আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তুরস্ক কতগুলো বিশেষ নীতি গ্রহণ করে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্ক স্বাধীনভাবে তার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করতে সক্ষম হয় ।
দখলদার মিত্র বাহিনীর সাথে সহযোগিতাকারী সুলতানের সরকার আক্রমকারী গ্রিক বাহিনী, সাম্রাজ্য বিস্তার প্রয়াসী ফ্রান্স, ইতালি ও ষড়যন্ত্রকারী আর্মেনিয়দের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরত জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ স্বাভাবিকভাবে নব প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত সরকারের বন্ধুত্বের হস্ত এবং সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। ১৯২১ সালে মুস্তফা কামালের বিদেশমন্ত্রী বকর সামী মস্কো গমণ করে এক বন্ধুত্বমূলক চুক্তি স্বাক্ষর
করেন। মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য রুশ সাহায্য ও সহযোগিতা কামালের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে লুজান চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর এ প্রয়োজনীযতা কমে যায়। কামাল ইচ্ছা করেই রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চেয়েছিলেন। কারণ রাশিয়া এ সুযোগে তুরস্কে সাম্যবাদ প্রচার করার প্রয়াস পায়। লুজান চুক্তিতে তিনটি বিষয় অমিমাংসিত ছিল যেমন প্রণালী সমস্যা, মসুল সমস্যা ও আলেকজান্দ্রেত্তা জেলা সমস্যা। প্রণালীসমূহে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব সীমিত করা হয়। এবং একটি আন্তর্জাতিক কাউন্সিলের উপর এর পরিচালনার ভার ন্যাস্ত করা হয়। মসুল এলাকা নিয়ে ব্রিটেন ও তুরস্কের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। ইরাকের উপর লীগ অব নেশনস এর অনুমতি প্রাপ্ত সরকার হিসেবে ব্রিটেন এ এলাকা ইরাকের অংশ বলে দাবি করে এবং তুরস্কেরও অনুরূপ দাবির প্রেক্ষিতে বিষয়টি লীগ অব নেশনস এর নিকট বিচারের জন্য প্রেরণ করা হয়। একটি আন্তর্জাতিক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী লীগ ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এ এলাকা ইরাকের অংশ বলে মত প্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে আরো বলা হয় যে ইরাকে আরো ২৫ বছর ম্যান্ডেট শাসন বলবৎ থাকা সাপেক্ষে এ সুপারিশ কার্যকর হবে। ১৯২৬ সালের ৫ জুন স্বাক্ষরিত তুর্কি-ব্রিটিশ চুক্তিতে উভয় পক্ষই এ সমস্যার সমাধান আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে। মসুলে প্রাপ্ত তেলের দশভাগ তুরস্ককে প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয় ৷
আলেকজান্দ্রেত্তা জেলাটির সমস্যাও কম জটিল ছিল না। জাতীয়তার দিক হতে এ জেলার মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ তুর্কি বংশোদ্ভূত এবং বাকী অংশ খ্রিষ্টান ও মুসলিম আরব। সিরিয়া ও লেবাননের উপর ফরাসি ম্যান্ডেট শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথেই জেলাটিকে আলেপ্পো প্রদেশের সাথে যুক্ত না করে একে পৃথক শাসনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ফরাসি কর্মচারীদের উপরেই জেলাটির শাসনভার ন্যাস্ত ছিল এবং এখানে তারা আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠার কোন সুযোগ দেয় নি। তুরস্কে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সাফল্য লাভ করার পর আলেকজান্দ্রেত্তা প্রশ্ন তুর্কি নেতাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয় ।
ফরাসিদের অধীনে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা সাময়িকভাবে গ্রহণ করলেও এ জেলার ভবিষ্যত নিয়ে তুর্কি নেতাদের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। ১৯৩৬ সালে প্রস্তাবিত সিরিয়-ফরাসি চুক্তি সম্পর্কে আলোচনার পর উদ্বেগ আরো বৃদ্ধি পায় । জেলার তুর্কি অধিবাসীদের কোন সিরিয় আরব সরকারের অধীনে দেখতে তুর্কি সরকার মোটেই রাজী ছিল না ।
তুরস্ক এ বিষয়টি লীগ অব নেশনসের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ফ্রান্স ও তুরস্কের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে এ জেলাটির জন্য এক বিশেষ শাসন ব্যবস্থা এবং তুর্কি নাগরিকদের জন্য বিশেষ রক্ষা কবচের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এ ব্যবস্থা তুরস্কের আশানুরূপ হয় নি । ১৯৩৮ সালের গ্রীষ্মকালে তুর্কি ফরাসী গোপন আলোচনার পর জেলাটির উপর যৌথ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আরো স্থির
করা হয় যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তুর্কি ও ফরাসী সেনাবাহিনী যৌথভাবে কাজ করবে। একটি গণভোটের মাধ্যমে এ জেলার ভাগ্য নির্ধারিত হবে। আর একটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাগ্রস্থ ফ্রান্স পূর্ব ভূ-মধ্য সাগরে তুরস্কের মত মিত্র লাভ করার আশায় কিছুটা সুযোগ-সুবিধা দিতে রাজি ছিল। ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে তুর্কি বাহিনী অধিকতর সংখ্যায় এ জেলায় প্রবেশ করতে শুরু করলে আরব অধিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত গণভোটে তুর্কি সেনাবাহিনী এত নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে যে, লীগ অব নেশনস এর পর্যবেক্ষক দলের ব্রিটিশ সদস্য এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। তীব্র উত্তেজনার মধ্যে অনুষ্ঠিত এ গণভোটে তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রার্থীগণ ৪০ টির মধ্যে ২২ টি আসন দখল করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। নবনির্বাচিত সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভোটের মাধ্যমে জেলাটিকে ‘হাতাই’ নামক স্বায়ত্তশাসিত জেলায় পরিণত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তুর্কি পতাকা উত্তোলন করে। একটি প্রতিনিধিদল আঙ্কারা গমন করে তুরস্কের সাথে যোগদানের প্রশ্নটি আলোচনা করে এবং যোগদানের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৩৯ সালে তুর্কি-ফরাসি ‘যুদ্ধ নয় চুক্তি' স্বাক্ষরের সময় ফ্রান্স-তুরস্ক কর্তৃক জেলাটির দখল স্বীকার করে নেয়। সাথে সাথে তুরস্ক প্রশাসনিকভাবে জেলাটিকে তুরস্কের সাথে অন্তর্ভুক্ত করে একে তুরস্কের অন্যতম প্রদেশে পরিণত করে। এ ঘটনার ফলে সিরিয়ার আরবরা ফরাসি ও তুর্কি বিরোধী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। তুরস্ক যখন মসুল প্রশ্নে ব্রিটেনের সাথে বিরোধের সম্মুখীন হয়, তখন সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের উন্নতি সাধন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৯২৫ সালে দু'দেশের মধ্যে প্যারিসে ‘বন্ধুত্ব ও নিরপেক্ষতার' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ বা আক্রমণাত্মক চুক্তি বা অন্য কোন প্রকার-শত্রুতা হতে বিরত থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। ১৯৩৫ সালে চুক্তিটির নবায়ন করা হয়। রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেও তুরস্ক তার স্বাধীনতা রক্ষায় সদা জাগ্রত ছিল। এবং কম্যুনিস্টদের কার্যকলাপের উপর সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল। ইরানের সাথে ১৯২৬ সালে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তুরস্ক কর্তৃক কুর্দিবিদ্রোহ দমন করার সময় সীমান্ত প্রশ্নে দু'দেশের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটলেও ভুল বুঝাবুঝির শীঘ্রই অবসান ঘটিয়ে দুটি দেশ ১৯৩২ সালে একটি সীমানা চুক্তি স্বাক্ষর করে ।
বলকান যুদ্ধ ও প্রথম মহাযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে তুরস্ক তার প্রতিবেশী বলকান রাষ্ট্রগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে প্রয়াসী হয়। এর অংশ হিসেবে ১৯২৩ সালে হাঙ্গেরি, ১৯২৪ সালে অস্ট্রিয়া এবং ১৯২৫ সালে বুলগেরিয়া ও যুগোস্লাভিয়ার সাথে মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করে। ১৯২৮ সালে ইতালির সাথে অনুরূপ এক চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে তুরস্ক ১৯৩০ সালে গ্রিসের সাথে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর দান করে। এ চুক্তিতে স্থির হয় যে, দুটি দেশ যে কোন সমস্যা নিজেদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান করতে পারবে ।
আরো বলা হয় যে, যে কোন দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অন্যপক্ষ বন্ধুত্বমূলক নিরক্ষেপতার মনোভাব প্রদর্শন করবে। ১৯৩৩ সালে এ চুক্তি নবায়নের সময় পারস্পরিকভাবে ভৌগলিক সীমারেখা মেনে চলার অঙ্গীকার করে। ১৯৩২ সালে তুরস্ক লীগ অব নেশানস এর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৩৪ সালে রুমানিয়া, যুগোস্লাভিয়া, গ্রিস ও তুরস্ক পারস্পরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করে।
মূলত: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানিয় সাম্রাজ্যের স্থলে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে তুরস্ক একটি বৃহৎ শক্তি হতে ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তবে এর ফলে তুরস্কের আয়তন হ্রাস পেলেও একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দিক থেকে প্রজাতন্ত্রিক তুরস্ক দুর্বল ওসমানিয় সাম্রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী ছিল। কেননা এ সময় তুরস্কের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ লোপ পায়। স্বাধীনভাবে তুরস্ক এর বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়। লুজান চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্ব পর্যন্ত পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে মুস্তফা কামাল কিছুটা দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিলেও পরবর্তীকালে তিনি ও তার উত্তরসূরীরা তুরস্কের শক্তি ও সামর্থের সাথে সঙ্গতি রেখে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত বিদেশ নীতি নির্ধারণ করেন। এসময় থেকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব প্রশমিত হতে কিছুটা সময় লেগেছিল। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকে তুরস্ক লুজান চুক্তিতে অমিমাংসিত মসুল সমস্যা, আলেকজাত্তা সমস্যা ও প্রণালীসমূহ সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা কামনা করে। ১৯২১ সালে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেকির সামি বে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মস্কো গমন করেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সাথে পুঁজিবাদী শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দূরত্বের সুযোগ নিয়ে তুরস্ক তার অমিমাংসিত সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা চালায়। তুরস্কের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং এ্যাংলো-ফ্রান্স আতাত বিরোধী অবস্থান সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা লাভ করে। উপরন্তু, তুরস্ককে সহযোগিতা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এশিয়ার অন্যান্য দেশের নিকট নিজেকে নির্যাতিত ও শোষিতদের একমাত্র ও প্রকৃত বন্ধু হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। এছাড়া ভবিষ্যতে পুঁজিবাদী দেশগুলোর সাথে যুদ্ধে তুরস্কের প্রাণালীসমূহ ব্যবহারের সুযোগ লাভ করাও সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। ফলে উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্কের আন্তজার্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ সময় তুরস্ক বলকান যুদ্ধ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে বলকান অঞ্চলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ
সম্পর্ক স্থাপনে প্রয়াসী হয়। এর অংশ হিসেবে তুরস্ক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
তুরস্ক সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐ সম্পর্কের ঐতিহাসিক পটভূমি জানা প্রয়োজন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর ব্রিটেন ও তুরস্কের মধ্যে বিদ্যমান মসুল সমস্যাটি পরোক্ষভাবে তুর্কি সোভিয়েত সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে ভূমিকা রেখেছিল। এ বিষয়ে লীগ অব নেশনসের সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের পক্ষে যাওয়ার পর তুরস্ক রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯২৫ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে দশ বছর মেয়াদি একটি মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উভয় দেশের মধ্যকার এ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্রমেই অর্থনৈতিক সহযোগিতার রূপ নেয়। ১৯৩৪ সালে তুরস্কের ৫ বছর মেয়াদি শিল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সোভিয়েত ইউনিয়ন শিল্প ঋণ ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে সহযোগিতা করে । তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এ সম্পর্কে কিছুটা শীতল হাওয়া বইতে থাকে। মুস্তফা কামালের সমাজতন্ত্রবাদ বিরোধী পরিকল্পনা ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ক্ৰমশ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি
১৯৩৯ সালের গ্রীষ্মে জার্মানিকে বিশ্ব শান্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ মনে করে সমাজতন্ত্র বিরোধী মনোভাব থাকা সত্ত্বেও ব্রিটেন ও ফ্রান্স সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একযোগে কাজ করার আগ্রহ পোষণ করে। শান্তিকামী তুরস্ক অত্যন্ত আগ্রহভরে বিষয়টি লক্ষ করে। ইতোমধ্যে মুস্তফা কামাল মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর উত্তরসূরিরা কামাল কর্তৃক অনুসৃত বিশ্বে শান্তি রক্ষার নীতি পরিত্যাগ করে নি। কিন্তু ১৯৩৯ সালের ২৩ আগষ্ট সম্পাদিত সোভিয়েত জার্মান চুক্তি তুরস্কের নেতৃবৃন্দকে হতাশ করে। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর দখল ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে সুক্রু সারাকোগলু সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে মস্কো গমন করেন। চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা এবং তুরস্কের স্বাধীনতা ও ভূখন্ডগত অখন্ডতার প্রতি সোভিয়েত সমর্থন আদায় করাই ছিল তুরস্কের উদ্দেশ্য। কিন্তু রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জার্মানির সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাওয়া রাশিয়ায় তখন এ্যাংলো-ফরাসি তুর্কি আতাত বিরোধী মনোভাবের জন্ম দিয়েছিল। জার্মান তখন বলকান অঞ্চল ও নিকট প্রাচ্যকে ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে লন্ডন ও প্যারিস কর্তৃক গ্রীস ও রোমানিয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান জার্মানিকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। জার্মানি তখন বলকান অঞ্চল ও তুরস্ককে নিরপেক্ষ অঞ্চলে পরিণত করার উপায় খুঁজতে থাকে। এক্ষেত্রে তুরস্ক অত্যন্ত কৌশলগত অবস্থানে ছিল। রুমানিয়ায় এ্যংলো ফেঞ্জ সাহায্য পৌছানোর জন্য প্রণালীগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই যুদ্ধের প্রথম দিকে পশ্চিমা দেশগুলোকে সহযোগিতা করা থেকে তুরস্ককে বিরত রাখা ছিল জার্মানির পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু জার্মানির একার পক্ষে এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা কঠিন ছিল। তুরস্কের ঘনিষ্ঠ ও
শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র রাশিয়ার মাধ্যমেই তা করানো সম্ভব বলে জার্মানি মনে করেছিল। মস্কোয় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত কাউন্ট ভন দার স্কুলেনবার্গ ছিলেন সোভিয়েত নাজি মৈত্রী প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি
তুরস্কের বিদেশ মন্ত্রী সারাকোগলুর মস্কো সফরের সময় তিনি ক্রিমলিনের সাথে সর্বদা যোগযোগ রক্ষা করেন। এবং সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভকে জার্মান অভিসন্দি বাস্তবায়নের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। তার এ নীতির প্রতি সোভিয়েত
নেতৃবৃন্দেরও
সমর্থন ছিল । জার্মানি ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলকেও নিরপেক্ষ অঞ্চলে পরিণত করে জার্মানিকে সহযোগিতা করার জন্য রাশিয়া প্রস্তুত ছিল। এর ফলে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী বলকান অঞ্চলকে যুদ্ধের প্রভাব হতে মুক্ত রাখার সোভিয়েত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেরও সুযোগ ছিল। কিন্তু তুরস্কের সাথে মিত্রতার সুযোগে ব্রিটিশ ও ফরাসি রণতরী কৃষ্ণ সাগরে প্রবেশ করলে রাশিয়ার এ উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই জার্মানিকে সন্তুষ্ট করা এবং রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া রোধ করতেই রাশিয়া তুরস্কের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। সুতরাং, যুদ্ধের সময় তুরস্ক ও রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তুরস্ক ও সোভিয়েত বিদেশ নীতিরও ভিন্নতার কারণেই মস্কোর সারাকোগলুর সফরটি ব্যর্থ হয়েছিল। কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার সারাকোগলুর এ সফর ছিল কিছুটা অস্বাভাবিক। কেননা আন্তর্জাতিক ক্রাইসিসের এ সময় তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে প্রায় এক মাস দেশের বাইরে অবস্থান করতে হয়েছিল। তার মস্কোতে অবস্থানকালে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনটপও রাশিয়া সফর করেন। পূর্ব ইউরোপে জার্মান ও সোভিয়েত প্রভাবাধীন এলাকা নির্ধারণ সম্পর্কিত আলোচনার উদ্দেশ্যে রিবেনট্রপ মস্কো এসেছিলেন। সোভিয়েত সরকার এ আলোচনাকে অগ্রাধিকার দেয়ায় সারাকোগলুকে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল ।
জার্মানির সাথে আলোচনা শেষে স্টালিন এবং মলোটভ সারাকোগলুকে দুটি প্রস্তাব দেন। (১) বিটিশ ও ফরাসি যুদ্ধ জাহাজের জন্য প্রণালীসমূহ বন্ধ করে দিতে হবে। (২) অ্যাংলো-ফরাসি মিত্রতা বিসর্জন দিয়ে তুরস্ককে রাশিয়ার সাথে একটি পারস্পরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। সারাকোগলু সরাসরি প্রথম প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করেন। কেননা এ প্রস্তাব মেনে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে Montreux straits convention লংঘন করা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর শত্রুতা অর্জন করা। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলে। এ সময় সারাকোগলু লন্ডন ও প্যারিসের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। কেননা ইতিমধ্যে ‘এহ্যালো ফরাসি তুর্কি’ মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল এবং চুক্তির অধিকাংশ ধারা সম্পর্কে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্ব এবং সোভিয়েত প্রস্তাবের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য তুরস্ক
আধিপত্যবাদ এমন এক পর্যায়ে পৌছায় যে এক পর্যায়ে মিশরিয় সরকারের বিভিন্ন দফতরে ১৪০০ ইউরোপীয় কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। এ ছিল মিশরিয়দের জন্য চরম লজ্জা, ক্ষোভ ও হতাশা, যা থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় ।
মিশরিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রথম নেতৃত্ব দেন আহম্মদ ওরাবী পাশা । উত্তর মিশরের এক কৃষক পরিবারে তার জন্ম হয়। কৃষকের সন্তান হলেও তিনি অসাধারণ মেধা, কর্মদক্ষতা ও নির্ভীকতার পরিচয় দেন। তিনি মিশরের বিখ্যাত আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন। একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে তিনি ক্রমশঃ স্বীয় উদ্যম ও সামরিক মেধার ফলে অতি অল্প সময়ে কর্নেল পদে উন্নীত হন। মিশরিয় বাহিনীতে যখন তুর্কি ও সিরকাসিয়ান মামলুকদের প্রদত্ত সুযোগ সুবিধার প্রতিবাদে মুষ্টিমেয় মিশরিয় সামরিক অফিসারদের নিয়ে একটি গুপ্ত সমিতি গঠন করা হয়। যা পরে একটি সংস্কার আন্দোলনে রূপ লাভ করে। ওরাবী পাশা একজন খ্যাতিমান বাগ্মী ছিলেন। প্যান ইসলামের প্রবক্তা সৈয়দ জামালুদ্দিন আফগানির জ্বালাময়ী বক্তৃতার ফলে মিশরিয়রা বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে এবং জাতীয়তাবাদী মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয় । বিদেশি দ্বৈত শাসন, খেদিভের স্বৈরশাসন, কৃষকদের নিপীড়ন ইত্যাদি কারণে ওরাবী পাশা আধুনিক মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেন ৷
ওরাবী পাশা সর্বপ্রথম মিশরিয় সেনাবাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক গুপ্ত দল গঠন করেন। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, খেদিভ ইসমাইল ও তৌফিকের শাসনামলে সেনাবাহিনী অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জাতীয়তাবাদী দল ও মিশরিয় সেনাবাহিনীর একাংশ দ্বৈত শাসন ও অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মিশরকে মুক্ত করার জন্য ওরাবী পাশার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হল। মিশ্রিত মন্ত্ৰী পরিষদ, যাতে একজন ফরাসি ও একজন ইংরেজ সদস্য ছিল। দেউলিয়া হতে মিশরকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর আড়াই হাজার সদস্যের মাসিক বেতন অর্ধেক করা হয়। সামরিক স্কুলের অর্থ বরাদ্দ হ্রাস করা হয়। অনেক সক্ষম মিশরিয় অফিসারকে জোরপূর্বক অবসর দেয়া হয়। এছাড়া তুর্কি, সিরকাসিকান ও মিশরিয়দের দ্বারা গঠিত সেনাবাহিনী সুসংঘবদ্ধ ছিল না। কারণ মিশরিয় অফিসারদের তুলনায় তুর্কি ও সিরকাসিয়ান অফিসার ও সৈন্যরা কম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। সেনাবাহিনীতে জাতীয় বেতনক্রমে ও পদোন্নতির সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব এবং সামাজিক মর্যাদার বৈপরিত্য মিশরিয়া সদস্যদের ক্ষুব্ধ করে তোলে । লতিফ বে সালিম এবং মোহাম্মদ আলী পাশা আল-বারুদী এবং ওরাবী পাশার সেনাবাহিনীর বৈষম্য দূর করার জন্য খেদিভ তথা নুবার সরকারের বিরুদ্ধে গোপন সমিতি গঠন করেন । নুরার পাশার মন্ত্রীসভা বাতিল হলে ইসমাইল যুবরাজ তৌফিক পাশাকে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করতে বলেন। কিন্তু তৌফিক পাশা বেশিদিন মন্ত্রীত্ব করতে পারেন নি। তারপর শরীফ পাশা প্রধানমন্ত্রী হন। ইসমাইল পদচ্যুত হলে
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত