প্রাচীন যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য Bangla Language and Literature in Ancient Age

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বঙ্গদেশ মৌর্যাধিকারে আসার পর থেকে আর্যভাষা এদেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং এর প্রায় সহস্রাব্দ পরে প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) কর্তৃক ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের পদগুলোর রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত। এতে বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মতত্ত্ব ও সাধনভজনমূলক ৪৭টি পদ আছে এবং সেগুলো সুনির্ধারিত তাল, রাগ ও সুরে গীত হওয়ার উপযোগী। পদগুলোর ভাব ও ভাষা সর্বত্র সহজবোধ্য নয়; কতক বুঝা যায় কতক বুঝা যায় না, তাই এ ভাষার নাম হয়েছে সান্ধ্য ভাষা। ব্যঞ্জনাময় শব্দ ব্যবহার, উপমা-রূপকাদি অলঙ্কারের প্রয়োগ, প্রাকৃতিক বর্ণনা, সমাজচিত্র ইত্যাদি বিবেচনায় পদগুলোর সাহিত্যিক ও ভাষানিদৰ্শনগত মূল্য অপরিসীম। পদগুলো রচয়িতাগণ ‘সিদ্ধাচার্য' নামে খ্যাত এবং তাঁদের কয়েকজন হলেন লুইপা, ভুসুকুপা, কাহ্নপা, শবরপা প্রমুখ।
চর্যাপদের পরে প্রবাদ, বচন, ছড়া, ডাক ও খনার বচর ইত্যাদি কিছু কিছু কাব্যনিদর্শন থাকলেও চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন রচনা পাওয়া যায় না। তাই এ সময়টাকে (১২০১-১৩০৫) কেউ কেউ ‘অন্ধকার যুগ' বলে অভিহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল পরিবর্তনের যুগ; ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এবং মুসলিম শাসকদের ভিন্নতর রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তখন এক নতুন পরিবেশ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছিল। সে সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছিল সৃজ্যমান অবস্থায় এবং চর্যার বঙ্গীয়- বৈশিষ্ট্যময় অপভ্রংশ ভাষা আরো বেশি মাত্রায় বাংলা হয়ে ওঠে। এ যুগের প্রাপ্ত নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৩শ-১৪শ শতকের রামাই পণ্ডিতের গাঁথাজাতীয় রচনা শূন্যপুরাণ। এতে বৌদ্ধদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, মুসলমানদের জাজপুর প্রবেশ ইত্যাদি ঘটনার বর্ণনাসম্বলিত 'নিরঞ্জনের রুম্মা' শীর্ষক একটি কবিতা আছে। এছাড়া আছে অপভ্রংশ ভাষায় রচিত প্রাকৃতপৈঙ্গল নামক একটি গীতিকবিতার সংকলন, যার ছন্দ ও ভাষা প্রাকৃত বা আদি পর্যায়ের বাংলা। হলায়ুধ মিশ্র রচিত সেখশুভোদয়া (আনু. ১২০৩) নামক সংস্কৃত গ্রন্থেও একটি বাংলা গান পাওয়া গেছে । এরূপ পীরমাহাত্মসূচক ছড়া বা আর্যা, প্রেমসংগীত এবং খনার বচন শ্রেণির দু-একটি বাংলা শ্লোকই এ সময়কার প্রধান রচনা। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য
Bangla Literature in Middle Age
১. আদি মধ্যযুগ। সাধারণভাবে খ্রিস্টীয় ১৩শ-১৪শ শতক পর্যন্ত কাল বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে চিহ্নিত। এ সময়ের বাংলা সাহিত তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে। বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গল সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য। বড়ু চণ্ডীদাস (১৪শ শতক) এ সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি সিনি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়বিষয়ক নাট্যগীতিকাব্য রচনা করেন। তাঁর আগে কবি জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমমূলক যে গীতিসাহিত্যের প্রবর্তন করেন, চণ্ডীদাস ে ধারাকেই বিকশিত করে তোলেন।
