১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবুর কর্তৃক ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা মধ্যযুগের ভারতের
ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। দিল্লির সুলতানি শাসনের পতনের যুগে পরাক্রমশালী
কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা আত্মপ্রকাশ করেছিল। সমরকুশলী
মুঘল নেতা বাবুর বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজশক্তিকে অবদমিত করে পুনরায় পরাক্রমশালী কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে
ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
বাবুর ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার দুই পরাক্রমশালী বীরের
বংশধর। পিতৃক‚লের দিকে তৈমুর লঙ্গ এবং মাতৃক‚লের দিকে মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খাঁ ছিলেন তাঁর
পূর্বপুরুষ। স্বভাবতই বাবুরের রক্তে শৌর্য-বীর্য, পরাক্রম ও দুঃসাহসিক অভিযানপ্রিয়তা ছিল সহজাত।
বাবুরের পিতা ওমর শেখ মীর্জা ছিলেন মধ্য এশিয়ার (বর্তমান রুশ তুর্কিস্থানের অন্তর্গত) ক্ষুদ্র ফরগনা
রাজ্যের অধিপতি। তিনি এই ক্ষুদ্র রাজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। কারণ তাঁর বড়ভাই আহমদ মীর্জা তৈমুর
লঙ্গের রাজধানী সমরখন্দ ও বুখারাসহ সম্পদশালী অঞ্চলগুলো অধিকার করেছিলেন। ওমর শেখ মীর্জাও
ফরগনা রাজ্যের উত্তর দিকে অবস্থিত আখশী দুর্গের অধিকার নিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে এক পারিবারিক দ্বন্দে¡
লিপ্ত হয়ে পড়েন। এমনি পরিস্থিতিতে উড়ন্ত পায়রার সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে ১৪৯৪
খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে বাবুর মাত্র এগার বছর বয়সে ফরগনা
রাজ্যের অধিপতি হন। সিংহাসনে বসে বাবুর প্রথম থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমুরের মতো বিশাল সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন এবং তাঁর রাজধানী সমরখন্দ অধিকারের পরিকল্পনা করেন। বাবুরের আত্মীয়-
স্বজনের বিরোধিতা সর্বোপরি জ্ঞাতি উজবেক নেতা সাইবানি খানের বিরোধিতা সত্তে¡ও ১৪৯৭ খ্রি. তিনি
সমরখন্দ অধিকার করেন। শীঘ্রই স্বরাজ্য ফরগনার ষড়যন্ত্রের সংবাদ পেয়ে বাবুর সমরখন্দ পরিত্যাগ করলে
সাইবানি সমরখন্দ অধিকার করেন। বাবুর পুনরায় ১৫০১ খ্রি: সমরখন্দ আক্রমণ করেন, কিন্তু সাইবানির
নিকট পরাজিত হয়ে তাঁকে সমরখন্দ অধিকারের আশা চিরতরে ত্যাগ করতে হয়। শুধু তাই নয়, এই সময়
তাঁর জ্ঞাতি মীর্জা গোষ্ঠীর সর্দারদের চক্রান্তে ফরগনার সিংহাসন থেকে বিতাড়িত হন। ফলে বাবুর নিরাশ্রয়
ও সম্বলহীন অবস্থায় ভাগ্য-বিড়ম্বিত হয়ে যাযাবর জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হন। বাবুর এই দুর্দিনে তাসকেèন্ট
(বর্তমান রাশিয়া)-এ তাঁর মামা সুলতান মাহমুদ খানের আশ্রয়ে আসেন। তাঁর দুই মামা মাহমুদ খান ও
আহমদ খানের সাহায্যে ফরগনা রাজ্য উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৫০৩ খ্রি. আর্চিয়ান-এর যুদ্ধে সাইবানি
খানের কাছে পরাজিত হয়ে চিরতরে পিতৃরাজ্য ফরগনা উদ্ধারের স্বপ্ন ত্যাগ করেন। অতঃপর তিনি হিন্দুকুশ
পর্বতমালা অতিক্রম করে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হন।
১৫০৪ খ্রি. বাবুর উজবেক শাসনের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহের সুযোগে কাবুল অধিকার করেন এবং ‘পাদশাহ'
(বাদশাহ) উপাধি ধারণ করে সেখানে রাজ্য স্থাপন করেন। কাবুলে ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পর বাবুর
পুনরায় সমরখন্দ অধিকার করার জন্য পারস্যের শাহ ইসমাইলের সাহায্যপ্রাপ্ত হন। তাঁর সহায়তায় ১৫১১
খ্রি. বাবুর সমরখন্দ অধিকার করেন। কিন্তু ১৫১২ খ্রি. সাইবানির পুত্রের কাছে বাবুর পরাজিত হলে
সমরখন্দ পুনরায় তাঁর হস্তচ্যুত হয়। এইভাবে বার বার সমরখন্দ বিজয়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি ভারত বিজয়ের
দিকে মনোনিবেশ করেন। তখন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা বাবুরের ভারত আক্রমণের অনুক‚ল ছিল। এ
সময় ভারতে সার্বভৌম কেন্দ্রীয় শক্তি বলে কিছুই ছিল না। দিল্লির লোদি বংশীয় সুলতানি শাসন দিল্লি ও
তাঁর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। উত্তর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলই কার্যত স্বাধীন হয়ে
পড়েছিল। এইসব অঞ্চলে বিভিন্ন আফগান শাসকগণ শাসন করছিলেন। রাজপুতনাও এই সময়ে কার্যত
স্বাধীন। মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহও কেন্দ্রীয় আফগান শক্তির দুর্বলতার সুযোগে ভারতে হিন্দুরাজ্য
স্থাপনের স্বপ্ন দেখছিলেন।
১৫১৯ খ্রি. বাবুর এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারত অভিযানের উদ্দেশ্যে বাজাউর ও সোয়াতের দিকে
অগ্রসর হন এবং ঝিলাম নদীর পশ্চিম তীরে ভিরা নগরীতে উপস্থিত হন। এই সময়ে বাবুর দিল্লির সুলতান
ইব্রাহিম লোদির নিকট এক দূত পাঠিয়ে তৈমুরের উত্তরাধিকারী হিসাবে তৈমুরের বিজিত অঞ্চলগুলো দাবি
করেন। কিন্তু বাবুরের দূতকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লোদি আটক করেন। পাঁচ মাস পর তাকে
শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বাবুরও ভীর, খুসব এবং চন্দ্রবতী নদীর তীরস্থ এলাকা জয় করে কাবুলে
ফিরে যান। ১৫২০ খ্রি. বাদাকশান দখল করে স্বীয় পুত্র হুমায়ুনের নিকট শাসনভার অর্পণ করেন। ১৫২২
খ্রি. তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্থান কান্দাহার অধিকার করে দ্বিতীয় পুত্র কামরানকে এর
শাসনের দায়িত্ব দেন।
উল্লেখ্য, লোদি বংশীয় সুলতানগণের অধীনে দিল্লি সাম্রাজ্য পাঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু
লোদি সাম্রাজ্য ছিল কতগুলো স্বাধীন রাজ্যের সমষ্টিমাত্রÑ তাদের মধ্যে কোন সংহতি ছিল না। সুলতান
ইব্রাহিম লোদির স্বেচ্ছাচারিতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের ফলে কয়েকজন ওমরাহ সুলতানের প্রতি প্রতিশোধ
পরায়ণ হন। উপরন্তু পাঞ্জাবের গভর্নর দৌলত খান লোদির পুত্র দিলওয়ার খানের প্রতি ইব্রাহিম লোদির
নিষ্ঠুর আচরণ লোদি অভিজাতদের ক্ষিপ্ত করে তোলে।এই পরিস্থিতিতে দৌলত খান লোদি ও দিল্লির
সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার আলম খান কাবুলের অধিপতি বাবুরকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ
জানান। দৌলত খান আশা করেছিলেন যে, ইব্রাহিম লোদির অপদার্থতা এবং দিল্লি সুলতানির অভ্যন্তরীণ
গোলযোগের সুযোগে বাবুরের সহায়তায় নিজ ক্ষমতা বিস্তার করবেন। বাবুর কালবিলম্ব না করে দৌলত
খান লোদির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এবং ১৫২৪ খ্রি. সসৈন্যে সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদী অতিক্রম করে
লাহোর অধিকার করেন। এতে দৌলত খান ও আলম খান অসন্তুষ্ট হন। তাঁরা দেখতে পেলেন সাহায্যকারী
মিত্র হিসেবে আমন্ত্রণ করে ভারতে এক নতুন প্রভু ডেকে আনলেন। স্বভাবতই দৌলত খান ও আলম খান
বিরুদ্ধাচরণ শুরু করলেন। বাবুর এরূপ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে নতুন শক্তি সংগ্রহের জন্য পুনরায় কাবুলে
ফিরে যান এবং দিল্লির সুলতানি শাসনে শেষ আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
১৫২৫ খ্রি. নভেম্বর মাসে বাবুর কাবুল থেকে পুনরায় ভারত অভিযানে বের হন। বাদাকশান থেকে হুমায়ুন
এক শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী নিয়ে পথিমধ্যে পিতার সঙ্গে যোগ দেন। দৌলত খান লোদিকে এবার
সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে বাবুর পাঞ্জাব অধিকার করেন। অত:পর তিনি দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করে ১৫২৬
খ্রি. ১২ এপ্রিল পানিপথের প্রান্তরে এসে উপস্থিত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য সমাবেশ করেন। ইব্রাহিম
লোদিও তাঁর বাহিনী নিয়ে কয়েক মাইল ব্যবধানে পানিপথে ঘাঁটি স্থাপন করেন। বাবুরের আত্মজীবনীর
তথ্য মতে তাঁর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র বার হাজার। এসঙ্গে ছিল উস্তাদ আলি ও মুস্তফার নেতৃত্বাধীন একটি
সুসজ্জিত গোলন্দাজ বাহিনী। অন্যদিকে ইব্রাহিম লোদির সৈন্য বাহিনীতে এক লক্ষ পদাতিক ও এক হাজার
হস্তি ছিল। উভয় বাহিনী ১২ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল আটদিন শুধু দাঁড়িয়ে রইল। ২০ এপ্রিল হঠাৎ এক
রাতে বাবুর চার পাঁচ হাজার সৈন্যকে শত্রু শিবির আক্রমণের নির্দেশ দেন। যদিও সৈন্যদের অবহেলায় এ
অভিযান ব্যর্থ হয়। কিন্তু ইব্রাহিম লোদি এই আক্রমণে প্ররোচিত হয়ে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে শত্রু শিবিরের
দিকে অগ্রসর হতে আদশে দেন। সঙ্গে সঙ্গে বাবুরও ইব্রাহিম লোদির সৈন্যবাহিনী মোকাবেলা করতে
অগ্রসর হন। পানিপথের ঐতিহাসিক রণক্ষেত্রে ১৫২৬ খ্রি. ২১ এপ্রিল সকাল ৯টায় বাবুরের সৈন্যবাহিনী
আফগান অধিপতি ইব্রাহিম লোদির সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি হন। এই যুদ্ধে বাবুর প্রথমবারের মতো কামান
ব্যবহার করেন। বাবুরের প্রতিপক্ষ ইব্রাহিম লোদির সৈন্যসংখ্যা বেশি হলেও তাঁদের মধ্যে সামরিক শৃ´খলা
ও অভিজ্ঞতার যেমন অভাব ছিল তেমনি কোন যোগ্য সেনাপতি দ্বারা যুদ্ধ পরিচালিত হয়নি। তাছাড়া
ইব্রাহিম লোদির কোন কামান-বন্দুক ছিল না। শত্রুপক্ষের এসব দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে বাবুর স্বীয়
সৈন্যবাহিনীকে সুকৌশলে পরিচালিত করেন। তিনি শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে কামান থেকে গোলা ছুঁড়তে নির্দেশ
দেন। বাবুরের গোলন্দাজ বাহিনী ও সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের মুখে ইব্রাহিম লোদির সৈন্যবাহিনী দাঁড়াতে
পারেনি। ঐদিন দুপুরের মধ্যে ইব্রাহিম লোদির হাজার হাজার সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। আর স্বয়ং
ইব্রাহিম লোদি বীরের মতো লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন। অতপর বাবুর পানিপথের রণক্ষেত্র থেকে অগ্রসর
হয়ে দিল্লি ও আগ্রা দখল করেন এবং নিজেকে ভারতের বাদশা হিসেবে ঘোষণা করেন। পানিপথের যুদ্ধে
ইব্রাহিম লোদির পরাজয়ের ফলে লোদি বংশের শাসনের অবসান ঘটে এবং দিল্লি সুলতানির স্থলে মুঘল
শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এটি পানিপথের প্রথম যুদ্ধ নামে খ্যাত।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে পানিপথের এই যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধ জয়ের ফলে দিল্লি ও আগ্রা
বাবুরের অধিকারে আসে। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ যথার্থই বলেছেন, “ঞযব নধঃঃষব ড়ভ চধহরঢ়ধঃয ঢ়ষধপবফ
ঃযব বসঢ়রৎব ড়ভ উবষযর রহ ইধনঁৎ’ং যধহফ. ঞযব ঢ়ড়বিৎ ড়ভ ঃযব খড়ফর ফুহধংঃু ধিং ংযধঃঃবৎবফ ঃড় ঢ়রবপবং,
ধহফ ঃযব ংড়াবৎবরমহঃু ড়ভ ঐরহফঁংঃধহ ঢ়ধংংবফ ঃড় ঃযব ঈযধমযঃধর ঞঁৎশং.” (পানিপথের যুদ্ধ দিল্লি সাম্রাজ্যকে
বাবুরের হাতে অর্পণ করে। লোদি বংশের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে চূর্ণ হয়ে যায় এবং হিন্দুস্তানের সার্বভৌমত্ব
চাঘতাই তুর্কিদের অধীনে আসে।)
বাবুর দিল্লি ও আগ্রার অধিপতি হলেও ভারতবর্ষের এমন কি উত্তর ভারতের বিরাট এলাকা তাঁর অধিকারের
বাইরে ছিল। সমগ্র দেশে আফগান আমীর ও জায়গীরদারগণের কর্তৃত্ব তখনও অক্ষুন্ন ছিল। তাঁদের
পরাজিত না করা পর্যন্ত দিল্লির সিংহাসন নিরাপদ ছিল না। তাই প্রথমেই তিনি দিল্লি সুরক্ষার জন্য দিল্লি ও
আগ্রার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বিয়ানা, গোয়ালিয়র, ধোলপুর, কালপি, জৌনপুর, গাজীপুর প্রভৃতি অঞ্চল অধিকার
করেন।
পানিপথের যুদ্ধ বিজয়ী বাবুরের পক্ষে সমগ্র ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তার করা সহজ ছিল না। একদিকে যেমন
সুলতানি আমলের আফগান জায়গীরদার ও আফগান দলনেতাগণ বাবুরকে সুনজরে দেখেননি, তেমনি
অন্যদিকে মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহ তাঁর দিল্লি অধিকার পরিকল্পনায় বাবুরকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ¡ী রূপে
বিবেচনা করতে লাগলেন। উল্লেখ্য, বাবুর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, রানা সংগ্রাম সিংহ কাবুলে দূত
পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, বাবুর দিল্লি আক্রমণ করলে রানা সংগ্রাম সিংহও একই সময়ে আগ্রার দিকে
আক্রমণ পরিচালনা করবেন। কিন্তু সংগ্রাম সিংহ তাঁর কথা রাখেননি। তাই বাবুরও যে রানা সংগ্রাম সিংহের
বিরোধিতার সম্মুখীন হবেন তা বুঝতে পেরেছিলেন। সংগ্রাম সিংহ মনে করেছিলেন বাবুর তাঁর পূর্বপুরুষ
তৈমুরের মতো দিল্লি লুণ্ঠন করে কাবুলে ফিরে যাবেন। কিন্তু বাবুরের ভারত ত্যাগের ইচ্ছা নেই দেখে রানা
সংগ্রাম সিংহ বাবুরকে ভারত থেকে বিতাড়িত করতে আট লক্ষ সৈন্য ও পাঁচশত যুদ্ধহস্তি সহ বাবুরের
বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন। রানা সংগ্রাম সিংহ ও মেওয়াটের হাসান খাঁর সম্মিলিত বাহিনী বাবুর অধিকৃত বিয়ানা
অধিকার করেন। ১৫২৭ খ্রি. ১১ ফেব্রুয়ারি বাবুর উল্লেখিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠান। কিন্তু রাজপুত ও
আফগান সৈন্যদের কাছে বাবুরের সৈন্যগণ পরাজিত হন। অন্যদিকে আফগানগণ রাপ্রি এবং চান্দয়ার
অধিকার করেন। তাছাড়া ইতোমধ্যে বাবুর অধিকৃত সম্বল, কনৌজ ও গোয়ালিয়রেরও পতন ঘটে। চান্দেরী,
অম্বর, মাড়োয়ার, আজমীর, গোয়ালিয়র প্রভৃতি অঞ্চলের শাসকগণ এবং বহুসংখ্যক রাজপুত দলপতি,
মেওয়াটের হাসান খাঁ এবং সুলতান সিকান্দর লোদির পুত্র মাহমুদ লোদি রানা সংগ্রাম সিংহের সঙ্গে যোগ
দিয়ে সম্মিলিত আফগান ও রাজপুত বাহিনী গঠন করে। এরূপ সংকটময় পরিস্থিতিতে বাবুর স্বয়ং
পানিপথের যুদ্ধে সেনাবাহিনী পরিচালনায় যে কৌশল নিয়েছিলেন সেই একই কৌশলে ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের
১৬ মার্চ তিনি আগ্রা থেকে সাইত্রিশ মাইল পশ্চিমে খানুয়ার নামক স্থানে সম্মিলিত আফগান ও রাজপুত
বাহিনীর মোকাবেলায় অগ্রসর হন। শত্রুদের বিশাল সম্মিলিত বাহিনীর সামনে বাবুরের সৈন্যবাহিনী ভয়ে ও
হতাশায় উদ্যমহীন হয়ে পড়ে। বাবুর নিজেও খানুয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করেন। কিন্তু বিপদে
নির্ভীকচিত্ত বাবুর তাঁর সৈন্যদের চিত্তে প্রেরণা দানের উদ্দেশ্যে উদাত্তকণ্ঠে আল্লাহ্র নামে যুদ্ধে জয়লাভ
অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হতে আহŸান জানান। তাঁর এই আহŸানে সৈন্যগণ অনুপ্রাণিত হয় এবং যুদ্ধে
জয়লাভ অথবা শহীদ হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এখানেও বাবুর পানিপথের অনুরূপ সৈন্য সংস্থাপনের ব্যবস্থা
করেন। বাবুর নিজে উস্তাদ আলি ও মুস্তফার নেতৃত্বে অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে গোলন্দাজ বাহিনীর কামান
ব্যবহার করলে রানা সংগ্রাম সিংহের বিশাল বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে রাজপুত বাহিনী প্রবল
বিক্রমে যুদ্ধ করেও পরাজিত হয়। মেওয়াটের হাসান খাঁ ও দুঙ্গরপুরের রাওয়াল উদয় সিংহ সহ বহু
সেনাপতি নিহত হন। রানা সংগ্রাম সিংহ কোন রকমে প্রাণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন এবং দুই
বছর পর ভগ্ন হৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেন। খানুয়ার যুদ্ধে ভারতে বাবুরের প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ¡ী রাজপুত শক্তি
সম্পূর্ণভাবে পরাজয় বরণ করে।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব সমধিক। প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধের ফলাফল পানিপথের যুদ্ধের
চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। পানিপথের যুদ্ধে শুধু ইব্রাহিম লোদি পরাজিত হয়েছিলেন, কিন্তু ু খানুয়ার যুদ্ধে সম্মিলিত
রাজপুত শক্তির পরাজয়ের ফলে সমগ্র ভারতে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সর্বাপেক্ষা গুরুতর বাধা দূর হয়।
ভারতে রাজপুত জাতির রাজনৈতিক পুনরুত্থানের সুযোগ বিনষ্ট হয়। প্রকৃতপক্ষে, পানিপথে ভারতে মুঘল
বিজয়ের যে সূচনা হয়েছিল, খানুয়ায় তা সম্পূর্ণ হয়। এই যুদ্ধের পর থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক
কেন্দ্র কাবুল থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর হয়। খানুয়ার যুদ্ধকেই বাবুরের শেষ আত্মরক্ষার যুদ্ধ বলা যায়।
কারণ, এই যুদ্ধের পর বাবুরের দিল্লির সিংহাসন চ্যুতির আর কোন সংশয় রইল না। পরবর্তীকালে বাবুর
যেসব যুদ্ধ করেছিলেন, সেগুলো ছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ।
বাবুর খানুয়ার যুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ এপ্রিল মেওয়াটের রাজধানী আলোয়ার
অধিকার করেন। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে বাবুর মেদিনী রায়কে পরাজিত করে চান্দেরী দুর্গ মুঘল
অধিকারে আনেন। ঐ বৎসর ফেব্রুয়ারিতে আফগানগণ বিবনের নেতৃত্বে অযোধ্যা ও লক্ষেèৗ থেকে মুঘলদের
উচ্ছেদ করে। পরের মাসেই বাবুর কনৌজ পৌঁছে সেখান থেকে গঙ্গা নদী পার হন এবং আফগানদের
পরাজিত করে অযোধ্যা নিজ অধিকারে নিয়ে আসেন। বিবন বাংলায় পলায়ন করেন।
এরপর বাবুর বিহার ও বাংলার আফগান শক্তিকে উৎখাত করতে মনোনিবেশ করেন। ইব্রাহিম লোদির ভ্রাতা
মাহমুদ লোদি বিহার অধিকার করেন। বিহার থেকে কনৌজ পর্যন্ত এলাকার আফগানগণ তাঁর সাথে
যোগদান করে বাবুরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে একতাবদ্ধ হন। এ সংবাদ জানতে পেরে বাবুর পুত্র
আসকারীকে মাহমুদ লোদির বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন এবং নিজে সৈন্যবাহিনী নিয়ে পূর্বদিকে এগুতে থাকেন।
বাবুরের আগমনের কথা জানতে পেরে আফগান সেনা প্রধানগণ একে একে মাহমুদ লোদির পক্ষ ত্যাগ
করেন। ফলে মাহমুদ লোদির অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। বাবুর এলাহাবাদ, চুনার এবং বারাণসী হয়ে
বক্সারের দিকে এগুতে থাকেন। এ সময়ে অনেক আফগান নেতা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে। শের খান
এবং মাহমুদ লোদি বাংলার সুলতান নসরত শাহের কাছে আশ্রয় নেন। আফগান বিদ্রোহীদের দমন করার
জন্য বাবুর আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হন এবং ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে পাটনার নিকটবর্তী গোগরা নামক
স্থানে মাহমুদ লোদির নেতৃত্বে গঠিত আফগানদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এটি বাবুরের শেষ
বৃহত্তম যুদ্ধ। বিহারের শাসক জালাল খাঁ বাবুরের অধীনতা স্বীকার করেন। এ সময়ে সুলতান নসরত শাহ
বাবুরের সাথে কোন বিবাদে না গিয়ে দূত পাঠিয়ে সন্ধি স্থাপন করেন এবং বিহারের ওপর বাবুরের কর্তৃত্ব
মেনে নেন। ফলস্বরূপ বাবুরও একরকম বঙ্গদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেন। এভাবে তিনটি যুদ্ধ দ্বারা
তাঁর সাম্রাজ্য কাবুল থেকে গোগরা এবং হিমালয় থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
বাবুর তাঁর ভারত বিজয়ের ফল বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর মাত্র
আটচল্লিশ বছর বয়সে মুঘল সাম্রাজ্যের ভাগ্যবিধাতা পরলোকগমন করেন। বাবুরকে প্রথমদিকে আগ্রার
কাছে আরামবাগে সমাহিত করা হয় কিন্তু কয়েক বছর পর তাঁর অভিপ্রায় অনুযায়ী কাবুলে তাঁর এক প্রিয়
উদ্যানে সমাহিত করা হয়।
বাবুরের কৃতিত্ব
মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসে জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবুরের স্থান নির্ণয় কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। বাবুর
শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসে এক রোমান্টিক ও হৃদয়গ্রাহী ব্যক্তিত্ব। ঐতিহাসিকগণ
তাঁর কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। সমসাময়িক ও আধুনিক ইতিহাসবিদগণ
একমত যে, “ইধনধৎ ধিং ড়হব ড়ভ ঃযব সড়ংঃ নৎরষষরধহঃ সড়হধৎপযং ড়ভ সবফরবাধষ যরংঃড়ৎু.” ভিনসেন্ট স্মিথ
মন্তব্য করেন, “তাঁর যুগে বাবুর ছিলেন এশিয়ার নরপতিদের মধ্যে সব থেকে প্রতিভাদীপ্ত ব্যক্তি এবং
ভারতীয় নরপতিদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী।” রাসব্রুক উইলিয়াম বলেন, বাবুর
“ষোড়শ শতাব্দীর একজন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা।” তিনি তাঁর চরিত্রে আটটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন,
যথাÑ বিচক্ষণতা, মহান উচ্চাশা, যুদ্ধ-নিপুণতা, সুদক্ষ শাসনকৌশল, প্রজা-হিতৈষণা, উদার প্রশাসনিক
আদর্শ, সৈনিকদের হৃদয় জয়ের ক্ষমতা ও ন্যায় বিচার প্রবণতা।
বাবুর ছিলেন একজন নির্ভীক সৈনিক, সেনাপতি, সুদক্ষ অস্ত্র পরিচালক ও অশ্বারোহী এবং একজন দুর্ধর্ষ
শিকারী। বাবুরের মাঝে তুর্কি জাতির সাহস ও কর্মদক্ষতার সঙ্গে মোঙ্গলদের তেজস্বিতা ও সমরনিপুণতার
সমন¦য় ঘটেছিল। এ কারণে ভারত অভিযানে তিনি কখনো বিপর্যস্ত হননি। তিন তিনটি যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে
ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। একটানা যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে দিয়ে কাবুল
থেকে বিহার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উত্তর ভারতের এলাকাসমূহের অধিশ্বররূপে চার বৎসর রাজত্বকালে সুষ্ঠু
প্রশাসনিক কাঠামো, আইনকানুন, শাসনক্ষেত্রে কোন নতুন সংগঠনও গড়ে তুলতে পারেননি। তবে তিনি
তাঁর শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভ‚ত করেন। তাঁর সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যকে জায়গীরদারদের মধ্যে বিভক্ত করে দেন।
এসঙ্গে জায়গীরদারদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করেন। বাবুরের প্রশাসন ব্যবস্থার অন্যতম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ
ছিল চিঠিপত্র আদান-প্রদানের জন্য পনর মাইল অন্তর ডাক-চৌকির ব্যবস্থাকরণ। তবে একথা সত্যি যে,
ত্রুটিযুক্ত রাজস্বনীতির কারণে তাঁর রাজত্বকালে অর্থনৈতিক অবস্থা চরম আকার ধারণ করে। বিনা কারণে
বদান্যতা দেখাতে গিয়ে দিল্লি ও আগ্রায় প্রাপ্ত ধন-সম্পদ তিনি মুক্তহস্তে অনুচরবর্গের মধ্যে বিলি করে
দিয়েছিলেন। তাছাড়া বহু রাজস্বও মওকুফ করেছিলেন। ফলে প্রতিদিনের রাষ্ট্রীয় খরচের জন্য যে অর্থের
প্রয়োজন তারও অভাবে শাসনব্যবস্থাকে সুসংহত রূপ দিতে অন্তরায়ের সৃষ্টি হয়।
সমরকুশলী ও বীরযোদ্ধা হয়েও বাবুরের মতো এমন সংস্কৃতিপরায়ণ ও বিদ্বান ব্যক্তির আবির্ভাব
সমসাময়িককালে মধ্য এশিয়ায় আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাবুরই একমাত্র নরপতি যিনি তাঁর
আত্মজীবনীতে পাপ-পুণ্যের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তুর্কি ভাষায় রচিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ
‘তুজুক-ই-বাবুরী' তৎকালীন ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের অমূল্য আকর গ্রন্থ।
এছাড়া তুর্কি ও ফারসি ভাষায় তিনি কবিতা রচনা করেছেন। তুর্কি ভাষায় রচিত তাঁর ‘দেওয়ান' কাব্যগ্রন্থটি
খুবই উচ্চমানের গ্রন্থ। এতে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত
ঐতিহাসিক স্ট্যানলি লেনপুল মন্তব্য করেন, “মধ্য এশিয়ার ও ভারতবর্ষের ল্যাটিন ও সংস্কৃতির ভাষা
ফারসিতে তিনি কীর্তিমান কবি ছিলেন এবং তাঁর মাতৃভাষা তুর্কিতে গদ্য রচনা করেন এবং কবিতায় তিনি
বিশুদ্ধ ও স্বাভাবিক রীতি প্রচলন করেন।”
বাবুরের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব
বাবুর ছিলেন মধ্যযুগীয় এশিয়ার এক অনন্য সাধারণ চরিত্র এবং এক দুঃসাহসিক ও চমকপ্রদ ব্যক্তিত্বের
অধিকারী। এ প্রসঙ্গে রায় চৌধুরী, দত্ত ও মজুমদার বলেন, “বাবুর এশিয়ার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা
রোমাঞ্চকর এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের অন্যতম।” ব্যক্তিগত জীবনেও বাবুর ছিলেন অত্যন্ত
ভদ্র, অকপট ও কোমল স্বভাবের। পরিবারের সকলের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ। বন্ধু হিসেবে
ছিলেন বেশ উঁচু মানের। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল মানবিক গুণসম্পন্ন। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ চেঙ্গিজতৈমুরের মতো রক্তপিপাসু অথবা লুণ্ঠন ও ধ্বংস সাধনের পক্ষপাতি ছিলেন না। বিজিত শত্রুর প্রতি তিনি
উদারতা দেখাতেন। বাবুর ব্যক্তিগত জীবনে কঠোর নীতিবোধ মেনে চলতেন।
ধর্মের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন সুন্নি মুসলমান, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। ধর্মীয় আচার-আচরণে
নিষ্ঠাবান ছিলেন। অপর ধর্মের মানুষের প্রতি গোঁড়া মুসলমান শাসকদের মতো নির্যাতনমূলক কোন নীতি
অবলম্বন করেননি। তাছাড়া বাবুর স্বয়ং সুন্নি মুসলমান হওয়া সত্তে¡ও শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী পারস্যের শাহ
ইসমাইল সাফাভীর সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করতে কোন দ্বিধা করেননি। এমনকি এক সময়ে তিনি সমরখন্দে শিয়া
মতবাদীদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। অমুসলমানদের প্রতি উদারতা ও সহিষ্ণুতা তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রের
অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ যথার্থ মন্তব্য করেছেন, ‘তাঁর যুগের অপরাপর
মুসলিম নৃপতিগণ অপেক্ষা বাবুর সন্দেহাতীতভাবে শ্রেষ্ঠ ছিলেন'।
সারসংক্ষেপ
মধ্য এশিয়ার ফরগনা রাজ্যের অধিপতি জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবুর তাঁর জ্ঞাতি গোষ্ঠীর চক্রান্তে ফরগনার
সিংহাসনচ্যুত হয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে কাবুল অধিকার করেন। অতপর তিনি ভারত
বিজয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা তাঁকে ভারত আক্রমণে উদ্বুদ্ধ
করেছিল।
তিনি সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদী অতিক্রম করে লাহোর ও পাঞ্জাব অধিকার করার
মাধ্যমে ভারত ভ‚মি অধিকারে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেন। পরবর্তীকালে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম
লোদিকে পানিপথের যুদ্ধে (১৫২৬ খ্রি.) পরাজিত করে বাবুর ভারতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
এরপর তিনি খানুয়ার যুদ্ধে সম্মিলিত রাজপুত ও আফগান শক্তিকে এবং গোগরার যুদ্ধে সম্মিলিত
আফগান বাহিনীকে পরাজিত করে ভারতে তাঁর আধিপত্য সুদৃঢ় করেন।
পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। বাবুর কত খ্রিস্টাব্দে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন?
(ক) ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে।
২। কত খ্রি. বাবুর লাহোর অধিকার করেন?
(ক) ১৫২২ খ্রি. (খ) ১৫২৪ খ্রি.
(গ) ১৫২৬ খ্রি. (ঘ) ১৫২৮ খ্রি.।
৩। কোন যুদ্ধে বাবুর প্রথমবারের মত কামান ব্যবহার করেন?
(ক) পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (খ) খানুয়ার যুদ্ধে
(গ) গোগরার যুদ্ধে (ঘ) পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে।
৪। খানুয়ার যুদ্ধে কোন রাজপুত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন?
(ক) রানা প্রতাপসিংহ (খ) মানসিংহ
(গ) রানা সংগ্রাম সিংহ (ঘ) রানা অরূপ সিংহ।
৫। গোগরার যুদ্ধ সংগঠিত হয় কত খ্রিস্টাব্দে?
(ক) ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। বাবুর কিভাবে ফরগনা রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিন।
২। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ-পূর্ব ভারতে বাবুরের অভিযানগুলোর বর্ণনা দিন।
৩। পানিপথের যুদ্ধের ঘটনাবলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন।
৪। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ও খানুয়ার যুদ্ধের মধ্যে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন?
৫। বাবুর সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মূল্যায়ন সংক্ষেপে বিবৃত করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বাবুরের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
২। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠিত যুদ্ধ বিগ্রহের বর্ণনা দিন।
৩। বাবুরের চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত