রেজা শাহের সংস্কারসমূহ সংস্কারসমূহ ইরানের আধুনিকীকরণের নায়ক রেজা খান

রেজা শাহের পরিচিতি : রেজা শাহের পূর্ব নাম রেজা খান। পাহলভী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রেজা খান ১৮৭৮ সালের ১৬ মার্চ ইরানের মাজেন্দ্রেরান প্রদেশের সাভাদকুহ জেলার আলাশত নামে একটি ক্ষুদ্র ও অখ্যাত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এ গ্রামটি কাম্পিয়ান সাগরের খুব কাছেই অবস্থিত। তার পিতা মেজর আব্বাস আলি খান এবং পিতামহ ক্যাপ্টেন মুরাদ আলি ইরানি সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য ছিলেন। মাত্র ৪০ দিনের শিশু রেজা খান তার পিতাকে হারান। আলাশত- এর তীব্র শীত থেকে নবজাত শিশুকে রক্ষার জন্য তার মাতা তাকে নিয়ে তেহরানে চলে আসেন। রেজা খান কাজারদের মত তুর্কি বংশোদ্ভূত ছিলেন না। তার ধমনিতে প্রকৃত ইরানি রক্ত প্রবাহিত ছিল। শৈশব থেকেই তার প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। বাল্যকাল থেকে তিনি শরিয়তের বিধি অনুযায়ী চলতেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে রেজা খান কশাক বিগ্রেডে যোগদান করেন। রেজা খানের পুত্র মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর মতে, তার পিতা নিরক্ষর ছিলেন। কারণ ইরানে সে সময়ে শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল কেবলমাত্র বিত্তশালী এবং মোল্লা শ্রেণির। কিন্তু, মেধা, দক্ষতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার দরুন রেজা খান শীর্ঘই একজন সামান্য সৈনিক থেকে কশাক বিগ্রেডের অধিনায়ক পদে উন্নীত হন। ইরানের কশাক বিগ্রেডে রুশ সেনাপতিদের অসামান্য প্রতাপ ছিল। কিন্তু রেজা খানের দেশপ্রেম ও কর্মদক্ষতায় ইরানি সৈন্যরা আকৃষ্ট হয় । ক্রমশ তিনি প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। ইরানের চরম রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সংকটে তিনি ব্যথিত হন । কশাক বিগ্রেডে রুশ সৈন্যদের প্রতিপত্তিতে তিনি বিক্ষুব্ধ হন । ১৯২০ সালের আগস্টে তিনি কশাক বিগ্রেডের রুশ অফিসারদের অপসারণ করে
সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইরানি বাহিনী নিয়ে তিনি রাশিয়ার অগ্রগতিতে কঠোর প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। ইরানকে বৈদেশিক শক্তির প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস পান রেজা খান। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক বানানি বলেন, “Reza Khan was tall, broad shouldered possessed a natural air of authority. He was strong willed and impa- tient, quicktempered and uncouth but he had to perfection the politi- cian's talent for opportunity."
কশাক ব্রিগেডের সর্বাধিনায়কের পদ থেকে রাষ্ট্রীয় প্রধানের ক্ষমতা লাভে রেজা খান অসামান্য দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেন। তিনি রাজার বংশের অধঃপতন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, রুশবাহিনীর স্বেচ্ছাচার, বৈদেশিক প্রভাবে জর্জরিত ইরানকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে তার সহকর্মী মেধাবী সাংবাদিক সাঈদ জিয়া উদ্দিন তাবে-তাবাইয়ের সহযোগিতায় ভগ্নপ্রায় ইরানী রাজনৈতিক কাঠামোকে ধুলিসাৎ করে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করার প্রয়াস পান। ইরানের চরম রাজনৈতিক সংকটে কশাক বিগ্রেডের এ সেনাপতি তার সৈন্যদল নিয়ে তাব্রিজ থেকে তেহরানে এসে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত এ ‘ক্যু-দে-তার' নায়ক ছিলেন রেজা খান। সাঈদ জিয়া প্রধানমন্ত্রী এবং রেজাখান যুদ্ধমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। ১৯২১ সালের জুন মাসে চতুর্থবারের মত পার্লামেন্টের সভা আহ্বান করা হয়। সাঈদ জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেও ‘সর্দার সিপাই’ বা সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে রেজা খান সকল ক্ষমতার অধিকারী হন ।
রেজা খান ইরানকে বৈদেশিক প্রভাব বলয় থেকে রক্ষার জন্য ১৯২১ সালে স্বাক্ষরিত ইঙ্গ-পারস্য চুক্তি এবং ১৯২১ সালে সম্পাদিত ‘রুশ-পারস্য' সন্ধি বাতিল ঘোষণা করেন। তিনি কঠোর হাতে ইরানের সকল বিদ্রোহ দমন করেন। সামরিক বাহিনীর সর্বময় কর্তা হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯২৩ সালের অক্টোবরে ইরানের শাহ আহমদ শাহ চৌকস রেজা খানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে ইউরোপে চলে যান ।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা লাভ করে রেজা খান স্বীয় প্রভাব ও কর্মদক্ষতাকে সুদূরপ্রসারী করতে থাকেন। তিনি তুরস্কে কামাল পাশা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের মত পারস্য প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। ১৯২৪ সালের পার্লামেন্টের সভায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রেজা খান মন্ত্রিবর্গের সমর্থন লাভ করেন । কিন্তু জাতীয়তাবাদী ও মোল্লা শ্রেণী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় ও বিক্ষোভ শুরু করে। তুরস্কের মহানায়ক কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক খিলাফতের অবসানে মুসলিম জাহানে মোল্লাশ্রেণীর ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে এ আশঙ্কায় তারা রেজা খানের সাংবিধানিক সংস্কারে বাধা দেয়। তার বিরুদ্ধে অপ্রপ্রচার করা হয় যে, তিনি একজন ‘বাবি' এবং ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য এ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। মোল্লাপন্থি শিয়া সম্প্রদায়ের সহানুভূতি লাভের জন্য তিনি মহরমের মিছিলে যোগদান এবং কুম, নজফ ও কারবালার পবিত্র শিয়া ইমামদের স্থানগুলো জিয়ারত করেন। কিন্তু ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মোল্লা শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান বিরোধীতায় তিনি অবশেষে প্রজাতন্ত্রের স্থলে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন । এর ফলে ইরানে নতুন রাজশক্তির আবির্ভাব হয়, মসলিশ-আস-শুরা পরপর তিনটি আইন জারী করেন। ১৯২৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রেজা খানকে সর্দার সিপাই এবং সংবিধান অনুযায়ী সমগ্র ইরানের প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা দেয়া হয় ।
৩১ অক্টোবর মসলিশ কাজার রাজবংশের বিলুপ্তি ঘোষণা করে এবং সকল ক্ষমতা রেজা শাহের উপর অর্পিত হয়। ফলে পাহলভী বংশের আবির্ভাব হয়। উল্লেখ্য যে, কাজার বংশের উৎপত্তি হয় তুকি গোত্র থেকে। কিন্তু পাহলভী ইরানি (মাজেন্দ্রান) বংশোদ্ভূত। অবশেষে ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে রেজা খানকে জাতীয় সভায় ইরানের শাহনশাহ বলে ঘোষণা করা হয় এবং এ বংশ বংশানুক্রমিক রাজবংশের রূপ গ্রহণ করে। ১৯২৫ সালে রেজা খান রেজা শাহ পাহলভী নামে ইরানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ।
রেজা শাহের সংস্কারসমূহ : রেজা শাহ ইরানে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন ৷ শাসক হিসেবে রেজা শাহ তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যে কোন শাসকের চেয়ে একটি ব্যতিক্রমী দায়িত্ব পালন করেন। তার সুদীর্ঘ ২০ বছর শাসনামলে তিনি গোটা দেশের জনজীবনে যতখানি মুখ্য ভূমিকার অধিকারী হয়েছিলেন সম্ভবত আর কোন প্রধান নির্বাহী তা করতে পারেন নি ।
অব্যাহতভাবে বিদেশি শোষণ এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের আধিপত্যের কারণে ঐতিহ্যবাহী পারস্য একটি পশ্চাদপদ জনপদে পরিণত হয়েছিল। ফলে স্বভাবতই ইরানের সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে উঠে। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে রেজা শাহ ব্যাপক সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে ইরানের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। যদিও ১৯২৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর রেজা সিংহাসনারোহণের মাধ্যমে ইরানের পাহলভী রাজবংশের শাসনের সূত্রপাত ঘটে, তথাপি একথা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ১৯২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই রেজা শাহ ক্ষমতার মূল কেন্দ্ৰবিন্দুতে চলে আসেন। এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করতে থাকেন। তাই ইরানে রেজা শাহ কর্তৃক সম্পাদিত সংস্কারসমূহের ধারাবাহিক ও পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে হলে ১৯২১ সাল থেকেই আলোচনার সূত্রপাত করতে হয়। প্রধানত ৩টি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রেজা শাহ তার সংস্কার কার্য সম্পাদন করেন। (এ) ইরানকে বিদেশি প্রভাব হতে মুক্ত করা;
(বি) অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং (সি) পাশ্চাত্যের অনুকরণে ইরানের আধুনিকায়ন। রেজা শাহ পালহলভীর সংস্কারসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. সামরিক সংস্কার : ইরানকে বৈদেশিক শক্তির প্রভাব ও তাদের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইরানকে যে কী অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে নিপতিত করেছিল সে সম্পর্কে রেজা শাহ অবহিত ছিলেন। তাই ক্ষমতারোহণের শুরু হতেই দেশকে বৈদেশিক প্রভাব মুক্ত করার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। এজন্য একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রয়োজন একথা তিনি ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এছাড়া সেনাবাহিনীর লোক হিসেবে তার ক্ষমতার উৎসই ছিল সেনাবাহিনী । এ দৃষ্টিকোণ থেকেও তিনি সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন। শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনের জন্য তিনি বিভিন্ন প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি কসাক বাহিনী বিলুপ্ত করে পরিপূর্ণভাবে ইরানীদের দ্বারা নিজস্ব জাতীয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এ বাহিনীর সর্বোচ্চ পদগুলি ছিল রুশ সেনাবাহিনীর সামরিক অফিসারদের জন্য সুরক্ষিত। স্বভাবতই এ বাহিনী ছিল রুশ প্রভাবিত এবং ইরানে রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষায় শুরু থেকেই এ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। রেজা খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে এ বাহিনী বিলুপ্ত করে দেন। তিনি প্রাদেশিক অনিয়মিত সেনাবাহিনীও তুলে দেন এবং অভিজাতদের সেনাবাহিনী রাখার প্রথাটি বিলুপ্ত করে দেন। ১৯২৫ সালের ৬ জুন একটি আইন পাস করে তিনি ২১-২৫ বছর বয়সী প্রত্যেকটি ইরানি যুবককে সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করেন। সেনাবাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেশে-বিদেশে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ১৯২৮ সালে প্রথমবারের মত ইরানি পাইলট দলকে প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানিতে পাঠানো হয়। রাশিয়া ও ব্রিটেন হতে বিমান ক্রয় করে ১৯২৪ সালে তিনি ইরানি বিমান বাহিনী গঠন করেন। আর ১৯২৭ সালে পারস্য উপসাগরে দুটি ডেস্ট্রয়ার এবং ৪টি গান বোট নিয়ে ইরানি নৌবাহিনী গঠিত হয়। মোটকথা প্রতিরক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে তিনি কোনরূপ কার্পণ্য করেন নি। ১৯২১-৪১ সাল পর্যন্ত তিনি মোট রাজস্বের ৩৩.৫% সামরিক খাতে ব্যয় করেন। সেনাবাহিনীর জন্য অর্থ বরাদ্দের এ বাড়াবাড়িতে আপত্তি করায় তিনি মার্কিন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. আর্থার চেস্টার মিলঘপকে পদচ্যুত করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেন নি। সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য রেজা শাহের এসব পদক্ষেপের ফলে পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোর তুলনায় সামরিক শক্তিতে ইরান যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠে। ১৯২১ সালের ইরানের সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২২০০০। ১৯২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০,০০০-এ। আর ১৯৪১ সালে তা হয় ১,২৭,০০০-এরও বেশি। তবে এ বাহিনী ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে মিত্রশক্তির সেনাবাহিনীর ইরানের প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে নি। এ প্রসঙ্গে আমিন বানানি যথার্থই বলেন, “The heavy investment of money, man-power, time and resources at the expense of other vital needs, may be considered an error of Judgment. In the atmosphere of intense nationalism that had been created, however such error was well-nigh unavoidable."
২. প্রশাসনিক সংস্কার : কাজার বংশের রাজত্বকালে ইরানে সুষ্ঠু প্ৰশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় নি। কেন্দ্রীয় শাসন অথবা সরকার ছিল না। সরকারি কর্মচারিগণ ছিল অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ন। মন্ত্রীপরিষদ ছিল এবং কখনও কখনও বৈদেশিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা হত। কিন্তু রেজা শাহ ক্ষমতা লাভ করে সর্বপ্রথম সমগ্র ইরানকে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ত্তাধীনে আনেন । তার আমলে সরকার একনায়কত্বের রূপ গ্রহণ করলেও মজলিশের গণতান্ত্রিক সংবিধান মোতাবেক তিনি কতিপয় সংস্কার সাধন করেন। ১৯২২ সালের ১২ ডিসেম্বর মজলিশ “সিভিল সার্ভিস” আইন জারী করেন এবং এর ফলে আমলাতন্ত্ৰ প্রবর্তিত হয়। পাশ্চাত্য রীতির অনুকরণে ইরানিদের প্রশাসনিক কার্যে নিয়োগ করা হয়। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং বরখাস্ত করার অধিকার সরকারের উপর ন্যস্ত হয়। প্রশাসনের সুবিধার জন্য সমগ্র দেশকে কাজারদের সময় ৪টি ‘আয়ালাত’ বা ভৌগোলিক সীমারেখায় ভাগ করেন এবং আয়ালাতগুলিকে কয়েকটি ভিলায়াত-এ ভাগ করা হয়। কিন্তু এতে প্রশাসনিক নৈরাজ্য দেখা দিলে এ ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে ১৯৩৮ সালে ১০টি ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিতে এবং ওস্তানগুলিকে কয়েকটি শাহরেস্তান-এ ভাগ করা হয়। প্রশাসনের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য শাহরেস্তানগুলিকে আবার ‘বাক্স' এ বিভক্ত করা হয়। প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ যেমন-মেয়র, পুলিশ অফিসার ইত্যাদি কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত করত। ১৯২২ সালে একজন অভিজ্ঞ মার্কিন অর্থনীতিবিদকে সুষ্ঠু ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজেট প্রণয়নের জন্য নিযুক্ত করা হয়। এমনকি শহর নির্মাণের জন্য তেহরান মিউনিসিপ্যালিটি একজন বিশিষ্ট মার্কিন নগর পরিকল্পনাকারীকে নিয়োগ করেন ।
ইরানের আধুনিকীকরণের নায়ক রেজা খান প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শুধু আমূল পরিবর্তন সাধনই করেন নি, তার কতিপয় বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ইরানের জাতীয় স্বার্থও সংরক্ষিত হয়। ১৯২৬ সালের এপ্রিলে তুরস্কের সাথে পারস্যের সীমানা সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। এমনকি তিনি তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের সাথে সাক্ষাত করতে যান। কামালের সংস্কার আন্দোলনে তিনি অনুপ্রাণিত হন এবং জাতীয়তাবাদী স্বার্থরক্ষার্থে ব্রিটিশ প্রভাব হ্রাস করার জন্য ১৯২৮ সালের ইঙ্গ-পারস্য চুক্তি বাতিল করেন। পারস্য উপসাগরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রেজা শাহ স্বয়ং গ্রহণ করেন । ১৯৩১ সাল থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় টেলিগ্রাফ কোম্পানি যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করছিল তা বাতিল ঘোষিত হয়। ১৯০১ সালে D' Archy-কে তেল উৎপাদনের জন্য যে সুযোগ সুবিধা ও দায়িত্ব দেয়া হয় তা পরবর্তীকালে ইঙ্গ-পারস্য তেল কোম্পানির উপর অর্পিত হয়। রেজা শাহ ১৯৩২ সালে এ সুযোগ সুবিধা বাতিল করে দেন। অবশ্য কোম্পানী লীগ অব নেশনস-বিষয়টি উপস্থাপন করলে কোম্পানিকে আরো ছয় বছরের কনসেশন বৃদ্ধি করা হয়। তবে তাদের প্রভাব ও কার্যক্রম হ্রাস করা হয়। ব্যয় হ্রাস করে একটি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কায়েম করা হয়। বিদেশি ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা এবং ভূ-স্বামীদের সুযোগ-সুবিধাও রহিত করা হয়।
৩. বিচার ব্যবস্থার সংস্কার : রেজা শাহ বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। ইরানের আধুনিকীকীকরণে তিনি পাশ্চাত্য রাজনীতি, আইন-কানুন ও প্রথা ব্যবস্থা চালু করেন। সংস্কার আন্দোলনে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। লক্ষণীয় যে, আইন ও বিচার ব্যবস্থার মত অপর কোন ক্ষেত্রে প্রাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব প্রকট ছিল না। পাহলভি রাজত্বের পূর্বে যদিও দুটি পৃথক বিচার ব্যবস্থা ছিল। যেমন-শরিয়া অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষও সাধারণ, সিভিল আইন সংক্রান্ত এবং উরফ বা রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবস্থার প্রচলন বিশেষভাবে ছিল না। কেবলমাত্র ‘দিওয়ানখানা-ই আদলিয়া বা বিচারালয় প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু কার্যকর ছিল না। অপরদিকে শারিয়া ব্যবস্থা ছিল মূলতঃ প্রধান। ১৯০৭ সালে সিভিল কোর্ট প্রতিষ্ঠা, ১৯১০ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ এবং ১৯১১ সালে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিচার ব্যবস্থার বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয় নি । এর মূল কারণ শরিয়া কোর্টের প্রাধান্য। রেজা খান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে খ্রিস্টানদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদত্ত ঘৃণ্য capitulation ব্যবস্থা বাতিল এবং সিভিল আইন প্রবর্তন করেন। ১৯২৪-১৯২৬ সালে বাণিজ্যিক ও শাস্তিমূলক আইন প্রবর্তিত হয়। শরিয়া কোর্টের প্রাধান্য খর্ব করে সিভিল কোর্ট স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব বিচার মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়। মজলিশের মাধ্যমে ১৯২৮-১৯৩০ সালের মধ্যে কতিপয় আইন পাশ করা হয়। এতে পাশ্চাত্য আইনের প্রতিফলন বিশেষভাবে দেখা যায়। কমিউনিস্টদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিরসনের জন্য ১৯৩১ সালে রেজা খান সংবাদপত্রের বিধি এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে-কঠোর আইন প্রবর্তন করেন ।
বিচার ব্যবস্থার সংস্কারে রেজা শাহ ১৯৩২ সালে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্ৰহণ করেন। তিনি পূর্ববর্তী শরিয়া কোর্টের সকল প্রকার জমিজমা রেজিস্ট্রির অধিকার সিভিল কোর্টে স্থানান্তর করেন। এর ফলে শুধু শরিয়া কোর্টের ক্ষমতাই সীমিত হয় নি। মোল্লা শ্রেণির প্রভাবও হ্রাস পায়। মোল্লা শ্রেণি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে লব্দ আয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। নতুন আইন প্রবর্তনের ফলে তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং তাদের অনেককে আলখাল্লা ছেড়ে সরকারি অথবা সাধারণ চাকরি গ্রহণ করতে হয়। ১৯৩৬ সালে চূড়ান্তভাবে ইরানের বিচার ব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ ও পাশ্চাত্যকরণ করা হয়। আকস্মিক এ পরিবর্তনের ফলে বিচারব্যবস্থা পরিচালনার জন্য উপযুক্ত বিচারক ও আইনজ্ঞ পাওয়া যায় নি। এর ফলে একদিকে যেমন মোল্লা শ্রেণির বিরোধিতা শুরু হয়। অপরদিকে বিচার ব্যবস্থায় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। পাশ্চাত্যকরণের পটভূমি বিচার করলে দেখা যায় যে, ইরানের মত অনুন্নত এবং গোড়া শিয়া মতাবলম্বীদের-দ্বারা পরিচালিত শারিয়া আইনের সীমাবদ্ধতায় ইউরোপীয় অধ্যাপক ও উপদেষ্টাদের অবদান যথেষ্ট ছিল । ক্রমশ শারিয়া কোর্টের কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ করা হয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমোদন ছাড়া শরিয়া কোর্টে কোন বিচার করা যেত না। তাদের শুধু বিয়ে সংক্রান্ত বিচার এবং জমিজমার ট্রাস্টি নিয়োগের অধিকার দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আমিন বানানি বলেন, “Despite the striking changes of the Reza Shah period, it would be erroneous to assure that the time honoured concepts of the Shariah, which were at the heart of Iranian society and culture were disregarded and replaced all together. রেজা শাহ তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের নারী জাগরণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরদানশিন অবহেলিত ও অশিক্ষিত ইরানি নারীদের ঘৃণ্য সামাজিক কুসংস্কার ও অনাচার থেকে মুক্তিদানের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বৈবাহিক আইন পাস করে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। শরিয়া আইন প্রসঙ্গে বলা যায় যে, Nowhere did the hold of the Shariah concepts prove more lasting than in laws pertaining to marriage, divorce, family relation and crimes against morality. রেজা শাহের সময় বৈবাহিক আইন একটি সামাজিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ আইন হলেও মূলত বিয়ে সংক্রান্ত সকল বিরোধ শরিয়া মোতাবেক নিষ্পত্তি করা হত । ১৯৩১ সালে প্রবর্তিত বিয়ে আইনে প্রত্যেক বিয়েতে রেজিস্ট্রিকরণ না হলে আইনসঙ্গত হবে না ৷ তালাকের ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই সমান অধিকার ছিল। বিবাহ আইনে পুরুষের বয়স সর্বনিম্ন ১৮ এবং মহিলার ১৬ বছর নির্ধারণ করা হয়। তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষনের অর্থলাভ করার অধিকার অর্জন করে। উত্তরাধিকার আইন ও নাবালকের অভিভাবকত্ব আইন দ্বারা স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদর ভবিষ্যত নিশ্চিত করা হয়। বিয়ে আইন, সিভিল কোড ইত্যাদি প্রবর্তনের ফলে ইরানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু এ পরিবর্তন শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। রেজা শাহের সংস্কার আন্দোলন গ্রামের অতি প্রাচীন ধ্যান-ধারণা ও রীতিনীতির পরিবর্তন সাধনে ব্যর্থ হয়। পর্দা প্রথার উচ্ছেদ নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু এটা গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় নি। অবশ্য তুরস্কের নারী জাগরণে অনুপ্রাণিত হয়ে রেজা শাহ ইরানি তালাকপ্রাপ্ত মহিলাদের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেন। সরকারি অফিসে চাকরি, উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষার জন্য বৃত্তি, অবাধ চলাফেরা ও পর্দা প্রথার অবসান এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ।
৪. জনস্বাস্থ্য : রেজা শাহ চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সংস্কার সাধন করেন। চিকিৎসা ব্যবস্থার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ইরানে সম্ভব হয় নি। জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে রেজা শাহ বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আমেরিকান ও ইউরোপিয় মিশনারিজ প্রতিষ্ঠানসমূহ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সামান্য অবদান রাখলেও তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন নি। অবশ্য তারাই প্রথম ১৮৩০ সালে ইরানের বিভিন্ন শহরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০৭ সালে একটি আইন জারি করে প্রাদেশিক সরকারকে জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য চিকিৎসার উপর বিশেষ নজর দিতে বলা হয়। উপদ্রুত ও মহামারির প্রকোপ বিধ্বস্ত এলাকায় ডাক্তার সেবিকা ও ঔষধপত্র প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯১০ সালে সর্বপ্রথম ইরানে টিকাদান ব্যবস্থা চালু হয়। ডাক্তারদের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপর বিশেষ নজর দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পাহলভি বংশ প্রতিষ্ঠার পূর্বে চিকিৎসা ব্যবস্থা অজ্ঞতা ও মোল্লাদের বিরোধীতার জন্য বিশেষভাবে কার্যকর হয় নি। রেজা খান ক্ষমতা লাভ করে জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে প্যারিসের লুই পাস্তুর ইনস্টিটিউটের মত তেহরানে একটি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯২৩ সালে ডাক্তার জোসেফ মেসনার্ডকে এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ১৯২৭-১৯৩০ সালের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনুযায়ি চিকিৎসা ব্যবস্থায় উৎসাহিত করার জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়। মোল্লাদের চরম বিরোধীতার জন্য ১৯১৫ সাল পর্যন্ত শবব্যবচ্ছেদের কোন প্রথা ছিল না। কিন্তু শারীরিক গঠন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভের জন্য এর প্রয়োজন ছিল। এ কারণে ইরান সরকার ১৯৩০ সালের মধ্যে শবব্যবচ্ছেদের রীতি প্রবর্তন করেন। রেজা শাহের ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে ইরানে ১৯৩৫ সালের মধ্যে প্রতি ৪ হাজার লোকের জন্য একজন ডাক্তার তৈরি হয়ে যায় । সংক্রামক ব্যাধি দূর করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে সজাগ দৃষ্টি রাখে। ১৯৪০ সালে সৃষ্ট এ মন্ত্রণালয় একজন অভিজ্ঞ মন্ত্রীর দায়িত্বে ন্যস্ত ছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রেলওয়ে, খনিজ ও শিল্প বিভাগে নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল। কেবলমাত্র তেহরানেই নয়, ইরানের সর্বত্র সুসজ্জিত হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। যেমন মেসহেদ এ রেজা শাহ হাসপাতাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইরানি চিকিৎসকরা জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। আমেরিকান-পোলিশ, জার্মান ও ফরাসি চিকিৎসকদের নিয়োগ দ্বারা চিকিৎসা বিদ্যার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় । পাহলভি রাজত্বে ইরানের চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি পরিলক্ষিত হলেও অনুন্নত ও অশিক্ষিত ইরানি জনগণ পাশ্চাত্যে প্রবর্তিত চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিল না। ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান থেকে যায় ।
