সেভার্স চুক্তি : সেভার্স চুক্তি তুরস্কের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

অটোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে এক সুপরিচিত দেশ। তুরস্কের অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়া মাইনরে । তুরস্ক ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের মাঝামাঝি জায়গায় বসফরাস প্রণালীতে এশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করেছে। তুরস্ক ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। “সুলতান সুলায়মান ছিলেন প্রথম দশজন অটোমান সুলতানের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ।” এভারসলের এ উক্তিটি যথার্থ। কেননা সুলতান মহামতি সোলায়মানের পর থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়। এ পতনের মূলে বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক কারণ ছিল। (এ) সোলায়মানের অধিকাংশ উত্তরাধিকারী ছিলেন অকর্মণ্য, অযোগ্য, বিলাসপ্রিয় ও ইন্দ্রিয়গ্রস্থ। সোলায়মানের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ‘Salim the sot” বা নেশাগ্রস্থ সেলিম নামে পরিচিত ছিলেন। (বি) অটোমানরা ইউরেশীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ইসলামের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ রাজ্যের অধিপতি হন । কিন্তু এ বিশাল সাম্রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় সক্ষম হন নি। এ কারণে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও অসন্তোষের কারণে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। (সি) ষোড়শ শতাব্দীতে রেঁনেসা ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে ইউরোপীয় যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয় তার সাথে সমান তালে চলতে পারে নি বলে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টান ইউরোপের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক প্রাইস যথার্থই বলেন,” মধ্যেযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণে ইউরোপের সাথে তুরস্ক তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে পারে নি।” এর ফলে তুরস্কে নানাবিধ সংস্কার সাধিত হলেও ইউরোপে যে বৈপ্লবিক আন্দোলনের সূচনা হয় তা একদিন যেমন খ্রিস্টান ইউরোপীয়দের নতুন আশা-আকাঙ্খা ও চিন্তা- ভাবনার দিকে উৎসাহিত করে। আপরদিকে বিধিবদ্ধ আইন-কানুনের ফলে তুরস্কে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় নি। (ডি) এলান বুলক বলেন, “সোলায়মানের ইউরোপ ও অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। মনে হয় যে, মহান তুর্কি আন্দোলনের তৎপরতা ইউরোপে স্তিমিত হয়ে যায়, তারপর আর অগ্রসর হতে পারে নি।” এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ইউরোপে যুদ্ধ বিদ্যার প্রভূত উন্নতি সাধিত হলে অটোমানদের তুলনায় ইউরোপীয়রা অধিকতর পারদর্শি হয়ে উঠে। এর ফলে জলে ও স্থলে তুর্কিদের প্রাধান্য ক্ষীণ হয়ে পড়ে। (ই) সোলায়মানের পর তুর্কি সামরিক বাহিনীর শক্তি লোপ পেতে থাকে। তুর্কি নৌবহর বিভিন্ন রাজ্যজয়ে সহায়তা করে; এমনকি কন্সটান্টিনোপল দখলেও। কিন্তু মূলত ভেনেসীয় ও স্পেনিস জাতির মত তুর্কিরা সমুদ্রাভিযানে অনভ্যস্থ ছিল এবং তারা একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনে ব্যর্থ হয়। এ কারণে সোলায়মানের মৃত্যুর পর ১৫৭১ সালে Lepanto বা লেপান্টোর যুদ্ধে তাদের পরাজয় ঘটে। অটোমানদের নৌবহর পুনর্গঠিত হলেও ভূ- মধ্যসাগরের মাল্টা ও ইতালিতে তাদের নৌ-অভিযান সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। এর ফলে তুর্কি নৌশক্তি ভূ-মধ্যসাগরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে বলে ঐতিহাসিক প্রাইস মন্তব্য করেন। স্থলবাহিনীও পূর্বের ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলে। এ কারণে ১৬৬৪ সালের ইফসবুর্গ বাহিনী সেন্ট গডহার্থ এর রণক্ষেত্রে তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত করে। ১৬৮৩ সালে কারা মোস্তফার নেতৃত্বে পরিচালিত সমরাভিযানে ৬০ দিন অবরোধ করেও ভিয়েনা দখলে তুর্কিরা ব্যর্থ হয়। ১৬৯৯ সালে কার্লোইটিজের সন্ধি (The Treaty of Karlowitz) অনুযায়ী অস্ট্রিয়া সমগ্র হাঙ্গেরী লাভ করে। এবং পোল্যাণ্ড, রাশিয়া ও ভেনিস পতনোন্মুখ অটোমান সাম্রাজ্যের অঞ্চলসমূহ একের পর এক দখল করতে থাকে। (এফ) অটোমান সাম্রাজ্যে একক জাতি দ্বারা গঠিত ছিল না। সপ্তদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন জাতি, ভাষা, ধর্ম ও বর্ণের প্রায় ২৫ হতে ৩০ লক্ষ লোকের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল অটোমান সাম্রাজ্য ছিল একটি সঙ্কর রাষ্ট্র। এর ফলে সাম্রাজ্যের ঐক্য, সংহতি ও স্থিতিশীলতা ব্যহত হয়। (জি) রাজ্য সম্প্রসারণ নীতি স্থগিত হলে সেনাবাহিনী বিশেষ করে জেনিসারী বাহিনীর মধ্যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয় । এবং তারা যুদ্ধলব্ধ ধন-রত্ন ও দাস-দাসী থেকে বঞ্চিত হয়ে বিয়ে করে নাগরিক জীবন-যাপন করতে থাকে। এর ফলে দ্বিতীয় মুহম্মদ সেলিম ও সোলায়মানের রাজত্বকালে অটোমান সেনা বাহিনীদের যে সুখ্যাতি ছিল তা লোপ পায়। সেনাবাহিনীর দুর্বলতা পক্ষান্তরে রাজ্যের স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ন করে। (এইচ) সোলায়মানের পর এক শ্রেণীর দুর্বল রাজকর্মচারী বিশেষভাবে উজীরবর্গ এবং হেরেমের প্রভাবশালী সুলতানগণ রাজ্যের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। এর প্রকৃত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় দ্বিতীয় সেলিমের রাজত্বকালে; মুহাম্মদ সকুল্লী ও কুপ্রিলি উজিরদের হাতেই ছিল রাজ্য শাসনের দায়িত্ব (আই) অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে সমগ্র অটোমান রাজ্যে কৃষিকার্য ও শিল্পের অনগ্রসরতা ও মধ্যযুগীয় ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। (জে) তুর্কি সাম্রাজ্যের পতনে অস্ট্রিয়ার মত রাশিয়াও সম্প্রসারণের দ্বারা আগ্রাসন নীতি চরিতার্থ করে। এর ফলে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয় এবং তুরস্ক “Sickman of Europe” বা ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি নামে অভিহিত হয় ।

মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। তুরস্কের ইতিহাস ঘটনাবহুল। তুরস্কের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সেভার্স চুক্তি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, লুজান চুক্তি, কামালের সংস্কারসমূহ, ছয় নীতি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুরস্ক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল ।
সেভার্স চুক্তি : সেভার্স চুক্তি তুরস্কের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এ চুক্তির পটভূমি নিম্নে তুলে ধরা হল। ১৯১৯ সালের ২৮ জুন বিজয়ী মিত্র বাহিনী (ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া) কর্তৃক গৃহীত শান্তি চুক্তিতে জার্মানী স্বাক্ষর দান করে । প্যারিসের অদূরে ভার্সাই প্রাসাদে এ চুক্তি সম্পাদিত হলে এটি ভাসাই চুক্তি নামে অভিহিত হয়। ১৫ খণ্ডে ৪০ টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত ভার্সাই এর চুক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের পুনর্গঠন করবার একটি আন্তর্জাতিক সাফল্যজনক প্রচেষ্টা বলে মনে করা হয়। জার্মানীর পক্ষে যে সকল রাষ্ট্র প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যোগদান করে মিত্রপক্ষ তাদের সাথে পৃথক পৃথক চুক্তি সম্পাদিত করে। তুরস্ক জার্মানির সাথে যুদ্ধে যোগদান করলে অপরাপর পরাজিত ও বিধ্বস্ত রাষ্ট্রের মত তাকেও খণ্ড-বিখণ্ড করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা করা হয়। ভার্সাই চুক্তির উদ্যোক্তারা জার্মানীতে ব্যস্ত ছিলেন। লয়েড জর্জের পরামর্শ-দাতারা তাকে বললেন, “তুরস্ককে ছেড়ে দিন। ওটা এমনিতেই ভেঙ্গে পড়বে; তখন তার খণ্ডগুলি ভাগ করে নিব যুদ্ধকালে তুরস্কের সুলতান আব্দুল হামিদ মৃত্যুবরণ করলে তার ভাই মাহমুদ (পঞ্চম) সিংহাসনে উপবেশন করেন। উল্লেখ্য যে, জার্মানীর পক্ষে তুরস্কের যোগদানের মূলে নব্য-তুর্কি সংগঠন জড়িত ছিল। পঞ্চম মাহমুদের রাজত্বকালে ‘ইউনিয়ন এণ্ড প্রগ্রেস' সমিতি সংবিধানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে । এবং এনভার ও তলাতের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে। মাহমুদ সেভকেত পাশা নতুন সরকার গঠন করেন এবং এ সরকার বা মন্ত্রীসভা দৃশ্যত: ছিল “জার্মান ঘেষা” ( distinct German Colouring)। তুরস্কের রাজনৈতিক বিপর্যায়ের জন্য একজন ব্যক্তিকে দায়ী করা হলে নিশ্চিতভাবে এনভার পাশার নাম উল্লেখ করতে হবে । একজন দুর্ধর্ষ ও সাহসী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থেকে তিনি ১৯০৯ সালে বার্লিনে ‘সামরিক এটাচীর' পদে উন্নীত হন। জার্মানীতে অবস্থানকালে তিনি উন্নতমানের জার্মান সামরিক শক্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। বলকান যুদ্ধের বিপর্যয়েও তুর্কি বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ম্লান হয় নি, একথা এনভার মনে করতেন। এনভার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তুর্কি সমর মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক কেন্দ্রীয় শক্তিকে (অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইতালি) সমর্থন দান করে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। ১৯১৪ সালের ১ নভেম্বর তুরস্ক প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে তুরস্ক বিপর্যস্ত হলে ১৯১৮ সালের ১ নভেম্বর এনভার পাশা জার্মানিতে পলায়ন করেন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ চলাকালে তুরস্কে মোস্তফা কামাল পাশা নামে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা ও সেনানায়কের আবির্ভাব ঘটে। তিনি পতনোন্মুখ তুরস্ক সাম্রাজ্যকে বৈদেশিক আগ্রাসন থেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু ত্রি-শক্তির আতাতের (Triple Entente) নিকট ত্রি শক্তির চুক্তির (Triple Alliance) পরাজয়ে তুরস্কের রাজনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে স্যান-রেমোতে প্রথম মিত্র শক্তির বৈঠক বসে ।
সেভার্স চুক্তিতে পরাজিত তুরস্ককে কোন প্রকার আলোচনার সুযোগ দেয়া হয় নি। যুদ্ধকালীন গোপন চুক্তিসমূহ অনুযায়ী মিত্র শক্তি তুর্কি সাম্রাজ্যেভুক্ত অঞ্চলগুলির উপর স্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়। একমাত্র আরব অঞ্চলগুলো ছাড়া তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্য কোন অঞ্চলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্রিটেন তথা মিত্র শক্তির কোন দায়বদ্ধতা ছিল না। রাশিয়ার বলশেভিক সরকার যুদ্ধকালীন গোপন চুক্তিগুলি প্রকাশ করে দেয়ায় তুরস্ক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই চুক্তিগুলি সম্পর্কে অবগত ছিল। তাই তুরস্কের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী এসব চুক্তির মোকাবেলায় তুরস্ক উইলসনের ১৪ দফার ১২ নম্বর দফাটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়। এ দফায় ওসমানিয় সাম্রাজ্যভুক্ত তুর্কি ভূ-খণ্ডের সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা প্রদান করার কথা বলা হয়েছিল । যুদ্ধ বিরতির পূর্বে ১৯১৮ সালের ৫ জানুয়ারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ঘোষণা দিয়েছিলেন তুরস্ককে তার রাজধানী কন্সটান্টিপোনল বা তুর্কি অধ্যুষিত সমৃদ্ধ অঞ্চল থ্রেস থেকে বঞ্চিত করার কোন ইচ্ছা বৃটেনের নেই। তবে উইলসন ও লয়েড জর্জ উভয়েই প্রণালী সমূহের উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এগুলিকে সকল জাতির জাহাজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। কিন্তু এসব ঘোষণার কোথায়ও আনাতোলিয়ার ভবিষ্যত সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয় নি। শান্তি সম্মেলনের শুরুর দিকে আর্মেনিয়রা পূর্ব আনতোলিয়াকে ঘোষিত আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। আর্মেনিয়দের দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা করার জন্য প্রেসিডেন্ট উইলসন মেজর জেনারেল জেমস জি-হাবার্ডের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। কমিশন এশিয়া মাইনর সফর করে ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে তুরস্ক ও ট্রান্সককেশীয় অঞ্চলকে একটি ম্যান্ডেটরি শক্তির শাসনাধীনে আনার সুপারিশ করে। শান্তিসম্মেলনে ব্রিটেন সহ অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ কন্সটান্টিনোপল, আনাতোলিয়া প্রণালীসমূহ এবং আর্মেনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ম্যান্ডেটরি শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পক্ষে মত দেয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করায় প্রেসিডেন্ট উইলসন তুর্কি ভূ-খণ্ডের উপর যে কোন সামরিক দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানায়। ফলে ম্যান্ডেটের পরিকল্পনাটি পরিত্যাক্ত হয় ।
শান্তি সম্মেলনে রাশিয়ার অনুপস্থিতি এবং যুদ্ধকালীন গোপন চুক্তির বিরোধিতা মিত্র শক্তির কাজকে আরো কঠিন করে তোলে। দক্ষিণ সীমান্তে তুরস্ক ব্রিটেনের নিকট পরাজিত হলেও সমগ্র তুরস্কের উপর মিত্র শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় নি শুধুমাত্র কন্সটান্টিনোপল প্রণালীসমূহ দক্ষিণ আনাতোলিয়া এবং আরব অঞ্চলসমূহের উপর মিত্র শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এ অঞ্চলগুলো ছাড়া তুর্কি ভূ-খণ্ডের অন্য কোন অঞ্চল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা সহজসাধ্য ছিল না। মধ্য এবং উত্তর পূর্ব আনাতোলিয়ার উপর মিত্র পক্ষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এমতাবস্থায় যুদ্ধকালীন গোপন চুক্তিগুলি বাস্তবায়নে প্যারিস, লন্ডন ও স্যান-রেমো সম্মেলনে ব্যাপক আলোচনার পর ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট মিত্রশক্তি ও তুরস্কের মধ্যে সেভার্সের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তুরস্কের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে একের পর এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায় চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা হয় নি ।
সেভার্স চুক্তির ধারাসমূহ : প্যারিসের সেভার্স কমিউনে (ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিট) স্বাক্ষরিত চুক্তিটিতে একটি প্রস্তাবনা এবং ৪৩৩ টি ধারা ছিল। বিষয়বস্তু অনুযায়ী চুক্তির ধারাগুলি ১৩টি ভাগে বিভক্ত ছিল। এসব ভাগে বিবৃত চুক্তির প্রধান প্রধান ধারাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল—
১। চুক্তির প্রথম ভাগে লীগ অব নেশনসের কভেনান্টটি সন্নিবেশিত হয়েছে। বাকি ভাগগুলোতে চুক্তির মূল বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
২। চুক্তির দ্বিতীয় ভাগে তুর্কি ভূ-খন্ডের সীমানা উল্লেখ করা হয়েছে। ইউরোপে গ্রীস, কৃষ্ণসাগর, ও মর্মর সাগর অঞ্চলে এবং এশিয়া ভূ-খন্ডের সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার সাথে তুরস্কের সীমা নির্ধারিত হয়। চুক্তির সাথে গ্রথিত একটি মানচিত্রে উপরোক্ত সীমানা চিহ্নিত করা হয়। একটি সীমানা কমিশন গঠন করা হবে এবং এ কমিশন মানচিত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে সীমানা চিহ্নিত করবে।
সেভার্সের চুক্তি মোতাবেক সীমানা নির্ধারণের ফলে তুরস্কের ভৌগলিক এলাকা সীমিত হয়ে পড়ে, এবং লোকসংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। ১৯১৪ সালের তুরস্কের আয়তন ছিল ৬,১৩৫০০ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ২ কোটি । মিত্র শক্তি তা কমিয়ে দিলে পরিমাণ দাড়ায় ১,৭৫,০০০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা মাত্র ৮০ লক্ষে ।
৩। এ চুক্তির তৃতীয় ভাগটি ১৩ শাখায় বিভক্ত ছিল। এ ভাগে তুর্কি সাম্রাজ্যের ভূ-খন্ডসমূহের রাজনৈতিক রূপরেখা প্রণীত হয় ।
(ক) কন্সটান্টিনোপলের উপর তুরস্কের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয় ৷ তুরস্কের রাজধানী হিসেবে এখানে তুর্কি সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা ও সুলতানের বসবাসের ক্ষেত্রে কোন বাধা থাকবে না। তবে তুর্কি সরকার চুক্তির কোন ধারা মেনে চলতে বা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হলে উপরোক্ত ধারা সংশোধন করার ক্ষমতা মিত্র শক্তির থাকবে ।
(খ) দার্দানেলিস ও বসফরাস প্রণালী এবং মর্মর সাগরের মধ্যে দিয়ে সকল দেশের বাণিজ্যিক ও যুদ্ধ জাহাজ এবং আকাশ পথে সকল দেশের বাণিজ্যিক ও যুদ্ধ বিমান শান্তি ও যুদ্ধ উভয় সময়ই বিনা বাধায় চলাচল করতে পারবে। লীগ অব নেশনস এর কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ছাড়া এর কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। এছাড়া চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য একটি ‘প্রণালী কমিশন' গঠনের কথা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, গ্রীস ও রুমানিয়ার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হবে। লীগ অব নেশনসের সদস্যপদ লাভের পর রাশিয়া, বুলগেরিয়া ও তুরস্ক এ কমিশনের সদস্যপদ লাভ করবে। কমিশনে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও রাশিয়ার দু'টি ভোটাধিকার থাকবে ।
(গ) চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির সরকার কর্তৃক মনোনীত তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন ইউফ্রেটিস এর পূর্বে, প্রতিষ্ঠিতব্য ও আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্রের দক্ষিণে এবং সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার উত্তরে অবস্থিত কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহের স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত একটি খষড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। পরিকল্পনাটিতে এ অঞ্চলে বসবাসরত আসিরিয়, ক্যালডিয় ও অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকবে । কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তুর্কি সরকার কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। এ চুক্তি কার্যকর হওয়ার এক বছরের মধ্যে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ কুর্দি জনগণ লীগ অব নেশনসের নিকট স্বাধীনতার জন্য আবেদন করে এবং লীগ যদি মনে করে তারা স্বাধীনতা লাভের যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাহলে লীগের সিদ্ধান্ত তুর্কি সরকার মেনে নিবে ।
(ঘ) স্মার্ণা শহর ও এর সংলগ্ন এলাকাসমূহকে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে গ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। তবে স্মার্ণার উপর তুরস্কের সার্বভৌমত্ব বজায় থাকবে। এর নিদর্শন স্বরূপ স্মার্ণা দুর্গে তুর্কি পতাকা উত্তোলন করা হবে। এ চুক্তি কার্যকর হওয়ার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যদি স্মার্ণার পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য গ্রীসের সাথে একত্রিত হওয়ার পর লীগ অব নেশনসের নিকট আবেদন করে তাহলে লীগ একটি গণভোটের মাধ্যমে জনমত যাচাই করবে। যদি জনমত গ্রীসের সাথে সংযুক্তির পক্ষে যায় তাহলে স্মার্ণার উপর তুরস্কের বদলে গ্রীক সার্বভৌমত্ব' প্রতিষ্ঠিত হবে ।
(ঙ) ইমব্রস ও তেনেদস দ্বীপসহ পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় বেশকিছু দ্বীপরে উপর গ্রীক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
(চ) তুরস্ক আর্মেনিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে নিবে। এরজুরাম, ত্রেবিজন্দ, ভ্যান ও বিতলিস ভিলায়েতগুলিতে প্রেসিডেন্ট উইলসন কর্তৃক নির্ধারিত সীমানা তুরস্ক ও আর্মেনিয়া মেনে নিবে ।
(ছ) সিরয়া, মেসোপটেমিয়া ও ফিলিস্তিনের উপর তুরস্কের কর্তৃত্ব লোপ পাবে এবং এ অঞ্চলে ম্যান্ডেটরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। চুক্তি কার্যকর হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে গঠিত একটি কমিশন সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার সাথে তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ করবে। এ চুক্তির ফিলিস্তিন বিষয়ক অংশে ব্যালফোর ঘোষণাটি সন্নিবেশিত হয় এবং ম্যান্ডেটরি শক্তির উপর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয় ।
(জ) তুরস্ক হিজাজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিবে। পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদীনা বিশ্বের সকল দেশের মুসলমানদের হজ্জ্ব যাত্রা এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে ।
(ঝ) তুরষ্ক মিশরের উপর তার সকল অধিকার পরিত্যাগ করবে এবং মিশরকে ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্য হিসেবে স্বীকার করে নিবে। মিশরে বসবাসরত তুরস্কের নাগরিককরা মিশরিয় জাতীয়তা অর্জন করবে। তবে চুক্তি কার্যকর হওয়ার এক বছর পর্যন্ত তাদের তুরস্কে ফিরে আসার সুযোগ থাকবে। ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ও মিশরিয় সরকারের প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা অনুযায়ী সুদানের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে। তুরস্ক ১৯১৪ সালের ৫ নভেম্বর সাইপ্রাসের প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে স্বীকার করে নিবে এবং দ্বীপটিতে তার সকল অধিকার পরিত্যাগ করবে। সাইপ্রাসে জন্মগ্রহণকারী অথবা বসবাসরত সকল তুর্কি ব্রিটিশ জাতীয়তা অর্জন করবে।
(ঞ) তুরস্ক, তিউনিস ও মরক্কোকে ফরাসি আশ্রিত রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিবে । তুরস্কে প্রবেশের ক্ষেত্রে তিউনিস ও মরক্কোর পণ্য ফরাসী পণ্যের মর্যাদা পাবে ৷
(ট) তুরস্ক লিবিয়ায় তার সকল অধিকার ত্যাগ করবে। তুরস্ক ইজিয়ান সাগরে অবস্থিত রোডস দ্বীপসহ আরো কয়েকটি দ্বীপের অধিকার ইতালির অনুকূলে পরিত্যাগ করবে।
(ঠ) সেভার্সের চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন অঞ্চল সমূহের মানুষ তুরস্কের নাগরিকত্বের বদলে স্ব-স্ব অঞ্চলের নাগরিকত্ব অর্জন করবে। তবে চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার এক বছরের মধ্যে তুরস্কে ফিরে এলে তারা তুরস্কের জাতীয়তা লাভ করতে পারবে ।
(ড) মিত্রশক্তি ও অক্ষ শক্তির দেশসমূহের মধ্যে সম্পাদিত সকল চুক্তিকে তুরস্ক স্বীকৃতি দিবে। তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও আশ্রিত রাষ্ট্রসমূহের মুসলমানদের উপর তার অধিকার ও এখতিয়ার পরিত্যাগ করবে। তুরস্ক থেকে বিযুক্ত অঞ্চলসূহের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন প্রকার ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করবে না ।
৪। চুক্তির চতুর্থভাগে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয় । এখানে তুরস্ক জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে তুরস্কে বসবাসকারী সকল নাগরিকের জীবন ও স্বাধীনতার পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করে ।
৫। চুক্তির পঞ্চমভাগ পাঁচটি সেকশনে বিভক্ত ছিল। এখানে বলা হয় সুলতানের দেহরক্ষী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ে তুরস্কের সেনাবাহিনী গঠিত হবে । সুলতানের ৭০০০ দেহরক্ষী ছাড়া তুর্কি সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৫০,০০০ এর অধিক হবে না। চুক্তি কার্যকর হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে তুরস্ক তা বাস্তবায়ন করবে। তুরস্ক তার যুদ্ধ জাহাজগুলি মিত্রশক্তির কাছে হস্তান্তর করবে এবং নতুন করে কোন যুদ্ধ জাহাজ তৈরী করতে পারবে না। সমুদ্রে মৎস্য শিকার ও উপকূলীয় অঞ্চলে টহলের জন্য ৭টি এক মাস্তুল বিশিষ্ট ছোট পাল তোলা জাহাজ ও ৬টি টর্পোডো বোটের সমন্বয়ে তুরস্কের নৌ-বাহিনী গঠিত হবে। তুরস্কের কোন নিজস্ব বিমান বাহিনী থাকবে না ।
৬। দুইটি সেকশনে বিভক্ত চুক্তির ষষ্ঠ ভাগে বলা হয়। চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার পর মিত্রশক্তি তুর্কি যুদ্ধ বন্দীদের ফিরত দিবে। তবে তুর্কি সরকারকে যুদ্ধবন্দীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের খরচ বহন করতে হবে। যুদ্ধের সময় তুর্কি ভূ-খন্ডে মিত্রশক্তির নিহত সৈনিকদের সমাধিস্থলগুলি মালিকানার তুরস্ক মিত্র শক্তির সংশ্লিষ্ট দেশগুলির নিকট হস্তান্তর করবে।
৭। সপ্তম খণ্ডে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত শর্তসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। তুর্কি সেনাবাহিনীর যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে তুর্কি সরকার তাদেরকে মিত্রশক্তির সামরিক আদালতের নিকট অপর্ণ করতে বাধ্য থাকবে। যুদ্ধারপরাধীদের বিচারের স্বার্থে তুর্কি সরকার মিত্রশক্তিকে সকল প্রকার দলিল-দস্তাবেজ ও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে ।
৮ । অর্থনীতি বিষয়ক শর্তসমূহ চুক্তির অষ্টম ভাগে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিশন তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বাজেট, মুদ্রা বৈদেশিক ঋণ, কর ব্যবস্থা সহ সকল অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করবে। কমিশনকে সহযোগিতার জন্য একজন তুর্কি কমিশনার নিয়োগ করা হবে ।
৯। চুক্তির নবম ভাগটি ৭টি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। ১৯১৪ সালের ১ আগষ্টের পূর্বে মিত্রশক্তির দেশসমূহ ক্যাপিচুলেশন প্রথা অনুযায়ী যেসব সুযোগ -সুবিধা ভোগ করত তা পুনপ্রবর্তন করা হয়। এমনকি মিত্র শক্তির যেসব দেশ যুদ্ধের পূর্বে এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত না তাদেরকেও নতুন ক্যাপিলেশনের অধিকার প্রদান করা হয়। তুর্কি সরকার তার ভূ-খণ্ডে যুদ্ধের সময় বাজেয়াপ্ত মিত্র শক্তিভুক্ত দেশসমূহের নাগরিকদের সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দিবে ।
১০। দশম ভাগে মিত্রশক্তির দেশসমূহকে তুর্কি ভূ-খন্ড ও জলভাগের উপর দিয়ে স্বাধীনভাবে বিমান চলাচল ও অবতরণের অধিকার প্রদান করা হয় ।
১১। একাদশ ভাগে বলা হয় তুরস্কের জলপথ ও রেলপথ দিয়ে বিনাশুল্কে মিত্রশক্তির যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের অধিকার থাকবে। এছাড়া তুরস্কের বন্দরসমূহে মিত্র শক্তির জাহাজগুলির যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে কোন প্রকার বৈষম্য করা হবে না ৷
১২। দ্বাদশ ভাগে শ্রম বিষয়ক ধারাগুলো ছিল ভার্সাই চুক্তির অনুরূপ। এখানে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার্থে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা, মুজুরি ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণে একটি আন্তজাতিক শ্রম সংস্থা গঠনের কথা বলা হয় ।
১৩। ত্রয়োদশ ভাগে বলা হয়, অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান রোধে মিত্র শক্তি যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং ভবিষ্যতে স্বাক্ষর করবে তুরস্ক তা মেনে নিতে বাধ্য থাকবে। যুদ্ধের সময় তুর্কি নৌবাহিনীর আক্রমণের ফলে নিমজ্জিত মিত্র শক্তির কার্গো ও জাহাজগুলি উদ্ধারে তুরস্ক সহযোগিতা করবে ।
সেভার্সের চুক্তির সাথে যুগপৎভাবে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যে একটি ত্রি- পক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে তুরস্ককে ফ্রান্স ও ইতালির প্রভাবাধীন অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। যুদ্ধকালে সম্পাদিত সাইকস পিকো চুক্তি অনুযায়ী ফরাসি প্রভাবাধীন অঞ্চল নির্ধারিত হয়। আর লন্ডন চুক্তি এবং St. Jean. de Maurienne চুক্তি অনুযায়ী স্মার্ণা ছাড়া দক্ষিণ পশ্চিম আনাতোলিয়ায় ইতালিয় প্রভাবাধীন অঞ্চল নির্ধারিত হয় ৷
সেভার্স চুক্তির প্রতিক্রিয়া : এম, আবদুল কাদির যথার্থই বলেন, “সেভার্সের চুক্তি পাশ্চাত্যের উৎকট সাম্রাজ্যবাদের সর্বাপেক্ষা নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।” স্পষ্টত : ক্ষুদ্ৰ রাজ্যগুলির অধিকার রক্ষার অজুহাতে বিশ্ব যুদ্ধ বাধে। প্রেসিডেন্ট উইলসন তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় স্বাধীনতা লাভের অধিকার স্বীকার করে নেন। এর পরেও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিকগণ যখন Balance of Power বা শক্তি সাম্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মিত্র শক্তিকে পুরষ্কার দানে ও জগতে শান্তি স্থাপনে ব্যস্ত, তখনও তাদের মাথায় সাম্রাজ্যবাদ ঘুরপাক খাচ্ছিল। এর জন্যই লন্ডন, স্যানরেমো ও সেভার্সের মিত্র শক্তির প্রতিনিধিরা ধরাশায়ী রোগীকে বিকলাঙ্গ করার ব্যবস্থা দিয়েই ক্ষান্ত হলে না। তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বন্দরগুলি অধিকার করে তারা তার সর্বাপেক্ষা কর্মঠ ও কার্যকর অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলিরও ছেদন করার নির্দেশ দান করেন। এ প্রসঙ্গে বার্নার্ড লুইস বলেন, “The Treaty of Severes was very harsh and would have left Turkey helpless and mutileted, a shadow, state liv- ing in the sufferance of the powers and people who were annexing her rechest province. It was far more severe than that imposed on a defeated Germany and was received in Turkey with a national day of mourning.”
১৯২০-১৯২৩ সাল পর্যন্ত সময়কাল তুরস্কের ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণের সৃষ্টি করেছে। ১৯২০ সালের সম্পাদিত সেভার্সের চুক্তি এবং এ চুক্তি লংঘনে সম্পাদিত ১৯২৩ সালের লুজেনের চুক্তির মধ্যবর্তী সময়কালে তুরস্কের ইতিহাসে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের মত এক ক্ষণজন্মা রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়, যিনি তুরস্কের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা বজায় রাখার প্রয়াস পান। তুরস্কের পশ্চিম প্রান্তে যখন ইস্তাম্বুলের সুলতানগণ অপমানকর চুক্তিতে ঘৃণিত ও ধিকৃত রুগ্ন ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছেন তখন পূর্বাঞ্চল আনাতোলিয়ায় কামাল পাশা তার অবস্থান সুদৃঢ় করতে ব্যস্ত থাকেন। প্রথমে তিনি ১৮৯৫ সালে পদাতিক বাহিনীর ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৮৯৯ সালে ইস্তাম্বুলের সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এ কলেজ-সুলতান বিরোধী কার্যকলাপের প্রধান প্রাণ কেন্দ্র ছিল। তিনি নব্য তুর্কিদের কীর্তি সম্পর্কে অবগত হন এবং মনে মনে যুদ্ধে তাদের অংশ গ্রহণের পদক্ষেপকে নিন্দা করেন। তিনি ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী তুর্কি নেতা। কয়েকমাস বন্দী থাকার পর তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং দামেস্কে অবস্থিত পঞ্চম বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি আনাতোলিয়ায় সেনাবাহিনী পুনর্গঠন ও জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন। সেভার্সের চুক্তি ছিল অপমানকর-যদিও এর শর্তাবলী পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় নি। এ সময় আনাতোলিয়ায় এক নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে বার্ণাড লুইস বলেন, “While the allies were imposing their terms on the docile government of the sultans, a new turkish state was emerging in Anatolia."
আনাতোলিয়ায় অবস্থান করে কামাল গুপ্ত ভাষায় (Cypher) অন্যান্য সামরিক ইউনিটকে বিভিন্ন নির্দেশমালা প্রদান করতে থাকেন। তিনি প্রচার করেন যে, দেশের অখন্ডতা বজায় রাখার জন্য জরাজীর্ণ খেলাফত ও সালতালাতের কেন্দ্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা উচিত।
সেভার্সের চুক্তির পর তুরস্কের রাজনৈতিক বিপর্যয় ও স্বাধীনতা বিপন্ন হতে থাকে। তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রীক বাহিনী বিজয়ের সফলতা অর্জন করলেও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। ১৯২০, ১৯২১ এবং ১৯২২ সালে তিন স্তরে তুর্কি-গ্রিক সংঘর্ষ ঘটে । ১ম পর্যায়ে গ্রীক বাহিনী জয়ী হলেও ২য় ও তৃতীয় পর্যায়ে মুস্তফা কামাল পাশার সুযোগ্য নেতৃত্বে তুর্কিরা বিজয়ী হয় ।
মূলত মিত্র শক্তির বিজয়ে তুরস্কের উপর ঘৃণ্য সেভার্সের চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হয়। এবং এ চুক্তিকে তুরস্কের জন্য ‘Death warrant' বা 'মৃত্যু ঘন্টা' বলা হয়েছে। এ চুক্তি তুরস্কের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক ছিল। চুক্তির মাধ্যমে তুর্কি সাম্রাজ্যকে ব্যবচ্ছেদ করে তুরস্ককে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। ক্ষুদ্র তুরস্কের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে একে একটি আশ্রিত রাজ্যের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। সঙ্গত কারণেই তুরস্কের জনগণ এ চুক্তি মেনে নেয় নি। তারা চুক্তি বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেয় এবং অবশেষে তুরস্ককে সেভার্সের চুক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। ঐতিহাসিক প্রাইসের ভাষায়— "More it would, if implemented, have meant the end of turkey itself. সৌভাগ্যবশত সেভার্সের চুক্তি বাস্তবায়িত হয় নি ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]