পশ্চিম এশিয়া পরিচিতি

পশ্চিম এশিয়া (West Asia)
কোন কোন দেশকে নিয়ে পশ্চিম এশিয়া তার কোন স্বীকৃত সংজ্ঞা নেই । পশ্চিম এশিয়া সম্পর্কে কোন আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কয়েকটি প্রশ্ন মনে জাগে। পশ্চিম এশিয়া ঠিক কোন জায়গাকে বলা হবে? এর সীমানা কি? পশ্চিম এশিয়া নামটি কি যুক্তিযুক্ত? একে পশ্চিম এশিয়া নাকি মধ্যপ্রাচ্য কোনটি বলা সমীচিন হবে—এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নিম্নোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এ বিতর্কের অবসান ঘটতে পারে ।
পশ্চিম এশিয়া পরিচিতি
পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য নামক অঞ্চল এবং এর অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের চিহ্নিতকরণ প্রশ্নে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এ বিতর্ক এ অঞ্চলে বিরাজমান সমস্যাগুলোর মতই প্রকট। সাধারণভাবে তুরস্কের দক্ষিণে ও মিশরের পূর্বে যে ভূ- খণ্ড তাকেই মধ্যপ্রাচ্য বলা যায় । অনেকে আবার তুরস্ক এবং মিশরকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। বিশ্ব মানচিত্রের দিকে তাকালে মধ্য প্রাচ্যের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠে। মধ্য প্রাচ্যের উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিমে এজিয়ান সাগর, ভূ-মধ্যসাগর, লিবিয়া, লোহিত সার; দক্ষিণে সুদান, আরব সাগর ও পারস্য উপসাগর এবং পূর্বে পাকিস্তান অবস্থিত। মধ্যপ্রাচ্যের মোট আয়তন ৭৮,২৪,৪৫১ বর্গ কিলোমিটার । ৫০° পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের নামটি প্রথম ব্যবহার করেন মার্কিন নৌ-কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আলফ্রেড থেয়ার মাহান (Alfred Thayer Mahan )। ১৯০২ সালে ন্যাশনাল রিভিউ (বৃটিশ সাময়িকী) পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর 'The Persian Gulf and International Relations”. নামক প্রবন্ধে মধ্যপ্রাচ্য নামটি প্রকাশ করেন। কিন্তু নামটি তখন ব্যবহারিক মর্যাদা লাভ করতে পারে নি। মধ্যপ্রাচ্য নামটি তুলনামূলকভাবে নতুন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর নামটি কিছুটা ব্যবহৃত হতে থাকে । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর হতে নামটি ব্যাকপভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এর পূর্বে এলাকাটি ‘নিকটপ্রাচ্য' (Near East) নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিল ।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় মিত্রশক্তি উত্তর আফ্রিকা হতে ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত সমগ্র অঞ্চলব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধের প্রয়োজনে এ অঞ্চলকে ‘মধ্যপ্রাচ্য' নাম দিয়ে একই সামরিক প্রশাসনের অধীনে আনা হয়। এ অঞ্চলের উপর বৃটেনের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় এবং বৃটেনের সরকারি কাগজপত্রে ব্যবহারের ফলে নামটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে ।
কিন্তু দিক নির্ভর এ নামকরণ অঞ্চলটির অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে । বৃটিশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু লণ্ডন হতে দূরত্ব ও দিক অনুসারে এ নামকরণ সঠিক হলেও বিশ্বের অন্যান্য স্থান হতে এ নামকরণ ভৌগলিকভাবে মোটেও সঠিক নয়। কেননা একজন বৃটিশ নাগরিকের জন্য অঞ্চলটি পূর্ব দিকে হলেও একজন ভারতীয় অথবা বাংলাদেশের নাগরিকের জন্য তা পশ্চিম দিকে অবস্থিত । আবার একজন রুশ নাগরিকের জন্য অঞ্চলটি দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এ বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতে অঞ্চলটিকে পশ্চিম এশিয়া নামে অভিহিত করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের ইতিহাস ‘পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস' নামে পাঠ করা হচ্ছে।
কিন্তু ভারতবর্ষ হতে ভৌগলিক দিক থেকে এ নামকরণ সঠিক হলেও মধ্যপ্রাচ্যভুক্ত সবগুলো দেশ নির্দেশ করে না। কেননা পশ্চিম এশিয়া বললে শুধু মাত্র মধ্যপ্রাচ্যের এশিয়া দেশগুলোকে বুঝায়। অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত মিশরসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো এবং ইউরোশিয়ার দেশ তুরস্ক বাদ থেকে যায়। অথচ এ দেশগুলো রাজানৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যভুক্ত এশিয় দেশগুলোর সাথে এত ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ যে এগুলোকে বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ধারণাটি সম্পূর্ণ হয় না । আবার জাতিসংঘের কাগজপত্রে অঞ্চলটি দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া নামে পরিচিত একই কারণে এ নামটিও গ্রহণযোগ্য নয় ।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ঠভাবে বলা যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যেভুক্ত দেশগুলোকে দূরত্ব ও দিক অনুসারে এবং মহাদেশ ভিত্তিক অভিধায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত এ অঞ্চলটিকে ‘পশ্চিম এশিয়া' অথবা ‘মধ্যপ্রাচ্য' বলা যেতে পারে ।
এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা কী? এ প্রশ্নের উত্তর ও এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্য নামের প্রবক্তা ক্যাপ্টেন মাহান এ বিষয়ে স্পষ্ঠ কোন ধারণা দেন নি। তার মতে ভূ-মধ্যসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-খণ্ডই হচ্ছে মধ্য প্রাচ্য ।
কিন্তু ধারণাটি ছিল একান্তই নৌবাহিনীর দৃষ্টিকোণ প্রসূত। তাই এ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায় না ।
যদিও এ অঞ্চলটি ধর্মীয়ভাবে ইউরোপ, সাংস্কৃতিকভাবে দূরপ্রাচ্য, ভৌগোলিকভাবে মধ্য এশিয়া থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং ফারটাইল ক্রিসেন্টকে এ অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা হয় । তথাপি এসব বৈশিষ্ট্য ও উপাদান দ্বারা এর প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর সুস্পষ্ট সীমা নির্ধারণ করা যায় না।
মধ্যপ্রাচ্য নামটি যারা ব্যবহার করেন তারাও এর সীমানার ব্যাপারে একমত নন । বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের রয়েছে এ অঞ্চলের সাথে সংশ্লিষ্টতার দীর্ঘ ইতিহাস, মধ্যপ্রাচ্য নামটিও যুক্তরাজ্যের প্রদত্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক প্রয়োজনে যুক্তরাজ্য এ নামকরণ করলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের সীমানার ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছ থেকেও কোন স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় নি। ১৯৪৭ সালের ১৯ মে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত বিতর্ক হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সময় বৃটিশ আণ্ডার সেক্রেটারি ক্রিস্টোফার মেহিউ মধ্য প্রাচ্যের সীমানা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “Where precision would be required we should not use this term.” এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, যুক্তরাজ্য সরকার সুনির্দিষ্ট সীমানার প্রশ্নে 'মধ্যপ্রাচ্য' নামটি ব্যবহার করা উচিত নয় বলে মনে করে।
কিন্তু তার পরও বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান মধ্য প্রাচ্যের সীমানা নির্ধারণের প্রয়াস চালিয়েছে। ‘Middle East Institute' নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি সংগঠন এ ব্যাপারে চরম মত পোষণ করে। এ প্রতিষ্ঠানের মতে মরক্কো হতে ইন্দোনেশিয়া এবং সুদান হতে উজবেকিস্থান পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম জাহানই মধ্য প্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত। আবার সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত কিছু গ্রন্থে মধ্যপ্রাচ্য বলতে শুধু ফারটাইল ক্রিসেন্টকে (সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ইরাক ও ইসরাইল) বুঝানো হয়েছে। প্রথম মতটির ব্যাপকতা এবং দ্বিতীয় মতটির সংকীর্ণতা মত দু'টির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইতিহাস থেকে সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না। কেননা সময়ের বিবর্তনে ও রাজনৈতিক কারণে মধ্যপ্রাচ্যের সীমা পাল্টেছে বহুবার। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে এ অঞ্চলটির অংশ বিশেষ নিকট প্রাচ্য নামে পরিচিত ছিল। বলকান অঞ্চল, মিশর ও পূর্ব ভূ-মধ্য সাগরীয় এলাকা মিলে ছিল নিকট প্রাচ্য-যা তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। আর ইরান, ইরাক, আরব উপদ্বীপ, আফগানিস্থান এবং কখনও কখনও ভারতবর্ষকেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা হত। এশিয়ার অবশিষ্ট অংশকে বলা হত দূরপ্রাচ্য ।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্বাবস্থার পরিবর্তন হয়। তুর্কি সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে বলকান এলাকা অনেকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এবং এশীয় দেশগুলো হতে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ দিকে তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত এশীয় দেশগুলোও যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের ম্যান্ডেটরী শাসনাধীনে চলে যায়। ফলে নিকট প্রাচ্য শব্দটি অপ্রচলিত হয়ে পড়ে এবং মধ্য প্রাচ্য হতে একে পৃথক করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এ সময় যুক্তরাজ্য শুধুমাত্র বলকান অঞ্চল নিয়ে নিকট প্রাচ্য এবং বসফরাস থেকে ভারতের পূর্ব সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য গঠিত বলে মত প্রকাশ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্য মাল্টা থেকে ইরান এবং সিরিয়া থেকে ইথিওপিয়া পর্যন্ত ভূ-খণ্ডকে মধ্যপ্রাচ্য নাম দেয়ায় অবস্থান আরো পরিবর্তন ঘটে। সোমালিল্যাণ্ড এবং সাইপ্রাসকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত বলে দেখানো হয়। কিন্তু মধ্য প্রাচ্যের বর্তমান ধারণা অনুযায়ী এ সীমানাও গ্রহণযোগ্য নয় ।
ধর্মীয় এবং নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায়ও মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় । ইসলামী সংস্কৃতির ধারক হিসেবে এ অঞ্চলের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র এর ভিত্তিতে অঞ্চলটিকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো থেকে পৃথক করা যায় না। কেননা মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও দূরপ্রাচ্য সহ সাব-সাহারান আফ্রিকায় ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। এছাড়া বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অমুসলিম সম্প্রদায় ও মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে । নৃতাত্ত্বিকভাবেও অনেক সময় মধ্যেপ্রাচ্যকে আরব বিশ্বের সাথে এক করে দেখা হয়। এক্ষেত্রে মধ্য প্রাচ্যে বসবাসকারী তুর্কি, পার্সিয়ান, ইহুদি, কুর্দি ও আর্মেনিয়ানদের মতো গুরুত্বপূর্ণ নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোকে বাদ দিতে হয়। অন্যদিকে এ বিবেচনায় আরবীভাষী মৌরীতানিয়ানদের মধ্য প্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সাব-সাহারার অন্তর্ভুক্ত মৌরিতানিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয় না ৷
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা সুনির্দিষ্টকরণ সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময় এর পরিসীমার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। এ অঞ্চল ভৌগলিকভাবে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে উঠে। তবে এ অঞ্চলে ‘মধ্যপ্রাচ্য' ও ‘পশ্চিম এশিয়া' নাম দুটিই সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]