রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে কোন কিছুই একমুখী চলেনা, উত্থান ও পতন সময়ের ব্যবধানে ঘটে। অনেকটা
প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই তা হয়ে থাকে। মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। একদা যে মুঘল
সাম্রাজ্যে সমগ্র উত্তর ভারত, মধ্য ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার
করেছিল তা কালের গতিতে ধুলিস্যাৎ হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান লাভ করেছে। ভারতের সুপ্রাচীন
ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্য যেসব কারণের সমন¦য়ে বিলুপ্ত হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে
সেসব শক্তির ভিন্নরূপ প্রকাশই লক্ষণীয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ তথা অভ্যন্তরীণ বিশৃ´খলা এবং
বৈদেশিক আক্রমণ মুঘল সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য করে তুলেছিল।
অভ্যন্তরীণ কারণ
১. সুযোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাব ঃ মুঘল আমলে যে পদ্ধতির রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তার সফলতা নির্ভর
করতো কেন্দ্রীয় শাসক তথা সম্রাটের ব্যক্তিগত প্রতিভা ও শাসন দক্ষতার ওপর। অদক্ষ আরামপ্রিয় বা কম
প্রতিভাসম্পন্ন সম্রাট অধিষ্ঠিত হলে সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই দেখা
যায়, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের মতো প্রতিভাবান শাসকের শাসনকালে সাম্রাজ্যের
অভ্যন্তরীণ অনেক সংকট থাকা সত্তে¡ও সাম্রাজ্যের শান্তি ও শৃ´খলা বজায় ছিল। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির
আবির্ভাব হওয়া সত্তে¡ও সেগুলো সুকৌশলে দমন করে তাঁরা সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু
আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারীরা প্রায় সকলেই পূর্ববর্তী মুঘল সম্রাটদের মতো শৌর্য-বীর্যের অধিকারী ছিলেন
না। অকর্মণ্য ও অযোগ্য এ সমস্ত শাসকের দুর্বলতার ফলে সাম্রাজ্যের বিশৃ´খলা বৃদ্ধি পায়। অন্তর্দ্বন্দ¡ ও
নৃশংসতা এ যুগের একমাত্র বৈশিষ্ট্য। অপদার্থ সম্রাটগণ নামমাত্র শাসকে পরিণত হন এবং তাঁরা
ক্ষমতাশালী রাজকর্মচারীদের ক্রীড়ানকে পরিণত হন। এসব সম্রাটের অযোগ্যতাই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে
ত্বরানি¦ত করেছিল। মূলত আওরঙ্গজেব পরবর্তী সুযোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের
অন্যতম কারণ।
২. উত্তরাধিকারী নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট আইনের অভাব ঃ মধ্যযুগের ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলে উত্তরাধিকারী
নির্বাচনের কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। ফলে সম্রাটদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রগণ সিংহাসনের দাবি নিয়ে
নিজেদের মধ্যে দ্বন্দে¡ লিপ্ত হতেনÑ যা সাম্রাজ্যের পক্ষে চরম সংকট সৃষ্টি করতো। শাহজাহানের রাজত্বের
শেষভাগে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে তাঁর চার পুত্রের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ফলে দরবারে অভিজাতদের মধ্যে
গোষ্ঠী রাজনীতি শুরু হয়, তার ফলে সাম্রাজ্যের প্রভুত ক্ষতি হয়। পরবর্তী মুঘলদের শাসনকালেও এই
গৃহযুদ্ধ মুঘল সাম্রাজ্যে চরম সর্বনাশ ডেকে আনে। যে কারণে আরওঙ্গজেব মৃত্যুর পূর্বে পুত্রদের মধ্যে
সাম্রাজ্য বন্টন করে মুসলিম আইন অনুযায়ী ‘ওসিয়তনামা' বা ইচ্ছাপত্র করে যান। কিন্তু পুত্রগণ তা মান্য
করেননি। কাজেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের গুরুত্ব বিচারে মুঘল রাজপরিবারের গৃহযুদ্ধ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
কারণ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে।
৩. সাম্রাজ্যের বিশালতা ঃ মুঘল সাম্রাজ্যের বিশালতাও এই সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ।
আওরঙ্গজেবের শাসনকালেই মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের চরম সীমায় আরোহণ করে। এটি উত্তরে
আফগানিস্তান, পূর্বে আসাম, পশ্চিমে কাশ্মির ও দক্ষিণে মহীশূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি
নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের যোগাযোগ ও সংবাদ সংগ্রহ সহজ ছিল
না। শক্তিশালী শাসকের আমলে যা প্রকাশ পায়নি দুর্বল শাসকদের সময় তা প্রকাশিত হতে থাকে। সুদূর
অঞ্চলের বিদ্রোহ ও বিশৃ´খলা দমন করা তাঁদের পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না। আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারীগণ
বিশাল সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হন।
৪. অভিজাতদের নৈতিক অবক্ষয় ও স্বার্থের সংঘাত ঃ অভিজাত আমীরদের চারিত্রিক পরিবর্তন ও অন্তর্দ্বন্দ¡
মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আকবর সৃষ্ট এই অভিজাত আমীরগণই ছিলেন
মুঘল সাম্রাজ্যের মেরুদন্ড স্বরূপ। মুঘল সাম্রাজ্যের উন্নতির যুগে বিশেষত ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে
অভিজাতগণ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও উন্নতিতে তাঁদের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের
সংহতি বিধানে তাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই অভিজাতদের চরিত্রে
এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে বিরাট পরিবর্তন এসে পড়ে। বিলাসবহুল এবং অপরিসীম বৈভবে জীবন অতিবাহিত করে
তাঁরা নির্বিরোধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তাছাড়া সম্রাটের দুর্বলতার সুযোগে তাঁরা শুধুমাত্র
ব্যক্তিগত ক্ষমতা বৃদ্ধিতে উৎসুক হয়ে পড়েন। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ অপেক্ষা সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ তাঁদের
নিকট অভিপ্রেত হয়ে দাঁড়ায়। সম্রাট তাঁদের ক্রীড়নকে পরিণত হন। এসঙ্গে দেশীয় অভিজাত এবং বিদেশী
অভিজাতদের মধ্যে প্রতিনিয়তই ক্ষমতা দ্বন্দ¡ লেগে থাকতো। মুঘল রাজদরবারের অভিজাতবর্গ পরস্পর
বিরোধী ‘ইরানি', ‘তুরানি' ও ‘হিন্দুস্তানি'-এই তিন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দ্বিধাবিভক্ত এই
অভিজাতবর্গের উপদলীয় সংঘর্ষ ও উচ্চাভিলাষমূলক কর্মকান্ড মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরানি¦ত করে।
৫. মুঘল সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা ঃ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মুঘল সামরিক সংগঠনের ত্রুটিকে মুঘল
সাম্রাজ্য পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ঐতিহাসিক আরভিন ও ভিনসেন্ট স্মিথ সামরিক
ব্যবস্থার ত্রুটির ব্যাপারে প্রধানত দায়ী করেছেন ‘মনসবদারি' ব্যবস্থাকে। তাঁদের অভিমত হলো,
মনসবদাররা অশ্বারোহী সৈন্য রাখার জন্য যে পরিমাণ অর্থ জায়গীর থেকে পেতেন, তা নিজেদের
বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পিছনে ব্যয় করে ফেলতেন। ফলে অনেক সময় প্রয়োজনে যোগ্য সেনা সরবরাহ
করে রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হতেন। যোগ্য অশ্বারোহী সেনা না রেখে প্রয়োজনে অশিক্ষিত অশ্বারোহী
নামমাত্র সৈন্য পাঠাতেন। তাছাড়া প্রত্যেক মনসবদারের অধীনে সৈন্য থাকায় তাদের রাষ্ট্রীয় ঐক্যের স্বার্থে
প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হতো না। উপরন্তু মনসবদারি ব্যবস্থায় সেনাবাহিনী তাদের মনসবকে চিনতো।
