সুলতানি আমলে বাংলার মুসলিম স্থাপত্য শিল্প Muslim Architecture of Bengal in Sultanate Period


১৩.৩ সুলতানি আমলে বাংলার মুসলিম স্থাপত্য শিল্প
Muslim Architecture of Bengal in Sultanate Period বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সূচনা হয় বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের। মিনহাজের তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, বখতিয়ার খলজি 'মসজিদ মাদ্রাসা ও খানকাহ' নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু নিছক অনুমান ছাড়া এসব নির্মাণকাজের ধরন ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অতি সামান্যই জানা যায়। অপরাপর দেশের সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং এদেশের পরবর্তী সময়ের জ্ঞাত উদাহরণ থেকে অনুমান করা যায় যে, তারা যুদ্ধকালে শত্রুদের পরিত্যক্ত স্থানীয় উপকরণ এসব কাজে ব্যবহার করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে মুসলমানগণ তাদের বিজয়ের পরপরই প্রয়োজনবোধে শত্রুদের পরিত্যক্ত গির্জা ও মন্দিরগুলোকে মসজিদরূপে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ভারতবর্ষ ও বঙ্গদেশে এটা সম্ভব ছিল না, কারণ মন্দিরগুলোর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য, প্রধানত এদের আকার ও দিগ্বলনের কারণে এগুলো মসজিদে রূপান্তর করার অনুপযোগী ছিল। কাজেই নির্মাণ কারিগরদের (বেশির ভাগ স্থানীয়) হাতে মসজিদের নকশা তুলে স্থানীয় উপকরণ দিয়ে তাদের নিজস্ব নির্মাণশৈলী মোতাবেক মসজিদের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে বলাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। এর ফল ছিল সুস্পষ্ট; স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে স্থানীয় নির্মাণপদ্ধতিতে মসজিদ নির্মিত হয় ৷
বঙ্গবিজয়ের পর এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছিল, তাতে এই সময়ে বহু ইমারত নির্মিত হয়েছিল এমনটি মনে করা স্বাভাবিক নয়। শিলালিপিতে বিধৃত কতিপয় বরাত এবং এখনো বিদ্যমান জাফর খান গাজী মসজিদ ও সমাধিসৌধ এবং পশ্চিবঙ্গের হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে অবস্থিত বরী মসজিদ ও মিনার ছাড়া অপর কোন ধর্মীয় ও সেক্যুলার ইমারতের টিকে থাকার নজির নেই। এমনকি, যে জাফর খান গাজীর মসজিদ ও বরী মসজিদ যথাক্রমে ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে এবং চতুর্দশ শতকের প্রথমদিকে নির্মিত বলে কথিত, সেগুলোতেও পরবর্তীকালের মসজিদের নির্মাণবৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট। গৌড়ের কদম রসুল ও রাজশাহীর বাঘা মসজিদ এর সঙ্গে জাফর খান গাজীর মসজিদের, বিশেষত সম্মুখদিকের স্তম্ভ ও ভেতরের মিহরাবের তুলনা করলে প্রমাণিত হয় যে, এগুলো হোসেন শাহী আমলে নির্মিত অথবা সেসময়ে পরিবর্তিত ও পুননির্মিত। বরী মসজিদের অবয়বের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অবস্থা। এই মসজিদের স্তম্ভ, খিলান ও পেন্ডেন্টিভ গৌড়ের দরসবাড়ি বা ধুনিচক মসজিদ এর স্তম্ভ খিলান ও পেন্ডেন্টিভের মধ্যে এমনই সাদৃশ্য বিদ্যমান যে, এই মসজিদ দুটি নিঃসন্দেহে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে পরবর্তী ইলিয়াসশাহী শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল।
১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াসশাহী বংশের ক্ষমতালাভের ফলে অবস্থার পরিবর্তন। ঘটে। এতকাল দিল্লির সুলতানের অধীনস্থ শাসনকর্তাগণ বাংলা শাসন করতেন। এই শাসনকর্তারা মাঝেমধ্যে বিদ্রোহী হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। কিন্তু ইলিয়াসশাহী বংশের ক্ষমতা লাভের ফলে প্রায় সমগ্র দেশের উপর কর্তৃত্ব ও স্থানীয় উচ্চাভিলাষ নিয়ে একটি সার্বভৌম রাজবংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। হাজী ইলিয়াস শাহই বাংলায় সর্বপ্রথম 'শাহ-ই-বাঙ্গালা' উপাধি ধারণ করেন। এই বংশের সুলতানগণ মধ্যখানে তেইশ বছরকাল বিরতিসহ ১৩৪২ থেকে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গদেশ শাসন করেন এই তেইশ বছর (১৪৮৭-১৪৯৩)। এঁদের পর ১৪৯৪ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গদেশ শাসন করেন হোসেনশাহী বংশীয়রা। ১৫৩৮ থেকে ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শূর বংশীয় এবং ১৫৬৩ থেকে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের বঙ্গদেশ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত শাসন কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন কররানী বংশীয় শাসকগণ। ১৩৪২ থেকে ১৫৭৬ পর্যন্ত সময়টি ছিল বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণকাল। এসময় স্থাপত্যশিল্প তার স্বকীয় রীতি পরিগ্রহ করে এবং সাধারণত একে বাংলা রীতি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই বাংলা রীতি দিল্লির সুলতানি রীতি বা ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক রীতি থেকে ভিন্নতর। এই নতুন রীতিতে ইলিয়াসশাহী ও হোসেন শাহী সুলতানরা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
স্বাধীন যুগের যেসকল সৌধ এখনো টিকে আছে তার সবগুলোই রাজধানী শহর অথবা বিভাগীয় সদরে অবস্থিত। এর থেকে বুঝা যায় যে, তখনকার সময়ে স্থাপত্যশিল্প ছিল একান্তই শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপার। যেসব নগর বা শহরে এসব সৌধ টিকেছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গৌড়-লখনৌতি, পাণ্ডুয়া- ফিরুজাবাদ, মাহমুদাবাদ বা মুহম্মদাবাদ, খলিফাতাবাদ, সোনারগাঁও ও বাঘা। এদের সবগুলোই ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র। সুরা, কুসুম্বা, শৈলকুপা, নবগ্রাম, মসজিদবাড়ি, রামপাল প্রভৃতি স্থানে ছোট অথচ স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যেসব মসজিদ রয়েছে তার থেকে বুঝা যায় যে, এসব স্থান একসময় ছিল ছোট প্রশাসনিক কেন্দ্র বা বাজার ।
যেসব স্থাপত্য নিদর্শন এখনো টিকে আছে তার অধিকাংশই ধর্মীয় ইমারত। এর কারণ সুস্পষ্ট। ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে ইমারতগুলো পরিত্যক্ত হলেও এদের উপকরণ অপহৃত বা লুণ্ঠিত হয়নি। গৌড়-লখনৌতি ও পাণ্ডুয়া-ফিরুজাবাদের দিকে তাকালেই বুঝা যাবে যে, ব্যক্তিগত ইমারত তৈরির জন্য কিভাবে পুরাতন সেক্যুলার ইমারতগুলো অপহৃত বা লুণ্ঠিত হয়েছে।
ধর্মীয় শ্রেণির ইমারতের মধ্যে মসজিদের প্রাধান্যই সর্বাধিক। এগুলো আবার দুধরনের- শুক্রবারের জুমা'র নামাযের জন্য জামে মসজিদ এবং ওয়াক্তিয়া মসজিদ । এই ওয়াক্তিয়া মসজিদকে কখনো কখনো পাঞ্জেগানা মসজিদও বলা হয়। শুধু
পাঞ্জেগানা বা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয় বলে এই
