মিশরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পটভূমি

শক্তিদ্বয়ের সাহায্যে তৌফিক পাশাকে খেদিভ নিযুক্ত করা হয় এবং তৌফিক পাশা ক্ষমতা লাভ করে প্রথমে উদারপন্থী শরিফ পাশা এবং পরে রিয়াদ পাশাকে মন্ত্রী পরিষদ গঠনের আহ্বান জানান। ওরাবী পাশা জামাল উদ্দিন আফগানির বিশ্ব ইসলাম বাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মিশরকে বিদেশি দখলদারদের কবল হতে মুক্ত করে স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের জন্য সংগ্রাম করেন। তৌফিক পাশা আফগানিকে ১৮৭৯ সালে বিতাড়িত করলেও ইসলামী মূল্যবোধে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলটি ১৮৮১ সালে সর্বপ্রথম ওরাবী পাশার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেন। এ বিপ্লটি ছিল খেদিভ তৌফিক এবং প্রধানমন্ত্রী রিয়াদ পাশার বিরুদ্ধে। ওরাবী বিচক্ষণতার সাথে উদারপন্থী শরিফ পাশার নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সোসাইটি পার্টির সাথে সংঘবদ্ধভাবে এ বিপ্লব পরিচালনা করেন। এর ফলে মিশরিয় সেনাবাহিনীতে দু'টি দলের সৃষ্টি হয়। একটি মিশরিয়, অপরটি তুর্কি ও সিরকাসিয়ান। শেষোক্ত দলটি সেনাবাহিনীর গুপ্ত দলটিকে ‘হিযর-আল-ফেলাহীন' বা কৃষক দল নামে ধিক্কার দিলেও আসলে এ দলটি ‘আল-হিযর-আল-ওয়াতীন আলআহমী' বা ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক দল নামে পরিচিত ছিল। অবশ্য একথা সত্য যে, ওরাবী পাশা করাভাবে (কর্মী) জর্জরিত ফেলাহীনদের মিশর সরকারের স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে ।
তৌফিক পাশা খেদিভ নিযুক্ত হলে তিনি স্বৈরাচারী নীতির প্রতিফলনের জন্য রিয়াদ পাশাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। রিয়াদ কর্মীসহ নির্যাতনমূলক কর রহিত করলেও ফেলাহীনদের দুর্দশা লাঘব হয় নি। অপরদিকে সংবিধান বিরোধী মনোভাবের জন্য ১৮৮২ সালে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত সঙ্কটের জন্য খেদিভ তৌফিক রিয়াদ পাশাকে দায়ী করেন। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সঙ্কট, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সেনাবাহিনীতে বিরাজমান অসন্তোষ এমন এক পর্যায়ে পৌছায় যে, ওরাবী পাশা ১৮৮২ সালে সেনাবাহিনীর সদস্য জাতীয়তাবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের সংঘটিত করেন। তিনি ইউরোপীয় আধিপত্যবাদ নিরসন করে ‘Egypt for Egyptians' বা মিশরিয়দের জন্য মিশর এ দাবী তোলে বিদ্রোহ শুরু করেন। এ তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রিয়াদ পাশা সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এদিকে ওরাবী পাশা পরিষদের যেসব নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন, তারা হলেন সুলতান পাশা। সুলায়মান আবজা, মাহমুদ ফাহমী, খেদিভ বিরোধী সেনাদলের প্রধান ওরাবী পাশা তার সহকর্মী আবদ-আল-হিলমী এবং আলী ফাহমীর সাথে একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম পরিচালনা করেন। একটি ম্যানিফেস্টোতে এ দল খেদিভ ইসমাইলের পদচ্যুতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তৌফিক পাশার অনুসৃত অর্থনৈতিক আধিপত্য থেকে রক্ষা করে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দানের দাবী জানায়। এ পর্যায়ে জাতীয়তাবাদী দল সামরিক বাহিনীর একাংশের সাথে একতাবদ্ধ হলে আন্দোলন আরো জোরদার হয়। ফলে তুরস্কের সুলতান তার সার্বভৌমত্ব প্রকাশের জন্য ইসমাইলের স্থলে তার পুত্র তৌফিককে খেদিভ নিযুক্ত করেন। ওরাবী আন্দোলনকারীরা খেদিভের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। কেননা তারা তাকে ফরাসি - ব্রিটিশ শক্তির একজন ক্রীড়নক মনে করে। ওরাবী পাশা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তৌফিক পাশার সরকারের বিরুদ্ধে।
সরকারের সাথে সেনাবাহিনীর যে বিরোধ ইসমাইলের রাজত্বকালে শুরু হয় তা তৌফিক পাশার আমলে সুদূরপ্রসারী হয়। উল্লেখ্য যে, সমর মন্ত্রী হিসেবে ওসমান রিফকী নামে একজন সিরকাসিয়ানকে সেনাবাহিনীর সদস্যকে মিশরিয়রা মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারে নি। উপরন্তু ১৮৮০ সালের জুলাই মাসে জারিকৃত একটি ফরমানে খেদিভ সামরিক সার্ভিস ৪ বছর সীমাবদ্ধ করেন। স্বৈরাচারী তৌফিক সরকার ১৮৮১ সালের জানুয়ারি মাসে সেনাবাহিনীর এহেন দাবিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য সামরিক বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৮৮১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আবেদীন প্রাসাদে আয়োজিত একটি বিক্ষোভ মিছিলে ওরাবীগণ খেদিভের অনুসারীদের উপর প্রভাব বিস্তার করলে একদিকে যেমন খেদিভের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিপর্যস্ত হয়, অন্যদিকে ওরাবী নিজেকে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে মিশরিয় স্বার্থ রক্ষার জন্য বিদেশি সরকারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার ক্ষমতা লাভ করেন। খেদিভের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকলে তুর্কি সুলতান মিশরে দুজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। সুলতানের এহেন পদক্ষেপে ব্রিটেন শঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং ওরাবীদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সংসদ সদস্যদের সাথে ওরাবীদের বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু ওরাবী পাশার প্রভাব ও প্রতিপত্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে । প্রধানমন্ত্রী শরীফ পাশা এবং খেদিভ এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের নিরব সাক্ষী ছিলেন। ওরাবী পাশা ১৮৮১ সালের অক্টোবরে জাকাজিকের একজন সভায় বলেন যে, সংস্কার দ্বারা মিশরের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন এবং তা করতে হলে বিদেশিদের মিশর হতে বিতাড়িত করতে হবে। তিনি আরো বলেন যে, মিশরকে প্রকৃত অর্থে বিদেশি প্রভাব হতে মুক্ত করে স্বাধীন করতে হলে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন। ১৮৮১ সালের ২৬ ডিসেম্বর খেদিভ তৌফিক পাশা রাজনৈতিক সঙ্কট দূরীকরণের জন্য পরিষদের সভা আহ্বান করেন। কিন্তু ওরাবী পাশাসহ অপরাপর মন্ত্রী পদত্যাগ করতে অস্বীকার করলে খেদিভ সরকার তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় ।
১৮৮২ সালের মাঝামাঝি ওরাবী পন্থীদের সাথে খেদিভ সরকারের যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয় তার ফলে তুরস্কের সুলতান এবং ইঙ্গ-ফরাসী সরকার বিচলিত হয়ে পড়ে। ইঙ্গ-ফরাসি সরকার সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তাবও খেদিভকে দেন এবং মিত্র বাহিনীর নৌবহর ভূ-মধ্যসাগরে প্রেরণ করেন। সমরমন্ত্রী হিসেবে ওরাবী পাশা বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করেন। ইঙ্গ-ফরাসী সরকার ১৮৮২ সালে খেদিভের নিকট দাবি করেন যে, মিশরিয় সরকারের পতন না হলে এবং ওরাবী ও তার সঙ্গীদের মিশর থেকে বিতাড়িত না করলে তারা নৌবাহিনীর অবরোধ তুলে নিবেন না। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে এবং স্বীয় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ওরাবী পাশা আত্মগোপন করেন । কিন্তু গোপন ইস্তেহারে সেনাবাহিনীও দেশবাসীকে বিদেশি শক্তির আগ্রাসন ও খদিভের বিশ্বাসঘাতকতার কথা প্রচার করতে থাকেন। ওরাবী তৌফিককে Traitor বা দেশদ্রোহী নামে আখ্যায়িত করেন। ১৮৮২ সালের ২৬ মে সরকার পদত্যাগ করলে প্রমাণিত হয় যে, মিশর বিদেশি শক্তির কবলে রয়েছে। ফলে মিশরে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। মে-জুন মাসে সমগ্র দেশে বিক্ষোভ শুরু হল এবং সেনাবাহিনী ওরাবীকে পুনরায় সমরমন্ত্রী নিযুক্তির দাবি জানায়। পরিষদের সদস্যগণ গোপনে ওরাবীর বাসায় মিলিত হয় এবং ওরাবী তার বাহিনীসহ আবেদীন প্রাসাদ আক্রমণের হুমকী দেন। যাহোক ২৭ মে ওরাবী পুনরায় সমরমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলে ৩১মে খদিভ তৌফিক ভীত হয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় গমন করে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে সমরমন্ত্রী ওরাবী সমস্ত ক্ষমতা গ্রহণ করলেন এবং কায়রোর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওরাবীর ক্ষমতা দখলে খ্রিস্টান সম্প্রদায় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে কায়রো থেকে আলেকজান্দ্রিয়া পলায়ন করতে থাকে। ফলে ১৮৮২ সালের জুন মাসে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে উভয় সম্প্রদায়ের বহু লোক নিহত হয় ৷
এক পর্যায়ে মিশর-ব্রিটিশ সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মিশরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে । আলেকজান্দ্রিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। ব্রিটিশ নৌ- বহরের উপস্থিতিতে ওরাবী পাশা সমর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মিশর সমরমন্ত্রী ওরাবী পাশার কর্তৃত্বাধীন থাকার সময় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আলেকজান্দ্রিয়ায় বোমা বর্ষণের হুমকি দেয়। ১৮৮২ সালের ১১ই জুলাই ফ্রান্স নিষ্ক্রিয় থাকলেও ব্রিটিশ নৌবহর স্যারসিমুরের নির্দেশে আলোকজান্দ্রিয়ায় বোমাবর্ষণ করে। ওরাবী পাশার নেতৃত্বে মিশরিয়রা বিদেশী হামলা মোকাবেলা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শক্তিশালী ব্রিটিশ নৌবহর এবং সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ওরাবী পাশাসমূহ বিপদের সম্মুখীন হন। তিনি সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। একটি ডিগ্রি জারী করে সমগ্র দেশপ্রেমিক মিশরিয়দের বিদেশী আগ্রাসন প্রতিরোধ করার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ প্রদান করেন। ওরাবী পাশা তৌফিকের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আল-আযাহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখের নিকট থেকে একটি ফতোয়া আদায় করে তৌফিককে বিদেশি শক্তির মদদকারী দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা দেন এবং তার পদচ্যুতি দাবি করেন। অপরদিকে খেদিভও ওরাবীকে বিদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করেন। যিনি বলপূর্বক সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। ১৮৮২ সালের আগস্ট মাসে স্যার সারনেটের উলসনের নেতৃত্বে ২০,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য মিশরে অবতরণ করে। প্রথমে তারা আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেন। এ সময় মিশরে দ্বৈত সরকার ছিল। আলেকজান্দ্রিয়ায় ব্রিটিশ আশ্রিত খেদিভের সরকার এবং কায়রোসহ মিশরের অন্যান্য প্রদেশসমূহ ওরাবী সরকার থাকায় সমগ্র দেশে অরাজকতা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এ দ্বৈত শাসনের ফলে। ওলসলে ওরাবী সরকার উৎখাত করার জন্য সমরাভিযান করেন। ব্রিটিশ বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ইসমাইলিয়ায় আগমন করে। ১৮৮২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘তেল-আল-কবীরের’ যুদ্ধে মুষ্টিমেয় ওরাবী সৈন্য বিশাল ইংরেজ বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়। যুদ্ধে পরাজিত হলে ওরাবী আন্দোলন ধুলিসাৎ হয়ে যায়। ব্রিটিশবাহিনী খেদিভের বাহিনী হিসেবে পরিগণিত হয় এবং খেদিভ তৌফিকের লুপ্ত ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কায়রোসহ সমগ্র মিশরে ব্রিটিশ আধিপত্য কায়েম হয় এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। ১৮৮২ সালে ওরাবী পাশা সিংহলে নির্বাসিত হন। ওরাবী পাশা ছিলেন মিশরের প্রথম পর্যায়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃত। ইমামুদ্দিনের ভাষায় "His achievement lies in the fact that he made his countrymen understand that Egypt was theirs and compelled the foreign powers to recognize the Egyptions as a nation."
দ্বিতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : ১৮৯২ সালে তৌফিক পাশার মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় আব্বাস হিলমী (১৮৯২-১৯১৪) খেদিভ নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন নাবালক ও প্রশাসনে অনভিজ্ঞ। ফলে মিশরে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এরূপ বিশৃঙ্খলায় প্যারিসে আইন শাস্ত্রে অধ্যয়নরত মোস্তফা কামিল নামে এক বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ সংবাদপত্রের মাধ্যমে মিশরে ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের অবসান দাবী করেন। ১৮৯৬ সালে তিনি ‘হিযাবুল ওয়াতান' নামে একটি জাতীয় দল গঠন করেন। ১৮৯৬ সালে প্যারিস থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি সংবাদপত্র ও স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র প্রচার করতে থাকেন। ১৯০৮ সালে তার মৃত্যুর পর ‘হিযাবুল ওয়াতানের' নেতৃত্ব দেন তার সহকর্মী মোহাম্মদ ফরিদ বে। প্রথম ও দ্বিতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে তুলনা করলে প্রতীয়মান হবে যে ওরাবী পাশার নেতৃত্বে প্রথম যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় তা মূলতঃ ছিল গ্রাম ও কৃষিভিত্তিক যার শিখর ছিল খুব গভীরে। অপরদিকে দ্বিতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটি ছিল বিশেষতঃ নগর ও কতিপয় বুদ্ধিজীবীভিত্তিক। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উদ্ভূত এ আন্দোলনটি জনগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয় এবং এ কারণে এটি সহজেই ব্যর্থ হয়। ১৮৮২ সালে মিশরে ব্রিটিশ নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর তৎপরতার ফলে মিশরে ব্রিটিশ আধিপত্য সুদৃঢ় হয়। মিশরে ব্রিটিশ বাহিনীর তৎপরতায় ফরাসী সরকার বিচলিত হয় এবং অবশেষে ১৯০৪ সালের একটি চুক্তির মাধ্যমে মিশরে ইঙ্গ-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভুত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয় । উল্লেখ্য যে, মরক্কো ব্রিটিশ সরকার ও ফরাসি আধিপত্য স্বীকার করে নিলে মিশরে ব্রিটিশদের একচেটিয়া প্রভাবে ফ্রান্স বিরোধীতা করে নি। ১৮৮২-১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মিশর ব্রিটেনের দখলে ছিল। যদিও ব্রিটেনের কোন Legal Right বা আইন সঙ্গত অধিকার ছিল না। এর ফলে দ্বিতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
তৃতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : মিশরে ব্রিটিশ আধিপত্য সুদৃঢ় হলে তৃতীয়বারের মত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন নেতৃত্ব দেন মিশরের দু'জন কৃতি সন্তান। শেখ মোহাম্মদ আবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫) এবং সাদ জগলুল পাশা (১৮৫৭-১৯২৮)। ওরাবী পাশার মত আবদুহু একটি কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৮৭২ সালে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ইসলামবাদের প্রবক্তা শেখ জামালউদ্দিন আফগানির সংস্পর্শে আসেন এবং তার মতবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। ক্রমে তিনি মিশরে একজন উদার ইসলামপন্থী সমাজ সংস্কারক ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ওরাবী পাশার সহচর ছিলেন এবং সাদ জগলুল পাশার সমর্থক ছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত হিযাবল উম্মা দল তার মতবাদ প্রচার করে। তার লেখনীর মধ্যে কুসংস্কার ও গোঁড়ামির উর্ধ্বে একটি ধর্মীয় সংস্কারের আভাষ পাওয়া যায়। তিনি ইবন তাইমিয়ার মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তফসিল-আল কুরআন আল-হাকিম' ধর্মীয় পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর বহন করে। তিনি ১৮৯৯-১৯০৫ সাল পর্যন্ত মিশরে 'গ্রান্ড মুফতির' পদ অলঙ্কৃত করেন। তাঁকে উনবিংশ শতাব্দীর মিশরের ইতিহাসে প্রথম ও প্রভাবশালী ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারকের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
মিশরের তৃতীয় পর্যায়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ হলেন সাদ জগলুল পাশা। তিনি মিশরিয় জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার দরুন মিশরিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শূন্যতা দেখা দিলে সাদ জগলুল পাশা তার নবগঠিত ‘উম্মা’ ‘পার্টির মাধ্যমে নব জাগরণের চেষ্টা করেন। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হলে মিশরিয়রা সংবিধান প্রণয়ন ও স্বায়ত্তশাসনের প্রবর্তনে আন্দোলন শুরু করে। নতুন খেদিভ প্রথম ফুয়াদের স্বৈরাচারী নীতি ও ব্রিটিশ শাসকদের আধিপত্যবাদের জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিঘ্নিত হলেও ব্রিটিশ সরকার একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। একটি নতুন মন্ত্রীসভাও গঠিত হয় রুশদি পাশার নেতৃত্বে, কিন্তু ব্রিটিশদের বিরোধীতায় সাদ জগলুলকে মন্ত্রীপরিষদ থেকে বাদ দেয়া হয়। মিশরের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের এ যুগ সন্ধিক্ষণে সাদ জগলুলকে উপেক্ষা করে ব্রিটিশ সরকার মারাত্মক ভুল করে । কারণ মিশরিয় জনগণ জগলুলকে তাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়। এ পরিস্থিতি নিরসনের জন্য জগলুল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান এবং সঙ্কট নিরসনের জন্য ব্রিটেনে একটি জাতীয় প্রতিনিধি দল প্রেরণের প্রস্তাব দেন। এ পর্যায়ে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জগলুল পাশা মিশরের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও কূটনৈতিক প্রত্যয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে। তিনি সর্বদলীয় সমর্থন লাভ করেন। তার নেতৃত্বে আব্দুল আজীম ফাহামী এবং আলী শাহ সাবায়ীসহ একটি জাতীয় প্রতিনিধি দল গঠন করেন । তিনি ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও রেসিডেন্ট স্যার রেজিনাল্ড উইনগেটের সাথে সাক্ষাৎ করে তার ডেলিগেটদের ব্রিটেনে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু দমন নীতির ফলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জগলুলের এ আবেদন অনুমোদন করেন নি । অতপর ১৯১৮ সালের ১৩ই নভেম্বর জগলুল প্রতিষ্ঠা করেন ‘ওয়াফদ পার্টি' যা মিশরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিশরের সামরিক সরকার ‘ওয়াফদ পার্টির' কার্যকলাপ বন্ধের জন্য জগলুল পাশাসহ কতিপয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে ১৯১৯ সালের ৮ মার্চ মাল্টায় নির্বাসিত করে। এর প্রতিবাদে মিশরিয় জাতীয়তাবাদীরা ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং শহর বন্দর ও গ্রামে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয় । স্কুল থেকে শুরু করে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সংঘবদ্ধভাবে মিশর থেকে ব্রিটিশ আধিপত্য অবসানের আন্দোলন শুরু করে। মিশরের জাগ্রত জনতা টেলিগ্রাফের লাইন কেটে দেয় । রেল ও সড়কপথ ধ্বংস করে যাতায়াতের বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ সরকারও কঠোর দমন নীতি চালায় । দমন নীতি চরমে উঠলে বিক্ষুব্ধ মিশরিয়রা ১৮ মার্চ আসওয়ান থেকে কায়রো গামী ট্রেনে হামলা চালিয়ে ৮ জন ব্রিটিশ অফিসার ও কর্মচারীকে হত্যা করে। তীব্র আন্দোলনের চাপে মিশরের সামরিক সরকার ১৯২১ সালের ৫ এপ্রিল জগলুলকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু এলেন বে রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় আবারো জগলুলকে গ্রেফতার করে প্রথমে এডেন ও পরে সিসিলি দ্বীপে নির্বাসিত করেন। ১৯২৭ সালের ২৩ আগস্ট জগলুল মৃত্যুবরণ করেন । তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মিশরের তৃতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অবসান ঘটে। প্রায় দুই দশক তিনি মিশরিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার ব্যাপক জনপ্রিয়তাকে মিশরের রাজা ও বৃটিশ কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজনে পরিণত করে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করতে তাকে দুবার নির্বাসনে পাঠানো হয়। তার হাতেই মিশরিয় জাতীয়তাবাদ পরিপক্কতা লাভ করেছিল। তবে তিনি তার জীবদ্দশায় মিশরিয় জাতীয়তাবাদের সফলতা দেখে যেতে পারেন নি
সাদ জগলুল পাশা ও তার ওয়াফদ পার্টি
(ক) সাদ জগলুল পাশা :

সাদ জগলুল পাশার নাম মিশরের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :
সংগ্রামী জীবন : মিশরের জাতির পিতা সাদ জগলুল পাশা । তিনি বিশ্ব ইসলামবাদী সৈয়দ জামাল উদ্দিন আফগানির একজন কৃতী ছাত্র এবং আবদুহুর সহপাঠী ছিলেন। তাকে প্রকৃত অর্থে “Fathers of modern Egypt” বা আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি ১৮৫৭ মতান্তরে ১৮৬০ ডেল্টা অঞ্চলের আবিয়ানা গ্রামের এক নিরন্ন কৃষক পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা গ্রাম প্রধান ছিলেন এবং সে কারণে তিনি খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মক্তবে পাঠ শেষ করে তিনি ১৮৭১ সালে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ সময়ে তিনি তার সহপাঠী আবদুহুসহ আফগানীর প্রভাবাধীনে আসেন। তিনি আবদুহুর ১৮৮০ সালে অফিসিয়াল গেজেট পত্রিকা প্রকাশে সহযোগিতা করেন। তিনি ফরাসি ভাষায় আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করে একজন কৃতী আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৮৯২ সালে তিনি আপীল কোর্টের বিচারক নিযুক্ত হন। এবং শারিয়া কোর্ট ও বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের আত্মনিয়োগ করেন। ব্রিটিশপন্থী প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা ফাহমীর কন্যাকে বিয়ে করার ফলে তিনি মিশরের উচ্চ ও অভিজাত মহলে চলাফেরা করতে পারতেন। তিনি সংস্কারপন্থী ছিলেন এবং মিশরিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। তীক্ষ্ণ মেধা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা জগলুল পাশা একাধারে ছিলেন বাগ্মী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। তিনি ১৮৯২ সালে মোহাম্মদ আবদুহুর সাথে “মুসলিম বেনে ভোলেন্ট সোসাইটি” গঠন করেন। এছাড়া তার সাথে বৃটিশ সমর্থক উম্মাপন্থী বা হিযাবুল উম্মা এর সাথে সংযোগ ছিল। এ কারণে তিনি লর্ড ক্রোমারের সুপারিশে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ সরকারি পদ অলস্কৃত করেন। কিন্তু ১৯০৬ সালের দিনসাওয়াই ঘটনা তার জীবনের ধারাকে পাল্টে দেয়। যাহোক সাদ জগলুলের জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রখর ছিল এবং তিনি ১৮৯৫ সালে মোস্তফা কামিল প্রতিষ্ঠিত ‘হিসাবুল ওয়াতান' নামক রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেন । মোস্তফা কামিলের মৃত্যুর পর সাদ জগলুল ‘হিযাবুল ওয়াতান' এর নেতৃত্ব দেন।
সাদ জগলুল পাশার কর্মজীবন : ১৯০৬ সালে যখন দিন সাওয়াই ঘটনাটি সংঘটিত হয় তখন লর্ড ক্রোমার ব্রিটিশ এজেন্ট হিসেবে মিশরের শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন। মিশরের শক্তিহীন নাবালক খেদিভ দ্বিতীয় আব্বাস শুধু নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯০৬-১৯১২ সাল পর্যন্ত মিশরের রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে এবং এ পট পরিবর্তনে জগলুল পাশা অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ক্রোমারের সুপারিশে খেদিভ দ্বিতীয় আব্বাস সাদ জগলুল পাশাকে শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করেন। তার শ্বশুর প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা ফাহমী পাশার মন্ত্রীসভায় ১৯০৬ সালে যোগদান করেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। সাদ জগলুলের মন্ত্রিত্ব দিনসাওয়াই ঘটনার তিক্ততাকে নিরসনের জন্য নতুবা শাসন ব্যবস্থায় মিশরিয়দের অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ দানের জন্য তা বলা দুষ্কর। এতদসত্ত্বেও ভ্যাটিকিওটিসের ভাষায় একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, “সাদ জগলুলের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদে নিযুক্তি শাসন ব্যবস্থার মিশরিয়করণের একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ।” উপরন্তু এ নিযুক্তি উদারপন্থী সেকুলার রাজনীতিবিদদের প্রশাসনে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেয়। ১৯০৬-১৯১০ সাল পর্যন্ত সাদ জগলুল পাশা মিশরে শিক্ষার অবকাঠামো তৈরি করেন এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য কুতুবখানা বা মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বয়স্কদের জন্য নৈশ স্কুল স্থাপন করেন। তিনি ইংরেজীর স্থলে আরবিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করেন এবং স্কুল পরিদর্শক হিসেবে অধিক সংখ্যক মিশরিয়দের নিয়োগ দেন । ১৯১০ সালে তিনি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করে আইনের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি শারিয়া বিচারকদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তিনি বিচারের ক্ষেত্রে খেদিভের ক্ষমতা হ্রাসের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯১৩ সালে লর্ড কিচেনারের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় সাদ জগলুল পদত্যাগ করেন। ১৯১২ সালে লর্ড কিচেনারও খেদিভকে হত্যার একটি ষড়যন্ত্র ফাঁস করলে ব্রিটিশ এজেন্ট কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু গণআন্দোলনের ফলে কিচেনার সংবিধানকে গণতন্ত্রমুখী করতে বাধ্য হন। তিনি উচ্চ ও নিম্ন পরিষদ একীভূত করে একটি ব্যবস্থাপক সভা গঠন করেন। ১৯১৩-১৪ সালে কিচেনার কর্তৃক সৃষ্ট নতুন ব্যবস্থাপক সভায় জগলুল সমর্থকেরা নির্বাচনে বিপুল ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন এবং জগলুলসহ সভাপতির পদ অলংকৃত করেন । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৪ সালে Assembly অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সামরিক আইন জারী করা হয়। ফলে সদস্যপদ হারিয়ে তিনি ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিরোদী দল গঠন করেন। যাহোক, স্বল্পকালীন সময়ে (জুন, ১৯১৪) তিনি ব্যবস্থাপক সভার নেতা হিসেবে শিক্ষা, সমাজ, জনকল্যাণকর, বিভিন্ন সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । ভ্যাটিকিওটিস যথার্থই বলেন যে, “সাদ জগলুলের রাজনৈতিক, সংবিধানিক অভিজ্ঞতায় এমন একটি Elite বা নিশ্চিত জাতীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে যার ফলে ১৯১৯ সালের ব্রিটিশ বিরোধী গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন জোরদার হয়। ফলে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী শাসনের স্থলে 'Constitutional government' বা সাংবিধানিক সরকার প্রবর্তন করতে বাধ্য হন ৷ ”
সাদ জগলুল পাশার নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯১৪ সলে “Protectorate Declaration in Egypt” বা মিশরকে ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্য ঘোষণা দেয়ায় সাংবিধানিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে ১৯১৭ সালে রাজা প্রথম ফুয়াদ এবং প্রধানমন্ত্রী রুশদী পাশা মিশরের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে ক্যাপিচুলেশন নিরসন করে সাংবিধানিক সংস্কার প্রবর্তনের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দেন। এর ফলে মিশরের ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী গণবিক্ষোভ ও আন্দোলনের আশাঙ্কায় ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে । এ কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করা। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে স্যার উইলিয়াম ব্রায়নসেটের নেতৃত্বে একটি রিপোর্ট প্রণীত হলেও তাতে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হয় নি। যুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার দরুন মিশরিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শূন্যতা দেখা দিলে জগলুল পাশা তার নবগঠিত
'উম্মা' পার্টির নব জাগরণের চেষ্টা করেন। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হলে মিশরিয়রা সংবিধান প্রণয়ন ও স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের আন্দোলন শুরু করে। নতুন খেদিভ প্রথম ফুয়াদের স্বৈরাচারীনীতি ও ব্রিটিশ শাসকদের আধিপত্যবাদের জন্য জাতীয়তাবাদের আন্দোলন বিঘ্নিত হলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। রুশদী পাশার নেতৃত্বে একটি নতুন মন্ত্রীসভাও গঠিত হয়। কিন্তু ব্রিটিশদের বিরোধীতায় জগলুলকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ দেয়া হয়। মিশরের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের এ যুগ সন্ধিক্ষণে সাদ জগলুলকে উপেক্ষা করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মারাত্মক ভুল করে। কারণ মিশরিয় জনগণ জগলুলকে তাদের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে। এর পরিণতিতে সমগ্র দেশে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়। এ পরিস্থিতি নিরসনের জন্য জগলুল বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান এবং সঙ্কট নিরসনের জন্য ব্রিটেনে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণের প্রস্তাব দেন। এ পর্যায়ে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জগলুল পাশা মিশরের অবিসংবাদিত জননেতায় পরিণত হন এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞায় বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি সর্বদলীয় সমর্থন লাভ করেন। তার নেতৃত্বে আব্দুল আজিজ কাহামী এবং আলী শাহ সাবায়ীসহ একটি জাতীয় প্রতিনিধি দল গঠন করেন । তিনি ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও রেসিডেন্ট স্যার রেজিনাল্ড উইনগেটের সাথে সাক্ষাৎ করে তার ডেলিগেটদের বৃটেনে যাবার অনুমতি প্রার্থণা করেন। ব্রিটিশ সরকারের সাথে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু দমন নীতির ফলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জগলুলের আবেদন মঞ্জুর করে নি। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী রুশদী পাশাও একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ব্রিটেনে যেতে চান। কিন্তু তাকে পাসপোর্ট দেয়া না হলে তিনি ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন। ফলে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় ।
সাদ জগলুল পাশার ভাগ্য বিপর্যয়ে ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসের শেষার্ধে সাদ জগলুল পাশা পুনরায় ব্রিটিশ সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে লন্ডনে ডেলিগেশন প্রেরণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে ব্রিটিশ রেসিডেন্সি অনুমতি প্রত্যাখান করে। অতঃপর ওয়াফদ পার্টি ব্রিটিশ দখলদার বাহিনীর কুকীর্তি ও দমন নীতি প্রকাশের জন্য মিশরের বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসে এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের নিকট পত্র প্রেরণ করে। এ কার্যকলাপের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনসমর্থন ও বিদেশি সরকারের সহানুভূতি আকর্ষণ করে আশ্রিত রাজ্যে মিশরের স্বাধীকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা এবং ব্রিটিশ কতৃপক্ষকে নাজেহাল করা। যাহোক, ব্রিটিশ রেসিডেন্সী ওয়াফদ পার্টিকে ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লন্ডন অথবা প্যারিসে গমনে বাধা দান করতে সমর্থ হন। ১৯১৯ সালের ১৮ই জানুয়ারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এ চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে ‘ওয়াফদ পার্টি' তাদের দাবি উপস্থাপনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১২ জানুয়ারি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিরিয় ডেলিগেশনকে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে যোগদানের অনুমতি দেয়। কিন্তু মিশরিয় ডেলিগেশনকে বাধা দান করলে গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়। অতঃপর ১৩ জানুয়ারি সাদ জগলুল পাশা হামদ পাশা নামক একজন সদস্যের বাসায় ওয়াফদ পার্টির সাধারণ সভা আহ্বান করেন। এ সভায় সকল সদস্য বলিষ্ঠ কণ্ঠে মিশরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন করার দীপ্ত প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। জগলুল যুক্তি দ্বারা বক্তব্য রাখেন যে মুহাম্মদ আলীর সময় তুরস্কের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে মিশর স্বাধীন ছিল যা ১৮৪০ সালে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ স্বীকার করে। কিন্তু খেদিভের বৈরিতায় মিশর ইঙ্গ-ব্রিটিশদের অধীনতা স্বীকারে বাধ্য হয়। ওয়াফদ পার্টি তাদের দাবি সমর্থনে ১৯১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি গণবিক্ষোভের আয়োজন করলে ব্রিটিশ বাহিনীর জেনারেল ওয়াটসন তা নস্যাৎ করে দেন। ৮ ফেব্রুয়ারি জগলুল তার দাবিতে অটল ছিলেন এবং ১ মার্চ রুশদীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে সুলতান ফুয়াদ (১৯১৭-১৯৩৬) সংবিধান ও জাতীয়তাবিরোধী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন । একদিকে ওয়াফদ পার্টির ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলন, অপরদিকে মিশরের রুশদী সরকারের পতন এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায় ৬ মার্চ জেনারেল ওয়াটসন জগলুল পাশা ও তার সাথীদের সামরিক দপ্তরে ডেকে তাদের সাবধান করে দেন। এ ধরনের অহেতুক নিপীড়ন ও হয়রানিতে জগলুল পাশার নির্বাসনে সুপ্ত বারুদে অগ্নিস্ফুরণের মত প্রতিক্রিয়া হয় । কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে ১৯২১ সালের ৫ এপ্রিল জগলুলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু এলেন বে মিশরে রাজনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কায় জগলুলকে আবারো গ্রেফতার করে প্রথমে এডেন ও পরে সিসিলি দ্বীপে নির্বাসিত করেন ।
সাদ জগলুল পাশার প্রধানমন্ত্রীত্ব : সারওয়াত সরকার ১৯২২ সালে সরকার গঠন করলেও মিশরিয়রা তাদের অভিষ্ঠ লক্ষে পৌঁছতে পারে নি। সারওয়াত পাশা ওয়াফদপন্থীদের প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে সংবাদপত্রে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। সংবিধান প্রণয়নে তিনি ব্যর্থ হন। অসহযোগিতার জন্য বাধ্য হয়ে ১৯২২ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করেন। তার স্থলাভিষিত্ব হন মোহাম্মদ তৌফিক নাসিম পাশা ৷ কিন্তু বৃটিশদের উপর সন্ত্রাসীদের আক্রমণ ও সুদান প্রশ্নে মতবিরোধ হলে তিনি ৩ মাস পরে পদত্যাগ করেন। ব্রিটিশ রেসিডেন্ট অরাজকতা দমনের জন্য সামরিক আইন জোরদার করেন । যে এলেন বে ব্রিটিশ ঘোষণার নেপথ্য নায়ক ছিলেন, তিনি উৎপীড়ন শুরু করলেন এবং ওয়াফদ পার্টির সদর দক্ষতর বন্ধ করে দেন। ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ এক মাস মিশরে কোন সরকার ছিল না। এদিকে মিশরিয় জনগণ এবং মিডিয়া মিশরের এ সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে জগলুল পাশাকে দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে থাকে। ১৯২৩ সালের ১৫ মার্চ উদারপন্থী বিচারক ইয়াহইয়া ইব্রাহীম পাশা সরকারের প্রধান হলে তিনি জগলুল পাশাকে মুক্তির নির্দেশ দেন। জগলুল পাশা ১৯২৩ সালে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয় এবং ১৯২৩ সালের ১৯ এপ্রিল নতুন সংবিধান ঘোষিত হয়। ৩০ এপ্রিল সাধারণ নির্বাচনের আইন অনুমোদিত হয় এবং সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে মিশরে প্রথম নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ১৯২৪ সালের ১২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওয়াফদ পার্টির সদস্যগণ বিপুল ভোটাধিক্যে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তাদের এ বিজয় সাফল্যের জন্য জগলুল পাশার অক্লান্ত ও নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগই দায়ী। ওয়াফদ পার্টি যেখানে ২১৪টি আসন লাভ করে সেখানে উদারপন্থী সংবিধানপন্থীগণ এবং জাতীয় পার্টি মাত্র ২টি করে আসন লাভ করে। ফলে জগলুল পাশার নেতৃত্বে ওয়াফদ পার্টি সরকার গঠনের সুযোগ পায়। জগলুল পাশা প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। ১৯২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রথম ওয়াফদ সরকার গঠিত হয়। ১৫ মার্চ রাজা ফুয়াদ সংসদের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন ।
১৯২৪ সালে জগলুল পাশা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ওয়াফদ সরকার গঠন করেন। তিনি ছিলেন মিশরের সর্বজন স্বীকৃত নেতা। তার সহকর্মী আহম্মদ শফি তাকে বলতেন, “জায়েম-আল উম্মা” ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় বীর'। তিনি ক্ষমতা লাভ করেই মিশরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেষ্টা করেন । তার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিতনীতি ছিল “ইশতি- কলাল আল-তাম” বা “পূর্ণ স্বাধীনতা” । এ লক্ষ্যে পৌছবার জন্য তিনি সংসদের মোট ২১৪ টি আসনের মধ্যে ১৯৫টি লাভ করে সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণ করেন এবং মাত্র ৯ জন তথাকথিত বিরোধী গ্রুপকে বিশেষ গ্রাহ্য করেন নি । সংসদে স্বীয় ক্ষমতা ও প্রভাব সুদৃঢ় করে জগলুল বৃটিশ সেনা বাহিনীর অপসারণ দাবি করেন। কারণ দখলদার বাহিনীর অবস্থান সার্বভৌমত্বের হানিকর। উপরন্তু ‘Reserved point’ বা সংরক্ষিত পয়েন্টে উল্লোসিত সুদান প্রশ্নে ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথেও জগলুল একমত ছিলেন না। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে সমস্যার সমাধান করতে চান । কিন্তু বৃটিশ সরকারের অনমনীয় মনোভাবের জন্য আলাপ আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অতঃপর ১৯২৪ সালের জুন মাসে পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, মিশর সরকার মিশরে অবস্থানরত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বহন করবে না এবং সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ লীগ অব নেশনস এর উপর অর্পিত হবে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও রাজনৈতিক জটিলতার জন্য তা কার্যকরী হয় নি। যাহোক, ১৯২৮ সালের নভেম্বরে মিশরের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান কায়রোতে আততায়ীর হাতে নিহত হলে জগলুল পাশার সরকার মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয় । ব্রিটেনের টোরী সরকার এ হত্যাকান্ডের জন্য জগলুল সরকারের নিকট চরমপত্র প্রেরণ করে ক্ষতিপূরণ সহ অন্যান্য দাবি পেশ করে। দাবিগুলি ছিল-(এ) পূর্বের মত ব্রিটিশ কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। (বি) সুদান থেকে সব মিশরিয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। (সি) নীল নদের পানি দিয়ে সুদানের সেচ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। হত্যার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জগলুল পাশা ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০০০০০ লক্ষ পাউন্ড স্টার্লিং প্রদানে সম্মত হলেও অপর তিনটি ঘৃণ্য শর্ত মানতে রাজী হলেন না। ফলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া কাস্টমস হাউজ দখল করে জগলুলকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। ১৯২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস ওয়াফদ সরকার বলবৎ ছিল। সিনেটের প্রথম প্রেসিডেন্ট আহমদ জিওর পাশা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলে তিনি ব্রিটিশ কর্তৃক আরোপিত সকল শর্ত মেনে নেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের বিধিমালা এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যাতে ১৯২৫ সালে পরবর্তী নির্বাচনে ‘ওয়াফদ' পার্টি' যোগদান করতে না পারে ।
প্রেসিডেন্ট পদে সাদ জগলুল পাশা ১৯২৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লিবারাল, জাতীয়তাবাদী, ইত্তেহাদী, ওয়াফদ পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সম্মিলিতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল সংখ্যক ভোটে পুনরায় বিজয়ী হয়। মোট ২১৪ টি আসনের মধ্যে ১১৬টি আসন তারা লাভ করে। নবগঠিত পার্লামেন্টে জগলুল পাশা নির্বাচিত হয়ে আবারো তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেন। তিনি মিশরের প্রেসিডেন্টের মর্যাদা লাভ করেন । এবং তিনটি দল থেকে (জাতীয়তাবাদী, ওয়াফদ ও লিবারাল) ৩ জনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেন। জগলুল পাশার ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ সরকার সনুজরে দেখে নি। তারা শঙ্কিত হয়ে লর্ড এলেন বের স্থলে নিযুক্ত নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার লর্ড লয়েড আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি যুদ্ধ জাহাজ নোঙ্গর করার নির্দেশ দেন। সাদ জগলুল পাশা বার্ধক্যজনিত কারণে সরকারি দায়িত্ব লিবারেল পার্টির নেতা আদলী পাশার উপর ন্যাস্ত করেন। সক্রিয় অংশগ্রহণে ব্যর্থ হলেও জগলুল মিশরের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃত ছিলেন এবং তারই অসামান্য ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবের ফলেই মিশর স্বাধীনতা লাভ করে। তিনি ১৯২৭ সালের আগস্ট মাসে মৃত্যুবরণ করেন। এরই মধ্য দিয়ে সাদ জগলুল পাশার মত একজন কিংবদন্তীকে হারায় মিশর এবং এক বর্ণাঢ্য ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।
(খ) ওয়াফদ পার্টি : ১৯১৯ সালের ১৮ই জানুয়ারী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এ চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে ‘ওয়াফদ পার্টি' তাদের দাবী উপস্থাপনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১২ জানুয়ারি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিরিয় ডেলিগেশনকে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে যোগদানের অনুমতি দেয়। কিন্তু মিশরিয় ডেলিগেশনকে বাধা দান করলে তীব্র গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়। অতঃপর ১৩ জানুয়ারি জগলুল পাশা হামদ পাশা নামক একজন সদস্যের বাসায় ‘ওয়াফদ পার্টির' সাধারণ সভা আহ্বান করেন। এ সভায় সকল সদস্য বলিষ্ঠ কণ্ঠে মিশরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন করার দীপ্ত প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। ওয়াফদ পার্টি তাদের দাবির সমর্থনে ১৯১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি বিক্ষোভ করে। এহেন বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হয়ে সামরিক শাসকবর্গ ওয়াফদ পার্টির কার্যকলাপ বন্ধের জন্য জগলুল পাশা সহ কতিপয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে ৮ মার্চ মাল্টায় নির্বাসিত করে। জগলুলের নির্বাসনের প্রতিবাদে ওয়াফদ পার্টি সহিংস আন্দোলন শুরু করে । জগলুলের অবর্তমানে আলী পাশা সাবায়ী ওয়াফদ পার্টির নেতৃত্ব দেন । সারাদেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে ১৯১৯ সালের ৭ এপ্রিল জগলুলকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু এলেন বে ওয়াফদ পার্টির সন্ত্রাসী সদস্যদের আন্দোলনে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কায় জগলুলকে গ্রেফতার করে প্রথমে এডেন এবং পরে সিসিলি দ্বীপে নির্বাসিত করেন। ওয়াফদ পার্টির তীব্র আন্দোলনের চাপে সঙ্কটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯২৩ সালের ১৫ মার্চ উদারপন্থী বিচারক ইয়াহইয়া সরকার প্রধান হলে তিনি জগলুল পাশাকে মুক্তির নির্দেশ দেন। জগলুল পাশা ১৯২৩ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯২৪ সালের ১২ জানুয়ারির নির্বাচনে জননেতা জগলুলের নেতৃত্বে ওয়াফদ পার্টি বিপুল বিজয় অর্জন করেন । জগলুল পাশার নেতৃত্বে ওয়াফদ পার্টি সরকার গঠন করে। ১৯২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রথম ওয়াফদ সরকার গঠিত হয়। জগলুল পাশা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে ওয়াফদ পার্টির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট নির্বাচনে বিজয়ী হয়। জগলুল পাশা ওয়াফদ পার্টি থেকে আবারো নির্বাচিত হন। এবার তিনি মিশরের প্রেসিডেন্টের পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯২৭ সালে ওয়াফদ পার্টির এ শীর্ষনেতা মৃত্যুবরণ করেন। জগলুলের মৃত্যুর পর মোস্তফা নাহাদ পাশা ওয়াফদ পার্টর নেতৃত্বে আসেন। সর্বোপরি, ওয়াফদ পার্টি সম্পর্কে দুজন ফরাসি গ্রন্থাগারের বক্তব্য তুলে ধরা যায়। Jean and Simone lacouture বলেন, “The affad was the expression of the entire people of which in the fullest sense it was the delegate. Any attempt at defining it would involve a com- plete description of Egypt. It contained all the generosity. intellectual mood, good nature, contradictions and megalomania of the millions of supporters.”
পরিশেষে বলা যায় যে, জনপ্রিয় ওয়াফদ পার্টি মিশরের জাতীয়তাবাদী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ দল মিশরিয় গণ আন্দোলন ও জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানে আরোহণ করে। সুতরাং, ওয়াফদ পার্টি মিশরে রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]