বেলফোর ঘোষণা: ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আলোচনা কর

ব্যালফোর ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে জয়লাভের উদ্দেশ্যে ব্রিটেন যুদ্ধকালীন গোপন চুক্তিগুলি সম্পাদন করে। আর এ গোপন চুক্তির মাধ্যমেই ব্রিটেন, রাশিয়া, ইতালি, ফ্রান্স ও আরবদের মিত্রতা অর্জন করে। ব্রিটেনের বিশ্বাস ছিল যে, জাইয়নবাদীদের সাথে একটি সমঝোতায় পৌছাতে পারলে গোটা বিশ্বের ইহুদি সম্প্রদায় ও তার মিত্রে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে ব্রিটেন সীমাহীন কূটকৌশলের আশ্রয় নেয় ।
ব্যালফোর ঘোষণার ঐতিহাসিক পটভূমি :
জাইয়নবাদী আন্দোলন : বেলফোর ঘোষণার পশ্চাতে জাইয়নবাদী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দীর্ঘ দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসের সময় ফিলিস্তিনে প্রর্তাবর্তনের বিষয়ে ইহুদিরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের এক অংশের মতে কোরনরূপ প্রচেষ্টা ছাড়াই ঈশ্বরের ইচ্ছায় একদিন তারা ফিলিস্তিনে ফিরে যাবে। তারা মনে করে ঈশ্বর যেমন তাদের পূর্ব পুরুষ আব্রাহামকে পথ দেখিয়ে কেনান দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন ঠিক তেমনি ঈশ্বরের প্রত্যাদেশে তারাও একদিন ফিলিস্তিনে ফিরে যাবে। আর অন্য দলের মতে ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনের জন্য ইহুদিদের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শেষোক্ত মতবাদের অনুসারীরাই জাইয়নবাদী নামে পরিচিত। জেরুজালেমের রাজা ডেভিড ও সলোমনের মন্দিরের নিকট অবস্থিত জাইয়ন পাহাড়ের নামানুসারে জাইয়নবাদ শব্দটি এসেছে। উনিশ শতকের শেষদিকে এ জাইয়নবাদী আন্দোলনের সূচনা পূর্ব ইউরোপ থেকে বিশেষত রাশিয়া ও পোল্যান্ড থেকে ইহুদিদের ক্রমাগত ফিলিস্তিনে আগমণের ফলে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পটভূমি রচিত হয় ।
জাইয়নবাদ ছিল একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল বার্লিনে। সেখান থেকে তারা ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনে ওসমানিয় সরকারের অনুমতি আদায়ের চেষ্টা করে। এজন্য তারা তুরস্কের সুলতানের ঘনিষ্ঠ মিত্র জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের সাহায্য প্রার্থনা করে । কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তুরস্কের সুলতান আব্দুল হামিদ আরবদের বিরোধীতার আশঙ্কায় ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন নি। নব্য তুর্কিরা জাইয়নবাদীদের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করলেও ১৯১২ সালে আরবদের প্রচণ্ড বিরোধীতার মুখে তারাও জাইয়নবাদীদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে এ আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। কেননা যুদ্ধের সময় এ আন্দোলন মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির দেশগুলি সরকারি নীতি দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। ফলে যুদ্ধরত দেশগুলির মত জাইয়নবাদীরাও পরস্পর বিরোধী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ব জাইয়নবাদী সংস্থার সদর দফতর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বার্লিনে। জাইয়নবাদী সংস্থার নীতি
নির্ধারণী সংগঠন “Inner Action Committee” প্রকাশ্যে জার্মানির পক্ষাবলম্বন করা ভবিষ্যত জাইয়নবাদী আন্দোলনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। Inner Action Committee কোপেন হেগেন থেকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করলেও বার্লিনে অবস্থিত জাইয়নবাদী সংস্থার প্রধান কার্যালয় ছিল একেবারেই নিষ্ক্রিয়। তাই নিউইয়র্কে একটি বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠান করে জাইয়নবাদীরা স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় সিদ্ধান্ত নেয়। এবং এ সংস্থার সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে একটি অস্থায়ী কার্যকরী পরিষদ গঠন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক লুই ডেমবিজ ব্রান্ডাইস এবং জ্যাকব ডিহ্যাস যথাক্রমে এ পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যুদ্ধের সময় ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক ডঃ ওয়াইজম্যানের নেতৃত্বে ব্রিটেনে জাইয়নবাদীরা অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠে।
ড. ওয়াইজমান
আর্থার জেমসম ব্যালফোর
লর্ড রথশ্চাইল্ড
ড. ওয়াইজম্যান ও জাইয়নবাদী আন্দোলনের ঘটনাসমূহ : রাশিয়ান বংশোদ্ভূত ড. ওয়াইজম্যান ১৯০৪ সালে ইংল্যাণ্ডে আসেন। ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আর্থার বেলফোরের সাথে তার আলোচনা হয়। ১৯০২ সালে ব্যালফোর যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তার উপনিবেশ মন্ত্রী জোসেফ চেম্বার লেইন জাইয়নবাদী নেতা থিওডর হার্জলকে উগান্ডায় ইহুদী বসতি স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু জাইয়নবাদীরা এতে সম্মত হয় নি। ১৯০৬ সালে বেলফোর যখন ম্যানচেষ্টার থেকে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তখন তিনি উগান্ডায় বসতি স্থাপনে সম্মত না হওয়ার কারণ জানতে চান। আর এ উদ্দেশ্যেই তিনি ড. ওয়াইজম্যানের সাথে আলোচনা করেন। ড. ওয়াইজম্যানের আত্মজীনীমূলক বিখ্যাত গ্রন্থ “Trialand Error”-এ ব্যালফোরের সাথে কথোপকথনের বর্ণনা রয়েছে। এ কথোপকথনটি নিম্নে তুলে ধরা হল ।
Then suddenly I said. "Mr. Balfour, supposing I were to offer you Paris instead of London, Would you take it ?" He sat up, looked at me, and answered: "But, Dr. Weizman, we have London." "That is true.” I said, But we had Jerusalem when London was a marsh.” He leaned back, continued to stare at me, and said two things which I remember vividly. The first was: "Are there many Jews who think like you?" I answered: "I believe I speak the mind of millions of Jews whom you will never see and who can not speak for them- selves, but with whom I could pave the street of the country I come from." To this he said: "If that is so you will one day be a force." Shortly before I withdrew, Balfore said, “It is curious. The Jews I meet are quite different." I answered: "Mr Balfour, you meet the wrong kind of Jews."