প্রত্যক্ষভাবে তারা সম্রাট বা সেনাপতির অধীনে ছিল না। কাজেই মনসবদারি ব্যবস্থার ত্রুটির জন্য মুঘল
সৈন্যবাহিনী কখনো একটি অষন্ড জাতীয় সৈন্যবাহিনীতে পরিণত হতে পারেনি। এছাড়া মুঘল অস্ত্রশস্ত্রও
আধুনিক ছিল না। তাদের কামানগুলো ছিল সেকেলে। এই কামানগুলো একস্থান থেকে অন্যস্থানে দ্রুত নিয়ে
যাওয়া যেতো না। মুঘল সৈন্যবাহিনী দরবার ও হারেম সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা করতো। এই বিপুল দ্রব্যসম্ভার
মুঘল সেনাবাহিনীর ক্ষিপ্রতা বিনষ্ট করতো।
মুঘল সম্রাটরা স্থলবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয় যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতের বিস্তৃত উপক‚লীয়
অঞ্চল রক্ষার জন্য যে নৌবাহিনীর প্রয়োজন ছিল তা উপলব্ধি করতে পারেননি। যদিও আকবর এই
বিবেচনায় নৌবাহিনী গঠন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী মুঘল সম্রাটরা তাতে উদাসীন ছিলেন। মুঘল
নৌবাহিনী থাকলে পাশ্চাত্য বণিকগণ ভারতবর্ষে বাণিজ্যিক ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার
করতে সহজে সক্ষম হতো না। এজন্যে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে নৌবাহিনীর
অভাবকে দায়ী করেছেন।
৬. অর্থনৈতিক সংকট ঃ অর্থনৈতিক সংকট মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। রাষ্ট্র
পরিচালনা ও সৈন্যবাহিনী পোষণে বিপুল অর্থ ব্যয় হতো। বিশেষত আওরঙ্গজেবের সময়ে বিদ্রোহ দমন,
রাজ্যজয় ও প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য অজস্র অর্থ খরচ হয়। দীর্ঘদিন দাক্ষিণাত্য অভিযানে
রাজকোষের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং দারুন অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এই সংকট নিরসনের
জন্য অধিক হারে কর আদায় করা হয়। এতে কৃষকরা অসন্তুষ্ট হয় এবং মাঝে মাঝে কৃষক শ্রেণী বিদ্রোহ
করে। সামরিক বাহিনী দ্বারা এসব বিদ্রোহ দমন করা হয়। তথাপি আর্থিক অবস্থাকে উন্নত করা যায়নি।
এমন কি সৈন্যদের বেতন দেয়াও কষ্টকর হয়ে পড়ে। পরবর্তী দুর্বল শাসকদের আমলে রাষ্ট্রের আয় আরও
সংকুচিত হয়ে পড়ে। আর্থিক দুরবস্থা সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে ফেলে।
৭. আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ঃ আওরঙ্গজেব অনুসৃত দাক্ষিণাত্য নীতিও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের
অন্যতম কারণ। সুন্নী সম্রাট আওরঙ্গজেব গোলকুন্ডা ও বিজাপুর রাজ্যের শিয়া সুলতানদের স্বাধীনতা ধ্বংস
করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি। মারাঠাদের জাতীয় অভ্যুত্থানকে দমন করতে গিয়ে
আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের পতনকে অনিবার্য করে তোলেন। জীবন সায়াহ্নে দীর্ঘ সময় আওরঙ্গজেব
দাক্ষিণাত্যের মারাঠা শক্তি দমনে ব্যস্ত ছিলেন। অর্থব্যয় ও লোকক্ষয় ছাড়া এই সুদীর্ঘ অভিযান সাম্রাজ্যের
জন্য কোন স্থায়ী ফল আনতে পারেনি। অপরদিকে এতে সাম্রাজ্যের আর্থিক এবং সামরিক শক্তি
নিদারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাজধানী থেকে সম্রাটের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তাঁর একচ্ছত্র শাসন ব্যবস্থায়
নানা বিশৃ´খলার সৃষ্টি হয়। আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরানি¦ত করে এবং
সেদিক দিয়ে আওরঙ্গজেব মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী। “দাক্ষিণাত্য তাঁর দেহ ও
খ্যাতির কবরে পরিণত হয়েছিল।”
৮. কেন্দ্রীয় শাসনের শৈথিল্য ও প্রাদেশিক শাসকদের স্বাধীনতা ঘোষণা ঃ দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের শৈথিল্য
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের একটি বিশেষ কারণ। আওরঙ্গজেব যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছিলেন দিল্লি থেকে
তার শাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। সম্রাটদের অকর্মণ্যতা, অভিজাতবর্গের ষড়যন্ত্র, প্রাদেশিক
শাসনকর্তাদের উচ্চাভিলাষ সাম্রাজ্যকে অবনতির দিকে ঠেলে দেয়। কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় দুর্বলতার
সুযোগে সাম্রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে শাসনকর্তাগণ নামেমাত্র সাম্রাজ্যের আনুগত্য স্বীকার করে কার্যত
স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর নিযাম-উল-মূলক
দাক্ষিণাত্যে, মুর্শিদকুলী খান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায়, সাদত খান অযোধ্যায় এবং আলী মুহম্মদ খান
রোহিলাখন্ডে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমস্ত স্বাধীন নবাব মুঘল সম্রাটকে বাৎসরিক কর প্রদান করে
মুঘল সার্বভৌমত্ব স্বীকার করলেও এতে সাম্রাজ্যের শক্তি ও সংহতি নষ্ট হয়।
৯. মারাঠা শক্তির অভ্যুত্থান ঃ মারাঠা শক্তির উত্থান মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে
বিবেচিত। যে মারাঠা জাতি শিবাজীর আদর্শ এবং অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দাক্ষিণাত্যের অন্যতম প্রধান
রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, তা অষ্টাদশ শতাব্দীতে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে
ভারতে হিন্দু সাম্রাজ্য পুনপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠারা ভারতের অন্যতম প্রধান
রাজনৈতিক শক্তি ছিল এবং মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে তারা এক বিশেষ ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালন করে।
১০. জায়গীর প্রথায় সংকট ঃ জায়গীর প্রথায় সংকট মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের একটি প্রধান কারণ ছিল। বহু
মনসবদারকে জায়গীর দিতে সম্রাটের ব্যর্থতা, লাভজনক জায়গীর না পাওয়ায় পুরাতন জায়গীরদারদের
অসন্তোষ, ইজারাদার ও জায়গীরদারদের নির্মম কৃষক-শোষণ, ঘন ঘন কৃষক-বিদ্রোহ, উৎপাদন হ্রাস কিন্তু
সাম্রাজ্যের ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধি, কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতি বিধানে সম্রাটদের ঔদাসীন্য প্রভৃতি মুঘল
সাম্রাজ্যকে দ্রুত পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
১১. জাতীয়তাবোধের অভাব ঃ মধ্যযুগের ভারতবর্ষের অন্যান্য সাম্রাজ্যের মতো মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি
সামরিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, জনগণের সমর্থনের ওপর নির্ভর ছিল না। সম্রাট আকবর ভারতের
সকল সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির প্রয়াস চালান। কিন্তু সফল হতে পারেননি। মুঘল
সম্রাটগণ ভারতের জনসাধারণকে এক জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি বলে সম্রাট আক্রান্ত হলে
সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য জনগণ এগিয়ে আসেনি। জাতীয়তাবোধের অভাব মুঘল সাম্রাজ্য পতনের
একটি উলে খযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচ্য। -
বহিরাগত কারণ
অভ্যন্তরীণ বিশৃ´খলা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ে যখন মুঘল সাম্রাজ্যের মূল শক্তি ও সংহতি বিনষ্ট
তখনই পারস্যের সম্রাট নাদির শাহের ভারত আক্রমণে মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। নাদির শাহের এক
ভ‚ঁইফোঁড় পুত্রের সঙ্গে সম্রাট তাঁর মেয়ের বিয়ের সম্মতি দিয়ে মুঘল সম্রাটের যে সম্মান ও মর্যাদা অবশিষ্ট
ছিল তাও বিনষ্ট হয়। নাদির শাহের ভারত আক্রমণের ফলে সমগ্র পৃথিবী বিশেষত ভারতবর্ষের উপক‚লীয়
অঞ্চলে অবস্থানকারী ভাগ্যানে¦ষী ইউরোপীয় বণিকদের নিকট মুঘল সম্রাটের দুর্বলতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
ইউরোপীয় বণিকগণ ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তীক্ষèভাবে দৃষ্টি রাখতে শুরু করে। কাবুল ও
সিন্ধুর পশ্চিমাঞ্চল নাদির শাহের অধিকারে যাওয়ায় ভারতবর্ষ দেশরক্ষার অগ্রবর্তী অঞ্চল ও পশ্চিম এশিয়ার
ঘটনা নিরীক্ষণ করার সুবিধাজনক অবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে নাদির শাহ মণিমুক্তা সহ প্রায় ১৭
কোটি টাকার সম্পদ ভারতবর্ষ থেকে পারস্যে নিয়ে যাওয়ার ফলে মুঘল রাজকোষ একেবারে নি:শেষ হয়ে
পড়ে এবং অর্থনৈতিক অবক্ষয় চরমভাবে দেখা দেয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থাও প্রায় ভেঙ্গে পড়ে।
এমনি অবস্থায় আফগানিস্তানের শাসক আহমদ শাহ আবদালী নয়বার ভারত আক্রমণ করে মুঘল সাম্রাজ্যকে
ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আহমদ শাহ আবদালীর বারবার আক্রমণে কার্যত মুঘল সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এরপর মারাঠারা এবং সর্বশেষে ইংরেজগণ মুঘল সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে ফেলে।
সারসংক্ষেপ
বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল যোগ্য প্রতিভাবান শাসকের। কিন্তু আওরঙ্গজেবের
পর প্রতিভাবান সম্রাটের অভাবে কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অভিজাতবর্গ অন্তর্দ্বন্দে¡
লিপ্ত হয়ে সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। এছাড়া আরওরঙ্গজেব পরবর্তী সম্রাটগণ ছিলেন দুর্বল ও
বিলাসপ্রিয়। তাঁদের শাসনামলে সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়ে। সর্বোপরি
বৈদেশিক আক্রমণ, মুঘল রাষ্ট্র প্রজাবর্গের সমর্থনপুষ্ট না হওয়ায় এবং প্রধানত প্রশাসনিক ও সামরিক
দুর্বলতার কারণে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। মুঘল আমলে প্রশাসন ব্যবস্থা সম্রাটের কোন গুণের ওপর নির্ভর করতো?
(ক) গণতান্ত্রিক মনোভাবের ওপর (খ) নিয়মানুবর্তিতার ওপর
(গ) ব্যক্তিগত প্রতিভা ও শাসন দক্ষতার ওপর (ঘ) মহানুভবতার ওপর।
২। কোন মুঘল সম্রাটের আমলে সাম্রাজ্য বিস্তার চরম সীমায় পৌঁছেছিল?
(ক) আকবর (খ) শাহজাহান
(গ) জাহাঙ্গীর (ঘ) আওরঙ্গজেব।
৩। ঐতিহাসিক আরভিন ও ভিনসেন্ট স্মিথ কোন ব্যবস্থাকে মুঘল সামরিক ব্যবস্থার ত্রুটির জন্য দায়ী
করেছেন?
(ক) জায়গীরদারী (খ) মনসবদারী
(গ) জাবতি (ঘ) গাল্লাবক্স।
৪। মারাঠা জাতি কার আদর্শ অনুসরণ করতেন?
(ক) শিবাজী (খ) কবীর
(গ) নানক (ঘ) চৈতন্য।
৫। পারস্যের কোন শাসক ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন?
(ক) আহমদ শাহ আবদালী (খ) নাসির শাহ
(গ) নাদির শাহ (ঘ) মোহাম্মদ শাহ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। মুঘল আমলে উত্তরাধিকারী নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার ফলাফল কি হয়েছিল?
২। মুঘল সামরিক বাহিনীর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করুন।
৩। আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি কি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী? আপনার মতামত দিন।
৪। দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের শৈথিল্য মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের একটি অন্যতম কারণÑ এর সপক্ষে যুক্তি
দিন।
৫। মুঘল সাম্রাজ্য পতনে বহিরাগত কারণের বিবরণ দিন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। মুঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণসমূহ বর্ণনা করুন।
২। মুঘল সাম্রাজ্য পতনের অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ বর্ণনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত