কলকাতা পুনরুদ্ধার ও আলিনগর সন্ধি Rescued Kalkata and the Condition of Alinagar

কাশিমবাজার ও কলকাতার পতন সিরাজের জন্য এনেছিল সাময়িক বিজয়। এ বিজয় চূড়ান্ত হতে পারতো যদি তিনি ইংরেজদের নৌযানের দেশের অভ্যন্তরে পুনঃপ্রবেশের পথ রুদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু সে ক্ষমতা নবাবের ছিল না। কলকাতা থেকে পিছু হটে ড্রেক হুগলী নদীর মোহনায় ফুলতায় গিয়ে শিবির স্থাপন করেন। উপযুক্ত নৌশক্তির অভাবে সিরাজউদ্দৌলা পলায়নপর শত্রুকে তাড়িয়ে সাগরবক্ষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। ফিরে গেলেন তিনি মুর্শিদাবাদে। কলকাতা পতনের খবর পেয়ে মাদ্রাজ থেকে রবার্ট ক্লাইভ এর নেতৃত্বে পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ ১৫ ডিসেম্বর (১৭৫৬) ফুলতায় এসে ড্রেকের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির অবস্থান কাশিমবাজার দখলের পূর্বাবস্থায় পুনঃস্থাপিত করা এবং ভবিষ্যতে যেন এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির উদ্ভব না হয় তা নিশ্চিত করা।
সিরাজউদ্দৌলাকে ক্লাইভ এক পত্রে আহ্বান জানান ক্ষতিপূরণদানসহ কোম্পানির সকল অধিকার, জায়গা-জমি, সম্পত্তি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে দেবার জন্য। বলাই বাহুল্য, ক্লাইভের উক্ত পত্র ছিল নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই পূর্বাভাস। নবাব যুদ্ধ পরিহার করতে চান। তিনি কলকাতার দিউয়ান মানিকচাঁদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার আপস-মীমাংসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ক্লাইভের মনোভাব এমনি জঙ্গি ছিল যে, সিরাজউদ্দৌলা আবার বাধ্য হলেন সামরিক পন্থা অবলম্বন করতে। ক্লাইভ ২ জানুয়ারি (১৭৫৭) কলকাতা পুনর্দখল করেন। কলকাতা আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে ক্লাইভ ১০ জানুয়ারি নবাবের হুগলি বন্দর ধ্বংস ও লুট করেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিরাজউদ্দৌলা আত্মরক্ষামূলক নীতি অবলম্বন করেন। তিনি ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নিকট দূত প্রেরণ করেন এ আশ্বাস দিয়ে যে, কোম্পানির সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি তিনি পূরণ করবেন এবং পূর্বের মতোই বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবেন, তবে শর্ত শুধু এই যে, কোম্পানি ও সুবার মধ্যে খারাপ সম্পর্কের হোতা ড্রেককে এদেশ থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। ক্লাইভ শর্ত মেনে নিলেন। ৯ ফেব্রুয়ারি (১৭৫৭) কোম্পানি ও সুবার মধ্যে এক শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলো। ‘আলিনগর সন্ধি' নামে পরিচিত এ চুক্তির ধারাগুলো ছিল: (ক) ১৭১৭ সনের বাদশাহী ফরমান বাস্তবায়ন অর্থাৎ ফরমানে উল্লিখিত কলকাতার পার্শ্ববর্তী আটত্রিশ মৌজা কোম্পানিকে হস্তান্তর করা; (খ) দস্তকভুক্ত মালামাল নবাবি চৌকিতে তল্লাসী না করা; (গ) কোম্পানির ব্যবসা শুল্কমুক্ত রাখা; (ঘ) কলকাতায় দুর্গ ও টাকশাল নির্মাণে বাধা দেয়া; (ঙ) কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং (চ) সন্ধির মধ্যস্থতাকারীদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা।
এ অসম ও গ্লানিকর চুক্তিতে সিরাজউদ্দৌলা আবদ্ধ হলেন এজন্য যে, তিনি খবর পান যে, আফগানপতি আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি লুণ্ঠন করে সুবা বাংলার দিকে এগুচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই নবাবের কর্মতালিকায় আবদালীর মোকাবিলার প্রস্তুতি অগ্রাধিকার পায়। একযোগে দু'দিক থেকে দুই বড় মহাশত্রুকে সামলানো অবাস্তব। এদিকে ক্লাইভও খবর পান ইউরোপে সপ্তবর্ষ (১৭৫৬-৬৩) যুদ্ধের। ফরাসিদের সঙ্গে। নবাবের কোনো যুদ্ধমৈত্রী গঠনের সম্ভাবনা তিরোহিত করা হলো আলিনগর চুক্তি সম্পাদন করে। নবাবের অনেক ওমরাহ্ আলিনগর চুক্তির জন্য ছিল অসন্তুষ্ট। কেননা চুক্তিতে কলকাতা আক্রমণের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকলেও কোম্পানি কর্তৃক হুগলি বন্দর ধ্বংসের কোনো ক্ষতিপূরণ মেনে নেয়া হয়নি। ইংরেজরাও অনেকে খুশি হয়নি, কারণ কলকাতা আক্রমণের ফলে শুধু কোম্পানির ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু ইউরোপীয় ও দেশি নাগরিকদের ব্যক্তিগত ক্ষতি ধরা হয়নি। অর্থাৎ নবাব ও ক্লাইভ উভয়েই তৃতীয় শত্রুর ভয়ে আপাতত একটি শান্তিচুক্তির তাগিদ অনুভব করেছিলেন। এ হেন চুক্তি অবশ্যি স্থায়ী হবার নয় ।
ক্লাইভের চন্দননগর বিজয়
Victory of Chandannagar by Clieve
মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভের বাংলা অভিযানের উদ্দেশ্যে ছিল দুটি। প্রথম, সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটিয়ে মুর্শিদাবাদের মসনদে একজন অনুকূল নবাব বসানো যেন ভবিষ্যতে এখানে কোম্পানির স্বার্থ আর হুমকির সম্মুখীন না হয়। দ্বিতীয়, বাংলাদেশ থেকে ফরাসি প্রভাব নিশ্চিহ্ন করা। বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা ছাড়াও ইংরেজদের প্রতি নবাবের বৈরিতার জন্য ফরাসি প্ররোচনা রয়েছে বলে ইংরেজদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। অতএব সপ্তবর্ষ যুদ্ধের সুযোগে ফরাসিদেরকে এদেশ থেকে বিতাড়ন করা দরকার ।
আলিনগর চুক্তি করেই ক্লাইভ ফরাসিদের উৎখাত করার জন্য পরিকল্পনা নেন। বিদেশিরা বাংলাকে আরেকটি কর্ণাটকে পরিণত করুক সেটা নবাব হতে দেবেন না বলে প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেন। নবাব ঘোষণা দেন যে, বিদেশিদের এদেশে ব্যবসা করার অধিকার দেয়া হলেও একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবার অধিকার দেয়া হয়নি। অতএব, দেশের আইন লঙ্ঘন করে যুদ্ধে লিপ্ত হলে আক্রমণকারীকে উপযুক্ত সাজা পেতে হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন ।
নবাবের হুঁশিয়ারিতে ইংরেজ বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে বলে ক্লাইভ অভিযোগ করেন। নবাবের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে ক্লাইভ ৮ মার্চ (১৭৫৭ ) চন্দননগর অভিমুখে যাত্রা করেন। ফরাসিরা নবাবের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ক্লাইভ চন্দননগর অবরোধ করেন। ২২ মার্চ চন্দননগরের পতন ঘটে।
ইতিহাস মাস্টার্স ফাইনাল টেক্সট (৩১3401)-28
৩৬৮ বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যকলাপ ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত, পলাশীর সঙ্কটকালে অভিজাত শ্রেণির ভূমিকা
১৫.১৩ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র : ক্লাইভ-মীর জাফর গোপন চুক্তি
Conspiracy Against Sirajuddulla: the Secret Condition of Clieve-Mirjafor
ইংরেজ কর্তৃক ফরাসি বসতি চন্দননগর দখলকে বাংলার ইতিহাসে অতটা গুরুত্ব দেয়া না হলেও ইউরোপের সপ্তবর্ষ যুদ্ধের ইতিহাসে এ এক বড় ঘটনা। এ যুদ্ধ চলছিল বিশ্ব জুড়ে। বাংলায় ফরাসিদের পরাজয় ছিল বিশ্বব্যাপী ঐ যুদ্ধে ইংরেজের বিজয়ের একটি বড় অধ্যায়। ইংরেজের জন্য এ বিজয় অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। ক্লাইভ অনুভব করেন যে, এ বিজয়কে স্থায়ী রূপ দিতে হলে ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সরানো প্রয়োজন। সুযোগ পেলেই নবাব আবার কোম্পানিকে উৎখাত করতে সচেষ্ট হবেন- এ ভয় ইংরেজদের মনে প্রবল ছিল।
এদিকে মুর্শিদাবাদ দরবারি রাজনীতিতে আলিবর্দী খানের রাজত্বের শেষ দশক থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের একটি চক্র তৈরি হতে দেখা যায়। চক্রটি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে যখন আলিবর্দী ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনয়ন দেন। তাঁদের সহানুভূতি ছিল শওকত জং এর প্রতি। নিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসেই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বণ্টনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রদবদল করেন। যেমন, বকশি বা সেনানায়কের পদ থেকে মীর জাফরকে সরিয়ে সর্বোচ্চ এ সামরিক পদটি দেয়া হলো মীর মদনকে। রাজস্ব ও সমরশালার প্রধান পদ থেকে রায় দুর্লভকে সরিয়ে সে পদ প্রদান করা হলো মোহনলালকে। সিংহাসনে আরোহণের আগে ও পরে আপত্তিকর ভূমিকা রাখার জন্য কয়েকবার সিরাজউদ্দৌলা প্রভাবশালী আমীর জগৎশেঠকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বানিয়া শ্রেণি নবাবের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে ।
দরবার ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি কাজে লাগান ক্লাইভ। সকল বিরোধী শক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ করে নবাবকে উৎখাত করার একটি নীলনকশা তৈরি করে কলকাতা কাউন্সিল । ক্লাইভ এর স্থপতি ।
সিরাজ উৎখাত ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেবার জন্য ক্লাইভ প্রথম বেছে নেন সামরিক নেতা ইয়ার লতিফ খানকে। কিন্তু জগৎশেঠের পরামর্শে পরে মীর জাফরকে মনোনয়ন দেয়া হয়। ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে আরো ছিলেন রায় দুর্লভ খান, মির্জা আমির বেগ, খাদেম হোসেন খান প্রমুখ। ষড়যন্ত্রীদের নেতা জগৎশেঠ। ১ মে থেকে প্রায় এক মাস যাবৎ কলকাতা কাউন্সিল ও ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে নবাববদলের পরিকল্পনা আলোচিত হয়। অবশেষে ৪ জুন (১৭৫৭) কলকাতা কাউন্সিলের পক্ষে উইলিয়াম ওয়াট্স ও ষড়যন্ত্রীদের পক্ষে মীর জাফরের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কলকাতা কাউন্সিল চুক্তিবদ্ধ হয় যে, সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করে মীর জাফরকে মসনদে বসানো হবে এবং তাঁকে নওয়াবত রক্ষা করার ব্যাপারে কোম্পানি সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করবে এবং এর শর্ত নিম্নরূপ :
উভয়পক্ষ ৯ ফেব্রুয়ারির আলিনগর চুক্তি পালন করবে;
২. সমুদয় সম্পত্তিসহ সকল ফরাসিদের ইংরেজদের নিকট সমর্পণ করা হবে;
এশীয় হোক বা ইউরোপীয় হোক কোম্পানির সকল শত্রুকে নবাবের শত্রু বলে গণ্য করা হবে এবং ভবিষ্যতে নবাবের প্রয়োজনে কোম্পানির সামরিক সাহায্য চাইলে এর খরচ বহন করবেন নবাব;
৪. সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক কলকাতা আক্রমণের ফলে কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ বাবদ এককালীন এক কোটি, ইউরোপীয়দের প্রাইভেট ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লক্ষ, নগরীর হিন্দু-মুসলমান, আর্মেনীয় অধিবাসীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৭ লক্ষ টাকা পরিশোধ করা হবে;
৫. কলকাতার আশেপাশের জমিদারিসমূহ এবং কলকাতার দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলের উপর কোম্পানিকে জমিদারিস্বত্ব প্রদান করা হবে এবং ৬. হুগলীর ভাটিতে কোনো নবাবী দুর্গ স্থাপন না করা হবে না ।
১৫.১৪ পলাশীর প্রান্তর
Field of Palashi
পৃথিবীর সকল যুদ্ধবাজরা যেভাবে আগ্রাসনের অজুহাত দেখিয়ে থাকে সেভাবে ক্লাইভও ষড়যন্ত্রচুক্তি করেই সিরাজউদ্দৌলাকে জানান যে, তিনি আলিনগরের সন্ধি মেনে চলছেন না, অতএব তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়া কোম্পানির গত্যন্তর নেই। ১২ জুন ক্লাইভের বাহিনী মুর্শিদাবাদের দিকে ধাবিত হলেন। কোম্পানি বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীও অগ্রসর হয়। দুই বাহিনীর সাক্ষাৎ ঘটে পলাশীতে। নবাবের যুদ্ধশক্তি ছিল ১৫,০০০ অশ্বারোহী, ৩৪,০০০ পদাতিক সৈন্য আর ৪০টি কামান। এর বিপরীতে ক্লাইভের অধীনে ছিল মাত্র ১,৩০০ ইউরোপীয় ও দেশি সৈন্য ও ৮টি কামান। স্থলযুদ্ধে ইতোপূর্বে কখনো ইউরোপীয়রা ভারতীয়দের চেয়ে অধিকতর শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করতে পারেনি।
২৩ জুন বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় যুদ্ধ শুরু হলো, বিকেল চারটায় সমাপ্ত হয়ে গেল । নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত। নবাবের সেনাবাহিনীর অধিকাংশই ছিল নিষ্ক্রিয়, দণ্ডায়মান। হতবিহ্বল বাকি সৈন্যরা বিকেল অব্দি যুদ্ধ করে আত্মসমর্পণ করলো । সিরাজউদ্দৌলা বিহারে অবস্থানরত অনুগত রামনারায়ণের বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে পাটনার দিকে সপরিবারে গোপন অভিযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পথিমধ্যে তিনি ধৃত হন এবং মুর্শিদাবাদে ২ জুলাই নিহত হন। এমনিভাবে অবসান হলো মাত্র অর্ধেক শতাব্দীর স্বাধীন নবাবি যুগের।
ইতিহাস মাস্টার্স ফাইনাল টেক্সট
৩৭০ বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যকলাপ ১৭৫৭সাল পর্যন্ত, পলাশীর সঙ্কটকালে অভিজাত শ্রেণির ভূমিকা ১৫.১৫ পলাশী যুদ্ধের মূল্যায়ন
Evaluation of Palashi War
পলাশী যুদ্ধ নামে আখ্যায়িত ঐ ঘটনাটি প্রকৃত অর্থ কোনো যুদ্ধ কিনা বিতর্কসাপেক্ষ। পলাশীতে যুদ্ধ হবে মনে করে ক্লাইভ সেখানে সৈন্য মোতায়েন করেননি। পলাশীতে একটি সামরিক মহড়ায় নবাব বদল হবে এটাই ছিল ক্লাইভের নীলনকশা। সে নীলনকশা পুরোপুরি কার্যকর হয়েছিল। ১৬৮৬-৯০ সালের যুদ্ধ, এ্যাংলো-মুঘল থেকে শুরু করে পলাশী পর্যন্ত ঘটনারাজি অনেকগুলো প্রশ্নের উদ্রেক করে। উইলিয়াম হেজেজ এবং জব চার্নক প্রথম এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন। রাজত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্য না থাকলেও মাদ্রাজ ও বোম্বাই-এর মতো বাংলার উপকূল অঞ্চলে একটি সার্বভৌম সুরক্ষিত বসতি স্থাপনের লক্ষ্যেই কোম্পানি চার বছর পর্যন্ত যুদ্ধ করে অবশেষে ব্যর্থ হয়ে এদেশ থেকে ব্যবসায় গুটিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সরকার বসতি স্থাপনের সুযোগ দিয়ে এদের আবার বাণিজ্যে ফিরিয়ে আনে। বুঝা যায় যে, সরকার বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে অর্জন করছিল প্রভূত মুনাফা, যা তারা কিছুতেই হারাতে রাজি ছিল না। কিন্তু যা বুঝা কঠিন তা হচ্ছে নৌশক্তি নির্মাণে সরকারের অনীহা। তিনটি গ্রামের উপর জমিদারি স্বত্ব প্রদান করে সরকার কি লাভ করলো? ব্যক্তিগতভাবে সুবাদার আজিম-উশ-শান কিছু নগদ পেশকাশ লাভ করেছিলেন মাত্র। কয়েক বছর আগেই যুদ্ধ করেছে সরকারের বিরুদ্ধে এমন একটি বিদেশি শক্তিকে পেশকাশের বিনিময়ে আঞ্চলিক অধিকার ছেড়ে দেয়া এবং সর্বোপরি দুর্গ নির্মাণের অনুমতি দেয়ার মধ্যে শাসকশ্রেণির যে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও পশ্চাদপদতার পরিচয় পাওয়া যায় তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। পার্শ্ববর্তী রাজ্য চীনদেশ এবং ব্রহ্মদেশেও ইউরোপীয়রা দেশের অভ্যন্তরে বসতি স্থাপনের অধিকার পায়নি। পেশকাশের বিনিময়ে সম্রাট ফররুখশীয়র ইংরেজদের বিস্তীর্ণ এলাকার ভূস্বত্ব প্রদানসহ এমন এমন অধিকার প্রদান করলো যা সরাসরি সার্বভৌমত্বকে আঘাত করে। ফরমানই ইংরেজ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কে ক্রমাবনতির প্রধান কারণ। সুবাসরকার ঐ ফরমান পুরোপুরি বাস্তবায়নে সম্মত হয়নি, আর কোম্পানি দাবি তুলেছে, সুবাসরকার তাদেরকে কেন্দ্রীয় কর্তৃক প্রদত্ত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। নবাবের সঙ্গে আলিনগর সন্ধি ও ষড়যন্ত্রীদের সঙ্গে গোপন চুক্তি উভয় দলিলের মধ্যেই প্রধান ধারা ছিল বাদশাহি ফরমানের (১৭১৭) পূর্ণ বাস্তবায়ন। মীর জাফর ও ক্লাইভের মধ্যে স্বাক্ষরিত গোপন চুক্তিটিও ছিল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব ভাগবাটোয়ারা করার একটি কৃষ্ণ দলিল। অর্থাৎ আঞ্চলিক ও জাতীয় স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব প্রত্যয়টি যেভাবে দূরপ্রাচ্য ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে আমরা লক্ষ করি, সমকালীন ভারতীয় সরকার সেটা সেরকমভাবে দেখেনি। মুঘল শাসক ছিলেন বিশ্বমালিক, যেজন্য তিনি ছিলেন বাদশাহ্, শাহানশাহ, শাহ্ আলম, আলমগীর ইত্যাদি। তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বের সব মানুষই তাঁর প্রজা। যথোপযুক্ত নজরানা, পেশকাশ
দিয়ে আনুগত্যের অঙ্গীকার করলে বিশ্বের যে-কেউ তাঁর রাজ্যে বাস করতে পারে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে পারে। ইউরোপীয়দের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে নৌ-বাহিনী নির্মাণ না করার কারণ ঐ মিলনচিন্তার মধ্যেই নিহিত।
তবে মুঘল শাসনতান্ত্রিক কাঠামোয় থেকেও মুর্শিদকুলী খান থেকে বাংলার নবাবগণ এক ধরনের আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। সুজাউদ্দীন খান রাষ্ট্রের সেরা পেশাজীবীদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। ঐ পরিষদ আরো সম্প্রসারিত হয় আলিবর্দী খানের সময়। ঐ চিন্তা থেকেই মুর্শিদকুলী খান ও পরবর্তী নবাবগণ কোম্পানির প্রচণ্ড চাপপ্রয়োগ সত্ত্বেও ফররুখশীয়রের ফরমান (১৭১৭) বাস্তবায়ন করেননি। সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা চিন্তার সবচেয়ে অগ্রগামিতার পরিচয় দিয়েছেন সিরাজউদ্দৌলা। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবস্থান রাজনৈতিকভাবে তিনি যেভাবে দেখেছেন সেভাবে ইতোপূর্বে কোনো নবাবই দেখেননি। সিংহাসনে আরোহণের পর পরই তিনি কোম্পানিকে জানিয়ে দেন যে, এ দেশে ব্যবসায় করতে হলে কোম্পানিকে আইনের অধীনে আনার জন্যে তিনি যে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা যে-কোনো সমকালীন পাশ্চাত্য বা দূরপ্রাচ্য দেশের সরকারের পক্ষে স্বাভাবিক। প্রথমেই তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেননি। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানে কোম্পানির ব্যর্থতাই তাঁকে সামরিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা শেষ রক্ষা করতে পারেননি। এর জন্য আংশিকভাবে দোদুল্যমানতা দায়ী, আর বহুলাংশে দায়ী বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশ। কলকাতা থেকে হটে গিয়ে ইংরেজরা ফুলতায় অবস্থান করেছে মাদ্রাজ থেকে সামরিক সাহায্যের আশায়, এটা জেনেও কলকাতাকে একজন বানিয়া আমিরের হাতে ছেড়ে দিয়ে কোনো রকম সামরিক প্রস্তুতি না দিয়ে তাঁর মুর্শিদাবাদে চলে আসা ছিল আঘাত করার জন্য শত্রুর হাতে কুড়াল তুলে দেয়ার সামিল। ইউরোপে ইংরেজ ও ফরাসিরা যুদ্ধরত। এমতাবস্থায় ফরাসি সাহায্য লাভ করা তার পক্ষে কঠিন ছিল না। কিন্তু ইংরেজরা যখন ফরাসি বসতি চন্দননগর আক্রমণ করলো তখন তিনি নিরপেক্ষতা বজায় রাখলেন। অথচ ইতোপূর্বে তিনি কোম্পানিকে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ না করার জন্য হুঁশিয়ার দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে ইংরেজরা যখন চন্দননগর আক্রমণ করলো তখন তিনি নিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখলেন। ফরাসিরা তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেছিল। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ হয়ত ভিন্নতর হতো যদি তখন সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলেই নবাব আক্রান্ত ফরাসিদের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। ইংরেজরা ফরাসিদের পরাজিত ও বন্দী করে নবাবকে একা করেই তাঁকে উৎখাত করার চক্রান্তে লিপ্ত হয় ।
... সিংহাসনে আরোহণ করেই অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে রদবদল এনে মীর জাফরসহ সকল সন্দেহভাজন উচ্চাভিলাষী আমীরদের দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া নবাবের পক্ষে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু কুচক্রীদের চাপে আবার তাদের স্বপদে পুনর্বহাল করা ছিল একটি মারাত্মক ভুল পদক্ষেপ। যে সময়ে নবাবের উচিত ছিল
৩৭২ বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যকলাপ ১৭৫৭সাল পর্যন্ত, পলাশীর সঙ্কটকালে অভিজাত শ্রেণির ভূমিকা
তাদেরকে সম্পূর্ণ অচল করে অন্তরীণ রাখা সে সময়ে তিনি তাদেরকে দিলেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কলে ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে আর সময় লাগেনি। এদিকে আহমদ শাহ আবদালীর হামলা আসন্ন এমন একটি গুজবে কান দিয়ে তিনি তাঁর অতিশয় অনুগত ও দক্ষ সমরবীর রামনারায়ণের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে চৌকশ অংশকে পাঠিয়ে দিলেন পাটনায়। ফলে পলাশী প্রান্তরে প্রকৃত অর্থে আর যুদ্ধ করার প্রয়োজন হলো না। ক্লাইভ জয়ী হলেন। সূচিত হলো বাংলার ইতিহাসে আরেকটি নতুন অধ্যায়।
সিরাজউদ্দৌলা একজন সাহসী বীর সন্দেহ নেই। যে ক্ষিপ্র গতিতে তিনি একযোগে এবং একই সময়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী শওকত জং এর পাশাপাশি ইংরেজদের শায়েস্তা করেছেন তা তাঁর সামরিক দক্ষতা, গতি ও অসাধারণ সাহসের পরিচয় বহন করে। কিন্তু তিনি প্রজ্ঞাবলে তা ধরে রাখতে পারেননি। অচিরেই তিনি বন্ধুহারা হয়ে পড়েছেন। এটা তার চারিত্রিক দুর্বলতা বলা যায়। কিন্তু তিনি অযোগ্য, চরিত্রহীন, মাদকাসক্ত, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, জিঘাংসু, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য এসব অভিযোগের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এসব অভিযোগ পলাশী-উত্তর শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক প্রয়োজনে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটাও আরেক ষড়যন্ত্র- নবাবকে উৎখাত করার নৈতিক ভিত্তি এবং রাজনৈতিক যৌক্তিকতা দেখানোর ষড়যন্ত্র। প্রকৃতপক্ষে সমকালীন শাসকশ্রেণির মানদণ্ডে সিরাজউদ্দৌলার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও দুর্দান্ত সাহসিকতা এবং অসাধারণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ বিস্ময়কর বটে। G. B. Malleson এর কথায়, “সিরাজউদ্দৌলার যাই দোষত্রুটি থাকুক না কেন, তিনি মনিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, দেশকে বিকিয়ে দেননি...।” পলাশীর ঐ বিয়োগান্ত নাটকে তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ যিনি কখনো প্রতারণার আশ্রয় নিতে চাননি। আলিবর্দী খান সিরাজের যোগ্যতা যাচাই করেই মসনদের জন্য তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। কিন্তু সময় তাঁর বিরুদ্ধে গেল। মাত্র চৌদ্দ মাসের নবাবি জীবনে তেইশ বছরের এই হতভাগ্য যুবককে এককভাবে এবং একাধারে লড়তে হয়েছে ঘরের শত্রু শওকত জং- এর সঙ্গে, দরবারের শত্রু জগৎশেঠ-রায়দুর্লভ চক্রের সঙ্গে এবং বহিঃশত্রু ইংরেজের সঙ্গে। হতভাগ্য থেকে গেলেন তিনি মৃত্যুর পরও। ইংরেজ ও ইংরেজপন্থীরা শতাধিক বছর যাবৎ তাঁর চরিত্রের উপর কাল্পনিক কলঙ্ক লেপন করেছে পলাশী ঘটনাকে যৌক্তিক বলে দেখানোর জন্য ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]