বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি
(Development During the World War)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানব ইতিহাসের এক ভয়াবহতম ঘটনা। এই বিশ্বযুদ্ধকালীন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে শরীফ- ম্যাকমেহন পত্রালাপ, সাইকস-পিকো চুক্তি ব্যালফোর ঘোষণা, প্যারিস শান্তি সম্মেলন ও ম্যান্ডেট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
১৯০৮ সালে পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্য প্রাচ্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। এ সময় উদারপন্থি নব্য তুর্কিরা ক্ষমতায় আসে। তাদের ক্ষমতায় আসার পর আরবরা আশা করেছিল যে শাসন ব্যবস্থায় তাদের সম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে এ সময় আরবরা নব্য তুর্কিদের সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের মুক্তির উপায় খোঁজে। পারস্পরিক সদিচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ তুর্কি আরব ভ্রাতৃসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। নব্য তুর্কিদের চাপেই সুলতান আবদুল হামিদ শরীফ হুসেইনকে হেজাজের গভর্ণর, পবিত্র ভূমি সমূহের রক্ষাকর্তা এবং মক্কার প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু আরবদের প্রতি নব্যতুর্কিদের এ উদারতা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। কেননা নব্য তুর্কিদের উদারতার সুযোগে ওসমানিয় সাম্রাজ্যের বেশ কয়েকটি প্রদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তাই সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য অল্প কিছুদিন পরেই তারা প্রশাসনে কেন্দ্রীয়করণ এবং সাম্রাজ্যের তুর্কিকরণ নীতি অবলম্বন করে । আরবদের আশা ছিল আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে। কিন্তু নব্য তুর্কীদের হস্তক্ষেপের ফলে মোট ২৪৫টি আসনের মধ্যে তুর্কিরা পায় ১৫০টি আসন এবং আরবরা পায় মাত্র ৬০টি আসন। ফলে নব্য তুর্কীদের ব্যাপারে আরবদের মোহভঙ্গ হয়। প্রকাশ্যে ও গোপনে বেশ কিছু আরব জাতীয়তাবাদী সংগঠন জন্ম নেয়। এমন সময়ে অর্থাৎ ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্ক অক্ষশক্তিভুক্ত দেশ জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরীর পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। যোগদানের পর তুরস্ক ১৯১৪ সালের ২৩ নভেম্বর সমগ্র মুসলিম জাহানকে উদ্দেশ্য করে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেয়। তুর্কিরা মনে করেছিল, সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে এবং বাইরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জিহাদের এ আহ্বান ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে । এ জিহাদ ঘোষণায় অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য ছিল আরবদের আনুগত্য আদায় আর
বাহ্যিকভাবে জিহাদ ঘোষণার মাধ্যমে তুর্কিরা চেয়েছিল মিত্র শক্তির উপনিবেশসমূহে বসবারত মুসলমানদেরকে বিদ্রোহী করে তোলা । কিন্তু তাদের এ আশা ব্যর্থ হয়েছিল । তুর্কি সরকারের উদ্দেশ্য এবং তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত জাতিসমূহের উদ্দেশ্য এক ছিল না। যুদ্ধের সুযোগে আরবরা তাদের জাতীয়তাবাদের আশা- আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি স্বাধীন আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়। সাম্রাজ্য ভুক্ত আরবদের একটি বড় অংশ শরীফ হুসেইনের নেতৃত্বে নিষ্ক্রিয় থাকে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন আরবদেরকে তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে প্ররোচিত করে। আরবদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হলে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ করবে। এ সুযোগে আরব নেতৃবৃন্দ মিত্রশক্তির পক্ষ থেকে আরবদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নিশ্চয়তা আদায় করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। যেসব শর্তের ভিত্তিতে তারা তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সহযোগিতা করতে সম্মত আছে সেসব শর্ত সম্বলিত একটি খসড়া প্রস্তুত করে যা দামেস্ক প্রটোকল নামে পরিচিত। এ প্রটোকলে প্রদত্ত শর্তসমূহের উপর ভিত্তি করে শরীফ হুসেইন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে পত্র বিনিময় করেন ।
শরীফ-ম্যাকমেহন পত্রালাপ
১৯১৫ সালের জানুয়ারী মাসে স্যার হেনরী ম্যাকমেহন মিশর এবং সুদানের হাই কমিশনার নিযুক্ত হন। তার সঙ্গেই শরীফ হুসেইন পত্রালাপের মাধ্যমে যুদ্ধে যোগদানের শর্ত হিসেবে আরবদের দাবি-দাওয়াসমূহ উপস্থাপন করেন। নবনিযুক্ত হাইকমিশনার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী হুসেইনের পত্রগুলির জবাব দেন। এক্ষেত্রে তার অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন ওরিয়েন্টাল সেক্রেটারী রোনাল্ড স্টর্স। কিচেনারের সময়কাল থেকেই স্টর্স কায়রোতে অবস্থান করেছিলেন। এবং আরবদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। ম্যাকমেহন শরীফ হুসেইনের মধ্যকার এই পত্রালাপই শরীফ ম্যাকমেহন পত্রালাপ নামে পরিচিত। বিখ্যাত ঐতিহাসিক জর্জ এন্টেনিয়াস ১৯৩৮ সালে তার Arab Awakening গ্রন্থে সর্বপ্রথম এ পত্রগুলি প্রকাশ করেন ।
(১) ম্যাকমেহনের নিকট শরীফের প্রথম পত্র (১৪ জুলাই, ১৯১৫) : শরীফ হুসেইন তার প্রথম পত্রের ভূমিকায় স্বাধীনতা অর্জনের ব্যাপারে আরবদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানান। এ লক্ষে বৃটেনের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের শর্ত হিসেবে প্রথমেই তিনি দামেস্ক প্রটোকলের শর্তসমূহ উল্লেখ করেন। তারপর তিনি একটি আরব খেলাফত প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেনের স্বীকৃতি দানের শর্তটি জুড়ে দেন। এছাড়া তিনি জানান যে, প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার প্রদান সংক্রান্ত পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহের মেয়াদ হবে ১৫ বছর। তবে উভয় পক্ষের সম্মতিতে তা নবায়ন করা যাবে।
(২) শরীফের নিকট ম্যাকমেহনের প্রথম পত্র (৩০ আগস্ট, ১৯১৫) : পত্রের শুরুতে ম্যাকমেহন ব্রিটেনের প্রতি আরবদের বন্ধুত্ব মনোভাবের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তারপর তিনি ইতোপূর্বে লর্ড কিচেনার কর্তৃক আবদুল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। উল্লেখ্য যে কিচেনারের বার্তায় আরবদের স্বাধীনতা প্রদানে ব্রিটেনের সদিচ্ছা এবং আরব খেলাফত ঘোষিত হলে ব্রিটেন কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদানের প্রতিশ্রুতি ছিল । কিন্তু ম্যাকমেহন প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের সীমানার বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ করেন নি। সম্ভবত বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের নির্দেশক্রমেই তিনি সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন নি। যুদ্ধকালীন সময়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে সময় ক্ষেপন করা উচিত হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। এছাড়া অনেক আরব অঞ্চল এখনো তুরস্কের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব অঞ্চলের আরবরা ব্রিটেনকে সহযোগিতা না করে তুরস্ক ও জার্মানীর পক্ষাবলম্বন করায় ম্যাকমেহন বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেন ।
(৩) ম্যাকমেহনের নিকট শরীফের দ্বিতীয় পত্র (৯ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫) : এ পত্রে শরীফ আরবদের মূল দাবি অর্থাৎ আরব রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে ম্যাকমেহনের পত্র অস্পষ্ট, শীতল ও দ্বিধা মিশ্রিত বলে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে কোন স্পষ্ট বক্তব্য ছাড়া আরবদের পক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব নয় বলে তিনি জানান। কেননা এটি শুধুমাত্র তার দাবী নয় গোটা আরব জাতির দাবি। এমনকি যেসব আরবরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে তুরস্কের পক্ষে যুদ্ধ করছে তারাও এ পত্রালাপের ফলাফল জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সুতরাং সীমানা সংক্রান্ত বিষয়টিকে একটি মৌলিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট বক্তব্য প্রদানের জন্য তিনি ম্যাকমেহনকে অনুরোধ জানান ।
(৪) শরীফের নিকট ম্যাকমেহনের দ্বিতীয় পত্র (২৪ অক্টোবর, ১৯১৫) : শরীফের দ্বিতীয় পত্র পাওয়ার পর ম্যাকমেহনের সামনে সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য প্রদান ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। শরীফ তার পত্রে গুপ্ত সমিতিগুলির সাথে তার যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেন নি। এছাড়া হেজাজের বাইরে আরবদের তুর্কি বিরোধী তৎপরতার কোন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ তিনি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন নি। তাই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ হেজাজ ছাড়া অন্য কোন আরব অঞ্চল সম্পর্কে কোন প্রতিশ্রুতি দেয় নি। কিন্তু এ সময় একটি আকস্মিক ঘটনার ফলে আরবদের তৎপরতা সম্পর্কে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বিস্তারিত জানতে পারে এবং শরীফের প্রস্তাবের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তিত হয়। গ্যালিপলির যুদ্ধে ব্রিটিশদের নিকট বন্দী মোহাম্মদ শরীফ আল ফারুকী নামে তুর্কি সেনাবাহিনীর একজন আরব অফিসারকে তার ইচ্ছানুযায়ী কায়রোতে প্রেরণ করা হয়। যুদ্ধের সময় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রিটিশ সীমানা অতিক্রম করে আত্মসমর্পণ করেন। তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে বলে জানান এবং তাকে মিশরে প্রেরণ করার অনুরোধ জানান। তিনি আল আহাদের একজন সদস্য এবং আরবদের
স্বাধীনতার মতবাদে বিশ্বাসী। তার কাছ থেকেই ম্যাকমেহন আল আহাদ এবং আল ফাতাতের উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত হন এবং সিরিয়া ও ইরাকের আরব জাতীয়তাবাদীদের মনোভাব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। তার প্রদত্ত তথ্য সমূহ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যাচাই করা হয় এবং তাকে পরিকল্পিতভাবে মিশরে পাঠানো হয়েছে কিনা সে বিষয়েও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধান করা হয়। অবশেষে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সামনে প্রতীয়মান হয় যে, তার দেয়া তথ্যসমূহ নির্ভরযোগ্য এবং কোন ব্যক্তি বা সংগঠক তাকে পাঠায় নি। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মিশরে এসেছেন। শরীফের নিকট প্রেরিত ম্যাকমেহনের দ্বিতীয় পত্রের বিষয়বস্তু নির্ধারণে ফারুকীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ
করেছে।
এ পত্রে ম্যাকমেহন শরীফকে লিখেন, তার পূর্ববর্তী পত্রে সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে শীতল এবং দ্বিধান্বিত মনোভাবের যে ধারণা শরীফ পেয়েছেন তা সঠিক নয়। এ বিষয়ে আলোচনায় তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন। কারণ তার মনে হয়েছিল, সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনার সময় তখনও আসে নি। তবে শরীফের দ্বিতীয় পত্র প্রাপ্তির পর সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে যে আরবদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক দাবি তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং কালবিলম্ব না করে পত্রের বিষয়বস্তু ব্রিটিশ সরকারকে অবহিত করেছেন। ব্রিটিশ সরকার এ বিষয়ে ম্যাকমেহনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে এবং সেই অনুযায়ী তিনি শরীফকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের সীমানা ও অন্যান্য শর্তসমূহ অবহিত করেন ।
(ক) মার্সিন ও আলেকজান্দ্রেত্তা জেলা দুটি এবং দামেস্ক, হম্স, হামা ও আলেপ্পো জেলা সমূহের পশ্চিমে অবস্থিত সিরিয় ভূ-খণ্ডকে বিশুদ্ধ আরব অঞ্চল বলা যায় না। তাই দাবিকৃত সীমানা হতে এ এলাকাগুলিকে বাদ দেয়া উচিত ।
(খ) উপরোক্ত সংশোধন সাপেক্ষে ও আরব শেখদের সাথে ব্রিটেনের বিদ্যমান চুক্তিসমূহের সাথে সঙ্গতি রেখে এবং ফ্রান্সের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে ব্রিটেন আরবদের সীমানার দাবিকে সমর্থন করে।
(গ) ব্রিটেন সকল প্রকার বৈদেশিক আক্রমণ পবিত্র স্থানগুলির নিরাপত্তা বিধান করবে এবং এগুলির অলঙ্গনীয়তাকে স্বীকৃতি দিবে ।
(ঘ) প্রস্তাবিত অঞ্চলসমূহের জন্য উপযোগী সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্রিটেনে আরবদেরকে যথাসময়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করবে।
(ঙ) আরবদের ইচ্ছানুযায়ী একমাত্র ব্রিটেনই প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা এবং উপদেষ্টা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা দিয়ে সাহায্য করবে।
(চ) এ অঞ্চলকে বৈদেশিক আক্রমণ হতে রক্ষা এবং স্থানীয় জনগণের কল্যাণ ও পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে বাগদাদ এবং বসরা ভিলায়েতে ব্রিটেন যে বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে আরবরা তা মেনে নিবে ।
পত্রটি ম্যাকমেহন হুসাইনের পত্র বাহক শেখ মুহাম্মদ ইবনে আরফি ইবনে উরাইফানের মাধ্যমেই মক্কায় প্রেরণ করেন। তিনি শরীফ এবং ম্যাকমেহনের বিনিময়কৃত প্রায় সবগুলি পত্রের বাহক ছিলেন।
৫। ম্যাকমেহনের নিকট শরীফের তৃতীয় পত্র (৫ নভেম্বর ১৯১৫) : এ পত্রে শরীফ কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। প্রস্তাবিত আরব রাজ্য হতে ম্যাকমেহন মার্সিন জেলাটিকে বাদ দিতে বললেও শরীফ গোটা আদানা ভিলায়েত (মার্সিন জেলাটিও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল) বাদ দিতে রাজী হন। কিন্তু তিনি আলেপ্পো ভিলায়েতের অন্তর্গত আলেকজান্দ্রেত্তা জেলাটি বাদ দিতে অস্বীকৃতি জানান । দামেস্ক, হমস, হামা ও আলেপ্পো জেলাসমূহের পশ্চিমে অবস্থিত সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল খ্রিস্টান অধ্যুষিত হলেও জাতিগত দিক থেকে যে তারা আরব এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এ অঞ্চল প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে মুসলিম আরবরা তাদের পূর্ব পুরুষ উমর বিন খাত্তাবের মতই খ্রিস্টান আরবদের সম অধিকার প্রদান করবে বলে শরীফ পত্রে উল্লেখ করেন ।
আরব শেখদের সাথে ব্রিটেনের চুক্তিগুলোর মধ্যে শরীফ শুধুমাত্র বসরা অঞ্চলের শেখদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিসমূহ মেনে নিতে সম্মত হন। বাগদাদ ও বসরা ভিলায়েতের ক্ষেত্রে শরীফ ম্যাকমেহনের প্রস্তাব পুরোপুরি মেনে নেন নি। তিনি সাময়িকভাবে এ অঞ্চলের উপর ব্রিটিশ দখলদারিত্ব স্বীকার করে নেন। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিতব্য আরব রাজ্যের অর্থনৈতিক চাহিদা মিটানোর জন্য ব্রিটেনের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করেন। তবে কোন অবস্থাতেই এ অঞ্চলকে আরব রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন। মিত্র শক্তি যেন আরবদেরকে ছাড়া কোন শান্তি চুক্তি সম্পাদন না করে এবং কোন অবস্থাতেই আরবদেরকে জার্মানি ও তুরস্কের সামনে একা ফেলে না যায় সেই ব্যাপারে শরীফ ব্রিটেনের কাছ থেকে নিশ্চয়তা দাবি করেন। যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে হলেও আরবদেরকে যুদ্ধরত পক্ষ হিসেবে গণ্য করার জন্যও অনুরোধ করেন। এছাড়া ব্রিটেনকে যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি আলোচনায় আরবদের পক্ষ অবলম্বন করে তাদের দাবি-দাওয়াসমূহ আদায়ে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এসব বিষয়ে স্পষ্ট কোন প্রতিশ্রুতি ছাড়া বিদ্রোহ করা সম্ভব নয় বলে জানান ।
(৬) শরীফের নিকট ম্যাকমেহনের তৃতীয় পত্র (১৪ ডিসেম্বর ১৯১৫) : এ পত্রে ম্যাকমেহন প্রস্তাবিত আরব রাজ্য হতে মার্সিন ও আদানাকে বাদ দেয়ায় সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন। কিন্তু দামেস্ক, হম্স, হামা ও আলেপ্পো জেলাসমূহের পশ্চিমে অবস্থিত সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল বিশুদ্ধ আরব নয় বলে তিনি যে যুক্তি দিয়ে ছিলেন শরীফ তা খণ্ডন করায় এ অঞ্চলকে আরব রাজ্যের বাইরে রাখার পক্ষে তিনি ফরাসি স্বার্থ জড়িত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন। এ পত্রে অঞ্চলটিকে তিনি আলেপ্পো ও বৈরুত প্রদেশ বলে উল্লেখ করেন। আরব শেখদের সাথে বিদ্যমান চুক্তিগুলির ব্যাপারে ম্যাকমেহন বলেন, শুধু বসরা উপকূল নয় আরবিয় উপদ্বীপের শেখদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিসমূহও বহাল থাকবে। কেননা বৃটিশ সরকার চুক্তিভঙ্গের পক্ষপাতী নয়। বাগদাদ ও বসরা ভিলায়েত সম্পর্কে শরীফ যে প্রস্তাব
দিয়েছেন ম্যাকমেহন তার কোন স্পষ্ট জবাব দেন নি। তবে যুদ্ধের পর এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশক্রমে ম্যাকমেহন শরীফকে জানান যে আরবদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি নেই এমন কোন চুক্তিতে স্বাক্ষর কবরার কোন ইচ্ছা ব্রিটেনের নেই। আরবদের আকাঙ্খার প্রতি সদিচ্ছার সহযোগিতার লক্ষে শরীফের দূতের কাছে ম্যাকমেহন তার পত্রের সাথে বিশ হাজার পাউন্ড প্রেরণ করেন ।
(৭) ম্যাকমেহনের নিকট শরীফের চতুর্থপত্র (১ জানুয়ারী, ১৯১৬) : পত্রের শুরুতে শরীফ বাগদাদ ও বসরা ভিলায়েত সম্পর্কে মনোভাব প্রকাশ করেন। এ সম্পর্কে ম্যাকমেহনের অস্পষ্ট বক্তব্যকে তিনি তার প্রস্তাবের প্রতি মৌন সমর্থন হিসেবে ধরে নেন। এবং বিলায়েত দুটি দখলের বিনিময়ে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ নির্ধারণের ভার ব্রিটেনের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেন। দামেস্ক, হমস, হামা ও আলেপ্পো জেলাসমূহের পশ্চিমে অবস্থিত সিরিয়ার সমুদ্রপোকূল নিয়ে শরীফ কিছুটা সংকটে পড়েন। কেননা গুপ্ত সমিতি সমূহের কেন্দ্রস্থল সিরিয়া সম্পর্কে আপোষ করার স্বাধীনতা তাকে দেয়া হয় নি। তাই এ বিষয়ে তিনি ম্যাকমেহনের প্রস্তাবে সম্মত হন নি। আবার ম্যাকমেহনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে আলোচনায় অচলাবস্থাও সৃষ্টি করেন নি। তিনি বিষয়টি যুদ্ধকালীন সময়ে স্থগিত রাখাই সমীচীন হবে বলে মনে করেন। তাই ম্যাকমেহনকে জানান যে, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যে যাতে সম্পর্কের অবনতি না ঘটে সেজন্য তিনি বিষয়টি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের জন্য স্থগিত রাখতে সম্মত আছেন। তবে ম্যাকমেহনকে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, ফ্রান্স অথবা অন্য কোন শক্তি কর্তৃক সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের এক বিঘা পরিমাণ ভূমি দখলকেও আরবরা মেনে নিবে না। এবং যুদ্ধের পর প্রথম সুযোগেই তিনি ম্যাকমেহনের নিকট এ অঞ্চলটি ফেরত চাইবেন। পত্রের শেষে তিনি অনতিবিলম্বে বিদ্রোহ ঘোষণার অঙ্গীকার করেন। এবং যথাসময়ে অস্ত্রশস্ত্র ও প্রয়োজনীয় রসদ চেয়ে পাঠাবেন বলে জানান ।
(৮) শরীফের নিকট ম্যাকমেহনের চতুর্থপত্র (২৫ জানুয়ারী, ১৯১৬) : এ পত্রে ম্যাকমেহন ইরাক প্রসঙ্গে শরীফের প্রস্তাবটি যুদ্ধ জয়লাভের পর গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যকার সুসম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল সম্পর্কে শরীফের নমনীয় মনোভাবে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি জানান যে যুদ্ধের পরও ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রাখা হবে। যুদ্ধ উপলক্ষে ফ্রান্সের পাশাপাশি এখন আরবরাও বৃটেনের মিত্রে পরিণত হন। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও পারস্পরিক সহযোগিতা তাদের এ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করবে। যা সকলের জন্য শান্তি ও মঙ্গল বয়ে আনবে। তারপর ম্যাকমেহন জানান যে, বিদ্রোহের ব্যাপারে শরীফ কর্তৃক যে কোন সাহায্যের অনুরোধ তাৎক্ষণিকভাবে বিবেচনা করা হবে। এ পত্রের মাধ্যমেই এ্যাংলো-আরব দর কষাকষির অবসান ঘটে। পরবর্তী দুটি পত্রে মূলত বিদ্রোহের প্রস্তুতি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
(৯) ম্যাকমেহনের নিকট শরীফের পঞ্চম পত্র (১৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯১৬) : এ পত্রের মাধ্যমে শরীফ ম্যাকমেহনকে জানান যে, সিরিয়ার তুর্কি শাসনে সেখানকার আরবরা এতটাই অসন্তুষ্ট যে তারা কোন অবস্থাতেই তুর্কি সরকারকে সহযোগিতা করবে না। তিনি আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং পাশ্ববর্তী আরব অঞ্চল যেমন আলেপ্পো ও দক্ষিণ মসুল হতে প্রায় ১,০০,০০০ আরব যুদ্ধার আগমণের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানান। যত দ্রুত সম্ভব সৈন্যদের জন্য তিনি মাসিক ৫০,০০০ পাউন্ড সমমূল্যের স্বর্ণ এবং প্রয়োজনীয় রসদ প্রেরণের অনুরোধ জানান । এছাড়া সৈন্যদের জন্য ২০,০০০ বস্তা চাউল, ১৫,০০০ বস্তা ময়দা, ৩,০০ বস্তা বার্লি, ১৫০ বস্তা কপি, ১৫০ বস্তা চিনি, ৫,০০০ টি রাইফেল এবং ১০০০ বাক্স কার্তুজ প্রয়োজন। বিদ্রৌহ ঘোষণা না করা পর্যন্ত এসব সামগ্রী পোর্ট সুদানের গভর্ণরের নিকট মজুদ রাখার কথা বলা হয়। তবে উল্লেখিত পরিমাণ অর্থ যত দ্রুত সম্ভব পোর্ট সুদানের গভর্ণরের নিকট প্রেরণ করতে তিনি অনুরোধ জানান । একজন বিশ্বস্থ প্রতিনিধি পাঠিয়ে তিনি এ অর্থ সুদানের গভর্ণরের কাছ থেকে সংগ্রহ
করবেন।
(১০) শরীফের নিকট ম্যাকমেহনের পঞ্চম পত্র (১০ মার্চ, ১৯১৬) : বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ম্যাকমেহন শরীফ কর্তৃক দাবীকৃত অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের যৌক্তিকতা স্বীকার করেন এবং ইতোমধ্যেই বৃটিশ সরকার তা অনুমোদন করেছে বলেও জানান। অবশিষ্ট রসদপত্র যত দ্রুত সম্ভব পোট সুদানে জমা করা হবে। এবং শরীফ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্রোহ ঘোষণার পর তা বাস্তবায়ন করা হবে। ম্যাকমেহন জানান যে, আরবের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বেশ কিছু তুর্কি সেনা ঘাঁটি থেকে লোহিত সাগরে ব্রিটিশ নৌ-স্বার্থকে বিপন্ন করার পরিকল্পনা চলছে। ব্রিটিশ সরকার এ ঘাঁটিসমূহ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ আক্রমণের ফলে কোন অবস্থাতেই যাতে নির্দোষ আরবদের বসতগুলো ক্ষতিগ্রস্থ না হয় এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিষয়টি কেন্দ্র করে যাতে কোন প্রকার ভুল বুঝা-বুঝির সৃষ্টি না হয় তাই পূর্ব থেকেই ম্যাকমেহন শরীফকে তা অবহিত করেন। ব্রিটিশ সরকার আরো জানতে পেরেছে যে, শত্রুপক্ষে লোহিত সাগরে মাইন পোঁতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য পেলে পূর্ব থেকেই তা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার অনুরোধ জানান ম্যাকমেহন । এছাড়া ইবনে রশিদ কর্তৃক তুর্কিদের নিকট বিপুল পরিমাণ উট বিক্রির তথ্য ব্রিটেনের নিকট রয়েছে। উটগুলি সিরিয়ার মধ্যে দিয়ে পাঠানোর চেষ্টা চলছে। ম্যাকমেহন আশা করেন যে, শরীফ তার প্রভাব খাটিয়ে ইবনে রশীদকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবেন। তারপরও যদি রশিদ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তাহলে শরীফ যেন সিরিয়ার আরবদের মাধ্যমে উটগুলি দখল করার পদক্ষেপ নেন। শরীফ ম্যাকমেহনের পত্রালাপের মূল বিষয়বস্তু ছিল প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ। শরীফ তার প্রথম পত্রে প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের সীমানা উল্লেখ করেন। ম্যাকমেহনের দ্বিতীয় পত্রে এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব প্রকাশ পায়। এ পত্রে শরীফ কর্তৃক উল্লেখিত আরব রাজ্যের সীমারেখা হতে বেশ
কিছু আরব অঞ্চলকে বাদ দেয়া হয়। বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে শরীফ অঞ্চলগুলিকে আরব রাজ্যভুক্ত করার চেষ্টা করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তা মেনে নেয় নি। শেষ পর্যন্ত শরীফ বাধ্য হয়েই কিছু অঞ্চল আরব রাজ্য হতে বাদ দিতে রাজী হন। এবং কিছু অঞ্চল সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত অমীমাংসিত রেখে ১৯১৬ সালের ৫ জুন তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ।
শরীফ-ম্যাকমেহন পত্রালোপে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ : ফিলিস্তিনকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের সীমানাভুক্ত করা হয়েছিল কিনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এ বিষয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। আরবদের মতে ব্রিটেন কর্তৃক প্রতিশ্রুত আরব রাজ্যের সীমানার মধ্যে ফিলিস্তিনও ছিল। কিন্তু বৃটিশ সরকার জানায়, ফিলিস্তিন বিষয়ে আরবদেরকে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় নি। সাধারণভাবে উভয় পক্ষের এ পরস্পর বিরোধী বক্তব্যকে তখন যাচাই করার কোন উপায় ছিল না। কেননা তখনো পর্যন্ত শরীফ- ম্যাকমেহন পত্রালাপ শুধুমাত্র আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় প্রকাশিত হয় নি। পত্রগুলি সরকারিভাবে প্রকাশের দাবি সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় ব্রিটিশ সরকার তা করে নি। হাউজ অব লর্ডস এবং হাউস অব কমন্সে অনুষ্ঠিত বিতর্কের বিবরণ হতে জানা যায় সে, ব্রিটিশ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও পত্রালাপের বিষয়বস্তু জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি জানান। তাদের মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এ্যাডওয়ার্ড গ্রের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার নির্দেশনায়ই ম্যাকমেহন তার পত্রগুলি রচনা করেছিলেন। ১৯২৩ সালের ২৭ মার্চ হাউস অব লর্ডসে দেয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অন্যান্য উৎস হতে এ পত্রালাপের বিষয়বস্তু প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। তাই যদি প্রকৃতপক্ষেই ব্রিটেনের বক্তব্যের সাথে পত্রালাপের বিষয়বস্তুর অসঙ্গতি থেকে থাকে তাহলে তা গোপন রেখে এবং কোন অসঙ্গতি নেই বলে ঘোষণা দিয়ে ব্রিটেনের মর্যাদা রক্ষা করা যাবে না। পত্রগুলি প্রকাশ করে যুদ্ধের সময় আরবদের প্রতি ব্রিটেনের অঙ্গীকারসমূহ জনগণকে অবহিত করাই হবে সম্মানজনক কাজ। যদি
১. কোন অসঙ্গতি থেকে থাকে তাহলে তিনি তা অকপটে স্বীকার করে কতটুকু অসঙ্গতি রয়েছে তা নির্ণয় করার মাধ্যমে সমস্যাটির ন্যায্য ও সম্মানজনক সমাধান দাবি করেন ৷
তবে সমসাময়িক আরবরা পত্রলাপের বিষয়বস্তু সম্পর্কে শুরু থেকেই অবহিত ছিল। কেননা যুদ্ধের সময় শরীফ-ম্যাকমেহন পত্রালাপের সার সংক্ষেপ সরকারিভাবে প্রকাশ করে তা আরবদেরকে অবহিত করেন। এছাড়া আরবিতে প্রকাশিত তৎকালীন সংবাদ পত্রগুলিতে ও পত্রালাপের সার সংক্ষেপ প্রকাশিত হয়। কিন্তু পত্রালাপের সারসংক্ষেপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফিলিস্তিন বিষয়ে কোন চূড়ান্ত মন্তব্য করা সম্ভব ছিল না। এছাড়া ব্রিটেনের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষের নিকট মধ্যপ্রাচ্যে আরবিতে প্রকাশিত ও সার সংক্ষেপটুকু সহজলভ্য ছিল না। তাই ব্রিটিশ সরকারের অসম্পূর্ণ এবং অস্পষ্ট বক্তব্যই ছিল এ সম্পর্কে জানার একমাত্র উৎস। বৃদ্ধ ও ভগ্ন স্বাস্থ্য শরীফ হুসেইন প্যারিস শান্তি সম্মেলনে প্রতারিত হয়ে এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন যে, পত্রগুলির ইংরেজী অনুবাদ করে তা যথাযথভাবে প্রচার করার কোন উদ্যমই তার ছিল না। তবে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় এক যুগ পর এবং তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পূর্বে ১৯৩১ সালে শরীফের অনুরোধে বিখ্যাত ঐতিহাসিক জর্জ এ্যান্টেনিয়াস এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্য সম্পাদন করেন। ম্যাকমেহনের নিকট তার প্রেরিত পত্রগুলি তিনি এন্টোনিয়াসকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনুলিপি করার অনুমতি দেন। তারও প্রায় ৭ বছর পর এ্যান্টোনিয়াসের গ্রন্থে পত্রগুলি প্রকাশিত হয় । এবং এ বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সুযোগ উন্মোচিত হয় ।
এ পত্রগুলির যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই কেবল ফিলিস্তিন বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এবং এর ফলে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব। মজার ব্যাপার হল, এ পত্রালাপের কোথায়ও ফিলিস্তিন শব্দটির উল্লেখ নেই। ওসমানিয় প্রশাসন ব্যবস্থায় জেরুজালেম ছিল সিরিয়ার অন্তর্গত একটি সানজাক বা জেলা। পূর্বতন ও জেরুজালেম জেলার অন্তর্ভুক্ত ভূ-খণ্ড নিয়েই মূলত বর্তমান ফিলিস্তিন গঠিত । পত্রালাপে ম্যাকমেহন যেসব এলাকাকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্য থেকে বাদ দেয়ার কথা বলেন তার মধ্যে পরোক্ষভাবেও জেরুজালেমের নাম উল্লেখ করেন নি। এ প্রসঙ্গে শরীফের নিকট ম্যাকমেহনের দ্বিতীয় পত্রে উল্লেখিত দামেস্ক, হমস্, হামা ও আলেপ্পো জেলাসমূহের পশ্চিমে অবস্থিত সিরিয়ার ভূ-খণ্ড সম্পর্কিত বাক্যাংশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকারের বক্তব্য হল এ বাক্যাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে ম্যাকমেহন যেসব অঞ্চল প্রস্তাবিত আরব রাজ্য থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে ফিলিস্তিনও ছিল। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের কথা না থাকলেও ফিলিস্তিন যে আরব রাষ্ট্রের বাইরে থাকবে তার ইঙ্গিত এ বাক্যাংশে ছিল। ১৯২২ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল এ বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, ফিলিস্তিন বিষয়ে আরবদেরকে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় নি। তিনি যুক্তি দেখান যে, বাক্যাংশটিতে ব্যবহৃত districts শব্দটি দিয়ে আরবি Vilayets-কে বুঝানো হয়েছে। ম্যাকমেহনের বাক্যাংশে দামেস্কের পশ্চিমে
অবস্থিত সিরিয়া ভূখণ্ড বলতে ফিলিস্তিনকেই বুঝানো হয়েছিল। এবং এ ভূ-খণ্ডকে আরব রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে তার আপত্তি ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন সমস্যা যখন প্রকট আকার ধারণ করে তখন আরবরা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে শরীফ-ম্যাকমেহন পত্রালাপে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ আনে। এবং ব্রিটেনকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করে। ব্রিটেনের বিরদ্ধে উত্থাপিত এ অভিযোগ খণ্ডন করার উদ্দেশ্যেই সম্ভবত চার্চিল এ যুক্তি প্রদর্শন করেন ।
কিন্তু বাক্যাংশটি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করলে চার্চিলের এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। প্রথমত, আরবি শব্দ ভিলায়েতের অর্থ হচ্ছে প্রদেশ, যা কোনভাবেই ইংরেজি District এর প্রতিশব্দ নয়। বরং District-কে আরবি শব্দ সানজাক বা জেলার প্রতিশব্দ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। দ্বিতীয়তঃ ম্যাকমেহন কর্তৃক ব্যবহৃত এ বাক্যাংশে Districts শব্দটি Vilayets বুঝাতে যে ব্যবহৃত হয় নি তারও প্রমাণ রয়েছে। কেননা দামেস্ক, হমস, হামা নামে কোন ভিলায়েত ছিল না। তখন সিরিয়া ভিলায়েত নামে একটি মাত্র ভিলায়েত ছিল। যা আরবীতে ভিলায়েত আস-সূরীয়া নামে পরিচিত ছিল। দামেস্ক ছিল এ ভিলায়েতের রাজধানী। আর হমস ও হামা ছিল ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিট ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। সুতরাং, ম্যাকমেহনের ব্যবহৃত Districts শব্দটিকে একমাত্র “জেলাসমূহের” শব্দের সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করলেই বাক্যাংশটি অর্থপূর্ণ হয়। এর ফলে উল্লেখিত চারটি শহর সংলগ্ন সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চল বুঝায় যা সাইদন থেকে আলেকজান্দ্রাত্তা পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু চার্চিল দামেস্ক শহরটিকে সিরিয়া ভিলায়াতের সমার্থক বিবেচনা করে আকাবা পর্যন্ত বিস্তৃত এ প্রদেশের পশ্চিমাংশকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্য হতে বাদ দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। ফলে জর্ডান নদীর পশ্চিমে অবস্থিত ফিলিস্তিন ও প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের বাইরে ছিল বলে যুক্তি দেখান, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া শরীফের নিকট প্রেরিত তার তৃতীয় পত্রে ম্যাকমেহন এ অঞ্চলকে আলেপ্পো ও বৈরুত ভিলায়েত হিসেবে উল্লেখ করে একে প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের বাইরে রাখার ব্যাপারে যুক্তি উপস্থাপন করেন। যদি ফিলিস্তিনকেও আরব রাজ্যের বাইরে রাখার ইচ্ছা থাকত তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আলেপ্পো ও বৈরুত ভিলায়েতের সাথে জেরুজালেম সানজাকের কথাও উল্লেখ করতেন । তৃতীয়ত, ম্যাকমেহন তার দ্বিতীয় পত্রে উল্লেখিত অঞ্চলে ফ্রান্সের স্বার্থ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ফ্রান্সের স্বার্থ জড়িত ছিল শুধুমাত্র সিরিয়া ও লেবাননে। যে কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সিরিয়া ও লেবাননে ফরাসি ম্যান্ডেটরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর যুদ্ধের পর ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসনাধীনে । বৃহত্তর সিরিয়ার অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনের উপর ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগ্রহ থাকলেও এ অঞ্চলে তার বিশেষ কোন স্বার্থ জড়িত ছিল না। আর বৃটিশ কর্তৃপক্ষও ফ্রান্সকে অঞ্চলটি দিতে প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং, চার্চিলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ম্যাকমেহন যদি বাক্যাংশটির মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্য থেকে বাদ দেয়ার কথা বুঝাতেন তাহলে সঙ্গত কারণেই ফরাসি স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার কারণে যুদ্ধের পর তা ফ্রান্সের দখলে যাওয়ার কথা ছিল ।
ফিলিস্তিন বিষয়ে শরীফ ম্যাকমেহন পত্রালাপের যথাযথ ব্যাখ্যা করার সুযোগ আসে অনেক পরে। ইতোমধ্যেই ব্রিটিশ যুক্তির উপর ভিত্তি করে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ফিলিস্তিনকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্যে থেকে বাদ দেয়া হয়। আর এ সিদ্ধান্তের ফলে পরবর্তীতে আরব ও ইহুদীদের মধ্যে বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। যখন এ পত্রালাপ সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশিত হয় তখন ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে তা কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে নি। তবে একটি ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচিত্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পত্রগুলি প্রকাশিত হওয়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত