আরব জাতীয়তা বিকাশে মুহাম্মদ আলী পাশার অবদান আলোচনা কর।

আরব জাতীয়তাবাদের মহানায়ক মুহাম্মদ আলী পাশা ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে এ জিয়ান সাগরের তীরবর্তী কাভাল্লা নামক একটি ছোট মেসিডোনীয় বন্দরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা-মাতা ছিলেন খুবই দরিদ্র এবং তিনি কাভাল্লায় বাল্যকাল অতিবাহিত করেন। পরবর্তীতে তিনি একজন ফরাসী তামাক ব্যবসায়ীর সাথে কাজ করেন। তিনি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে সামরিক স্কুলে যোগদান করেন। ফরাসি দখলদারিত্ব থেকে মিশরকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ওসমানিয় সুলতান নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। ১৮০১ সালে তুরস্ক ও ব্রিটেনের সম্মিলিত এ বাহিনীর নিকট ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয় । এ বাহিনীর একজন গর্বিত সৈনিক ছিলেন মুহাম্মদ আলী পাশা। ফরাসি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর মুহাম্মদ আলী ১৮০৫ খ্রিঃ মিশরে ওয়ালি (প্রদেশপাল) নিযুক্ত হন। ক্ষমতারোহণের পরপরই তিনি মিশরে তাঁর কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় ওহাবিরা মক্কা, মদীনা, কারবালাসহ ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো দখল করে নেয়, যা ছিল তুর্কি সুলতানের এখতিয়ারভুক্ত অঞ্চল। তুর্কি সুলতান এ বিদ্রোহ দমনের জন্য মুহাম্মদ আলী পাশার শরণাপন্ন হন। ১৮১১ সালে মুহাম্মদ আলী পাশা এবং তাঁর পুত্র ইব্রাহীম পাশা ইসলামের এ পবিত্র স্থানগুলো ওহাবিদের কাছ থেকে মুক্ত করে তুর্কি সুলতানের কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসেন । তখন থেকেই আরব জগতের সর্বত্র মুহাম্মদ আলীর সুনামও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া এ বিজয় মুহাম্মদ আলী পাশা ও তাঁর পুত্র ইব্রাহীম পাশাকে আরবদের কাছাকাছি আসার সুযোগ এনে দেয় । তাঁরা আরবদের আশা-আকাঙ্খা সম্পর্কে অবগত হন ।
১৮২১ সালে গ্রিসের খ্রিস্টানগণ রাশিয়ার প্ররোচণায় ও সহযোগিতায় ওসমানির সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য সুলতান আবারও মুহাম্মদ আলী পাশার মুখাপেক্ষী হন। বিনিময়ে মুহাম্মদ আলীকে সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ক্রীট দিয়ে পুরষ্কৃত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। মুহাম্মদ আলীর নির্দেশে তাঁর পুত্র ইব্রাহিম পাশা গ্রিসের বিদ্রোহ দমন করেন। এদিকে তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ তাঁর অধীনস্থ মুহাম্মদ আলী পাশার সর্বক্ষেত্রে সফলতায় কিছুটা ঈর্ষাবোধ করতে থাকেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি সিরিয়া এবং ফিলিস্থিনের শাসন ক্ষমতা মুহাম্মদ আলী পাশাকে অর্পণ না করে শুধুমাত্র ক্রীটের শাসনভার তাঁকে অর্পণ করতে রাজী হন। সুলতানের এরূপ হীনমন্য আচরণে মুহাম্মদ আলী ক্ষুব্ধ হন। তিনি শক্তি প্রয়োগ করে সুলতান কর্তৃক প্রতিশ্রুত অঞ্চল দখল করার সংকল্প করেন। সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনি দখলের জন্য ১৮৩১ সালের জুলাই মাস নাগাদ ইব্রাহিম পাশা তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত করে সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন দখল করে নেন। সুলতান আলোচনার জন্য মুহাম্মদ আলী পাশার নিকট দূত প্রেরণ করেন। পিতার নির্দেশে ইব্রাহিম পাশা সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ।
দীর্ঘ পাঁচ মাস আলোচনা চলার পর সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে তুর্কি সুলতান ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। এ বাহিনী ইব্রাহিমের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তুর্কি বাহিনীর এ পরাজয়ের ফলে কন্সটান্টিনোপল অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ইব্রাহিম কন্সটান্টিনোপল অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু আবারো পিতার নির্দেশে তাঁকে থেমে যেতে হয়। অবশেষে ১৮৩৩ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে তুর্কি সুলতান মুহম্মদ আলী পাশাকে সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে স্বীকার করে নেন। তাঁর পক্ষে তার পুত্র ইব্রাহিম পাশা-সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পূর্বে ওহাবিদের কাছ থেকে মুসলমানদের পবিত্র ভূমি দখল আর এখনকার সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখলের মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য ছিল । মুহাম্মদ আলী পাশা সুলতানের পক্ষ হয়ে ওহাবিদের নিকট হতে মক্কা, মদীনা ও কারবালা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। অর্থাৎ এটা ছিল সুলতানের পক্ষ হয়ে মুহাম্মদ আলী কর্তৃক তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্যান্য বিদ্রোহ দমনের মতই একটি ঘটনা। কিন্তু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তার নিকট থেকে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার মধ্যে একটা আলাদা তাৎপর্য ছিল। এর ফলে মুহাম্মদ আলী পাশা নিজেকে তুর্কি সুলতানের সমকক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতে থাকেন। আরবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দুটি তার দখলে চলে আসার পর তিনি অবশিষ্ট আরব ভূমি দখলে এনে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তাঁর এ চাওয়ার মধ্যে কোন লুকোচুরি ছিল না। তিনি জানতেন তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি ফ্রান্সের সহযোগিতা পাবেন। কারণ সিরিয়া, মিশর ও আরব উপদ্বীপ নিয়ে গঠিত আরব রাজ্যটি ফ্রান্সের প্রভাবাধীনে থাকলে ভারতের সাথে ব্রিটেনের স্থলপথে যোগাযোগ বাধাপ্রাপ্ত হবে। ফলে ব্রিটেনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ফ্রান্স তার নিজ স্বার্থেই মুহাম্মদ আলীকে সহযোগিতা করবে। অস্ট্রিয়ার সরকারও মুহাম্মদ আলীকে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্য ও আশ্বাসের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও মুহাম্মদ আলী পাশার অনুকূলে ছিল। ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। কেননা পবিত্র ভূমিদ্বয়ের রক্ষক মক্কার শরীফ ছিলেন তাঁর অনুগত। ওসমানিয় সুলতান তার মুসলিম ও খ্রিষ্টান প্রজাদের কাছে ছিলেন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এছাড়া নতুন সাজে সজ্জিত মিশরিয় বাহিনী ছিল তুর্কি বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি সুসংগঠিত। সুতরাং, স্বাধীন আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ আলী পাশা একটি অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিলেন, স্বাধীন আরব সাম্রাজ্য গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি পাশ্চাত্য কায়দায় মিশরের আধুনিকায়নে মনোনিবেশ করেন। নিম্নে মিশরের আধুনিকায়নে মুহাম্মদ আলী পাশার বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সংস্কার আরব জাতীয়তাবাদ বিকাশে যে ভূমিকা রেখেছিল তা আলোচনা করা হলো ।
ভূমি সংস্কারের নীতিমালা : মোহাম্মদ আলী একজন শ্রেষ্ঠ সংস্কারক ছিলেন। তিনি ইসলামী বিশ্বের প্রথম শাসক যিনি ক্ষমতা লাভ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন জনহিতকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তিনিই সর্বপ্রথম মধ্যযুগীয় অর্থনীতিকে আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের উপযোগী করে বিভিন্ন সংস্কারমূলক নীতি গ্রহণ করেন। মিশরিয় অর্থনীতির রূপান্তরে তাঁর প্রখ্যাত ও জনমঙ্গলকর ভূমি সংস্কার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার মূল চাবিকাঠি ছিল প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দ্বারা কৃষি উৎপাদন ও রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি। ক্ষমতালাভের অর্থাৎ ১৮০৫ সালের পূর্বে মিশরের সমস্ত জমি ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ
শতাব্দীতে সরকার নিয়ন্ত্রিত জমি জায়গীর দেয়া মুহাম্মদ আলী পাশা হত যা ‘Tax farming নামে পরিচিত। মিশরিয় ভাষায় ‘ইলতিযাম' নামে পরিচিত এ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী জায়গীরদার বা ‘মোলতাসিম’গণ অনির্দিষ্টকালের জন্য জমি ভোগ দখল করতে পারত এবং সরকারকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্ষিক কর দিত। এসব ‘মুলতাসিম'গণ নির্যাতন করে কৃষকদের নিকট হতে ইচ্ছামত কর আদায় করতে পারত। এভাবে কৃষকরা নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়। পূর্বে জায়গীর সাময়িকভাবে দেওয়া হলেও ১৮০০ সালের পর আজীবন জায়গীর দেয়া শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, এ জায়গীর ভোগ করতেন গ্রামের জোতদার শ্রেণী, প্রভাবশালী কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনীর সদস্যবর্গ এবং তারা শোষণ নীতির বশবর্তী হয়ে কৃষকদেরকে নিঃস্ব করে ফেলে। মুহাম্মদ আলী পাশার ভূমি সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তুর্কি ও মামলুকদের প্রদত্ত সব জমি রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় ।
রাষ্ট্রয়করণ নীতি :,/b> মুহাম্মদ আলী অর্থনৈতিক সংকট দূরীকরণে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করার চিন্তা-ভাবনা করেন। এবং এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য জোতদারী, জায়গীরদারী ও স্বত্বভোগী শ্রেণীদের কাছে বরাদ্দকৃত ভূমি রাষ্ট্রীয়করণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮১৩ সালে তিনি মিশরের সমগ্রভূমি জরিপের নির্দেশ দেন। ভূমি সংস্কার নীতি বাস্তবায়নে তিনি মূলত: দুটি সমস্যা চিহ্নিত করেন।
(১) জোতদারী (Tax-farming) রাষ্ট্রকে ভূমি থেকে প্রাপ্য প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে।
(২) জোতদারী কৃষকদের উপর নির্যাতন চালিয়ে বিত্তশালী হওয়ার সুযোগ দেয়। এবং জোদতারগণ ক্রমশঃ মিশরের উপর পাশার একচ্ছত্র ক্ষমতার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মুহাম্মদ আলী উলামা শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার জন্য শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং মনে করেন যে এর প্রধান কারণ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘ওয়াকফ’ এবং ‘রিযাক আব্বাসীয়া’ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব, যা থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণে পাশা পূর্বে বরাদ্দকৃত জমি বাজেয়াপ্ত এবং ধর্মীয় সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ (ওয়াকফ) সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনেন ।
রাজস্ব ব্যবস্থা : মুহাম্মদ আলী রাষ্ট্রীয় স্বার্থে মামলুকদেরকে কায়রোর দূর্গে নৃশংভাবে হত্যা করে তাদের ক্ষমতা চিরতরে বিলুপ্তই করেন নি, বরং তাদের জমি জমা বাজেয়াপ্ত করেন। ‘ইলতিযাম' বা জোতদারী উচ্ছেদ করা হয় এবং ‘মোলতাসিম’দের দখলে সমস্ত জমি রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় । তিনি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রতিষ্ঠানসমূহে বরাদ্দকৃত জমি বা ওয়াকফ সম্পত্তির উপর কর নির্ধারণ করেন। অবশ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন বাগান এ করের আওতামুক্ত ছিল, ১৮০৯ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত মুহাম্মদ আলী তার নীতিতে অটল ছিলেন, ওয়াকফ সম্পত্তির উপর রাজস্ব ধার্য করা হলে উলেমা সম্প্রদায়, এমনকি আলআযহারের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের প্রভাব ও প্রতিপত্তি হ্রাস করা হয়। ভূমি সংস্কারের নীতি বাস্তবায়নের জন্য তিনি ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ সালের মধ্যে দেশব্যাপী জমি সংক্রান্ত জরিপ (Cadastral Survey) পরিচালনা করা হয় । নতুন নীতি প্রবর্তনে রাষ্ট্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ও নিয়ন্ত্রিত সব জমি এক একটি গ্রামীণ সম্প্রদায়কে বরাদ্দ দেয়া হয় এবং এ সম্প্রদায় সরকারকে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব দিতে বাধ্য করা হয়। এ নিয়ম অনুযায়ী ‘ফেলাহীন’ বা ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক না হলেও সে বংশ পরম্পরায় একই জমি চাষ করতে পারত। রাষ্ট্রীয় করণের ফলে নির্যাতিত ও শোষিত কৃষক শ্রেণীর সাথে রাষ্ট্রের মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং এর ফলে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ববৃদ্ধি পায় অন্যদিকে কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়। ১৮০৫ থেকে ১৮১৬ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছর তিনি ভূমি সংক্রান্ত সংস্কারের (Agrarian reform) দ্বারা সমগ্র মিশরের জমি রাষ্ট্রয়িকরণে সমর্থ হন ৷
ভূমিবন্টন : মুহাম্মদ আলীর ভূমি সংস্কার সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল । তার শাসনামলে সমগ্র মিশরকে একটি বিরাটকার কৃষি উপযোগী ভূমি-সম্পত্তি বলে মনে করা হত। (Thus Egypt became nearly one great farm held at nominal rental of the state)। তিনি 'ইলতিযাম' পদ্ধতি বিলুপ্ত করে গ্রামের প্রধান এবং কৃষকদের মধ্যে সরাসরি জমি বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। তিনি জমির স্বত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যাস্ত করেন যাতে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভূ-স্বামী শ্রেণীর (Private own- ership) উদ্ভব না হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি তার নীতি পরিবর্তিত করে ১৮২৯ ১৮৩০ সালে রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের পতিত ও অকর্ষিত জমি বণ্টন করেন। এ ব্যবস্থার একটি শর্ত ছিল যে, জমির মালিককে ভূমি কর্ষণ দ্বারা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এবং সরকারকে পর্যাপ্ত রাজস্ব প্রদান করতে হবে । এ ব্যবস্থা ‘ইবাদিয়া’ (Ibadiyya) নামে পরিচিত। এ ব্যবস্থায় প্রথম দিকে জমির মালিক ভূমি স্বত্ব লাভ করত না। কেবল জমি চাষের অধিকার ছিল । কিন্তু ১৮৩৬ সালে সন্তান জমির প্রকৃত মালিক হয়ে পড়ে। ১৮৪৬ সালে এসব জমির মালিক জমি বন্ধক, বিক্রি বা হস্তান্তর করার অধিকার লাভ করে। মুহাম্মদ আলীর ভূমি সংস্কারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভূমি বণ্টন ব্যবস্থা এবং তিনি তিন প্রকার পন্থার উদ্ভাবন করেন। ১.ইবাদিয়া, ২. সিফতলিক (Ciftlik) এবং ৩. উহদা (Uhda)। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে মুহাম্মদ আলী ব্যক্তিগত মালিকানা বিরোধী হলেও প্রাচীন অটোমান রীতি অনুযায়ী তিনি তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জমি বণ্টন করেন। এ পদ্ধতি ‘সিফতলিক নামে পরিচিত। এ পদ্ধতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সমগ্র মিশরের চাষ উপযোগী জমির এক ষষ্ঠাংশ তার পরিবারের দখলে চলে যায়। তৃতীয় পদ্ধতিতে সমগ্র গ্রাম বা অঞ্চল উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী, গভর্ণর, সামরিক অফিসার, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে দেয়া হয়। যার ফলে সরকার নিয়মিতভাবে রাজস্ব আদায় করতে পারতেন। ‘উহদা' নামে পরিচিত এ ব্যবস্থার সাথে প্রাচীন জায়গীর প্রথা ‘ইলতিযাম' এর পার্থক্য হচ্ছে যে, পাশা এ সমস্ত জমিতে রাজস্ব নির্ধারণ করতেন। এবং জমির মালিক অধিক হারে কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করতে পারতেন না। যা হোক একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মুহাম্মদ আলীর শাসনামলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটে। জমির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য, সেচের ব্যবস্থা ছিল, উৎপাদিত শস্যের মধ্যে, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ধান, আখ, গম, তুলা ও নীল । নীলনদের মোহনা থেকে খাল কেটে কৃষি জমিতে সেচের সুব্যবস্থা করা হয় ।
সামরিক সংগঠন : মুহাম্মদ আলী তার শাসনকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিণপ্রাপ্ত সমারিক বাহিনী গঠন করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, তুর্কি ও মামলুক বাহিনী দ্বারা রাষ্ট্র সংগঠন এবং নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব হবে না। এ কারণে তিনি তুরস্কের সুলতান তৃতীয় সেলিম এবং দ্বিতীয় মাহমুদের মত মোহাম্মদ আলী তার শাসনকালের স্থায়িত্বের জন্য এবং নতুন যুগের সূচনায় একটি ইউরোপীয় পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়াস পান । এছাড়া অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দূরীকরণ এবং বিদেশে যুদ্ধাভিযানের জন্য তার একটি বিশাল সেনাদলের প্রয়োজন ছিল। তিনি ইংরেজ নৌবিহারের তৎপরতা এবং স্থল বাহিনীর দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মিশরিয় বাহিনী গঠনে মনস্থ করেন। এ সামরিক সংগঠনের অন্তরায় ছিল মামলুকগণ এবং এ কারণে মহিলা ও শিশু ছাড়া প্রায় সব মামলুককে নিধন করা হয়। ১৮২০ সালে পাশার সেনাবাহিনীতে ছিল অনিয়মিত ও উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদল । তিনি এ বাহিনীকে প্ৰশিক্ষণ দ্বারা সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে ব্যর্থ হলে তিনি এ বাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে একটি নতুন ও ক্ষীপ্রগতি সম্পন্ন নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন । তিনি ইউরোপীয় প্রশিক্ষক নিয়োগ করেন এবং আধুনিক ইউরোপীয় সমরাস্ত্রে একটি আধুনিক মিশরিয় বাহিনী গঠন করেন। ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের পতন হলেও মিশরে বসবাসকারী ফরাসী প্রকৌশলী ও সামরিক কর্মকর্তা বসবাস করতে থাকেন। মুহাম্মদ আলীর সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফরাসী কর্ণেল সেভেস (Seves)। এ ফরাসী সেনাধ্যক্ষ মিশরিয় বাহিনীর আধুনিকীকরণে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান পাশা আল-ফারানেসাভী (ফরাসীবাসী) নাম ধারণ করেন। তার নিরলস প্রচেষ্টা ও দক্ষতায় মিশরিয় বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত হয় এবং এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় এক লক্ষে ।
সামরিক প্রশিক্ষণ : কর্ণেল সেভেসের বলিষ্ট নেতৃত্বে মিশরিয় বাহিনীর প্রথম ব্যাচে আসওয়ানে প্রতিষ্ঠিত সামরিক স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। মুহাম্মদ আলী পাশার দূরদর্শিতায় মিশরে যে আধুনিক সেনাবাহিনী গঠিত হয় তাতে তুর্কি ও আলবেনীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। কারণ তারা দুর্ধর্ষ ও উশৃঙ্খল ছিল। তিনি সেনাবাহিনীতে কৃষক শ্রেণীর অন্তভুক্তির বিরোধিতা করেন। কারণ এর ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। নতুন ক্যাডেট সংগ্রহের জন্য (Conscription) বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে ভর্তি করা হত। মুহাম্মদ আলী নতুন সৈন্য সংগ্রহের জন্য সুদানে অভিযান করেন। কিন্তু বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করায় তাদের সংখ্যা কমে যায়। অতঃপর তিনি মিশরিয়দের নিয়েই মিশরিয় বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮২৩ সালের মধ্যে এরূপ আটটি ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়। এর ফলে মিশরিয় বাহিনী একটি অপারাজেয় সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। এর ফলে এশিয়া ও ইউরোপের রণাঙ্গনে তারা সুখ্যাতি অর্জন করেন। ফরাসী পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ লাভ করে মিশরিয় বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়। কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে সৈন্যদের থাকতে হত। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ডেমিট্রায় পদাতিক বাহিনীর স্কুল, গির্জায় অশ্বারোহী বাহিনীর স্কুল, তুরায় গোলন্দাজ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, খানকায় স্টাফ কলেজ এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় নৌবাহিনীর কলেজ স্থাপিত হয়। রিফাত বে বলেন, “১৮৩৯ সালের মধ্যে মুহাম্মদ আলীর সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২,০০,০০০ এ দাঁড়ায়, এর মধ্যে ১,৩০,০০০ সৈন্য ছিল নিয়মিত। আধুনিক সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিশরিয় বাহিনীর সমর বিজয় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, মুহাম্মদ আলীর সুদান অভিযানের সাফল্যের পর তার পুত্র ওমর তুসুনের নেতৃত্বে মিশরিয় বাহিনীকে আরব দেশের ওয়াহাবীদের দুর্দান্ত প্রতাপ ধ্বংসের জন্য একটি সেনাবাহিনী পাঠান। ইবনে সাউদ তুসুনের বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে মুহাম্মদ আলী স্বয়ং হেজাজ গমন করেন। তুসুনের মৃত্যুর পর মিশরিয় বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হন তদীয় ভ্রাতা ইব্রাহিম। ইব্রাহিম ওয়াহাবীদের রাজধানী দরিয়া দখল করেন। ১৮১১-১৮২৩ সালের মধ্যে মুহাম্মদ আলী আরবদেশে সমরাভিযান করেন। ১৮১৮ সালে আবদুল্লাহ ইবনে সাউদকে প্রথমে বন্দী করেন এবং তিনি পরে ইস্তাম্বুলে মারা যান। ক্রমশ হেজাজে অবস্থিত পবিত্র নগরী মক্কা, মদিনা, ও হারমাইন মিশরিয় পাশার অধীনে আসে। মুহাম্মদ আলী স্বীয় পুত্র ইব্রাহিমকে আরব দেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১৯২০ সালে সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট লাভের জন্য এবং খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য সুদানে মিশরিয় বাহিনী অভিযান করেন। সুদানের রাজধানী খাতুম শহরের ভিত্তি স্থাপিত হয় । তিনি এক বিরাট নৌবহরের সহায়তায় সিরিয়ায় অভিযান করেন ।
নৌবহর : মুহাম্মদ আলী পাশা বিশাল সেনাবাহিনী গঠনের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। কারণ তিনি বুঝতে পারেন যে নৌবাহিনী ছাড়া শক্তিশালী ইংরেজ, তুর্কি ও গ্রীকদের নৌবাহিনীর সাথে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তিনি নৌবাহিনী পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করার জন্য তুলোবাসী ফরাসী নৌধ্যক্ষ লেফেবর দ্যা কেরিসীকে (Lefebure de Cerisy) দায়িত্ব দেন। কেরিসীর নেতৃত্বে ভূ-মধ্যসাগরে মিশরিয় নৌবহর গঠিত হয়। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় ১৮২৯ – ৩০ সালে একটি নৌবিদ্যার কলেজ এবং গোলাবারুদের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এ নৌ-বন্দরে নৌ-সেনার শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ১৮৩৭ সালের মধ্যে মুহাম্মদ আলী নেতৃত্বে ১১টি নৌ-তরী, ৬টি ফ্রিগেড এবং অসংখ্য রণতরী নির্মিত হয়। সামরিক কারখানায় বিদেশীদের নিয়োগ করা হয়। বিশেষ করে ফরাসী-ইতালীয় ও গ্রীকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ড. ব্রাউন বলেন, “পোষাক ছাড়া মিশরিয় নৌ-বাহিনীকে সুশৃঙ্খল ইউরোপীয় নৌবাহিনীর সাথে পার্থক্য করা যায় না। বলা বাহুল্য, সেনাবাহিনী সংগঠন জাহাজ নির্মাণ, অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের কারখানা মুহাম্মদ আলীকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় যুদ্ধাভিযানে সহায়তা করে। তার পুত্র ইব্রাহিম ভূ-মধ্যসাগরীয় দ্বীপ ক্রীট এবং মোরিয় দখল করেন। অবশ্য ১৮২৭ সালে নাভারিনোর যুদ্ধে ইন্দো-ফরাসী যৌথ নৌ-অভিযানের ফলে তিনি পরাজয় বরণ করেন।”
প্রশাসনিক সংস্কার : প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্বিন্যাসে মুহাম্মদ আলীর বিশেষ অবদান ছিল। প্রাচীন অন্তঃসারশূন্য অটোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে মধ্যযুগীয় প্রশাসন উচ্ছেদ করা হয় । ভাতিকিউটিস বলেন, “মুহাম্মদ আলীর সরকার এবং প্রশাসনের মূলনীতি ছিল কঠোর ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন। অটোমান সুলতান কর্তৃক প্রদত্ত সমস্থ ক্ষমতা মুহাম্মদ আলী কুক্ষিগত করেন। তিনি পূর্ববর্তী প্রাদেশিক গভর্ণর বা শেখ আল বালাদের' সুলতানের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। স্বীয় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি দ্বারা মিশরে একটি ‘পাসালিক' প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি সুলতানের সহায়তায় আরব দেশে সৈন্য প্রেরণ করেন সত্য, কিন্তু শাসন কার্য স্বাধীনভাবে পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর পুত্র ইব্রাহিমের নেতৃত্বে অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত সিরিয়ায় সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ১৮৩৩ সালে তিনি তুরস্কের সুলতানের নিকট থেকে ‘উনকাইর স্কেলেসীর' সন্ধি অনুযায়ী একরে নেবলুস, দামেস্ক, আলেপ্পো ও আদানার পাশা নিযুক্ত হন। এমনকি তিনি কনস্টানটিনোপল দখলের হুমকী দেন, যাহোক তিনি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ছিলেন না। কেননা তিনি অটোমান সুলতানকে বার্ষিক নজরানা দিতেন। তিনি ১৮৪১ সালে তুর্কি সুলতানের নিকট থেকে একটি ফরমানের মাধ্যমে মিশরের ভাইসরয়ের মর্যাদা লাভ করেন, তিনি মিশরে মূলত: একটি স্বাধীন পাসালিক স্থাপন করেন, যা ছিল বংশানুক্রমিক ।
প্রশাসনকি বিন্যাস : একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মুহাম্মদ আলী একজন প্রতিভাবান ও দক্ষ শাসক ছিলেন, তিনি প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন এবং কঠোর হস্তে ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন। তিনি প্রশাসনিক কাঠামোর বিন্যাসে সর্বাধিক দায়িত্ব অর্পণ করেন তার চার পুত্র-তুসুন, ইব্রাহিম, ইসমাইল এবং সাঈদের উপর। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সর্বময় ক্ষমতা তাদের ছিল। শুধু তাই নয়, মিশরের প্রশাসন তার বংশের সদস্যদের উপর অর্পিত হয়। ইব্রাহিম পাশা সুদানে অভিযান করেন এবং ভূ-মধ্যসাগরীয় দ্বীপ ক্রীট ও মোরীয় দখল করেন। ইব্রাহিম ওয়াহাবীদের বিরুদ্ধে অভিযান করে তাদের রাজধানী দখল করেন। আরব দেশের পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনা মুহাম্মদ আলীর দখলে আসে এবং ইব্রাহিম আরব দেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তার পুত্র ইসমাইল পাশা পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। সাঈদ পাশা নৌবহরের অধিনায়ক ছিলেন। পৌত্র আব্বাস কায়রোর গভর্ণর নিযুক্ত হন। মুহাম্মদ আলীর ভ্রাতুষ্পুত্র ও পৌত্রদের বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক পদে নিযুক্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় শাসনকে সুদৃঢ় করার জন্য তিনি সমগ্র দেশকে কয়েকটি প্রদেশ, বিভাগ ও মহকুমায় বিভক্ত করেন। সমগ্র দেশকে ৭টি প্রদেশে এবং প্রত্যেক প্রদেশকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করা হয় । মামলুক আমলে ২৪ টি প্রদেশ ছিল । কিন্তু প্রশাসনিক সুবিধার্থে সেগুলো ভেঙ্গে ৭টি প্রদেশে পরিণত করা হয়। মিশরে মোট ৬১ টি জেলা ছিল। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে গভর্ণর থেকে সাধারণ সরকারি কর্মচারী কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত করতেন। মুহাম্মদ আলী স্বীয় হস্তে কঠোরভাবে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য ফরমান জারী করতেন । প্রাদেশিক শাসনকর্তা ‘মুদির' নামে পরিচিত ছিল ।
মন্ত্রণালয় : কেন্দ্রীয় প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হয়। মুহাম্মদ আলী প্রাথমিক স্তরে ৬টি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেন। যথা—স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, অর্থ, সমর, বাণিজ্য ও নৌবাহিনী। ১৮৩৩ সালে আধুনিক মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আর্মেনীয় বগুস বে (Boghos Bey)। ১৮৩৭ সালে অপর ৫টি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান ছিলেন খ্রিষ্টান হাবিব এফেন্দী। মুহাম্মদ আলী সামরিক বাহিনী সুগঠিত করার জন্য ‘নিযামতে-ই-হারবিয়া' বা সামরিক দফতর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘দিওয়ান আল জিহাদিয়া' বা যুদ্ধ সংক্রান্ত কাউন্সিল গঠন করেন। ফরাসী সামরিক সংগঠনের অনুকরণে মিশরের সমর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনী গঠন, গোলাবারুদের কারখানা স্থাপন, সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ (Logistic) ইত্যাদি। তাঁর প্রশাসনিক সংস্কারের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি ফরাসী শাসন কর্তাদের প্রবর্তিত আইন এবং পরামর্শ পরিষদ (Legislative and Consultative) বাতিল করেন, যেমন— কায়রো কাউন্সিল বা দিউয়ান এবং প্রাদেশিক ও সাধারণ কাউন্সিলসমূহ । এক্ষেত্রে তিনি উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী ও মন্ত্রীদের নিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত কাউন্সিল গঠন করেন। এ কাউন্সিলের মাধ্যমে তিনি তার ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে সক্ষম হন। ফরাসী প্রশাসনের অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ফরাসী শাসনামলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নেপোলিয়ন উলেমা ও মোল্লাশ্রেণীকে পরামর্শ ও অংশ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু আধুনিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুহাম্মদ আলী ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ধর্মীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ করতে দিতেন না। তারা শরিয়ত বিষয়ে পরামর্শ ও বিচার করতে পারতেন।
ধর্মীয় সাহিষ্ণুতা : মুহাম্মদ আলীর শাসনকাল ছিল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রতি, সদ্ভাব ও সখ্যতার ইতিহাস। বলা বাহুল্য যে, মিশরকে আধুনিকীকরণে বিদেশী প্রকৌশলী,কারিগর, ডাক্তার, সামরিক ও বেসামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হয়। নেপোলিয়নের মিশর বিজয় থেকে প্রশাসনে ফরাসী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মূলত: মিশরের সেনাবাহিনী গঠনে বিশেষ অবদান ছিল ফরাসী কর্ণেল সেভেসের (Seves) । তিনি অবশ্য পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ফরাসী ধরণের লাইসী স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং ফরাসী শিক্ষক ও নিয়োগ করা হয়। ফরাসী ডাক্তার ক্লট বে-র তত্ত্বাবধানে প্রথম মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত করা হয়। লেফেবর দ্যা কেরিসী আলেকজান্তিয়ায় নৌবিহার ও নৌ-বিদ্যার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । ইটালীয় ক্যাময়াগী (Camiagi) কাগজের মিল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সাম্প্রদায়িক সমঝোতা কায়েমের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অনুসৃত হয়। তিনি খ্রিষ্টান, আর্মেনীয়, গ্রীক ও ফরাসী, ইটালীয় কপটিক কর্মচারী নিয়োগ করেন। ভ্যাটিকিওটিসের ভাষায়, “A factor of the pashas insistence upon public order and security was his policy of religious tolerance."
শিক্ষা সংস্কার : মুহাম্মদ আলী পাশা-আধুনিক সভ্যতার আলোকে মিশরকে গড়ে তোলার প্রয়াস পান ! তিনি শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি তিনি ইউরোপীয় রীতিতে আধুনিক শিক্ষাক্রম চালু করেন । আল আজহার সহ ধর্মীয় মাদ্রাসা, মক্তব ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষা কুরআন, হাদিস ও ফেকাহ চালু ছিল। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ফরাসী পদ্ধতিতে আধুনিক শিক্ষাক্রম চালু করেন। যেমন— প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এ ধরনের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন মিশরের জন্য একটি অভিনব ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ (A revolutionary innova- tion) বলা হয়েছে। তিনি মিশরিয় শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন ।
প্রশিক্ষণ ও জাতীয় জাগরণ : মুহাম্মদ আলীকে আধুনিক মিশরের জনক বলা হয়। এর মূল কারণ হল-তিনি জাতিগঠনমূলক অসংখ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেন। তার পরিকল্পিত ‘নতুন সমাজ ব্যবস্থার' (New Order) মূলে ছিল শিক্ষা । আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি আধুনিক ছাপাখানা স্থাপন করেন । প্রথম দিকে তিনি তুর্কি ভাষায় প্রশাসন পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে আরবী ভাষা তুর্কি ভাষার স্থান দখল করে। ফলে স্থানীয় মিশরিয় আরবগণ উচ্চপদে সমাসীন হয়। এ সময় পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে মিশরিয়গণ আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসে ।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন : তিনি যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধনা করেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। বিভিন্ন স্থানে বহু শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়। শিল্প বিপ্লব শুরু হলে বিদেশী বণিক, বিনিয়োগকারী ও শিল্পপতি মিশরে আগমণ করেন। মিশরিয় অর্থনীতির নতুন দিগন্তের সূচনা হয় ।
মূল্যায়ন : মুহাম্মদ আলী পাশাকে নিঃসন্দেহে আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় । বলা হয়ে থাকে যে মুহাম্মদ আলী পাশাকে মিশর যেমন সৃষ্টি করেছিল তেমনি মুহাম্মদ আলী পাশাও মিশরকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন। ১৮০৫ সালে ক্ষমতা লাভ করে তিনি ফরাসী দখলদার কর্তৃক প্রবর্তিত সংস্কারের প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করেন। ফরাসী প্রকৌশলী ও বুদ্ধিজীবীরা মিশরে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদের দ্বার উন্মোচন করেন। মুহাম্মদ আলী এসব সম্পদের প্রয়োগ করে নব জাগরণ আনেন। এ কারণে বলা হয়েছে যে মুহাম্মদ আলী মিশরের নিকট যতটুকু ঋণী মিশরও আধুনিকীকরণে মুহাম্মদ আলীর নিকট ততটুকু ঋণী । মিশরের ইতিহাসে মুহাম্মদ আলী পাশার অবদান সম্পর্কে নানা রকম অভিমত রয়েছে ।
রিফাত বে বলেন, “মুহাম্মদ আলী সংস্কার এবং প্রগতির একটি সমুজ্জ্বল একনায়কত্বের ভূমিকা পালন করেন। এবং অটোমান সাম্রাজ্যের একটি সামান্য প্রদেশকে তার মধ্যযুগীয় অবস্থা-জাতীয়তাবাদী অধিকার পুষ্ট সভ্য রাষ্ট্রসমূহের সাথে সমতুল্য একটি প্রগতিশীল আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন।” ঐতিহাসিক লেনপুল সমালোচনা করে বলেন,” ভূমি সংস্কার নীতির দ্বারা তিনি ভূ-স্বামীদের যে শ্রেণী বিভাগ করেন এর ফলেই স্বত্বভোগী জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়, যা তাঁর পরিবার ও প্রিয়জনেরা ভোগ করত। ব্লক ম্যান উচ্চসিত প্রশংসা করে বলেন।”
তিনি আধুনিক ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।” ইয়ং এর মতে, “মুহাম্মদ আলীকে আধুনিক মিশরের আসল স্রষ্টা এবং প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা উচিত।” হেনরী ডডওয়েল মুহাম্মদ আলী পাশাকে “Universal Master, Universal Landlord, and Universal Merchant” বলে অভিহিত করেন । ঐতিহাসিক হিট্টি যথার্থই বলেন, “তিনি যে প্রকারের পদক্ষেপ, কর্মদক্ষতা এবং দূরদর্শিতা প্রদর্শন ও প্রয়োগ করেন তা তার মুসলমান সমসাময়িকদের মধ্যে তুলনাহীন ।”
সুতরাং মুহাম্মদ আলী পাশার উপরোক্ত গুণাবলী ও সংস্কার ব্যাপকভাবে মিশর তথা আরব জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়। আরব জাতীয়তা বিকাশে তাঁর অবদান অপরিসীম ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]