রেজা শাহের বিদেশনীতি

মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বহুবিধ কারণে রেজাশাহ বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। তিনি শুধু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই সংস্কার সাধন করেন নি; ইরানের বিদেশ নীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২১ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রেজা শাহ ইরানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। তার রাজত্বকাল (১৯২১-১৯৪১) ইরানের বৈদেশিক নীতির জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা এ সময়ে ইরানের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দুই দশক ব্যাপী বিস্তৃত রেজা শাহের শাসনামলে ইরানের বিদেশনীতিতে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন-বৃহৎ শক্তিবর্গের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের নীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করার নীতি । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
রেজা শাহ প্রথমেই বৃহৎ দেশগুলির সাথে ইরানের সম্পর্কোন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৯২৩ সালে রেজা শাহ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ায় পর থেকে ইরানের বিদেশ নীতিতে একটি নতুন ধারার সূচনা হয়। বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক হয়ে উঠেন। তার বিদেশ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল-ইরান থেকে বিদেশি আধিপত্যের অবসান এবং ইঙ্গ-সোভিয়েত প্রভাব বলয় থেকে দেশকে মুক্ত করা । বিশ শতকের গোড়া থেকেই বৃহৎ শক্তিবর্গ ইরানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এ আধিপত্য বিস্তারে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল ব্রিটেন ও রাশিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানি এবং যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দেয়। এসব দেশের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের বিদেশ নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।
ইরান-সোভিয়েত সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, রেজা শাহ ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ইরান সোভিয়েত সম্পর্কে পরিবর্তন সূচিত হয়। রেজা শাহের সামরিক অভ্যুত্থানের মাত্র ৫ দিন পর ১৯২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইরান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯১৯ সালে সম্পাদিত ইঙ্গ-ইরান চুক্তির বিপরীতে এ চুক্তিটি ছিল ইরানি জনগণের প্রতি বন্ধুত্ব ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের পরিচায়ক। এ চুক্তিতে বলা হয়;
(১) জারের আমল থেকে রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে যে সকল সুয়োগ সুবিধা পেয়ে আসছিল তা পরিত্যাগ করবে। অর্থাৎ চুক্তিটিতে রাশিয়া দ্ব্যর্থকণ্ঠে ইরানে তার পুরনো সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ পরিত্যাগের ঘোষণা দেয়। তবে শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, রশিয়া কর্তৃক পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধাগুলি ইরান তার জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করবে। অন্যকোন বৈদেশিক শক্তিকে তা প্রদান করতে পারবে না।
(২) ইরানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানতে পারে এমন কোন কাজ রাশিয়া করবে না।
(৩) উভয় দেশ একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করবে না।
(৪) ১৮৮১ সালে যে রুশ-পারস্য সীমানা নির্ধারিত হয় তা বলবৎ করা হবে। সেই সাথে কাম্পিয়ান সাগরের দক্ষিণাঞ্চলে আওবাদা এবং অন্যান্য দ্বিপাঞ্চলে রাশিয়া তাবেদারি পরিত্যাগ করবে। পারস্য সাগরের উপর রুশ কর্তৃত্ব মেনে নিবে। এছাড়া আটারাক নদীসহ সীমান্ত নদীসমূহ রাশিয়া ও পারস্য উভয়েই ব্যবহার করতে পারবে। সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যৌথ কমিশন গঠন করা হবে।
(৫) উভয় দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে তারা নিম্নে বর্ণিত কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকবে;
(i) পারস্য ও রাশিয়া উভয়ে উভয়ের স্বার্থ বিরোধী কোন সংগঠন বা গোষ্ঠী গঠনে সহায়তা করবে না। অথবা এ দুদেশের মিত্রদের বিরুদ্ধে কোন বিরোধী বা সন্ত্রাসী দল গঠন করতে সাহায্য করবে না।
(ii) উভয় দেশের অভ্যন্তরে অপর কোন তৃতীয় শক্তির উপস্থিতি বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে এমন কোন শক্তি যা সীমান্ত লংঘনের হুমকি দিতে পারে।
(iii) উভয় অঞ্চল দিয়ে অপর কোন দেশের মালামাল স্থানান্তরিত করা যাবে না। যা উভয়ের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে।
(৬) যদি কোন তৃতীয় শক্তি অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে পারস্য আক্রমণের পরিকল্পনা করে অথবা কোন বিদেশী শক্তি রুশ-পারস্য সীমান্ত ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ালে পারস্য সরকার যদি তা নিরসনে ব্যর্থ হয় তাহলে পারস্য সরকারের অনুরোধে রুশ সরকার পারস্যে সৈন্য পাঠিয়ে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। অবশ্য আগ্রাসন বন্ধ হয়ে গেলে রুশ সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে ।
(৭) উপরোক্ত অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তানুযায়ী কম্পিয়ান সাগরে অবস্থানরত রাশিয়ার বিরোধীতাকারী পারস্য নৌবহরে অংশগ্রহণকারী বিদেশিদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হবে।
(৮) জার সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত রাশিয়ার অর্থনৈতিক নীতি বর্জন করে পারস্যকে পূর্বের মত ঋণ প্রদান করে রাশিয়ার অধীন করা হবে। পূর্বের সমস্ত ঋণ ও অনুদান বাতিল বলে গণ্য হবে।
(৯) রাশিয়া ডিসকাউন্ট ব্যাংকের সম্পদ, দায়-দেনা পারস্যকে ছেড়ে দিবে। কিন্তু মাত্র একটি বাড়ি রুশ কনসুলেটের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
(১০) রাশিয়া তার নির্মিত এনজেলী তেহরান এবং কামউইন-হামাদন সড়ক, জুলফা-তাব্রিজ, সুফিয়ান-উমুরিয়া রেল পথ, উমুরিয়া হ্রদের বার্জগুলি, টেলিফোন লাইন, টেলিগ্রাফ লাইন, এজেন্সী নৌবহর এবং বৈদ্যুতিক কেন্দ্রসমূহ পারস্যকে অর্পণ করবে।
(১১) ১৮২৮ সালের রাশিয়ার সাথে পারস্যের ঘৃণ্য তাকুমানচাই চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করা হবে। এবং কাম্পিয়ান সাগরে ইরানের নৌবহর চলাচল করতে পারবে।
(১২) জার সরকারকে প্রদত্ত সকল সুযোগ-সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে এবং রুশ দখলে ইরানের সকল সম্পত্তি কেবলমাত্র রুশ কনসুলেট ছাড়া ইরান সরকারকে হস্তান্তর করা হবে। রাশিয়া তেহরানের অনতি দূরে জারগানদারের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিবে। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ লিগেশন গুলহাকে অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে।
(১৩) উপরোক্ত অনুচ্ছেদের বরাতে আরো বলা যায় যে, পূর্বের রুশ অধিকৃত কোন অঞ্চল বা রুশ দখলে কোন সম্পত্তি কোন তৃতীয় শক্তিকে দেয়া হবে না। এক্ষেত্রে তৃতীয় শক্তি বলতে ব্রিটিশ সরকারকে বুঝানো হয়েছে।
(১৪) এ অনুচ্ছেদে কাম্পিয়ান সাগরে ইরানী মৎস্যজীবীদের অবাধে মৎস্য শিকারের অধিকার থাকবে।
(১৫) জারের আমলের সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাতিল করা হবে এবং এসকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি স্কুল ও বিদ্যাপীঠ হিসেবে ব্যবহারের জন্য ইরান কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করতে হবে।
(১৬) এ অনুচ্ছেদের সর্বপ্রকার অতি রাষ্ট্রিক অধিকার বর্জিত হবে।
(১৭) উভয় দেশের নাবিকদের সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ অথবা এর পরিবর্তে অর্থ দানের যে নীতি ছিল তা থেকে জনগণকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
(১৮) উভয় দেশের নাগরিকদের পারস্পরিক দেশ ভ্রমণের সমান সুযোগ থাকবে এবং এর মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধুসুলভ আচরণ গড়ে উঠবে।
(১৯) এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার অল্প দিনের মধ্যে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। আমদানি-রপ্তানি, অর্থবিনিয়োগ, পরিশোধ ব্যবস্থা ও শুল্ক ইত্যাদি উভয় দেশের প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত বাণিজ্যিক কমিশন নির্ধারণ করবে।
(২০) আন্তর্জাতিক নিয়ম মাফিক মাল পারাপারের জন্য উভয় দেশের সমান অধিকার থাকবে।
(২১) উভয় দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ চালু করা হবে।
(২২) উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য দূত বিনিময় করা হবে।
(২৩) উপরের ধারার বাস্তবায়নে উভয় দেশের কনসুলেট প্রতিষ্ঠিত হবে। এ চুক্তি উভয়দেশ কর্তৃক তিন মাসের মধ্যে অনুমোদিত হবে।
(২৫) চুক্তিটি রুশ ও পারস্য উভয় ভাষায় লিপিবদ্ধ হবে। যাতে উভয় দেশের জনগণ এ চুক্তির মর্ম উপলব্ধি করতে পারে ।
সুতরাং, এ চুক্তি ইরানের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে। কেননা চুক্তিটি ছিল সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পাদিত একটি চুক্তি। এ সময় রাশিয়া তার অভ্যন্তরীণ সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যস্ত ছিল। রুশ বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতি রাশিয়াকে চুক্তিটি সম্পাদনে বাধ্য করেছিল। ফলে রাশিয়া সাময়িকভাবে হলেও পারস্য উপসাগরে তার চিরন্তন সাম্রাজ্যবাদি নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবে সোভিয়েত বিরোধী আগ্রাসন মোকাবেলায় ইরানে রাশিয়ার সৈন্য পাঠানোর অধিকার সংক্রান্ত ধারাটির মধ্যে কিছুটা পুরাতন সাম্রাজ্যবাদি চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। যাহোক, এ চুক্তির সুফল হিসেবে ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে জিলান থেকে সোভিয়েত সৈন্য অপসারিত হয়। এবং রেজা শাহের পক্ষে জিলানের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা কুচিকখানকে দমন করা সম্ভব হয়। ১৯২১ সালের চুক্তির পর দুটি দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তখনও কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। এ ক্ষেত্রে রেজা শাহের সময়ের বিদেশ নীতি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। (এ) জিলানের বিদ্রোহের ঘটনা ছাড়াও ইরানের আজারবাইজান ও খোরাসানের বিদ্রোহগুলি সংঘটিত হয়েছিল সোভিয়েত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। ফলে রেজা শাহের পক্ষে এসব বিদ্রোহের পিছনে সোভিয়েত ইন্ধন রয়েছে তা ভাবার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ ছিল। এসব বিদ্রোহ ইরানকে রাশিয়ার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাতে বাধ্য করেছিল ।
(বি) কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি গ্রহণের ফলে ইরানের কমুনিস্ট পার্টি গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। রেজা শাহের এ কমুনিস্ট বিরোধী বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাশিয়ার বিরক্তির উদ্রেক করে। অথচ ব্রিটিশ সমর্থনে রেজা শাহ যখন ইরানের ক্ষমতা দখল করেছিলেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়েছিল। কেননা সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টিতে রেজা শাহের ক্ষমতা দখল ছিল সামন্তবাদ বিরোধী আধা বুর্জোয়া বিপ্লব, যা ক্রমান্বয়ে মার্কসীয় বিপ্লবের পথ ধরে এগুবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে যখন রেজা শাহ কমিউনিস্টদের দমনে অগ্রসর হলেন তখন রাশিয়ার পক্ষে অনুশোচনা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ।
(সি) কিছু অর্থনৈতিক সমস্যাও ইরান সোভিয়েত সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধ্য সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে ইরানের উত্তরাঞ্চলের তেল সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের বিষয়টি ছিল উল্লেখযোগ্য। উত্তর ইরান থেকে রাশিয়া তার সুযোগ সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর ইরান সরকার উত্তর অঞ্চলে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যাপারে কয়েকটি ব্রিটিশ ও মার্কিন কোম্পানির সাথে চুক্তি সম্পাদন করে। ১৯২১ সালের চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া এর বিরোধীতা করে। কেননা উক্ত চুক্তিতে ইরান-সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিত্যাক্ত সুযোগ সুবিধা অন্য কোন দেশকে প্রদান করবে না বলে অঙ্গীকার করেছিল। ব্রিটেন যুক্তি উপস্থাপন করে যে, চুক্তি সম্পাদনের এ সময় এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল জর্জিয়া, রাশিয়া নয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ব্রিটেনের এ যুক্তি প্রতিষ্ঠা পায় নি। ইরানের রেজা শাহ সরকার রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কায় ১৯২৪ সালে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পাদিত চুক্তিগুলি বাতিল ঘোষণা করে। ১৯৩৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয় নি। ১৯৩৭ সালে ইরান সরকার আমেরিকান অয়েল কোম্পানিকে উত্তরাঞ্চলে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অনুমতি প্রদান করে। সে সময় অবশ্য সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি করা হয় নি। তবে বিরাজমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে কোম্পানি তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে নি। ১৯৩৮ সালে কোম্পানিটি ইরানে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অধিকার পরিত্যাগ করে।
(ডি) দু'দেশের মধ্যে বিবাদের আরেকটি অন্যতম বিষয় ছিল রুশ-ইরান বাণিজ্য । উত্তর ইরানে উৎপাদিত রপ্তানিযোগ্য পণ্যের একমাত্র বাজার ছিল রাশিয়া। অর্থাৎ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উত্তর ইরান ছিল সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। যে কারণে তেহরানে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত Petrovsky বলেছিলেন “আমরা যদি ইরান থেকে দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করা বন্ধ করে দেই তাহলে ইরান এক মাসের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে যাবে। প্রেট্রোভস্কির এ বক্তব্য অযাথার্থ ছিল না । কারণ শুধু রাশিয়ার সাথেই উত্তর ইরানের রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালিত হত। ইরানের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিয়া একাধিকবার তার এ অর্থনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ১৯২৬ সালে কাম্পিয়ান সাগরে মৎস্য শিকারের অধিকার নিয়ে ইরানের সাথে বিরোধ দেখা দিলে রাশিয়া ইরান থেকে একমাত্র তুলা ছাড়া সব ধরনের পণ্য সামগ্রী আমদানি বন্ধ করে দেয়। এর সাথে ইরানের উত্তর অঞ্চল মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। অবশেষে ১৯২৭ সালে ইরান সরকার কাম্পিয়ান সাগরে মৎস্য শিকারের ব্যাপারে রাশিয়ার দাবীর অনুকূলে একটি চুক্তি পায়। উত্তর ইরানে অর্থনীতির উপর রাশিয়ার প্রভাব এত বেশি ছিল যে, ইচ্ছা করলেই রাশিয়া বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট করতে পারত। গোটা বিশের দশক জুড়ে প্রতিনিয়তই ইরান রাশিয়ার দ্বারা এ ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছে। রাশিয়ার বহিঃবাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকায় ইরানের ব্যবসায়ীরা এ অবস্থার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। এ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ১৯৩১ সালে রেজা শাহ বহিঃবাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে জার্মানিতে হিটলারের আবির্ভাব এবং ইরান সরকারের সাথে নাজি সরকারের সম্পর্কোন্নয়নের ফলে রাশিয়ার পরিবর্তে জার্মানীর সাথে ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পরিচালিত হতে থাকে। বলশেভিক বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ায় ইরানের ‘Non-Oil-Export'-এর পরিমাণ ছিল শতকরা ৭০ভাগ। ১৯২১-১৯৪১ সালে এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। ১৯২৫- ১৯২৯ সালে এর পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ৪০ ভাগে এবং ১৯৩০- ১৯৩৪ সালে ২৭ ভাগে। এরপর থেকে ১৯৪১ সালে রেজা শাহের সিংহাসন ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত এর পরিমাণ আরো কমে শতকরা ২১ ভাগে নেমে আসে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো সুদূরীকরণের জন্য ইরান বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। রেজা শাহের শাসনামলে ইরান তার প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। তুরস্ক ও আফগানিস্থানের সাথে ইরানের শত্রুতা ছিল দীর্ঘদিনের। ১৯২৬ সালের ২২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ইরান, তুরস্ক ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অস্বস্তিকর কুর্দি সমস্যা আন্ধারা ও তেহরানের মধ্যকার চূড়ান্ত বিরোধ নিস্পত্তির ক্ষেত্রে ছিল প্রধান অন্তরায়। ১৯৩০ সালের জুন ও জুলাই মাসে সংঘটিত কুর্দি বিদ্রোহ সমস্যটিকে আরো প্রকট করে তোলে। এবং আপোষ নিষ্পত্তির বিষয়টিকে বেশ খানিকটা প্রলম্বিত করে। তারপরও দুটি দেশের প্রতিবেশি সুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা থেকেই ১৯৩২ সালে বিদ্যমান সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটে। প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্থানের সাথেও ইরানের সীমান্ত বিরোধ ছিল। ১৯২৫ সালে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ বিরোধী মিটিয়ে ফেলা হয়। ১৯২১ সালে আফগানিস্তানের বাদশাহ আমান উল্লাহর ইরান সফর দু'দেশের সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ট করে তোলে। প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরাকের সাথে ইরানের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। শাত-ইল-আরব এলাকার সীমান্ত নির্ধারণের সমস্যা এ বিরোধকে জিইয়ে রেখেছিল। ১৮৪৭ সালে সম্পাদিত অরজুরাম চুক্তি অনুসারে ওসমানিয় সাম্রাজ্যের সীমানা শাত-ইল-আরবের পূর্ব উপকূলে স্থির হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ম্যান্ডটাধীনে ইরাক উত্তরাধিকার সূত্রে এ সীমানা লাভ করে। তাই শাত-ইল-আরবের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ইরানি বন্দর খুররম শহরের পক্ষে ইরাকি জলপথ ব্যবহার করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। সঙ্গত কারণেই ইরানের পক্ষে এ সীমানা মেনে নেয়া সম্ভবপর ছিল না। কেননা শাত -ইল-আরব তীরবর্তী ইরানি বন্দর খুররম শহরে প্রবেশ ও বন্দর হতে বের হতে হলে ইরানি জাহাজকে ইরাকি জলপথ ব্যবহার করতে হত। সীমানা পুননির্ধারণের জন্য ১৯৩৫ সালে ইরান লীগ অব নেশনস এর নিকট আবেদন করে। কিন্তু তারপরেও বিষয়টি নিষ্পত্তি হয় নি। অবশেষে ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে একটি অন্তবর্তীকালীন চুক্তির মাধ্যমে ইরানের আবদান তৈল শোধনাগারের নিকট শাত ইল-আরবের মাঝ বরাবর ইরাক ইরান সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়। এ চুক্তিও রেজা শাহের নিকট সম্পন্নরূপে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তিনি একটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে চুক্তিটি গ্রহণ করেন। ইরান-ইরাক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে বিষয়টি ছিল প্রধান অন্তরায়। ১৯৩৭ সালে তেহরানের উপকণ্ঠে রেজা শাহের সাদাবাদ প্রাসাদে তুরস্ক, ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা সাদাবাদ চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারি দেশসমূহ একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার এবং যেকোন বিরোধ পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার অঙ্গীকার করে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আরব দেশের সাথে ইরানের বৈদেশিক সম্পর্ক ছিল একেবারেই সীমিত। ম্যান্ডেটরি শাসনাধীনে সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনের পক্ষে স্বাধীন বিদেশ নীতি পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। মিশরের সাথে উল্লেখ করার মত কোন বৈদেশিক সম্পর্ক ইরানের ছিল না। তবে রেজা শাহ ১৯৩৯ সালে মিশরের বাদশাহ ফারুকের বোনের সাথে নিজ পুত্র মুহাম্মদ রেজা শাহের বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একমাত্র হজ্জের সময় হজ্জ্ব যাত্রাকে কেন্দ্র করে সউদি আরবের সাথে সাময়িক সম্পর্কের কথা বাদ দিলে ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত আরবিয় উপদ্বীপের দেশসমূহের সাথে ইরানের কোন বৈদেশিক সম্পর্ক ছিল না । আর জাতিগত প্রার্থক্য থাকায় আরব দেশগুলোর সাধারণ সমস্যার সাথেও ইরানের কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাই ফিলিস্তিনি আরবদের সংগ্রামে ইরান নিজেকে জড়ানোর তাগিদ অনুভব করেন নি। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের মতই ইরানের বিদেশ নীতিও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে নয়, বরং বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে তার সম্পর্ককে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিল ।
রেজা শাহ মার্কিন-ইরান সম্পর্ক বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন। স্বদেশবাসী অনেকের মত তিনিও বিশ্বাস করতেন ব্রিটেন ও রাশিয়া ছাড়াও তৃতীয় আরেকটি বৃহৎ শক্তির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ইরানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষায় সহায়ক হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে অব্যাহতভাবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। এ নীতির ফল হিসেবেই ১৯২২ সালে ইরানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য মার্কিন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. আর্থার সি মিলসপকে আমন্ত্রণ জানানো হয় । রেজা শাহের প্রত্যাশা ছিল এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্ক গভীরতা লাভ করবে। কিন্তু ইরানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনীহা ছিল লক্ষণীয়। কেননা দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল অন্তর্মুখিতা। এ সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিশেষত ব্রিটিশ প্রভাবিত অঞ্চল হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুসম্পর্ক অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়ে রেজা ব্রিটিশ তেল কোম্পানীগুলোর বিপরীত ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলিকে ইরানে তেল অনুসন্ধানেও জড়িত করার পদক্ষেপ নেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৩৭ সালে ইরান সরকার আমেরিকান অয়েল কোম্পানীকে উত্তরাঞ্চলে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অনুমতি প্রদান করে। তবে বিশ্বমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে কোম্পানী তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে নি। ১৯৩৮ সালে কোম্পানি ইরানে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অধিকার পরিত্যাগ করে। তারপরও রেজা শাহ হাল ছাড়েন নি। তিনি ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পাদিত বাণিজ্য ও নৌ চলাচল সংক্রান্ত চুক্তির অনুরূপ একটি চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পাদনের চেষ্টা করেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও এ ব্যাপারে কোন সাড়া পাওয়া যায় নি। ফলে পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়। তাই চূড়ান্ত বিচারে রেজা শাহকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সীমিত পর্যায়ে কুটনৈতিক সম্পর্ক ও সামান্য পরিমাণে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত দুটি বৃহৎ পরাশক্তির বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের ব্যবহারের উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে যদিও রেজা শাহের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিদেশ নীতিতে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না ।
রেজা শাহের বিদেশ নীতিতে ব্রিটেনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ইরানে ব্রিটিশ কূটনৈতিক অবস্থা দুই ভাবে পরিচালিত হত। একদিকে তেহরানস্থ ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে ব্রিটেন ইরান সরকারের সাথে তার সম্পর্ক রক্ষা করত। অন্য দিকে স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রাদেশিক শাসক ও শক্তিশালী যাযাবর গোত্রগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখত। এমনকি রেজা শাহের ক্ষমতা গ্রহণের পরও এ অবস্থার তেমন একটি হেরফের হয় নি। তবে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার যথেষ্ট উপাদান বিদ্যমান ছিল। (এ) তেল সমৃদ্ধ বাহরাইন দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে সম্পর্ক শীতলতার দিকে গড়ায়। ১৯২৭ সালে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইরান বাহরাইনের উপর তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে। কিন্তু ব্রিটেন এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে । ফলে উভয় দেশের মধ্যে ভয়াবহ রকমের বৈরী সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। (বি) ১৯২৮ সালের মধ্যে আরো কিছু বিবদমান বিষয় ইঙ্গ-ইরানি সম্পর্কে শীতল বাতাস প্রবাহিত করছিল। ইরানের উপকুলীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে ভারতের সাথে বিমান চলাচলের ব্রিটিশ দাবি ইরান প্রত্যাখ্যান করে। অথচ এ সময় ইরান জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিমান চলাচল সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। (সি) তেল সমৃদ্ধ খুজিস্থানের শাসক শেখ খাজয়াল ছিলেন ব্রিটিশ আশীর্বাদপুষ্ট। রেজা শাহ ইরানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে খাজয়ালের ক্ষমতা খর্ব করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যা ব্রিটেনের মনঃপুত হয় নি । (ডি) ১৯২৮ সালে রেজা শাহ একতরফাভাবে Capitulation বাতিল করলে ব্রিটেন তার নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। (ই) রেজা শাহ কর্তৃক এসব পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিবাদে ব্রিটেন ইরানের নিকট প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গঠিত সাউথ পার্সিয়ান রাইফেলস গঠনের জন্য প্রদত্ত ঋণ পরিশোধের দাবী জানায়। ব্রিটেনের এ আচরণের প্রতিবাদে ইরান সরকার ইরাকে ব্রিটেনের মদদপুষ্ট সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। এছাড়া শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়েও উভয় দেশের মধ্যে মতদ্বৈততা ছিল। ইরান ও ব্রিটেনের মধ্যে এক চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন ইরানের কয়েকটি বন্দরে শুল্ক আদায় করার অধিকার পেলেও রেজা শাহ তা বাতিল করে শুল্ক আদায়ের ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। (এফ) অবশেষে ১৯২৮ সালের ১৬ মে উভয় দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে (‘এ’ থেকে 'ই' পর্যন্ত) সমস্যাগুলোর সমাধান করা হয়। উভয় দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে। চুক্তিটির মাধ্যমে ইরানে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ সংরক্ষণের কথা স্বীকার করে নেয় ইরান। ব্রিটিশ সরকারও Capitulation বাতিল সংক্রান্ত ইরান সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন জানায়। এ চুক্তি ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বিমান চলাচলের অনুমতি প্রদান করে। ব্রিটেন থেকে যুদ্ধ জাহাজ ক্রয়েও ইরান রাজী হয়। এক্ষেত্রে রেজা শাহের বিদেশ নীতি সফল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন ।
কিন্তু ১৯৩২ সালে ইরান-ব্রিটেনের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি লক্ষ্য করা যায়। ১৯৩২ সালে নতুন একটি সমস্যা উভয় দেশের সম্পর্ককে তিক্ততার চরম সীমায় পৌছে দেয়। সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য এর প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন। ১৯০১ সালের ২৮ মে ইরানের তৎকালীন বাদশাহ মোজাফফর উদ্দিন শাহ ব্রিটিশ ব্যবসায়ী উইলিয়াম নক্সডি আর্চিকে ১৬% রয়েলিটি প্রদানের বিনিময়ে ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় ৫টি প্রদেশ ছাড়া সমগ্র ইরানে ৬০ বছরের জন্য তৈল অনুসন্ধান, উত্তোলন, পরিশোধন, বহন ও বাজারজাতকরণের অনুমতি প্ৰদান করেন। ১৯০৮ সালে ইরানের মসজিদ-ই-সুলায়মান নামক স্থানে তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯০৯ সালে এ তেল উত্তোলনের জন্য ইঙ্গ-ইরানি তেল কোম্পানী গঠিত হয়। ১৯১০ সালে ব্রিটিশ নৌবাহিনী জ্বালানী হিসেবে কয়লার পরিবর্তে তেল ব্যবহার শুরু করে। ১৯১৪ সালের ২০ মে কোম্পানির ৫১% শেয়ার কিনে নেয় ব্রিটিশ সরকার। একই দিনে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাথে ও কোম্পানির একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে কোম্পানী পরবর্তী ৩০ বছরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে নির্দিষ্ট মূল্যে অব্যাহতভাবে তেল সরবরাহ করার নিশ্চয়তা প্রদান করে। অল্প কিছুকালের মধ্যেই এ কোম্পানি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রধান উৎসে পরিণত হয়। এভাবে কোম্পানির স্বার্থের সাথে ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৩২ সালে রেজা শাহ ইঙ্গ-ইরানি তেল কোম্পানী কর্তৃক ইরান-সরকারকে দেয় লভ্যাংশের ক্ষেত্রে কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে এ অজুহাতে একতরফাভাবে কোম্পানির সাথে সম্পাদিত ১৯০১ সালের চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। ব্রিটিশ সরকার ইরানকে তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিতে বলে এবং ইরানকে চাপের মধ্যে রাখার জন্য পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ জাহাজ প্রেরণ করে । এতে ইরান সম্মত না হওয়ায় বিষয়টি ব্রিটেন “Permanent court of International Justice”-এ উপস্থাপন করে। কিন্তু ১৯০৬ সালে ইরানে প্রতিষ্ঠিত শাসনতান্ত্রিক সরকারের পূর্বেকার কোন চুক্তি মেনে নিতে ইরান সরকার বাধ্য না বলে ঘোষণা না করায় ১৯৩২ সালের ১৪ ডিসেম্বর ব্রিটেন এর প্রস্তাবে বিষয়টি লীগ অব নেশনসের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচিত হয়। চেকোশ্লোভাকিয়ার বিদেশ সচিব Rapporteur Edvard Benes-এর প্রস্তাব অনুযায়ী উভয় পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছে। ১৯৩৩ সালের এপ্রিলে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ৬০ বছর মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে ইরানের প্রাপ্ত লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়ানো হয়। কোম্পানির তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের একটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম ইরানের উপকূলবর্তী ব্রিটিশ জ্বালানী কেন্দ্রগুলি সরকারি নিয়ন্ত্রণের নিয়ে আসেন। ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইরানের মুদ্রা ছাপানোর অধিকার বাতিল করে দিয়ে তা ন্যাশনাল ব্যাংক অব ইরানের অধিকারে আনেন। ১৯২১-১৯৪১ সাল পর্যন্ত ইরানের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক ছিল বৈচিত্রপূর্ণ । কখনও তা ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। কখনও আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা দিলেও বাহ্যিক সু-সম্পর্ক বজায়ছিল। আবার কখনও বাহ্যিক সম্পর্ক প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছিল । অবশ্য ব্রিটেনের সাথে যখন ইরানের সম্পর্ক খুব বেশি ভাল যাচ্ছিল না বা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না তখনও তা অন্য যে কোন বৃহৎ শক্তির সাথে সম্পর্কের তুলনায় ভাল ছিল। কেননা ব্রিটিনের নিকট ইরানের ভৌগলিক অবস্থানের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর এ গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। এশিয়ায় কমিউনিজমের প্রসার ঠেকাতে ইরানের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া ব্রিটেনের অন্য কোন উপায় ছিল না। তাই মাঝে মধ্যে ইরান ব্রিটেনে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হলেও সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি কখনো হয় নি। অন্যদিকে রাশিয়ার মত প্রতিবেশী দেশ না হলেও ম্যান্ডেটরী শাসক হিসেবে ইরাকে ব্রিটেনের উপস্থিতি ছিল। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলেও ব্রিটিশ উপস্থিতি ছিল । উত্তর ইরানে রুশ প্রভাব ও দূরভিসন্ধি প্রতিহত করার জন্য ব্রিটেনের এ উপস্থিতি ইরান সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। যা ইরানকে পুরোপুরিভাবে রাশিয়ার প্রভাবাধীন অঞ্চলে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। এছাড়া ঈঙ্গ-ইরানি তেল কোম্পানি কোম্পানি কর্তৃক আবাদানে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল শোধানাগার ইরানের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছিল। প্রচুর সংখ্যক ইরানি নাগরিক প্রতিষ্ঠান দুটিতে কর্মরত ছিল। তাই ইরান তার নিজের স্বার্থের কথা ভেবে ব্রিটেনের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। এক্ষেত্রে রেজা শাহের বিদেশ নীতি সাফল্যমন্ডিত ছিল-একথা বলা যায়। রেজা শাহের বিদেশ নীতিতে ইরান- জার্মানি সম্পর্কও বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করে। ইরানে ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রভাব খর্বর করার জন্য একটি তৃতীয় শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রথম প্রচেষ্টা বিফল হলেও রেজা শাহ দ্বিতীয় প্রচেষ্টা হিসেবে জার্মানির সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। জার্মানির সাথে ইরানের সম্পর্কের সূচনাটি অবশ্য ব্রিটেনকে দিয়েই শুরু হয়েছিল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে পরাজিত ও ধ্বংস প্রায় জার্মানী মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছিল। এমতাবস্থায় দেশটির কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পেক্ষাপটে সেখানে যাতে কমিউনিজমের বিস্তার না ঘটে সেজন্য ব্রিটেন জার্মানির অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার নীতি গ্রহণ করে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য ব্রিটেন তার প্রভাবিত রাষ্ট্রগুলিকে নিজ নিজ দেশে জার্মানির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যর ক্ষেত্র প্রস্তুত করার নির্দেশ দেয়। ব্রিটেনের পরামর্শ অনুযায়ী রেজা শাহ জার্মানির ব্যবসা বাণিজ্য ও পুঁজি বিনিয়োগের জন্য ইরানের দরজা খুলে দেন। কিন্তু হিটলারের আবির্ভাবের পর ব্রিটেনের জার্মান নীতিতে পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটেন ইরানসহ তার অনুগত দেশগুলিকে জার্মানির সাথে তাদের সম্পর্ককে ব্রিটেনের নতুন নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নেয়ার নির্দেশ দেয়। এসব দেশ থেকে জার্মান বিশেষজ্ঞদের বহিষ্কারের জন্য ব্রিটেনকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানের আবির্ভাবের ব্যাপারে আশাবাদী রেজা শাহ দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্র ব্রিটেনের পরামর্শকে উপেক্ষা করে জার্মানির সাথে সু-সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। ১৯২৮ সাল থেকে ইরান জার্মানির কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা পেতে থাকে। হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের পর তা আরো বৃদ্ধি পায় ৷
১৯২৭ সালে রেজা শাহ জার্মান অর্থনীতিবিদ ড. লিন্ডেন ব্লাটকে উপদেষ্টা নিযুক্ত করেন। ইরানের যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প ক্ষেত্রে, দালান কোঠা ও হাসপাতাল নির্মাণ থেকে শুরু করে কৃষি সহ সকল ক্ষেত্রে জার্মান সহযোগিতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাশিয়ার সাথে ইরানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক হ্রাস পাওয়ার ফলে যে শূন্যতায় সৃষ্টি হয় তা পূরণ করে জার্মানি। উভয়দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। ১৯২৫-২৯ সালে যেখানে জার্মানিতে ইরানের Non-Oil- export এর পরিমাণ ছিল শতকরা মাত্র ১ ভাগ। সেখানে ১৯৩৫-১৯৩৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ৩২ ভাগে। ইরান ও ইউরোপের মধ্যে ডাক যোগাযোগের জন্য জার্মান ইয়ানকার্স কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়। ১৯৩৫ সালে তেহরানে উভয় দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মধ্যেকার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সৌজন্য সফর সম্পর্ককে আরো গভীর করে তোলে। ১৯৩৯ সালে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৪১ ভাগ পরিচালিত হচ্ছে জার্মানির সাথে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইরানে অবস্থানরত জার্মান প্রযুক্তিবিদ, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০০-এ। এ সময় ইরানে নাৎসি প্রচার প্রচারণা ব্যাপক সফলতা লাভ করে। জার্মানির পক্ষ থেকে এ প্রচারণাকে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি দেয়ার চেষ্টা করা হয়। বলা হল যে, উভয় দেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক উৎস এক। তাদের শরীরে খাঁটি আর্য রক্ত প্রবাহিত । এবং তারা একই ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক মতাদর্শগত দিক থেকেও দেশ দুটির মধ্যে মিল রয়েছে। কেননা দুটি দেশেই দুজন আলোক প্রাপ্ত শাসকের নেতৃত্বে তাদের সাধারণ শত্রু কমিউনিজমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা বদ্ধপরিকর। ইরানকে কমিউনিজমের কবল থেকে রক্ষার জন্য রেজা শাহ জার্মানির এসব প্রচারণাকে সমর্থন করেন। রেজা শাহের এ নীতির ফলে ইরানে ব্রিটিশ ও রুশ প্রভাব খর্ব হয়ে জার্মান প্রভাব বৃদ্ধি পায়। জার্মানীর সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপনে রেজা শাহের বিদেশ নীতি সফল হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন রেজা শাহের বিদেশ নীতিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৩৯ সালে জার্মানীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এরপর ১৯৪১ সালে জুন মাসে জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নি। বরং কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ অভিযানে তারা হয়ত কিছুটা খুশিই হয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই ব্রিটেন ও ফ্রান্সের টনক নড়ল যখন তারা হিটলারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নীতি সম্পর্কে জানতে পারল। সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল খনিগুলি দখল করে ইউরোপীয় শত্রু রাষ্ট্রগুলোর এশীয় উপনিবেশসমূহে আঘাত হানাই ছিল হিটলারের মধ্যপ্রাচ্য নীতির মূল লক্ষ্য। হিটলারের এ মধ্যপ্রাচ্য নীতি ফাঁস হয়ে গেলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায়। দেশের এ দুর্যোগময় মুহূর্তে সোভিয়েত নেতা স্টালিনও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ভুলে গিয়ে পুঁজিবাদী ও উপনিবেশবাদী দেশসমূহের সহযোগিতা আগ্রহভরে গ্রহণ করলেন। এ দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ইরান যুদ্ধে তার নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে এবং ইরানের ভূ-খণ্ড কোন বিদেশী রাষ্ট্রকে ব্যবহারের অনুমতি প্রদানে অস্বীকৃত জানায়। প্রকৃতপক্ষে ইরানের এ নীতি ছিল জার্মানির জন্য সুবিধাজনক। কেননা জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তৃতীয় কোন দেশ হতে সাহায্য পাঠানোর সম্ভাব্য পথ ছিল ৪টি। মুরমানস্ক, ভ্লাদিভস্তক, দার্দানেলিস-বসফরাস প্রণালী ও ইরান। মুরমানস্ক ও ভ্লাদিভস্তকের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য পাঠানো সম্ভব ছিল না। আর যুদ্ধের সময় তুরস্ক দার্দানেলিস ও বয়ফরাস প্রণালী দুটি বন্ধ করে দিয়েছিল। জোর পূর্বক এ দুটি প্রণালী খুলে দিতে তুরস্ককে বাধ্য করার অর্থ হবে তুরস্কের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া যার পরিণামে জার্মানির শক্তি বৃদ্ধি করত। একমাত্র বিকল্প হিসেবে বাকি রইল ইরান। ইরানে ছিল সকল মৌসুমে বিপুল পরিমাণে রসদ ও সৈন্য প্রেরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ইরানের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম প্রেরণের এ প্রয়াসে ইরানে অবস্থানরত জার্মান প্রযুক্তিবিদরা নস্যাত করে দিতে পারে এ আশঙ্কায় ১৯৪১ সালের জুন ও আগস্ট মাসে সোভিয়েত রাশিয়া ও ব্রিটেন ইরান হতে জার্মান নাগরিকদের বহিষ্কার করার জন্য ইরান সরকার দুই দফায় অনুরোধ করে। রেজা শাহের প্রত্যাখ্যানের ফলে এ অনুরোধ আদেশে পরিণত হয়। উল্লেখ্য যে, হিটলারের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী রেজা শাহ তার পুরনো ও সুদীর্ঘকালের বন্ধু ব্রিটেন ও রাশিয়ার নির্দেশ অমান্য করলেন। এদিকে হিটলারের অভিযানকে প্রতিহত করতে সামান্য বিলম্ব করার অর্থ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ক্ষেত্রগুলি জার্মানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া। তাই ১৯৪১ সালের ২৫ আগস্ট ব্রিটেন ও রাশিয়া ইরান আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। পূর্বের মতই রাশিয়া ইরানের উত্তরাঞ্চল ও ব্রিটেন দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করে। ইরানের রাজধানী শহর তেহরান নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয়। ব্রিটেন ও সোভিয়েত শক্তির চাপে রেজা শাহ তার ২০ বছর বয়সী পুত্র মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর অনুকূলে ক্ষমতা ত্যাগ করেন । এরপর তাকে একটি ব্রিটিশ জাহাজে করে মরিশাস দ্বীপ এবং পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৯৪৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্য দিয়ে রেজাশাহের বর্ণাঢ্য বিদেশ নীতির অবসান ঘটে।
মূলতঃ ১৯২৩ সালে রেজা শাহ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে ইরানের বিদেশ নীতিতে একটি নতুন ধারার সূচনা হয়। বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক ছিলেন। তার বিদেশ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, ইরান থেকে বিদেশি আধিপত্যের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং ইঙ্গ-ফরাসী প্রভাব বলয় থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। বিশ শতকের গোড়া থেকেই বৃহৎ শক্তিবর্গ ইরানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রভাব বিস্তারে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ব্রিটেন ও রাশিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানি এবং যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দেয়। এসব দেশের মধ্যে প্রতিবেশি দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের বিদেশ নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
উপরন্তু, ইরানের মহানায়ক রেজা শাহ তার দীর্ঘ শাসনামলে ইরানের বৈদেশিক নীতিকে একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইরানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাককালে ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রতি তার পররাষ্ট্র নীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একমাত্র রেজা শাহের দূরদর্শি ও সফল বৈদেশিক নীতির ফলে দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তীকালে ইরানে ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস পেয়েছিল এ মন্তব্য যথার্থ ও সমীচীন নয় । সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি, ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দেশ দুটির বৈদেশিক নীতিও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। অন্যভাবে বলা যায় যে, ব্রিটেন ও রাশিয়া যতদিন চেয়েছিল ঠিক ততদিনই রেজা শাহের পক্ষে ইরানকে বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত রাখায় রেজা শাহের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তবে একথা সত্য যে, কাজার আমলে ইরানে বৈদেশিক শক্তিসমূহের প্রভাব রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং রেজা শাহ ইরানকে সে অবস্থা হতে মুক্ত করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি ইরানের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ দিক থেকে রেজা শাহের বিদেশ নীতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]