ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবুরের চার পুত্র সন্তানদের মধ্যে নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন ছিলেন
জ্যেষ্ঠ। তাঁর অপর তিন ভাইদের নাম কামরান, আসকারী এবং হিন্দাল। হুমায়ুন ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ
করেন। হুমায়ুন নামের অর্থ ভাগ্যবান; কিন্তু তাঁর মত ভাগ্যহীন বাদশা খুব কমই জন্মগ্রহণ করেছেন।
বাল্যকাল থেকে তিনি পিতা বাবুরের কাছ থেকে সামরিক এবং শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়
করেছেন। বাবুরের উত্তর ভারত বিজয়ের সময় পানিপথ ও খানুয়ার যুদ্ধে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর
রেখেছিলেন। মাত্র বিশ বৎসর বয়সে তিনি বাদাকশানের শাসনকর্তার পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। এসব
অভিজ্ঞতার ফলে বাবুরের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে বাবুর
হুমায়ুনকে নবপ্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান এবং হুমায়ুনকে তাঁর ভ্রাতাদের
প্রতি ভ্রাতৃবাৎসল্য, উদারতা ও ¯েœহ প্রদর্শন করতে উপদেশ দেন। সেই অনুসারে বাবুরের মৃত্যুর (২৬
ডিসেম্বর, ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ) চারদিন পর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর তেইশ বছর বয়সে হুমায়ুন দিল্লির
সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
সিংহাসনে বসেই হুমায়ুন পিতার নির্দেশ অনুসারে তিন ভ্রাতাকে সাম্রাজ্যের তিনটি অংশের শাসনকর্তা
নিয়োগ করেন। কাবুল এবং কান্দাহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন কামরান, পূর্ব হতেই তিনি ঐ দুই স্থানের
শাসনকর্তা ছিলেন। আলওয়ার ও মেওয়াটের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন হিন্দাল আর আসকারীকে নিযুক্ত করা
হয় সম্বলের শাসনকর্তা। পিতৃব্যপুত্র মির্জা সুলায়মানকে বাদাকশানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সিংহাসনে
অধিষ্ঠিত হয়ে হুমায়ুন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন ঃ
প্রথমত, বাবুরের সেনাবাহিনী গঠিত ছিল মধ্য এশিয়ার নানা জাতির মানুষ দিয়ে। এরূপ সেনাবাহিনী
পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল অসাধারণ ব্যক্তিত্বের। হুমায়ুন ঐরূপ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন না। ফলে
সৈন্যবাহিনীর মধ্যে শৃ´খলার অভাব দেখা দেয়।
দ্বিতীয়ত, আফগান শক্তি বাবুরের কাছে পরাজিত হলেও তখন পর্যন্ত পূর্ব ভারতে তাঁদের যথেষ্ট শক্তি ছিল
এবং মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দি¡তায় অবতীর্ণ হতে তৎপর ছিল।
তৃতীয়ত, রাজপুত শক্তি বাবুরের নিকট পরাজিত হলেও তাঁদের শক্তি তখনও সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়নি।
চতুর্থত, গুজরাটের শাসনকর্তা বাহাদুর শাহ হুমায়ুনের অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে উত্তর ভারতে প্রাধান্য
বিস্তারে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।
পঞ্চমত, বাবুরের ইচ্ছানুযায়ী হুমায়ুন সিংহাসন লাভের পর তাঁর তিন ভ্রাতাকে সাম্রাজ্যের তিনটি অংশের
শাসনকর্তা নিয়োগ করলেও তিন ভ্রাতাই তাঁর চরম বিরোধিতা করতে থাকেন। ভ্রাতাদের মধ্যে চরম বৈরিতা
হুমায়ুনের বিপদের দিনে তাঁকে অধিকতর বিপদগ্রস্ত করে তুলেছিলেন।
প্রথমে সমস্যার সৃষ্টি করলেন উচ্চাকাক্সক্ষী কামরান। তিনি কাবুল ও কান্দাহারের শাসনভার লাভ করে সন্তুষ্ট
হতে পারেননি। হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহণ করার পরপরই কামরান বলপূর্বক পাঞ্জাব, হিসার, ফিরুজা
প্রভৃতি অঞ্চল অধিকার করে নেন। ভ্রাতৃ¯েœহ, ভ্রাতৃ-বিরোধ পরিহার এবং সর্বোপরি মৃত্যুশয্যায় পিতার শেষ
উপদেশের প্রতি শ্রদ্ধাবশত হুমায়ুন কামরানকে ক্ষমা প্রদর্শন করেন। এসঙ্গে তাঁর দখলকৃত অঞ্চলগুলোর
ওপর কামরানের অধিকার স্বীকার করে নেন। কিন্তু সাম্রাজ্যের সংহতি ও নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করলে
হুমায়ুনের এই সিদ্ধান্ত অদূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। হিসার, ফিরুজা কামরানের অধিকারের ফলে
পাঞ্জাব ও দিল্লির সংযোগপথ বিচ্ছিন্ন হলো। মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সংগ্রহের সুযোগ
থেকে হুমায়ুন বঞ্চিত হন।
বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্তে¡ও হুমায়ুন তাঁর রাজত্বের প্রথমদিকে স্বল্পকালের জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহে সাফল্য লাভ
করেছিলেন। বুন্দেলখন্ডের কালিঞ্জরের রাজা আফগানদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল থাকার কারণে হুমায়ুন
সিংহাসনে বসার ৫/৬ মাস পর কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু রাজ্যের পূর্বদিকে আফগানগণ উদ্ধত
হয়ে ওঠার সংবাদ পেয়ে তিনি কালিঞ্জরের রাজার কাছ থেকে অর্থ পেয়ে কৃতার্থ হয়ে অবরোধ তুলে নেন
এবং আফগানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। রাজার উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে না পেরে কালিঞ্জর দুর্গের অবরোধ
তুলে নিয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ভুল করেন।
এরূপ পরিস্থিতিতে হুমায়ুন আফগানদের সংঘবদ্ধ দলকে মোকাবেলা করতে সসৈন্যে অগ্রসর হন। এই
সংঘবদ্ধ দলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রাক্তন সুলতান ইব্রাহিম লোদির ভাই মাহমুদ লোদি এবং প্রধান দুই
সেনাপতি বিবন খান জালওয়ানী ও শেখ বায়জিদ কারমালি। হুমায়ুন লক্ষেèৗর নিকটে দৌরাহ্ নামক স্থানে
সংঘবদ্ধ আফগান দলকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এসঙ্গে তিনি সুলতান মাহমুদ লোদিকে জৌনপুর
থেকে বিতাড়িত করেন। পরে মাহমুদ লোদি বিহারে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে
লোদি বংশের বিলুপ্তি ঘটে।
দৌরাহ্-এর যুদ্ধে জয়লাভ করে হুমায়ুন শের খাঁর অধীনস্থ চুনার দুর্গ অবরোধ করেন। চার মাস এই
অবরোধ স্থায়ী হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে গুজরাটের বাহাদুর শাহের আগ্রা অভিযানের সংবাদ পেয়ে হুমায়ুন শের
খাঁর থেকে মৌখিক আনুগত্য আদায় করে অবরোধ তুলে নেন। হুমায়ুন চুনার দুর্গ শের খাঁর অধীনে রেখে
সসৈন্য বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। শের খাঁর মৌখিক আনুগত্যে বিশ্বাস করে তাঁর ক্ষমতা সম্পূর্ণ
বিনষ্ট না করে আগ্রায় ফিরে হুমায়ুন তৃতীয়বারের মতো অদূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন। হুমায়ুন বাহাদুর
শাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ায় শের খাঁ শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ পেয়ে যান। এবং পরবর্তী সময়ে হুমায়ুনের
সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী শত্রুতে পরিণত হন।
বাহাদুর শাহ প্রথম থেকেই হুমায়ুনের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি মালব জয় করেন এবং খান্দেশ,
বেরার ও আহম্মদনগরের সুলতানদের যুদ্ধে পরাজিত করে স্বীয় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। হুমায়ুনের
বহু শত্রু আফগান দলপতিদের তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে বাহাদুর শাহ চিতোর দুর্গ
অবরোধ করলে চিতোরের রাণী দুর্গাবতী বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু
হুমায়ুন চিতোরের রাণীর ডাকে সাড়া না দিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভুল করেন। বাহাদুর শাহ
যখন তুর্কি, পর্তুগিজ বিভিন্ন দেশীয় গোলন্দাজের সাহায্য নিয়ে চিতোর দুর্গ ধ্বংসে ব্যস্ত ছিলেন, তখন
হুমায়ুন তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে মালব অধিকার করে বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ১৫৩৫
খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মান্দাসার-এর নিকট বাহাদুর শাহ ও হুমায়ুনের মধ্যে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মান্দাসারের যুদ্ধে হুমায়ুনের নিকট বাহাদুর শাহ সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হন এবং মান্ডুতে পালিয়ে যান।
হুমায়ুন মান্ডু দুর্গ প্রায় তেইশ মাস অবরোধ করে রাখেন। অবরোধ চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর ভেবে অবশেষে
হুমায়ুন শান্তি চুক্তির চেষ্টা চালান এবং বাহাদুর শাহও শান্তি স্থাপনের জন্য যোগাযোগ করতে থাকেন। এ
পর্যায়ে হঠাৎ এক রাতে মুঘল সৈন্যবাহিনীর আক্রমণে দুর্গের দরজা খুলে যাওয়ায় বাহাদুর শাহ চাম্পানের
দুর্গে আশ্রয় নেন। হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে ধরার জন্য চাম্পানের দুর্গে উপস্থিত হলে বাহাদুর শাহ ক্যাম্বেতে
পালিয়ে যান। পরে সেখান থেকে পালিয়ে দিউতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন
চাম্পানের দুর্গ অধিকার করেন। এর ফলে সমগ্র গুজরাট তাঁর অধিকারে আসে। হুমায়ুনের ভ্রাতা আসকারী
গুজরাটের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। গুজরাট এবং মালব অধিকার ছিল হুমায়ুনের কৃতিত্বের মহান স্মারক।
এই বিজয়ের পর দুই ভাই মিলে কিছুকাল আনন্দ উৎসব করলেন। কিন্তু বিজিত রাজ্যের সুরক্ষায় কোন
স্থায়ী পদক্ষেপ নিলেন না। এই সুযোগে বাহাদুর শাহ পর্তুগিজদের সহযোগিতায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট
হন। কিন্তু হুমায়ুনের পক্ষে বাহাদুর শাহকে বাধা দেবার সময় ছিল না। কারণ সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে আফগান
দলপতিগণ পুনরায় শের খাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহী হয়ে উঠলে হুমায়ুনকে সেদিকে মনযোগ দিতে হয়। এছাড়া
ইতোমধ্যে বাহাদুর শাহের অনুক‚লে গুজরাটের নানাস্থানে স্থানীয় নেতৃত্বে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ফলে গুজরাট
থেকে আসকারী দিল্লি ফিরে আসতে বাধ্য হন। আর এ সুযোগে বাহাদুর শাহ গুজরাট ও মালব পুনরুদ্ধার
করেন। এইভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য গুজরাট ও মালব দখল করেও পুনরায় হুমায়ুনের
হাতছাড়া হয়ে যায়।
১৫৩০ থেকে ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হুমায়ুন যখন গুজরাট ও মালব নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন শের খাঁ
বিহারে নিজের ক্ষমতার ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। প্রকৃতপক্ষে শের খাঁ চুনার দুর্গকে কেন্দ্র করে শুধু ক্ষমতা
সুপ্রতিষ্ঠিত করেননি, তিনি সেখানকার প্রভুতে পরিণত হয়েছিলেন। এমন কি অতর্কিতে বঙ্গদেশ আক্রমণ
করেন।বঙ্গদেশের সুলতান মাহমুদ শাহ ছিলেন দুর্বলচেতা শাসক। দেশরক্ষার জন্য আফগান শত্রুর
মোকাবেলা করার শক্তি বা সাহস কোনটাই তাঁর ছিল না। তিনি তের লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ও কিউল থেকে
সক্রিগলী পর্যন্ত শের খাঁকে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও বাংলা রক্ষা পেল না। শের খাঁ পুনরায় (১৫৩৭
খ্রিস্টাব্দে) বঙ্গদেশ আক্রমণ করেন এবং বঙ্গদেশের রাজধানী গৌড় অবরোধ করেন। হুমায়ুন শের খাঁর
উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁকে দমন করার উদ্দেশ্যে ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে এক বিরাট
সৈন্যবাহিনী নিয়ে শের খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। কিন্তু চুনার দুর্গ অবরোধে অযথা কালবিলম্ব করেন।
চুনার দুর্গ অধিকার করতে হুমায়ুনের সময় লাগে ছয় মাস। হুমায়ুনের এই অযথা কালক্ষেপনের ফলে শের
খাঁ তখন বঙ্গদেশ জয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হুমায়ুন যদি তৎক্ষণাৎ চুনার দুর্গ দখল করে গৌড়ে উপস্থিত
হতেন, তাহলে বঙ্গদেশ ও সুলতান রক্ষা পেত এবং শের খাঁও পরাস্ত হতেন। কিন্তু হুমায়ুন তা না করে
বারাণসী চলে যান। এই সুযোগে শের খাঁ ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল গৌড় অধিকার করে সেখানে প্রাপ্ত
ধনসম্পদ রোটাস দুর্গে স্থানান্তর করেন। এই দুর্গ শের খাঁ আগে থেকেই দখলে রেখেছিলেন।
এদিকে বঙ্গদেশ থেকে পলাতক সুলতান মাহমুদ শাহ হুমায়ুনকে কালবিলম্ব না করে বঙ্গদেশ অধিকার
করতে অনুরোধ করেন। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট তিনি বঙ্গদেশের রাজধানী গৌড় অধিকার করেন।
শের খাঁ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী সামরিক নেতা। তিনি হুমায়ুনের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে
চতুরতার সঙ্গে দক্ষিণ বিহারে চলে যান। এদিকে বর্ষা নামার ফলে হুমায়ুনকে দীর্ঘ ছয়মাস বঙ্গদেশে বাধ্য
হয়ে অবস্থান করতে হয়। তখন শের খাঁ চুনার দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। এছাড়া বারাণসী, জৌনপুর প্রভৃতি
অঞ্চল জয় করে তিনি কনৌজ পর্যন্ত অগ্রসর হন। এসব অঞ্চল অধিকার করার ফলে হুমায়ুনের বঙ্গদেশ
থেকে আগ্রা প্রত্যাবর্তনের পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সংবাদ পেয়ে হুমায়ুন শঙ্কিত হয়ে গৌড় ত্যাগ করে
সসৈন্যে আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে বক্সারের নিকট চৌসা নামক স্থানে শের খাঁ ও তাঁর
আফগান অনুচরবর্গ হুমায়ুনকে বাধা প্রদান করেন। এখানে ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন হুমায়ুনের সঙ্গে শের
খাঁর এক প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে হুমায়ুন সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হন। বহু মুঘল সৈন্য গঙ্গা নদী
অতিক্রম করতে গিয়ে প্রাণ হারায় এবং অনেকেই শের খাঁর সেনাবাহিনী কর্তৃক বন্দি হন। নিজাম নামে এক
ভিস্তিওয়ালা তার মশকের সাহায্যে কোনক্রমে হুমায়ুনকে গঙ্গা নদী পার করে দিলে তিনি প্রাণে রক্ষা পান।
চৌসার যুদ্ধে জয়লাভ শের খাঁকে অভাবনীয় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। এই যুদ্ধ জয়লাভের ফলে পূর্ব
ভারত কিছুদিনের জন্য মুঘল শাসনের বাইরে থাকে। কনৌজ থেকে আসাম, রোটাস থেকে বীরভ‚ম পর্যন্ত
অঞ্চলে শের খাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এই বিস্তীর্ণ রাজ্যের শাসক হলেন; ধারণ করলেন রাজকীয়
উপাধি ‘শেরশাহ'। এসঙ্গে নিজ নামে মুদ্রা চালু করেন।
চৌসার যুদ্ধে অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে হুমায়ুন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। পরের বছর হুমায়ুন
হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করার জন্য সসৈন্যে প্রস্তুত হন। এবং ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল কনৌজের নিকটে
বিলগ্রাম নামক স্থানে শেরশাহকে আক্রমণ করেন। উল্লেখ্য, শেরশাহের বিরুদ্ধে এ আক্রমণে তিনি তাঁর
ভ্রাতৃদ্বয় ও অভিজাতদের কোন সাহায্য পাননি। এই যুদ্ধেও হুমায়ুন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। এবার
কোন রকমে হুমায়ুন প্রাণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। শেরশাহ দ্রুত দিল্লি ও আগ্রা
অধিকারভুক্ত করে উত্তর ভারতের অধিপতি হয়ে ওঠেন। আর পরাজয়ের ফলে রাজ্যচ্যুত হয়ে হুমায়ুন
নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে (১৫৪০Ñ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ) বাধ্য হলেন।
হুমায়ুনের এই দুর্দিনে তাঁর ভ্রাতাগণ সংঘবদ্ধভাবে শেরশাহের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার কোন প্রয়োজন
উপলব্ধি করেননি। কামরানের সাহায্য লাভের আশায় হুমায়ুন লাহোরে যান। কিন্তু কামরান শেরশাহের ভয়ে
ভীত হয়ে কাবুলে পলায়ন করেন এবং শেরশাহকে পাঞ্জাব দান করে তাঁর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। হৃতসর্বস্ব
হতভাগ্য হুমায়ুন সিন্ধু থেকে সৈন্য সংগ্রহে এবং মাড়বারের রাজার নিকট আশ্রয় লাভে ব্যর্থ হয়ে
অমরকোটের রাণা প্রসাদের দরবারে আশ্রয় নেন। সেখানে অবস্থানকালে পুত্র আকবরের জন্ম হয়। পরে
অমরকোট থেকে কান্দাহারে নিজ ভ্রাতা আসকারীর রাজ্যে গমন, সেখানে নিরাপদ নয় মনে করে অবশেষে
পারস্যের শাহ তহসাম্প-এর দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হুমায়ুন তাঁর হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য শাহের
নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। শাহ তাঁকে সাহায্য করার বিনিময়ে দুটি শর্ত আরোপ করেনÑ (১) হুমায়ুনকে
শিয়াধর্ম গ্রহণ করতে হবে এবং ভারতে শিয়াধর্ম বিস্তার করতে হবে, (২) আফগানিস্তানে হুমায়ুনের অধিকার
প্রতিষ্ঠার জন্য হুমায়ুনকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করা হবে, কিন্তু তার বিনিময়ে আফগানিস্তান পুনরুদ্ধার করার
পর কান্দাহার শাহের হাতে তুলে দিতে হবে। চরম অপমানজনক হওয়া সত্তে¡ও হুমায়ুন শর্ত দু'টি মেনে
নেন। ফলে শাহ হুমায়ুনকে ১৪,০০০ সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। এই সামরিক সাহায্য নিয়ে ১৫৪৫
খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন কান্দাহার অধিকার করেন। কামরান আত্মসমর্পন করেন। কান্দাহার বিজয়ের পর পারস্য
বাহিনী হুমায়ুনের হয়ে আর যুদ্ধ করতে রাজি হলো না। তখন হুমায়ুন তাঁর সংগৃহীত সৈন্যবাহিনী দ্বারা
আক্রমণ চালিয়ে পারস্যের শাহের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করে পারস্য বাহিনীকে কান্দাহার থেকে হটিয়ে দেন।
১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর এক প্রকার বিনা বাধায় কাবুল অধিকার করেন। অনিচ্ছাসত্তে¡ও কামরানকে
বন্দি করে তাঁর চক্ষু দু'টি উৎপাটন করে মক্কায় প্রেরণ করা হলো। আসকারীও মক্কায় আশ্রয় নেন এবং
হিন্দাল এক নৈশ আক্রমণে প্রাণ হারান। এইভাবে ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক বিজয় সম্পন্ন করে ১৫৫৪ খ্রি.
নভেম্বর মাসে হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হন। ইতোমধ্যে শের শাহের মৃত্যু হলে
তাঁর অযোগ্য বংশধরগণ দিল্লির সিংহাসন নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত থাকার ফলে হুমায়ুনের হৃতরাজ্য
পুনরুদ্ধার বহুলাংশে সহজ হলো। তিনি অনায়াসে বিনা বাধায় ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোর
অধিকার করে নেন। বিদ্রোহী আফগানগণ পাঞ্জাবের শাসনকর্তা সিকান্দার শূরকে সুলতান বলে ঘোষণা
দেন। হুমায়ুন সিকান্দার শূরকে শরহিন্দের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই
মাসে হুমায়ুন দিল্লি ও আগ্রা পুনরুদ্ধার করেন। এভাবে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের এক উল্লেখযোগ্য বিস্তৃত অঞ্চল
পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হন। কিন্তু দীর্ঘ পনর বৎসর নির্বাসিত জীবনের দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে কতটুকু বাস্তববাদী
ও দূরদর্শী করে তুলেছিল সে পরিচয় দেবার সুযোগ তাঁর ঘটেনি। সদ্য পুনপ্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের
সূচনাকালে অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে পাঠাগারের সিঁড়ি দিয়ে
তাড়াতাড়ি নামার সময় পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। হুমায়ুনের সাময়িক জ্ঞান ফিরলে অবস্থা
বিপজ্জনক ভেবে আকবরকে পাঞ্জাব থেকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী
মনোনীত করেন। অতপর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি হুমায়ুন মারা যান।
হুমায়ুনের ব্যর্থতার কারণ
একাধিক কারণে হুমায়ুন ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকলে হয়তো
হুমায়ুন নিজেকে ভাগ্য বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারতেন। এই কারণে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন
যে, হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয় তাঁর নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য ঘটেছিল।
প্রথমত, তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেই পিতার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী সাম্রাজ্যের কিছু অংশ তাঁর তিন
ভ্রাতার মধ্যে বন্টন করে দিয়েছিলেন।কিন্তু তাঁরা হুমায়ুনের চরম বিপদের দিনে সাহায্য করেননি।
সাম্রাজ্যের স্বার্থে বিশ্বাসঘাতক ও স্বার্থপর ভ্রাতাদের শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা প্রদর্শন করা উচিত হয়নি।
দ্বিতীয়ত, হুমায়ুন সিংহাসন লাভের অব্যবহিত পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে অহেতুক যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতে
থাকেন। যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত না হয়ে তিনি যদি সে সময় নবপ্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব এবং সংহতির
প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, তাহলে মুঘল সাম্রাজ্যের স্বার্থ অধিক মাত্রায় রক্ষিত হতো।
তৃতীয়ত, হুমায়ুন বিহারের আফগান শাসনকর্তা শের খাঁর উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধির স্বরূপ প্রথম অবস্থায়
অনুধাবন করতে সক্ষম হননি। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে শের খাঁর বিরুদ্ধে যখন অগ্রসর হন তখন
আর শের খাঁকে পরাজিত করা সম্ভব ছিল না।
চতুর্থত, হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। গুজরাট অভিযানকালে যে
পরিমাণ অর্থ ও লোকক্ষয় হয় তাতে হুমায়ুনের দুর্বলতা বৃদ্ধি পায়। গুজরাট অভিযানের ব্যর্থতা তাঁর
প্রতিদ্বন্দ¡ীদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
পঞ্চমত, হুমায়ুনের মধ্যে নেতৃত্ব দান করার মতো বিশেষ ক্ষমতা ছিল না। তিনি সৈন্যবাহিনীকে উৎসাহ ও
উদ্দীপনায় উজ্জীবিত করে তুলতে অসমর্থ হয়েছিলেন। এছাড়া হুমায়ুনের চরিত্রের মহানুভবতা এবং সকলের
প্রতি অনুকম্পা এমনকি বিদ্রোহী সেনাপতিদের প্রতি অনুকম্পা সৈন্যবাহিনীর শৃ´খলাকে বহুল পরিমাণে ক্ষুন্ন
করে।
ষষ্ঠত, স্বল্পকালের জন্য তিনি প্রচন্ডভাবে উদ্যোগী হতে পারতেন, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কোন পরিকল্পনা
সাফল্যমন্ডিত করতে যে পরিমাণ উদ্যোগ ও আয়োজনের প্রয়োজন ছিল সেরূপ উদ্যোগী হতে পারেননি।
হুমায়ুনের চরিত্র ও কৃতিত্ব
হুমায়ুন যে একজন যথার্থ সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন সে সম্পর্কে কারো দ্বিমত নেই। সমকালীন ও আধুনিক
ঐতিহাসিক সকলেই একমত যে, হুমায়ুন দয়াবান, শান্ত স্বভাব, ¯েœহশীল ও হৃদয়বান নরপতি ছিলেন।
পিতার মৃত্যুর পরও তাঁর আদেশ পালন থেকে বিচ্যুত হননি। নিজের সিংহাসন পণ করেও মৃত্যুশয্যায় দেয়া
পিতার আদেশ অনুযায়ী ভ্রাতাদের সাম্রাজ্যের অংশ ভাগ করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-
স্বজনদের প্রতি তাঁর উদারতার এত মাত্রাধিক্য ঘটেছিল যে, কখনো কখনো এর জন্য তাঁকে বিপদে পড়তে
হয়েছিল। ভ্রাতাদের চরম শত্রুতা সত্তে¡ও তাদের প্রতি উদার ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। অভিজাতবর্গ সিংহাসন
নিষ্কণ্টক করার জন্য কামরানের প্রাণদন্ডের অনুরোধ করলেও হুমায়ুন তা করেননি। তিনি বলেছিলেন,
“বুদ্ধির বিচারে আমি আপনাদের সঙ্গে একমত কিন্তু অন্তরের দিক দিয়ে এই পরামর্শ গ্রহণে অক্ষম।”
এতেই হুমায়ুনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে।
দৈহিক সামর্থের দিক বিচার করলে হুমায়ুন সক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পিতা বাবুরের সহযোগী হিসেবে
পানিপথ ও খানুয়ার যুদ্ধে তিনি শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দিয়েছেন। চরম সংকটেও তিনি অবিচল থাকতে
পারতেন। অসীম দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করার মানসিকতা ছিল তাঁর, যা তাঁর পনর বৎসর নির্বাসিত জীবনে দেখা
গেছে। চৌসার ও কনৌজের যুদ্ধে শেরশাহ যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, সরহিন্দের যুদ্ধেও হুমায়ুন একই রকম
কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
হুমায়ুনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গুণ- অমায়িক ব্যবহার ও আনন্দপ্রবণ মেজাজ। ভাগ্য বিপর্যয় ও দুঃখ-
দুর্দশার মধ্যে থেকেও তিনি তাঁর চিত্তের সরলতা বা সহৃদয়তাকে হারাতে পারেননি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহযোগী ও অধস্তন ব্যক্তিদের প্রতি সমানভাবে প্রীতিমূলক আচরণ করতেন। এই স্বভাবসিদ্ধ
সহৃদয়তা একজন শাসকের বিপদেরও কারণ হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই কারণে ঐতিহাসিক
ফিরিস্তা মন্তব্য করেছেন, চরিত্রের সদগুণাবলির দিক দিয়ে হুমায়ুন সর্বশ্রেষ্ঠ।
হুমায়ুন একজন নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তবে তাঁর মধ্যে কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। নামাজ
পড়তেন, কিন্তু অন্য ধর্মের প্রতি কোন বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন না।
বাবুরের মতো হুমায়ুনের সাহিত্য প্রতিভা না থাকলেও সাহিত্য প্রীতি ও কবি প্রতিভা তাঁর চরিত্রের অন্যতম
গুণ ছিল। গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল।
শাসক হিসেবে হুমায়ুন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেননি। তাঁর রাজত্বের প্রথম দশ বৎসর তিনি
শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে তেমন কোন কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। ঐতিহাসিক রাসব্রুক উইলিয়াম মনে
করেন, তাঁর পিতার কাছ থেকে তখন তিনি এক কম্পমান সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন। সে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব
নির্ভর ছিল অবিরাম যুদ্ধের মাধ্যমে। অবিরাম যুদ্ধ করতে গিয়ে এবং ভ্রাতাদের বিরোধিতায় বিব্রত হয়ে
হুমায়ুন শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেননি। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিক ড. ত্রিপাঠী বলেন, তাঁর
প্রথম দশ বৎসরের শাসনকালে কামরানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল। যখন কামরান দেখলেন যে,
হুমায়ুন শাসক হিসেবে ব্যর্থ তখনই তিনি হুমায়ুনের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রকৃতপক্ষে, নব প্রতিষ্ঠিত
সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষার জন্য এবং আফগানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য যে
রাজনৈতিক বিচক্ষণতার ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন ছিল, তা হুমায়ুনের মধ্যে ছিল না। হুমায়ুনের
দুর্ভাগ্য যে, তাঁর অশেষ গুণাবলি থাকা সত্তে¡ও তিনি শাসক হিসেবে ব্যর্থ হন।
সবশেষে হুমায়ুনের ব্যর্থতা পর্যালোচনা করার সময় মনে রাখা উচিত বাবুরকে লড়াই করতে হয়েছিল
ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে, আর হুমায়ুনকে লড়তে হয়েছিল ‘মহান আকবরের অগ্রদূত' শেরশাহের বিরুদ্ধে। তাই
ব্যর্থতা ও দুর্বলতা সত্তে¡ও মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে হুমায়ুন এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। বিশেষত
যথাসময়ে মুঘল শক্তির পুনরুদ্ধার করা প্রকৃতই তাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্বÑ যা পরবর্তীকালে আকবরের
ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করেছিল।
সারসংক্ষেপ
ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবুরের মৃত্যুর পর পুত্র হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
পিতার নির্দেশ অনুসারে তিন ভ্রাতা কামরান, হিন্দাল ও আসকারীকে সাম্রাজ্যের তিনটি অংশের
শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সিংহাসনে বসে তিনি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। তম্মধ্যে পূর্ব ভারতে
আফগান শক্তির উত্থান ঘটে। প্রথম দিকে আফগান শক্তির মোকাবিলায় হুমায়ুন সাফল্য লাভ করলেও
পরবর্তীকালে চৌসার (১৫৩৯ খ্রি.) এবং বিলগ্রামের যুদ্ধে (১৫৪০ খ্রি.) শেরশাহের নিকট পরাজিত হয়ে
হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসন হারিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হন। এই দুর্দিনে হুমায়ুন ভাইদের
নিকট থেকে কোন সহযোগিতা পাননি পরে পারস্যের শাহের সহযোগিতায় দীর্ঘ পনর বৎসর পর
শেরশাহের উত্তরাধিকারী সিকান্দার শূরকে সরহিন্দের যুদ্ধে (১৫৫৫ খ্রি.) পরাজিত করে দিল্লির
সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। এই বিজয়ের সুফল তিনি বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। ১৫৫৬ খ্রি.
তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। হুমায়ুন কত খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন?
(ক) ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে।
২। কত খ্রি. বাহাদুর শাহ চিতোর দুর্গ অবরোধ করেন?
(ক) ১৫৩০ খ্রি. (খ) ১৫৩১ খ্রি.
(গ) ১৫৩২ খ্রি. (ঘ) ১৫৩৩ খ্রি.।
৩। কত খ্রিস্টাব্দে শের খাঁ গৌড় আধিকার করেছিলেন?
(ক) ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল (খ) ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল
(গ) ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল (ঘ) ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল।
৪। চৌসার যুদ্ধে কে পরাজিত হয়েছিলেন?
(ক) হুমায়ুন (খ) শেরশাহ
(গ) আকবর (ঘ) বাবুর।
৫। সরহিন্দের যুদ্ধের বিজেতা কে ছিলেন?
(ক) বাবুর (খ) শেরশাহ।
(গ) হুমায়ুন (ঘ) কামরান।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। হুমায়ুন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন তার একটি বিবরণ দিন।
২। চৌসার যুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন।
৩। হুমায়ুনের নির্বাসিত জীবনের ওপর একটি টীকা লিখুন।
৪। হুমায়ুনের ব্যর্থতার কারণগুলো উল্লেখ করুন।
৫। হুমায়ুনের চারিত্রিক গুণাবলির একটি বিবরণ দিন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। হুমায়ুনের রাজত্বকালের একটি বিবরণ দিন। এসঙ্গে তাঁর ব্যর্থতার কারণ নির্দেশ করুন।
২। হুমায়ুনের সঙ্গে শেরশাহের সংঘর্ষের ঘটনাবলির ধারাবাহিক বর্ণনা দিন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত