আরব জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ (Arab Nationalism)

আরব জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে “আরব” শব্দটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিককালে আরব শব্দটিকে রাজনৈতিকভাবে সংজ্ঞায়নের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এ সংজ্ঞানুযায়ী একজন ব্যক্তি যদি এমন একটি দেশের নাগরিক হয়, যে দেশের জাতীয় ভাষা আরবী অথবা আরবী একটি সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃত (দেশের অধিকাংশ জনগণ আরবীতে কথা না বললেও) অথবা সে দেশ আরব লীগের সদস্য তাহলে সেই ব্যক্তিকে আরব বলে অভিহিত করা যাবে। এক্ষেত্রে বিশ্বের ৩০০ মিলিয়নেরও বেশী জনগোষ্ঠীকে আরব জাতিভুক্ত করা যায় ৷ তবে সংজ্ঞাটি সমালোচনামুক্ত নয়। ফিলিস্তিনি পণ্ডিত, হাবিব হাসান তুমা (Habib Hasan Touma) আরব শব্দটিকে সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে এ সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করেছেন। আরব বলতে তিনি বুঝিয়েছেন আরব রাষ্ট্রের জাতীয়তাভুক্ত কোন ব্যক্তিকে যার আরবী ভাষার উপর ভালো দখল রয়েছে এবং আরব ঐতিহ্য ও প্রথা সম্পর্কে সম্যক-ধারণা রয়েছে। ১৯৬৪ সালে আরব লীগও অনুরূপ একটি সংজ্ঞা প্রদান করে । এ সংজ্ঞায় আরবী ভাষাভাষী রাষ্ট্রের বসবাসকারী ব্যক্তি, যার মাতৃভাষা আরবী এবং আরবি ভাষাভাষী জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতি যার সহানুভূতি রয়েছে তাকে আরব বলে অভিহিত করা যায়। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন সময় আরব শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে। আরবী ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের সাথে সাথে আরব জাতি-গোষ্ঠীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সংকীর্ণ অর্থে শব্দটির ব্যবহার শুরু হলেও ক্রমেই তা ব্যাপকতা লাভ করেছে। বর্তমানে এ ব্যাপক অর্থেই আরব শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আরবি ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যভুক্ত দেশ সমূহের জনগণকে আরব বলে অভিহিত করা যায় ।
আরব জাতীয়তাবাদের ধারণা
আরব জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশের পিছনে ক্রিয়াশীল প্রধান দুটি উপাদান ছিল ভাষা ও ঐতিহ্য। প্রায় সকল আরব বুদ্ধিজীবীই আরবদের মধ্যে মানসিক ঐক্য সৃষ্টি অথবা জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হওয়ার পিছনে ভাষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এসব বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সাতিআল হুসরি (Sati al Husri) এর মতে, জাতীয়তাবাদের উপাদানগুলোর মধ্যে ভাষা হচ্ছে এমন একটি উপাদান যার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে অন্য একটি জনগোষ্ঠী হতে সহজেই পৃথক করা যায়। তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার পর তুর্কি ভাষার দাপটে আরবী ভাষা ম্রিয়মান হয়ে পড়লেও এ আরবী ভাষাকে কেন্দ্ৰ করেই আরবদের মধ্যে এক ধরনের স্বাতন্ত্রবোধ সৃষ্টি হয়েছিল। এছাড়া সাধারণত যৌথ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং ঐতিহ্যকেও জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যায় । হুসরীর মতে অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অথবা ভাগ্যবিড়ম্বনা উভয়ই একটি জনগোষ্ঠীকে তার নিজস্ব সত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে । আরবদের ক্ষেত্রে একথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। এ আরবদেরই রয়েছে অর্ধ দুনিয়া শাসন করার মত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কিন্তু তের শতকের গোড়ার দিকে ধর্মতত্ত্ব চর্চার আধিক্য, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে কুসংস্কার, নানা অলৌকিক উপাদানের প্রাধান্য, বিজ্ঞান-সম্মত চিন্তাধারার অভাব ইত্যাদি কারণে আরবরা সার্বিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। তাই অল্প কিছু কাল পরেই তারা তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। আরবরা তখন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাবাদ দিয়ে কেবল ধর্ম চর্চায় মনোযোগী হয়ে উঠে। ফলে তাদের মধ্যে তখন জাতীয়তাবাদী চেতনা বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু উনিশ শতকের গোড়ার দিকে তারা তাদের হৃত স্বাধীনতা ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে সচেতন হয়ে উঠে। নিজেদের অধিকার ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের এ সচেতনতাই আরব জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় ।
কোন একটি নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আরব জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় নি। বরং বিভিন্ন ঘটনাবলীর মিলিত প্রভাবেই আরবদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয়েছিল । তাই আরব জাতীয়তাবাদের উদ্ভব সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে, নিম্নে আরব জাতীয়তাবাদ উদ্ভবের পেছনে দায়ি ঘটনাসমূহ আলোচনা করা হলো :
মধ্যে আরবের ওহাবি আন্দোলনকে অনেকে আরব জাতীয়তাবাদের প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করেন। এ আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব (১৭০৩ –১৭৯২ খ্রিঃ)। তাঁর মতে সমসাময়িক ইসলাম নানা রকম অনাচার ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। তিনি এবং তার অনুসারীগণ ইসলামের প্রথম যুগের নিয়ম- কানুনে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে তখনকার ইসলাম ছিল খাঁটি ইসলাম । ওহাবিরা পরবর্তীকালে সংযোজিত অনৈসলামিক সকল কিছুকে বাতিল ঘোষণা করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামের মূল আইন কানুনের সাথে যেসব নতুন আচার ও প্রথা যুক্ত হয়েছে তারা সেগুলোর বিরোধীতা করে। ওহাবি মতানুসারে দরবেশ, দরগাহ, মাজার ইত্যাদি বিশ্বাস করা ইসলাম বিরোধী। এমনকি মরুভূমির যাযাবর গোত্রগুলোর মধ্যে যে প্রাক-ইসলামী নিয়ম-কানুন ও বিশ্বাস প্রচলিত ছিল সেগুলোর বিরুদ্ধেও তারা সোচ্চার হয়ে উঠে। ওহাবিরা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ওসমানীয় সুলতানের নমনীয় নীতি গ্রহণেরও বিরোধিতা করে। মোটকথা সমসাময়িক কালের ইসলামের কাঠামোকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য। আর বিদ্যমান এ কাঠামোকে যেহেতু পৃষ্ঠপোষকতা করত ওসমানিয় সুলতান সেহেতু ওহাবিদের এ বিরোধিতা পরোক্ষভাবে ওসমানিয় সুলতানের বিরুদ্ধেই ছিল। এছাড়া তিনি আরবরদের খেলাফতের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য তুর্কীদের দায়ী করেন।
আবদুল ওহাব তার মতবাদ বাস্তবায়নের জন্য ১৭৪৭ সালে মধ্যে আরবে সউদ নামে এক গোত্র প্রধানের সাথে জোটবদ্ধ হন। ফলে আন্দোলনের উৎপত্তিস্থল মধ্য আরবে এ আন্দোলনের দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৭৬৫ খ্রিঃ আবদুল ওহাবের মিত্র ইবনে সউদ মৃত্যুবরণ করেন। এবং তার পুত্র আব্দুল আযীয (প্রথম) ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সউদ ১৭৬৫ সালে ক্ষমতাসীন হন। ১৭৯৯ খ্রিঃ তার নেতৃত্বে ওহাবিরা ইরাক আক্রমণ করে বাগদাদের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়। ইরাকের তুর্কি গভর্ণর ওহাবিদের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এর দুই বছর পর তারা শিয়াদের পবিত্রস্থান কারবালা দখল করে নেয়। ১৮০৩ সালে ওহাবিরা মক্কা দখল করে নেয় এবং ওসমানিয় সুলতানের পরিবর্তে সউদের নামে খুতবা পাঠ করে। এ বছরই আব্দুল আযিয (প্রথম) ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সউদ মৃত্যু বরণ করেন এবং তার পুত্র সউদ ইবনে আব্দুল আযিয (দ্বিতীয় ইবনে সউদ) সিংহাসনারোহণ করেন। তার নেতৃত্বে ওহাবিরা ১৮০৪ সালে মদীনা দখল করে নেয়। ১৮১১ সালে তুরস্কের সুলতানের নির্দেশে মুহাম্মদ আলী পাশাা কর্তৃক অধিকৃত না হওয়া পর্যন্ত এই স্থানগুলো ওহাবিদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু ওসমানিয় সুলতানের বিরুদ্ধে ওহাবিদের এ বিদ্রোহ ধর্ম নিরপেক্ষ ছিল না। পরবর্তী কালের ধর্ম নিরপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে এ আন্দোলনের কোন সাদৃশ্য ছিল না। এছাড়া এ বিদ্রোহে আরব ঐক্যের কোন ইঙ্গিতও ছিল না। ইতিহাসে ওহাবিদের আন্দোলন ধর্ম সংস্কার আন্দোলন নামেই সমধিক পরিচিত। তবে ওসমানিয় সুলতানের বিরুদ্ধে তাদের এ প্রতিবাদ পরবর্তীতে রাজনৈতিক দাবী- দাওয়া উত্থাপনে আরবদের উৎসাহ যোগিয়েছিল, তাই আরব জাতীয়তাবাদের উদ্ভবে ওহাবি আন্দোলনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
ঊনিশ শতকের শেষের দিকের কিছু ঘটনাবলিও আরব জাতীয়তাবাদের উদ্ভবে সহায়তা করেছিল। এ সময় তুরস্ক তার পাশ্ববর্তী ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়ে। এবং এ সুযোগে তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত খ্রিষ্টান প্রজারা তাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে দীর্ঘদিন তাদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছিল সেগুলোর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানায়। তুরস্কের দুর্বলতার সুযোগে ইউরোপীয় দেশগুলো তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। ইউরোপীয় দেশগুলোর সহযোগিতায় বলকান অঞ্চলের খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো একে একে বিদ্রোহ করতে থাকে। এবং কিছু কিছু দেশ স্বাধীনতাও লাভ করে। আবার কিছু দেশ পার্শ্ববর্তী ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে তুর্কি সাম্রাজ্যের বাইরে চলে যায়। ওসমানিয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আরব দেশগুলো এ বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু তখনও তুর্কিসুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা লাভের কথা কেউ ভাবে নি। তবে বলকান জাতিসমূহের স্বাধীনতা লাভের বিষয়টি একটি জাতি হিসেবে আরবদেরকেও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখায়। যা আরব জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ।
নেপোলিয়নের মিশর দখলের কারণেও আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ন মিশর আক্রমণ করেন। ফরাসীদের এ মিশর আক্রমণ অতর্কিত বা অপরিকল্পিত ছিল না। গোটা আঠার শতক জুড়ে ইউরোপ তথা সারা বিশ্বে নতুন নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ইঙ্গ-ফরাসী প্রতিযোগিতার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল নেপোলিয়নের মিশর আক্রমণ ও দখল । ভারতে নব প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে এ সাম্রাজ্যের কেন্দ্র বিন্দু লণ্ডন হতে বিচ্ছিন্ন করাই ছিল তার মিশর দখলের উদ্দেশ্য। মিশর দখল করার পরপরই নেপোলিয়ন মিশরবাসীর হৃদয় জয় করে এ বিজয়কে সংহত করার চেষ্টা করেন। মিশরিয়দের তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন এবং ধর্মীয় উৎসব পালনে উৎসাহ প্রদান করেন। এমনকি তিনি নিজে প্রধান শেখের পোষাক পরে এসব উৎসবে যোগ দিতেন। দেশের শাসন ব্যবস্থায়ও তিনি মিশরিয়দের অন্তর্ভুক্ত করেন। যা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। কেননা ইতোপূর্বে মিশরিয় প্রশাসনের উচ্চ পদগুলো ছিল মামলুক ও তুর্কি অভিজাতদের দখলে । ফলে নেপোলিয়ন মিশরিয়দের এসব পদে নিয়োগের নির্দেশ দিলে মিশরিয়রা অত্যন্ত বিস্মিত হয়। সুলতানের প্রতিনিধি ছাড়া এসব পদে অন্য কারো নিয়োগ ছিল তাদের নিকট কল্পনাতীত ব্যাপার। নেপোলিয়ন মিশরবাসীকে এ মানসিক হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন, নেপোলিয়নের মিশর দখলের পর তুর্কি ও মামলুক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পলায়নের ফলে প্রশাসনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা মিশরিয়দের দ্বারা পূরণ করা হয়। নেপোলিয়নের এ পদক্ষেপ মিশরিয়দের মনে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। তিনি মিশরিয়দের সামনে তুর্কি শাসনের স্বৈরাচারী রূপ তুলে ধরেন এবং নিজে একটি উদারতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে মিশরিয়দের সহযোগিতায় ইঙ্গ তুর্কি আঁতাত মোকাবেলায় সচেষ্ট হন। এছাড়া নেপোলিয়ন তাঁর সুসজ্জিত নৌবহরে শুধুমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র ও সৈনিক নিয়ে আসেন নি, ফ্রান্সের উদীয়মান শিল্পী, সাহিত্যিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকগণ তাঁর সহচর ছিলেন। ফলে রাজ্য জয়, বিদ্রোহ দমন ও নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সাথে সাথে সমান উৎসাহ ও উদ্দীপনায় চলে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। তাদের এ কর্মকাণ্ডের ফলে প্রাচীন মিশরিয় সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য উদ্ঘাটিত হয় যা মিশরিয়দের তাদের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ফরাসি বিপ্লবের অল্প কিছুকাল পরেই নেপোলিয়নের এ মিশর অভিযানের ফলে মিশরে ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারা বিকাশ লাভ করে যা মিশরিয়দের মনে জাতীয়তাবাদী ধ্যান ধারণা জন্ম দেয়। ফ্রান্সের মিশর ত্যাগের পরও এ এলাকার সাথে ফ্রান্সের একটি সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় থাকে। একটি প্রগতিশীল দেশের সাথে প্রতিষ্ঠিত এ যোগাযোগ মিশরিয় আরবদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টিতে যথেষ্ট অবদান রেখেছিল ।
আঠার শতকের মধ্যভাগে সংঘটিত ওহাবি আন্দোলন প্রথম তুর্কি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দৃষ্টি স্থাপন করে। ভিন্নতর উদ্দেশ্যে পরিচালিত হলেও আন্দোলনটি আরবদেরকে কিছুটা হলেও সচেতন করে তুলতে সক্ষম হয়। বলকান অঞ্চলসমূহের স্বাধীনতা লাভ এবং নেপোলিয়ানের উদারনৈতিক শাসনের ফলে আরবরা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠে। এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে ৷

মিশরের মুহাম্মদ আলী পাশার অবদান

আরব জাতীয়তাবাদের মহানায়ক মুহাম্মদ আলী পাশা ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে এ জিয়ান সাগরের তীরবর্তী কাভাল্লা নামক একটি ছোট মেসিডোনীয় বন্দরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা-মাতা ছিলেন খুবই দরিদ্র এবং তিনি কাভাল্লায় বাল্যকাল অতিবাহিত করেন। পরবর্তীতে তিনি একজন ফরাসী তামাক ব্যবসায়ীর সাথে কাজ করেন। তিনি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে সামরিক স্কুলে যোগদান করেন। ফরাসি দখলদারিত্ব থেকে মিশরকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ওসমানিয় সুলতান নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। ১৮০১ সালে তুরস্ক ও ব্রিটেনের সম্মিলিত এ বাহিনীর নিকট ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয় । এ বাহিনীর একজন গর্বিত সৈনিক ছিলেন মুহাম্মদ আলী পাশা। ফরাসি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর মুহাম্মদ আলী ১৮০৫ খ্রিঃ মিশরে ওয়ালি (প্রদেশপাল) নিযুক্ত হন। ক্ষমতারোহণের পরপরই তিনি মিশরে তাঁর কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় ওহাবিরা মক্কা, মদীনা, কারবালাসহ ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো দখল করে নেয়, যা ছিল তুর্কি সুলতানের এখতিয়ারভুক্ত অঞ্চল। তুর্কি সুলতান এ বিদ্রোহ দমনের জন্য মুহাম্মদ আলী পাশার শরণাপন্ন হন। ১৮১১ সালে মুহাম্মদ আলী পাশা এবং তাঁর পুত্র ইব্রাহীম পাশা ইসলামের এ পবিত্র স্থানগুলো ওহাবিদের কাছ থেকে মুক্ত করে তুর্কি সুলতানের কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসেন । তখন থেকেই আরব জগতের সর্বত্র মুহাম্মদ আলীর সুনামও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া এ বিজয় মুহাম্মদ আলী পাশা ও তাঁর পুত্র ইব্রাহীম পাশাকে আরবদের কাছাকাছি আসার সুযোগ এনে দেয় । তাঁরা আরবদের আশা-আকাঙ্খা সম্পর্কে অবগত হন ।
১৮২১ সালে গ্রিসের খ্রিস্টানগণ রাশিয়ার প্ররোচণায় ও সহযোগিতায় ওসমানির সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য সুলতান আবারও মুহাম্মদ আলী পাশার মুখাপেক্ষী হন। বিনিময়ে মুহাম্মদ আলীকে সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ক্রীট দিয়ে পুরষ্কৃত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। মুহাম্মদ আলীর নির্দেশে তাঁর পুত্র ইব্রাহিম পাশা গ্রিসের বিদ্রোহ দমন করেন। এদিকে তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ তাঁর অধীনস্থ মুহাম্মদ আলী পাশার সর্বক্ষেত্রে সফলতায় কিছুটা ঈর্ষাবোধ করতে থাকেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি সিরিয়া এবং ফিলিস্থিনের শাসন ক্ষমতা মুহাম্মদ আলী পাশাকে অর্পণ না করে শুধুমাত্র ক্রীটের শাসনভার তাঁকে অর্পণ করতে রাজী হন। সুলতানের এরূপ হীনমন্য আচরণে মুহাম্মদ আলী ক্ষুব্ধ হন। তিনি শক্তি প্রয়োগ করে সুলতান কর্তৃক প্রতিশ্রুত অঞ্চল দখল করার সংকল্প করেন। সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনি দখলের জন্য ১৮৩১ সালের জুলাই মাস নাগাদ ইব্রাহিম পাশা তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত করে সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন দখল করে নেন। সুলতান আলোচনার জন্য মুহাম্মদ আলী পাশার নিকট দূত প্রেরণ করেন। পিতার নির্দেশে ইব্রাহিম পাশা সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ।
দীর্ঘ পাঁচ মাস আলোচনা চলার পর সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে তুর্কি সুলতান ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। এ বাহিনী ইব্রাহিমের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তুর্কি বাহিনীর এ পরাজয়ের ফলে কন্সটান্টিনোপল অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ইব্রাহিম কন্সটান্টিনোপল অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু আবারো পিতার নির্দেশে তাঁকে থেমে যেতে হয়। অবশেষে ১৮৩৩ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে তুর্কি সুলতান মুহম্মদ আলী পাশাকে সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে স্বীকার করে নেন। তাঁর পক্ষে তার পুত্র ইব্রাহিম পাশা-সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পূর্বে ওহাবিদের কাছ থেকে মুসলমানদের পবিত্র ভূমি দখল আর এখনকার সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখলের মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য ছিল । মুহাম্মদ আলী পাশা সুলতানের পক্ষ হয়ে ওহাবিদের নিকট হতে মক্কা, মদীনা ও কারবালা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। অর্থাৎ এটা ছিল সুলতানের পক্ষ হয়ে মুহাম্মদ আলী কর্তৃক তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্যান্য বিদ্রোহ দমনের মতই একটি ঘটনা। কিন্তু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তার নিকট থেকে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার মধ্যে একটা আলাদা তাৎপর্য ছিল। এর ফলে মুহাম্মদ আলী পাশা নিজেকে তুর্কি সুলতানের সমকক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতে থাকেন। আরবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দুটি তার দখলে চলে আসার পর তিনি অবশিষ্ট আরব ভূমি দখলে এনে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তাঁর এ চাওয়ার মধ্যে কোন লুকোচুরি ছিল না। তিনি জানতেন তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি ফ্রান্সের সহযোগিতা পাবেন। কারণ সিরিয়া, মিশর ও আরব উপদ্বীপ নিয়ে গঠিত আরব রাজ্যটি ফ্রান্সের প্রভাবাধীনে থাকলে ভারতের সাথে ব্রিটেনের স্থলপথে যোগাযোগ বাধাপ্রাপ্ত হবে। ফলে ব্রিটেনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ফ্রান্স তার নিজ স্বার্থেই মুহাম্মদ আলীকে সহযোগিতা করবে। অস্ট্রিয়ার সরকারও মুহাম্মদ আলীকে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্য ও আশ্বাসের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও মুহাম্মদ আলী পাশার অনুকূলে ছিল। ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। কেননা পবিত্র ভূমিদ্বয়ের রক্ষক মক্কার শরীফ ছিলেন তাঁর অনুগত। ওসমানিয় সুলতান তার মুসলিম ও খ্রিষ্টান প্রজাদের কাছে ছিলেন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এছাড়া নতুন সাজে সজ্জিত মিশরিয় বাহিনী ছিল তুর্কি বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি সুসংগঠিত। সুতরাং, স্বাধীন আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ আলী পাশা একটি অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিলেন, স্বাধীন আরব সাম্রাজ্য গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি পাশ্চাত্য কায়দায় মিশরের আধুনিকায়নে মনোনিবেশ করেন। নিম্নে মিশরের আধুনিকায়নে মুহাম্মদ আলী পাশার বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সংস্কার আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশে যে ভূমিকা রেখেছিল তা আলোচনা করা হলো ।
ভূমি সংস্কারের নীতিমালা : মোহাম্মদ আলী একজন শ্রেষ্ঠ সংস্কারক ছিলেন। তিনি ইসলামী বিশ্বের প্রথম শাসক যিনি ক্ষমতা লাভ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন জনহিতকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তিনিই সর্বপ্রথম মধ্যযুগীয় অর্থনীতিকে আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের উপযোগী করে বিভিন্ন সংস্কারমূলক নীতি গ্রহণ করেন। মিশরিয় অর্থনীতির রূপান্তরে তাঁর প্রখ্যাত ও জনমঙ্গলকর ভূমি সংস্কার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার মূল চাবিকাঠি ছিল প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দ্বারা কৃষি উৎপাদন ও রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি। ক্ষমতালাভের অর্থাৎ ১৮০৫ সালের পূর্বে মিশরের সমস্ত জমি ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ
শতাব্দীতে সরকার নিয়ন্ত্রিত জমি জায়গীর দেয়া মুহাম্মদ আলী পাশা হত যা ‘Tax farming নামে পরিচিত। মিশরিয় ভাষায় ‘ইলতিযাম' নামে পরিচিত এ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী জায়গীরদার বা ‘মোলতাসিম’গণ অনির্দিষ্টকালের জন্য জমি ভোগ দখল করতে পারত এবং সরকারকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্ষিক কর দিত। এসব ‘মুলতাসিম'গণ নির্যাতন করে কৃষকদের নিকট হতে ইচ্ছামত কর আদায় করতে পারত। এভাবে কৃষকরা নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়। পূর্বে জায়গীর সাময়িকভাবে দেওয়া হলেও ১৮০০ সালের পর আজীবন জায়গীর দেয়া শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, এ জায়গীর ভোগ করতেন গ্রামের জোতদার শ্রেণী, প্রভাবশালী কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনীর সদস্যবর্গ এবং তারা শোষণ নীতির বশবর্তী হয়ে কৃষকদেরকে নিঃস্ব করে ফেলে। মুহাম্মদ আলী পাশার ভূমি সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তুর্কি ও মামলুকদের প্রদত্ত সব জমি রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় ।
রাষ্ট্রয়করণ নীতি :,/b> মুহাম্মদ আলী অর্থনৈতিক সংকট দূরীকরণে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করার চিন্তা-ভাবনা করেন। এবং এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য জোতদারী, জায়গীরদারী ও স্বত্বভোগী শ্রেণীদের কাছে বরাদ্দকৃত ভূমি রাষ্ট্রীয়করণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮১৩ সালে তিনি মিশরের সমগ্রভূমি জরিপের নির্দেশ দেন। ভূমি সংস্কার নীতি বাস্তবায়নে তিনি মূলত: দুটি সমস্যা চিহ্নিত করেন।
(১) জোতদারী (Tax-farming) রাষ্ট্রকে ভূমি থেকে প্রাপ্য প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে।
(২) জোতদারী কৃষকদের উপর নির্যাতন চালিয়ে বিত্তশালী হওয়ার সুযোগ দেয়। এবং জোদতারগণ ক্রমশঃ মিশরের উপর পাশার একচ্ছত্র ক্ষমতার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মুহাম্মদ আলী উলামা শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার জন্য শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং মনে করেন যে এর প্রধান কারণ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘ওয়াকফ’ এবং ‘রিযাক আব্বাসীয়া’ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব, যা থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণে পাশা পূর্বে বরাদ্দকৃত জমি বাজেয়াপ্ত এবং ধর্মীয় সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ (ওয়াকফ) সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনেন ।
রাজস্ব ব্যবস্থা : মুহাম্মদ আলী রাষ্ট্রীয় স্বার্থে মামলুকদেরকে কায়রোর দূর্গে নৃশংভাবে হত্যা করে তাদের ক্ষমতা চিরতরে বিলুপ্তই করেন নি, বরং তাদের জমি জমা বাজেয়াপ্ত করেন। ‘ইলতিযাম' বা জোতদারী উচ্ছেদ করা হয় এবং ‘মোলতাসিম’দের দখলে সমস্ত জমি রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় । তিনি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রতিষ্ঠানসমূহে বরাদ্দকৃত জমি বা ওয়াকফ সম্পত্তির উপর কর নির্ধারণ করেন। অবশ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন বাগান এ করের আওতামুক্ত ছিল, ১৮০৯ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত মুহাম্মদ আলী তার নীতিতে অটল ছিলেন, ওয়াকফ সম্পত্তির উপর রাজস্ব ধার্য করা হলে উলেমা সম্প্রদায়, এমনকি আলআযহারের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের প্রভাব ও প্রতিপত্তি হ্রাস করা হয়। ভূমি সংস্কারের নীতি বাস্তবায়নের জন্য তিনি ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ সালের মধ্যে দেশব্যাপী জমি সংক্রান্ত জরিপ (Cadastral Survey) পরিচালনা করা হয় । নতুন নীতি প্রবর্তনে রাষ্ট্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ও নিয়ন্ত্রিত সব জমি এক একটি গ্রামীণ সম্প্রদায়কে বরাদ্দ দেয়া হয় এবং এ সম্প্রদায় সরকারকে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব দিতে বাধ্য করা হয়। এ নিয়ম অনুযায়ী ‘ফেলাহীন’ বা ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক না হলেও সে বংশ পরম্পরায় একই জমি চাষ করতে পারত। রাষ্ট্রীয় করণের ফলে নির্যাতিত ও শোষিত কৃষক শ্রেণীর সাথে রাষ্ট্রের মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং এর ফলে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ববৃদ্ধি পায় অন্যদিকে কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়। ১৮০৫ থেকে ১৮১৬ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছর তিনি ভূমি সংক্রান্ত সংস্কারের (Agrarian reform) দ্বারা সমগ্র মিশরের জমি রাষ্ট্রয়িকরণে সমর্থ হন ৷
ভূমিবন্টন : মুহাম্মদ আলীর ভূমি সংস্কার সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল । তার শাসনামলে সমগ্র মিশরকে একটি বিরাটকার কৃষি উপযোগী ভূমি-সম্পত্তি বলে মনে করা হত। (Thus Egypt became nearly one great farm held at nominal rental of the state)। তিনি 'ইলতিযাম' পদ্ধতি বিলুপ্ত করে গ্রামের প্রধান এবং কৃষকদের মধ্যে সরাসরি জমি বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। তিনি জমির স্বত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যাস্ত করেন যাতে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভূ-স্বামী শ্রেণীর (Private own- ership) উদ্ভব না হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি তার নীতি পরিবর্তিত করে ১৮২৯ ১৮৩০ সালে রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের পতিত ও অকর্ষিত জমি বণ্টন করেন। এ ব্যবস্থার একটি শর্ত ছিল যে, জমির মালিককে ভূমি কর্ষণ দ্বারা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এবং সরকারকে পর্যাপ্ত রাজস্ব প্রদান করতে হবে । এ ব্যবস্থা ‘ইবাদিয়া’ (Ibadiyya) নামে পরিচিত। এ ব্যবস্থায় প্রথম দিকে জমির মালিক ভূমি স্বত্ব লাভ করত না। কেবল জমি চাষের অধিকার ছিল । কিন্তু ১৮৩৬ সালে সন্তান জমির প্রকৃত মালিক হয়ে পড়ে। ১৮৪৬ সালে এসব জমির মালিক জমি বন্ধক, বিক্রি বা হস্তান্তর করার অধিকার লাভ করে। মুহাম্মদ আলীর ভূমি সংস্কারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভূমি বণ্টন ব্যবস্থা এবং তিনি তিন প্রকার পন্থার উদ্ভাবন করেন। ১.ইবাদিয়া, ২. সিফতলিক (Ciftlik) এবং ৩. উহদা (Uhda)। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে মুহাম্মদ আলী ব্যক্তিগত মালিকানা বিরোধী হলেও প্রাচীন অটোমান রীতি অনুযায়ী তিনি তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জমি বণ্টন করেন। এ পদ্ধতি ‘সিফতলিক নামে পরিচিত। এ পদ্ধতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সমগ্র মিশরের চাষ উপযোগী জমির এক ষষ্ঠাংশ তার পরিবারের দখলে চলে যায়। তৃতীয় পদ্ধতিতে সমগ্র গ্রাম বা অঞ্চল উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী, গভর্ণর, সামরিক অফিসার, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে দেয়া হয়। যার ফলে সরকার নিয়মিতভাবে রাজস্ব আদায় করতে পারতেন। ‘উহদা' নামে পরিচিত এ ব্যবস্থার সাথে প্রাচীন জায়গীর প্রথা ‘ইলতিযাম' এর পার্থক্য হচ্ছে যে, পাশা এ সমস্ত জমিতে রাজস্ব নির্ধারণ করতেন। এবং জমির মালিক অধিক হারে কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করতে পারতেন না। যা হোক একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মুহাম্মদ আলীর শাসনামলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটে। জমির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য, সেচের ব্যবস্থা ছিল, উৎপাদিত শস্যের মধ্যে, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ধান, আখ, গম, তুলা ও নীল । নীলনদের মোহনা থেকে খাল কেটে কৃষি জমিতে সেচের সুব্যবস্থা করা হয় ।
সামরিক সংগঠন : মুহাম্মদ আলী তার শাসনকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিণপ্রাপ্ত সমারিক বাহিনী গঠন করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, তুর্কি ও মামলুক বাহিনী দ্বারা রাষ্ট্র সংগঠন এবং নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব হবে না। এ কারণে তিনি তুরস্কের সুলতান তৃতীয় সেলিম এবং দ্বিতীয় মাহমুদের মত মোহাম্মদ আলী তার শাসনকালের স্থায়িত্বের জন্য এবং নতুন যুগের সূচনায় একটি ইউরোপীয় পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়াস পান । এছাড়া অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দূরীকরণ এবং বিদেশে যুদ্ধাভিযানের জন্য তার একটি বিশাল সেনাদলের প্রয়োজন ছিল। তিনি ইংরেজ নৌবিহারের তৎপরতা এবং স্থল বাহিনীর দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মিশরিয় বাহিনী গঠনে মনস্থ করেন। এ সামরিক সংগঠনের অন্তরায় ছিল মামলুকগণ এবং এ কারণে মহিলা ও শিশু ছাড়া প্রায় সব মামলুককে নিধন করা হয়। ১৮২০ সালে পাশার সেনাবাহিনীতে ছিল অনিয়মিত ও উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদল । তিনি এ বাহিনীকে প্ৰশিক্ষণ দ্বারা সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে ব্যর্থ হলে তিনি এ বাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে একটি নতুন ও ক্ষীপ্রগতি সম্পন্ন নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন । তিনি ইউরোপীয় প্রশিক্ষক নিয়োগ করেন এবং আধুনিক ইউরোপীয় সমরাস্ত্রে একটি আধুনিক মিশরিয় বাহিনী গঠন করেন। ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের পতন হলেও মিশরে বসবাসকারী ফরাসী প্রকৌশলী ও সামরিক কর্মকর্তা বসবাস করতে থাকেন। মুহাম্মদ আলীর সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফরাসী কর্ণেল সেভেস (Seves)। এ ফরাসী সেনাধ্যক্ষ মিশরিয় বাহিনীর আধুনিকীকরণে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান পাশা আল-ফারানেসাভী (ফরাসীবাসী) নাম ধারণ করেন। তার নিরলস প্রচেষ্টা ও দক্ষতায় মিশরিয় বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত হয় এবং এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় এক লক্ষে ।