মসজিদগুলোর এরূপ নাম দেওয়া হয়েছে। জামে মসজিদকে আলাদাভাবে শনাক্তকরণের চিহ্ন হচ্ছে এগুলো আকারে বড় এবং এতে সাধারণত উত্তর-পশ্চিম কোণে শাহী গ্যালারি বা মাকসুরা থাকে অনেকটা দোতলার মতো। শাসক বা তার প্রতিনিধির নিরাপত্তা বিধানের জন্য এই গ্যালারি বা মাসুরা নির্মাণ করা হয়। খলিফাতাবাদ মসজিদ অর্থাৎ বর্তমান বাগেরহাট জামে মসজিদে (আদিনা মসজিদ এর মসজিদ) শাহী গ্যালারি না থাকার কারণ এখানে গ্যালারির বিকল্প হিসেবে মধ্যবর্তী মিহরাবের উত্তর পাশে একটি গুপ্ত পথ তৈরি করা হয়েছে। প্রথম দিকের শাসকগণ মিহরাবকে বেষ্টনকারী মাকসুরায় পৌঁছার জন্য মাঝেমধ্যে এই পথটি পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবহার করতেন ।
জামে মসজিদগুলো সচরাচর আয়তাকার ও বহু গম্বুজবিশিষ্ট। এতে মধ্যখানে লম্বালম্বিভাবে ভাগ করা খিলানযুক্ত বিস্তৃত 'নেভ' থাকে। হজরত পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ ছাড়া কোন জামে মসজিদেই 'রিওয়াক' বেষ্টিত খোলা ‘সাহান’ নেই। ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদের এই বৈশিষ্ট্যটি ভারতের বাইরে অথবা দিল্লির কোন মসজিদেও সংযোজন করা হয়নি। আদিনা মসজিদ (১৩৭৩) ও খলিফাতাবাদ মসজিদ (পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগ) ছাড়া সুলতানি আমলের প্রতিনিধিত্বকারী নিম্নোক্ত জামে মসজিদগুলো নজির হিসেবে উল্লেখ করা যায় : গুণমন্ত মসজিদ (পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ), তাঁতিপাড়া মসজিদ (আনু. ১৪৮০), দরসবাড়ি মসজিদ (১৪৭৯), গৌড়- লখনৌতির ছোট সোনা মসজিদ (১৪৯৪-১৫১৯) ও বড় সোনা মসজিদ (১৫৫৮) এবং সম্প্রতি উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত বারো বাজারের (যশোর) সাতগাছিয়া ও মনোহর দিঘির জামে মসজিদ (পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ অথবা ষোড়শ শতকের প্রথম দিকের)। রাজকীয় গ্যালারি নেই অথচ শিলালিপিতে জামে মসজিদ বলে উল্লিখিত একমাত্র মসজিদ হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ জেলার রামপালের মসজিদ। এই মসজিদটি পরবর্তী ইলিয়াসশাহী বংশের শেষ সুলতান জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ কর্তৃক ৮৮৮ হিজরিতে (১৪৮৩ খ্রি.) নির্মিত হয়।
ওয়াজিয়া মসজিদগুলো আকারে ছোট এবং সাধারণত বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত হয়ে থাকে। এগুলো শুধু নামাযের জন্যই নয়, সামাজিক বৈঠক অনুষ্ঠানস্থল এবং প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষালয়রূপেও ব্যবহৃত হতো। এই মসজিদগুলো সাধারণত এক গম্বুজ বিশিষ্ট। এ ধরনের কোন কোন মসজিদের সম্মুখভাগে উত্তর ও দক্ষিণে বিস্তৃত খিলানাকৃতি বারান্দাও থাকে। জামে ও ওয়াক্তিয়া উভয় ধরনের মসজিদের খিলান তৈরি হয় বাংলার চিরায়ত কুটিরের অনুকরণে চৌচালা আকৃতিতে। এধরনের মসজিদের চৌচালা খিলানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো গৌড়-লখনৌতির চামকাটি মসজিদ (১৪৭৫), খনিয়া দিঘি মসজিদ (পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের), বারো বাজারের জোড় বাংলা ও গোড়ায় মসজিদ (পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ বা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকের),
৩২৪ বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যশিল্প : সুলতানি আমল ও মুঘল আমলে বাংলার মুসলিম স্থাপত্য রীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য
সোনারগাঁয়ের গোয়ালদি মসজিদ (পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ বা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকের) এবং দিনাজপুরের সুরা মসজিদ (পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ বা ষোড়শ শতাব্দীর
প্রথম দিকের) ।
টিকে থাকা অপরাপর ধর্মীয় শ্রেণির সৌধ হচ্ছে কিছুসংখ্যক সমাধিসৌধ। এই সৌধগুলো দুধরনের- ইমারত ও পাথরে বাঁধানো কবর। এছাড়া রয়েছে গৌড়- লখনৌতির দুটি মাদ্রাসা ভবন। এদের একটির ভিত সম্প্রতি খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। ইমারতগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পাণ্ডুয়া-ফিরুজাবাদের জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের (১৪১৫-১৪৩২) সমাধি ও বাগেরহাটের খান জাহান এর (মৃত্যু ১৪৫৯) সমাধি। বর্গাকার ও এক-গম্বুজবিশিষ্ট এই সৌধগুলো সম্ভবত নির্মিত হয়েছে দিল্লির বর্গাকার সৌধের অনুকরণে, যার সর্বপ্রাচীন উদাহরণ সুলতান ইলতুৎমিশ এর সমাধিসৌধ। এই ধরনের সৌধের উৎস প্রাক-ইসলামি যুগের সাসানীয় চ হারতক। মনে হয়, সমাধিসৌধ নির্মাণ মুঘল আমলে যত প্রচলিত ছিল সুলতানি আমলে ততটা ছিল না। পাথরে নির্মিত সমাধির মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিত সোনারগাঁয়ে গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধি। পাথর খোদাই করে এই সমাধিটি নির্মিত। পাথরে নির্মিত অপরাপর সমাধি, যেমন গৌড়-লখনৌতিতে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ও তাঁর পরিবারবর্গের সমাধি, পাণ্ডুয়া-ফিরুজাবাদের শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি (মৃত্যু ১২২৬ বা ১২৪৪) ও নূর কুতুব আলম এর (মৃত্যু ১৪১৫) সমাধি থেকে এটি ব্যতিক্রমী। এসব পাথরে বাঁধানো সমাধির মধ্যে শুধু পুণ্যাত্মাদের সমাধি ছাড়া আর সব এমনই অরক্ষিত যে, এগুলো সহজেই প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও উদ্দেশ্যমূলক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়ে পড়ছে। স্থানীয়ভাবে দরসবাড়ি মাদ্রাসা (১৫০৪) নামে পরিচিত গৌড়-লখনৌতির মাদ্রাসা ছিল মধ্যখানে উন্মুক্ত চত্বরসহ বিশাল এক আয়তাকার ইমারত। মধ্যখানের পশ্চিম দিকের কক্ষ ছাড়া উন্মুক্ত চত্বরের চারপাশের কক্ষগুলো ডরমেটরিরূপে ব্যবহৃত হতো। মধ্যখানের অপেক্ষাকৃত বড় কক্ষটি ব্যবহৃত হতো মসজিদ হিসেবে। এই কক্ষের তিনটি মিহরাবই তার প্রমাণ। বেলবাড়ি মাদ্রাসা (১৫০২) নামে পরিচিত গৌড়ের অপর একটি মাদ্রাসা উদ্ধারের জন্য এখনো কোন খননকাজ হয়নি।
গৌড়-লখনৌতির কদম রসুল (১৫৩১) এক আলাদা ধরনের ধর্মীয় সৌধের একক উদাহরণ। তবে সুলতানি আমলে ধর্মীয় সৌধ হিসেবে এর তেমন স্বীকৃতি ছিল না। হোসেনশাহী বংশের নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ মসজিদের অবয়বে এটি নির্মাণ করান। তবে এর কেন্দ্রস্থলে ছিল অতীব সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে মহানবী (স) এর পদচিহ্নের স্মারক স্থাপনের জন্য একটি মঞ্চ। এই রীতি মুঘল আমলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সেক্যুলার সৌধ এখন খুব কমই টিকে আছে। টিকে আছে শুধু কয়েকটি ফটক (দাখিল দরওয়াজা, গুমতি গেট ও চিকা ভবন, শেষোক্তটি সম্ভবত একটি অফিস ভবন), আর আছে গৌড়-লখনৌতিতে কিছুসংখ্যক সেতুর অবশেষ (পঞ্চদশ শতকের
মাঝামাঝি সময়ের) এবং গৌড়-লখনৌতি ও পাণ্ডুয়া-ফিরুজাবাদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। গৌড়-লখনৌতি প্রাসাদের (পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের) বাইশগজী নামে পরিচিত চৌহদ্দি দেওয়ালের কিছু অংশ এবং মোজাইক করা পাকার মেঝের কিছু অবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। পাণ্ডুয়া-ফিরুজাবাদ প্রাসাদও (চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের) এখন সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও জঙ্গলে আচ্ছাদিত। এর কিছু অংশ এখন পরিণত হয়েছে চাষের জমিতে। এখন একটি হাম্মামের ভগ্নাংশ ও একটি ভাঙা বুরুজ থেকে প্রাসাদটিকে শনাক্ত করা হয়। এটি সম্ভবত মিনার নামে পরিচিত নগরের ফটকের কোণের একটি বুরুজ। মোটা স্তম্ভ ও দেওয়ালের কারুকার্য সমেত দুই নগরের প্রাসাদগুলোর যে বিবরণ চীনা ও পর্তুগিজ পর্যটকরা রেখে গেছেন, তা থেকে এ দুটি বিশাল নগরের গৌরবময় দিনের কথা জানা যায়। এগুলো ছিল মধ্যযুগীয় নগরের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক উদাহরণ ।
আকৃতি বা রীতি ব্যতিরেকে বাংলায় সুলতানি আমলের স্থাপত্যশিল্পের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো যে, এ যুগের ইমারতগুলো ইটের তৈরি, দেওয়াল বেশ পুরু (১.৫ থেকে ৪ মিটার), সম্মুখভাগে পাথর অথবা পাথরের সরদল মাঝখান দিয়ে সরাসরি বসানো । যে বুরুজ সংযোজন করে ইমারতের কোণ মজবুত করা হয়েছে তার বেশির ভাগই অষ্টভুজাকৃতি, কখনো কখনো গোলাকার এবং ছাদের শীর্ষভাগ সমতলে উঁচু ও চূড়াবিহীন। এক বুরুজ থেকে অন্য বুরুজ পর্যন্ত টানা ছাদ ধনুকের মতো বাঁকা, প্রচলিত কুঁড়েঘর আকৃতির স্থানীয় ধরনের গম্বুজ। এই গম্বুজের বেশির ভাগই ত্রিকোণী পেন্ডেন্টিভের উপর এবং মাঝেমধ্যে স্কুইঞ্চের উপর বসানো। গম্বুজ স্থাপনের এ দুটি পদ্ধতিই বহিরাগত। বড় বড় ইমারতের অভ্যন্তরভাগে দ্বিকেন্দ্রিক সূচ্যগ্র খিলান বহনের জন্য গ্রানাইট পাথরের বাঁকা অথচ শক্ত দেশীয় স্তম্ভ সারিবদ্ধভাবে বসানো আছে এবং ফলে ভেতরে একটা খোলামেলা আবহের সৃষ্টি হয়েছে। ইমারতের ভেতর ও বাইরে ছিলার আলঙ্কারিক পট্টি বা বন্ধনী এবং স্থানীয় পোড়ামাটির ফলকের নকশা দ্বারা কারুকার্য করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের ঝুলন্ত নকশা ধরে রাখার জন্য লতাপাতার ফ্রেম, যা মূলত মন্দির অলঙ্করণের শিকল ও ঘণ্টার মোটিফ থেকে গৃহীত। মসজিদগুলোতে পূর্বদিকের প্রবেশপথ বরাবর সমসংখ্যক মিহরাবে ছিল সম্মুখ দিকে গ্রিল করা খিলান এবং পুরো নকশাই আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে এমন ব্যাপকভাবে কারুকার্যমণ্ডিত ছিল যে, এর মধ্য দিয়ে পুরো অভ্যন্তরভাগ তাৎক্ষণিকভাবে পরিদৃষ্ট হতো ।
ইমারতের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য বাংলায় সুলতানি স্থাপত্যকে একটি আলাদা রূপ দিয়েছে। এই রূপ ছিল ভারতবর্ষ ও অপরাপর স্থানের মধ্যযুগীয় স্থাপত্য থেকে ভিন্নতর। এই বৈশিষ্ট্য এমন একটি রীতির জন্ম দিয়েছে যা স্পষ্টতই ছিল স্বতন্ত্র বাঙালি রীতি। এই রীতি প্রচলিত ছিল চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে এবং পরবর্তী
শতাব্দীগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত ছিল বিশেষত মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে। অবশ্য মুঘল ইমারতশিল্পের অনুপ্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত এই ধারা অক্ষুণ্ণ ছিল এবং সপ্তদশ শতাব্দী।
থেকে মুঘল স্থাপত্যরীতিই স্বীকৃত ধারায় পরিণত হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]