চৈতন্যদেবের আগে পরে রচিত সহস্রাধিক বৈষ্ণব পদের ভণিতায় একাধিক চণ্ডীদাসের নাম পাওয়া যায় আদি চণ্ডীদাস, কবি চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস। এঁরা এক না পরস্পর ভিন্ন তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিতর্ক আছে, যা 'চণ্ডীদাস সমস্যা' নামে পরিচিত। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিষয়গুতের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে যে পুঁথিটি প্রকাশিত হয়, তার ভণিতায় বড়ু চণ্ডীদাসের নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত ইনিই আদি চণ্ডীদাস, যাঁর কাব্যের রচনাকাল ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা যায়। মালাধর বসু সংস্কৃত শ্রমস্তাগবত অবলম্বনে পয়ার ছন্দে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক উপাখ্যান শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। এই কাব্যের জন্য গৌড়েশ্বর তাঁকে 'গুণরাজ খাঁ' উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি 'মঙ্গল' বা 'বিজয়' জাতীয় পাঁচালি বা আখ্যানকাব্য হিসেবে পরিচিত; তাই এর অন্য নাম গোবিন্দমঙ্গল বা গোবিন্দবিজয়। এই পাঁচালিকাব্য বাংলার অনুবাদ শাখারও একটি প্রাচীনতম নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন।
এ যুগেই রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি অনুবাদকাব্যের রচনা শুরু হয়। এ ব্যাপারে মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯- ১৫৩২) এবং সেনাপতি পরাগল খাঁর উৎসাহ ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ব্রজবুলি ভাষায় বাঙালিদের পদ রচনার শুরুও এ সময়েই। এ সময় কবি কঙ্ক সত্যপীরের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় সর্বপ্রথম বিদ্যাসুন্দর কাহিনী রচনা করেন (আনু. ১৫০২)। চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবও এ সময়। তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত বাংলা ভাষায় প্রচার করলে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচিত হয় এবং বৈষ্ণব সাহিত্যেরও ভিত্তি স্থাপিত হয়।
২. মধ্য-মধ্যযুগ এ সময় চৈতন্যদেব বঙ্গদেশে এক নবভক্তিধারার প্রবর্তন করেন, যা ভাবচৈতন্যের ক্ষেত্রে রেনেসাঁর সূচনা করে। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে বাংলায় একটি শক্তিশালী সাহিত্যিকগোষ্ঠী এবং এক বিরাট সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়। এ যুগেই বাংলায় জীবনচরিত লেখার প্রচলন হয় এবং প্রধানত চৈতন্যদেবের
জীবনকে কেন্দ্র করে জীবনী গ্রন্থগুলো রচিত হয়। এ ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। হলো: বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত (১৫৭৩), জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল (১৬শ শতকের শেষভাগ), লোচনদাসের (১৫২৩-১৫৮৯) চৈতন্যমঙ্গল এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত (১৬১৫)। এগুলো ছাড়া আরো কিছু উল্লেখ করার মতো চৈতন্য- সংশ্লিষ্ট জীবনীকাব্য হচ্ছে নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর (চৈতন্যদেবের পার্ষদ- ভক্তদের জীবনী), নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস (শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দের জীবনী এবং তাঁদের ধর্মমত প্রচারের কথা) ও ঈশান নাগরের অদ্বৈতপ্রকাশ (১৫৬৮- ৬৯)। এগুলোর মধ্যে চৈতন্যচরিতামৃতকে চৈতন্যদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ মনে করা হয়। পাণ্ডিত্যপূর্ণ
এ গ্রন্থে একাধারে জীবনচরিত, দার্শনিক তত্ত্ব ও ভক্তিতত্ত্ব চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল বেশকিছু ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ । ক. পদাবলি : এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যধারা হচ্ছে পদাবলি। এর শুরু চৈতন্যপূর্বযুগেই। রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক এ সাহিত্য ভাব, ভাষা ও ছন্দে অতুলনীয়। এতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আত্মার আত্মীয়রূপে কল্পিত; তাঁর ও ভক্তের মধ্যে কোন দূরত্ব নেই। পরে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এবং চৈতন্যদেবের প্রেমসাধনাকে অবলম্বন করেই বিস্তার লাভ করে মধ্যযুগের পদাবলি বা গীতিকাব্যের ধারা। চৈতন্যদেবের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা পদাবলি সাহিত্য বিশেষভাবে পরিপুষ্ট হয়। অনেকের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত জাগরণ ঘটে এই পদাবলি রচনার মধ্য দিয়েই। কতিপয় মুসলমানসহ অগণিত কবি রাধাকৃষ্ণলীলার পদ রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন, যেমন- চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, লোচনদাস, গোবিন্দদাস, কবিবল্লভ রায়শেখর, বলরাম দাস, নরোত্তম দাস, নরহরি দাস, রাধামোহন ঠাকুর প্রমুখ । মিথিলার বিদ্যাপতি ছিলেন চৈতন্যপূর্ব কবি। মৈথিল ভাষায় রচিত তাঁর পদগুলো পদাবলি সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি পদাবলি সাহিত্যের দুই সেরা কবি।
খ. অনুবাদ সাহিত্য : এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝা। বড়ু চণ্ডীদাসের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর রচিত রামায়ণ বাংলা ভাষায় প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। বর্ণনার হৃদয়গ্রাহিত্য এবং ভাষার প্রাঞ্জলতাই এর জনপ্রিয়তার কারণ। কৃত্তিবাস ১৫শ শতকের গোড়ার দিকে জীবিত ছিলেন। তাঁর কাব্যে মধ্যযুগের বাঙালি জীবন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। ১৮০২-৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়। মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে তা সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃত্তিবাসের পরে আরো অনেকে রামায়ণ রচনা করেছেন। সতেরো শতকে ময়মনসিংহের মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতীর রামায়ণগাঁথা সে অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। উত্তরবঙ্গের অদ্ভুত আচার্য রামায়ণ গায়ক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। নোয়াখালীর দ্বিজ ভবানী দাসের শ্রীরাম পাঁচালি কাব্য অধ্যাত্ম রামায়ণ অবলম্বনে রচিত।
মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ হচ্ছে কবীন্দ্র মহাভারত। ১৫১৫-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কবীন্দ্র পরমেশ্বর এটি রচনা করেন। লস্কর পরাগল খাঁর নির্দেশে রচিত বলে এটি পরাগলী মহাভারত নামেও পরিচিত। কবীন্দ্র মহাভারতে অশ্বমেধ পর্ব সংক্ষিপ্ত ছিল বলে ছুটি খাঁর নির্দেশে শ্রীকর নন্দী জৈমিনিসংহিতার অশ্বমেধপর্ব অবলম্বনে বিস্তৃত আকারে সেটি রচনা করেন, যাকে পৃথক গ্রন্থ না বলে বরং কবীন্দ্র মহাভারতের পরিশিষ্ট বলা চলে। বাংলা মহাভারতের প্রধান কবি কাশীরাম দাস আনুমানিক ১৬০২-১৬১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্য রচনা করেন। শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ১৮০১-১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি মুদ্রিত হয়। সকল বাংলা মহাভারতের মধ্যে এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা
লাভ করে।
গ. মঙ্গলকাব্য : বাংলার নিজস্ব উপাদানে রচিত লৌকিক দেবমাহাত্ম্যমূলক কাহিনীকাব্য। পাঁচালি কিংবা পালার আকারে চৈতন্যপূর্ব যুগেই এগুলো রচিত হয়। এগুলোর নাম কেন মঙ্গলকাব্য হয়েছে সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। এর পালা এক মঙ্গলবারে শুরু হয়ে আরেক মঙ্গলবারে শেষ হতো বলে কেউ কেউ একে মঙ্গলকাব্য বলেছেন। নামকরণের ক্ষেত্রে এরূপ একটি কারণকে বিবেচনা করা হলেও মূলত কাব্যগাথার মাধ্যমে দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচার এবং তা শ্রবণে ধর্মীয় বিনোদনের সঙ্গে মঙ্গল কামনাই বাঙালি হিন্দু কবিকে মঙ্গলকাব্য রচনায় উৎসাহিত করে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় পূর্ণ বঙ্গদেশে তাই অবশ্যম্ভাবীরূপে এসেছে পুরাণের দেবদেবীরা এবং ভক্তমনের কল্পনাপ্রবাহে অসংখ্য মানব ও অতিমানব; আর চরিত্রগুলোও হয়ে উঠেছে শাশ্বত বাংলা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া সংগ্রামী মানুষের প্রতীক। এই কাব্যগুলো থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, কৃষি, বাণিজ্য, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্বন্ধে
অনেক তথ্য জানা যায় ।
মঙ্গলকাব্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মনসামঙ্গল, তন্মধ্যে বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ (১৪৯৪) সর্বাধিক জনপ্রিয়। মনসামঙ্গল এক সময় পূর্ববঙ্গের জাতীয় কাব্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারা উৎকর্ষের জন্য বিখ্যাত। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৬শ শতক) রচিত চণ্ডীমঙ্গল সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত; এর জন্য রাজা রঘুনাথ রায় তাঁকে ‘কবিকঙ্কণ” উপাধিতে ভূষিত করেন। অন্যান্য মঙ্গলকাব্য হচ্ছে ধর্মমঙ্গল, শিবমঙ্গল ইত্যাদি এবং এগুলোর প্রধান রচয়িতারা ছিলেন ১৮শ শতকের। ধর্মমঙ্গলের আদি কবি ময়ূরভট্ট; তাঁর পরবর্তী প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন খেলারাম চক্রবর্তী, যাঁর কাব্যের নাম গৌড়কাব্য; কিন্তু এঁদের কাব্যের পুঁথি পাওয়া যায়নি; একমাত্র রূপরাম চক্রবর্তীর কাব্যই পাওয়া গেছে, যার রচনাকাল ১৬৪৯-১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বলে ধরা হয়। রূপরাম বাস্তব দৃষ্টিতে মানব জীবন বর্ণনা করেছেন।
কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনে বৈদিক দেবতা রুদ্র শিবের রূপ ধারণ করে; শিব বাঙালি হিন্দুর জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই বাঙালির সুখ-দুঃখ ভরা সংসারের কথা স্থান পেয়েছ শিবমঙ্গলে। এ ধারার প্রথম কাব্য দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৬৭৪)
।। শিবায়নের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর রচয়িতা রামেশ্বর চক্রবর্তী । শীতলামঙ্গল (কৃষ্ণরাম দাস) ও ষষ্ঠীমঙ্গল নামে দুটি । ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের কথা নিয়ে রচিত শেষোক্ত গ্য। এ কাব্যে সমাজধর্মের সমন্বয় প্রয়াসে নিম্নশ্রেণির র সহাবস্থানের কথা আছে। ফলে দক্ষিণরায়ের সঙ্গে পূজাও এতে স্থান পেয়েছে ।
সাহিত্য চর্চা : মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় মলে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের বড় অবদান ব্যধারার প্রবর্তন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৌদ্ধ-হিন্দু রচিত দেবীরা প্রধান এবং মানুষ অপ্রধান সেখানে মুসলমান রচিত য়ছে। মুসলমান কবিরা কাহিনীকাব্য ও ধর্মীয় সাহিত্যের ংস্কৃতির সমন্বয়মূলক সাহিত্যও রচনা করেছেন; এমনকি তিশাস্ত্রীয় কাব্যও তাঁরা রচনা করেছেন। বিষয়বস্তুর দিক রচিত কাব্যগুলোকে প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়: সংস্কৃতিবিষয়ক কাব্য, শোকগাঁথা, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় কাব্য
মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছেন শাহ মুহম্মদ সগীর। তাঁর কাব্য য়াসুদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত সব পুঁথি চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা ও পার্শ্ববর্তী পাওয়া গেছে। বাইবেল কুরআনের ইউসুফ নবীর সংক্ষিপ্ত জামীর ইউসুফ জুলেখায় পল্লবিত, তিনি তা বাংলায় যেভাবে তে তা একটি মৌলিক কাব্যের মর্যাদা পেয়েছে। জৈনুদ্দীন জয় রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি গৌড় সুলতান ১৪৮১) সভাকবি ছিলেন। এর গল্পাংশ ফারসি থেকে নেওয়া। ধারা মধ্যযুগে প্রাধান্য লাভ করে তদনুসারেই এর নামের সঙ্গে । কাহিনীতে কিছু ঐতিহাসিক নামের উল্লেখ থাকলেও ঘটনা ম্মিল ১৫শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান ছিলেন। তিনি র জন্য খ্যাতি অর্জন করেন: নীতিশাস্ত্রবার্তা, সায়ানামা ও অনুবাদ সায়ানামায় সুফিবাদ স্থান পেয়েছে এবং অনুবাদে ১টি আকর্ষণীয় হয়েছে। তাঁর নীতিশাস্ত্রবার্তায় বহু বিষয় লিপিবদ্ধ হলেন গৌড় সুলতান হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) নবদ্বীপের থাকাকালেই নবদ্বীপে গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের প্রচার ও প্রসার ঘটে ণ বৈষ্ণব ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি কোন কাব্য রচনা । পদ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। শেখ কবীরও ছিলেন
একজন খ্যাতিমান পদকর্তা। তিনি সুলতান নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের সময়ে আবির্ভূত হন এবং সম্ভবত তাঁর রাজকর্মচারী ছিলেন। আফজাল আলী এ যুগের কবিদের অন্যতম। নসিহতনামা নামে একটি কাব্য এবং বৈষ্ণবীয় ঢঙে রচিত তাঁর কয়েকটি প পাওয়া গেছে (সম্ভবত ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত)। এ গ্রন্থে কবিত্ব তেমন নেই তবে সরল ভাষায় ধর্মোপদেশ আছে। সাবিরিদ খান বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা বল মনে করা হলেও কোনটিরই সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায়নি। বিদ্যাসুন্দর, রসুলবিজয় এব হানিফা ও কয়রাপরী নামে তাঁর তিনটি কাব্যের খণ্ডিত পুঁথি পাওয়া গেছে। সোনাগাজীর বিখ্যাত কাব্য সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল। তিনি সম্ভবত ১৬শ শতকের মধ্যভাগে আবির্ভূত হন। তাঁর ভাষা সাধারণ এবং প্রাকৃত প্রভাব ও সারল্যের মিশ্রণে প্রাচীনত্বের দ্যোতক। শেখ ফয়জুল্লাহ মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের মধ্যে একটি বিশিষ্ট অধিকার করে আছেন। যে পাঁচটি গ্রন্থের জন্য তিনি খ্যাতিমান সেগুলো হলো গোরক্ষবিজয়, গাজীবিজয়, সত্যপীর (১৫৭৫), জয়নবের চৌতিশা এবং রাগনামা রাগনামাকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সংগীতবিষয়ক কাব্য মনে করা হয়। দৌলত উজীর বাহরাম খাঁর একটিমাত্র কাব্য পাওয়া গেছে এবং সেটি হলো লায়লী মজনু; এর রচনাকাল ১৫৬০-১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অনুমান করা হয়। এটি ফারসি কবি জামীর লাইলী মজনু কাব্যের ভাবানুবাদ; তবে স্বচ্ছন্দ রচনা, কাব্যরস ইত্যাদি গুণে এটি অনন্য। মুহম্মদ কবীর একটিমাত্র কাব্য মধুমালতী রচনা করেই বিখ্যাত হন। ১৫৮৩- ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যটি রচিত বলে মনে করা হয়। কাব্যের পরিবেশ ও পরিকল্পনা গুলে বকাওলী জাতীয় ।
इन
এছাড়া অন্যান্য মুসলমান কবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: সৈয়দ সুলতান (আনু. ১৫৫০-১৬৪৮, কাব্য: নবীবংশ, শব ই মিরাজ, রসুলবিজয়, ওফাৎ-ই- রসুল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিসনামা, জ্ঞানচৌতিশা, জ্ঞানপ্রদীপ, মারফতি গান, পদাবলি), শেখ পরান (আনু. ১৫৫০-১৬১৫, কাব্য: নূরনামা, নসিহতনামা), হাজী মুহাম্মদ (আনু. ১৫৫০-১৬২০, কাব্য: নূর জামাল, সুরনামা), মীর মুহাম্মদ শফী (আনু. ১৫৫৯-১৬৩০, কাব্য: নূরনামা, নূরকন্দীল, সায়ানামা), নসরুল্লাহ খাঁ (আনু. ১৫৬০-১৬২৫, কাব্য: জঙ্গলনামা, মুসার সওয়াল, শরীয়ত্নামা, হিদায়িতুল ইসলাম), মুহম্মদ খান (আনু. ১৫৮০-১৬৫০, কাব্য: সত্য-কলি-বিবাদ-সংবাদ, হানিফার লড়াই, মকতুল হুসেন), সৈয়দ মর্তুজা (আনু. ১৫৯০-১৬৬২, কাব্য: যোগ-কলন্দর, পদাবলি), শেখ মুত্তালিব (আনু. ১৫৯৫-১৬৬০, কাব্য: কিফায়িতুল-মুসল্লীন), আবদুল হাকীম (আনু, ১৬২০-১৬৯০, কাব্য: লালমতী-সয়ফুলমুলক, নূরনামা সহ ৮টি)। ১৬০০ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকজন হলেন নওয়াজিশ খাঁ, কমর আলী, মঙ্গল (চাঁদ), আবদুন নবী, মুহম্মদ ফসীহ, ফকির গরীবুল্লাহ, মুহম্মদ ইয়াকুব, শেখ মনসুর, শেখ চাঁদ, মুহম্মদ উজীর আলী, শেখ সাদী, হেয়াত মামুদ প্রমুখ। সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ, মুহম্মদ খানের মকতুল হোসেন এবং শেখ চাঁদের রসুলবিজয়কে ইসলামি পুরাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]