তুরস্কের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পটভূমি

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুরস্কের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তুরস্কে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জাতয়ীতাবাদী আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা অর্জন তথা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বরূপ নিম্নে বিশ্লেষণ করা হল ।
পটভূমি : সুলতান পঞ্চম মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে তার ভ্রাতা ষষ্ঠ মুহাম্মদ তুর্কি সালতানতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সময়েই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং পরাজিত তুরস্ক মুদ্রসের যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। নব্য তুর্কি নেতা আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও জামাল পাশা- একটি জার্মান যুদ্ধ জাহাজে করে পলায়ন করেন। ১৩ নভেম্বর একটি গ্রীক রণতরীসহ মিত্র শক্তির মোট ৬০টি রণতরীর সমন্বয়ে এক বিশাল নৌবহর কন্সটান্টিনোপলে নোঙ্গর করে। বাহ্যিকভাবে বলশেভিকদের মোকাবেলার ঘোষণা দিলেও কার্যত মিত্রশক্তির কন্সটান্টিনোপলের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে । ইতোমধ্যেই আরব প্রদেশসমূহে মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । এখন মিত্র শক্তি তুর্কি ভূ-খণ্ড দখলে অগ্রসর হয়। ফরাসি বাহিনী সিরিয়া থেকে সিলিসিয়া ও আদানা জেলায় প্রবেশ করে। ব্রিটিশ বাহিনী দার্দানেলিস, সামসুন ও আনাতোলিয়ার রেলপথ সহ অন্যান্য কৌশলগত স্থানসমূহ দখল করে। যুদ্ধকালীন গোপন চুক্তি অনুযায়ী ইতালিকে প্রদত্ত স্থানসমূহ দখলের উদ্দেশ্যে ১৯১৯ সালের ২৯ এপ্রিল ইতালিয় বাহিনী আন্তালিয়ায় অবতরণ করে। ১৫ মে স্মার্ণায় গ্রিক বাহিনী অবতরণ করে যা তুর্কিদের মনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তুর্কিরা পশ্চিমে দখলদারিত্ব মেনে নিলেও তুর্কি সাম্রাজ্যের পূর্বতন প্রজা-গ্রিকদের দ্বারা তুর্কি ভূ-খন্ড দখলকে মেনে নিতে কোনভাবেই প্রস্তুত ছিল না। স্মার্ণার গ্রীক বাহিনী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তুর্কিদের উপর গণহত্যা চালাতে থাকে। তুরস্ক সহ গোটা বিশ্বে তা প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এর প্রতিকারের কোন উপায় ছিল না। কেননা যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পক্ষে যোগদানের পুরষ্কার হিসেবে গ্রিসকে স্মার্ণা প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ আপোষমূলক নীতি অনুসরণ করেন। তিনি যে কোন মূল্যে তুরস্কের সিংহাসন আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। এজন্য মিত্রশক্তির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং তুর্কি ভূ-খন্ডের ব্যবচ্ছেদেও তার কোন আপত্তি ছিল না। তুর্কি সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধের জন্য নব্য তুর্কিদের দায়ি করা হয়। প্রচার করা হয় যুদ্ধে তুর্কি জাতি নয় বরং নব্য তুর্কিরা পরাজিত হয়েছে। তিনি নব্য তুর্কিদের রাজনৈতিক সংগঠন “ঐক্য ও প্রগতি সংঘ” (Committee of Union and Progress-CUP) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তুরস্কের জাতীয় সংসদে নব্য তুর্কিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তিনি সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে তার ভগ্নিপতি দামাদ ফরিদ পাশাকে প্রধানমন্ত্রী (Grand Vizier) পদে নিয়োগ দেন ।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পর্যায়সমূহ : তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনায় মুস্তফা কামালের আবির্ভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য যে, তুর্কি সুলতান আপোষমূলক নীতি গ্রহণ করলেও তুর্কি ভূ-ভাগে মিত্রশক্তির সামরিক দখলদারিত্ব তুরস্কে বিদ্রোহের সূচনা করে। খোদ কন্সটান্টিনোপল সরকারেরই অনেক কর্মকর্তা এ বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েন। মিত্রবাহিনীর কঠোর নজরদারী সত্ত্বেও তারা বিদ্রোহের প্রাণকেন্দ্র আনাতোলিয়ায় সামরিক সাহায্য প্রেরণ করতে থাকেন। এ সময় মুস্তফা কামাল সিলসিয়া থেকে কন্সটান্টিনোপলে প্রত্যাবর্তন করেন। সুলতান তাকে নবম পদাতিক বাহিনীর ইন্সপেক্টর জেনারেল পদে নিয়োগ দিয়ে আনাতোলিয়ার বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রেরণ করেন। ১৯১৯ সালের ১৯ মে কন্সটান্টিনোপল ত্যাগ করে কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী আনাতোলিয় বন্দর সামসুনে অবতরণ করেন। কিন্তু তিনি সুলতানের নির্দেশ অনুযায়ী বিদ্রোহ দমন না করে বিদ্রোহী দলগুলিকে একত্রিত করে তুরস্ককে বিদেশী দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির পথে অগ্রসর হন। যুদ্ধ মন্ত্রণালয় তাকে রাজধানীতে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তিনি এ নির্দেশ অমান্য করলে যুদ্ধ মন্ত্রণালয় সুলতানের অনুমতি নিয়ে তাকে পদচ্যুত করার উদ্যোগ নেয়। মুস্তফা কামাল প্রকাশ্যে তুর্কি সরকারের বিরোধিতা না করে তুর্কি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। ফলে সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আর কোন বাধা রইল না। তিনি ১৯১৯ সালের ৩ মার্চ এরজুরামে প্রতিষ্ঠিত “পূর্ব আনাতোলিয়ার অধিকার রক্ষা সমিতি”-এর সদস্যপদ গ্রহণ করেন ।
তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘আমাসিয়া প্রটোকল ও এরজরাম কংগ্রেস' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯১৯ সালের ১৯ জুন মুস্তফা কামাল প্রাক্তন নৌমন্ত্রী রউফকে আন্ধারায় তুর্কি বাহিনীর অধিনায়ক ফুয়াদ বের সাথে ‘আমাসিয়া' নামক স্থানে মিলিত হয়ে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন যা ‘আমাসিয়া প্রটোকল' নামে পরিচিত। এ প্রটোকলেই প্রথম বিদেশী দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ডাক দেয়। এরপর ২৩ জুলাই এরজুরামে পূর্ব আনাতোলিয়ার অধিকার রক্ষা সমিতির একটি আঞ্চলিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ কংগ্রেসে কামাল সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এরজুরাম কংগ্রেসের মূল উদ্দেশ্য পূর্ব আনাতোলিয়ার প্রতিরক্ষা হলেও পরবর্তীকালে এ কংগ্রেসের ঘোষণাপত্ৰ জাতীয় চুক্তির মর্যাদা লাভ করে। এ কংগ্রেসের স্থিরীকৃত ১০টি উদ্দেশ্যের মধ্যে তুর্কি ভূ- ভাগে অখন্ডতা রক্ষা, তুর্কি সালতানাত ও খিলাফত অক্ষুণ্ণ রাখা। তুর্কি ভূ-খণ্ডকে বিদেশী দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করা। কোন বিশেষ অধিকার প্রদান না করে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং তুর্কি সরকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে বিকল্প সরকার গঠন ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে জাতীয়তাবাদীরা বিদেশি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কন্সটান্টিনোপলস্থ তুর্কি সরকারের সমালোচনা করলেও সুলতানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং সুলতানকে বিদেশি শক্তি সমূহের প্রভাব থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দেয়। এ পর্যায়ে আন্দোলনের উপর মুস্তফা কামালের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় ৷
এ পর্যায়ে ‘সিভাস কংগ্রেস' ও ‘দ্বিতীয় আমাসিয়া প্রটোকল' সম্পর্কে তুলে ধরা হল। ১৯১৯ সালের ৪ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর মুস্তফা কামালের নেতৃত্বে আনাতোলিয়ার সিভাস নগরীতে একটি জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র তুরস্ক থেকে প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে। প্রতিনিধিবৃন্দ “ঐক্য ও প্রগতি সংঘ” পুনর্জীবিত করবে না বলে শপথ নেয় । এরজুরাম কংগ্রেসের গৃহীত সিদ্ধান্ত এ সম্মেলনে জাতীয় রূপ লাভ করে এবং “পূর্ব আনাতোলিয়ার অধিকার রক্ষা সমিতি” রূপান্তরিত হয়ে “পূর্ব আনাতোলিয়া ও রুমেরিয়ার অধিকার রক্ষা সমিতি” ধারণ করে। এ সমিতির একটি স্থায়ী প্রতিনিধি পরিষদ গঠিত হয়। মুস্তফা কামাল এ পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হন। এ সম্মেলনও সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা হয়। তবে দামাদ ফরিদ পাশা ও তার সরকারকে তুরস্কের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপ এবং সুলতানের মান মর্যাদা ভুলণ্ঠিত করার জন্য দায়ী করা হয় । জাতীয়তাবাদীদের অব্যাহত সমালোচনার মুখে ১ অক্টোবর দামাদ ফরিদ পাশা পদত্যাগ করেন। এবং আলী রেজা পাশা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কামালের সাথে আলোচনার জন্য জাতীয়তাবাদীদের অনুমোদিত প্রতিনিধি দল প্রেরণ ইত্যাদি বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দ্বিতীয় আমাসিয়া প্রটোকল নামে পরিচিত। কিন্তু কন্সটান্টিনোপলে সালিহ পাশা প্রটোকলটির অনুকূলে মন্ত্রীসভার অনুমোদন লাভ করতে ব্যর্থ হন ।
চূড়ান্ত পর্যায়ে ওসমানিয় সংসদ তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতীয়তাবাদীদের চাপে ডিসেম্বরে তুরস্কে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মোস্তফা কামালের সমর্থক জাতীয়তাবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯২০ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে তুরস্কের অখন্ডতা ও স্বাধীনতা রাখার জন্য এরজুরাম ও সিভাস কংগ্রেসের সিদ্ধান্তসমূহ অনুমোদন লাভ করে যা জাতীয় চুক্তি নামে পরিচিত। ফলে আন্ধারায় মোস্তফা কামাল ও তার প্রতিনিধি পরিষদ বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠে। কন্সটান্টিনোপল থেকে কামালের প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল সংসদ সদস্য ও সরকারী কর্মকর্তাগণ আন্ধারায় সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রেরণ করতে থাকে। তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য মিত্রশক্তি প্রধানমন্ত্রী আলী রেজা পাশার উপর চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করায় ৩ মার্চ তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ৮ মার্চ নৌ মন্ত্রী সালিহ পাশা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৬ মার্চ ব্রিটিশ বাহিনী কন্সটান্টিনোপলের তুর্কি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে প্রবেশ করে। মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল উইলসন জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যসহ মোট ১৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং মাল্টায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে কামালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রউফ বেও ছিলেন। ১৮ মার্চ শেষবারের মত সংসদ অধিবেশন বসে এবং সর্বসম্মতিক্রমে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবি জানায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৫ এপ্রিল সুলতান তার ভগ্নিপতি দামাদ ফরিদ পাশাকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন এবং ১১ এপ্রিল সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ১১ এপ্রিল সংসদ বিলুপ্তির দিনই শায়খ-উল-ইসলাম দূররীজাদে আবদুল্লাহ আফেন্দী-মুস্তফা কামাল ও জাতীয়তাবাদীদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদের হত্যা করা ধর্মীয় কাজ বলে ফতোয়া দেন। মিত্র বাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী ১৮ এপ্রিল ফরিদ পাশা জাতীয়তাবাদীদের দমন করতে শৃঙ্খলা বাহিনী নামে একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করে। ১১ মে কন্সটান্টিনোপলে একটি বিশেষ সামরিক আদালত কামাল ও তার সহযোগীদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। জবাবে আন্ধারার গ্র্যান্ড মুফতি রিফাত এক ফতোয়ায় বলেন যে বিদেশি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে প্রদত্ত ফতোয়ার কোন বৈধতা নেই। তারা সুলতানকে বিদেশীদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য মুসলমানদের আহ্বান করেন ।
এর ফলে সরকার ও জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ সময় তুর্কি সরকারের সাহায্য পুষ্ট হয়ে জাতীয়তাবাদ বিরোধী আন্দোলন কিছুটা শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং বিভিন্ন স্থানে জাতীয়তাবাদীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় । তুর্কি সরকারের ও মিত্র বাহিনীর দমন নীতিতে ভীত হয়ে কামালের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসমত ইনুনু এবং সদ্য বিলুপ্ত সংসদের স্পিকার জালাল উদ্দিন আরিফ সহ অনেকেই কন্সটান্টিনোপল থেকে আন্ধারায় চলে আসেন। ১৯২০ সালের ২৩ এপ্রিল আন্ধারায় মহা জাতীয় সংসদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইস্তাম্বুল থেকে পালিয়ে আসা ১০০ জন সংসদ সদস্য এবং তুরস্কের বিভিন্ন স্থান হতে জাতীয়তাবাদের নির্বাচিত ১৯০ জন প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগ দেয়। মুস্তফা কামাল এ সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তার নেতৃত্বে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। এ সংসদ কনস্টান্টিনোপলস্থ তুর্কি সরকারের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন এ সরকারের তুরস্কের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নেই বলে ঘোষণা করে। মুস্তফা কামাল সকল সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের কন্সটান্সিনোপলের পরিবর্তে আন্ধারার জাতীতাবাদী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার নির্দেশ দেন।
এ পর্যায়ে জাতীয়তাবাদীরা বৈদেশিক শক্তিসমূহের মোকাবেলা করে। আনাতোলিয়ায় মুস্তফা কামাল একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এ সেনাবাহিনীর সাহায্যে তিনি পূর্বদিকে আর্মেনিয়, সিলিসিয়ান ফরাসি, আদালিয়ায় ইতালিয়, স্মার্ণায় গ্রীক এবং কনস্টান্টিনোপলে ব্রিটিশদের মোকাবেলা করেন। ১৯২০ সালের শুরুতে কামাল সিলসিয়া আক্রমণ করে ফরাসিদের আলেপ্পোয় পশ্চাদপসারণ করাতে সক্ষম হন । ফ্রান্স এ সময় সিরিয়াকে ফয়সালের প্রভাব থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। তাই ফ্রান্স ৩০মে আন্ধারায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলে। ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট কন্সটান্টিনোপল সরকার কর্তৃক সেভার্সের চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে তুরস্কের সরকার বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়। উপরন্তু মিত্রশক্তির দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও বিরোধ কামালের উদ্দেশ্য অর্জনের পথকে আরো সহজ করে দেয়। মিত্রশক্তির চাপে ১৭ অক্টোবর দামাদ ফরিদ পাশা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তৌফিক পাশা নতুন প্রধানমন্ত্রী হন। এদিকে ফ্রান্সের সাথে বিরোধ মিটিয়ে কামাল আর্মেনিয়া সীমান্তে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির সুযোগ পান। জেনারেল কাজিম কারা বেকিরের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী বাহিনী আর্মেনিয়া আক্রমণ করে। এবং কারস দখল করে নেয়। এ সময় বলশেভিকরাও আর্মেনিয়া আক্রমণ করে এবং এরিভান দখল করে সেখানে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২০ সালের ৩ ডিসেম্বর আলেকজান্দ্রোপল চুক্তির মাধ্যমে কমিউনিস্ট সরকার কারস ও আরদাহানসহ পশ্চিম আর্মেনিয়ার এক বৃহৎ অংশ তুরস্ককে প্রদান করে। এভাবে কামালের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদীরা পূর্ব দিকে ফরাসী এবং আর্মেনিয়াদের হুমকি থেকে মুক্ত হয়ে পশ্চিম আনাতোলিয়ার দিকে মনোনিবেশ করে। পশ্চিম দিকে গ্রীকদের মোকাবেলার পূর্বে কামাল পররাষ্ট্রবিষয়ক ৩টি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধান করেন। (১) ১৯২১ সালের ১৩ মার্চ তিনি ইতালির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিতে কিছু অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে ইতালি আনাতোলিয়া থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ১৬ মার্চ তিনি রাশিয়ার সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে ফেলেন ৷ (২) এ চুক্তিতে রাশিয়াকে বাটুম প্রদানের মাধ্যমে কামাল আলেকজান্দ্রোপল চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত কারস্ ও আরদাহানের উপর তুর্কি নিয়ন্ত্রণের প্রতি রাশিয়ার স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হন। উপরন্তু এ চুক্তিতে রাশিয়া পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তুরস্ককে সামরিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার করে। (৩) ২০ অক্টোবর কামাল ফ্রান্সের সাথে (Franklin Bouillon) চুক্তি স্বাক্ষর করে কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে চূড়ান্তভাবে সিলসিয়া থেকে ফরাসি সৈন্য প্রত্যাহার করতে সক্ষম হন ।
ফ্রান্স ও ইতালিকে নিরপেক্ষকরণের পর কামাল ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রিকদের প্রতি দৃষ্টি দেন। ইতোপূর্বে ১৯২০ সালে গ্রীক বাহিনী কামালের বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে আনাতোলিয়া ও রুমেলিয়ার দিকে অগ্রসর হয় ৷ ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে ইসমত পাশার নেতৃত্বে তুর্কিরা ইনুনুর নিকটবর্তী উপত্যকায় গ্রীক বাহিনীর অগ্রগতিকে রুখে দেয় । ইনুনুর যুদ্ধে সফলতা লাভের পর থেকেই ইসমত পাশার নামের সাথে ইনুনু শব্দটি যুক্ত হয়। জুলাই মাসে গ্রীক বাহিনী আবারো অগ্রসর হলে মুস্তফা কামালের নেতৃত্বে সাকারিয়া নদীর তীরে তুর্কিরা সুস্পষ্ট বিজয় লাভ করে। সাকারিয়া বিজয়ের পর বহির্বিশ্বে জাতীয়তাদের গুরুত্ব বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। এবং তারাই তুরস্কের প্রকৃত সরকারের মর্যাদা পেতে থাকে। অক্টোবর মাসে ফ্রান্সের সাথে সম্পাদিত একটি নতুন চুক্তিতে তুরস্কের অনুকূলে তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্ত নির্ধারিত হয়। উপরন্ত এ চুক্তির ধারা অনুযায়ী ফ্রান্স সিলসিয়ায় তুর্কি নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে নেয়। ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে আবারো গ্রীস বাহিনী আনাতোলিয়ার অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে চাইলে কামাল এ বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। ৯ সেপ্টেম্বর স্মার্ণা পুর্নদখলের মাধ্যমে সমগ্র আনাতোলিয়ায় জাতীয়তাবাদীদের বিজয় সমাপ্ত হয়। আনাতোলিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর কামাল তুর্কি ভূ-খণ্ডের ইউরোপীয় অংশের উপর দৃষ্টি দেন। এ লক্ষে তিনি দার্দানেলিস অতিক্রম করেন। ফ্রান্স ও ইতালি কন্সটান্টিনোপল থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ১৫ সেপ্টেম্বর বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ প্রণালীগুলোর সুরক্ষার জন্য মিত্রশক্তির দেশগুলিকে আহ্বান জানান। কিন্তু এ ব্যাপারে ফ্রান্স ও ইতালির পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায় নি। পরদিনই জেনারেল হ্যারিংটনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী দার্দানেলিসের পূর্ব তীরের এশীয় শহর চনকে অবতরণ করে। কামালের বাহিনীও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। অবশেষে ব্রিটেন নতি-স্বীকার করে এবং কামালের দাবি মেনে নিয়ে কন্সটান্টিনোপল থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হয়। ১১ অক্টোবর কামাল ও মিত্রশক্তির মধ্যে মর্মর সাগরের দক্ষিণ উপকূলীয় শহর মুদানিয়ায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