সামরিক প্রশিক্ষণ : কর্ণেল সেভেসের বলিষ্ট নেতৃত্বে মিশরিয় বাহিনীর প্রথম ব্যাচে আসওয়ানে প্রতিষ্ঠিত সামরিক স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। মুহাম্মদ আলী পাশার দূরদর্শিতায় মিশরে যে আধুনিক সেনাবাহিনী গঠিত হয় তাতে তুর্কি ও আলবেনীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। কারণ তারা দুর্ধর্ষ ও উশৃঙ্খল ছিল। তিনি সেনাবাহিনীতে কৃষক শ্রেণীর অন্তভুক্তির বিরোধিতা করেন। কারণ এর ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। নতুন ক্যাডেট সংগ্রহের জন্য (Conscription) বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে ভর্তি করা হত। মুহাম্মদ আলী নতুন সৈন্য সংগ্রহের জন্য সুদানে অভিযান করেন। কিন্তু বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করায় তাদের সংখ্যা কমে যায়। অতঃপর তিনি মিশরিয়দের নিয়েই মিশরিয় বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮২৩ সালের মধ্যে এরূপ আটটি ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়। এর ফলে মিশরিয় বাহিনী একটি অপারাজেয় সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। এর ফলে এশিয়া ও ইউরোপের রণাঙ্গনে তারা সুখ্যাতি অর্জন করেন। ফরাসী পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ লাভ করে মিশরিয় বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়। কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে সৈন্যদের থাকতে হত। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ডেমিট্রায় পদাতিক বাহিনীর স্কুল, গির্জায় অশ্বারোহী বাহিনীর স্কুল, তুরায় গোলন্দাজ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, খানকায় স্টাফ কলেজ এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় নৌবাহিনীর কলেজ স্থাপিত হয়। রিফাত বে বলেন, “১৮৩৯ সালের মধ্যে মুহাম্মদ আলীর সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২,০০,০০০ এ দাঁড়ায়, এর মধ্যে ১,৩০,০০০ সৈন্য ছিল নিয়মিত। আধুনিক সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিশরিয় বাহিনীর সমর বিজয় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, মুহাম্মদ আলীর সুদান অভিযানের সাফল্যের পর তার পুত্র ওমর তুসুনের নেতৃত্বে মিশরিয় বাহিনীকে আরব দেশের ওয়াহাবীদের দুর্দান্ত প্রতাপ ধ্বংসের জন্য একটি সেনাবাহিনী পাঠান। ইবনে সাউদ তুসুনের বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে মুহাম্মদ আলী স্বয়ং হেজাজ গমন করেন। তুসুনের মৃত্যুর পর মিশরিয় বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হন তদীয় ভ্রাতা ইব্রাহিম। ইব্রাহিম ওয়াহাবীদের রাজধানী দরিয়া দখল করেন। ১৮১১-১৮২৩ সালের মধ্যে মুহাম্মদ আলী আরবদেশে সমরাভিযান করেন। ১৮১৮ সালে আবদুল্লাহ ইবনে সাউদকে প্রথমে বন্দী করেন এবং তিনি পরে ইস্তাম্বুলে মারা যান। ক্রমশ হেজাজে অবস্থিত পবিত্র নগরী মক্কা, মদিনা, ও হারমাইন মিশরিয় পাশার অধীনে আসে। মুহাম্মদ আলী স্বীয় পুত্র ইব্রাহিমকে আরব দেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১৯২০ সালে সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট লাভের জন্য এবং খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য সুদানে মিশরিয় বাহিনী অভিযান করেন। সুদানের রাজধানী খাতুম শহরের ভিত্তি স্থাপিত হয় । তিনি এক বিরাট নৌবহরের সহায়তায় সিরিয়ায় অভিযান করেন ।
নৌবহর : মুহাম্মদ আলী পাশা বিশাল সেনাবাহিনী গঠনের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। কারণ তিনি বুঝতে পারেন যে নৌবাহিনী ছাড়া শক্তিশালী ইংরেজ, তুর্কি ও গ্রীকদের নৌবাহিনীর সাথে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তিনি নৌবাহিনী পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করার জন্য তুলোবাসী ফরাসী নৌধ্যক্ষ লেফেবর দ্যা কেরিসীকে (Lefebure de Cerisy) দায়িত্ব দেন। কেরিসীর নেতৃত্বে ভূ-মধ্যসাগরে মিশরিয় নৌবহর গঠিত হয়। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় ১৮২৯ – ৩০ সালে একটি নৌবিদ্যার কলেজ এবং গোলাবারুদের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এ নৌ-বন্দরে নৌ-সেনার শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ১৮৩৭ সালের মধ্যে মুহাম্মদ আলী নেতৃত্বে ১১টি নৌ-তরী, ৬টি ফ্রিগেড এবং অসংখ্য রণতরী নির্মিত হয়। সামরিক কারখানায় বিদেশীদের নিয়োগ করা হয়। বিশেষ করে ফরাসী-ইতালীয় ও গ্রীকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ড. ব্রাউন বলেন, “পোষাক ছাড়া মিশরিয় নৌ-বাহিনীকে সুশৃঙ্খল ইউরোপীয় নৌবাহিনীর সাথে পার্থক্য করা যায় না। বলা বাহুল্য, সেনাবাহিনী সংগঠন জাহাজ নির্মাণ, অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের কারখানা মুহাম্মদ আলীকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় যুদ্ধাভিযানে সহায়তা করে। তার পুত্র ইব্রাহিম ভূ-মধ্যসাগরীয় দ্বীপ ক্রীট এবং মোরিয় দখল করেন। অবশ্য ১৮২৭ সালে নাভারিনোর যুদ্ধে ইন্দো-ফরাসী যৌথ নৌ-অভিযানের ফলে তিনি পরাজয় বরণ করেন।”
প্রশাসনিক সংস্কার : প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্বিন্যাসে মুহাম্মদ আলীর বিশেষ অবদান ছিল। প্রাচীন অন্তঃসারশূন্য অটোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে মধ্যযুগীয় প্রশাসন উচ্ছেদ করা হয় । ভাতিকিউটিস বলেন, “মুহাম্মদ আলীর সরকার এবং প্রশাসনের মূলনীতি ছিল কঠোর ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন। অটোমান সুলতান কর্তৃক প্রদত্ত সমস্থ ক্ষমতা মুহাম্মদ আলী কুক্ষিগত করেন। তিনি পূর্ববর্তী প্রাদেশিক গভর্ণর বা শেখ আল বালাদের' সুলতানের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। স্বীয় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি দ্বারা মিশরে একটি ‘পাসালিক' প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি সুলতানের সহায়তায় আরব দেশে সৈন্য প্রেরণ করেন সত্য, কিন্তু শাসন কার্য স্বাধীনভাবে পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর পুত্র ইব্রাহিমের নেতৃত্বে অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত সিরিয়ায় সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ১৮৩৩ সালে তিনি তুরস্কের সুলতানের নিকট থেকে ‘উনকাইর স্কেলেসীর' সন্ধি অনুযায়ী একরে নেবলুস, দামেস্ক, আলেপ্পো ও আদানার পাশা নিযুক্ত হন। এমনকি তিনি কনস্টানটিনোপল দখলের হুমকী দেন, যাহোক তিনি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ছিলেন না। কেননা তিনি অটোমান সুলতানকে বার্ষিক নজরানা দিতেন। তিনি ১৮৪১ সালে তুর্কি সুলতানের নিকট থেকে একটি ফরমানের মাধ্যমে মিশরের ভাইসরয়ের মর্যাদা লাভ করেন, তিনি মিশরে মূলত: একটি স্বাধীন পাসালিক স্থাপন করেন, যা ছিল বংশানুক্রমিক ।
প্রশাসনকি বিন্যাস : একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মুহাম্মদ আলী একজন প্রতিভাবান ও দক্ষ শাসক ছিলেন, তিনি প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন এবং কঠোর হস্তে ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন। তিনি প্রশাসনিক কাঠামোর বিন্যাসে সর্বাধিক দায়িত্ব অর্পণ করেন তার চার পুত্র-তুসুন, ইব্রাহিম, ইসমাইল এবং সাঈদের উপর। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সর্বময় ক্ষমতা তাদের ছিল। শুধু তাই নয়, মিশরের প্রশাসন তার বংশের সদস্যদের উপর অর্পিত হয়। ইব্রাহিম পাশা সুদানে অভিযান করেন এবং ভূ-মধ্যসাগরীয় দ্বীপ ক্রীট ও মোরীয় দখল করেন। ইব্রাহিম ওয়াহাবীদের বিরুদ্ধে অভিযান করে তাদের রাজধানী দখল করেন। আরব দেশের পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনা মুহাম্মদ আলীর দখলে আসে এবং ইব্রাহিম আরব দেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তার পুত্র ইসমাইল পাশা পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। সাঈদ পাশা নৌবহরের অধিনায়ক ছিলেন। পৌত্র আব্বাস কায়রোর গভর্ণর নিযুক্ত হন। মুহাম্মদ আলীর ভ্রাতুষ্পুত্র ও পৌত্রদের বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক পদে নিযুক্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় শাসনকে সুদৃঢ় করার জন্য তিনি সমগ্র দেশকে কয়েকটি প্রদেশ, বিভাগ ও মহকুমায় বিভক্ত করেন। সমগ্র দেশকে ৭টি প্রদেশে এবং প্রত্যেক প্রদেশকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করা হয় । মামলুক আমলে ২৪ টি প্রদেশ ছিল । কিন্তু প্রশাসনিক সুবিধার্থে সেগুলো ভেঙ্গে ৭টি প্রদেশে পরিণত করা হয়। মিশরে মোট ৬১ টি জেলা ছিল। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে গভর্ণর থেকে সাধারণ সরকারি কর্মচারী কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত করতেন। মুহাম্মদ আলী স্বীয় হস্তে কঠোরভাবে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য ফরমান জারী করতেন । প্রাদেশিক শাসনকর্তা ‘মুদির' নামে পরিচিত ছিল ।
মন্ত্রণালয় : কেন্দ্রীয় প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হয়। মুহাম্মদ আলী প্রাথমিক স্তরে ৬টি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেন। যথা—স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, অর্থ, সমর, বাণিজ্য ও নৌবাহিনী। ১৮৩৩ সালে আধুনিক মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আর্মেনীয় বগুস বে (Boghos Bey)। ১৮৩৭ সালে অপর ৫টি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান ছিলেন খ্রিষ্টান হাবিব এফেন্দী। মুহাম্মদ আলী সামরিক বাহিনী সুগঠিত করার জন্য ‘নিযামতে-ই-হারবিয়া' বা সামরিক দফতর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘দিওয়ান আল জিহাদিয়া' বা যুদ্ধ সংক্রান্ত কাউন্সিল গঠন করেন। ফরাসী সামরিক সংগঠনের অনুকরণে মিশরের সমর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনী গঠন, গোলাবারুদের কারখানা স্থাপন, সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ (Logistic) ইত্যাদি। তাঁর প্রশাসনিক সংস্কারের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি ফরাসী শাসন কর্তাদের প্রবর্তিত আইন এবং পরামর্শ পরিষদ (Legislative and Consultative) বাতিল করেন, যেমন— কায়রো কাউন্সিল বা দিউয়ান এবং প্রাদেশিক ও সাধারণ কাউন্সিলসমূহ । এক্ষেত্রে তিনি উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী ও মন্ত্রীদের নিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত কাউন্সিল গঠন করেন। এ কাউন্সিলের মাধ্যমে তিনি তার ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে সক্ষম হন। ফরাসী প্রশাসনের অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ফরাসী শাসনামলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নেপোলিয়ন উলেমা ও মোল্লাশ্রেণীকে পরামর্শ ও অংশ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু আধুনিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুহাম্মদ আলী ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ধর্মীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ করতে দিতেন না। তারা শরিয়ত বিষয়ে পরামর্শ ও বিচার করতে পারতেন।
ধর্মীয় সাহিষ্ণুতা : মুহাম্মদ আলীর শাসনকাল ছিল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রতি, সদ্ভাব ও সখ্যতার ইতিহাস। বলা বাহুল্য যে, মিশরকে আধুনিকীকরণে বিদেশী প্রকৌশলী,কারিগর, ডাক্তার, সামরিক ও বেসামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হয়। নেপোলিয়নের মিশর বিজয় থেকে প্রশাসনে ফরাসী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মূলত: মিশরের সেনাবাহিনী গঠনে বিশেষ অবদান ছিল ফরাসী কর্ণেল সেভেসের (Seves) । তিনি অবশ্য পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ফরাসী ধরণের লাইসী স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং ফরাসী শিক্ষক ও নিয়োগ করা হয়। ফরাসী ডাক্তার ক্লট বে-র তত্ত্বাবধানে প্রথম মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত করা হয়। লেফেবর দ্যা কেরিসী আলেকজান্তিয়ায় নৌবিহার ও নৌ-বিদ্যার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । ইটালীয় ক্যাময়াগী (Camiagi) কাগজের মিল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সাম্প্রদায়িক সমঝোতা কায়েমের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অনুসৃত হয়। তিনি খ্রিষ্টান, আর্মেনীয়, গ্রীক ও ফরাসী, ইটালীয় কপটিক কর্মচারী নিয়োগ করেন। ভ্যাটিকিওটিসের ভাষায়, “A factor of the pashas insistence upon public order and security was his policy of religious tolerance."
শিক্ষা সংস্কার : মুহাম্মদ আলী পাশা-আধুনিক সভ্যতার আলোকে মিশরকে গড়ে তোলার প্রয়াস পান ! তিনি শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি তিনি ইউরোপীয় রীতিতে আধুনিক শিক্ষাক্রম চালু করেন । আল আজহার সহ ধর্মীয় মাদ্রাসা, মক্তব ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষা কুরআন, হাদিস ও ফেকাহ চালু ছিল। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ফরাসী পদ্ধতিতে আধুনিক শিক্ষাক্রম চালু করেন। যেমন— প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এ ধরনের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন মিশরের জন্য একটি অভিনব ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ (A revolutionary innova- tion) বলা হয়েছে। তিনি মিশরিয় শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন ।
প্রশিক্ষণ ও জাতীয় জাগরণ : মুহাম্মদ আলীকে আধুনিক মিশরের জনক বলা হয়। এর মূল কারণ হল-তিনি জাতিগঠনমূলক অসংখ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেন। তার পরিকল্পিত ‘নতুন সমাজ ব্যবস্থার' (New Order) মূলে ছিল শিক্ষা । আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি আধুনিক ছাপাখানা স্থাপন করেন । প্রথম দিকে তিনি তুর্কি ভাষায় প্রশাসন পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে আরবী ভাষা তুর্কি ভাষার স্থান দখল করে। ফলে স্থানীয় মিশরিয় আরবগণ উচ্চপদে সমাসীন হয়। এ সময় পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে মিশরিয়গণ আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসে ।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন : তিনি যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধনা করেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। বিভিন্ন স্থানে বহু শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়। শিল্প বিপ্লব শুরু হলে বিদেশী বণিক, বিনিয়োগকারী ও শিল্পপতি মিশরে আগমণ করেন। মিশরিয় অর্থনীতির নতুন দিগন্তের সূচনা হয় ।
মূল্যায়ন : মুহাম্মদ আলী পাশাকে নিঃসন্দেহে আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় । বলা হয়ে থাকে যে মুহাম্মদ আলী পাশাকে মিশর যেমন সৃষ্টি করেছিল তেমনি মুহাম্মদ আলী পাশাও মিশরকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন। ১৮০৫ সালে ক্ষমতা লাভ করে তিনি ফরাসী দখলদার কর্তৃক প্রবর্তিত সংস্কারের প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করেন। ফরাসী প্রকৌশলী ও বুদ্ধিজীবীরা মিশরে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদের দ্বার উন্মোচন করেন। মুহাম্মদ আলী এসব সম্পদের প্রয়োগ করে নব জাগরণ আনেন। এ কারণে বলা হয়েছে যে মুহাম্মদ আলী মিশরের নিকট যতটুকু ঋণী মিশরও আধুনিকীকরণে মুহাম্মদ আলীর নিকট ততটুকু ঋণী । মিশরের ইতিহাসে মুহাম্মদ আলী পাশার অবদান সম্পর্কে নানা রকম অভিমত রয়েছে ।
রিফাত বে বলেন, “মুহাম্মদ আলী সংস্কার এবং প্রগতির একটি সমুজ্জ্বল একনায়কত্বের ভূমিকা পালন করেন। এবং অটোমান সাম্রাজ্যের একটি সামান্য প্রদেশকে তার মধ্যযুগীয় অবস্থা-জাতীয়তাবাদী অধিকার পুষ্ট সভ্য রাষ্ট্রসমূহের সাথে সমতুল্য একটি প্রগতিশীল আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন।” ঐতিহাসিক লেনপুল সমালোচনা করে বলেন,” ভূমি সংস্কার নীতির দ্বারা তিনি ভূ-স্বামীদের যে শ্রেণী বিভাগ করেন এর ফলেই স্বত্বভোগী জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়, যা তাঁর পরিবার ও প্রিয়জনেরা ভোগ করত। ব্লক ম্যান উচ্চসিত প্রশংসা করে বলেন।”
তিনি আধুনিক ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।” ইয়ং এর মতে, “মুহাম্মদ আলীকে আধুনিক মিশরের আসল স্রষ্টা এবং প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা উচিত।” হেনরী ডডওয়েল মুহাম্মদ আলী পাশাকে “Universal Master, Universal Landlord, and Universal Merchant” বলে অভিহিত করেন । ঐতিহাসিক হিট্টি যথার্থই বলেন, “তিনি যে প্রকারের পদক্ষেপ, কর্মদক্ষতা এবং দূরদর্শিতা প্রদর্শন ও প্রয়োগ করেন তা তার মুসলমান সমসাময়িকদের মধ্যে তুলনাহীন ।”
সুতরাং মুহাম্মদ আলী পাশার উপরোক্ত গুণাবলী ও সংস্কার ব্যাপকভাবে মিশর তথা আরব জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়। আরব জাতীয়তা বিকাশে তাঁর অবদান অপরিসীম । মিশরে ইব্রাহিম পাশার অবদান (৩)
আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশে ইব্রাহীম পাশার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁকে আরব জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা বলা হয়। আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশে তাঁর অবদান নিম্নে আলোচনা করা হল ।
পিতার যোগ্য উত্তরসূরী : ইব্রাহীম পাশা ছিলেন তাঁর পিতা মুহাম্মদ আলীর সুযোগ্য উত্তরসূরী। সিরিয়া জয়ের পর মুহাম্মদ আলী-পাশা তাঁর পুত্র ইব্রাহীম পাশাকে সিরিয়ার গভর্ণর নিযুক্ত করেন। পিতার মত তিনিও ছিলেন আরব জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক। তবে পিতা অপেক্ষা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন হলেও তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তিনি নিজেকে একজন আরব বলতে গর্ববোধ করতেন এবং আরবি ভাষায় কথা বলতেন। মিশরের আলো বাতাসে বড় হওয়ায় আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর আন্তরিক সহানুভূতি ছিল । সিরিয়ায় তার শাসনামলের প্রথম দুই বছর তিনি সিরিয়াবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করার জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালান। পিতার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সিরিয়াবাসীকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, মুহাম্মদ আলী পাশার শাসনের ফলে সিরিয়ায় এক নবযুগের সূচনা হয়েছে।
সংস্কার : সিরিয়ার গভর্ণর হওয়ার পর তিনি সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি আরবদের প্রাচীন বীরত্ব গাঁথার বর্ণনা দিতেন। সিরিয়ার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার পর সিরিয়ার প্রশাসন যন্ত্রকে উন্নত ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । তিনি আইন, বিচার, কর ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেন। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তিনি আরবদেরকে নিযুক্ত করেন। আরবদের শাসনকার্য পরিচালনার যোগ্যতা সম্পর্কে তার পূর্ণ আস্থা ছিল। তাঁর শাসনামলে সিরিয়ায় এক নব যুগের সূচনা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অর্জন ও সফলতাগুলো উল্লেখ করে দেখানোর চেষ্টা করেন যে, যদি তুর্কি শাসন থেকে চূড়ান্তভাবে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হয় তাহলে আরবদের জন্য আরো উন্নত ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে ৷
আরব রেঁনেসা : ইব্রাহীম পাশার শাসনামলেই সিরিয়া ও লেবাননে বুদ্ধিবৃত্তিক পুনজাগরণ ঘটে, তার সময়েই প্রথম বৈরুতে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ফরাসী ও মার্কিন মিশনারীদের স্বাধীনভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমতি দেন। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় কিছু মিশনারি বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । আর এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের ফলে আরবদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় যা আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইব্রাহীম পাশা নিজেও সিরিয়ায় প্রচুর সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি দামেস্ক, আলেপ্পো এবং এ্যান্টিওতে বেশ কিছু কলেজ স্থাপন করেন। এসব কলেজে মুসলিম শিক্ষার্থীরা সরকারি খরচে পড়াশুনা করতো। তবে ইব্রাহীম এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজন মিটানোর হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। তাই অনেক মুসলিম অভিভাবকদের তা পছন্দ ছিল না। তারা তাদের সন্তানদের সামরিক প্রশিক্ষণ মুক্ত শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ইব্রাহীমের স্কুলের বিকল্প হিসেবে বেশ কিছু স্কুল স্থাপন করেন । এভাবে আরব রেঁনেসার সূত্রপাত হয় ।
মূল্যায়ন : ইব্রাহীম পাশার এতসব সংস্কার ও উন্নয়ন কাজের পরও সিরিয়ায় তার শাসন ক্ষমতা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে নি। মাত্র আট বছর পর তাকে সিরিয়া ত্যাগ করতে হয়। এর কারণ হিসেবে বলা যায় তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও এশিয়া মাইনর অভিযান ইউরোপীয় শক্তিসমূহ এবং তুর্কি সুলতানের মনে শঙ্কার সৃষ্টি করেছিল। ইব্রাহীম এবং তার পিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য সে সময় এমন একটি আবহ সৃষ্টি করেছিল যে, মনে হচ্ছিল অল্প কিছু কালের মধ্যেই তুর্কি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাবে এবং মিশর তুর্কি সাম্রাজ্যের স্থলাভিষিক্ত হবে। কিন্তু ইউরোপীয় শক্তিগুলো ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যের অখণ্ডতার পক্ষে, তাই ইউরোপীয় রাষ্ট্রনেতাদের চাপে মুহাম্মদ আলী সুলতানের সাথে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হন এবং বংশানুক্রমিক শাসন ক্ষমতার বদলে সুলতান অনুমোদিত সিরিয়ার আজীবন শাসন ক্ষমতা নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কেননা ইউরোপীয় শক্তি এবং সুলতানের বিরুদ্ধে একা লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। তবে তাৎক্ষণিকভাবে না পারলেও তিনি যথাসময়ে এর সমুচিত জবাব দেওয়ার সংকল্প করেন। এ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার সমৃদ্ধ করার এবং সেনা বাহিনীকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেন। পুত্র ইব্রাহীমকে তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ দেন। পিতার আদেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইব্রাহীম সিরিয়ায় নতুন নতুন কর আরোপ করেন এবং বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ দেন। তার এ দু'টি অপ্রিয় পদক্ষেপের ফলে সিরিয়াতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং সর্বত্র বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইব্রাহীমকে প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হয়। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে যে নির্যাতন ও নিপীড়ন তাকে চালাতে হয়েছিল তা তার জনপ্রিয়তাকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেয়। মাত্র আট বছর পূর্বে যে ইব্রাহীম মুক্তিদাতা হিসেবে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন। তিনি একজন ব্যাপক অজনপ্রিয় শাসক হিসেবে সিরিয়া ত্যাগ করেন। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সিরিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি যেসব সংস্কার কার্য সম্পাদন করেছিলেন সেগুলোর প্রভাবে পরবর্তী সময়ে সিরিয়ায় জাতিয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটেছিল ।
সর্বোপরি, মুহাম্মদ আলী পাশা ও তার পুত্র ইব্রাহীম পাশা আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু তারা আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সে স্বাধীন আরব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত হয় নি। এর পিছনে তাদের নিজেদের দুর্বলতা ছাড়াও দুটি প্রধান কারণ ছিল-প্রথমটি হচ্ছে ব্রিটেনের বিরোধিতা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আরবদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের অভাব ।
সিরিয়ায় পুনর্জাগরণ ইব্রাহীম পাশার উদারনৈতিক শাসন ব্যবস্থার ফলে সিরিয়ায় পুনর্জাগরণ শুরু হয়। এ সময় পাশ্চাত্যের মিশনারীদের জন্য সিরিয়ার দ্বার উন্মোচিত করে দেয়া হয়। ফ্রান্স ও আমেরিকা থেকে বহু খ্রিস্টান মিশনারীরা সিরিয়ায় আসতে শুরু করে। ইব্রাহীমের শাসনামলে অপেক্ষাকৃত উদার পরিবেশে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ধর্মান্ধতার এ যুগে সিরিয়ায় বহু স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় যা সিরিয়ায় পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৮১৬ সালে কন্সটান্টিনেপোলে এবং ১৮২২ সালে কায়রোতে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তিকা ছাপা হতে থাকে। ১৮৩৪ সালে আমেরিকান মিশনারীদের দ্বারা বৈরুতে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা সাহিত্য সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য আরবী ভাষায় পাঠ্য পুস্তক ছাপানোসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উন্নয়নে এ ছাপাখানার ভূমিকা অনস্বীকার্য ।

১৮৬০–১৮৭৫ সালের মধ্যে সিরিয়ায় বহু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন সিরিয়ান প্রটেস্টান্ট কলেজ, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্রটেস্টান্ট কলেজ, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্রটেস্টান্ট, ইউনির্ভার্সিটি অব সেন্ট যোসেফ ইত্যাদি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সিরিয়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ হতে আরব ছাত্র-ছাত্রীরা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসত। ফলে সিরিয়াতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয় ।
খ্রিস্টান মিশনারীরা স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর বিকাশের জন্যে বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখে। ১৮৪৭ সালে বৈরুতে ‘Society of Science and Arts, ১৮৫০ সালে “Oriental Society” প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৭ সালে জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় The "Syrian Scientific Society" নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠে। এর ফলে আরবরা ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল এবং ধর্মানিরপেক্ষ জ্ঞান চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে সিরিয়ায় বুদ্ধিভিত্তিক পুনর্জাগরণ ঘটে।
জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ
আরব জাতীয়তাদের বিকাশে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের অবদান অপরিসীম। এক্ষেত্রে তিনজন জ্ঞানী ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য। এই তিন বুদ্ধিজীবী হলেন-১. নাফিস ইয়াজিজী ২. বুতরাস আল বুস্তানি এবং ৩. ইব্রাহীম আল ইয়াজিজী ।
১। নাসিফ ইয়াজিজী
বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে নাফিস ইয়াজিজী (১৮০০-১৮৭১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই জ্ঞানী ব্যক্তি লেবাননের একটি ক্ষুদ্র গ্রামে এক খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । জ্ঞান আহরণের সীমাহীন আগ্রহ তাকে ছোটবেলা থেকেই তাড়া করে ফিরেছিলেন। মুদ্রিত পুস্তকের অভাব তার জ্ঞানার্জনের স্পৃহাকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। গির্জার লাইব্রেরীতে রক্ষিত পাণ্ডুলিপিই ছিল জ্ঞানার্জনের একমাত্র উপায় । কিন্তু সেখানে সাধারণের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাঁর অদম্য আগ্রহের জোরে তিনি গির্জার অভ্যন্তরস্থ লাইব্রেরীতে পাণ্ডুলিপি পাঠ, এমনকি প্রয়োজনে বাড়ীতে এনে পড়ারও অনুমতি পেলেন । তিনি এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন । তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী । যখনই কোন মূল্যবান পাণ্ডুলিপি পেতেন তখন তিনি তা মুখস্থ করে ফেলতেন অথবা তা হাতে লিখে নিজের সংগ্রহে রেখে দিতেন। তাঁর এ ব্যাপক পড়াশুনা তাকে হারিয়ে যাওয়া আরবি সাহিত্যের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে ।
সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি আরবি ভাষার সমৃদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। ভাষার এ আকর্ষণ ও সৌন্দর্য তার মনের সুপ্ত আরব সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে । তখন থেকেই তিনি আরবী ভাষার পুনর্জাগরণে মনোনিবেশ করেন। তিনি আরবি ভাষায় ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা, অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদি রচনা করেন ।
বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে তার এসব লেখা ছাত্র শিক্ষক উভয়ের নিকটই সাদরে গৃহীত হয়। শুধুমাত্র পুস্তক রচনার মধ্যেই তিনি তার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেন নি। কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর তার বাড়িতে আরবি ভাষা সম্পর্কে আলোচনার জন্য নিয়মিত বৈঠক বসত। নিজেদের মাতৃভাষা সম্পর্কে জানার আগ্রহে দলে দলে লোক এ বৈঠকে যোগ দিত । তিনি তার আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত বর্ণনার মধ্য দিয়ে আরবদেরকে তাদের মাতৃভাষার সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত করতেন। এভাবে তিনি আরবদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করেন ।
২। বুতরাস আল বুস্তানি
আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশে যেসব বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের মধ্যে বুতরাস আল বুস্তানির নাম অগ্রগণ্য। বুতরাস আল বুস্তানি (১৮১৯-১৮৩৩) দাবাইয়া (Dabya) নামক লেবাননের একটি গ্রামে ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৮৪০ সালে তিনি ম্যারোনাইট ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে প্রটেস্টান্ট ধর্মমত গ্রহণ করেন ।
ফলে ম্যারোনাইট গীর্জা তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। এবং তাকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। তাই তিনি প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বৈরুতে চলে আসেন। এখানে তিনি মার্কিন মিশনারীদের কার্যক্রম পরিচালনায় সহযোগিতা করতে থাকেন। বৈরুতে মার্কিন ও ফরাসী কনস্যুলেটেও তিনি কিছুদিন দোভাষীর কাজ করেন। ১৮৬০ সালে লেবানন ও দামেস্কে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তার ধর্মীয় মনোভাবে আমূল পরিবর্তন আনে । তিনি সিরিয়াবাসীর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ধর্মকে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখতে পান। তাই তিনি মিশনারী কার্যক্রম ত্যাগ করেন এবং ধর্ম ভিত্তিক বিভাজন দূর করে সিরিয়াবাসীর মধ্যে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও দেশ প্রেম জাগ্রত করার প্রয়াস পান ।

সংবাদপত্রের মাধ্যমেও তিনি তার আদর্শ সিরিয়া লেবাননের জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এ বছরই তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক পত্রিকা Nafir
Syriyya (Clarion of Syria)-তে লিখেছেন, “সিরিয়া আমাদের পিতৃভূমি। ধর্মীয় বিশ্বাস, সম্প্রদায় এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে সকল সিরিয়াবাসী-এ পিতৃভূমির সন্তানতুল্য। যারা এ পিতৃভূমিকে ভালবাসার বদলে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা ছড়ায় তাদের সিরিয়ায় বসবাসের কোন অধিকার নেই। এবং তারা এ পিতৃভূমির শত্রু।” তার মতে ধর্মীয় ঐক্য জাতীয় ঐক্যে রূপান্তরিত হওয়া উচিত। সিরিয়ার উন্নয়নের জন্য সিরিয়াবাসীকে সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের বদলে জাতীয় পরিচয় খুঁজতে হবে। এ লক্ষে ১৮৬৩ সালে তিনি কতিপয় ব্রিটিশ ও মার্কিন বন্ধুর সহায়তায় একটি জাতীয় বিদ্যালয় (আল মাদ্রাসা-আল ওয়াতানিয়া) প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তিনি দীর্ঘ ১২ বছর সিরিয়া লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে হতে আগত ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের যুবকদের ধর্মীয় সহনশীলতা ও জাতীয় বুস্তানি বাইবেল অনুবাদ করেন। দীর্ঘ ১০ বছর পরিশ্রম করে ১৮৭০ সালে তিনি দুই খণ্ডে মুহিত আল মুহিত (Circumference of the Ocean) নামে একটি আরবি অভিধান প্রকাশ করেন। তিনিই প্রথম আরবি বিশ্বকোষ সংকলন করেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় এর ছয়টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল । তবে বুস্তানি নিজেকে তুর্কি সুলতানের একজন প্রজা হিসেবেই ভাবতেন। সিরিয়া লেবাননকে তিনি তার পিতৃভূমি হিসেবে বিবেচনা করলেও একে ওসমানি সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান নি। তাই তাকে আরব জাতীয়তাবাদী না বলে সিরিয়া জাতীয়তাবাদী বলাই যুক্তিসঙ্গত। তবে তার এই সিরিয় জাতীয়তাবাদই আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল ।
ইব্রাহীম আল ইয়াজিজী
আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী হলেন ইব্রাহীম আল ইয়াজিজী। বুতরাস আল বুস্তাানির সমসাময়িক ইব্রাহীম আল ইয়াজিজীর (১৮৪৭–১৯০৬) মতাদর্শ ছিল আরো ব্যাপক । বৈরুতে জন্ম গ্রহণকারী এই জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন গ্রিক ক্যাথলিক মতের অনুসারী। তিনি নাগাহ, তাবিব, দিয়াহসহ বেশকিছু সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। জেসুইটদের (ক্যাথলিক মতবাদের অনুসারি খ্রিস্টানদের একটি দল) অনুরোধে তিনি ১৮৭৬–১৮৮০ সময়কালে আরবিতে বাইবেল অনুবাদ করেন। এটি আরবিতে অনুদিত দ্বিতীয় বাইবেল হলেও প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের অনুমোদিত প্রথম আরবি বাইবেল হতে ভাষাগতভাবে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ছিল। প্রোটেস্টান্টদের অনুদিত প্রথম আরবি বাইবেলটি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের প্রতিষ্ঠাতা খ্রিষ্টান মিশনারি কর্নেলিয়াস ভ্যান ডাইক (Cornelius Van Dyke)-এর নেতৃত্বে ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। আরবি ভাষায় ইব্রাহীম ইয়াজিজীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল আরবি বর্ণমালার সহজীকরণ। তিনি আরবি বর্ণের সংখ্যা ৩০০ থেকে কমিয়ে ৬০ টিতে নিয়ে আসেন। আরবি টাইপ রাইটার সৃষ্টিতে তার এ অবদান অনস্বীকার্য। তিনি আরবদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রহ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আরবদের অতীত গৌরব ও মহিমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তিনি তাদের হীনমন্যতা দূর করতে চেয়েছিলেন, তার মতে আরবদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ধার করেই ইউরোপিয়রা দ্রুত অগ্রগতি লাভ করেছে। অনারবদের (তুর্কি) অধীনে যাওয়ার পর থেকেই আরবদের অধঃপতনের সূচনা। তাই তুর্কিদের কবল থেকে মুক্তি লাভের মাধ্যমেই কেবল আরবদের পূর্ব ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। এভাবেই আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশে এই মহামনীষী অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন ।
আরব বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মতামতের প্রভাব : আরব বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মতামত আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। যখন বুস্তানি ও ইয়াজিজী তাদের মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন তখন কিছু রাজনীতিবিদ শুধুমাত্র তত্ত্বের উপর নির্ভর না করেই কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৮৭৭–১৯৭৮ সালে ওসমানি রুশ যুদ্ধের সময় ওসমানিয়া সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। ওসমানিয় সাম্রাজ্যভুক্ত বিভিন্ন জাতি যেমন-মন্টিনিগ্রানস্ ও সার্বরা বৃহত্তর স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী জানায়, আর্মেনিয়রা শাসনতান্ত্রিক সংস্কার দাবী করে। অস্ট্রো- হাঙ্গেরী সাম্রাজ্য বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। রাশিয়া উত্তর-পূর্ব আনাতোলিয়া দখলের চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় যে কোন মুহূর্তে বৈদেশিক আক্রমণের ভয় সিরিয়াবাসীকে তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে শঙ্কিত করে তোলে । তারা বৈদেশিক আগ্রাসন থেকে সিরিয়াকে রক্ষার উপায় খুঁজতে থাকে এবং এ সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকে। শীঘ্রই এ আলোচনা বৈরুতকে কেন্দ্র করে একটি আন্দোলনের রূপ নেয়। আহমদ আল সুলুহ নামক বৈরুতের এক মুসলিম ব্যক্তি এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার উপায় খুঁজতে থাকেন। এবং এ উদ্দেশ্যে সাইদন, জামাল আমিলও দামেস্কে গমন করে স্থানীয় অভিজাতদের কাছে সিরিয়ার ভবিষ্যত সম্পর্কে তার শঙ্কার কথা জানান। এরপর বৈরুতে ফিরে তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন শহরের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। সম্মেলনে বিভিন্ন শহর হতে আগত ৩০ জন নেতা ওসমানিয় সিরিয়ার (বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, এবং ফিলিস্তিন) স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। নতুন রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে তারা আলজেরিয়া থেকে বহিষ্কৃত নেতা আবদ আল কাদির আল জাজাইরিকে (Abad al-Qdir - al-Jaza) মনোনীত করেন। তার পারিবারিক ঐতিহ্য, আলজেরিয়ায় আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার অবদান এবং ফরাসিদের কবল থেকে আলজেরিয়াকে রক্ষার সংগ্রামে তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য নির্বাসিত হয়েও তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী। তবে নতুন রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি ওসমানিয় খেলাফতের সাথে সিরিয়ার আধ্যত্মিক যোগাযোগ রক্ষার শর্ত জুড়ে দেন। অর্থাৎ সিরিয়াবাসি ওসমানিয় খলিফাকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে স্বীকার করে নিবে ।
ওসমানিয়-রুশ যুদ্ধ শেষে যখন বার্লিন সম্মেলন চলছিল তখন সুলুহ-এর আহবানে বৈরুত সম্মেলনে যোগদানকারী নেতৃবৃন্দ গভীর আগ্রহ নিয়ে এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়েছিলেন, তারা স্থির করলেন যদি সম্মেলন চলাকালে এই বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, কোন একটি শক্তি সিরিয়া দখল করে নিবে তাহলে তারা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী জানাবেন, আর যদি এমন না হয় তাহলে তারা সিরিয়ার জন্য মিশর ও কিছু বলকান রাষ্ট্রের অনুরূপ স্বায়ত্ব শাসন দাবী করবেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আল জাজাইরী সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করবেন। ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের জন্য সেখানে প্রতিনিধি প্রেরণ করবেন বলে স্থির করেন। কিন্তু ইতোমধ্যেই বিষয়টি ওসমানিয় কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়। এবং তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে । আন্দোলনকারীদের অনেককে সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বাসিত করা হয়। আহমদ আল-সুলুহ এবং আল-জাজাইরির মধ্যে যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হয়। কর্তৃপক্ষের এ পদক্ষেপ এবং বার্লিন সম্মেলনে ইউরোপিয় দেশগুলো কর্তৃক তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে সিরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিকল্পনাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
ইব্রাহীম ইয়াজিজীর মতবাদ অনুযায়ী স্বাধীন আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেও কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল। সিরিয়ার তুর্কি শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ পরিলক্ষিত হয় আলেপ্পোতে। সিরিয়ার উত্তর উপকূলীয় বন্দর সমূহের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মক্কার শরীফ হুসেইনের অধীনে একটি আরব রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ১৮৫৮ সালে সেখানকার বৃটিশ কনস্যুল এবং ফরাসী কনস্যুল জেনেরেলের রিপোর্টে হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় ।
আরেকটু বৃহত্তর পরিসরে আরব রাজ্য গঠনের পরিকল্পনার প্রমাণ পাওয়া যায় বৈরুতে নিযুক্ত ফরাসী কনস্যুল জেনারেলের রিপোর্ট হতে। ১৮৭৯ সালের অক্টোবরে তিনি রিপোর্ট দেন যে, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত যখন সিরিয়া সফর করেছিলেন তখন তিনি মিদহাত পাশাকে আলেপ্পো, মসুল, বাগদাদ, মক্কা ও মদীনা নিয়ে বৃহত্তর আরব্য রাজ্য গঠনের ষড়যন্ত্রের সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। মিদহাত পাশা এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন যে, তিনিও একথা শুনেছেন। এছাড়া একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ফরাসি কনস্যুল জেনারেলকে অবহিত করেন যে, তার জানামতে আলেপ্পো, দামেস্ক, বাগদাদ, ইয়েমেন ও অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে আরব রাজ্যটি গঠনের পরিকল্পনা চলছে। যতদূর অনুমান করা যায় তাতে মনে হচ্ছে আবদ আল কাদির আল জাজাইরি হবেন এ রাজ্যের সুলতান ।
আরবদের তুর্কি সাম্রাজ্যের কবল থেকে মুক্তির পরিকল্পনা সম্পর্কে আরো কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৭৭–১৮৭৮ সালে ওসমানি রুশ যুদ্ধের সময়কালে রোমে নির্বাসিত উত্তর লেবাননের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান নেতা ইউসুফ কারাম ও আবদ্ধ আল কাদির আল জাজাইরির মধ্যকার পত্রালাপ হতে। পত্রে কারাম আবদ আল কাদির আল জাজাইরির নেতৃত্বে আরবদের মুক্তির কথা বলেন, প্রতিষ্ঠিতব্য আরব রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কেও তিনি ইঙ্গিত দেন। তিনি তুর্কিদের কাছ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত আরব রাষ্ট্রগুলো নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠনের কথা বলেন। কারামের এ পরিকল্পনা আবদ আল কাদির আল জাজাইরি সমর্থন করলেও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রকাশ্যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। কেননা তিনি ভুলে যান নি যে, আরবদের মাঝে তার যথেষ্ট প্রভাব থাকলেও তিনি একজন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্ত শরণার্থী মাত্র । এছাড়া যুদ্ধ শেষে বার্লিন সম্মেলনে ওসমানিয় সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় তাদের এ পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে। তবে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও এর প্রভাব আরবদের মন থেকে মুছে যায় নি। পরবর্তীকালে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশে এ চেতনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, নাফিস ইয়াজিজী, বুতরাস আল বুস্তানি ও ইব্রাহীম আল ইয়াজিজী-এ তিন জ্ঞানী ব্যক্তির অবদান আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তাদের বহুবিধ কর্মকাণ্ড ও লেখনী আরব জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে মন্ত্রের মত কাজ করে ।
গুপ্ত সমিতি
আরব জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে গুপ্ত সমিতির অবদান প্রশংসনীয় । সিরিয়ার সর্বত্র তুর্কি শাসন বিরোধী মনোভাব বিরাজ করছিল। তখন একটি ক্ষুদ্র খ্রিষ্টান দল সিরিয়ায় ওসমানিয় শাসনের দমন নীতির প্রতিবাদে গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। তুরস্কের স্বৈরশাসনে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মতামত প্রদান করা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই ১৮৭৫ সালে সিরিয়ান প্রটেস্টান্ট কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত ৫ জন যুবক ‘Secret Society of Beirut' নামে একটি গুপ্ত সংস্থা গঠন করে। এ সংস্থা গঠনের পিছনে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন সিরিয়ান প্রোটেস্টান্ট কলেজের ফরাসী ভাষার শিক্ষক ইলিয়াছ হাব্বালিন, ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারায় উদ্দীপ্ত হাব্বালিন তার ছাত্রদের স্বৈরাচারী তুর্কি সরকারের দুর্নীতি ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহবান জানান। ১৮৭১–১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সিরিয়ান প্রটেস্টান্ট কলেজে শিক্ষকতা করার পর ১৮৭৫ সালে তিনি সিরিয়া ত্যাগ করে মিশরে চলে যান। কিন্তু যে আদর্শের বীজ তিনি তার ছাত্রদের মনে বপন করে গিয়েছিলেন তা বিনষ্ঠ হয় নি। এ বছরই তার আদর্শে দীক্ষিত ছাত্ররা গঠন করেছিল 'Secret Society of Beirut'। এরা সকলেই ছিল খ্রিস্টান। তবে তারা উক্ত সংস্থার উদ্দেশ্য অর্জনে মুসলিম ও দ্রুজদের অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা বিভিন্ন ধর্মের ২২ জন সদস্যকে এ সংস্থার সদস্যভুক্ত করেছিল। সংস্থার মূল কেন্দ্র ছিল বৈরুত, পরবর্তীতে দামেস্ক, ত্রিপলি এবং সাইদনে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রথম দিকে এ গুপ্ত সমিতির সদস্যরা দক্ষিণ বৈরুতের পার্বত্যাঞ্চলে গোপনে মিলিত হয়ে তাদের বিপ্লবী চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা করত এবং তা বাস্তবায়নে উপায় নিয়ে ভাবত। তখন তাদের কার্যক্রম শুধু মাত্র গোপন সভায় আলাপ আলোচনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ব্যক্তিগত প্রচারণার মাধ্যমে নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কয়েক বছর পর তারা আরো বৃহত্তর পরিসরে প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা রাতের অন্ধকারে শহরের দেয়ালে দেয়ালে তাদের দাবী দাওয়া সম্বলিত পোস্টার লাগাতে থাকে। কর্তৃপক্ষ যাতে প্রকৃত লেখক সনাক্ত করতে না পারে সেজন্য পোস্টারের লেখকরা হাতের লেখা পরিবর্তন এবং ইচ্চাকৃতভাবে ব্যাকরণগত ভুল করত। সকাল বেলা লোকজন এগুলোর পাশে ভিড় জমাত। খবর পেয়ে পুলিশ এসে পোস্টারগুলো ছিড়ে ফেলত। এবং আশেপাশে জড়ো হওয়া নিরপরাধ লোকজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেত।
বৈরুতের উত্তেজনা প্রশমিত হতে না হতেই দামেস্ক, ত্রিপলী অথবা সাইদন একই ধরনের পোস্টার পাওয়া যাওয়ার খবর আসত। ভিড়ের মধ্যে গুপ্ত সমিতির সদস্যরাও মিশে যেত এবং পোস্টারগুলো পড়ে জনগণের মাঝে কী ধরণের প্রতিক্রিয়া হয় তা লক্ষ্য করত। জনগণের প্রতিক্রিয়ার প্রতি লক্ষ্য রেখে পরবর্তী পোস্টারগুলো রচিত হত। কিন্তু লিখিত উৎসের অভাবে এসব পোস্টারের বিষয়বস্তু এবং গুপ্ত সমিতির সদস্যদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে দীর্ঘদিন কিছু জানা যায় নি। ঐতিহাসিক জর্জ এন্টোনিয়াস এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানসহ কায়রো ও বাগদাদে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি গুপ্ত সমিতির দু'জন সদস্য সহ আরো অনেকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। কিন্তু তারা কেউই পোস্টারের বিষয়বস্তু এবং গুপ্ত সমিতির সদস্যদের প্রকৃত উদ্দেশ্য-সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারে নি। এর বছর খানেক পর এন্টোনিয়াস যখন গবেষণার প্রয়োজনে লণ্ডনের পাবলিক রেকর্ড অফিসে পুরনো দলিল দস্তাবেজ দেখছিলেন তখন বৈরুতের গুপ্ত সমিতির ৩টি পোস্টার তার চোখে পড়ল। বৈরুতের বৃটিশ কনস্যুল জেনারেল ও দামেস্কের বৃটিশ প্রতিনিধিগণ-ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সমসাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করতে গিয়ে এগুলো পাঠিয়েছিলেন। পোস্টার তিনটির একটি ছিল মূলকপি, তুর্কি পুলিশ আসার পূর্বেই এটি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, যা পরে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেন। আর বাকী দুটি ছিল মূল কপির অনুলিপি। আরবিতে লিখিত এসব পোস্টারের বিষয়বস্তু হতে সমিতির সদস্যদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায় ৷
.
১৮৮০ সালের ৩ জুলাই ব্রিটেনে প্রেরিত প্রথম পোস্টারটি ছিল সংক্ষিপ্ত। পোস্টারটি ব্রিটিশ কনসুলেট কর্তৃক প্রেরিত প্রথম পোস্টার হলেও গুপ্ত সমিতি কতক প্রচারিত প্রথম পোস্টার ছিল না। এর বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা হতে পূর্বে আরো পোস্টার প্রকাশিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে তুরস্কের স্বৈরশাসনে আরবদের নিস্পৃহতাকে ভর্ৎসনা করা হয়। এবং সকল প্রকার ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে তুর্কি শাসন বিরোধী আন্দোলনের জন্য আরবদের প্রতি আহবান জানানো হয় । একই দিনে প্রেরিত দ্বিতীয় পোস্টারটিতে আরো সুনির্দিষ্টভাবে তুর্কি শাসনের সমালোচনা করা হয় । এতে বিশ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮৬০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন না করার জন্য কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনা করা হয়। শুধু তাই নয় এতে সিরিয়ার স্বায়ত্ত শাসন এবং প্রয়োজনে স্বাধীনতার দাবীও জানানো হয়। ১৮৮০ সালের ৩১ ডিসে'র প্রেরিত তৃতীয় পোস্টারটি ছিল সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এ পোস্টারেই প্রথমবারের মত স্পষ্টভাবে গুপ্ত সমিতির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায়। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা প্রয়োজনে তরবারির আশ্রয় নেয়ার কথাও উল্লেখ করে ।
পোস্টারের উল্লেখিত মূল বিষয়বস্তুগুলো ছিল :
১. লেবাননসহ সিরিয়াকে স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।
২. আরবীকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে ।
৩. বাক স্বাধীনতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
৪. স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত সৈনিকদেরকে স্থানীয় সেনাবাহিনীতেই দায়িত্ব দিতে হবে । অর্থাৎ তাদেরকে বাইরে পাঠানো যাবে না ।
প্রথম দাবিটি ঐক্যবদ্ধ সিরিয়ার স্বাধীনতা চাওয়া হয়েছিল কেননা ১৮৬০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ইউরোপিয় মধ্যস্থতায় ১৮৬৪ সালে লেবাননকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছিল। এর ফলে লেবানন স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা ভোগ করলে তা রাজনৈতিকভাবে সিরিয়া থেকে পৃথক হয়ে পড়েছিল, যা ছিল আরব ঐক্য তথা আরব জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্খার পরিপন্থি। তাই গুপ্ত সমিতির সদস্যরা ধর্মীয় আনুগত্যের বদলে জাতীয়তার ভিত্তিতে বৃহত্তর সিরিয়ার স্বাধীনতা চেয়েছিল।

সমকালীন সিরিয়ার দ্বিতীয় দাবিটিরও প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছিল । ১৮৬৪ সালের পর থেকে ওসমানিয় সরকার কেন্দ্রীয়করণ নীতির উপর জোর দেয়। এরই ফল হিসেবে সাম্রাজ্যের সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা তুর্কির ব্যবহারের উপর সরকারি নির্দেশ জারি করা হয় ।
সিরিয়ায়ও তুর্কি ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। খ্রিস্টান মিশনারি ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা যখন আরবি ভাষার পুনর্জাগরণের জন্য তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এ পদক্ষেপটি গৃহীত হয়। সরকারি ভাষা হিসেবে তুর্কিকে চাপিয়ে দেয়ার ফলে তাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হয় ।
তাই গুপ্ত সমিতির সদস্যগণ তাদের পোস্টারে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায় । ওসমানিয় কর্তৃপক্ষ শুধু তুর্কিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি। সুলতান আব্দুল হামিদ তার স্বৈরশাসনকে সুদৃঢ় করতে মুক্তচিন্তা বিকাশের সকল পথ রুদ্ধ করার প্রয়াস চালান। তিনি পুস্তক আমদানি নিষিদ্ধ করেন। স্থানীয়দের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ফলে ইয়াজিজী ও বুস্তানির মত জ্ঞানী ব্যক্তিদের বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। ওসমানিয় সরকারের এ পদক্ষেপটি গুপ্ত সমিতির সদস্যদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। কেননা তাদের সকলেই ছিলেন ইয়াজিজী ও বুস্তানীর শিষ্য। আর অধিকাংশই ছিলেন এই দুই বিখ্যাত ব্যক্তির ছাত্র। ফলে গুপ্ত সমিতির পোস্টারে সরকারি সেন্সরশিল্প প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। শেষ দাবিটির একটি যৌক্তিক প্রেক্ষাপট ছিল । সিরিয়া থেকে নিযুক্ত আরব সেনাদের ইয়েমেনী আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানোর প্রতিবাদে এ দাবিটি উত্থাপিত হয়। ১৮৭২ সালে তুর্কিরা পুনরায় ইয়েমেন দখল করলেও স্থানীয় আরবদের বিরোধীতার কারণে তুর্কিদের পক্ষে ইয়েমেনের উপর নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ওসমানিয় কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল আরবদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সেনাবাহিনী যদি ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয় তাহলে তারা কম বিরোধীতার সম্মুখীন হবে। এ চিন্তা থেকেই সিরিয় আরবদের ইয়েমেনে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । কিন্তু আরব জাতীয়তাবাদীরা আরবদের বিরুদ্ধে আরব সেনাদের ব্যবহারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া ১৮৭৮ সালে রুশ-তুর্কি যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য-সিরিয় সেনাদের প্রেরণ করা হয় । অথচ যে কারণে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার সাথে সিরিয়ার ন্যূনতম কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এ সব কারণেই গুপ্ত সমিতির পোস্টারে ওসমানিয় সরকারের এসব পদক্ষেপের বিরোধিতা করা হয় ।
পোস্টারে উল্লেখিত দাবিসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে প্রথম দাবিটির সাথে অন্য দাবিগুলোর অসামঞ্জস্য রয়েছে। স্বাধীনতার মত চূড়ান্ত দাবিটির সাথে বাকি দাবিগুলো উত্থাপন করা একেবারেই অবান্তর। কেননা স্বাধীনতা অর্জিত হলে অবশিষ্ট দাবিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর কোন বাধা থাকে না। মূলকপি থেকে অনুলিপি তৈরী করতে গিয়ে এ ধরণের ভ্রান্তি ঘটে থাকতে পারে। এছাড়া সিরিয়ার মুসলমানরা তুর্কিশাসনের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের প্রতিবাদকে সমর্থন করলেও তখনও তুর্কিদেরকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতার কথা ভাবতে শুরু করে নি ।
তাই তৎকালীন পরিস্থিতি ও পরবর্তী দাবিগুলো বিবেচনা করে স্বাধীনতার পরিবর্তে স্বায়ত্তশাসনের দাবী করা হয়েছিল বলে ধরে নেয়া যায় ।
যা হোক, তুর্কি গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতা এবং বাড়ী বাড়ী তল্লাশি করে সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের ফলে গুপ্ত সমিতির সদস্যরা দেশ ত্যাগ করে মিশরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় ।
সর্বোপরি গুপ্ত সমিতির সদস্যরা চাপের মুখে দেশ ত্যাগ করলেও তাদের বহুবিধ কর্মকাণ্ড আরবদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। বিশেষ করে তাদের দাবি দাওয়াগুলো-জনগণকে সচেতন করে তোলে। যা আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল ।
সার্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায় যে, দীর্ঘ পাঁচশত বছরেরও বেশি সময় তুর্কি শাসনাধীন থাকার পর আরবদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয় । বিভিন্ন ব্যক্তি সংগঠনের কর্মকাণ্ড ও তৎপরতার ফলে তা বিকাশ লাভ করে । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত আরবরা তাদের জাতীয়তাবাদী আশা- আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নি। প্ৰথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মক্কার শরীফ হুসেইনের নেতৃত্বে আরবরা তুর্কি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং আরব জাতীয়তাবাদ আশা-আকাঙ্ক্ষা-বাস্তবায়নে অগ্রসর হয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]