৫. শিক্ষা সংস্কার : রেজা শাহ শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পাহলভি রাজত্বের পূর্বে ইরানের ঘুনে ধরা শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির চেতনাবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তির উদ্রেক করতে পারে নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইরানে শিক্ষা জ্ঞান সাধনার সহায়ক ছিল না। শিক্ষা প্রধানত উচ্চ ও রাজবংশীয় শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সুদীর্ঘকাল ধরে ইরানে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধঃপতন ঘটে। এর ফলস্বরূপ শিক্ষা ব্যবস্থা মোল্লাশ্রেণির একচেটিয়া দায়িত্ব রূপে পরিগণিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বলতে কেবলমাত্র মক্তবকে বোঝাত এবং ধর্মীয় শ্রেণীভুক্ত আকন্দ শিক্ষা দান করতেন। তার কোন যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হত না এবং সরকারি অনুমোদন ছাড়া ইচ্ছামত যেকোন স্থানে মক্তব খুলে শিক্ষাদানের অধিকার ছিল। পাঠ্য বিষয় ও মক্তব্যের ফি নির্ধারিত না থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থা একটি লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয় এবং এ সুবিধা ভোগ করতে থাকে মোল্লা শ্রেণিভুক্ত শিক্ষকেরা। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও ভাগ্যহত পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার বিশেষ সুযোগ ছিল না। পর্দানশিন বালিকাদের মক্তবে পড়াশুনা নিষিদ্ধ ছিল। উল্লেখ্য যে, আধুনিক বিষয়বস্তুর স্থলে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইরানের প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ানো হত শিয়া ধর্ম, কবিতা, পারস্য আরবি ডিকশেনারি বা নিসাব ব্যাকরণ, কোরান ও হাদিস। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্পাদিত হত। কোন সরকারি শিক্ষানীতি চালু ছিল না। এছাড়া কুম, ইস্পাহান ইত্যাদি স্থানে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল এবং এসব সেমিনার থেকে মোল্লারা প্রশিক্ষণ লাভ করত ।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে ইরানে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার হতে থাকে। এ পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা পালন করে ইরানে স্থাপিত বিভিন্ন বিদেশি মিশনারি প্রতিষ্ঠান। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ১৯২৯ সালে এসব মিশনারি স্কুলের সংখ্যা দাড়ায় ৫০। কেবলমাত্র ৫টি মিশনারি স্কুল তেহরানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫১ সালে ইরানে প্রথম পাশ্চাত্য ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয় । ‘দারুল ফুলুন' বা বিজ্ঞান ভবন নাসির উদ্দিন শাহের রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া সামরিক একাডেমী ও পৌরনীতির স্কুলও চালু করা হয়। ১৮৯৮ সালে সর্বপ্রথম একটি সুসংহত শিক্ষা নীতি প্রবর্তনের জন্য ‘জাতীয় স্কুল কাউন্সিল' গঠিত হয়। এর ফলে ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব স্কুলে আরবি, ফার্সি ও গণিত শেখানো হত । ১৯১০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। রেজা শাহ ক্ষমতা লাভ করে শিক্ষাকে সর্বস্তরে বিস্তার করে নবজাগরণের প্রয়াস পান। ১৯২১ সালে একটি অধ্যাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে 'High council of education' গঠিত হয়। দীর্ঘ ১২ বছর ব্যাপী একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। "Text Book' প্রণয়নের ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন স্তরের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়। পুরাতন ও ধর্মীয় বিষয়বস্তুর সাথে সমন্বয় করে ভূগোল,
ইতিহাস, শরীর চর্চা, শিল্পকলা ইত্যাদি বিষয় প্রবর্তিত হয়। ৬ বছর ব্যাপী মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ফরাসি Lycee এর উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়। এ পর্যায়ে বিজ্ঞান, বৈদেশিক ভাষা, পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন ও বীজগণিত ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হত । শিক্ষকদের শিক্ষাদান, পাঠ্য বই প্রণয়ন, নতুন নতুন স্কুল স্থাপন এবং শিক্ষা ও প্রশাসনের সমন্বয় সাধন দ্বারা ইরানে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষকদের ইউরোপ ও আমেরিকায় পাঠানো হয়। এছাড়া তেহরানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ স্থাপন করা হয়। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এ ধরনের কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্ষা ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ সম্ভবপর হয়। ১৯৪০ সালে ইরানে একটি জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করা হয়। এর বাস্তবায়নে বৈদেশিক মিশনারি স্কুলের প্রশাসন ও বিষয়বস্তু পঠনের উপর সরকারি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় । ক্রমশ সেগুলো জাতীয়করণ করা হয়।
সাধারণ শিক্ষা ছাড়াও রেজা শাহ কারিগরি শিক্ষার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাশ্চাত্য রীতিতে বহু কারিগরি স্কুল কলেজ স্থাপন করে। জার্মান শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ১৯২২ সালে সর্বপ্রথম তেহরানে একটি পলিটেকনিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রিশের দশকে ইরানে সর্বপ্রথম একটি সঙ্গীত ও শিল্পকলা একাডেমী স্থাপিত হয়। রেজা শাহের রাজত্বের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব ছিল ১৯৩৫ সালে তেহরানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। প্রাথমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, আইন শাস্ত্র, মেডিসিন, প্রকৌশল ও মানবিক শাখা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। এ শিক্ষায়তনে ইরান ও বিদেশি অধ্যাপকেরা অধ্যাপনা করতেন। রেজা শাহের শিক্ষানীতির প্রধান দুটি দিক ছিল মহিলাদের জন্য শিক্ষায়তনের দ্বার উন্মোচন করা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা নীতিতে মোল্লা শ্রেণির প্রভাবকে নির্মূল করা। পাহলভি রাজত্বকালে ইরানকে একটি শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার যে প্রচেষ্টা রেজা শাহ গ্রহণ করেন তার কার্যকারিতা সম্পর্কে দ্বিমত রয়েছে। ইউরোপীয় ভাবধারায় মৌলবাদী ইরানিরা কতটুকু উদ্বুদ্ধ হয়েছিল তা বলা দুষ্কর। গোঁড়াপন্থী মোল্লারা তার প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিকে ইসলামের সনাতনী মূল্যবোধের উপর হামলা স্বরূপ মনে করে । শিক্ষাকে জাতীয়করণে মাদ্রাসা-মক্তবের যে একচেটিয়া অধিকার ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে তা লোপ পেল । ফলে তীব্র বিরোধীতা সর্বত্র শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে জনৈক লেখক বলেন, “The basic point of failure has been educational philosophy. We feel that the existing school system has accomplished with rela- tive success the aims which conciously or unconsciously its motivat- ed that of producing a distinguished intellectual elite and of establsi- hing an instrument by which the thoughts and action of the common people might be efficienty guided It is, therefore, not as much a tech- nical failure of schools as a changed social philosophy which make the existing system anachronishtic and unsatisfactory.” এতদসত্ত্বেও একথা স্বীকার করতে হবে যে, শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে নিরক্ষরতা দূর হয়, জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়। বিজ্ঞান ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। জনস্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় এবং টেকনিক্যাল স্কুল ইরানকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে সহায়তা করে।
৬. অর্থনৈতিক সংস্কার : রেজা শাহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তার অর্থনৈতিক সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হলে কাজার বংশের রাজত্বকালে ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থা জানা প্রয়োজন। এককথায় বলতে গেলে, সে সময় ইরান দেনার দায়ে জর্জরিত এবং দেউলিয়া হয়ে পড়ে। বৃহৎ শক্তির প্রভাব বলয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে ইরান ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় । ১৯২১ সালে রাষ্ট্রের রাজস্বের মূল উৎস ছিল ৩টি। যেমন— (এ) খাস জমি (বি) অভ্যন্তরীণ কর ও (সি) শুল্ক। রাজস্ব আয়ের মূল উৎস ছিল জমিদার শ্রেণির করতলগত। রাষ্ট্র ভূ-স্বামীদের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন করে দিত ৷ কিন্তু ভূ-স্বামীরা সরকারের তহবিলে সামান্য অংশ জমা দিয়ে বাকি অর্থ আত্মসাৎ করতেন। রাজস্ব আয় হ্রাস পেলে মজলিশ ১৯২৪ সালে খাস জমি বিক্রয় দ্বারা রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা করে । ফলে নতুন ভূ-স্বামী শ্রেণির উদ্ভব হয় । ভূমি রাজস্বের মত অভ্যন্তরীণ কর ব্যবস্থাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কারণ কারচুপি ছাড়াও পাশ্চাত্য রীতিতে আয়কর এবং বিভিন্ন প্রকার কর আরোপ অনুন্নত ইরানের পক্ষে সম্ভবপর হয় নি। কর ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমেরিকান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মর্গান সুস্তারকে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য তার ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হয় নি। ১৯২২ সালে অপর একজন বিশেষজ্ঞ আর্থার মিলসপকে কর ব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাসের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় । দুর্নীতি ও সরকারি ক্ষমতার শিথিলতার জন্য কার্যকর না হলেও মিলসপ-এর প্রবর্তিত কর ব্যবস্থা ইরানে বলবৎ থাকে। ১৯২৭ সালে মিলসপ এর কার্যকাল শেষ হলেও তার নীতির উপর ভিত্তি করে ১৯৩০ সালে মজলিশ কর আইন জারি করে । রেজা শাহের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় ।
ভূমি রাজস্ব ও বিভিন্ন ধরনের কর ছাড়াও শুল্ক ছিল রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উৎস। দক্ষ ও অভিজ্ঞ বেলজিয়াম কাস্টমস কর্মচারীদের সহায়তায় শুল্ক ব্যবস্থা বিশেষভাবে কার্যকর হয় এবং ইরানের অর্থনীতিতে এর সুফল দেখা দিতে থাকে । ১৯৪১ সালে ট্যারিফ আইন জারী করা হয়। এর ফলে শুল্ক নীতি ও কার্যক্রম সুদৃঢ় হয়। অর্থনীতির সুষ্ঠু বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যথেষ্ট অবদান ছিল। বলা বাহুল্য, বিদেশি অর্থ উপদেষ্টা এবং পাশ্চাত্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইরানি অর্থনীতিবিদ যেন দাওয়ার এবং হাজির এর প্রচেষ্টায় রাজস্ব ব্যবস্থা সুসংহত হয়। ১৯২৫-১৯৩২ সালের মধ্যে বাণিজ্যিক আইন জারি করা হয়। অর্থনৈতিক সংস্কারে রেজা শাহের বিশেষ অবদান পরিলক্ষিত হয় ১৯২৭ সালে ইরানের প্রথম জাতীয় ব্যাংক অলব ‘ব্যাংক-ই-মিল্লি' স্থাপনে। এর ফলে ইরানের অর্থনীতি আধুনিকীকরণ হয়। রেজা শাহ ইরানের মুদ্রা ব্যবস্থারও সংস্কার সাধন করেন। প্রথম দিকে রিয়াল ছিল রৌপ্যভিত্তিক। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে রৌপ্যের মান কমতে থাকে । ফলে ইরানের বৈদেশিক ঋণ বাড়তে থাকে। এ কারণে তিনি ১৯৩০ সালে ‘Gold standard Act' জারি করেন। রেজা খানের শাসনামলে কেন্দ্ৰীয় সরকারের ক্ষমতা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সুদৃঢ় হয় ।
রেজা শাহের শাসনামলে কৃষিক্ষেত্রে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। ১৯২৪ সালে ভূমি ব্যবস্থা পর্যালোচনার জন্য একটি বোর্ড গঠিত হয়। বস্তুতঃ ইরানে ৩ ধরনের ভূমিস্বত্ব ছিল। যেমন (এ) ব্যক্তিগত (বি) রাষ্ট্রীয় ও (সি) ওয়াকফ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আয়ত্তাধীন জমিজমা। শেষের দুটি স্তরের জমি অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে থাকলেও মূলত ওয়াকফ সম্পত্তি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহকে বন্দোবস্ত দেয়া হত। কিন্তু কৃষি ব্যবস্থায় নানা অব্যবস্থা ও অনিয়ম দেখা দিলে রেজা শাহ ১৯৩৭ সালে 'Land Development Act' বা ভূমি উন্নয়ন আইন জারি করেন। জমির উপাদন বৃদ্ধি কল্পে সেচ ব্যবস্থা, অনাবাদি জমি চাষের সুযোগ- সুবিধা প্রদান ও কৃষিঋণ দান করা হয়। কৃষি ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য ১৯৩২ সালে কৃষি বিভাগ স্থাপিত হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, কারাজে ১৯১৯ সালে একটি কৃষি কলেজ স্থাপিত হয়। কৃষি যন্ত্রপাতির আধুনিককরণ ও পশুপালনের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়। প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয় । পাহলভি শাসনে কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হলেও একথা নিশ্চিত হল তার প্রবর্তিত ব্যবস্থায় কৃষি সমাজ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। এর মূল কারণ ভূমি বণ্টন ও রাজস্ব আদায় ভূ-স্বামীদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ও কতৃত্ব। তারা উৎপাদনের ৫০% শস্য আদায় করে বিলাসব্যাসনে কালাতিপাত করতেন। কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয় নি। কেননা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে তাদের কোন উৎসাহ দেয়া হত না। উপরন্তু অনুন্নত ও সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তনের প্রয়াস দেখা গেলেও আধুনিক যন্ত্র দ্বারা কৃষি উৎপাদন বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায় নি ৷
৭. যাতায়াত ব্যবস্থার সংস্কার : রেজা শাহের শাসনামলে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয় । উল্লেখ্য, তার ক্ষমতা লাভের পূর্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ তাদের সুবিধার্থে ইরানে জলপথ, রাস্তা ও রেলপথ নির্মাণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে কুয়েটা, জায়েদান, জুলফা ও তাব্রিজ রেলপথ স্থাপিত হয়। এছাড়া খসরুভি- কাযউইন, রাস্ত-কাসউইন, রাস্ত ও বাকু এঞ্জেলি এবং কারুন নদীতে জলপথে যাতায়াতের ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯২১ সালে সর্বপ্রথম ইরানের অভ্যন্তরে রেলপথ নির্মিত হয় । এ পথ তেহরান থেকে শাহ আব্দুল আজিম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । যাতায়াত ব্যবস্থার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য ১৯২৪ সালে সরকার একটি নিরীক্ষণ কমিটি গঠন করে। সমগ্র ইরানে রেল ব্যবস্থার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা মজলিশ ১৯২৬ সালে অনুমোদন করে। ১৯৩৮ সালে বৈদেশিক কারিগরি সহায়তায় ট্রান্সইরানিয়ান রেলপথের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এটি রেজা শাহের অন্যতম স্মরণীয় কৃতিত্ব। প্রাথমিক অবস্থায় ইরানে বিমান চলাচলের ব্যবস্থা করে একটি জার্মান বিমান সংস্থা । উল্লেখ্য, ১৯২৯ সাল থেকে Funkers নামে এ সংস্থা ইরানের বিভিন্ন শহরের মধ্যে সর্বপ্রথম বিমান ডাক ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করে। এরপর ১৯৩৭ সালে ইরান নিজস্ব বিমান সার্ভিস চালু করে। গণসংযোগের মাধ্যম হিসেবে ইরানে ১৯৪০ সালে সর্বপ্রথম বেতার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরানে ১৯৪১ সালের মধ্যে টেলিফোনও চালু হয় । এভাবে রেজা খান পাশ্চাত্যকরণ নীতির বাস্তবায়নে ইরানকে মধ্যযুগীয় একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশ থেকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন ।
৮. জাতীয় ঐক্যস্থাপনে প্রয়োজনীয় সংস্কার : জাতীয় ঐক্য স্থাপনের লক্ষ্যে রেজা শাহ প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করেন। এজন্য তিনি সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য স্থাপনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তার ক্ষমতারোহণের সময় রাজধানীর বাইরে খুব কম জায়গাতেই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল। তিনি জানতেন একটি দেশের জাতীয় ঐক্যের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়েই বিদেশি শক্তিসমূহ তাদের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট হয়। তাই দেশকে বৈদেশিক প্রভাব মুক্ত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য স্থাপন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে কাজার বংশ পূর্ব হতেই ইরানের বিভিন্ন অংশে আঞ্চলিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব দানা বেঁধে উঠেছিল। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করে ইরানের সর্বত্র কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য রেজা শাহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। উত্তরে জিলানে জাঙ্গালী নামে খ্যাত কুচিক খানের অনুসারীরা বিদেশী আধিপত্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে রুশ বিপ্লবের আগে। ফলে ইরানে আধিপত্য বিস্তারকারী রাশিয়া এবং ব্রিটেন উভয় দেশই এ আন্দোলন দমনের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালায় । কিন্তু রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়ার জার শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটলে জাঙ্গালীদের সাথে রাশিয়ার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। কেননা রুশ বিপ্লবের মূলমন্ত্রও ছিল উপনিবেশবাদ বিরোধী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় ব্রিটেন জাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে নি। ফলে জাঙ্গালী আন্দোলনটি বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। ১৯২০ সালে ইরানে পালিয়ে আসা রাশিয়ার বিপ্লব বিরোধীদের দমনের নামে কমুনিষ্ট রাশিয়ার লালফৌজ উত্তর ইরানে প্রবেশ করে এবং অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু জাঙ্গালীরা নীতিগতভাবে ইরানের মাটিতে যেকোন বিদেশি সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিরোধী ছিল। তাই তারা ইরানে রুশ সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির বিরোধিতা করে। ১৯২০ সালের জুন মাসে কুচিক খান সোভিয়েত রিপাবলিক অব জিলান ঘোষণা করেন। রেজা শাহ এ বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হয়। এদিকে ব্রিটেনও তার যুদ্ধজনিত ঝামেলা কাটিয়ে উঠে রেজা শাহের সমর্থনে এগিয়ে আসে। ফলে জাঙ্গালীরা পরাজিত হয়। কুচিক খান গভীর জঙ্গলে পলায়ন করেন এবং প্রচণ্ড শীতে সেখানেই মারা যান । জিলান কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে ।
১৯২১ সালে রেজা শাহের অভ্যুত্থানের সময় খোরাসান প্রদেশের গভর্নর ছিলেন কাওয়ামুস সালতানাহ। তখন খোরাসানের পুলিশ বাহিনীর প্রধান ছিলেন কর্নেল মোহাম্মদ তাকী খান। অভ্যুত্থানের কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী জিয়া উদ্দিন তাবাতাবায়ী তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কাওয়ামুস সালতানাহকে গ্রেফতার করে তেহরানে পাঠানোর জন্য তাকী খানকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক তাকী খান সালতানাহকে গ্রেফতার করে তেহরানে প্রেরণ করেন। সে সময়কার ইরানে রাজনৈতিক অবস্থা এতটাই টালমাটাল ছিল যে একের পর এক মন্ত্রীসভার পতন ছিল ইরানের রাজনীতিতে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে ঘটনাচক্রে কাওয়ামুস সালতানাহ প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হলেন। কিন্তু তাকী খান তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে অসঙ্গতি জানান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রেজা খান এ বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হন। এতে তাকী খান পরাজিত ও নিহত হন এবং খোরাসানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেদুঈন আরব অধ্যুষিত খুজিস্থানের উপর মুহাম্মার শেখ খাজয়ালের ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল । কাজার আমল থেকেই এ অঞ্চল ছিল কেন্দ্রীয় প্রভাব মুক্ত। খুজিস্থানে তেল প্রাপ্তির পর ব্রিটিশ সরকার খাজয়ালের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করে খুজিস্থানকে বহিশত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষায়ও কিছুটা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তেল উত্তোলনের অধিকার লাভ করে। কিন্তু রেজা শাহের নেতৃত্বে ক্রমশ কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিশালী হয়ে উঠলে ব্রিটিশ সরকার তার তেল স্বার্থ রক্ষার্থে নীতি পরিবর্তন করে খাজয়ালের পরিবর্তে রেজা শাহকে সমর্থন জানায়। এ সুযোগে ১৯২৫ সালে রেজা শাহ সামরিক অভিযান পরিচালনা করে খাজয়ালকে পরাজিত করেন। খুজিস্থান কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে ৷
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর রুশ বাহিনী আজারবাইজান ত্যাগ করলে সেখানে প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা দেয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এ শূন্যতা পূরণে তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। এ সুযোগে শেখ মুহাম্মদ খিয়াবানী নামক একজন জাতীয়বাদী নেতা একটি অস্থায়ী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। আজারবাইজানের পৃথক অস্তিত্বের সুযোগ সুবিধা তার মনে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম হয়। তাই রেজা শাহের ক্ষমতা দখলের পরও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে অস্বীকৃতি জানান। রেজা শাহ এক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে এ বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করেন। উল্লেখ্য যে, প্রায় স্বাধীন যাযাবর গোত্রগুলিকেও রেজা শাহ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনেন। এক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অগ্রসর হওয়ার নীতি অবলম্বন করেন। কেননা বখতিয়ারী, লবস্ কাশকাই ইত্যাদি গোত্রগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপিয়দের কাছ থেকে অস্ত্র পেয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। রেজা শাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে, কষ্ট সহিষ্ণু, ভ্রাম্যমান, উদ্যোগী, উপরন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এসব গোত্রকে মোকাবেলার জন্য তার নিয়মিত সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন যা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই তিনি গোত্রগুলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদেরকে দুর্বল করার নীতি গ্রহণ করেন। যখন তিনি তার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন একের পর এক যাযাবর গোত্রকে আক্রমণ করে পরাস্থ করলেন। মাত্রাতিরিক্ত করারোপ গোত্রগুলির অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল । উপরন্তু তার বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের ফলে গোত্রগুলির শক্তি হ্রাস পায়। ফলে তারা সরকারি পদক্ষেপের বিরোধীতা করতে ব্যর্থ হয়। এরপরও যারা বিদ্রোহ করে তাদেরকে সেনাবাহিনী সহজেই দমন করতে সক্ষম হয়। ১৯৩৬ সালে রেজা শাহ বখতিয়ারী উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে একভাগ খুজিস্থানের গভর্নরের নিয়ন্ত্রণে এবং অন্যভাগ ইস্পাহানের গভর্নরের নিয়ন্ত্রণে স্থাপন করেন। এছাড়া রেজা শাহ গোত্র প্রধানদের শাসন ব্যবস্থাতে জড়িত করে তাদের আনুগত্য লাভ করেছিলেন। যেমন-বখতিয়ারী গোত্রের সর্দার আসাদকে প্রথমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এবং পরে যুদ্ধ মন্ত্রী করা হয়। এভাবে অত্যন্ত ধীরে ও কৌশলে তিনি যাযাবর গোত্রগুলির বিদ্রোহ দমন করে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এভাবে তিনি ইরানে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করেন ।
বৈদেশিক সুযোগ-সুবিধার বিলুপ্তি : রেজা শাহ বিদেশির বিশেষ সুযোগ সুবিধা বিলুপ্তির প্রতি দৃষ্টি দেন। ১৯২৭ সালের মে মাসে তার নির্দেশক্রমে মজলিশ একটি জাতীয় ব্যাংক “Bank-i-Milli” প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আইন পাশ করেন। এ ব্যাংক স্থাপনের পর ইরানে ব্রিটেনের মুদ্রা ছাপানোর অধিকার বিলুপ্ত করা হয়। ব্রিটিশ মালিকানাধীন ইমপেরিয়াল ব্যাংক এর বদলে ইরানের মিল্লি ব্যাংক মুদ্রা ছাপানোর দায়িত্ব পায়। এ মাসেই রেজা শাহের নির্দেশক্রমে ইরানের বিচারমন্ত্রী ইরানে অবস্থানকারী ১৭টি দেশের প্রতিনিধিকে আগামী এক বছরের মধ্যে ইরান সরকার কর্তৃক বিদেশিদের আইন বহির্ভূত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার অবসান ঘটানোর কথা অবহিত করেন। ১৯২৮ সালে ইরানে বিদেশিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ capitulation প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। রেজা শাহ ঘোষণা করেন, এখন থেকে কোন বিদেশিকে সাধারণ অধিকার বহির্ভূত কোন বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে না। ফলে বিচারের ক্ষেত্রে বিদেশিদের ইরানের বিচার বিভাগের আওতাভুক্ত করা হল। বিদেশি দূতাবাস হতে সামরিক প্রহরা প্রত্যাহার করে নেয়া হল এবং রাষ্ট্রদূতদের শুধুমাত্র নিজ নিজ দেশের জাতীয় ছুটির দিনগুলিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বদলে এর প্রতিকৃতি প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়া হল। বলতে গেলে প্রত্যহ দূতাবাস চত্বরে নিজ দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের রীতি রহিত করা হল। একই বছর কাজার আমলে ব্রিটেনকে প্রদত্ত কয়েকটি প্রধান প্রধান বন্দরে শুল্ক আদায়ের ক্ষমতা ইরান সরকার বিলুপ্ত করে দেয়। সরকার ১৯৩১ সালে বিদেশিদের আবাদযোগ্য জমি ক্রয় ও ব্যবসা পরিচালনার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ৷
এমনকি রাষ্ট্রদূতদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদস্যদের সরকারি অনুমতি ছাড়া বিদেশিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৩২ সালে রেজা শাহ ইঙ্গ-ইরানি তেল কোম্পানির উপর চাপ প্রয়োগ করে তেল হতে সরকারের আয় বৃদ্ধি করেন। ১৯৩৫ সালে ইরানের উপকূলীয় অঞ্চলের ব্রিটিশ জ্বালানী কেন্দ্রগুলোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এভাবে রেজা শাহ বৈদেশিক প্রভাব প্রতিপত্তির বলয় থেকে ইরানকে মুক্ত করার জন্য ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন ।
রেজা শাহ ইরানের অর্থনীতির উপর হতে বিদেশিদের কর্তৃত্ব দূর করে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসী ছিলেন। তিনি বিদেশি ঋণ গ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে বিদেশিদের নিয়োগ দানে বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বিদেশিদের উপর নির্ভরশীল হওয়ার চেয়ে না খেয়ে মৃত্যুবরণ করা হাজার গুণে শ্রেয়। তিনি বিদেশ হতে উপদেষ্টা আনারও পক্ষপাতি ছিলেন না। একজন বিদেশি সাংবাদিকের সাথে তার সাক্ষাৎকারে এর প্রমাণ মিলে। এ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “Iran must learn to do without foreigners and that after a very few years foreign specialists and advisers would be no longer required.”
কিন্তু ক্ষমতায় এসে তিনি একটি শূন্য রাজকোষ দেখতে পেলেন। যে কারণে তিনি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুজন উপদেষ্টা নিয়োগে সম্মত হন। তিনি মার্কিন অর্থনীতিবিদ আর্থার সি. মিলসপের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ১৯২৭ সালে জার্মান অর্থনীতিবিদ ড. লিন্ডেনব্লাটকে নিয়োগ দেন। ১৯৩২ সালের পর তিনি আর কোন উপদেষ্টা নিয়োগ করেন নি। এভাবে ইরানে বিদেশি শক্তিবর্গের বিশেষ করে বৃহৎ শক্তি রাশিয়া ও ব্রিটেনের প্রভাব হ্রাস পায়। ১৯৩৫ সালের মধ্যে ইরান অর্থনৈতিকসহ সর্বক্ষেত্রে বিদেশিদের প্রভাবমুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
৯. শিল্প ক্ষেত্রে সংস্কার : বৈদেশিক শোষণের শিকার ইরানিদের পক্ষে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না বলে রেজা শাহ এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও দায়িত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে টোবাকো কোম্পানী, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও পাওয়ার প্লান্টের মত বৃহৎ শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও রেজা শাহের সময়ে ইরানে চিনিকল, ইস্পাত কারখানা, চা শিল্প, বস্ত্র শিল্প, সাবান তৈরির কারখানা ইত্যাদি গড়ে উঠে। ১৯৩০-১৯৪০ সালের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ২৬৫টি শিল্প কারখানায় প্রায় ৪৭,০০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। আধুনিক শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হলেও রেজা শাহের সময় কুটির শিল্পকে উপেক্ষা করা হয় নি। ইরানের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তিনি কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । তিনি কয়েকটি কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করে আধুনিক রুচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের ব্যবস্থা করেন। বিশ্ববিখ্যাত ইরানের কার্পেট শিল্পের উন্নয়নের জন্য তিনি গালিচা বয়ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। উল্লেখ্য যে, তামাক উৎপাদন ও সিগারেট বিক্রয়ের জন্য একটি সরকারি সংস্থা গঠন করা হয় । এছাড়া বস্ত্র, চিনি, সিমেন্ট ও দিয়েশলাই উৎপাদনও বিক্রি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সরকারি অনুমোদন ছাড়া মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, পশমি ও সুতিবস্ত্র রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও ঔষধপত্র আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। রাশিয়ার সাথে ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্যের বড় একটা অংশ পরিচালিত হত। কিন্তু রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক বাণিজ্যের কারণে ইরানি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। তাই রেজা শাহ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ১৯৩১ সালে 'The foreign trade monopoly law প্রবর্তন করে বহিঃবাণিজ্যিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ আইনের মাধ্যমে সরকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমদানির অনুমতি দানের ক্ষেত্রে একটি শর্ত জুড়ে দেয়। বলা হয়, আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধিত হবে ইরান হতে রপ্তানিকৃত ‘Non-Oil’ পণ্যের আয় হতে। এ আইন প্রয়োগের ফলে অল্পদিনের মধ্যেই আমদানিকৃত পণ্য এবং রপ্তানিকৃত “Non-Oil” পণ্যের মূল্যের মধ্যে দারুণ ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ ১৯৩১ সালে বহু বছর পর প্রথম বারের মত Non-Oil পণ্যের রপ্তানি মূল্য ৭১৮ মিলিয়ন রিয়াল, যা আমদানি মূল্য ৬৩১ মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। যদিও পরবর্তী ২ বছরের মধ্যেই আইনটি প্রয়োগে শিথিলতা দেখা দেয়। তথাপি এ আইনের প্রভাবে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। রাশিয়ার সাথে ১৯২৭ সালে ৫টি এবং ১৯৩৫ সালে আরো কয়েকটি বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে ইরান থেকে অবারিত অর্থ পাচার বন্ধ করা হয়। এভাবে ইরানের অভ্যন্তরীণ ও বৈদিশিক শিল্প ও বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় ।
মোজাফফর উদ্দিন শাহের আমলে সম্পাদিত এক চুক্তি অনুযায়ী ইঙ্গ-ইরানি তৈল কোম্পানী ইরান সরকারকে যে রয়ালিটি প্রদান করত তা ছিল অত্যন্ত কম। এছাড়া কোম্পানির উচ্চ পদগুলি ছিল ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত। কোম্পানিতে কর্মরত হাজার হাজার ইরানি কর্মকর্তাদের বেতন ছিল খুবই কম। নিম্নপদস্থ ও নিম্ন বেতন ভুক্ত এসব কর্মচারিদের জন্য পর্যাপ্ত বাসস্থান নির্মাণেও কোম্পানি কোন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিল। অথচ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা ও ব্রিটিশ ক্লাবগুলোর পেছনে কোম্পানি প্রচুর অর্থ ব্যয় করত। বার বার অনুরোধ করার পর কোম্পানি অধিকহারে রয়ালিটি প্রদানে অস্বীকৃত জানালে রেজা শাহ ১৯৩২ সালে একতরফাভাবে পূর্বেকার চুক্তিটি বাতিল করে দেন। ব্রিটেন বিষয়টি লীগ অব নেশনসে উপস্থাপন করে। আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় ১৯৩৩ সালে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে কোম্পানি কর্তৃক ইরান সরকারকে দেয় অর্থের পরিমাণ কয়েকগুণে বৃদ্ধি পায়। ফলে ১৯৩১ সালে তেল হতে আয়ের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ মিলিয়ন পাউন্ড। ১৯৪০-১৯৪১ সালে এ পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪ মিলিয়ন পাউন্ডে এসে দাঁড়ায়। তেল উৎপাদন ও লক্ষনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯২৪ সালে যেখানে ইরানে উৎপাদিত তেলের পরিমাণ ছিল ৪ মিলিয়ন টন, ১৯৩৯ সালে তা দাঁড়ায় ১১ মিলিয়ন টনে।
ধর্মীয় সংস্কার : রেজা শাহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উলামাদের প্রভাব খর্ব করে তাদেরকে সরকারি কর্মচারিতে পরিণত করেন। শিয়া অধ্যুষিত ইরানে কারবালার ঘটনা স্মরণে গোটা মহরম মাস ব্যাপী শোক পালন করা হত। রেজা শাহ এ শোক পালন ১ সপ্তাহ কমিয়ে দেন। এবং এ উপলক্ষে কোন আত্মনিগ্রহ ও উৎকট প্রদর্শনী আড়ম্বরপূর্ণ ধর্মীয় শোভা যাত্রা বা তাজিয়া নিষিদ্ধ করেন। তিনি চেয়ার প্রবর্তন করে কিছু সংখ্যক মসজিদকে আধুনিকীকরণ করেন। উচ্চ স্বরে আযান দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এবং মক্কায় হজ যাত্রাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। সকল প্রকার ধর্মীয় খেতাব বিলুপ্ত করে জনসাধারণকে পারিবারিক উপাধি গ্রহণ করতে বলা হয় । তিনি নিজে প্রাক-ইসলামি পারস্যের ইতিহাসে সম্মানিত পাহলভী নাম গ্রহণ করেন। পূর্বে গোত্র প্রধান, ভূ-স্বামী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্বোধন করতে তাদের নামে নানা প্রকার বিশেষণ যোগ করা হত। রেজা শাহ এসব বিশেষণের পরিবর্তে মিস্টার, মিস, ম্যাডাম ইত্যাদি ব্যবহারের নির্দেশ দেন। আবহমান কাল ব্যাপী ইরানে পাগড়ি পরিধানকে ধর্মীয় সংস্কৃতি ও আভিজাত্যের অঙ্গ মনে করা হত। কেউ কেউ তুর্কি ফেজ পরিধান করত। রেজা শাহ পাগড়ি ও তুর্কি ফেজের বদলে প্রথম পাহলভী হ্যাট পরিধান বাধ্যতামূলক করেন। তিনি ইরানে ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকার বদলে পুরনো পারস্য সৌর পঞ্জিকা চালু করেন। উল্লেখ্য যে পর্দা প্রথাকে ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে করে তিনি ১৯৩৫ সালে আইন করে পর্দা প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে নারীদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি নিজ স্ত্রী ও কন্যাকে ইউরোপীয় পোষাক পরিধান করিয়ে জনসম্মুখে নিয়ে যেতেন। পর্দাহীন মহিলাদের সিনেমা ও রেস্তোরায় আগমনে বাধা না দেয়ার জন্য তিনি পুলিশকে নির্দেশ দেন। এমনকি মহিলাদের রাস্তায় অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলা এবং ঘোড়ার গাড়িতে চড়ার অনুমতিও প্রদান করা হয়। ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি তেহরানে প্রায় ৪,০০০ মহিলা ছিল যারা পর্দা ছাড়া জনসম্মুখে বের হত। তবে তাদের বেশির ভাগই ছিল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত তরুনী। ইউরোপ ফেরত ইরানিদের বিদেশি স্ত্রী এবং সংখ্যালগু মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। রেজা শাহ কন্যা শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। অফিস-আদালতে মেয়েদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেন। নারী-পুরুষ উভয়ের দিক থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ স্বীকৃত হয় । শুধু তাই নয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ও মুসলিমদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেয়া হয়। এছাড়া নতুন একটি বিবাহ আইনে ওলামাদের দ্বারা সম্পাদিত বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন বিশেষ কর্মচারীর কাছে নিবন্ধীকরণের আইন চালু করা হয়। এসব আইনের বিরুদ্ধে সকল প্রকার প্রতিরোধ আন্দোলনকে তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন ।
জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করা : রেজা শাহ ইরানের জনগণের মন থেকে হীনমন্যতা দূর করার জন্য প্রাচীন ইরানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তাদের সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করেন। তিনি Department of Public Guidance বা জন পরিচালনা বিভাগ, National Heritage Society বা জাতীয় ঐতিহ্য সমিতি, Geography Commission বা ভূগোল কমিশন, ইরান-ই-বাস্তান সাময়িকী বা প্রাচীন ইরান এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত দু'টি প্রভাবশালী পত্রিকা এত্তেলাত ও ‘জার্নাল দ্যা-তেহরান' এর সমন্বয়ে ফরাসী একাডেমির অনুকরণের ফারহাঙ্গেস্তান বা সাংস্কৃতিক একাডেমী নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন । সংগঠনটি প্রাচীন ইরানের গৌরব গাঁথা প্রচার এবং ফারসি ভাষাকে বিদেশি ভাষা বিশেষত আরবি ভাষার প্রভাব হতে মুক্ত করায় দায়িত্বে নিয়োজিত হয়। এ সংগঠন আরবি ভাষার স্থলে নতুন ফারসি শব্দ বা প্রাচীন ফারসি শব্দ ব্যবহারের কাজে নিয়োজিত হয় ।
ভূগোল কমিশন ১০৭টি স্থানের আরবি, তুর্কি ও আর্মেনিয়ান নাম পরিবর্তন করে ফারসি নাম চালু করে। যেমন আরাবিস্থান হয় খুঁজিস্থান। সুতলানাবাদ হয় আরাক, কামপুর হয় ইরান শহর। এ কমিশন পাবলিক আইন, ব্যবসায়িক চিঠিপত্র এবং এমনকি ভিজিডিং কার্ডেও ফার্সি ভাষা ব্যবহারের আইন জারি করে। সাংস্কৃতিক একাডেমীর প্রশাসনিক পরিভাষার ক্ষেত্রে ফারসি শব্দ চালু করে। ফলে আরবি ভিলায়েত বা প্রদেশ হয় ওস্তান, ওয়ালি (গভর্ণর) হয় ওস্তানধার । নাজমিয়ে বা পুলিশ হয় শহর বানি, সাহেব-ই-মনসব বা সামরিক কর্মকর্তা হয় আফসার এবং কুশুন বা সেনাবাহিনী হয় আরতেশ। পারস্যের বিখ্যাত কবি শাহনামার লেখক ফেরদৌসির সমাধির উপর রেজা শাহ একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ইরানী সাহিত্য কেন্দ্রের উপর ফারসি ভাষায় চর্চা এবং একে আরবি ভাষার প্রভাবমুক্ত করার দায়িত্ব দেন। একই বছর রাষ্ট্রের সরকারি নাম হেলেনিস্টিক পারস্যের স্থলে ইরান রাখা হয়। একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে তিনি বিদেশি রাষ্ট্রগুলিকেও তাদের চিঠিপত্রে ইরানি নাম ব্যবহারের কথা অবহিত করেন । এমনকি পারস্য সম্বোধন করে লেখা চিঠি প্রেরকের নিকট ফেরত পাঠানোর কড়া নির্দেশ দেয়া হয়। ইরানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিদেশি সরকার ও দূতাবাসগুলিকে ফারসি ব্যবহারের কথা বলা হয়। পূর্বে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত তেহরান ক্লাবে কোন ইরানি নাগরিকের প্রবেশাধিকার ছিল না। তিনি তেহরান ক্লাবের উপর চাপ প্রয়োগ করে ইরানিদেরকে এর সদস্য পদ প্রদান করতে বাধ্য করেন। তিনি প্রথম ১৯৪০ সালে বেতারে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । অবশ্য তার শাসনামলে সংবাদপত্রের সমালোচনামূলক অধিকার খর্ব করে সংবাদ পত্রের সংখ্যা ৪টিতে নামিয়ে আনা হয় ।
মূলতঃ ইরানকে বিদেশি প্রভাব হতে মুক্ত করা; অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং পাশ্চাত্যের অনুকরণে ইরানকে একটি অত্যাধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা রেজা শাহের আজীবনের স্বপ্ন ছিল। উপরন্ত, সংস্কারের মাধ্যমে তার সে স্বপ্ন অনেকটা বাস্তবে রূপ নেয় । এ ক্ষেত্রে তিনি একজন সফল রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন ।
রেজা শাহের সংস্কার কার্যক্রমের মূল্যায়ন : রেজা শাহ কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচি ইরানের ইতিহাসে একটি নবযুগের সূচনা করেছিল। যা কিছু অচল, যা কিছু পুরাতন ও ধর্মীয় গোড়মিপূর্ণ সেগুলো পরিবর্তন করে ইরান গঠনের অদম্য স্পৃহা নিয়েই রেজা শাহ তার সংস্কার কার্যে ব্রতী হন। তার শাসনামলে ইরানে সার্বিক আইন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। ইরানের সর্বত্র কেন্দ্রীয় কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়। উন্নয়ন, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিকায়ন ছিল তার শাসনামলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সমালোচকদের মতে রেজা শাহের শাসনামলে সরকারি দমন নীতি, দুর্নীতি ও অতিরিক্ত করারোপের ফলে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। এছাড়া কিছু অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও সমসাময়িক প্রতিকূল পরিবেশের কারণে চুড়ান্ত বিচারে তার সংস্কারগুলি পরিপূর্ণ সফলতা ও স্বায়ীত্ব লাভ করতে পারে নি। বর্তমান ইরানের দিকে তাকালেই রেজা শাহের আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা যে ব্যর্থ হয়েছিল তা বুঝা যায় । রেজা শাহ দেশ ত্যাগ করার পরপরই সাধারণ মানুষ তাদের পুরাতন জীবন ধারায় ফিরে যায়, যেন মাঝখানে কোন ব্যতিক্রম ঘটে নি ।
আজান দেয়া শুরু হয়। মহিলারা পর্দা প্রথা অনুসরণ করতে থাকে। ধার্মিকরা মাথায় পাগড়ি পরিধান করে দরূদ শরীফ পাঠ করতে করতে রাস্তায় চলতে থাকে । যে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের ও শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য রেজা শাহের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না সে সামরিক বাহিনীও প্রয়োজনের সময় যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারে নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেজা শাহের জর্মান ঘেঁষা নীতি অনুকরণের ফলে ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ইরান আক্রমণ করে তখন ইরানের সেনাবাহিনী কোন প্রকার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। এবং রেজা শাহ সিংহাসন ছেড়ে বিদেশ যেতে বাধ্য হন। রেজা শাহের দেশব্যাপী শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনাটিও কাঙ্খিত সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৪০ সালের শতকরা মাত্র ১০ ভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হয়েছিল । একই বছর ১২ থেকে ২০ বছর বয়সী শতকরা ১ ভাগ ছাত্র/ছাত্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেত। ১৯৬০ এর দশকের পূর্বে পরিসংখ্যানের কোন উন্নতি হয় নি। ১৯৭৮ সালে এসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় মোট শিশুর শতকরা ৭৫ ভাগ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শতকরা ৫০ ভাগ ।
রেজা শাহ সংস্কারের নামে জীবনের এমন কতগুলি ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেছিলেন যা চিরকালই ছিল আইনের আওতা বহির্ভূত। পর্দাপ্রথা নিষিদ্ধকরণ, মসজিদে চেয়ার প্রবর্তন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমর্থন লাভ করে নি। যে কারণে চূড়ান্ত বিচারে সংস্কারসমূহ স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে নি। রেজা শাহের সংস্কারগুলি পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া যায় যে, সংস্কারের ক্ষেত্রে
তিনি সমসাময়িক তুর্কি নেতা মুস্তফা কামাল পাশার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি মুস্তফা কামালের মত সফলকাম হতে পারেন নি। তার সংস্কারগুলির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে এ ব্যর্থতার কারণ বের হয়ে আসবে ।
তুরস্ক ইউরেশিয় দেশ হওয়ায় ইউরোপীয় সভ্যতার সাথে তুর্কিদের পরিচয় ছিল দীর্ঘদিনের। তাই ইউরোপীয় ভাবধারা গ্রহণ করার মত অনুকূল পরিবেশ তুরস্কে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। আধুনিক এ ভাবধারা গ্রহণের জন্য যে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন তাও তুর্কিদের ছিল। ইরানের অবস্থা ছিল এর বিপরীত এবং তুরস্কের তুলনায় ইরানি জনসাধারণ ছিল পশ্চাদপদ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইস্তাম্বুলে যেখানে মেয়েদের আধুনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৮ সালে সেখানে তেহরানে তা হয় ১৯০৭ সালে। ইস্তাম্বুলে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় ১৮৬৩ সালে আর তেহরানে হয় ১৯১৮ সালে। ইস্তাম্বুলে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয় ১৯১৪ সালে আর তেহরানে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে ১৯৩৬ সালে। ফলে পশ্চাদপদ এ সমাজে রেজা শাহের সংস্কারসমূহ দীর্ঘস্থায়ী না হওয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক ।
মুস্তফা কামাল তার সংষ্কারের উদ্দেশ্যে ও প্রকৃতি সম্পর্কে জনসাধারণকে ধারণা দেয়ার জন্য কামালবাদ নামে পরিচিত ছয় দফা কর্মসূচি তাদের সামনে তুলে ধরেন। কিন্তু রেজা শাহের সংস্কারের এ ধরনের কোন আদর্শিক ভিত্তি ছিল না । সুনির্দিষ্ট নীতিমালারও অভাব ছিল। সংস্কারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এ ধরনের অস্পষ্টতা সংস্কারগুলির বাস্তবায়নের পথে ছিল বড় অন্তরায়। মোস্তফা কামাল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি নামে একটি দল গঠনের মাধ্যমে তার সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। তার মৃত্যুর পর এ দলের কর্মসূচির মধ্যেই তার সংষ্কারগুলি টিকে ছিল। কিন্তু রেজা শাহ কোন দল গঠন না করায় তার ক্ষমতাচ্যুতির পর সংস্কারগুলির সমাপ্তি ঘটে। রেজা শাহ চেয়েছিলেন রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে আধুনিক ইরান, যা ছিল বাস্তবতা বিবর্জিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা । প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে কামাল যে সংস্কারগুলি বাস্তবায়ন কয়েছিলেন রেজা শাহের পক্ষে তা সম্ভব হয় নি ।
রেজা শাহ ইউরোপীয় কায়দায় ইরানের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। অথচ তার ২০ বছর শাসনামলে কখনও ইউরোপে যান নি। ফলে আধুনিক ইউরোপিয় সভ্যতার মূল ভাবধারা অনুধাবন করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। আর শিক্ষা ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন কামালের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। প্রথম জীবনে কামাল যদিও একজন সৈনিক ছিলেন তথাপি তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে তার সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রেজা শাহের সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেনাবাহিনী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার সামরিক চরিত্র পরিত্যাগ করতে পারেন নি। ফলে তার সংস্কারগুলি জনমনে স্থায়ী আসন পায় নি। সামরিক ভীতি অপসারিত হওয়ার পর জনগণ আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায় ।
সংস্কার ও নতুনের প্রতি ভয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস এবং পুরাতনকে আকঁড়ে থাকার প্রবণতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সে সাথে প্রাচীনপন্থীদের দৌরাত্ম্য, যোগ হয়ে রেজা শাহের সংস্কারসমূহকে পুরোপুরি সফল হতে দেয় নি। তবে একথা বলা যায় যে, তার সংস্কারের প্রথম দুটি উদ্দেশ্য অর্থাৎ ইরানকে বিদেশি প্রভাবমুক্ত করা এবং ইরানের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে তার সফলতা প্রশ্নাতীত। আর ইরানকে পুরোপুরি ইউরোপীয় কায়দায় আধুনিকায়ন না করতে পারলেও একথা সত্য যে, কাজার আমলের মধ্যযুগীয় অন্ধকার হতে তিনি ইরানকে আধুনিকতার আলোর পথ দেখিয়েছিলেন। অবশ্য রেজা শাহ তার নিজের অবদানকে একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। ইরানিদের প্রতি রেজা শাহ তার অবদান সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, “I have made the Iranians realize that when they get up in the morning they must go to work and work hard all day long.”
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মতামত : রেজা শাহের সংস্কার সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য প্রদান করেছেন। তাদের বক্তব্য নিম্নে উপস্থাপন করা হল :
ঐতিহাসিক আরণন্ড মুস্তফা কামাল পাশার সাথে রেজা শাহের তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, “Like Mustafa Kamal Pasha whom be evidently admired and imitated Reza Khan was a soldier and a self made man. Indeed he had a more romantic career than his Turkish confrere who only rose from second lieutenant to president of repub- lic where as Reza Khan rose from trooper to Shah."
অধ্যাপক ল্যাম্বটন বলেন, “রেজা শাহের পাশ্চাত্যকরণ নীতি খুবই দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয় এবং এর ফলে পাশ্চাত্য রীতিনীতি ও ভাবাদর্শের সাথে ইরানের সনাতনী প্রথা ও ভাবধারার সুষ্ঠু সমন্বয় হয় নি। বিদেশে প্রশিক্ষণ দ্বারা ও বৈদেশিক কারিগরি সাহায্যে এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে রেজা শাহ একটি মধ্যযুগীয় ভাবধারায় পুষ্ট দেশকে রাতারাতি আধুনিক করতে চান। এর ফলে তার সংস্কারগুলি সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে পারে নি।”
রিচার্ড ফ্রাই বলেন, The Shah forcibly revolutionized the social and religious life of his people as a result the revolution took place main- ly on the surface."
রেজা শাহের মন্ত্রিপরিষদের প্রভাবশালী শিয়া মন্ত্রী ইসা সাদিক রেজা সম্পর্কে বলেন, “The work of westernization or progress needs a centrailized government, without it the wordly priests would become too power- ful and the task that has been started might be endangered and postponed.”
ইরানের একজন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, কবি, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মুহম্মদ তাকি কাহার রেজা শাহ পাহলভীর সংস্কারের সমালোচনা করে বলেন, “আধুনিক ও কার্যকর রাজনৈতিক নীতিমালার অভাবে সংস্কার ফলপ্রসূ হয় নি। এবং বিফলতার প্রধান কারণ হল ইরানের পুরাতন সনাতনী ও অনগ্রসর মৌলিক ইসলামি চিন্তাধারায় পুষ্ট সামাজিক কাঠামো, রাজনৈতিক চেতনাবোধের অভাব এবং সংস্কারমনা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুপস্থিতি ।
G. Lenezowski, "Reza had never been in Europe and his concepts of modernization were sometimes native. Moreover, he was a despot and greedy individual apt to neglect his subjects in order to satisfy his personal ambitions, prossessing nor real concept to the rule of law and lacking the unselfishness that rendered Kamal a true statesman and father of his nation."
সার্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক ইরানের প্রতিষ্ঠাতা, প্রমিতযশা সংস্কারক ও পাহলভি বংশের প্রথম শাহ হিসাবে রেজা শাহ অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি অনুন্নত ও মধ্যযুগীয় অবস্থা থেকে পশ্চাত্যকরণের দ্বারা ইরানকে একটি প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত করেন। যদিও তার সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় ।

রেজা শাহের বিদেশনীতি


মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বহুবিধ কারণে রেজাশাহ বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। তিনি শুধু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই সংস্কার সাধন করেন নি; ইরানের বিদেশ নীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২১ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রেজা শাহ ইরানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। তার রাজত্বকাল (১৯২১-১৯৪১) ইরানের বৈদেশিক নীতির জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা এ সময়ে ইরানের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দুই দশক ব্যাপী বিস্তৃত রেজা শাহের শাসনামলে ইরানের বিদেশনীতিতে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন-বৃহৎ শক্তিবর্গের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের নীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করার নীতি । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
রেজা শাহ প্রথমেই বৃহৎ দেশগুলির সাথে ইরানের সম্পর্কোন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৯২৩ সালে রেজা শাহ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ায় পর থেকে ইরানের বিদেশ নীতিতে একটি নতুন ধারার সূচনা হয়। বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক হয়ে উঠেন। তার বিদেশ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল-ইরান থেকে বিদেশি আধিপত্যের অবসান এবং ইঙ্গ-সোভিয়েত প্রভাব বলয় থেকে দেশকে মুক্ত করা । বিশ শতকের গোড়া থেকেই বৃহৎ শক্তিবর্গ ইরানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এ আধিপত্য বিস্তারে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল ব্রিটেন ও রাশিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানি এবং যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দেয়। এসব দেশের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের বিদেশ নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।
ইরান-সোভিয়েত সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, রেজা শাহ ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ইরান সোভিয়েত সম্পর্কে পরিবর্তন সূচিত হয়। রেজা শাহের সামরিক অভ্যুত্থানের মাত্র ৫ দিন পর ১৯২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইরান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯১৯ সালে সম্পাদিত ইঙ্গ-ইরান চুক্তির বিপরীতে এ চুক্তিটি ছিল ইরানি জনগণের প্রতি বন্ধুত্ব ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের পরিচায়ক। এ চুক্তিতে বলা হয়;
(১) জারের আমল থেকে রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে যে সকল সুয়োগ সুবিধা পেয়ে আসছিল তা পরিত্যাগ করবে। অর্থাৎ চুক্তিটিতে রাশিয়া দ্ব্যর্থকণ্ঠে ইরানে তার পুরনো সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ পরিত্যাগের ঘোষণা দেয়। তবে শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, রশিয়া কর্তৃক পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধাগুলি ইরান তার জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করবে। অন্যকোন বৈদেশিক শক্তিকে তা প্রদান করতে পারবে না।
(২) ইরানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানতে পারে এমন কোন কাজ রাশিয়া করবে না।
(৩) উভয় দেশ একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করবে না।
(৪) ১৮৮১ সালে যে রুশ-পারস্য সীমানা নির্ধারিত হয় তা বলবৎ করা হবে। সেই সাথে কাম্পিয়ান সাগরের দক্ষিণাঞ্চলে আওবাদা এবং অন্যান্য দ্বিপাঞ্চলে রাশিয়া তাবেদারি পরিত্যাগ করবে। পারস্য সাগরের উপর রুশ কর্তৃত্ব মেনে নিবে। এছাড়া আটারাক নদীসহ সীমান্ত নদীসমূহ রাশিয়া ও পারস্য উভয়েই ব্যবহার করতে পারবে। সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যৌথ কমিশন গঠন করা হবে।
(৫) উভয় দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে তারা নিম্নে বর্ণিত কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকবে;
(i) পারস্য ও রাশিয়া উভয়ে উভয়ের স্বার্থ বিরোধী কোন সংগঠন বা গোষ্ঠী গঠনে সহায়তা করবে না। অথবা এ দুদেশের মিত্রদের বিরুদ্ধে কোন বিরোধী বা সন্ত্রাসী দল গঠন করতে সাহায্য করবে না।
(ii) উভয় দেশের অভ্যন্তরে অপর কোন তৃতীয় শক্তির উপস্থিতি বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে এমন কোন শক্তি যা সীমান্ত লংঘনের হুমকি দিতে পারে।
(iii) উভয় অঞ্চল দিয়ে অপর কোন দেশের মালামাল স্থানান্তরিত করা যাবে না। যা উভয়ের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে।
(৬) যদি কোন তৃতীয় শক্তি অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে পারস্য আক্রমণের পরিকল্পনা করে অথবা কোন বিদেশী শক্তি রুশ-পারস্য সীমান্ত ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ালে পারস্য সরকার যদি তা নিরসনে ব্যর্থ হয় তাহলে পারস্য সরকারের অনুরোধে রুশ সরকার পারস্যে সৈন্য পাঠিয়ে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। অবশ্য আগ্রাসন বন্ধ হয়ে গেলে রুশ সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে ।
(৭) উপরোক্ত অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তানুযায়ী কম্পিয়ান সাগরে অবস্থানরত রাশিয়ার বিরোধীতাকারী পারস্য নৌবহরে অংশগ্রহণকারী বিদেশিদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হবে।
(৮) জার সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত রাশিয়ার অর্থনৈতিক নীতি বর্জন করে পারস্যকে পূর্বের মত ঋণ প্রদান করে রাশিয়ার অধীন করা হবে। পূর্বের সমস্ত ঋণ ও অনুদান বাতিল বলে গণ্য হবে।
(৯) রাশিয়া ডিসকাউন্ট ব্যাংকের সম্পদ, দায়-দেনা পারস্যকে ছেড়ে দিবে। কিন্তু মাত্র একটি বাড়ি রুশ কনসুলেটের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
(১০) রাশিয়া তার নির্মিত এনজেলী তেহরান এবং কামউইন-হামাদন সড়ক, জুলফা-তাব্রিজ, সুফিয়ান-উমুরিয়া রেল পথ, উমুরিয়া হ্রদের বার্জগুলি, টেলিফোন লাইন, টেলিগ্রাফ লাইন, এজেন্সী নৌবহর এবং বৈদ্যুতিক কেন্দ্রসমূহ পারস্যকে অর্পণ করবে।
(১১) ১৮২৮ সালের রাশিয়ার সাথে পারস্যের ঘৃণ্য তাকুমানচাই চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করা হবে। এবং কাম্পিয়ান সাগরে ইরানের নৌবহর চলাচল করতে পারবে।
(১২) জার সরকারকে প্রদত্ত সকল সুযোগ-সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে এবং রুশ দখলে ইরানের সকল সম্পত্তি কেবলমাত্র রুশ কনসুলেট ছাড়া ইরান সরকারকে হস্তান্তর করা হবে। রাশিয়া তেহরানের অনতি দূরে জারগানদারের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিবে। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ লিগেশন গুলহাকে অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে।
(১৩) উপরোক্ত অনুচ্ছেদের বরাতে আরো বলা যায় যে, পূর্বের রুশ অধিকৃত কোন অঞ্চল বা রুশ দখলে কোন সম্পত্তি কোন তৃতীয় শক্তিকে দেয়া হবে না। এক্ষেত্রে তৃতীয় শক্তি বলতে ব্রিটিশ সরকারকে বুঝানো হয়েছে।
(১৪) এ অনুচ্ছেদে কাম্পিয়ান সাগরে ইরানী মৎস্যজীবীদের অবাধে মৎস্য শিকারের অধিকার থাকবে।
(১৫) জারের আমলের সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাতিল করা হবে এবং এসকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি স্কুল ও বিদ্যাপীঠ হিসেবে ব্যবহারের জন্য ইরান কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করতে হবে।
(১৬) এ অনুচ্ছেদের সর্বপ্রকার অতি রাষ্ট্রিক অধিকার বর্জিত হবে।
(১৭) উভয় দেশের নাবিকদের সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ অথবা এর পরিবর্তে অর্থ দানের যে নীতি ছিল তা থেকে জনগণকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
(১৮) উভয় দেশের নাগরিকদের পারস্পরিক দেশ ভ্রমণের সমান সুযোগ থাকবে এবং এর মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধুসুলভ আচরণ গড়ে উঠবে।
(১৯) এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার অল্প দিনের মধ্যে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। আমদানি-রপ্তানি, অর্থবিনিয়োগ, পরিশোধ ব্যবস্থা ও শুল্ক ইত্যাদি উভয় দেশের প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত বাণিজ্যিক কমিশন নির্ধারণ করবে।
(২০) আন্তর্জাতিক নিয়ম মাফিক মাল পারাপারের জন্য উভয় দেশের সমান অধিকার থাকবে।
(২১) উভয় দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ চালু করা হবে।
(২২) উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য দূত বিনিময় করা হবে।
(২৩) উপরের ধারার বাস্তবায়নে উভয় দেশের কনসুলেট প্রতিষ্ঠিত হবে। এ চুক্তি উভয়দেশ কর্তৃক তিন মাসের মধ্যে অনুমোদিত হবে।
(২৫) চুক্তিটি রুশ ও পারস্য উভয় ভাষায় লিপিবদ্ধ হবে। যাতে উভয় দেশের জনগণ এ চুক্তির মর্ম উপলব্ধি করতে পারে ।
সুতরাং, এ চুক্তি ইরানের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে। কেননা চুক্তিটি ছিল সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পাদিত একটি চুক্তি। এ সময় রাশিয়া তার অভ্যন্তরীণ সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যস্ত ছিল। রুশ বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতি রাশিয়াকে চুক্তিটি সম্পাদনে বাধ্য করেছিল। ফলে রাশিয়া সাময়িকভাবে হলেও পারস্য উপসাগরে তার চিরন্তন সাম্রাজ্যবাদি নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবে সোভিয়েত বিরোধী আগ্রাসন মোকাবেলায় ইরানে রাশিয়ার সৈন্য পাঠানোর অধিকার সংক্রান্ত ধারাটির মধ্যে কিছুটা পুরাতন সাম্রাজ্যবাদি চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। যাহোক, এ চুক্তির সুফল হিসেবে ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে জিলান থেকে সোভিয়েত সৈন্য অপসারিত হয়। এবং রেজা শাহের পক্ষে জিলানের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা কুচিকখানকে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯২১ সালের চুক্তির পর দুটি দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তখনও কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। এ ক্ষেত্রে রেজা শাহের সময়ের বিদেশ নীতি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। (এ) জিলানের বিদ্রোহের ঘটনা ছাড়াও ইরানের আজারবাইজান ও খোরাসানের বিদ্রোহগুলি সংঘটিত হয়েছিল সোভিয়েত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। ফলে রেজা শাহের পক্ষে এসব বিদ্রোহের পিছনে সোভিয়েত ইন্ধন রয়েছে তা ভাবার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ ছিল। এসব বিদ্রোহ ইরানকে রাশিয়ার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাতে বাধ্য করেছিল ।
(বি) কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি গ্রহণের ফলে ইরানের কমুনিস্ট পার্টি গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। রেজা শাহের এ কমুনিস্ট বিরোধী বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাশিয়ার বিরক্তির উদ্রেক করে। অথচ ব্রিটিশ সমর্থনে রেজা শাহ যখন ইরানের ক্ষমতা দখল করেছিলেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়েছিল। কেননা সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টিতে রেজা শাহের ক্ষমতা দখল ছিল সামন্তবাদ বিরোধী আধা বুর্জোয়া বিপ্লব, যা ক্রমান্বয়ে মার্কসীয় বিপ্লবের পথ ধরে এগুবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে যখন রেজা শাহ কমিউনিস্টদের দমনে অগ্রসর হলেন তখন রাশিয়ার পক্ষে অনুশোচনা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ।
(সি) কিছু অর্থনৈতিক সমস্যাও ইরান সোভিয়েত সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধ্য সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে ইরানের উত্তরাঞ্চলের তেল সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের বিষয়টি ছিল উল্লেখযোগ্য। উত্তর ইরান থেকে রাশিয়া তার সুযোগ সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর ইরান সরকার উত্তর অঞ্চলে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যাপারে কয়েকটি ব্রিটিশ ও মার্কিন কোম্পানির সাথে চুক্তি সম্পাদন করে। ১৯২১ সালের চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া এর বিরোধীতা করে। কেননা উক্ত চুক্তিতে ইরান-সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিত্যাক্ত সুযোগ সুবিধা অন্য কোন দেশকে প্রদান করবে না বলে অঙ্গীকার করেছিল। ব্রিটেন যুক্তি উপস্থাপন করে যে, চুক্তি সম্পাদনের এ সময় এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল জর্জিয়া, রাশিয়া নয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ব্রিটেনের এ যুক্তি প্রতিষ্ঠা পায় নি। ইরানের রেজা শাহ সরকার রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কায় ১৯২৪ সালে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পাদিত চুক্তিগুলি বাতিল ঘোষণা করে। ১৯৩৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয় নি। ১৯৩৭ সালে ইরান সরকার আমেরিকান অয়েল কোম্পানিকে উত্তরাঞ্চলে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অনুমতি প্রদান করে। সে সময় অবশ্য সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি করা হয় নি। তবে বিরাজমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে কোম্পানি তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে নি। ১৯৩৮ সালে কোম্পানিটি ইরানে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অধিকার পরিত্যাগ করে।
(ডি) দু'দেশের মধ্যে বিবাদের আরেকটি অন্যতম বিষয় ছিল রুশ-ইরান বাণিজ্য । উত্তর ইরানে উৎপাদিত রপ্তানিযোগ্য পণ্যের একমাত্র বাজার ছিল রাশিয়া। অর্থাৎ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উত্তর ইরান ছিল সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। যে কারণে তেহরানে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত Petrovsky বলেছিলেন “আমরা যদি ইরান থেকে দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করা বন্ধ করে দেই তাহলে ইরান এক মাসের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে যাবে। প্রেট্রোভস্কির এ বক্তব্য অযাথার্থ ছিল না । কারণ শুধু রাশিয়ার সাথেই উত্তর ইরানের রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালিত হত। ইরানের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিয়া একাধিকবার তার এ অর্থনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ১৯২৬ সালে কাম্পিয়ান সাগরে মৎস্য শিকারের অধিকার নিয়ে ইরানের সাথে বিরোধ দেখা দিলে রাশিয়া ইরান থেকে একমাত্র তুলা ছাড়া সব ধরনের পণ্য সামগ্রী আমদানি বন্ধ করে দেয়। এর সাথে ইরানের উত্তর অঞ্চল মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। অবশেষে ১৯২৭ সালে ইরান সরকার কাম্পিয়ান সাগরে মৎস্য শিকারের ব্যাপারে রাশিয়ার দাবীর অনুকূলে একটি চুক্তি পায়। উত্তর ইরানে অর্থনীতির উপর রাশিয়ার প্রভাব এত বেশি ছিল যে, ইচ্ছা করলেই রাশিয়া বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট করতে পারত। গোটা বিশের দশক জুড়ে প্রতিনিয়তই ইরান রাশিয়ার দ্বারা এ ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছে। রাশিয়ার বহিঃবাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকায় ইরানের ব্যবসায়ীরা এ অবস্থার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। এ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ১৯৩১ সালে রেজা শাহ বহিঃবাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে জার্মানিতে হিটলারের আবির্ভাব এবং ইরান সরকারের সাথে নাজি সরকারের সম্পর্কোন্নয়নের ফলে রাশিয়ার পরিবর্তে জার্মানীর সাথে ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পরিচালিত হতে থাকে। বলশেভিক বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ায় ইরানের ‘Non-Oil-Export'-এর পরিমাণ ছিল শতকরা ৭০ভাগ। ১৯২১-১৯৪১ সালে এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। ১৯২৫- ১৯২৯ সালে এর পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ৪০ ভাগে এবং ১৯৩০- ১৯৩৪ সালে ২৭ ভাগে। এরপর থেকে ১৯৪১ সালে রেজা শাহের সিংহাসন ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত এর পরিমাণ আরো কমে শতকরা ২১ ভাগে নেমে আসে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো সুদূরীকরণের জন্য ইরান বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। রেজা শাহের শাসনামলে ইরান তার প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। তুরস্ক ও আফগানিস্থানের সাথে ইরানের শত্রুতা ছিল দীর্ঘদিনের। ১৯২৬ সালের ২২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ইরান, তুরস্ক ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অস্বস্তিকর কুর্দি সমস্যা আন্ধারা ও তেহরানের মধ্যকার চূড়ান্ত বিরোধ নিস্পত্তির ক্ষেত্রে ছিল প্রধান অন্তরায়। ১৯৩০ সালের জুন ও জুলাই মাসে সংঘটিত কুর্দি বিদ্রোহ সমস্যটিকে আরো প্রকট করে তোলে। এবং আপোষ নিষ্পত্তির বিষয়টিকে বেশ খানিকটা প্রলম্বিত করে। তারপরও দুটি দেশের প্রতিবেশি সুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা থেকেই ১৯৩২ সালে বিদ্যমান সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটে। প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্থানের সাথেও ইরানের সীমান্ত বিরোধ ছিল। ১৯২৫ সালে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ বিরোধী মিটিয়ে ফেলা হয়। ১৯২১ সালে আফগানিস্তানের বাদশাহ আমান উল্লাহর ইরান সফর দু'দেশের সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ট করে তোলে। প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরাকের সাথে ইরানের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। শাত-ইল-আরব এলাকার সীমান্ত নির্ধারণের সমস্যা এ বিরোধকে জিইয়ে রেখেছিল। ১৮৪৭ সালে সম্পাদিত অরজুরাম চুক্তি অনুসারে ওসমানিয় সাম্রাজ্যের সীমানা শাত-ইল-আরবের পূর্ব উপকূলে স্থির হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ম্যান্ডটাধীনে ইরাক উত্তরাধিকার সূত্রে এ সীমানা লাভ করে। তাই শাত-ইল-আরবের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ইরানি বন্দর খুররম শহরের পক্ষে ইরাকি জলপথ ব্যবহার করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। সঙ্গত কারণেই ইরানের পক্ষে এ সীমানা মেনে নেয়া সম্ভবপর ছিল না। কেননা শাত -ইল-আরব তীরবর্তী ইরানি বন্দর খুররম শহরে প্রবেশ ও বন্দর হতে বের হতে হলে ইরানি জাহাজকে ইরাকি জলপথ ব্যবহার করতে হত। সীমানা পুননির্ধারণের জন্য ১৯৩৫ সালে ইরান লীগ অব নেশনস এর নিকট আবেদন করে। কিন্তু তারপরেও বিষয়টি নিষ্পত্তি হয় নি। অবশেষে ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে একটি অন্তবর্তীকালীন চুক্তির মাধ্যমে ইরানের আবদান তৈল শোধনাগারের নিকট শাত ইল-আরবের মাঝ বরাবর ইরাক ইরান সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়। এ চুক্তিও রেজা শাহের নিকট সম্পন্নরূপে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তিনি একটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে চুক্তিটি গ্রহণ করেন। ইরান-ইরাক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে বিষয়টি ছিল প্রধান অন্তরায়। ১৯৩৭ সালে তেহরানের উপকণ্ঠে রেজা শাহের সাদাবাদ প্রাসাদে তুরস্ক, ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা সাদাবাদ চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারি দেশসমূহ একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার এবং যেকোন বিরোধ পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার অঙ্গীকার করে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আরব দেশের সাথে ইরানের বৈদেশিক সম্পর্ক ছিল একেবারেই সীমিত। ম্যান্ডেটরি শাসনাধীনে সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনের পক্ষে স্বাধীন বিদেশ নীতি পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। মিশরের সাথে উল্লেখ করার মত কোন বৈদেশিক সম্পর্ক ইরানের ছিল না। তবে রেজা শাহ ১৯৩৯ সালে মিশরের বাদশাহ ফারুকের বোনের সাথে নিজ পুত্র মুহাম্মদ রেজা শাহের বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একমাত্র হজ্জের সময় হজ্জ্ব যাত্রাকে কেন্দ্র করে সউদি আরবের সাথে সাময়িক সম্পর্কের কথা বাদ দিলে ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত আরবিয় উপদ্বীপের দেশসমূহের সাথে ইরানের কোন বৈদেশিক সম্পর্ক ছিল না । আর জাতিগত প্রার্থক্য থাকায় আরব দেশগুলোর সাধারণ সমস্যার সাথেও ইরানের কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাই ফিলিস্তিনি আরবদের সংগ্রামে ইরান নিজেকে জড়ানোর তাগিদ অনুভব করেন নি। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের মতই ইরানের বিদেশ নীতিও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে নয়, বরং বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে তার সম্পর্ককে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিল ।
রেজা শাহ মার্কিন-ইরান সম্পর্ক বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন। স্বদেশবাসী অনেকের মত তিনিও বিশ্বাস করতেন ব্রিটেন ও রাশিয়া ছাড়াও তৃতীয় আরেকটি বৃহৎ শক্তির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ইরানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষায় সহায়ক হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে অব্যাহতভাবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। এ নীতির ফল হিসেবেই ১৯২২ সালে ইরানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য মার্কিন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. আর্থার সি মিলসপকে আমন্ত্রণ জানানো হয় । রেজা শাহের প্রত্যাশা ছিল এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্ক গভীরতা লাভ করবে। কিন্তু ইরানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনীহা ছিল লক্ষণীয়। কেননা দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল অন্তর্মুখিতা। এ সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিশেষত ব্রিটিশ প্রভাবিত অঞ্চল হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুসম্পর্ক অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়ে রেজা ব্রিটিশ তেল কোম্পানীগুলোর বিপরীত ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলিকে ইরানে তেল অনুসন্ধানেও জড়িত করার পদক্ষেপ নেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৩৭ সালে ইরান সরকার আমেরিকান অয়েল কোম্পানীকে উত্তরাঞ্চলে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অনুমতি প্রদান করে। তবে বিশ্বমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে কোম্পানী তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে নি। ১৯৩৮ সালে কোম্পানি ইরানে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অধিকার পরিত্যাগ করে। তারপরও রেজা শাহ হাল ছাড়েন নি। তিনি ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পাদিত বাণিজ্য ও নৌ চলাচল সংক্রান্ত চুক্তির অনুরূপ একটি চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পাদনের চেষ্টা করেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও এ ব্যাপারে কোন সাড়া পাওয়া যায় নি। ফলে পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়। তাই চূড়ান্ত বিচারে রেজা শাহকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সীমিত পর্যায়ে কুটনৈতিক সম্পর্ক ও সামান্য পরিমাণে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত দুটি বৃহৎ পরাশক্তির বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের ব্যবহারের উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে যদিও রেজা শাহের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিদেশ নীতিতে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না ।
রেজা শাহের বিদেশ নীতিতে ব্রিটেনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ইরানে ব্রিটিশ কূটনৈতিক অবস্থা দুই ভাবে পরিচালিত হত। একদিকে তেহরানস্থ ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে ব্রিটেন ইরান সরকারের সাথে তার সম্পর্ক রক্ষা করত। অন্য দিকে স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রাদেশিক শাসক ও শক্তিশালী যাযাবর গোত্রগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখত। এমনকি রেজা শাহের ক্ষমতা গ্রহণের পরও এ অবস্থার তেমন একটি হেরফের হয় নি। তবে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার যথেষ্ট উপাদান বিদ্যমান ছিল। (এ) তেল সমৃদ্ধ বাহরাইন দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে সম্পর্ক শীতলতার দিকে গড়ায়। ১৯২৭ সালে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইরান বাহরাইনের উপর তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে। কিন্তু ব্রিটেন এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে । ফলে উভয় দেশের মধ্যে ভয়াবহ রকমের বৈরী সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। (বি) ১৯২৮ সালের মধ্যে আরো কিছু বিবদমান বিষয় ইঙ্গ-ইরানি সম্পর্কে শীতল বাতাস প্রবাহিত করছিল। ইরানের উপকুলীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে ভারতের সাথে বিমান চলাচলের ব্রিটিশ দাবি ইরান প্রত্যাখ্যান করে। অথচ এ সময় ইরান জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিমান চলাচল সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। (সি) তেল সমৃদ্ধ খুজিস্থানের শাসক শেখ খাজয়াল ছিলেন ব্রিটিশ আশীর্বাদপুষ্ট। রেজা শাহ ইরানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে খাজয়ালের ক্ষমতা খর্ব করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যা ব্রিটেনের মনঃপুত হয় নি । (ডি) ১৯২৮ সালে রেজা শাহ একতরফাভাবে Capitulation বাতিল করলে ব্রিটেন তার নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। (ই) রেজা শাহ কর্তৃক এসব পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিবাদে ব্রিটেন ইরানের নিকট প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গঠিত সাউথ পার্সিয়ান রাইফেলস গঠনের জন্য প্রদত্ত ঋণ পরিশোধের দাবী জানায়। ব্রিটেনের এ আচরণের প্রতিবাদে ইরান সরকার ইরাকে ব্রিটেনের মদদপুষ্ট সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। এছাড়া শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়েও উভয় দেশের মধ্যে মতদ্বৈততা ছিল। ইরান ও ব্রিটেনের মধ্যে এক চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন ইরানের কয়েকটি বন্দরে শুল্ক আদায় করার অধিকার পেলেও রেজা শাহ তা বাতিল করে শুল্ক আদায়ের ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। (এফ) অবশেষে ১৯২৮ সালের ১৬ মে উভয় দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে (‘এ’ থেকে 'ই' পর্যন্ত) সমস্যাগুলোর সমাধান করা হয়। উভয় দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে। চুক্তিটির মাধ্যমে ইরানে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ সংরক্ষণের কথা স্বীকার করে নেয় ইরান। ব্রিটিশ সরকারও Capitulation বাতিল সংক্রান্ত ইরান সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন জানায়। এ চুক্তি ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বিমান চলাচলের অনুমতি প্রদান করে। ব্রিটেন থেকে যুদ্ধ জাহাজ ক্রয়েও ইরান রাজী হয়। এক্ষেত্রে রেজা শাহের বিদেশ নীতি সফল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন ।
কিন্তু ১৯৩২ সালে ইরান-ব্রিটেনের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি লক্ষ্য করা যায়। ১৯৩২ সালে নতুন একটি সমস্যা উভয় দেশের সম্পর্ককে তিক্ততার চরম সীমায় পৌছে দেয়। সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য এর প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন। ১৯০১ সালের ২৮ মে ইরানের তৎকালীন বাদশাহ মোজাফফর উদ্দিন শাহ ব্রিটিশ ব্যবসায়ী উইলিয়াম নক্সডি আর্চিকে ১৬% রয়েলিটি প্রদানের বিনিময়ে ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় ৫টি প্রদেশ ছাড়া সমগ্র ইরানে ৬০ বছরের জন্য তৈল অনুসন্ধান, উত্তোলন, পরিশোধন, বহন ও বাজারজাতকরণের অনুমতি প্ৰদান করেন। ১৯০৮ সালে ইরানের মসজিদ-ই-সুলায়মান নামক স্থানে তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯০৯ সালে এ তেল উত্তোলনের জন্য ইঙ্গ-ইরানি তেল কোম্পানী গঠিত হয়। ১৯১০ সালে ব্রিটিশ নৌবাহিনী জ্বালানী হিসেবে কয়লার পরিবর্তে তেল ব্যবহার শুরু করে। ১৯১৪ সালের ২০ মে কোম্পানির ৫১% শেয়ার কিনে নেয় ব্রিটিশ সরকার। একই দিনে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাথে ও কোম্পানির একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে কোম্পানী পরবর্তী ৩০ বছরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে নির্দিষ্ট মূল্যে অব্যাহতভাবে তেল সরবরাহ করার নিশ্চয়তা প্রদান করে। অল্প কিছুকালের মধ্যেই এ কোম্পানি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রধান উৎসে পরিণত হয়। এভাবে কোম্পানির স্বার্থের সাথে ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৩২ সালে রেজা শাহ ইঙ্গ-ইরানি তেল কোম্পানী কর্তৃক ইরান-সরকারকে দেয় লভ্যাংশের ক্ষেত্রে কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে এ অজুহাতে একতরফাভাবে কোম্পানির সাথে সম্পাদিত ১৯০১ সালের চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। ব্রিটিশ সরকার ইরানকে তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিতে বলে এবং ইরানকে চাপের মধ্যে রাখার জন্য পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ জাহাজ প্রেরণ করে । এতে ইরান সম্মত না হওয়ায় বিষয়টি ব্রিটেন “Permanent court of International Justice”-এ উপস্থাপন করে। কিন্তু ১৯০৬ সালে ইরানে প্রতিষ্ঠিত শাসনতান্ত্রিক সরকারের পূর্বেকার কোন চুক্তি মেনে নিতে ইরান সরকার বাধ্য না বলে ঘোষণা না করায় ১৯৩২ সালের ১৪ ডিসেম্বর ব্রিটেন এর প্রস্তাবে বিষয়টি লীগ অব নেশনসের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচিত হয়। চেকোশ্লোভাকিয়ার বিদেশ সচিব Rapporteur Edvard Benes-এর প্রস্তাব অনুযায়ী উভয় পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছে। ১৯৩৩ সালের এপ্রিলে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ৬০ বছর মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে ইরানের প্রাপ্ত লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়ানো হয়। কোম্পানির তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের একটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম ইরানের উপকূলবর্তী ব্রিটিশ জ্বালানী কেন্দ্রগুলি সরকারি নিয়ন্ত্রণের নিয়ে আসেন। ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইরানের মুদ্রা ছাপানোর অধিকার বাতিল করে দিয়ে তা ন্যাশনাল ব্যাংক অব ইরানের অধিকারে আনেন। ১৯২১-১৯৪১ সাল পর্যন্ত ইরানের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক ছিল বৈচিত্রপূর্ণ । কখনও তা ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। কখনও আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা দিলেও বাহ্যিক সু-সম্পর্ক বজায়ছিল। আবার কখনও বাহ্যিক সম্পর্ক প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছিল । অবশ্য ব্রিটেনের সাথে যখন ইরানের সম্পর্ক খুব বেশি ভাল যাচ্ছিল না বা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না তখনও তা অন্য যে কোন বৃহৎ শক্তির সাথে সম্পর্কের তুলনায় ভাল ছিল। কেননা ব্রিটিনের নিকট ইরানের ভৌগলিক অবস্থানের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর এ গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। এশিয়ায় কমিউনিজমের প্রসার ঠেকাতে ইরানের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া ব্রিটেনের অন্য কোন উপায় ছিল না। তাই মাঝে মধ্যে ইরান ব্রিটেনে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হলেও সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি কখনো হয় নি। অন্যদিকে রাশিয়ার মত প্রতিবেশী দেশ না হলেও ম্যান্ডেটরী শাসক হিসেবে ইরাকে ব্রিটেনের উপস্থিতি ছিল। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলেও ব্রিটিশ উপস্থিতি ছিল । উত্তর ইরানে রুশ প্রভাব ও দূরভিসন্ধি প্রতিহত করার জন্য ব্রিটেনের এ উপস্থিতি ইরান সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। যা ইরানকে পুরোপুরিভাবে রাশিয়ার প্রভাবাধীন অঞ্চলে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। এছাড়া ঈঙ্গ-ইরানি তেল কোম্পানি কোম্পানি কর্তৃক আবাদানে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল শোধানাগার ইরানের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছিল। প্রচুর সংখ্যক ইরানি নাগরিক প্রতিষ্ঠান দুটিতে কর্মরত ছিল। তাই ইরান তার নিজের স্বার্থের কথা ভেবে ব্রিটেনের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। এক্ষেত্রে রেজা শাহের বিদেশ নীতি সাফল্যমন্ডিত ছিল-একথা বলা যায়। রেজা শাহের বিদেশ নীতিতে ইরান- জার্মানি সম্পর্কও বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করে। ইরানে ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রভাব খর্বর করার জন্য একটি তৃতীয় শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রথম প্রচেষ্টা বিফল হলেও রেজা শাহ দ্বিতীয় প্রচেষ্টা হিসেবে জার্মানির সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। জার্মানির সাথে ইরানের সম্পর্কের সূচনাটি অবশ্য ব্রিটেনকে দিয়েই শুরু হয়েছিল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে পরাজিত ও ধ্বংস প্রায় জার্মানী মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছিল। এমতাবস্থায় দেশটির কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পেক্ষাপটে সেখানে যাতে কমিউনিজমের বিস্তার না ঘটে সেজন্য ব্রিটেন জার্মানির অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার নীতি গ্রহণ করে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য ব্রিটেন তার প্রভাবিত রাষ্ট্রগুলিকে নিজ নিজ দেশে জার্মানির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যর ক্ষেত্র প্রস্তুত করার নির্দেশ দেয়। ব্রিটেনের পরামর্শ অনুযায়ী রেজা শাহ জার্মানির ব্যবসা বাণিজ্য ও পুঁজি বিনিয়োগের জন্য ইরানের দরজা খুলে দেন। কিন্তু হিটলারের আবির্ভাবের পর ব্রিটেনের জার্মান নীতিতে পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটেন ইরানসহ তার অনুগত দেশগুলিকে জার্মানির সাথে তাদের সম্পর্ককে ব্রিটেনের নতুন নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নেয়ার নির্দেশ দেয়। এসব দেশ থেকে জার্মান বিশেষজ্ঞদের বহিষ্কারের জন্য ব্রিটেনকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানের আবির্ভাবের ব্যাপারে আশাবাদী রেজা শাহ দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্র ব্রিটেনের পরামর্শকে উপেক্ষা করে জার্মানির সাথে সু-সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। ১৯২৮ সাল থেকে ইরান জার্মানির কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা পেতে থাকে। হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের পর তা আরো বৃদ্ধি পায় ৷
১৯২৭ সালে রেজা শাহ জার্মান অর্থনীতিবিদ ড. লিন্ডেন ব্লাটকে উপদেষ্টা নিযুক্ত করেন। ইরানের যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প ক্ষেত্রে, দালান কোঠা ও হাসপাতাল নির্মাণ থেকে শুরু করে কৃষি সহ সকল ক্ষেত্রে জার্মান সহযোগিতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাশিয়ার সাথে ইরানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক হ্রাস পাওয়ার ফলে যে শূন্যতায় সৃষ্টি হয় তা পূরণ করে জার্মানি। উভয়দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। ১৯২৫-২৯ সালে যেখানে জার্মানিতে ইরানের Non-Oil- export এর পরিমাণ ছিল শতকরা মাত্র ১ ভাগ। সেখানে ১৯৩৫-১৯৩৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ৩২ ভাগে। ইরান ও ইউরোপের মধ্যে ডাক যোগাযোগের জন্য জার্মান ইয়ানকার্স কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়। ১৯৩৫ সালে তেহরানে উভয় দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মধ্যেকার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সৌজন্য সফর সম্পর্ককে আরো গভীর করে তোলে। ১৯৩৯ সালে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৪১ ভাগ পরিচালিত হচ্ছে জার্মানির সাথে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইরানে অবস্থানরত জার্মান প্রযুক্তিবিদ, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০০-এ। এ সময় ইরানে নাৎসি প্রচার প্রচারণা ব্যাপক সফলতা লাভ করে। জার্মানির পক্ষ থেকে এ প্রচারণাকে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি দেয়ার চেষ্টা করা হয়। বলা হল যে, উভয় দেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক উৎস এক। তাদের শরীরে খাঁটি আর্য রক্ত প্রবাহিত । এবং তারা একই ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক মতাদর্শগত দিক থেকেও দেশ দুটির মধ্যে মিল রয়েছে। কেননা দুটি দেশেই দুজন আলোক প্রাপ্ত শাসকের নেতৃত্বে তাদের সাধারণ শত্রু কমিউনিজমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর। ইরানকে কমিউনিজমের কবল থেকে রক্ষার জন্য রেজা শাহ জার্মানির এসব প্রচারণাকে সমর্থন করেন। রেজা শাহের এ নীতির ফলে ইরানে ব্রিটিশ ও রুশ প্রভাব খর্ব হয়ে জার্মান প্রভাব বৃদ্ধি পায়। জার্মানীর সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপনে রেজা শাহের বিদেশ নীতি সফল হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন রেজা শাহের বিদেশ নীতিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৩৯ সালে জার্মানীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এরপর ১৯৪১ সালে জুন মাসে জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নি। বরং কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ অভিযানে তারা হয়ত কিছুটা খুশিই হয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই ব্রিটেন ও ফ্রান্সের টনক নড়ল যখন তারা হিটলারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নীতি সম্পর্কে জানতে পারল। সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল খনিগুলি দখল করে ইউরোপীয় শত্রু রাষ্ট্রগুলোর এশীয় উপনিবেশসমূহে আঘাত হানাই ছিল হিটলারের মধ্যপ্রাচ্য নীতির মূল লক্ষ্য। হিটলারের এ মধ্যপ্রাচ্য নীতি ফাঁস হয়ে গেলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায়। দেশের এ দুর্যোগময় মুহূর্তে সোভিয়েত নেতা স্টালিনও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ভুলে গিয়ে পুঁজিবাদী ও উপনিবেশবাদী দেশসমূহের সহযোগিতা আগ্রহভরে গ্রহণ করলেন। এ দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ইরান যুদ্ধে তার নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে এবং ইরানের ভূ-খণ্ড কোন বিদেশী রাষ্ট্রকে ব্যবহারের অনুমতি প্রদানে অস্বীকৃত জানায়। প্রকৃতপক্ষে ইরানের এ নীতি ছিল জার্মানির জন্য সুবিধাজনক। কেননা জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তৃতীয় কোন দেশ হতে সাহায্য পাঠানোর সম্ভাব্য পথ ছিল ৪টি। মুরমানস্ক, ভ্লাদিভস্তক, দার্দানেলিস-বসফরাস প্রণালী ও ইরান। মুরমানস্ক ও ভ্লাদিভস্তকের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য পাঠানো সম্ভব ছিল না। আর যুদ্ধের সময় তুরস্ক দার্দানেলিস ও বয়ফরাস প্রণালী দুটি বন্ধ করে দিয়েছিল। জোর পূর্বক এ দুটি প্রণালী খুলে দিতে তুরস্ককে বাধ্য করার অর্থ হবে তুরস্কের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া যার পরিণামে জার্মানির শক্তি বৃদ্ধি করত। একমাত্র বিকল্প হিসেবে বাকি রইল ইরান। ইরানে ছিল সকল মৌসুমে বিপুল পরিমাণে রসদ ও সৈন্য প্রেরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ইরানের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম প্রেরণের এ প্রয়াসে ইরানে অবস্থানরত জার্মান প্রযুক্তিবিদরা নস্যাত করে দিতে পারে এ আশঙ্কায় ১৯৪১ সালের জুন ও আগস্ট মাসে সোভিয়েত রাশিয়া ও ব্রিটেন ইরান হতে জার্মান নাগরিকদের বহিষ্কার করার জন্য ইরান সরকার দুই দফায় অনুরোধ করে। রেজা শাহের প্রত্যাখ্যানের ফলে এ অনুরোধ আদেশে পরিণত হয়। উল্লেখ্য যে, হিটলারের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী রেজা শাহ তার পুরনো ও সুদীর্ঘকালের বন্ধু ব্রিটেন ও রাশিয়ার নির্দেশ অমান্য করলেন। এদিকে হিটলারের অভিযানকে প্রতিহত করতে সামান্য বিলম্ব করার অর্থ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ক্ষেত্রগুলি জার্মানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া। তাই ১৯৪১ সালের ২৫ আগস্ট ব্রিটেন ও রাশিয়া ইরান আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। পূর্বের মতই রাশিয়া ইরানের উত্তরাঞ্চল ও ব্রিটেন দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করে। ইরানের রাজধানী শহর তেহরান নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয়। ব্রিটেন ও সোভিয়েত শক্তির চাপে রেজা শাহ তার ২০ বছর বয়সী পুত্র মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর অনুকূলে ক্ষমতা ত্যাগ করেন । এরপর তাকে একটি ব্রিটিশ জাহাজে করে মরিশাস দ্বীপ এবং পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৯৪৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্য দিয়ে রেজাশাহের বর্ণাঢ্য বিদেশ নীতির অবসান ঘটে।
মূলতঃ ১৯২৩ সালে রেজা শাহ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে ইরানের বিদেশ নীতিতে একটি নতুন ধারার সূচনা হয়। বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক ছিলেন। তার বিদেশ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, ইরান থেকে বিদেশি আধিপত্যের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং ইঙ্গ-ফরাসী প্রভাব বলয় থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। বিশ শতকের গোড়া থেকেই বৃহৎ শক্তিবর্গ ইরানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রভাব বিস্তারে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ব্রিটেন ও রাশিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানি এবং যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দেয়। এসব দেশের মধ্যে প্রতিবেশি দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের বিদেশ নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
উপরন্তু, ইরানের মহানায়ক রেজা শাহ তার দীর্ঘ শাসনামলে ইরানের বৈদেশিক নীতিকে একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইরানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাককালে ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রতি তার পররাষ্ট্র নীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একমাত্র রেজা শাহের দূরদর্শি ও সফল বৈদেশিক নীতির ফলে দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তীকালে ইরানে ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস পেয়েছিল এ মন্তব্য যথার্থ ও সমীচীন নয় । সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি, ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দেশ দুটির বৈদেশিক নীতিও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। অন্যভাবে বলা যায় যে, ব্রিটেন ও রাশিয়া যতদিন চেয়েছিল ঠিক ততদিনই রেজা শাহের পক্ষে ইরানকে বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত রাখায় রেজা শাহের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তবে একথা সত্য যে, কাজার আমলে ইরানে বৈদেশিক শক্তিসমূহের প্রভাব রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং রেজা শাহ ইরানকে সে অবস্থা হতে মুক্ত করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি ইরানের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ দিক থেকে রেজা শাহের বিদেশ নীতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]