতে এবং ল-যুক্ত অতীতে স্ত্রীলিঙ্গ বজায় থাকে; (খ) আধুনিক বাংলা বিভক্তির আদিরূপ এই পর্বেই দেখা যায়; তবে কালবাচক-ইল -ইব কর্মভাববাচ্যের কর্তার সঙ্গে ব্যবহৃত হতে থাকে; (গ) সর্বনামেও আধুনিক বাংলা সর্বনামের আদিরূপ আহ্মে তুহ্মে ইত্যাদি লক্ষ করা যায়।
মধ্য বাংলা ধ্বনিগত: (ক) আদি-মধ্যস্তরে ই্ ড্ অর্ধস্বরের দুর্বলতা; (খ) মহাপ্রাণ নাসিক্যব্যঞ্জনের মহাপ্রাণতা লোপ; (গ) নাসিক্যধ্বনি + ব্যঞ্জনের জায়গায় অনুনাসিক স্বর + ব্যঞ্জন। রূপগত: (ক) আগের মতো কর্মভাববাচ্যের কর্তার সঙ্গে না হয়ে কালবাচক ইল্‌-ইব্ বিভক্তি কর্তৃবাচ্যের কর্তার সঙ্গে ব্যবহৃত হলে থাকে; (খ) বিভক্তির বদলে অনুসর্গ দিয়ে কর্মভাববাচ্য হতে থাকে; (গ) যুক্ত ও যৌগিক ক্রিয়ার বিস্তার ।
অন্ত্যমধ্য বাংলা ধ্বনিগত: (ক) অন্ত্য অ-এর লোপ; (খ) অপিনিহিতির উদ্ভব ও বিস্তার; (গ) নতুন স্বরধ্বনি অ্যা-এর উদ্ভব। রূপগত: (ক) -র, -গুলা, -গুলো, দি(c)গর ইত্যাদি নতুন বিভক্তির উদ্ভব। শব্দগত: সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি শব্দ থেকে
ব্যাপক ঋণগ্রহণ ।
আধুনিক বাংলা ধ্বনিগত : (ক) ই আর উ-র প্রভাবে স্বরোচ্চতাসাম্য বা স্বরসঙ্গতির নিয়মের ব্যাপকতা; (খ) অপিনিহিত ই্ উ-র বিলোপ; (গ) দ্বিতীয় স্বরলোপ বা দ্বিমাত্রিকতা; (ঘ) এ-জাত অ্যা-র সংখ্যাবৃদ্ধি; (ঙ) মৌখিক স্তরে স্বরাগম ও স্বরভক্তির দ্বারা যুক্তব্যঞ্জন ভাঙা, (চ) তৎসম ব, ম ও য-ফলা বিশিষ্ট যুক্তব্যঞ্জনের সমীভবন। রূপগত: (ক) মৌখিক স্তরে মান্য চলিত বাংলায় সর্বনাম ও ক্রিয়ার সংক্ষেপিত রূপ (তাহার তার; করিয়াছিল করেছিল)। কিন্তু বিভিন্ন উপভাষায় এখনও মধ্য বাংলার অনেক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ বাংলা ভাষা দ্রাবিড় ও কোল এ দুটি অনার্য ভাষা দ্বারা। বিশেষভাবে প্রভাবিত। শুধু শব্দসম্ভারে নয়, বাক্য গঠনেও এ দুটি ভাষার প্রভাব রয়েছে। বাংলায় প্রচুর অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক শব্দ, দ্বিত্ব শব্দ এবং যৌগিক ক্রিয়াপদের যে ব্যবহার হয় তা অনার্য প্রভাবজাত । যেমন- ঘোড়া-টোড়া, কাপড়-চোপড় (এ ক্ষেত্রে মূল শব্দের প্রথম ব্যঞ্জনের স্থলে অন্য ব্যঞ্জন বসিয়ে ইত্যাদি অর্থে মূল শব্দের সঙ্গে যোগ করে পদসাধন করা হয়েছে), টুকটুক্, খটখট্, খাখা, ধাঁধা (এ ক্ষেত্রে একই শব্দ দ্বিতীয়বার ব্যবহার করে পুনরাবৃত্তি বুঝানো হয়েছে), বসিয়া পড়া, লাগিয়া থাকা (এ) ক্ষেত্রে সহকারী ক্রিয়ার ব্যবহার হয়েছে) ইত্যাদি । বাংলা ভাষায় দ্রাবিড়াদি ভাষার শব্দও যথেষ্ট আছে, বিশেষকরে স্থাননামের ক্ষেত্রে।
বাংলা ভাষার উদ্ভবের পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বিভিন্ন পর্যায় ও সূত্রের প্রভাবে। সেগুলো হলো : (ক) প্রাচীন বাংলার ভাষা-রূপের সঙ্গে কিছু সংস্কৃত প্রভাব প্রথম থেকেই যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ খ্রিস্ট্রীয় অব্দের প্রথম থেকেই সংস্কৃত ভাষা ছিল প্রায় সমগ্র ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার বাহন।[পালি ও অর্ধমাগধি ছিল যথাক্রমে বৌদ্ধ ও জৈনদের নিজ নিজ ধর্মীয় আলোচনা সংস্কৃতির বাহন।] প্রাচীন বাংলার যুগে বাংলাভাষী অনেকেই কাব্যচর্চা করতেন সংস্কৃতে। ভারতের ইন্দো-আর্য ভাষা যখন প্রাচীন ও মধ্যস্তর উত্তীর্ণ হয়ে আধুনিক স্তরে পৌঁছায়, তখন বিভিন্ন জাতি- গোষ্ঠীর প্রভাব সত্ত্বেও [পাল রাজত্বে গৌড় সাম্রাজ্যের পত্তন সত্ত্বেও] সুপ্রসিদ্ধ বাঙালি কবিগণ (জয়দেব, উমাপতিধর, গোবর্ধন আচার্য প্রমুখ) সংস্কৃতেই কাব্য রচনা করেছেন। ফলে প্রাচীন যুগ থেকে তৎসম ও অন্যান্য প্রভাব বাংলায় এসেই গেছে; (খ) ১৩শ শতকে বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের পর থেকে আরবি-ফারসি ও তুর্কি ভাষার প্রভাব বাংলায় পড়তে শুরু করে; (গ) ১৪শ/১৫শ শতকে মুসলিম শাসনামলে ফারসি রাজভাষা হওয়ায় এবং এর বিশেষ মর্যাদার কারণে, সেই সঙ্গে এই ভাষা সম্পৃক্ত সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলায় স্থান পায় প্রচুর বিভাষী শব্দ; (ঘ) আবার একই সঙ্গে মুসলমান শাসকগণ ‘জবান-এ-বাংলা’র সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করার ফলে তৎকালীন পণ্ডিতদের কথিত ‘গৌড় ভাষার' শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, অর্থাৎ বাংলায় তৎসম শব্দের ব্যবহার বেড়ে যায়; (ঙ) ১৬শ শতকে পর্তুগিজদের আনীত শব্দাবলি বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে [আনারস, আতা, তামাক ইত্যাদি]; (চ) মধ্যযুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসি এবং এর মাধ্যমে আগত শব্দ ও ভাষিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়; (ছ) ১৭শ শতকে বঙ্গদেশে বিদেশিদের আগমন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজ ছাড়াও ফরাসি ও ইংরেজি শব্দের প্রভাবও বাড়তে থাকে [ফরাসি: কার্তুজ, কুপন, ডিপো; ওলন্দাজ: হরতন, ইস্কাবন, ইস্কুরুপ; ইংরেজি: টেবিল, চেয়ার, লাট, জাঁদরেল ইত্যাদি]; (জ) ১৭শ/১৮শ শতকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় বাংলায় প্রথমবারের মতো গদ্য-ভাষার কার্যকর ব্যবহার শুরু হয়; (ঝ) ১৮শ/১৯শ শতকে ইংরেজ শাসনে ইউরোপীয় শিক্ষার প্রভাবে ইংরেজি ও তার মাধ্যমে অন্যান্য বিদেশি ভাষার প্রভাব
বাংলা ভাষায় যুক্ত হতে থাকে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর তার প্রধান উইলিয়ম কেরী ও তাঁর সহযোগী বাঙালি পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষা সৌষ্ঠবপূর্ণ গদ্য-সাহিত্য রচনার উপযোগী হয়ে ওঠে; (ঞ) পরবর্তী পর্যায়ে ১৯শ শতকে রাজা রামমোহন রায়, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন। প্রমুখের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং গতিসঞ্চার হয়। তৎসম তদ্ভব শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে এই ভাষা হয়ে ওঠে সাহিত্যের যথার্থ বাহন; (ট) বিশ শতকে কথা ভাষা লেখ্য সাহিত্যিক ভাষায় উন্নীত হয় প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ এবং আরো অনের
প্রতিভাবান বাঙালির হাতে।
প্রথম থেকেই কাব্যের ভাষা প্রধান হওয়ায় কবিতার ছন্দ বাংলা ভাষন ক্রমপরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। বাংলা ছন্দের বিবর্তনে লক্ষ করা যায় যে, আমি নিদর্শন চর্যাপদ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। তখনো যৌগিক বা অক্ষরবৃত্ত পয়ারের উন্ন হয়নি। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে জয়দেব গীতগোবিন্দম নামে যে কাব্য রচনা করেন। তার ছন্দ মাত্রাবৃত্ত হলেও তাতে অক্ষরবৃত্তের আভাস রয়েছে। মধ্যযুগের শুরুতে পয়ারের প্রচলন হলেও অক্ষরবৃত্ত ছন্দই সুদীর্ঘকাল বাংলায় প্রধান হয়ে আছে। এরপর অন্ত্যমধ্যযুগ থেকে প্রস্বরপ্রধান স্বরবৃত্ত ছন্দের উৎপত্তি। বিশেষকরে পদান্ত অ-কারের হলন্ত উচ্চারণ রীতি প্রচলিত হওয়ায় শব্দের প্রথমে ঝোঁক দিয়ে উচ্চারণ করা শুরু হয়। এ সময় অক্ষরবৃত্তের প্রাধান্য সত্ত্বেও স্বরবৃত্ত ছন্দে লোকসংগীত, ছড়া ইত্যাদি রচিত হতে থাকে এবং উনিশ শতকের শেষভাগে স্বরবৃত্ত ছন্দ কাব্যসৃষ্টির অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে। ৪
আধুনিক পর্যায়ের বাংলা ভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে গদ্যভাষার লিখন-চর্চা, প্রসার লাভ, উন্নয়ন ও কার্যকর ব্যবহার। এর সিংহভাগই কলকাতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় ফলে সম্ভব হয়েছে। উনিশ শতকে প্রধানত খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় এবং তৎসঙ্গে স্থানীয় কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্যোগে বাংলা ভাষার (গদ্য ও পদ্য) উল্লেখযোগ্য মানোন্নয়ন ঘটে।
উপভাষা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২৬) বাংলা ভাষার চারটি প্রধান উপভাষা স্বীকার করেছিলেন- রাঢ়, বঙ্গ, কামরূপ ও বরেন্দ্র; সুকুমার সেন (১৯৩৯) এর সঙ্গে অতিরিক্ত একটি যোগ করে রাঢ়ী, বঙ্গালী, কামরূপী, বরেন্দ্রী ও ঝাড়খন্ডী এই পাঁচটি প্রধান উপভাষা লক্ষ করেন। রাঢ়ী হলো বর্তমানে মান্য চলিত বাংলার ভিত্তি, যা দক্ষিণ- পশ্চিম বঙ্গের এক বৃহৎ অংশে কথিত হয়। বঙ্গালী বলা হয় মূলত অবিভক্ত বাংলার পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। বঙ্গালীতে অনেক মধ্যবাংলার বৈশিষ্ট্য বজায় আছে যা রাঢ়ীতে লুপ্ত, যেমন- অপিনিহিত স্বর (=অর্ধস্বর), স্বরোচ্চতাসাম্যের অভাব, -ঙ্গ-তে গ্ ব্যঞ্জনের রক্ষা, নাসিক্যব্যঞ্জন + ব্যঞ্জন পরম্পরা রক্ষা (চাঁদ এর বদলে চান্দ)। বঙ্গালীতে ড. ই নেই চ্ ছ্ জ্ ক্ খৃষ্ট ধ্বনি না হয়ে উম্ম (শিস্) ধ্বনিতে পরিণত হয়। তবে সিলেট-
নোয়াখালী-চট্টগ্রামের ভাষা বঙ্গালীর সাধারণ রূপ থেকে এতই আলাদা যে, সে ভাষাকে অন্য একটি বা দুটি স্বতন্ত্র উপভাষা হিসেবে গণ্য করা সঙ্গত বলে মনে হয়। বাংলার সমস্ত প্রান্তীয় উপভাষা প্রত্যাশিতভাবেই পার্শ্ববর্তী ভাষাগুলোর সঙ্গে মিশে যায়। প্রত্যন্ত বঙ্গালী ও কামরূপীর সঙ্গে অসমিয়ার, ঝাড়খণ্ডীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম বিহারীর এবং কাঁথি অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে ওড়িয়ার ঘনিষ্ঠতা দুর্লক্ষ্য নয়। বাংলার সাহিত্যিক উপভাষার মধ্যে গদ্য-উপভাষা প্রাচীনতর সাধু ও আধুনিকতর চলিতে বিভক্ত। এই চলিতেরই মান্য রূপ সমগ্র বঙ্গভাষী জনগোষ্ঠীর গদ্য সাহিত্যরচনা এবং শিক্ষিত শ্রেণির আদান-প্রদান ও রেডিও-টেলিভিশনে ব্যবহৃত উপভাষা। কবিতার সাধু-চলিতে মিশ্র উপভাষাটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ক্রমশ চলিতের দিকে ঝুঁকেছে, যেমন ১৯৬৫-র মার্চের শেষে সংবাদপত্র সাধুগদ্যকে বর্জন করে চলিত গদ্যকে গ্রহণ করেছে।
ভাষার বিবিধ রূপ : বাংলা ভাষার লিখিত রূপ দুটি সাধু ও চলিত বা কথ্য। এ দুয়ের মধ্যে মূল পার্থক্য ক্রিয়াপদ ও সর্বনামে। চলিত রূপে ক্রিয়াপদ ও সর্বনামগুলো থাকে সংক্ষেপিত আকারে। বিশ শতকের শুরুতে চলিত ভাষার প্রাধান্য বৃদ্ধি পেলেও সাধু ভাষার ব্যবহার একেবারে উঠে যায়নি। এ সময়কার সংবাদপত্র ও দলিল- দস্তাবেজের ভাষায় এবং সরকারি ও যেকোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বর্ণনায় সাধু বাংলার ব্যবহার অব্যাহত থাকে। চলিত বাংলা ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক শিষ্টজনের মুখের ভাষা। তখন প্রচুরসংখ্যক প্রতিভাবান বাঙালি চলিত বাংলায় সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ফলে বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এবং বিশ শতকে বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার মর্যাদা লাভ করে ।
সাধু ও চলিত ভাষার ব্যবহার পাশাপাশি চালু থাকায় বাংলা ভাষায় সৃষ্টি হয় এক অনন্য ভাষিক প্রপঞ্চ দ্বিভাষা (diglossia) পরিস্থিতি। সংক্ষেপিত ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম চলিত ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও এ দুই ভাষারূপের প্রকৃত পার্থক্য মেজাজে ৷ তাছাড়া হিন্দু ও মুসলমানের বাংলা ব্যবহার রীতি এবং পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভাষা ব্যবহার রীতিতেও এক ধরনের পার্থক্য রয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের ফলে বাংলা ভাষার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়, যার আন্তঃফলস্বরূপ আধুনিক বাংলায় প্রচুর আরবি, ফারসি ও তুর্কি শব্দ অনুপ্রবেশ করে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে উচ্চ শ্রেণির হিন্দুরাও রাজভাষা ফারসির চর্চা করতেন; ফলে তাঁদের বাংলাও ফারসি দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়। আজও যুদ্ধ, কর, আইন, সংস্কৃতি ও কারু বিষয়ক প্রায় ২,০০০-এর বেশি আরবি ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে। বিশেষকরে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে তদানীন্ত ন পূর্ববঙ্গের সাধারণ কৃষিভিত্তিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলায় এ রকম শব্দের সংখ্যা ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়। অশিক্ষিত বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমানদের ভাষায়ও পার্থক্য আছে। আবার শিক্ষিত বাংলাভাষী এই দুই সম্প্রদায়ের ভাষায় একটা বড় পার্থক্য লক্ষ করা যায় আত্মীয়বাচক শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। বাংলাভাষী হিন্দুরা আত্মীয়বাচক শব্দ
ব্যবহার করে সংস্কৃত ও বাংলা অনুসরণে, আর মুসলমানরা করে উর্দু ও আরবির অনুসরণে (যেমন- কাকা/চাচা, মা/আম্মা ইত্যাদি)। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লেখ্য বাংলায় সমতা থাকলেও কথ্য বাংলার ক্ষেত্রে রয়েছে বিস্তর তফাৎ। বাংলাভাষী বিস্তৃত অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে উপভাষাগত পার্থক্য উল্লেখ করার মতো। বাংলাদেশের সিলেট
নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপভাষার তফাৎ অনেক সময় এতটাই বেশি হয় যে, একে
অপরের কথা সঠিকভাবে বুঝতেও পারে না।
মান্য চলিত বাংলা : সংগঠন-বিবৃতি ধ্বনিতত্ত্ব ফোনিম বা স্বনিমের হিসেবে মান চলিত বাংলায় সাতটি স্বরস্বনিম ই উ এ ও অ্যা আ অ; এর প্রত্যেকটিরই অনুনাসির উচ্চারণ হয়। ব্যঞ্জনস্বনিম ত্রিশটি প্ ফ্ ব্ ড্ ম্, ত্ প্ দ্ প্ ন, ট্‌ ট্‌ ড্ চ্ ডু ডু, ক খ গ ঙ্, চ্ ছ্‌ জ্ শ্ শ্, র্ ল্ স্ হ্ (স্-কে শ্-এর প্রতিবেশগত রূপান্তর বলা চলে)। অবস্থ চারটি ই উ এ ও । দীর্ঘ স্বরধ্বনি এ ভাষায় অনুপস্থিত। মান্য চলিত বাংলার প্রধান ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলো হলো: ক. স্বরোচ্চতাসাম্য, যার ফলে স্বরধ্বনির ঊর্ধ্বতা ঘটে, যেমন: প্যাঁচা পেঁচি (অ্যাএ), নট নটী (অও), লেখে লিখি (এই) এবং খোকায়ুর (ওউ); খ. শব্দঋণে বিশেষ প্রতিবেশে শ্ এর স্ পরিণতি এবং বিদেশি শব্দে স-এর উপস্থিতি; গ. অর্থনিয়ন্ত্রিত একটি ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া ব্যঞ্জনধ্বনির দীর্ঘতু, যেমন বড়োবড্ডো, ছোটছোট্ট। মুখের ভাষার ঋণকরা শব্দের যুক্তব্যঞ্জন সরলীকরণের প্রবণতা, প্রধানত স্বরধ্বনি যোগের মাধ্যমে। প্রস্বর (stress) মূলত শব্দের প্রথম দলে (syllable) এবং অর্থবদ্ধ শব্দগুচ্ছের প্রথম শব্দে স্পষ্টতম। বস্তুবাচক প্রশ্নে প্র শব্দটির (কে, কী, কেন) ওপর মূল প্রস্বর পড়ে। বাক্যের সুর বা পিচ (pitch)- এর সাধারণ ছক হলো উক্তিতে টানা সুর নিচে নামে, প্রশ্নে (হ্যাঁ-না বাচক প্রশ্নে) টানা সুর ওপরে ওঠে। আবেগের কারণে বা কন্ঠস্বর দূরে পাঠানোর জন্য কখনো কখনো স্বরধ্বনি দীর্ঘ বা প্রলম্বিত হয় (কীই? যাই!)। কোন অর্থের ওপর জোর দেওয়ার জন্যও প্রস্বর দেওয়া হয় । যৌগিক বাক্যে সংযোজক শব্দগুলোর উপর ন্যূনতম প্রস্বর পড়ে।
রূপতত্ত্ব : বাংলার রূপতত্ত্ব বিভক্তিপ্রধান, যদিও এর বিশ্লেষণাত্মক চরিত্রও ক্রমশ প্রকট হয়েছে। এর ক্রিয়ারূপ প্রায় পঞ্চাশটির মতো, যদিও শব্দরূপে বিভক্তির তুলনায় অনেক কম। শব্দরূপে কারকের অর্থ মূলত তিনভাবে প্রকাশ করা হয়: বিভক্তি যোগের দ্বারা (গৌণকর্ম সম্প্রদান, সম্বন্ধপদ ও অধিকরণ কারকে), বিভক্তি ও অনুসর্গের সাহায্যে (করণ, নিমিত্ত) এবং বিভক্তি ছাড়া শুধু অনুসর্গের দ্বারা (অপাদান)। কর্তৃকারক সাধারণভাবে বিভক্তিহীন, তবে ‘শ্রেণিগত' কর্তায় প্রাচীন- এ বিভক্তির সীমাবদ্ধ ব্যবহার আছে, যথা ‘মানুষে এমন কাজ করে না। অপ্রাণিবাচক গৌণকর্মেও বিভক্তি নেই। মান্য চলিতে গৌণকর্মের বিভক্তি -কে, সম্বন্ধ বিভক্তি -(এ)র, অধিকরণ বিভক্তি -(এ)তে। শব্দের শেষে যে ধ্বনি আছে তা-ই নিয়ন্ত্রণ করে বিভক্তিটি-র না -এর, -তে না -এতে হবে।
বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস ক্রিয়ার প্রকরণটি মোটামুটি জটিল। বিভক্তি অনুযায়ী সমাপিকা ক্রিয়ার প্রধান দুটি ভাগ নির্দেশক (indicative) ও অনুজ্ঞাবাচক (imperative)। বাংলায় শুধু তুমি-পক্ষ নয়, সে-পক্ষেরও অনুজ্ঞা (third person imperative) আছে। তুমি পক্ষের তিন শ্রেণির অনুজ্ঞা সম্রামার্থক (করুন), সাধারণ (করো) এবং তুচ্ছার্থক (কর্)। সে পক্ষের শুধু সাধারণ আর সম্ভ্রামার্থক (করুক, করুন)। অন্যদিকে তুমি পক্ষের অনুজ্ঞা ভবিষ্যৎ ও বর্তমান দুই কালেরই হতে পারে (করবেন-করুন, কোরো- করো, কর্ করিস্)।
নির্দেশকভাবে আছে তিনটি কাল বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ। বর্তমান আর অতীতে আছে যথাক্রমে তিনটি ও চারটি প্রকার (aspect)। বর্তমানে নিত্য (করি), ঘটমান (করছি), পুরাঘটিত করেছি); অতীতে সাধারণ (করলাম), ঘটমান (করছিলাম), পুরাঘটিত (করেছিলাম) আর নিত্যবৃত্ত (করতাম)। ভবিষ্যতে শুধু একটি প্রকার সাধারণ (করব)। ঘটমান ভবিষ্যৎ একটি মাত্র ক্রিয়াপদের হয় না। ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সবশেষে পাঁচটি পুরুষ বা পক্ষ বিভক্তি যুক্ত হয়, সেগুলোকে বলা হয় আমি- পক্ষ (=উত্তম পুরুষ), তুমি-পক্ষ (=সাধারণ মধ্যম পুরুষ), তুই-পক্ষ (তুচ্ছার্থক মধ্যম পুরুষ), সে-পক্ষ (=সাধারণ প্রথম পুরুষ) ও গুরু-পক্ষ (=আপনি-তিনি=সম্ভ্রমার্থক মধ্যম ও প্রথম পুরুষ)। এদের বিভক্তিগুচ্ছ এক এক কালে এক এক রকম। প্রকার ও কাল-বিভক্তি পক্ষ অনুযায়ী বদলায় না, কেবল অন্তস্থ পক্ষ-বিভক্তিই বদলায় (বর্তমান কালে -ই, -ও, -ইস, -এ, -এন: করি, কর, করিস, করে করেন)। ধাতুর সঙ্গে -আ বিভক্তি যোগ করে অনেক ধাতুকেই প্রযোজক ধাতুতে রূপান্তরিত করা যায় (করেকরাই); আবার -আ যুক্ত হয়ে নামধাতুও নির্মিত হয় ঘুমাই, সাঁতরাই। একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রিয়ারূপে বিভক্তিগুলোর ক্রম এরকম: (ধাতু) + প্রযোজক বিভক্তি + প্রকার বিভক্তি + কাল বিভক্তি + পক্ষ বিভক্তি (কর্ + আইই + এছ্‌ + ইল্ + আম) ।
বাংলা ধাতু মূলত একদল (monosyllabic) ও দ্বিদল ( bisyllabic), যেমন কর্-, করা-। প্রযোজক ধাতু ও নামধাতু স্বতই দ্বিদল। এর চেয়ে বেশিদলের ধাতুও আছে ঝলমলা-, চকমকা- ইত্যাদি। অসমাপিকা ক্রিয়ারূপ চারটি ক্রিয়াবিশেষ্য (করা), পূর্বক্রিয়া (ক’রে), সাপেক্ষ সংযোজক বা যদ্যর্থক (করলে) এবং নিমিত্তার্থক (করতে)। এক ধরনের সমাসের দ্বারা ব্যতিহার ক্রিয়া তৈরি হয় ডাকাডাকি, ঘোরাঘুরি। যুক্তক্রিয়া তৈরি হয় বিশেষ্য বা বিশেষণের সঙ্গে কর, হ, মার্ জাতীয় কিছু ধাতুর সমাপিকা রূপ যোগ করে উপকার করা, ভালো হওয়া, চোখ মারা। যৌগিক ক্রিয়া হয় পূর্বক্রিয়া, কখনো বা নিমিত্তার্থক ক্রিয়ার সঙ্গে উঠ পড় ফেল্ থাক্ ইত্যাদি একদল ক্রিয়া যোগ করে করে ওঠা, বসে পড়া, বলে ফেলা, হাসতে থাকা ইত্যাদি ।
বাংলায় প্রত্যয় যোগ করে পদান্তর ও পদনির্মাণের ক্ষেত্রটি খুব প্রশস্ত নয়। খাঁটি বাংলা প্রত্যয় খুব বেশি নেই, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কৃত প্রত্যয় -তা, -ত্ব, -ইমা ইত্যাদি ঋণ করে পদান্তর করতে হয়। তুলনাত্মক প্রত্যয় (-তর, -তম) এবং পূরণবাচক শব্দগুলোও (প্রথম দ্বিতীয় ইত্যাদি) বহুলাংশে সংস্কৃত নির্ভর। তবে বাংলায়
কৃৎ-তদ্ধিত প্রত্যয়ের সংখ্যা বেশি না হলেও নির্দেশক (-টা, -টি, খানা), (ঝোলা), ক্ষুদ্ৰাৰ্থক (ঝুলি), আদরার্থক (রামু), অনাদরার্থক (রামা) ইত্যাদি মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে।
অন্বয় : বাংলায় পদবিন্যাস সাধারণভাবে বামশাখাক্রমিক (left branching), অর্থাৎ বিশেষণ বাঁয়ে, বিশেষ্য ডাইনে বসে; তেমনই ক্রিয়াবিশেষণ আগে ও ক্রিয়া পরে বসে। বাক্যের উপাদানক্রম সাধারণভাবে এরকম: কর্তা + সময়বাচক পদ স্থানবাচক পদ + গৌণকর্ম + মুখ্যকর্ম + ধরনবাচক পদ + ক্রিয়া: 'আমি কাল স্টেশনে রুনাকে কথাটা কানে কানে বলেছি।' তবে উপাদানের স্থান অল্প বিস্তর বদল হয়, তাতে অর্থ ও ব্যঞ্জনায় অদলবদল ঘটে। বাংলায় রুশ, তামিল বা জাপানির মতো ক্রিয়াধীন বাক্য আছে ‘আমার নাম রুহুল কুদ্দুস।' ইংরেজি ধরনের কর্মভাববাচ্য বাংলায় তেমন নেই, তবে ক্রিয়াকে বিশেষ্য রূপ দিয়ে কর্তার ভূমিকায় বসিয়ে ভাববাচ্য যথেষ্ট প্রচলিত ‘তোমার খাওয়া হয়েছে? এ পথে ফরিদপুর যাওয়া চলে।' বাংলায় প্রশ্ন নির্মাণ সাধারণভাবে প্রশ্নবাচক শব্দ যোগ করে হয় । জটিল বাক্যের মধ্যে প্রতিনির্দেশক যুক্ত বা সাপেক্ষ বাক্যনির্মাণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ‘যখন ও আসবে তখন আর আমি থাকব না।'
শব্দভাণ্ডার : উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রধান উপাদান তদ্ভব (সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে বাংলায় এসে অন্তত দুবার পরিবর্তিত শব্দ), তৎসম (মূলত সংস্কৃত বানানে রক্ষিত কিন্তু উচ্চারণে পরিবর্তিত শব্দঋণ) এবং অর্ধতৎসম (বাঙালির মুখের উচ্চারণে ভেঙেচুরে নেয়া সংস্কৃত শব্দ, যেমন প্রত্যাশাপিত্যেশ)। এগুলোর উৎস সংস্কৃতভাষা। সেই সঙ্গে আছে অজস্র অজ্ঞাতমূল বা দেশি শব্দ যেগুলো হয়তো দ্রাবিড়, অস্ট্রিক বা ভোটবর্মী ভাষা থেকে প্রাচীন ঋণ। এছাড়াও আছে প্রচুর নতুন শব্দঋণ ফারসি, আরবি, ইংরেজ, পর্তুগিজ ও অন্যান্য ভাষা থেকে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানের মোট শব্দের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছিলেন, তাতে তদ্ভব ৫১.৪৫ শতাংশ, তৎসম ৪৪.০০ শতাংশ, ফারসি-আরবি ৩.৩০ শতাংশ আর ইংরেজি-পর্তুগিজ ইত্যাদি ১.২৫ শতাংশ। অবশ্য এ পরিসংখ্যান সর্বৈব সঠিক নয় এবং এ থেকে বাংলা শব্দের ব্যবহারিক (মৌখিক ও লিখিত) কোন ছবি পাওয়া যায় না। তাছাড়া জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধানে প্রায় দেড়লাখ শব্দ থাকলেও সমস্ত উপভাষা মিলিয়ে ব্যবহৃত বাংলা শব্দের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি।
১২.২ বাংলা লিপি ও ধ্বনিবিন্যাস পদ্ধতি
System of Bangla Alphabet and Phonetics
বাংলা ভাষায় যে লিপিপদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তা বাংলা লিপি নামে পরিচিত। প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপির বিবর্তিত রূপ কুটিল লিপি থেকে এর উৎপত্তি। উনিশ শতকের শুরুতে ছাপাখানায় বাংলা পুস্তক মুদ্রণ শুরু হওয়ার (প্রথম মুদ্রিত রূপ হ্যালহেডের
বাংলা ব্যাকরণ A Crammar of the Bengal Language। এতে প্রথম বাংলা রাইপ ব্যবহৃত হয়। এর পর থেকে বাংলা লিপির আকৃতি সুশৃঙ্খল হতে থাকে। ছাপাখানায় টাইপের উন্নততর ব্যবহারে, বিশেষকরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায়) বাংলা লিপির আকৃতি ও প্রকৃতি সুস্থিত হয়ে ওঠে। অক্ষরমূলক (syllabic) আরামিক (Aramic) পদ্ধতির সঙ্গে বাংলা লিখন পদ্ধতির সামঞ্জস্য রয়েছে। এ পদ্ধতিতে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে শব্দ তৈরি হয়, আর অক্ষরগুলো তৈরি হয় একটি স্বরধ্বনি বা একটি স্বরধ্বনির সঙ্গে অন্য কোন ধ্বনির (স্বরধ্বনি, অর্ধ-স্বরধ্বনি। বা ব্যঞ্জন ধ্বনির) সংযোগে ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) বাংলা লিপির আদর্শায়নের প্রয়াসে F বর্জন করেন এবং ং ও ঃ-কে ব্যঞ্জনবর্ণের শেষে ন্যস্ত করেন। ড়, ঢ় এবং ৎ-কেও তিনি বর্ণমালায় স্থান দেন। বাংলা বর্ণমালা তবু সংস্কৃত বর্ণমালার আদলেই প্রস্তুত। সচরাচর এতে বারোটি স্বরচিহ্ন ও ত্রিশটি ব্যঞ্জনচিহ্ন থাকে। মুখে উচ্চারিত ধ্বনির সঙ্গে এ চিহ্নগুলো সবক্ষেত্রে মেলে না। দীর্ঘ স্বর ও তার চিহ্ন এবং ঞ, ণ, য, ষ্ ইত্যাদি বর্ণের নির্দিষ্ট উচ্চারণ বাংলায় নেই ।
লিপিপদ্ধতিতে হ্রস্ব উ-কার, দীর্ঘ ঊ-কার, আর ঋ-কারের একাধিক বর্ণভেদ (allogragh) আছে, তেমনই আছে বহু যুক্তব্যঞ্জনচিহ্ন। বিরামচিহ্নগুলো বেশির ভাগ ইয়োরোপীয় । কোন কোন সময়ে ও স্থানে বাংলা আরবি-ফারসি বা এক বিশেষ ধরনের নাগরী (সিলেটি নাগরী) লিপিতে লেখা হয়েছে বাংলা লিপিতে। এখনও বঙ্গভাষী অঞ্চলের সাঁওতাল সম্প্রদায় সাঁওতালি লেখায় বহুলত বাংলা লিপি ব্যবহার করে।
ইতিহাস মাস্টার্স ফাইনাল টেক্সট (৩১১৫০৭)- ১৯
সাধারণভাবে সংস্কৃত ধ্বনিপদ্ধতির ব্যঞ্জনধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্যগুলো বাংলায় রয়েছে, যেমন: অল্পপ্রাণ/মহাপ্রাণ, ঘোষ/অঘোষ, দন্ত্য/প্রতিবেষ্টিত ইত্যাদি। সংস্কৃতের মতোই প্রত্যেক ব্যঞ্জনভিত্তিক অক্ষরে বা ব্যঞ্জনবর্ণ-এককের সঙ্গে অন্তঃস্থায়ী (inherent) স্বর ‘অ’ বিদ্যমান থাকে, যদি না সেই ব্যঞ্জনের সঙ্গে অন্য কোন স্বরধ্বনি যুক্ত হয়, যেমন— 'ক' হলো আসলে ক্+অ, আবার 'কি' হলো ক্+ই। কিন্তু তারপরেও সংস্কৃতের ধ্বনিপদ্ধতির সঙ্গে বাংলার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পার্থক্য।
বাংলায় অন্তঃস্থায়ী স্বর ‘অ-এর উচ্চারণ সংস্কৃতের মতো সর্বত্র সুনিয়মিত ও সুস্থিত নয়। ‘অ' কখনো অনেকটা ও-এর কাছাকাছি (অভিশ্রুত ও ) রূপে উচ্চারিত হয়। এরকম বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলায় অ-এর উচ্চারণে অস্থিরতার ফলে বাংলা বানানে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর অন্যান্য অনেক ভাষার মতোই বাংলায় শব্দান্তের সিলেবলে 'অ' প্রায়শই লোপ পায়। স্বরধ্বনির নাসিক্যীভবন স্বাভাবিক ও নিয়মিত, যেমন: সম্মানবাচক তৃতীয় পুরুষের সর্বনাম পদ ‘তাঁর'-এর সঙ্গে সাধারণ ‘তার'-এর সুস্পষ্ট পার্থক্য ঘটে। সংস্কৃতের মূল ‘ড’(d) বাংলায় আন্তঃস্বরীয় শব্দের মধ্যে বা শেষে থাকলে 'ড়'(r)-রূপে উচ্চারিত হয় এবং উনিশ শতক থেকে বাংলা লিপিতে এভাবে 'ড়' এবং 'ঢ়' রূপে পৃথক দুটি বর্ণের সংযোজন ঘটে। সংস্কৃতের বর্গীয়-ব (b) এবং অন্তঃস্থ-ব (v) বাংলায় বর্ণমালায় 'ব' রূপেই উচ্চারিত হয়।
সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি প্রায়শই দ্বিত্বব্যঞ্জনরূপে উচ্চারিত হয়; যেমন: বিশ্ব / (বিশ), / লক্ষ্মী / [লক্ষ্মী] (যথাক্রমে visva bisso, laksmilokkhi) ইত্যাদি। সংস্কৃতের ব (y) বাংলায় শব্দারম্ভে উচ্চারিত হয় 'জ' (dz) রূপে এবং আন্তঃস্বরায় y থেকে লিপি পদ্ধতিতে এর রূপ দাঁড়িয়েছে 'য', কিন্তু তা উচ্চারিত হয় 'জ' হিসেবেই। তাই তিনটি শিসবর্ণ শ, ষ, স-এর উচ্চারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তালব্য [শ] হয়, তবে সংস্কৃতের যম (Yama) বাংলায় লেখা হয় / যম, কিন্তু উচ্চারিত হয় জম/ হিসেবে। ক্ষেত্রবিশেষে, যথা দন্ত্য (স) যুক্তবর্ণ হিসেবে থাকলে তার উচ্চারণ ঠিক থাকে, যেমন: /আসতে/ [আশতে), কিন্তু / আস্তে / [আসৃতে]; তেমনি /রাস্তা/ [রাসূতা], কারে
[কাতে] ইত্যাদি ।
বাংলা ভাষার ব্যবহার : বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা এবং কয়েকটি বিচ্ছিন্ন উপজাতীয় বসতি ছাড়া দেশের মধ্যে ব্যাপকভাবে বাংলাই ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের সরকারি কাজে প্রধানত বাংলা ব্যবহৃত হলেও বিদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগে, বিদেশি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এবং উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সাধারণত ইংরেজি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দেশের সর্বত্র সাধারণভাবে বাংলা ভাষাই ব্যবহৃত হয়। ১৯৯০- এর দশকে বাংলাদেশ সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়।
উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ব্যতীত বাংলার বিভিন্ন উপভাষার প্রভাব বাংলাভাষীদের মধ্যে থেকেই যায়। নির্দিষ্ট কোন উপভাষী ব্যক্তি ঘরের ভেতরে তার নিজস্ব ভাষা, ঘরের বাইরে সাধারণ্যে ব্যবহৃত বাংলা ভাষা এবং শিক্ষা বা শিল্প-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ ও সুচারু মান-বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও আলোচনায় বাংলা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সাহিত্য, শিল্প, নাটক, গণমাধ্যম ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানসম্মত বাংলাই ব্যবহৃত হয়, তবে স্বল্প পরিমাণে হলেও উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও ইদানীং হচ্ছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]