সাদ জগলুল পাশা ও তার ওয়াফদ পার্টি মিশরের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সাদ জগলুল পাশা ও তার ওয়াফদ পার্টি
(ক) সাদ জগলুল পাশা :

সাদ জগলুল পাশার নাম মিশরের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :
সংগ্রামী জীবন : মিশরের জাতির পিতা সাদ জগলুল পাশা । তিনি বিশ্ব ইসলামবাদী সৈয়দ জামাল উদ্দিন আফগানির একজন কৃতী ছাত্র এবং আবদুহুর সহপাঠী ছিলেন। তাকে প্রকৃত অর্থে “Fathers of modern Egypt” বা আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি ১৮৫৭ মতান্তরে ১৮৬০ ডেল্টা অঞ্চলের আবিয়ানা গ্রামের এক নিরন্ন কৃষক পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা গ্রাম প্রধান ছিলেন এবং সে কারণে তিনি খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মক্তবে পাঠ শেষ করে তিনি ১৮৭১ সালে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ সময়ে তিনি তার সহপাঠী আবদুহুসহ আফগানীর প্রভাবাধীনে আসেন। তিনি আবদুহুর ১৮৮০ সালে অফিসিয়াল গেজেট পত্রিকা প্রকাশে সহযোগিতা করেন। তিনি ফরাসি ভাষায় আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করে একজন কৃতী আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৮৯২ সালে তিনি আপীল কোর্টের বিচারক নিযুক্ত হন। এবং শারিয়া কোর্ট ও বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের আত্মনিয়োগ করেন। ব্রিটিশপন্থী প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা ফাহমীর কন্যাকে বিয়ে করার ফলে তিনি মিশরের উচ্চ ও অভিজাত মহলে চলাফেরা করতে পারতেন। তিনি সংস্কারপন্থী ছিলেন এবং মিশরিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। তীক্ষ্ণ মেধা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা জগলুল পাশা একাধারে ছিলেন বাগ্মী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। তিনি ১৮৯২ সালে মোহাম্মদ আবদুহুর সাথে “মুসলিম বেনে ভোলেন্ট সোসাইটি” গঠন করেন। এছাড়া তার সাথে বৃটিশ সমর্থক উম্মাপন্থী বা হিযাবুল উম্মা এর সাথে সংযোগ ছিল। এ কারণে তিনি লর্ড ক্রোমারের সুপারিশে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ সরকারি পদ অলস্কৃত করেন। কিন্তু ১৯০৬ সালের দিনসাওয়াই ঘটনা তার জীবনের ধারাকে পাল্টে দেয়। যাহোক সাদ জগলুলের জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রখর ছিল এবং তিনি ১৮৯৫ সালে মোস্তফা কামিল প্রতিষ্ঠিত ‘হিসাবুল ওয়াতান' নামক রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেন । মোস্তফা কামিলের মৃত্যুর পর সাদ জগলুল ‘হিযাবুল ওয়াতান' এর নেতৃত্ব দেন।
সাদ জগলুল পাশার কর্মজীবন : ১৯০৬ সালে যখন দিন সাওয়াই ঘটনাটি সংঘটিত হয় তখন লর্ড ক্রোমার ব্রিটিশ এজেন্ট হিসেবে মিশরের শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন। মিশরের শক্তিহীন নাবালক খেদিভ দ্বিতীয় আব্বাস শুধু নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯০৬-১৯১২ সাল পর্যন্ত মিশরের রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে এবং এ পট পরিবর্তনে জগলুল পাশা অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ক্রোমারের সুপারিশে খেদিভ দ্বিতীয় আব্বাস সাদ জগলুল পাশাকে শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করেন। তার শ্বশুর প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা ফাহমী পাশার মন্ত্রীসভায় ১৯০৬ সালে যোগদান করেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। সাদ জগলুলের মন্ত্রিত্ব দিনসাওয়াই ঘটনার তিক্ততাকে নিরসনের জন্য নতুবা শাসন ব্যবস্থায় মিশরিয়দের অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ দানের জন্য তা বলা দুষ্কর। এতদসত্ত্বেও ভ্যাটিকিওটিসের ভাষায় একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, “সাদ জগলুলের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদে নিযুক্তি শাসন ব্যবস্থার মিশরিয়করণের একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ।” উপরন্তু এ নিযুক্তি উদারপন্থী সেকুলার রাজনীতিবিদদের প্রশাসনে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেয়। ১৯০৬-১৯১০ সাল পর্যন্ত সাদ জগলুল পাশা মিশরে শিক্ষার অবকাঠামো তৈরি করেন এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য কুতুবখানা বা মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বয়স্কদের জন্য নৈশ স্কুল স্থাপন করেন। তিনি ইংরেজীর স্থলে আরবিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করেন এবং স্কুল পরিদর্শক হিসেবে অধিক সংখ্যক মিশরিয়দের নিয়োগ দেন । ১৯১০ সালে তিনি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করে আইনের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি শারিয়া বিচারকদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তিনি বিচারের ক্ষেত্রে খেদিভের ক্ষমতা হ্রাসের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯১৩ সালে লর্ড কিচেনারের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় সাদ জগলুল পদত্যাগ করেন। ১৯১২ সালে লর্ড কিচেনারও খেদিভকে হত্যার একটি ষড়যন্ত্র ফাঁস করলে ব্রিটিশ এজেন্ট কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু গণআন্দোলনের ফলে কিচেনার সংবিধানকে গণতন্ত্রমুখী করতে বাধ্য হন। তিনি উচ্চ ও নিম্ন পরিষদ একীভূত করে একটি ব্যবস্থাপক সভা গঠন করেন। ১৯১৩-১৪ সালে কিচেনার কর্তৃক সৃষ্ট নতুন ব্যবস্থাপক সভায় জগলুল সমর্থকেরা নির্বাচনে বিপুল ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন এবং জগলুলসহ সভাপতির পদ অলংকৃত করেন । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৪ সালে Assembly অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সামরিক আইন জারী করা হয়। ফলে সদস্যপদ হারিয়ে তিনি ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিরোদী দল গঠন করেন। যাহোক, স্বল্পকালীন সময়ে (জুন, ১৯১৪) তিনি ব্যবস্থাপক সভার নেতা হিসেবে শিক্ষা, সমাজ, জনকল্যাণকর, বিভিন্ন সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । ভ্যাটিকিওটিস যথার্থই বলেন যে, “সাদ জগলুলের রাজনৈতিক, সংবিধানিক অভিজ্ঞতায় এমন একটি Elite বা নিশ্চিত জাতীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে যার ফলে ১৯১৯ সালের ব্রিটিশ বিরোধী গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন জোরদার হয়। ফলে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী শাসনের স্থলে 'Constitutional government' বা সাংবিধানিক সরকার প্রবর্তন করতে বাধ্য হন ৷ ”
সাদ জগলুল পাশার নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯১৪ সলে “Protectorate Declaration in Egypt” বা মিশরকে ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্য ঘোষণা দেয়ায় সাংবিধানিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে ১৯১৭ সালে রাজা প্রথম ফুয়াদ এবং প্রধানমন্ত্রী রুশদী পাশা মিশরের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে ক্যাপিচুলেশন নিরসন করে সাংবিধানিক সংস্কার প্রবর্তনের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দেন। এর ফলে মিশরের ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী গণবিক্ষোভ ও আন্দোলনের আশাঙ্কায় ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে । এ কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করা। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে স্যার উইলিয়াম ব্রায়নসেটের নেতৃত্বে একটি রিপোর্ট প্রণীত হলেও তাতে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হয় নি। যুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার দরুন মিশরিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শূন্যতা দেখা দিলে জগলুল পাশা তার নবগঠিত
'উম্মা' পার্টির নব জাগরণের চেষ্টা করেন। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হলে মিশরিয়রা সংবিধান প্রণয়ন ও স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের আন্দোলন শুরু করে। নতুন খেদিভ প্রথম ফুয়াদের স্বৈরাচারীনীতি ও ব্রিটিশ শাসকদের আধিপত্যবাদের জন্য জাতীয়তাবাদের আন্দোলন বিঘ্নিত হলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। রুশদী পাশার নেতৃত্বে একটি নতুন মন্ত্রীসভাও গঠিত হয়। কিন্তু ব্রিটিশদের বিরোধীতায় জগলুলকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ দেয়া হয়। মিশরের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের এ যুগ সন্ধিক্ষণে সাদ জগলুলকে উপেক্ষা করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মারাত্মক ভুল করে। কারণ মিশরিয় জনগণ জগলুলকে তাদের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে। এর পরিণতিতে সমগ্র দেশে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়। এ পরিস্থিতি নিরসনের জন্য জগলুল বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান এবং সঙ্কট নিরসনের জন্য ব্রিটেনে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণের প্রস্তাব দেন। এ পর্যায়ে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জগলুল পাশা মিশরের অবিসংবাদিত জননেতায় পরিণত হন এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞায় বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি সর্বদলীয় সমর্থন লাভ করেন। তার নেতৃত্বে আব্দুল আজিজ কাহামী এবং আলী শাহ সাবায়ীসহ একটি জাতীয় প্রতিনিধি দল গঠন করেন । তিনি ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও রেসিডেন্ট স্যার রেজিনাল্ড উইনগেটের সাথে সাক্ষাৎ করে তার ডেলিগেটদের বৃটেনে যাবার অনুমতি প্রার্থণা করেন। ব্রিটিশ সরকারের সাথে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু দমন নীতির ফলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জগলুলের আবেদন মঞ্জুর করে নি। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী রুশদী পাশাও একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ব্রিটেনে যেতে চান। কিন্তু তাকে পাসপোর্ট দেয়া না হলে তিনি ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন। ফলে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় ।
সাদ জগলুল পাশার ভাগ্য বিপর্যয়ে ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসের শেষার্ধে সাদ জগলুল পাশা পুনরায় ব্রিটিশ সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে লন্ডনে ডেলিগেশন প্রেরণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে ব্রিটিশ রেসিডেন্সি অনুমতি প্রত্যাখান করে। অতঃপর ওয়াফদ পার্টি ব্রিটিশ দখলদার বাহিনীর কুকীর্তি ও দমন নীতি প্রকাশের জন্য মিশরের বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসে এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের নিকট পত্র প্রেরণ করে। এ কার্যকলাপের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনসমর্থন ও বিদেশি সরকারের সহানুভূতি আকর্ষণ করে আশ্রিত রাজ্যে মিশরের স্বাধীকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা এবং ব্রিটিশ কতৃপক্ষকে নাজেহাল করা। যাহোক, ব্রিটিশ রেসিডেন্সী ওয়াফদ পার্টিকে ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লন্ডন অথবা প্যারিসে গমনে বাধা দান করতে সমর্থ হন। ১৯১৯ সালের ১৮ই জানুয়ারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এ চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে ‘ওয়াফদ পার্টি' তাদের দাবি উপস্থাপনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১২ জানুয়ারি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিরিয় ডেলিগেশনকে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে যোগদানের অনুমতি দেয়। কিন্তু মিশরিয় ডেলিগেশনকে বাধা দান করলে গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়। অতঃপর ১৩ জানুয়ারি সাদ জগলুল পাশা হামদ পাশা নামক একজন সদস্যের বাসায় ওয়াফদ পার্টির সাধারণ সভা আহ্বান করেন। এ সভায় সকল সদস্য বলিষ্ঠ কণ্ঠে মিশরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন করার দীপ্ত প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। জগলুল যুক্তি দ্বারা বক্তব্য রাখেন যে মুহাম্মদ আলীর সময় তুরস্কের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে মিশর স্বাধীন ছিল যা ১৮৪০ সালে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ স্বীকার করে। কিন্তু খেদিভের বৈরিতায় মিশর ইঙ্গ-ব্রিটিশদের অধীনতা স্বীকারে বাধ্য হয়। ওয়াফদ পার্টি তাদের দাবি সমর্থনে ১৯১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি গণবিক্ষোভের আয়োজন করলে ব্রিটিশ বাহিনীর জেনারেল ওয়াটসন তা নস্যাৎ করে দেন। ৮ ফেব্রুয়ারি জগলুল তার দাবিতে অটল ছিলেন এবং ১ মার্চ রুশদীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে সুলতান ফুয়াদ (১৯১৭-১৯৩৬) সংবিধান ও জাতীয়তাবিরোধী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন । একদিকে ওয়াফদ পার্টির ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলন, অপরদিকে মিশরের রুশদী সরকারের পতন এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায় ৬ মার্চ জেনারেল ওয়াটসন জগলুল পাশা ও তার সাথীদের সামরিক দপ্তরে ডেকে তাদের সাবধান করে দেন। এ ধরনের অহেতুক নিপীড়ন ও হয়রানিতে জগলুল পাশার নির্বাসনে সুপ্ত বারুদে অগ্নিস্ফুরণের মত প্রতিক্রিয়া হয় । কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে ১৯২১ সালের ৫ এপ্রিল জগলুলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু এলেন বে মিশরে রাজনৈতিক সঙ্কটের আশঙ্কায় জগলুলকে আবারো গ্রেফতার করে প্রথমে এডেন ও পরে সিসিলি দ্বীপে নির্বাসিত করেন ।
সাদ জগলুল পাশার প্রধানমন্ত্রীত্ব : সারওয়াত সরকার ১৯২২ সালে সরকার গঠন করলেও মিশরিয়রা তাদের অভিষ্ঠ লক্ষে পৌঁছতে পারে নি। সারওয়াত পাশা ওয়াফদপন্থীদের প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে সংবাদপত্রে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। সংবিধান প্রণয়নে তিনি ব্যর্থ হন। অসহযোগিতার জন্য বাধ্য হয়ে ১৯২২ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করেন। তার স্থলাভিষিত্ব হন মোহাম্মদ তৌফিক নাসিম পাশা ৷ কিন্তু বৃটিশদের উপর সন্ত্রাসীদের আক্রমণ ও সুদান প্রশ্নে মতবিরোধ হলে তিনি ৩ মাস পরে পদত্যাগ করেন। ব্রিটিশ রেসিডেন্ট অরাজকতা দমনের জন্য সামরিক আইন জোরদার করেন । যে এলেন বে ব্রিটিশ ঘোষণার নেপথ্য নায়ক ছিলেন, তিনি উৎপীড়ন শুরু করলেন এবং ওয়াফদ পার্টির সদর দক্ষতর বন্ধ করে দেন। ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ এক মাস মিশরে কোন সরকার ছিল না। এদিকে মিশরিয় জনগণ এবং মিডিয়া মিশরের এ সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে জগলুল পাশাকে দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে থাকে। ১৯২৩ সালের ১৫ মার্চ উদারপন্থী বিচারক ইয়াহইয়া ইব্রাহীম পাশা সরকারের প্রধান হলে তিনি জগলুল পাশাকে মুক্তির নির্দেশ দেন। জগলুল পাশা ১৯২৩ সালে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয় এবং ১৯২৩ সালের ১৯ এপ্রিল নতুন সংবিধান ঘোষিত হয়। ৩০ এপ্রিল সাধারণ নির্বাচনের আইন অনুমোদিত হয় এবং সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে মিশরে প্রথম নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ১৯২৪ সালের ১২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওয়াফদ পার্টির সদস্যগণ বিপুল ভোটাধিক্যে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তাদের এ বিজয় সাফল্যের জন্য জগলুল পাশার অক্লান্ত ও নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগই দায়ী। ওয়াফদ পার্টি যেখানে ২১৪টি আসন লাভ করে সেখানে উদারপন্থী সংবিধানপন্থীগণ এবং জাতীয় পার্টি মাত্র ২টি করে আসন লাভ করে। ফলে জগলুল পাশার নেতৃত্বে ওয়াফদ পার্টি সরকার গঠনের সুযোগ পায়। জগলুল পাশা প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। ১৯২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রথম ওয়াফদ সরকার গঠিত হয়। ১৫ মার্চ রাজা ফুয়াদ সংসদের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন ।
১৯২৪ সালে জগলুল পাশা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ওয়াফদ সরকার গঠন করেন। তিনি ছিলেন মিশরের সর্বজন স্বীকৃত নেতা। তার সহকর্মী আহম্মদ শফি তাকে বলতেন, “জায়েম-আল উম্মা” ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় বীর'। তিনি ক্ষমতা লাভ করেই মিশরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেষ্টা করেন । তার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিতনীতি ছিল “ইশতি- কলাল আল-তাম” বা “পূর্ণ স্বাধীনতা” । এ লক্ষ্যে পৌছবার জন্য তিনি সংসদের মোট ২১৪ টি আসনের মধ্যে ১৯৫টি লাভ করে সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণ করেন এবং মাত্র ৯ জন তথাকথিত বিরোধী গ্রুপকে বিশেষ গ্রাহ্য করেন নি । সংসদে স্বীয় ক্ষমতা ও প্রভাব সুদৃঢ় করে জগলুল বৃটিশ সেনা বাহিনীর অপসারণ দাবি করেন। কারণ দখলদার বাহিনীর অবস্থান সার্বভৌমত্বের হানিকর। উপরন্তু ‘Reserved point’ বা সংরক্ষিত পয়েন্টে উল্লোসিত সুদান প্রশ্নে ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথেও জগলুল একমত ছিলেন না। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে সমস্যার সমাধান করতে চান । কিন্তু বৃটিশ সরকারের অনমনীয় মনোভাবের জন্য আলাপ আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অতঃপর ১৯২৪ সালের জুন মাসে পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, মিশর সরকার মিশরে অবস্থানরত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বহন করবে না এবং সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ লীগ অব নেশনস এর উপর অর্পিত হবে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও রাজনৈতিক জটিলতার জন্য তা কার্যকরী হয় নি। যাহোক, ১৯২৮ সালের নভেম্বরে মিশরের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান কায়রোতে আততায়ীর হাতে নিহত হলে জগলুল পাশার সরকার মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয় । ব্রিটেনের টোরী সরকার এ হত্যাকান্ডের জন্য জগলুল সরকারের নিকট চরমপত্র প্রেরণ করে ক্ষতিপূরণ সহ অন্যান্য দাবি পেশ করে। দাবিগুলি ছিল-(এ) পূর্বের মত ব্রিটিশ কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। (বি) সুদান থেকে সব মিশরিয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। (সি) নীল নদের পানি দিয়ে সুদানের সেচ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। হত্যার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জগলুল পাশা ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০০০০০ লক্ষ পাউন্ড স্টার্লিং প্রদানে সম্মত হলেও অপর তিনটি ঘৃণ্য শর্ত মানতে রাজী হলেন না। ফলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া কাস্টমস হাউজ দখল করে জগলুলকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। ১৯২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস ওয়াফদ সরকার বলবৎ ছিল। সিনেটের প্রথম প্রেসিডেন্ট আহমদ জিওর পাশা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলে তিনি ব্রিটিশ কর্তৃক আরোপিত সকল শর্ত মেনে নেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের বিধিমালা এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যাতে ১৯২৫ সালে পরবর্তী নির্বাচনে ‘ওয়াফদ' পার্টি' যোগদান করতে না পারে ।
প্রেসিডেন্ট পদে সাদ জগলুল পাশা ১৯২৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লিবারাল, জাতীয়তাবাদী, ইত্তেহাদী, ওয়াফদ পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সম্মিলিতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল সংখ্যক ভোটে পুনরায় বিজয়ী হয়। মোট ২১৪ টি আসনের মধ্যে ১১৬টি আসন তারা লাভ করে। নবগঠিত পার্লামেন্টে জগলুল পাশা নির্বাচিত হয়ে আবারো তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেন। তিনি মিশরের প্রেসিডেন্টের মর্যাদা লাভ করেন । এবং তিনটি দল থেকে (জাতীয়তাবাদী, ওয়াফদ ও লিবারাল) ৩ জনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেন। জগলুল পাশার ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ সরকার সনুজরে দেখে নি। তারা শঙ্কিত হয়ে লর্ড এলেন বের স্থলে নিযুক্ত নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার লর্ড লয়েড আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি যুদ্ধ জাহাজ নোঙ্গর করার নির্দেশ দেন। সাদ জগলুল পাশা বার্ধক্যজনিত কারণে সরকারি দায়িত্ব লিবারেল পার্টির নেতা আদলী পাশার উপর ন্যাস্ত করেন। সক্রিয় অংশগ্রহণে ব্যর্থ হলেও জগলুল মিশরের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃত ছিলেন এবং তারই অসামান্য ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবের ফলেই মিশর স্বাধীনতা লাভ করে। তিনি ১৯২৭ সালের আগস্ট মাসে মৃত্যুবরণ করেন। এরই মধ্য দিয়ে সাদ জগলুল পাশার মত একজন কিংবদন্তীকে হারায় মিশর এবং এক বর্ণাঢ্য ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।
(খ) ওয়াফদ পার্টি : ১৯১৯ সালের ১৮ই জানুয়ারী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এ চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে ‘ওয়াফদ পার্টি' তাদের দাবী উপস্থাপনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১২ জানুয়ারি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিরিয় ডেলিগেশনকে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে যোগদানের অনুমতি দেয়। কিন্তু মিশরিয় ডেলিগেশনকে বাধা দান করলে তীব্র গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়। অতঃপর ১৩ জানুয়ারি জগলুল পাশা হামদ পাশা নামক একজন সদস্যের বাসায় ‘ওয়াফদ পার্টির' সাধারণ সভা আহ্বান করেন। এ সভায় সকল সদস্য বলিষ্ঠ কণ্ঠে মিশরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন করার দীপ্ত প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। ওয়াফদ পার্টি তাদের দাবির সমর্থনে ১৯১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি বিক্ষোভ করে। এহেন বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হয়ে সামরিক শাসকবর্গ ওয়াফদ পার্টির কার্যকলাপ বন্ধের জন্য জগলুল পাশা সহ কতিপয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে ৮ মার্চ মাল্টায় নির্বাসিত করে। জগলুলের নির্বাসনের প্রতিবাদে ওয়াফদ পার্টি সহিংস আন্দোলন শুরু করে । জগলুলের অবর্তমানে আলী পাশা সাবায়ী ওয়াফদ পার্টির নেতৃত্ব দেন । সারাদেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে ১৯১৯ সালের ৭ এপ্রিল জগলুলকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু এলেন বে ওয়াফদ পার্টির সন্ত্রাসী সদস্যদের আন্দোলনে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কায় জগলুলকে গ্রেফতার করে প্রথমে এডেন এবং পরে সিসিলি দ্বীপে নির্বাসিত করেন। ওয়াফদ পার্টির তীব্র আন্দোলনের চাপে সঙ্কটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯২৩ সালের ১৫ মার্চ উদারপন্থী বিচারক ইয়াহইয়া সরকার প্রধান হলে তিনি জগলুল পাশাকে মুক্তির নির্দেশ দেন। জগলুল পাশা ১৯২৩ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯২৪ সালের ১২ জানুয়ারির নির্বাচনে জননেতা জগলুলের নেতৃত্বে ওয়াফদ পার্টি বিপুল বিজয় অর্জন করেন । জগলুল পাশার নেতৃত্বে ওয়াফদ পার্টি সরকার গঠন করে। ১৯২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রথম ওয়াফদ সরকার গঠিত হয়। জগলুল পাশা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে ওয়াফদ পার্টির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট নির্বাচনে বিজয়ী হয়। জগলুল পাশা ওয়াফদ পার্টি থেকে আবারো নির্বাচিত হন। এবার তিনি মিশরের প্রেসিডেন্টের পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯২৭ সালে ওয়াফদ পার্টির এ শীর্ষনেতা মৃত্যুবরণ করেন। জগলুলের মৃত্যুর পর মোস্তফা নাহাদ পাশা ওয়াফদ পার্টর নেতৃত্বে আসেন। সর্বোপরি, ওয়াফদ পার্টি সম্পর্কে দুজন ফরাসি গ্রন্থাগারের বক্তব্য তুলে ধরা যায়। Jean and Simone lacouture বলেন, “The affad was the expression of the entire people of which in the fullest sense it was the delegate. Any attempt at defining it would involve a com- plete description of Egypt. It contained all the generosity. intellectual mood, good nature, contradictions and megalomania of the millions of supporters.”
পরিশেষে বলা যায় যে, জনপ্রিয় ওয়াফদ পার্টি মিশরের জাতীয়তাবাদী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ দল মিশরিয় গণ আন্দোলন ও জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানে আরোহণ করে। সুতরাং, ওয়াফদ পার্টি মিশরে রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]