জাতীয়তাবাদীদের সর্বশেষ লক্ষ্য হল প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। মিত্রশক্তি তুর্কিদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কন্সটান্টিনোপল সরকারও আন্ধারায় প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী সরকার উভয়কেই লুজান সম্মেলনে প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সম্মেলনে সুলতানের প্রতিনিধি প্রেরিত হলে তুরস্কের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই মুদানিয়া যুদ্ধ বিরতির মাত্র ৩ সাপ্তাহ পর ১ নভেম্বর ১৯২২ সালে জাতীয় মহা সংসদ তুর্কি সালতানাতের বিলুপ্তি ঘোষণা করে। তবে তার দায়িত্ব ও ক্ষমতা শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে সম্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করা হয়। কোন রকম প্রতিবাদ ছাড়াই মিত্রশক্তি এ পরিবর্তন মেনে নেয়। ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে লুজান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অক্টোবর মাসের শুরুতেই মিত্র পক্ষের সেনাবাহিনী কন্সটান্টিনোপল ত্যাগ করে । ৬ অক্টোবর জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী কন্সটান্টিনোপলে প্রবেশ করে। ঐদিনই দামাদ ফারিদ পাশা যুগোশ্লাভিয়া পালিয়ে যান। ১১ অক্টোবর গ্রান্ড ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি আন্ধারাকে তুরস্কের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। ২৯ অক্টোবর জাতীয় মহাপরিষদ তুরস্ককে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। মুস্তফা কামাল পাশা এ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট এবং ইসমত ইনুনু প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। খলিফার কতৃত্ব শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকলেও নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের সংস্কারবাদী চরিত্রের সাথে খেলাফতের অস্তিত্ব সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এছাড়া খলিফাকে কেন্দ্র করে প্রজাতন্ত্রের বিরোধীদের সংঘটিত হওয়ার আশাঙ্কা থাকায় ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ জাতীয় মহাপরিষদ খিলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করে। পরদিনই খলিফা আব্দুল মজিদ কন্সটান্টিনোপল ত্যাগ করেন। ফলে তুরস্ক প্রায় ৬৪০ বছরের পুরনো ওসমানীয় শাসনের অবসান ঘটে ।
সর্বোপরি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের যোগদানের ফলে তুরস্কের বুদ্ধিজীবী ও সেনাবাহিনীতে মূলত: দুটি বিপরীত মুখী ও পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। জার্মানীর পক্ষে সমর্থনকারী গোষ্ঠী এনভার পাশার নেতৃত্বে যুদ্ধে যোগদান করলেও কামাল পাশার নেতৃত্বে একদল স্বাধীনতাকামী ও জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ গোষ্ঠী এর তীব্র বিরোধীতা করে। ঘৃণ্য সেভার্সের চুক্তি সুলতান গ্রহণ করতে বাধ্য হলে তুরস্কের সার্বভৌমত্বে কঠোর আঘাত হানে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত করার জন্য ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা মুস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে বৈপ্লবিক আন্দোলনের সূচনা করে। এ আন্দোলন তুকি জাতির ইতিহাসে বহু ঘটনার জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত জাতীয়তবাদীরা সফল হয়। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ মহাপরিষদ খিলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এর ফলে তুরস্কে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রজাতন্ত্র ঘোষণার মূলে কামালের যে অসাধারণ নৈপূণ্য, কৌশল ও ক্ষিপ্রতা লক্ষ্য করা যায় তা সত্যিই বিরল। Wortham যথার্থই বলেন, “Possibly it may stand to posterity as his finest achievement.....the credit for having fashioned the instrument that enabled Turkey to extract such terms belongs to mustafa Kamal.” সুতরাং, তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গুরুত্ব তথা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে।
লুজান চুক্তি
লুজান চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে তুরস্কের সাথে মিত্র শক্তির দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম বৈঠক বসে লুজানে ১৯২৩ সালের ২০ নভেম্বর। ব্রিটিশ পরারাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড কার্জন যুক্তরাজ্যের, মুসোলিনী ইতালির, পয়ঙ্কাবি ফ্রান্সের এবং ইসমত পাশা (ইনুনু) তুরস্কের প্রতিনিধিত্ব করেন । ইসমত ইনুনুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে মিত্রশক্তি অন্যায়ভাবে কোন প্রকার শর্ত তুরস্কের উপর চাপাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ১৯২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি লুজেন বৈঠক বিফলে পরিণত হয়। দীর্ঘকালের আলোচনার ফলে এবং ইসমত ইনুনুর অটল সংকল্প ও দৃঢ় চিত্ততায় মিত্রবাহিনী অবশেষে ২৪ জুলাই পুনরায় বৈঠকে যোগদান করতে সম্মত হয়। এর ফলে তুর্কি তার সকল দাবী আদায়ে সমর্থ হয়। এবং সেভার্সের চুক্তির ফলে তুরস্ক যে গ্লানির সম্মুখীন হয় তা থেকে অব্যাহতি লাভ করে। লুজেনের চুক্তিতে স্বাক্ষর দাতা দেশগুলি হচ্ছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, রুমানিয়া, রাশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, জাপান, গ্রীস ও তুরস্ক ।
মুদানিয়ার যুদ্ধবিরতির পর মিত্রশক্তির নিকট প্রতীয়মান হয় যে মুস্তফা কামালের জাতীয়তাবাদী সরকারের মাধ্যমে সেভার্সের চুক্তি অনুমোদন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিত্র শক্তি ও তুরস্কের মধ্যে আরেকটি নতুন চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে ১৯২২ সালের ২১ নভেম্বর সম্মেলন শুরু হয়। এ সম্মেলনে আঙ্কারা সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন ইসমত ইনুনু। মুদানিয়ায় তার দৃঢ়তার কারণেই তাকে লুজানে তুর্কি জাতির প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি এমন একটি জাতির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, যে জাতি সেভার্সের চুক্তিকে অকার্যকর করে দিয়ে মিত্র শক্তিকে নতুন একটি চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিল । অথচ লুজানেও মিত্র শক্তি তাঁকে পরাজিত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করতে লাগল । কিন্তু তুরস্কের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি মিত্র শক্তির সকল প্রস্তাব ইসমত ইনুনু দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে মিত্র শক্তির অন্যায় যুক্তিসমূহ খন্ডন করেন। এমনকি তিনি মিত্র শক্তির প্রতিনিধিবৃন্দের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও তাদের বলশেভিক ভীতিকে তুরস্কের অনুকূলে কাজে লাগাতে সক্ষম হন ৷
সম্মেলন চলাকালে মুস্তফা কামাল পূর্ব থ্রেসের শহর সমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ইসমতের, অবস্থানকে শক্তিশালী করে দেন। দীর্ঘ বিতর্কের পর ৪ ফেব্রুয়ারী সাময়িক সময়ের জন্য সম্মেলন মূলতবি করা হয়। ইসমত আঙ্কারায় ফিরে আসেন। ৮ মার্চ জাতীয় মহা সংসদ একটি শান্তি প্রস্তাব প্রণয়ন করে। ২৩ এপ্রিল পুনরায় সম্মেলন শুরু হলে ইসমত এ প্রস্তাবটি নিয়ে লুজানে ফিরে আসেন এবং নব উদ্যমে নতুন নতুন যুক্তি প্রদানের মাধ্যমে প্রস্তাবটি মিত্র শক্তির নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন। দীর্ঘ ৩ মাস আলোচনার পর অবশেষে ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই লুজানে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটিই ঐতিহাসিক “লুজান চুক্তি” নামে পরিচিত।
লুজান চুক্তির ধারাসমূহ : লুজান চুক্তিতে ১৪৩ টি ধারা ছিল । চুক্তির উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ হলো—রাজনৈতিক ধারা, ভূ-খণ্ডগত ধারাসমূহ, সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত ধারাসমূহ ও জনসংখ্যা বিনিময় ইত্যাদি। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হল ।
১। চুক্তির প্রথম ভাগে রাজনৈতিক ধারার উল্লেখ করা হয়। এ চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, গ্রিস, রুমানিয়া এবং কিংডম অব সার্বস, ক্রোটস এন্ড স্লোভেনিজ, ইত্যাদি রাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের শান্তি পুনঃ স্থাপিত হবে। তুর্কিদের জাতিগত ঐক্য স্বীকৃতিসমূহের ভূ-খন্ডগত ঐক্য স্বীকার করে নেয়। তুরস্ক আরব অঞ্চল সমূহের পৃথক অস্তিত্ব মেনে নেয়।
২। ভূ-খণ্ডগত ধারাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল ।
(ক) কৃষ্ণসাগর ও ইজিয়ান সাগর পর্যন্ত অঞ্চলে তুরস্কের সাথে বুলগেরিয়া ও গ্রিসের সীমানা এবং ভূ-মধ্যসাগর থেকে পারস্য সীমান্ত পর্যন্ত তুরস্কের সাথে সিরিয়া ও ইরাকের সীমানা নির্ধারিত হয়। চুক্তির সাথে সংযুক্ত মানচিত্রে উপরোক্ত সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। চুক্তির ধারাসমূহ ও মানচিত্রের মধ্যে কোন অসঙ্গতি দেখা দিলে চুক্তির ধারাসমূহই অগ্রগণ্য হবে ।
(খ) গ্রিসের সাথে তুরস্কের সীমানা চূড়ান্ত করার জন্য উভয় দেশ থেকে একজন করে প্রতিনিধি এবং উভয় দেশের পছন্দক্রমে তৃতীয় কোন দেশ থেকে মনোনিত একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি সীমানা কমিশন গঠন করতে হবে। তৃতীয় দেশের প্রনিতিধি এ কমিশনে নেতৃত্ব দিবে না। সীমান্ত নির্দেশক পিলারগুলি উভয় রাষ্ট্র থেকেই দৃশ্যমান হবে এবং গ্রথিত পিলারের সংখ্যা ও অবস্থান মানচিত্রে চিহ্নিত করা হবে।
(গ) মারিজা নদী ও এর পশ্চিম তীরস্থ কারাগাচ শহর পর্যন্ত সমগ্র পূর্ব থ্রেচের উপর পুনরায় তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইমব্রস ও তেনেদস দ্বীপ তুরস্ককে প্রদান করা হয়। তুরস্ক এ অঞ্চলের অমুসলিমদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। তবে ইজিয়ান সাগরের অন্যান্য দ্বীপের উপর গ্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তুরস্ক ইতালির অনুকূলে দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব পরিত্যাগ করে। আনাতোলিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্মার্ণায় তুর্কি সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয় ।
(ঘ) ১৯২১ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়ার সাথে তুরস্কের সীমানা নির্ধারিত হবে বলে স্থির হয়। এ চুক্তিতে আলেকজান্দ্রেত্তা জেলাটি সিরিয়ার সাথে যুক্ত হয়। ইরাকের ম্যান্ডেটরি শাসক ব্রিটেনের সাথে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে তুর্কি-ইরাক সীমানা নির্ধারিত হবে বলে স্থির হয়। ব্রিটেন ও তুরস্ক যদি এক বছরের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থ হয় তাহলে উভয়পক্ষই লীগ অব নেশনস এর কর্তৃত্ব মেনে নিবে বলে অঙ্গীকার করে ।
(ঙ) তুরস্ক মিশর ও সুদানের উপর তার নিয়ন্ত্রণ পরিত্যাগ করে, যা ১৯১৪ সালের ৫ নভেম্বর থেকে কার্যকর বলে বিবেচিত হয়। তুরস্ক সাইপ্রাসের উপর ব্রিটিশ দাবি স্বীকার করে নেয়। সাইপ্রাসে বসবাসরত তুর্কিরা ব্রিটিশ নাগরিকত্ব অর্জন করবে বলে স্থির হয়। তবে চুক্তি কার্যকর হওয়ার দুই বছর পর্যন্ত তুর্কি নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য আবেদন করতে পারবে। আবেদন গৃহীত হওয়ার এক বছরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সাইপ্রাস ছেড়ে তুরস্কে চলে আসতে হবে। তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্নকৃত অঞ্চলের তুর্কি নাগরিকদের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য হবে ।
(চ) আর্মেনিয়া রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে চুক্তিতে কোন কিছু উল্লেখ করা হয় নি ৷ বিষয়টি ট্রান্স-ককেশিয় সীমান্ত নিয়ে পূর্বে সম্পাদিত তুর্কি-সোভিয়েত চুক্তির প্রতি মিত্রশক্তির পরোক্ষ স্বীকৃতির ইঙ্গিত বহন করে। কুর্দিস্থানের স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত বিষয়েও নীরবতা পালন করা হয় ।
৩। লুজানের চুক্তিতে সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত ধারাসমূহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ চুক্তিতে সেবার্সের চুক্তির তুলনায় তুরস্কের সার্বভৌমত্বের প্রতি অধিকতর সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ক্যাপিচুলেশন প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। বিনিময়ে তুরস্ক তার বিচার ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নিয়োগে সম্মত হয়। অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ক বৈদেশিক শক্তিসমূহের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয় এবং মিত্রশক্তি ক্ষতিপূরণের দাবী পরিত্যাগ, করে। তুর্কি সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের উপর সেভার্সের চুক্তিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। তবে তুরস্ক থ্রেস সীমান্তবর্তী ত্রিশ মাইল প্রশস্থ অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে সমর্থ হয়। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য সম্পাদিত চুক্তি সমূহের অনুরূপ চুক্তি সম্পাদন করতে সম্মত হয়। তবে তুরস্কে বসবাসরত গ্রিক-ও আর্মেনিয়দের ব্যাপারে বিশেষভাবে কোনকিছু উল্লেখ করা হয় নি। তবে তুরস্কের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি ধারাসমূহের মধ্যে প্রণালীসমূহের উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছিল অন্যতম। তবে এক্ষেত্রে তুরস্কের প্রতি কিছুটা সম্মান প্রদর্শন করা হয় । বলা হয়, লীগ অব নেশনসের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রণালী কমিশন গঠিত হবে এবং একজন তুর্কি নাগরিক সভাপতি নির্বাচিত হবেন। দার্দানেলিস ও বসফরাস প্রণালীর উভয় তীর এবং মর্মর সাগরস্থ দ্বীপসমূহে সকল প্রকার সামরিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়। তবে তুরস্ক কন্সটান্টিপোপলে ১২,০০০ সৈন্য রাখার অনুমতি পায়। লুজান সম্মেলনেই মর্মর সাগর সহ এ দুটি প্রণালীর ব্যবহার সংক্রান্ত মূল চুক্তির সমমর্যাদা সম্পন্ন একটি উপচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ উপচুক্তিতে বলা হয়। যুদ্ধ ও শান্তি উভয় সময়ই এ জলপথ সমূহের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের নৌ চলাচল এবং উপস্থিত আকাশপথে বিমান চলাচলের স্বাধীনতা থাকবে ।
৪ । জনসংখ্যা বিনিময় সংক্রান্ত ধারাতে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে সম্পাদিত পৃথক একটি চুক্তিতে তুরস্কে বসবাসরত গ্রীক সংখ্যালঘু এবং গ্রিসে বসবাসরত তুর্কি সংখ্যালঘুদের বাধ্যতামূলকভাবে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে কন্সটান্টিনোপলে বসবাসকারী গ্রিক এবং পশ্চিম থ্রেসে বসবাসকারী তুর্কিদের এ চুক্তির আওতামুক্ত রাখা হবে ।
অধিবাসী বিনিময়ের ফলে এশিয়া মাইনর থেকে ১৩,৫০,০০০ গ্রিক গ্রিসে এবং মেসিডোনিয়া থেকে ৪৩,২০০ তুর্কি মুসলমান আনাতেলিয়ায় চলে আসে। এটি বাধ্যতামূলক বাসিন্দা বদল ও যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে যন্ত্রণাদায়ক সংখ্যা গরিষ্ঠ সমস্যার চির অবসান ঘটে। এতে তুরস্কে সর্ব প্রথম জাতি, ভাষা ও ধর্মগত ঐক্য আসে, মিল্লাত অর্থাৎ তুরস্কের অমুসলমান সম্প্রদায়ের অবসান ঘটে ।
৫। লুজানের চুক্তি অনুযায়ী লিবিয়া, সুদান, প্যালেস্টাইন, ইরাক, সিরিয়া ও আরব রাজ্য সমূহের উপর তুর্কি আধিপত্য প্রত্যাহার করা হয় ।
৬। সাইপ্রাস ব্রিটেনের দখলে চলে যায় ।
৭। তুরস্ককে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এতে তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় ৷
ফলাফল : লুজানের চুক্তি তুরস্কের জন্য সুদূর প্রসারী ফল বয়ে আনে। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যোগ দিলে যুদ্ধ শেষে মিত্র শক্তি তুরস্কের উপর সেভার্সের মত যে ঘৃণ্য ও অপমানকর চুক্তি চাপিয়ে দেয় তা বহুলাংশে সংশোধিত ও পরিমার্জিত হয় লুজানের চুক্তিতে। এটি অনেকটা ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার পাওয়া একটি নতুন জাতি। এ কারণে ঐতিহাসিক প্রাইস বলেন, "The Ottoman Empire was dead but a new turkish nation had been internationally recognised in control of all the truly Turkish lands in Asia Minor and of a small part of South east Europe together with the historic capitals of constantinople and Adrianople"
ক্যাপিচুলেশন প্রথা বাতিলের ফলে তুরস্কের অর্থনীতিতে নতুন যুগের সূচনা হয়। উল্লেখ্য সে, ক্যাপিচুলেশন প্রথা অনুযায়ী বিদেশী খ্রিস্টান সম্প্রদায় তুরস্কের আইন না মেনে তাদের নিজস্ব অনুশাসন মানত। তারা তুরস্কের সরকারকে কোন প্রকার কর দিত না এবং রাষ্ট্রের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। ১৫৩৫ সালে মহামতি সুলায়মান সর্বপ্রথম ফরাসিদের এ ক্যাপিচুলেশন প্রদান করেন। লুজানের চুক্তিতে এ প্রথা বাতিল হওয়ায় তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় ।
সামরিক যুদ্ধে (গ্রিকদের সাথে) তুরস্ক জয়লাভ করে। জাতীয়তাবাদীদের রাজনৈতিক কাযক্রম কার্যকর হয় এবং একটি আন্তজার্তিক চুক্তি দ্বারা তা স্বীকৃত হয়। লুজানের চুক্তি তুরস্কের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রকটভাবে নাড়া দেয় এবং ক্ষয়িষ্ণু সালতানাত খিলাফতের পতনকে ত্বরান্বিত করে। মুস্তফা কামাল পাশা একজন জাতীয় নেতা বা আতার্তুকের মর্যাদা লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে ইসমত ইনুনু বলেন, “We have finised the exams and now we are graduating.” অর্থাৎ, আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়েছে এবং আমরা একটি আধুনিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছি।
সর্বোপরি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যে সকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার মধ্যে লুজানের চুক্তি ছিল দীর্ঘ স্থায়ী। এ চুক্তি ছিল তুর্কি জাতীয়তাবাদের বিজয়। এটি কোন আরোপিত চুক্তি ছিল না। এটি ছিল সমতার ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি। এ চুক্তিতে তুর্কিদের ন্যায্য দাবীসমূহ প্রতিফলিত হয়। তুরস্কের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এবং তুর্কি অধ্যুষিত ভূ-খণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষিত হয় । সামরিক, অর্থনৈতিক ও বিচারিক ক্ষেত্রে তুরস্ক বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জাতীয়তাবাদী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করে। তাই ঐতিহাসিক লুজান চুক্তি পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।
কামালিষ্ট সংস্কারসমূহ
মুস্তফা কামাল পাশার সংস্কারসমূহ ইতিহাসে Kamalist Reforms বা কামালিস্ট সংস্কার নামে পরিচিত। তিনি বহুবিধ সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্ককে একটি আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলেন ।
প্রাথমিক জীবন ও উত্থানের ইতিহাসের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, প্রখর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী মুস্তফা কামাল ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক ও তুর্কি জাতির প্রতিষ্ঠাতা। স্যালোনিকার একটি ক্ষুদ্র কৃষকপরিবারে ১৮৮১ সালে তার জন্ম হয়। তার পিতা আলীরেজা গোঁড়া ছিলেন না । এবং চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সুযোগ্য পুত্র মুস্তফা পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং বিদ্যা শিক্ষার ব্রতী হন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার পিতার মৃত্যু হলে তিনি আর্থিক সঙ্কটে পড়েন। মুস্তফা কামাল তার মাতা যোবায়দার সাথে এক মামার বাসায় বসবাস করতে থাকেন। তিনি কৃষিকার্যে ও কিছুকাল নিয়োজিত ছিলেন। এ কাজের পরিশ্রম ও কর্তব্যবোধ পরবর্তীকালে মুস্তফাকে অদম্য স্পৃহা ও অফুরন্ত শক্তির অধিকারী করে। তার বুদ্ধিমতি মাতা তাকে এগার বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করেন। কিছুকাল অধ্যায়ন করার পর তিনি স্কুল ত্যাগ করেন । তিনি স্বাধীনচেতা ও আদর্শবান ছিলেন। এ কারণে তিনি সাধারণ মাধ্যমিক স্কুল ছেড়ে ১৮৯৫ সালের মোনাস্তিরের সামরিক স্কুলে ভর্তি হন। মাতার অজান্তেই তিনি স্যালোনিকার সামরিক একাডেমীতে যোগদান করেন। কিন্তু তার মাতা জানতে পেরে তাকে আশীর্বাদ করেন। সেখান থেকে তিনি ১৮৯৯ সালে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। তারপর তিনি ইস্তাম্বুলের মিলিটারি স্টাফ কলেজে যোগ দেন। এবং সেখান থেকে তিনি ১৯০৫ সালে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ১৯১৫ সালে তিনি দার্দানেলিস প্রণালীতে তুরস্কের প্রতিরক্ষায় অসামান্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করে জাতীয় বীরে পরিণত হন। পুরষ্কার স্বরূপ তাকে সম্মানসূচক ‘পাশা’ পদবি প্রদান করা হয় । মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯১৯ সালে তিনি আনাতোলিয়ায় তুরস্কের উপর মিত্রশক্তির চাপিয়ে দেয়া সেভার্স চুক্তির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেন এবং মিত্রশক্তিকে নতুন আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। ১৯২১ সালে আঙ্কারায় তিনি একটি জাতীয় সরকার গঠন করেন এবং ১৯২২ সালে তুর্কি সালতানাতের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। ১৯২৩ সালে জাতীয় সংসদ তুরস্ককে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে এবং মস্তুফা কামাল এ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি তুরস্ককে একটি আধুনিক এবং ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা ও ভাষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় সংস্কার সাধন করেন যা ইতিহাসে Kamalist Reforms বা কমালিস্ট সংস্কার নামে পরিচিত।
মুস্তফা কামালের সংস্কারসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল :
১। রাজনৈতিক সংস্কার : জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) বহু রাজনৈতিক ও সামারিক আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন । তার অসমান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ধীশক্তি, দৃঢ়চিত্ততা ও সামরিক শৌর্যবীর্য দ্বারা আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা লাভ করেন। নব্য তুর্কি বিপ্লবের বিফলতায় কামাল মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন যে, তুরস্কের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করতে হলে
একটি গণতন্ত্রপন্থী ও প্রগতিশীল রাজনৈতক সংগঠন প্রয়োজন। এ কারণে সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেনের পদে থাকা সত্ত্বেও তিনি রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি দামেস্কে অবস্থানকালে পিতৃ সংগঠন ওয়াতন' (Waton) এ যোগদান করেন এবং তাকে Father land and Freedom Society' বা পিতৃভূমি ও স্বাধীনতাকামী সমিতি নামে পুনর্গঠিত করে। সামরিক গৌরব ও মর্যাদার মাধ্যমে কামাল পাশার রাজনৈতিক সাফল্য আসে। ১৯২৩ সালে তিনি ‘পিপলস পার্টি' গঠন করে সালতানাত উচ্ছেদসহ কতিপয় রাজনৈতিক সংস্কারে ব্রতী হন। পরবর্তী পর্যায়ে তুরস্ক তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে একটি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয় এবং তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর খিলাফত বিলুপ্ত করে কামাল তুরস্ককে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। তার জাতীয়তাবাদী নীতি তার ঘোষিত ‘Kamalism' বা কামালবাদের অন্যতম প্ৰধান মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩০ সালে তিনি মিউনিসিপাল নির্বাচনে নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করেন। ১৯৩৪ সালের নির্বাচনে ও নারীদের ভোটাধিকার ও প্রার্থী হওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়। এর ফলে ১৯৩৫ সালের নির্বাচনে ১৮ জন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ।
মুস্তফা কামাল রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসে আত্মনিয়োগ করেন এবং রাজধানী ইস্তাম্বুল থেকে আনাতোলিয়ার আঙ্কাররায় স্থানান্তরিত করেন। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। কামালকে রাষ্ট্র প্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার প্রধান কৃতিত্ব হল যে, তিনি তুরস্ককে একটি “Republican Nationalist, Populist, elitist, Secular and Reformist”— রাষ্ট্রে পরিণত করেন। নব্য-তুর্কি বিপ্লবে তিনি অংশ গ্রহণ করলেও এনভার পাশার মত হীন ব্যক্তিদের জার্মান প্রীতিতে তিনি এ সংস্থা থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি নবগঠিত তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের দিক পাল হিসেবে ঘোষণা দেন, “The Turkish nation is ready and resolved to advance unhalting and undaunted on the path of civilization.” অর্থাৎ তুর্কি জাতি নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং অকুতভয়ে সভ্যতার দিকে অগ্রসর হতে সদা প্রস্তুত ও সংকল্পবদ্ধ ।
২। সামাজিক সংস্কার : মুস্তফা কামালের সামাজিক সংস্কারের ফলে তুরস্কের সামাজিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল। কামালের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় তুরস্ককে নব জীবন দান করে। অটোমান সুলতানদের শাসনামলে নারী ও পুরুষের স্বাধীন সত্ত্বা স্বীকৃতি পায় নি । নিম্নে তার সামাজিক সংস্কারসমূহ আলোচনা করা হল ।
(ক) ওসমানিয় সমাজ ব্যবস্থায় সর্বত্র ধর্মীয় প্রভাব ছিল স্পষ্ট। জনগণের পোষাক-পরিচ্ছেদ তাদের ধর্মীয় পরিচয় ফুটে উঠত। এমনকি মাথায় পরিধেয় পাগড়ি, ফেজ, বনেট ইত্যাদি জনগণের পেশা ও পদমর্যাদা নির্দেশ করত। ১৯২৬ সালের প্রর্ণীত ড্রেস কোড' অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন ধর্ম ও পেশার মানুষের পরিধেয় বস্ত্র নির্দিষ্ট ছিল । মুস্তফা কামাল আইন প্রণয়ন করে এসব সনাতন পোষাক পরিধান নিষিদ্ধ করেন এবং আধুনিক পোষাক পরিধানের নির্দেশ দেন। ১৯২৫ সালে তিনি ‘হ্যাটল’ প্রবর্তন করে ফেজ ও পাগড়ীর বদলে হ্যাট পরিধান করার নির্দেশ দেন। অবশ্য মহিলাদের পর্দা প্রথাকে নিরুৎসাহিত করা হলেও তা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় নি ৷
(খ) তিনি সমাজের সর্ব ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন। প্রাচীন অটোমান রীতি অনুযায়ী তুর্কি পুরুষরা পাশা, এফেন্দি এবং মহিলারা হানুম ইত্যাদি পদবি গ্রহণ করত। এসব পদবির সাথে সংশ্লিষ্টপদ ও পদমর্যাদা বিলোপ করা হয়। ১৯৩৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রত্যেক তুর্কিকে পারিবারিক উপাধি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয় । ওগলু, ‘ইনুনু,' আতার্তুক ইত্যাদি পদবি চালু করা হয় ।
(গ) বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের চিকিৎসায় ওলামাদের অত্যন্ত প্রভাব ছিল । তারা ঝার-ফুঁক ও হারবাল ঔষধের মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করতেন। মুস্তফা কামাল ওলামাদের প্রাচীনপন্থি ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে অভিহিত করেন। আইন করে তিনি ওলামাদের চিকিৎসা প্রদান থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন এবং তাদের পরিবর্তে আধুনিক চিকিৎসাজ্ঞান সম্পন্ন ডাক্তারদের স্থলাভিষিক্ত করেন ।
(ঘ) খেলাফাত বিলুপ্ত হলে রাজনেতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রাধান্য লোপ পেলেও মুসলমানদের মুসাফির খানাগুলো তখনোও সমাজে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির কেন্দ্রহিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। ১৯২৫ সালে একটি আইন পাস করে কামাল মুসাফির খানাগুলো বন্ধ করে দেন।
(ঙ) তিনি সমাজে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। বহু বিবাহ লোপ করা হয় । বিবাহ বিচ্ছেদ আদালতের মাধ্যমে কার্যকর করার আইন করা হয় এবং নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেয়া হয়। ১৯২৯ সালে প্রথমবারের মত তুরস্কে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ১৯৩০ সালের মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য মিস তুর্কিকে রিওডিজেনিরোতে পাঠানো হয়। ১৯৩২ সালে নির্বাচিত মিস তুর্কি একই বছর মিস ইউনিভার্স নির্বাচিত হন ।
(চ) তুর্কি সমাজে শরীয়তী আইনের ব্যাপক প্রচলন ছিল । কামাল ১৯২৬ সালে সুইস দেওয়ানি আইন সংসদে পাস করেন। এতে শরিয়তী আইন বিলুপ্ত হয় ৷
৩। ধর্মীয় সংস্কার : মুস্তফা কামাল ১৯২৪ সালে খিলাফত উচ্ছেদ করে প্রমাণ করেন যে তিনি একটি ধর্ম নিরপেক্ষ (Secular) রাষ্ট্র কায়েম করেন। কামালবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের অর্থ অধার্মিকতা নয় বরং পার্থিব ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী থেকে ধর্মীয় কার্যাকলাপকে পৃথকীকরণ। আধুনিকীকরণের নামে মুস্তফা ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেন এবং রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথকীকরণের মূলে ছিল নিম্নবর্ণিত শর্তাবলী ।
প্রথমত, তুরস্ক প্রজাতন্ত্র জাতীয়তাবাদী নীতির উপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র। তাই ধর্ম ভিত্তিক স্বাধীনতার পরিবর্তে দ্ব্যর্থহীন ও শর্তহীন জাতীয় সার্বভৌমত্বের উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে এবং সামাজিক জীবনে আধুনিক সভ্যতায় নীতিমালার অনুকূল নতুন সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ধর্মকে যারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তারা ওসমানিয় সাম্রাজ্যের মত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এ সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তৃতীয়ত, বৈদেশিক নীতিতে ধর্মীয় নীতি বা মতবাদ ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই। এবং এ দ্বারা তুর্কি জাতির কোন উপকার হবে না বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে কামাল আতাতুর্ক যে সাহসী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ১২৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ওসমানিয় সাম্রাজ্য ১৯২২-২৪ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সাতশত বছর সুদৃঢ় সালতানাত ও খিলাফত হিসেবে বজায় থাকে । বস্তুত ৬৩২ থেকে শুরু করে প্রায় ১৩০০ বছর স্থায়ী হয় এবং এ প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করা সহজ কাজ ছিল না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পূর্বে বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে প্রথমে জনমত সৃষ্টি করা হয়। এতদসত্ত্বেও কুর্দি দরবেশদের বিদ্রোহ প্রজাতন্ত্রে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। যাহোক, ধর্মীয় ক্ষেত্রে সে সকল সংস্কার কামাল প্রবর্তন করেন তা নিম্নে তুলে ধরা হল ।
(ক) ১৯২২ সালের আনুষ্ঠানিকভাবে সালতানাতের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয় । (খ) ১৯২৪ সালে ঐতিহ্যবাহী খিলাফতের উচ্ছেদ করা হয়। বার্ণাড লুইস এ প্রসঙ্গে বলেন, “The abolition of Caliphate was a crushing blow to their whole hierarchic organization.” অর্থাৎ খিলাফতের অবলুপ্তি তাদের ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি প্রচণ্ড আঘাত স্বরূপ ছিল ।
(গ) ১৯২৪ সালে শরীয়ত ও ওয়াকফ মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করা হয় ।
(ঘ) ১৯২৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইসলাম ধর্মের নামে শপথ গ্রহণ না করে সততার নামে শপথ গ্রহণ করে ।
(ঙ) ক্যাপিচুলেশন প্রথা অর্থাৎ অমুসলিম সম্প্রদায়ের আইন, সামাজিক ও অন্যান্য সুবিধাভোগের যে রীতি ছিল তা অবসান হয় ।
(চ) নিজামিয়া আন্দোলন বিলুপ্ত করা হয়। ওসমানিয় যুগে এ আদালতে খ্রিস্টান, মুসলমান ও ইহুদি বিচারকেরা পাশাপাশি বসে আইন মোতাবেক প্রজাদের বিচার করতেন। এতে ব্যাপক জটিলতার সৃষ্টি হয় ।
(ছ) মক্তব, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে এনে শিক্ষা দফতরের উপর ন্যস্ত করা হয় ।
(ঝ) আরবী ভাষার সংস্কার করা হয় এবং আরবী হরফ পরিবর্তিত হয়ে তুর্কি ভাষা ও হরফ প্রচলিত হয় ।
(ঞ) ১৯২৫ সালের হিজরি সন পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক সময় ও পঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়। আবদুল কাদির বলেন, “এর ফলে পাশ্চাত্যের সাথে পত্রাদি লেখার সুবিধা হলেও মুসলিম জগতের কিংবদন্তীর সাথে তুরস্কের একটি দৃঢ়বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল।”
(ট) ইসলামে মূর্তি নির্মাণ বেশরিয়তি কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ১৯২৬ সালে কামাল আতার্তুকের একটি মর্মর মূর্তি খোদিত হয়ে প্রকাশ্যে প্ৰদৰ্শিত হয় । বর্তমানে আঙ্কারা যাদুঘরে এটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
(ঠ) ১৯৩৪ সালে ধর্মীয় নেতা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির ফেজ ও আলখাল্লা পরিধান নিষিদ্ধ ঘোষিত হল ।
(ড) ১৯৩৫ সালে আরবি-ফার্সি নামের পরিবর্তন করে তুর্কি নাম গ্ৰহণ বাধ্যতামূলক হল । কামাল নিজে ‘আতাতুর্ক এবং ইসমত পাশা ‘ইনুনু' উপাধি গ্রহণ
করেন।
(ঢ) ধর্মীয় শিক্ষার জন্য যে প্রতিষ্ঠান ছিল, যেমন তরিকত, তা বিলুপ্ত করা হয়। কামাল বলেন,“বন্ধুগণ আমাদের জানা উচিত যে, তুরস্ক প্রজাতন্ত্র শেখ, দরবেশ ও মুরিদদের দেশ হতে পারে না। সর্বোৎকৃষ্ট ও প্রকৃত তরিকত হল সভ্যতা তরিকত।” পীর মুরিদদের আস্তানা অসামাজিক ও রাজনৈতিক আখড়া হতে পারে এ কথা মনে করে ১৯২৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর একটি সরকারি আদেশে এসব তরিকতের আস্তানা বন্ধ করে দেয়। এমনকি দরবেশদের সমাধিও (Turbe) বন্ধ করে দেয়া হয় ।
৪। অর্থনৈতিক সংস্কার : মুস্তফা কামাল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন । তিনি কর ব্যবস্থাসহ অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কার করে তুরস্কের জন্য একটি সুষম বাজেট প্রণয়ন করতে সক্ষম হন। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ অনুযায়ী অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এবং বিদেশীদের দ্বারা শোষিত তুর্কিদের পক্ষে বৃহৎ শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ সম্ভব নয় বলেই এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। তাই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় বেশ কিছু শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কয়েকটি নতুন কলকারখানা স্থাপিত হয়। দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তীকালে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তুরস্কের কৃষিক্ষেত্রে চার বছর মেয়াদি পরিকল্পনা। খনিজ শিল্পে তিন বছর মেয়াদি এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে দশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । তুরস্কের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা ছাপানোর কাজ এবং অর্থনৈতিক নীতিসমূহ তদারকির কাজ করত। নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন করতে সুমের ব্যাংক Sumer Bank এবং খনিজ শিল্পে অর্থায়নের উৎস ছিল এতি ব্যাংক (Eti Bank) । আর আরব ব্যবসায় ও কৃষিখাতে অর্থায়ন করত যথাক্রমে ইজ ব্যাংক (Is Bank) ও কৃষি ব্যাংক। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তুরস্কের এসব কর্মতৎপরতার ফলে তুরস্কের প্রতি দাতা দেশগুলোর আস্থা বৃদ্ধি পায়। ফলে তুরস্ক তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক ঋণ পেতে সক্ষম হয়। এভাবে তিনি তুরস্কের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখেন ৷
৫। শিক্ষা সংস্কার : মুস্তফা কামাল শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। তুরস্কে বিদ্যমান সকল প্রকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে তুরস্কের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রভাব হতে মুক্ত করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সমম্বয়ে গঠিত শিক্ষা কাউন্সিল শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা সংবিধানে বর্ণিত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনটি কার্যকর করা হয়। ফলে অল্প কিছুকালের মধ্যেই মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ব্যবসায়, কৃষি, বন ইত্যাদি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে সরকার বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়। সরকারের নিমন্ত্রণে সুইস অধ্যাপক ড. ম্যালশে তুরস্কের উচ্চ শিক্ষা সংস্কারের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চিকিৎসা অনুষদ স্থাপিত হয়। এতে ২০ জন বিদেশি অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া হয়। ইস্তাম্বুলে একটি রাষ্ট্র ও সামাজিক বিজ্ঞান বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। প্রচুর প্রশাসক, কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ সৃষ্টিতে এ বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ্যাথলেটিকস, স্পোর্টস ক্লাব, বয়েস স্কাউট ইত্যাদিকে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৩৫ সালে তুর্কি এ্যাথলেটদের প্যারাসুটিং ও গ্লাইডিং প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য রাশিয়া থেকে প্রশিক্ষক আনা হয়। কামাল তার সংস্কারসমূহ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে কাজে লাগিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্ম এবং উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিপলস পার্টির সদস্য করার মাধ্যমে তিনি মতবাদগুলো প্রচার করেন। এ সংস্থার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সংস্থার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ।
মুস্তফা কামাল নারী শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নারীকে শিক্ষা দীক্ষায় তিনি অগ্রগতির সোপান হিসেবে তৈরী করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভ করার জন্য নারীদেরকে বিদেশে প্রেরণ করা হত । আইন, চিকিৎসা ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে তুর্কি নারীরা স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে চাকরী ক্ষেত্রে প্রবেশ করে মুসলিম নারী জাগরণের এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ।
৬। বিচার ব্যবস্থার সংস্কার : মুস্তফা কামাল বিচার বিভাগের সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ওসমানিয়া শাসনামলে বিদ্যমান মিল্লাত ব্যবস্থায় ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহ স্ব স্ব ধর্মের আইন অনুযায়ী বিচার কার্য সম্পাদন করত । তিনি এসব ভিন্ন ভিন্ন বিচার ব্যবস্থা বিলোপ করে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি বিচার ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনেন। সুইজারল্যান্ডের অনুকরণে তিনি তুরস্কের দেওয়ানি আইন এবং ইতালির অনুকরণে ফৌজদারি আইন প্রবর্তন করেন। এছাড়া জার্মানীর অনুকরণে বাণিজ্যিক আইন চালু করা হয়। ১৯৩৪ সালের আইনের দৃষ্টিতে সকল নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই বছর সংবিধান সংশোধন করে নারীদের ভোটাধিকার এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কিছু নারী জাতীয় মহাসংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তুর্কি ভাষার পুনর্জাগরণ এবং বিদেশি ভাষার প্রভাব হতে একে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত গবেষণায় সরকারি অর্থ বরাদ্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্তেরই পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৩০ সালে তুরস্কের বিভিন্ন স্থানের বৈদেশিক নামের পরিবর্তে তুর্কি নামকরণ করা হয়। যেমন—বাইজেন্টান নাম কন্সটান্টিনোপল পরিবর্তিত হয়ে তুর্কি নাম হয় ইস্তাম্বুল, আদ্রিয়ানোপল হয় এদিনে (Edirne) স্মার্ণা হয় ইজমির ইত্যাদি।
৭। ভাষা সংস্কার : মুস্তফা কামাল পাশার সর্বাপেক্ষা বিপ্লবাত্মক সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আরবি ভাষা ও হরফের স্থলে তুর্কি ভাষা ও হরফের প্রবর্তন । ১৯২৮ সালের ১ নভেম্বর ভাষা কমিশন আরবি বর্ণমালার পরিবর্তে তুর্কি বর্ণমালা চালু করে। এ সংস্কারের পক্ষে তিনি দেশব্যাপী প্রচারণায় নিয়োজিত হন। তিনি স্বয়ং তার গ্রীষ্মকালীন বাসভবনের সামনে স্থাপিত ব্ল্যাকবোর্ডে জনসাধারণকে ল্যাটিন বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। আরবির বদলে ল্যাটিন বর্ণমালা চালুর কারণ হিসেবে বলা হয় যে আরবি বর্ণ মালার সাহায্যে তুর্কি ভাষা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এছাড়া আরবি বর্ণমালার তুলনায় ল্যাটিন বর্ণমালায় তুর্কি ভাষা লেখা ও পড়া সহজ হওয়ায় জনগণের মধ্যেও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হয়। পরবর্তী সময়ে এ অনুমান কিছুটা সত্য প্রমাণিত হয়। ১৯২৮ সালে তুরস্কে শিক্ষার হার ছিল শতকরা প্রায় ৫ ভাগ । ১৯৩৫ সালে তা বেড়ে হয় শতকরা ২০ ভাগেরও বেশী এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তা হয় শতকরা ৩০ ভাগ । এছাড়া আরবি একটি ধর্মীয় ভাষা হওয়ায় এ ভাষার কবল থেকে তুর্কি ভাষাকে মুক্ত করার ফলে ভাষার ক্ষেত্রেও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাঠ্যসূচী থেকেও আরবি- ফার্সিকে বাদ দেয়া হয়। তুর্কি ভাষার মাহাত্ম্য প্রকাশ করার জন্য বলা হয়। তুর্কি ভাষা হল বিশ্বের প্রথম ভাষা এবং তুর্কি ভাষা থেকেই অন্য সব ভাষার জন্ম হয়েছে । কামাল জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেন, “প্রিয় দেশবাসী, নতুন তুর্কি বর্ণমালা শীঘ্র লিখে নিন। গ্রামবাসী' রাখাল, কুলি ও মাঝিসহ সমস্ত জাতিকে শিখান। এটি দেশ ও জাতির প্রতি ভালবাসার নিদর্শন।”
এভাবে তিনি দেশব্যাপী তুর্কি ভাষার প্রচার ও প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন তুরস্কে আরবি বর্ণমালার সমস্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিক বার্নাড লুইস বলেন, “The Arabic alphabet though admirably suited to Arabic, is peculiarly inappropriate to the Turkish language. Although Turkish contains many loan words, borrowed from Arabic and Persian, its basic structure remains very different from both with a range of forms and sounds that the Arabic script is unable to convey.” সুতরাং তুরস্কে আরবীর পরিবর্তে তুর্কি ভাষার প্রচলন করা অপরিহার্য ছিল ।
পরিশেষে বলা যায় যে, মুস্তফা কামাল পাশা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ও ইউরোপীয় ‘রুগ্ন দেশ' তুরস্ককে বৈদেশিক আক্রমণ হতে রক্ষাই করেন নি নবজীবনও দান করেন। সেদিক থেকে ত্রাণকর্তাও বলা যেতে পারে। তিনি ধ্বংস স্তূপ থেকে উদ্ধার করে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্ককে একটি আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি তার অতুলনীয় সংস্কার দ্বারা সালতানাত, খিলাফত, ক্যাপিচুলেশন ও মিল্লাত প্রথার অবসান ঘটান। পাশ্চাত্যের প্রভাবে তিনি তুরস্কের আধুনিকীকরণে সফলতা লাভ করেন। প্রগতিশীল, গণতন্ত্রী এবং সংস্কারপ্রবণ তুরস্ক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কামালকে জাতীয় পরিষদ ‘আতাতুর্ক' বা তুর্কি জাতির পিতা নামে অভিহিত করে।

ছয়নীতি (Six Principles )


তুরস্কের জাতীয় ইতিহাসে ছয় নীতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তুর্কি জাতির মহানায়ক মুস্তফা কামাল এ ছয়টি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে তার সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। যা কামালবাদ নামেও পরিচিত। কামাল প্রতিষ্ঠিত ‘পিপলস' পার্টির তৃতীয় অধিবেশন এ ছয় নীতি গৃহীত হয়। ১৯৩৭ সালে এ নীতিগুলো তুরস্কের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ নীতিগুলো হচ্ছে-
১ । প্রজাতন্ত্রবাদ
২। জাতীয়তাবাদ
৩ । গণবাদ
৪ । রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ ৫। বিপ্লববাদ
৬। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
নিম্নে এ নীতিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১ । প্রজাতন্ত্রবাদ : দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অসমর্থ এবং জাতির শত্রুদের সাথে সহযোগিতাকারী সুলতানের শাসন চালু রাখার কোন ইচ্ছা জাতীয়তাবাদীদের ছিল না। তুরস্কে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত ওসমানিয় সাম্রাজ্য তার ধর্মীয় ঐতিহ্য ও রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নিয়ে টিকে ছিল। প্রজাতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক সালতানাত বিলুপ্ত করা হলেও জনগণের মানসিকতায় তখনো এর কিছুটা প্রভাব ছিল। কামাল জনগণের মানসিকতা থেকে গতানুগতিক চিন্তা-চেতনা দূর করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধন করেন। ওসমানির আমলের দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পরিবর্তে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত এক কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় মহাসংসদ গঠন করা হয়। ওসমানিয় আমলের মিল্লাত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের নেতা নির্বাচিত করত এবং কর, বিচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। কামাল এ ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সাধারণ ও ধর্মনিপেক্ষ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ১৯৩০ সালে তিনি মিউনিসিপাল নির্বাচনে নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করেন। ১৯৩৪ সালে জাতীয় নির্বাচনেও নারীদের ভোটাধিকার ও প্রার্থী হওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়। এর ফলে ১৯৩৫ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ১৮ জন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। উপরন্তু প্রজাতন্ত্র ঘোষণা নিয়ে সংসদে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হলে প্রবীনতম সদস্য আব্দুর রহমান শরফ বলেন, “শত বর্ষের সংস্কার প্রয়াসের ফলস্বরূপ এ নবজাতক । আমরা কি এর নামাকরণে ভীত হব? এ সত্য আমাদেরকে গ্রহণ করতেই হবে যে এটা প্রজাতন্ত্র ।”
২। জাতীয়তাবাদ : প্যান-ইসলামবাদের মত কোন বিতর্কিত ও অনিশ্চিত আদর্শকে কামাল রাষ্ট্রীয় নীতির নিয়ামক হিসেবে গ্রহণ না করে দেশপ্রেম, তুর্কি জনসাধারণের স্বার্থ এবং দেশজ সংস্কৃতি ও আধুনিকতাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা অর্জন তথা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কামালের এ জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় নি। ওসমানিয় সাম্রাজ্যের হারানো অঞ্চলসমূহ পুনরুদ্ধার করাও এর উদ্দেশ্য ছিল না। কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল তুর্কি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। প্রজাতান্ত্রিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণকারী জনগণকে কামাল তুর্কি জাতি বলে অভিহিত করেছেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রজাতান্ত্রিক তুরস্কই তুর্কি জাতি রাষ্ট্রে পরিণত হয় । তুর্কি জাতির স্বাধীনতা লাভের পরও জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব হ্রাস পায় নি। নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের সংহতি রক্ষা এবং যে কোন প্রকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদ নীতিটি গৃহীত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ও পরে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনাধীন জাতিসমূহ স্বাধীনতা লাভ করলে ওসমানিয় সাম্রাজ্যের বহুজাতিক চরিত্র লোপ পেলেও শেখ, গোত্র প্রধান ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের প্রাধান্যের কারণে রাষ্ট্রীয় সংহতি ব্যহত হওয়ার উপক্রম হয়। তাদের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যেই কামাল তার জাতীয়তাবাদের ধারণাটি কাজে লাগান । কামালের এ জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্যেই ছিল স্বৈরতন্ত্র, মোল্লাতন্ত্র ও সামন্তবাদের কবল থেকে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র জনগণ তথা তুর্কি জাতির নিকট হস্তান্তর করা। ১৯২৭ সালে তুরস্কের জনসংখ্যার শতকরা ৯৭.৩ ভাগ ছিল তুর্কি মুসলমান। জাতিগত ও ধর্মীয় মিল থাকায় নব প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রটির জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়। সংবাদপত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, রিপাবলিকান পিপলস পার্টি এবং নব্যতুর্কিদের উত্তরসূরী সংগঠন Turkish Hearth Organization-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিয়তাবাদী মতবাদ প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এতে তুর্কিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশে তুর্কিদের অবদান প্রচার করা হয়। তাই তুর্কি জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।
৩। গণবাদ : গণবাদের মূলকথা হচ্ছে জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব ৷ সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস জনগণ এবং জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় মহাসংসদ এ সার্বভৌমত্বের প্রতিভূ। গণবাদ মতামতটি তুর্কি জাতীয়তাবাদ ও প্রজাতন্ত্রের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপে গণবাদের বিকাশ ঘটে। শ্রেণি, পদমর্যাদা, ধর্ম, পেশা নির্বিশেষে আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ঘোষিত হয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও শ্রেণীভিত্তিক সকল প্রকার বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বিলুপ্ত করা হয়। কাল মার্ক্সের শ্রেণি সংগ্রামের বিপরীতে কামাল এ মতবাদটি প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি রাষ্ট্রীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করেন। “There are no classess, There are only occupa- tion”. এ মতবাদকেই একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়। বলা হয়, যেহেতু তুর্কি সমাজে কোন শ্রেণী বিভাজন নেই সেহেতু সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব বা স্বার্থ রক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক প্ৰতিনিধিত্ব বা স্বার্থ রক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের ও প্রয়োজন নেই। রিপাবলিকান পিপলস পার্টিই সমগ্র জাতির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করবে। গণবাদ অনুযায়ী সরকারের মালিক জনগণ, শাসক শ্রেণি নয়। এ দৃষ্টিকোণ গণবাদকে গণতন্ত্রের সাথেও তুলনা করা যায়। শাসনকার্যে জনগণের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই জাতীয় মহাপরিষদ গঠন করা হয়েছিল । শুরুতে ১৮ বছর বা তদোর্ধ বয়সী পুরুষদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। পরে ১৯৩৪ সালে নারীরাও ভোটাধিকার এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার পায়।
৪। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ : কামাল বুঝতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও বৈদেশিক বিশেষ সুযোগ-সুবিধার শিকার তুর্কি জনসাধারণের পক্ষে মূলধন বিনিয়োগ করে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ বলতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে বুঝায় ৷ নির্দিষ্ট অর্থে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ হচ্ছে যেসব দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও পুঁজি অত্যন্ত দুর্বল সেসব দেশে জাতীয় উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষার জন্য অর্থনৈতিক ও শিল্পক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ। মুস্তফা কামালের রাষ্ট্রীয় কর্তত্ববাদ নীতিটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। কামাল বিভিন্ন সময় তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর তুরস্কের আধুনিকায়ন অনেকাংশে নির্ভরশীল । তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অর্থনীতির যেসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাফল্যের সম্ভাবনা কম সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তুরস্কের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কৃষি মন্ত্রণালয়কে কৃষি খাতের উন্নয়নের দায়িত্ব দেয়া হয় । কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, নতুন ফসল, তার উৎপাদন পদ্ধতি ও উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহে কার্যকর ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানো হয়। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম একদশকে শিল্প ক্ষেত্রে উন্নয়ন কৃষির তুলনায়ও মন্থর ছিল । শিল্পের বিকাশের জন্য নব্য তুর্কিরা কর আরোপে ছাড় এবং যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক মওকুক সুবিধা প্রদান করলেও এ খাতে খুব একটা অগ্রগতি সাধিত হয় নি। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ফলে তা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। উপরন্তু বিদেশী পুঁজিবাদীদের দীর্ঘ শোষণের ফলে তুর্কি শিল্পোদ্যোক্তারা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। তাই কামাল শিল্পোন্নয়নে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি তামাক, দিয়াশলাই, চা, লবণ, তেল ও মাদকদ্রব্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া বেসরকারী বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য তিনি রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের নীতি গ্রহণ করেন ।
৫। বিপ্লববাদ : সমাজ বা রাষ্ট্র সর্বদা গতিশীল। গতিহীনতা ব্যক্তির ন্যায় সমাজেরও মৃত্যুর লক্ষণ। বিপ্লববাদ বলতে কামাল সনাতন প্রতিষ্ঠান ও ধ্যান ধারণার পরিবর্তে আধুনিক প্রতিষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠাকে বুঝিয়েছেন। এজন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ৷ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, নতুন প্রযুক্তি আমদানি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি বিপ্লববাদের মূল উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। বিপ্লববাদ বলতে কোন অবস্থাতেই পশ্চাদপন্থি পুরাতন ধ্যান-ধারণায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বৈদেশিক শত্রুর মোকাবিলা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে বিপ্লববাদের অবতারণা করা হয় । কামালের মতে ইউরোপীয় দেশগুলোর মত তুরস্কের অগ্রগতির জন্য নিজেকে নিয়োজিত করা ও বিরামহীনভাবে সংগ্রাম করাই হচ্ছে বিপ্লববাদ। এজন্য কামাল তুরস্কের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা ও প্রথা প্রতিষ্ঠান আমদানির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন ।
৬। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ : ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কামালীয় সংস্কারের প্রধান স্তম্ভ। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাব যে রাষ্ট্র ও ধর্ম উভয়ের ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর এ সম্পর্কে কামালের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা তার এ বিশ্বাসকে আরো দৃঢ়তর করে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিচার কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা ও সর্বোপরি সমাজ ব্যবস্থাকে ধর্মের প্রভাব হতে মুক্ত করাই ছিল বিপ্লববাদের মূল উদ্দেশ্যে। এছাড়া ধর্ম কর্তৃক আরোপিত নিয়ন্ত্রণ হতে জনগণের ব্যক্তি জীবনকে মুক্তি প্রদান এবং ইসলামী আচার প্রথা অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়নও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমেই খেলাফতের বিলুপ্তি সাধন করে কামাল রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের প্রভাব হতে মুক্ত করেন। তারপর তিনি আরো কিছু সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে যোগসূত্র চূড়ান্তভাবে ছিন্ন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ অনুযায়ী কোন একটি বিশেষ ধর্মের প্রতিনিধি, করা বা রক্ষকের ভূমিকা পালন করা রাজনীতিবিদদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমানে তুরস্কেও এ নীতিটি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইস্তাম্বুলের মেয়র (১৯৯৪–১৯৯৮) থাকাকালে ধর্মীয় বক্তব্য সম্বলিত একটি কবিতা আবৃত্তির জন্য তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী Recep Tayyip Erdogan কে জেল খাটতে হয়েছিল। কেননা তুরস্কের বিচার বিভাগের মতে তার এ কাজ ধর্মে বিশ্বাসী এবং ধর্মে অবিশ্বাসী তুর্কি জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কামাল আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন ও বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ইত্যাদি সংস্কার কার্য সম্পাদন করেন। তবে কামালের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলতে ধর্ম বিরোধী কার্যকলাপকে বুঝায় না। রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করা বা কোন ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করা এ মতবাদের উদ্দেশ্যে ছিল না। চিন্তার স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধর্মীয় চিন্তা ও প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রভাব হতে মুক্ত করার উদ্দেশ্যেই এ মতবাদ প্রণীত হয়। তুরস্ক যেহেতু একটি ইসলাম প্রধান দেশ ছিল সেহেতু এ মতবাদের প্রভাব মূলত ইসলাম ধর্মের উপরই পড়েছিল । তবে তার এ মতবাদ আলোকিত ও যৌক্তিক ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় নি। ইসলামের যেসব প্রথা আধুনিকায়ন ও গণতন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল কামালের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল।
পরিশেষে বলা যায় যে, কামালের জীবদ্দশায় ছয় নীতি (Six Principles ) প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হলেও তার মৃত্যুর পর এগুলি মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তানজিমাতও নব্যতুর্কিদের শাসনামলে গৃহীত বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে কামালের এ মতবাদসমূহের মূল নিহিত ছিল বলে মনে করা হয়। এগুলোকে তিনি শুধু রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবেই ঘোষণা করেন নি। উপরন্তু এ মতবাদসমূহ বাস্তবায়নের জন্য তিনি ১৯২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রিপাকলিকান পিপলস পার্টি গঠন করেন, যা তার মৃত্যুর পরও এসব মতবাদ বাস্তবায়নে নিয়োজিত থাকে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]