জাইয়নবাদ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব জানার ক্ষেত্রেও কথোপকথনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিতে জাইয়নবাদীরা তখনও দর কষাকষির মত অবস্থায় পৌঁছায় নি। এমনকি তখন জাইয়নবাদের প্রতি সাধারণ ইহুদীদের সমর্থন সম্পর্কেও ব্রিটিশ সরকার সন্দিহান ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাইয়নবাদীদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের এ মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। এ সময় ড. ওয়াইজম্যান কৃত্রিম উপায়ে এসিটোন (আলো থেকে বিস্ফোরক তৈরীর উপাদান) উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করে বৃটেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এবং জাইয়নবাদীদের দাবি-দাওয়ার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। Inner Action Committee ড. ওয়াইজম্যানের প্রকাশ্যে ব্রিটিশ ঘেষানীতির সমালোচনা করে। ড. ওয়াইজম্যান এতে কর্ণপাত না করে তার নীতিতে অটল থাকেন। বরং স্বাধীনভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুবিধার্থে তিনি কোপেন হেগেন ব্যুরোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এ সময় তিনি নাহুম সকোলো (Nahum Sokolow) ও জোইয়েল সলেনো (Jehiel Tschlenow) নামে দুজন বিখ্যাত ইউরোপীয় জাইয়ানবাদীর সমর্থন লাভ করেন। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের জাইয়নবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল মিত্রশক্তির কাছ থেকে এ মর্মে একটি নিশ্চয়তা আদায় করা যে, যুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হলে ফিলিস্তিনকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। এবং অবাধে ইহুদি অভিবাসনের জন্য ফিলিস্তিনের সীমান্ত খুলে দেয়া হবে। এ উদ্দেশ্যে ওয়াইজম্যান ব্রিটেনের বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির সহানুভূতি ও সহযোগিতা লাভ করেন। এদের মধ্যে ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদক সিপিস্কট ও সামরিক রিপোর্টার হার্বাট সাইডবোথাম “ব্রিটিশ প্যালেস্টাইন কমিটি” গঠনে সহায়তা করে ।
এছাড়াও স্যার হার্বাট স্যামুয়েল, লর্ড রথশ্চাইল্ড এবং লর্ড আর্থার ব্যালফোরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাইয়নবাদীরা ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্যার হার্বাট স্যামুয়েলের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতি অর্জনের প্রচেষ্টা চালায় । কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হার্বাট হেনরী আসকুইথের পক্ষ থেকে সহযোগিতার কোন আশ্বাস পাওয়া যায় নি ।
১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে আসকুইথ মন্ত্রীসভার পতন ঘটে এবং লয়েড জর্জের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। লর্ড ব্যালফোর নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ড. ওয়াইজম্যান সরকারি পর্যায়ে আলোচনায় বেশ অগ্রগতি লাভ করেন। ১৯১৭ সালের শুরুতে মিত্রশক্তির পক্ষ থেকে মার্ক সাইকসকে বিশ্ব জাইয়নবাদী সংস্থার প্রতিনিধি নাহুম সকোলের সাথে আলোচনার দায়িত্ব দেয়া হয়। জাইয়নবাদীদের সাথে আলোচনায় তিনি সাইকস- পিকো চুক্তির কথা গোপন রাখেন। জাইয়নবাদীরা জর্জ পিকোর সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তিনিও সাইকস-পিকো চুক্তি অনুযায়ী জাইয়নবাদীদের দাবির বিরোধীতা করেন নি। ড. ওয়াইজম্যান প্যারিসের জাইয়নবাদীদের মাধ্যমে সাইকস-পিকো চুক্তি সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবগত ছিলেন। কিন্তু মার্ক-সাইকস এবং জর্জ পিকো দুজনের কেউ যখন এ চুক্তির কথা উল্লেখ করেন নি তখন তিনি বরং নিরব থেকে তাদের কাছ থেকে জাইয়নবাদীদের দাবির পক্ষে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেন। সাইকসের সাথে আলোচনায় জাইয়নবাদীরা ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করার দাবী জানায়। এর মাধ্যমেই নিশ্চিতভাবে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে বলে তারা মনে করেন। কিন্তু তাদের এ দাবি ছিল সাইকস-পিকো চুক্তির ফিলিস্তিন বিষয়ক ধারাটির পরিপন্থী, যা মেনে নিলে ব্রিটিশ সরকারকে আরেকটি পরস্পর বিরোধী প্রতিশ্রুতি প্রদান করতে হতো । তাই ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি বসবাসের দাবী মেনে নিলেও ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করার পক্ষপাতী ছিল না ।
জাইয়নবাদীদের প্রতি জোর মার্কিন সমর্থন : ১৯১৭ সালের মে মাসে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের উপদেষ্টা ও জাইয়নবাদী নেতা বিচারপতি ব্রান্ডাইসের সাথে সাক্ষাত করেন। জাইয়নবাদীদের কোন প্রতিশ্রুতি প্রদানের পূর্বে এ ব্যাপারে বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন লাভ করতে চেয়েছিল। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জাইয়ানবাদীরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তারা সরকারের নিকট থেকে তাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য জোরালো আবেদন জানায়। তাদের এ আবেদন বিফলে যায় নি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম জে. ব্রায়ান, যুদ্ধমন্ত্ৰী নিউটন, ডি. বেকার, নৌমন্ত্রী যোসেফাস দানিয়েলস সহ যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জাইয়নবাদীদের দাবীর প্রতি জোর সমর্থন জানায়। বিচারপতি ব্রান্ডাইস সহ অন্যদের সাথে আলোচনায় প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন শুধু জাইয়নবাদকে সমর্থন করেন নি, তিনি নিজেকেও একজন জাইয়নবাদী বলে উল্লেখ করেন। জাইয়নবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট উইলসনের পক্ষ থেকে জাইয়নবাদের পক্ষে একটি প্রকাশ্য বিবৃতি লাভ করা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু
“ তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নি সেহেতু উইলসন এ ধরনের কোন বিবৃতি
প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন ।
তবে ১৯১৭ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি তার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা কর্ণেল এডওয়ার্ড হাইসকে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা কর্তৃক জাইয়নবাদীদের পক্ষে প্রণীত খসড়া ঘোষণা পত্রটি অনুমোদনের নির্দেশ দেন। এর ফলে ঘোষণাটি প্রদানের ক্ষেত্রে বৃটিশ সরকারের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনাটি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড. ওয়াইজম্যান তার “Trial and Error”-নামক আত্মজীবনীতে লিখেন, “This is one of the most important individual fac- tor in breaking the deadlock created by the British Jewish anti Zionists, and in deciding the British Government to issue its declar- tion.” ব্রিটেনের প্রভাবশালী ইহুদিরা ড. ওয়াইজম্যান এবং তার জাইয়নবাদী আন্দোলনের প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছিল। বিখ্যাত ইহুদি পরিবারের সদস্য ও ভারত সচিব এডউন মন্টেগু জাইয়নবাদীদের পক্ষে ব্রিটিশ সরকারের কোন প্রকার ঘোষণার তীব্র বিরোধীতা করেন। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর সহ প্রভাবশালী ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা ঘোষণাটি প্রদানের মাধ্যমে জাইয়নবাদীদের প্রতি ন্যায় বিচার করার পক্ষপাতি ছিলেন।
ব্রিটিশ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় : এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ১৯১৭ সালে সংঘটিত দুটি ঘটনা জাইয়নবাদীদের উদ্দেশ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। প্রথমত, বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যহার করে নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এর ফলে পূর্ব রণাঙ্গনে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধরত বিপুল সংখ্যক জার্মান সেনা পশ্চিম রণাঙ্গনে নিয়োজিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই রাশিয়াকে যুদ্ধে ব্যাপৃত রাখতে এবং জার্মানির সাথে কোন প্রকার শান্তি চুক্তি সম্পাদন করা থেকে বিরত রাখতে মিত্রশক্তি ছিল বদ্ধপরিকর। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালাফোর জাইয়নবাদীদের আশা-আকাঙ্খার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করার মাধ্যমে রাশিয়ার বিপ্লবে প্রভাবশালী ইহুদিদের সন্তুষ্ট করে রাশিয়াকে আরো কিছুকাল যুদ্ধে ব্যাপৃত রাখার নীতি অবলম্বন করেন। যদিও পূর্ব রণাঙ্গনে রাশিয়াকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণাটি প্রদান করে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এ ঘোষণা রাশিয়ার যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি নেয়াকে প্রলম্বিত করতে পারে নি। কেননা বলশেভিক বিপ্লবের নেতৃত্বস্থানীয় ইহুদিরা ছিলেন জাইয়নবাদ বিরোধী। বৃটেনের এ ঘোষণা তাদের মনোভাবকে পরিবর্তন করতে পারে নি। ব্যালফোর ঘোষণার মাত্র এক মাস পর সোভিয়েত সরকার জার্মানির সাথে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে আলোচনা শুরু করে এবং ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে ‘ব্রেষ্ট লিটভাস্ক' চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে যুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। আর এ চুক্তি সম্পাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বলশেভিক ইহুদি

নেতা ট্রটস্কি। দ্বিতীয়ত প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকলেও মিত্রশক্তির প্রতি সহানভূতিশীল ছিল। জার্মানীর ক্রমাগত ডুবো জাহাজ আক্রমণের শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ১৯১৭ সালের ৬ এপ্রিল জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । ব্রিটেন তার নতুন মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ণাঙ্গভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এক্ষেত্রেও ব্রিটেন ঘোষণাটির মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনের প্রভাবশালী ইহুদিদের সন্তুষ্ট করে প্রেসিডেন্ট উইলসনকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা চালায়। অধিকন্ত ব্রিটেন মনে করে, জাইয়নবাদীদের অনুকূলে একটি ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে জার্মানির ইহুদিদেরও সহানুভূতি অর্জন করা সম্ভব। আর এর মাধ্যমে অক্ষ শক্তির অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করা যাবে।
এছাড়াও ঘোষণাটি প্রদানের পিছনে আরো কিছু কারণ বিদ্যমান ছিল । এ সময় কিছু মানবতাবাদী খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দের মনে নির্যাতিত এ জাতিটির প্রতি সহানভূতি সৃষ্টি হয়। তাই ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ইহুদিদের ফিলিস্তিনে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টাকে তারা সমর্থন জানায়। ঘোষণাটি প্রদানের পিছনে সরকারের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থও দায়ী ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষায় সুয়েজ খালের অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত থেকে সৈন্য ও রসদ পরিবহনে এ পথের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাই সুয়েজ খালকে ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এ অঞ্চলে ব্রিটেনের অনুগত একটি সরকারের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে আরবদের তুলনায় পাশ্চাত্য মনোভাবসম্পন্ন ইহুদিদের প্রতিই ব্রিটেনের আস্থা ছিল বেশী। ব্যালফোর ঘোষণা অনুযায়ী ফিলিস্তিনে ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ব্রিটেনের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ এ অঞ্চলে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকবে বলে ব্রিটেন মনে করেছিল। ঘোষণাটি প্রদানের পূর্বেই ব্রিটেন তার প্রতি জাইয়নবাদীদের আনুগত্যের প্রমাণ পায়। জাইয়নবাদী নেতা ভ্লাদিমির ঝাবোতিনস্কি ও পিনকার্স রুথেনবার্গের পরামর্শক্রমে ড. ওয়াইজম্যান ১৯১৭ সালের আগস্ট মাসে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য ইহুদিদের সমন্বয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন। সিরিয়া ও ফিলিস্তিন বহিষ্কৃত ইহুদি এবং ইউরোপ ও আমেরিকার জাইয়নবাদীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী কর্ণেল পেটারেসনের নেতৃত্বে জেনারেল এলেনবীর সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র ইউনিট হিসেবে গ্যালিপলি ও মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে ।
ব্যালফোর ঘোষণা : ইতোমধ্যে জাইয়নবাদীদের প্রণীত একটি খসড়া ঘোষণাপত্র ব্রিটিশ মন্ত্রীসভায় উত্থাপিত হয় এবং দীর্ঘ বিতর্কের পর ১৯১৭ সালের ৩০ অক্টোবর তা অনুমোদন লাভ করে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী লর্ড ব্যালফোর একটি পত্রের মাধ্যমে রথশ্চাইল্ডকে বিষয়টি অবহিত করেন। যা ইতিহাসে বিখ্যাত ব্যালফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ :
প্রিয় লর্ড রথশ্চাইল্ড,

আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাচ্ছি যে, জাইয়নবাদীদের আশা-আকাঙ্খার প্রতি সহানুভূতিশীল নিম্নের ঘোষণাটি ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার নিকট পেশ করা হয়েছে এবং মন্ত্রীসভা তা অনুমোদন করেছে ।
ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন রয়েছে। এবং এ লক্ষ্য অর্জনে ব্রিটিশ সরকার সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। এর ফলে ফিলিস্তিনে বসবাসকারি ইহুদি নয় এমন সম্প্রদায় সমূহের নাগরিকও ধর্মীয় অধিকার এবং অন্যান্য দেশের ইহুদিদের অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে না ।
আপনি যদি ঘোষণাটি জাইওনিস্ট ফেডারেশনকে অবহিত করেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকব ।
আপনার একান্ত,
আর্থার জেমস ব্যালফোর
৯ নভেম্বর দি টাইমস প্রত্রিকায় ঘোষণাটি প্রকাশিত হলে তা সাধারণ মানুষের গোচরীভূত হয়। যথাসময়েই ঘোষণাটি দেয়া হয়েছিল। কেননা ঘোষণাটি দেয়ার অল্প কিছুকাল পরেই (ডিসেম্বর, ১৯১৭ এবং জুলাই ১৯১৮) জার্মান জাইয়নবাদীদেরকে ফিলিস্তিনে একটি চাটার্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়ে তুরস্ক এবং জার্মানী ইহুদিদের সমর্থন লাভ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাধারণভাবে মিত্র শক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল ইহুদিদের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য ততদিনে অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল। যাহোক ঘোষণাটির মাধ্যমে ব্রিটেনে জাইয়নবাদীদের কাজ শেষ হয়। এরপর তারা ঘোষণাটির প্রতি মিত্রশক্তির অন্য দেশগুলোর সহানুভূতি আদায়ের প্রচেষ্টা চালায়। তাদের এ প্রচেষ্টাও দ্রুত সাফল্যের মুখ দেখে। ১৯১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ইতালি ঘোষণাটি অনুমোদন করে। ২৯ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ইহুদি ধর্মযাজক (Rabbi) স্টিফেন এস. ওয়াইজকে এক পত্রের মাধ্যমে ঘোষণাটির প্রতি তার সমর্থনের কথা জানান ৷ একইভাবে জাইয়ানবাদীদের ভাগ্য মিত্র শক্তির জয়পরাজয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। তারা মিত্র শক্তির আনুষ্ঠানিক মিত্রে পরিণত হয়। যুদ্ধে মিত্র শক্তির জয়ের পেছনে তাদের কতটুকু ভূমিকা ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে জাইয়নবাদীরা যে বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের মনোভাব ও সমর্থন মিত্রশক্তির পক্ষে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই ।
ব্যালফোর ঘোষণার সংবাদ শরীফ হুসাইনের নিকট পৌছা মাত্রই তিনি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট এর ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠান। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কায়রোতে অবস্থিত আরব ব্যুরোর কমান্ডার ডেভিড জর্জ হোগার্থের মাধ্যমে শরীফকে ব্রিটিশ মনোভাব সম্পর্কে অবহিত করে। ১৯১৮ সালের ৪ জানুয়ারী হোগার্থ জেদ্দা সফর করেন এবং হুসেইনকে অবহিত করেন যে, ফিলিস্তিনে বসবাসকারী জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সঙ্গতি রেখেই ব্রিটিশ ইহুদিদের ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে এবং ঘোষণাটির কোথায়ও ইহুদি রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা হয় নি। মৌখিকভাবে প্রদত্ত এ ব্যাখ্যায় হোগার্থ ব্যালফোর ঘোষণায় উল্লেখিত “সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার” ব্যাকাংশটির বদলে “রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার” বাক্যাংশটি ব্যাবহার করেন। শরীফ হুসেইন একটি অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে যুদ্ধের পর বিষয়টির সমাধান করবেন বলে মন্তব্য করেন।
ব্যালফোর ঘোষণার সমালোচনা : ব্যালফোর ঘোষণাকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে । ব্যালফোর ঘোষণাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। কেননা জাইয়নবাদীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধকালীন প্রয়োজনীয়তার কারণেই ব্যালফোর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘোষণাটিতে বিদ্যমান বেশ কিছু অস্পষ্টতা পরবর্তী সময়ে বেশ জটিলতার সৃষ্টি করে।
১। ঘোষণার শুরুতেই জাইয়নবাদীদের আশা-আকাঙ্খার (Zionists aspirations) প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতি ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু জাইয়নবাদীদের আশা-আকাঙ্খাগুলিকে একত্রিত করে প্রকাশ করে নি। তাদের দাবী-দাওয়াগুলি থেকে এ সম্পর্কে একটি অনুমান করা যায় মাত্র। এমন একটি বিভ্রান্তিকর বিষয়ের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতির ঘোষণা সত্যিই বিস্ময়কর ।
২। জাইয়নবাদীদের খসড়া ঘোষণাপত্র থেকে ব্যালফোর ‘জাতীয় আবাসভূমি' (Natonal Home) শব্দ গুচ্ছটি গ্রহণ করেন এবং তা চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেন। ১৯১৭ সালে অনেকের কাছেই শব্দ গুচ্ছটি ছিল নতুন এবং এর কোন প্রতিষ্ঠিত অর্থ ছিল না। ব্যালফোর শব্দ গুচ্ছটির এ অস্পষ্টতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। কেননা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্রের ঘোষণা ব্রিটিশ মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করানো কঠিন হত। এছাড়া ব্যালফোরকে জাইয়ানবাদ বিরোধী ইহুদি সম্প্রদায় এবং আরবদের বিরোধীতার কথাও ভাবতে হয়েছিল । কিন্তু জাতীয় আবাসভূমি' বলতে কি ফিলিস্তিনে ইহুদি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র, নাকি আরবদের নিয়ন্ত্রণে ইহুদিদের স্বায়ত্তশাসন, তা স্পষ্ট নয় ৷
৩। কেউ কেউ সমালোচনা করে থাকেন, ব্যালফোর ঘোষণায় ফিলিস্তিনের কতটুকু ভূ-খণ্ড নিয়ে ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠিত হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ইঙ্গিত নেই। ইহুদি আবাসভূমিটি কি গোটাফিলিস্তিন নিয়ে গঠিত হবে নাকি এর অংশ বিশেষে গঠিত হবে সে ব্যাপারে কিছু বলা হয় নি। কিন্তু বক্তব্যটি সঠিক নয়। ঘোষণা পত্রটির একটি খসড়া লর্ড রথশ্চাইল্ড পত্রের মাধ্যমে ব্যালফোরের নিকট প্রেরণ করেন। ব্যালফোর তা অনুমোদনের জন্য ব্রিটিশ মন্ত্রীসভায় পেশ করলে
ভারত সচিব মন্টেগু এর তীব্র বিরোধীতা করেন। তার বিরোধীতার কারণেই খসড়া ঘোষণাপত্রটিতে ভাষাগত পরিবর্তন আনা হয়। ফলে চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রে' Palestine should be reconstituted as the national home of the Jewish people.” বাক্যাংশটির বদলে ‘The establishment in Plaestine of a national home for the Jewish people.” বাক্যাংশটি ব্যবহৃত হয়। চূড়ান্ত বাক্যাংশটিতে ব্যবহৃত ‘in’ শব্দ দ্বারা সমগ্র ফিলিস্তিন নয় বরং ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার কথা বুঝানো হয়েছে ।
৪। ঘোষণাটির শেষাংশে ইহুদি নয় এমন সম্প্রদায়সমূহ' (Non Jewish Communities) শব্দ গুচ্ছটি ছিল অপমানজনক। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবদেরকে শুধু তাচ্ছিল্যই করা হয় নি বরং ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ যখন ঘোষণাটি প্রদান করা হয় তখন ফিলিস্তিনের বসবাসকারী জনসংখ্যার শতকরা ৯১ ভাগ ছিল আরব। আর ইহুদি ছিল শতকরা মাত্র ৯ ভাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ও খ্রিস্টান আরবদের নাম উল্লেখ না করে তাদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করা হয় ।
৫। আরবদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকারের প্রতি নিশ্চয়তাটিও ছিল খুবই ত্রুটিপূর্ণ। কেননা এখানে নাগরিক অধিকার শব্দ গুচ্ছটির অর্থ স্পষ্ট করা হয় নি। যে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরবরা শতাব্দী ব্যাপী সংগ্রাম করে যাচ্ছে এবং তা অর্জনের জন্য ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। নাগরিক অধিকার শব্দ গুচ্ছটির মাধ্যমে আরবদের সে রাজনৈতিক অধিকারের মর্যাদা দেয়া হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয় । অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের রাজনৈতিক মর্যাদা সহ সকল প্রকার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে নাগরিক অধিকারের মত অস্পষ্ট শব্দ গুচ্ছ ব্যবহার করা হয় নি। বরং রাজনৈতিক, অধিকার' শব্দটির বদলে রাজনৈতিক ‘মর্যাদা' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট ছিল না। তাই বিদ্যমান রাজনৈতিক মর্যাদা বজায় রাখার পক্ষে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের ফিলিস্তিনে যেতে বাধ্য করা অথবা ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ইহুদি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে ভোটাধিকার সহ-অন্যান্য রাজনৈতিক অধিকার হরণ করার সুযোগ বন্ধ হয়। অথচ ব্যালফোর ঘোষণা প্রদান করার পূর্বে ওয়াইজম্যান এমন একটি ধারণার সৃষ্টি করেছিলেন যে, গোটা বিশ্বের ইহুদি সম্প্রদায় ফিলিস্তিনে ফিরে যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ।
ব্যালফোর ঘোষণাটি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গৃহীত কোন আকস্মিক পদক্ষেপ ছিল না। ৬৭ শব্দ বিশিষ্ট ঘোষণাটির প্রতিটি শব্দ চয়ন ছিল দীর্ঘ বিতর্ক এবং চুলচেরা বিশ্লেষণের ফসল। পোলিশ বংশোদ্ভূত জাইয়নবাদী নেতা নাহুম সকলো তার 'History of Zionism' গ্রন্থে লিখেছেন, ব্রিটিশ জাইয়নবাদীদের প্রতিটি
পরিকল্পনা আমেরিকার জাইয়নবাদী সংস্থা কর্তৃক গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হত এবং আমেরিকার জাইয়নবাদীদের প্রতিটি পরামর্শ লণ্ডনে অত্যন্ত সচেতনতার সাথে বিবেচনা করা হত। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ ২ বছর পর ব্যালফোর ঘোষণাটি চূড়ান্ত করা হয়। সুতরাং ব্যালফোর ঘোষণায় যা কিছু ছিল তা ইচ্ছাকৃতভাবেই রাখা হয়েছিল। যদি কোন অস্পষ্টতা থেকে থাকে তাও ছিল ইচ্ছাকৃত ৷
প্যারিস শান্তি সম্মেলন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরীর সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর মিত্র শক্তিবর্গ কর্তৃক জার্মানির সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরের দু'মাসেরও অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শান্তিচুক্তি সম্পাদনের জন্য মিত্র ও সহযোগি শক্তি বর্গ (Allied and Associated Powers) প্যারিসে এক সম্মেলনে মিলিত হয়। প্যারিস শান্তি-সম্মেলনে অনেক আলাপ আলোচনার পর মিত্র ও সহযোগী শক্তিবর্গ জার্মানির সাথে ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই চুক্তি, অস্ট্রিয়ার সাথে ১০ সেপ্টেম্বর সেন্ট জার্মাইন চুক্তি, বুলগেরিয়ার সাথে ২৭ নভেম্বর নিউলী চুক্তি, এবং হাংগোরের সাথে ১৯২০ সালের ৪ জুন ত্রিয়ানন চুক্তি সম্পাদন করে। প্যারিস শান্তি সম্মেলনে সর্বশেষ যে চুক্তিটি সম্পাদন করা হয় তা অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট সেভরে স্বাক্ষর করা হয়। কিন্তু এ চুক্তিতে তুরস্কের বিরুদ্ধে যে কঠোর শর্তাবলী আরোপ করা হয় তাতে তুরস্কবাসিগণ অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং মোস্তফা কামাল পাশার সুযোগ্য নেতৃত্বে সেখানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সেভরের চুক্তি বাতিল দাবি করে। পরিশেষে ১৯২৩ সালের ২৩ জুলাই তুরস্কের সাথে লজেন (Lausanne)- এ এক নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় যা ১৯২৪ সালের ৬ আগস্ট কার্যকর হয়। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ছয় বছর পর বিশ্বব্যাপী শান্তি পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ শান্তি চুক্তিসমূহ বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আগত মিত্র ও সহযোগী শক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং একই সাথে তাদের প্রত্যেকের জার্মানির সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিরূপ ছিল তা জানা দরকার ।
১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্যারিসে যে শান্তি সম্মেলন শুরু হয় তাতে জার্মানির বিপক্ষে যে সকল দেশ যুদ্ধে অংশ নেয় অথবা যুদ্ধ চলাকালে জার্মানির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করে তারা প্রতিনিধি পাঠায়। মোট ৩২টি দেশ এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। পূর্বেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রত্যেকটি দেশ তার সামরিকশক্তি অনুযায়ী এক থেকে পাঁচ জন পর্যন্ত প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারবে এবং মোট একাত্তরটি আসনের বন্দোবস্ত করা হয়। সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সকল দেশের প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করলেও মূল কাজ সম্পাদনের ভার দেয়া হয় তথাকথিত দশ জনের পরিষদের (Council of Ten ) হাতে। দশ জনের এ
মেসোপটেমিয়া : সিরিয়ার মত মেসোপটেসিয়া (ইরাক) ও আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল অত্যন্ত প্রবল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ও পরে গিলানি, ওমরি এবং সুয়াইদি প্রভৃতি ইরাকি পরিবার আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। স্বাধীনতা লাভের আশায় বহু ইরাকি যুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে ব্রিটেনকে সহযোগিতা করেছিল। ১৯১৫-১৯১৬ সালে নাজাফ, কারবালা, হিল্লা, কুফা ইত্যাদি স্থানের জনগণ তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। নূরি আল সাঈদের মত তুর্কি সেনাবাহিনীর বেশ কিছু ইরাকি কর্মকর্তা ব্রিটিশদের সহযোগিতা করে এবং ফয়সালের হেজাজী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে যোগ দেয়। কিন্তু প্যারিস শান্তি সম্মেলনে তাদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে। আরব বাহিনীর ইরাকি কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে বাগদাদে Iraqi Convenanters (আল-আহাদ আল ইরাকি) নামক একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন ব্রিটিশ বিরোধী তৎপরতা চালাতে থাকে। ১৯২০ সালের ৮ মার্চ দামেস্কে সিরিয় জাতীয় কংগ্রেস যখন ফয়সালকে সিরিয়ার বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করে তখন বাগদাদে Iraqi Convenanters ফয়সালের বড় ভাই আবদুল্লাহকে ইরাকের বাদশাহ ঘোষণা করে। স্যান-রেমো সম্মেলনে সম্পাদিত ম্যান্ডেট চুক্তির সংবাদ ইরাকে পৌছা মাত্রই তা ব্যাপক বিদ্রোহের সূচনা করে। ১৯২০ সালের ৩ মে বিদ্রোহীরা দুজন ব্রিটিশ কর্মকর্তাতে হত্যা করে। এবং জুলাই মাস নাগাদ সমগ্র মেসোপটেমিয়া বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। বিদ্রোহের প্রকোপ এত বেশী ছিল যে, মেসোপটেমিয়াতে মোতায়েনকৃত ব্রিটেনের এক লক্ষ ত্রিশ হাজারেরও বেশী সৈন্য এ বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করে অক্টোবর মাসের দিকে ব্রিটেন পরিস্থিতি শান্ত করতে সামর্থ হয় । বিদ্রোহের ফলে ব্রিটেনের প্রায় দুই হাজার পাঁচ শত সৈন্য প্রাণ হারায়। যুদ্ধ পরবর্তী টানা পোড়েনের মধ্যেও ব্রিটেনকে বিদ্ৰোহ দমনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। অবশেষে সিরিয়ার মত মেসোপটেমিয়ার জনগণও ম্যাণ্ডেটরি ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয় ।
ফিলিস্তিন : সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ফিলিস্তিনের আরবদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ফিলিস্তিনের আরবরা সিরিয়ার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আরব রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখত। কিন্তু সিরিয়াকে ফ্রান্সের মান্ডেটাধীনে অর্পণ করা হলে তাদের সে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। উপরন্তু ফিলিস্তিনকে জাইয়নবাদের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে জেরুজালেম এবং জাফায় আরব- ইহুদি সংঘর্ষে প্রায় পঞ্চাশ জন ইহুদি নিহত হয়। এ ঘটনা ব্রিটেনকে তার সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। ২৪ এপ্রিল ব্রিটেনকে ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট প্রদান করা হয়। ১ জুলাই ফিলিস্তিনে সামরিক শাসনের বদলে বেসামরিক শাসন চালু হয়। স্যার হার্বার্ট স্যামুয়েল ব্রিটিশ হাইকমিশনার নিযুক্ত হন এবং ব্যালফোর ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন ।
আরবিয় উপদ্বীপ : আরবীয় উপদ্বীপের ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয়। শরীফ হুসাইনের শাসনাধীনে হেজাজ একটি স্বাধীন আরব রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। তবে ইবনে সউদের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে তিনি কিছুটা শঙ্কিত ছিলেন। নেজদের সুলতান ইবনে সউদ পশ্চিমের হেজাজের সীমানা থেকে পূর্বে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত সমগ্র মধ্য আরবের একচ্ছত্র শাসকে পরিণত হন। রাশিদীরা নেজাদের উত্তর সীমা হতে ইরাক সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত শামার অঞ্চল শাসন করেছিল। তবে যুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের ফলে তাদের শক্তি ও মর্যাদা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। দক্ষিণ আরবের আসির ইদ্রিসি এবং ইয়েমেন ইমাম ইয়াহইয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের শেখ শাসিত আমিরাতগুলির শাসন ব্যবস্থায়ও কোন পরিবর্তন সূচিত হয় নি।
ম্যান্ডেট প্রস্তাবে চূড়ান্ত সমঝোতা : বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্রিটেন আরবদের অসন্তোষ প্রশমনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তাই এ অঞ্চলের জন্য একটি সমন্বিত নীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বৃটিশ সরকার ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে উপনিবেশ দপ্তরের অধীনে মধ্যপ্রাচ্য বিভাগ নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২১ সালের ১২ ও ১৪ জুন উপনিবেশ মন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে কায়রোতে একটি সম্মেলন আহবান করেন। চার্চিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ইরাকের হাই কমিশনার স্যার ক্রক, ফিলিস্তিনের হাই কমিশনার স্যার হাবার্ট স্যামুয়েল, টি ই লরেন্স, গারট্রুড বেল সহ বিখ্যাত মধ্যপ্রাচ্য বিশারদগণ যোগদান করেন। এ সম্মেলনে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত ফয়সালকে ইরাকের বাদশাহ এবং আবদুল্লাহকে ট্রান্স জর্ডানের (জর্ডান নদীর পূর্ব তীরবর্তী আরব ভূ-খণ্ড যা নিয়ে বর্তমান জর্ডান রাজ্য গঠিত) আমীর পদে অধিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার ফয়সালের মতামত জানতে চাইলে তিনি ইরাকের উপর তার বড় ভাই আবদুল্লাহর অধিকারের কথা উল্লেখ করে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। কর্ণেল লরেন্স আবদুল্লাহকে ফয়সালের অনুকূলে ইরাকের উপর তার দাবি পরিত্যাগে রাজী করানোর দায়িত্ব দেন। এ সময় আবদুল্লাহ ফয়সালের প্রতি ফরাসি আচরণের প্রতিশোধ নিতে তার হেজাজি সেনাবাহিনী নিয়ে জর্ডানে অবস্থান করছিলেন। ফয়সালকে সিরিয়ায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে তিনি জর্ডান ও সিরিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কর্ণেল লরেন্স ফয়সালকে ইরাকের বাদশাহ করার ব্রিটিশ পরিকল্পনার কথা আবদুল্লাহকে অবহিত করেন। আবদুল্লাহ এতে সম্মত হন। ব্রিটিশ সরকার পুনরায় ফয়সালের মতামত জানতে চাইলে ফয়সাল আর আপত্তি করেন নি। কায়ারো সম্মেলন শেষে চার্চিল জেরুজালেম সফর করেন। সেখানে তিনি আবদুল্লাহর সাথে একটি সমঝোতায় উপনীত হন। এতে বলা হয় আবদুল্লাহর নেতৃত্বে দামেস্কে একটি আরব সরকার গঠনের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার ফ্রান্সের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করবে। এ ব্যাপারে ফ্রান্সের সম্মতি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আবদুল্লাহ ব্রিটেনের সহযোগিতায় জর্ডানের
পূর্বাঞ্চল শাসন করবেন। কিন্তু সিরিয়া বিষয়ক নীতিতে পরিবর্তনের কোন ইচ্ছা না থাকায় ফ্রান্স ব্রিটেনের প্রস্তাবে সম্মত হয় নি। ফলে একটি সামরিক ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ব জর্ডানে প্রতিষ্ঠিত আবদুল্লাহর শাসন ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ লাভ করে । তিনি ট্রান্স জর্ডানের আমীর নিযুক্ত হন। অন্যদিকে ব্রিটেনের প্রভাবে ১৯২১ সালের ১১ জুলাই ইরাকের আরব নেতৃবৃন্দ ফয়সালকে ইরাকের বাদশাহ হিসেবে মেনে নেয় ।
প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধকালীন গোপন চুক্তিগুলির বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধীতার কারণে চুক্তিগুলির পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নি। ম্যান্ডেট ব্যবস্থার মাধ্যমে পরস্পর বিরোধী দাবি- দাওয়াগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। এর ফলে সমগ্র আরব অঞ্চলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ সাইকস-পিকো চুক্তি শুধুমাত্র সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে ফরাসী নিয়ন্ত্রণ এবং দক্ষিণ ইরাকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। দামেস্ক হম্‌স, হামা এবং আলেপ্পো নিয়ে গঠিত সিরিয়ার অভ্যন্তর ভাগ এবং ইরাকের অবশিষ্টাংশ নিয়ে একটি আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা ছিল । অবশ্য ম্যাণ্ডেট চুক্তিতে বৃটেন ও ফ্রান্সকে শুধু অভিভাবকের দায়িত্ব প্রদান করা হয় । কিন্তু পরবর্তীকালে তারা অভিভাবকত্বের পরিবর্তে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় । এ ব্যাপারে ফ্রান্স ছিল অগ্রগামী। সম্ভবত শাসন করার এ সুপ্ত বাসনা থেকেই তারা সাইকস-পিকো চুক্তিতে উল্লেখিত অঞ্চলের উপর প্রত্যক্ষ শাসনের সুযোগ ত্যাগ করে ম্যান্ডেট ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল । তবে এ কথা সত্য যে, পূর্ণ রাজনৈতিক মুক্তি না পেলে ও তুরস্কের কঠোর নিয়ন্ত্রণের তুলনায় ম্যাণ্ডেটরী শাসন ব্যবস্থা আরবদের প্রতি কিছুটা নমনীয় ছিল। উপরন্ত আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে স্বীকার করে নিয়েই এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল । তাই মনোভাব যাই থাকুক না কেন ম্যান্ডেটরি কর্তৃপক্ষকে আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার স্বীকার করে নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। অন্যদিকে ফ্রান্স আরবদেরকে কোন প্রকার ছাড় দিতে রাজী না হলেও ব্রিটেন তার ম্যান্ডেটরী অঞ্চলে ফয়সাল এবং আবদুল্লাহকে প্রতিষ্ঠিত করে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব প্রদান করে। সম্ভবত আরবদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যেই ব্রিটেন এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে শান্তি সম্মেলনে ইহুদিদের সবগুলি উদ্দেশ্যই পূর্ণ হয় ।
ফিলিস্তিনে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের বদলে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং ব্যালফোর ঘোষণাকে ম্যান্ডেট চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একটি পরিপূর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী, যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী এসব ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]