ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসনাধীন ইরাক

মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি দেশ ইরাক। ইরাকের রাষ্ট্রীয় নাম রিপাবলিক অব ইরাক। এর আয়তন ৪,৩৭,০৭২ বর্গ কি.মি. । ইরাকের ভাষা আরবী এবং রাজধানী বাগদাদ ।
বিশ্বসভ্যতার অন্যতম লীলাভূমি ইরাকের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। বর্তমান ইরাকের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যেই প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মেসোপটেমিয়ার অবস্থান। মেসোপটেমিয়া শব্দটির অর্থ Land between the rivers বা দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল । দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী স্থানে এর অবস্থান। এখানেই গড়ে উঠেছিল বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা হিসেবে পরিচিত Cradle of civilization বা সুমেরীয় সভ্যতা। এছাড়া আসিরিয়, ব্যবিলনীয় সভ্যতার মত বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাসমূহের অবস্থানও ছিল এ মেসোপটেমিয়াতেই । ইরাক শব্দটি অপেক্ষাকৃত নতুন। উমাইয়া শাসনামলে (৬৬০-৬৭৫ খ্রি.) দক্ষিণ মেসোপটেমিয়াকে বুঝাতে প্রথম ইরাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। উত্তর মেসোপটেমিয়া তখন পরিচিত ছিল আল জাজিরা নামে। সম্ভবত সুমেরিয় শহর Uruk, যার হিব্রু উচ্চারণ Erech থেকে ইরাক শব্দটির উৎপত্তি। Uruk শব্দটির অর্থ উর্বর। আবার অনেকের মতে ইরাক শব্দটি প্রাচীন সুমেরিয় শব্দ Araco থেকে উৎসারিত যার অর্থ Sun বা সূর্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উইস্টটন চার্চিল যখন মেসোপটোমিয়া অঞ্চলের প্রদেশগুলোর সমন্বয়ে একটি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছিলেন তখন মেসোপটেমিয়ায় ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সেক্রেটারি গারট্রুড বেল নতুন রাষ্ট্রের জন্য ইরাক নামটি প্রস্তাব করেন। বাগদাদ, বসরা ও মসুল ওসমানিয় সাম্রাজ্যের এ ৩টি ভিলায়েত বা প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয় ইরাক। উল্লেখ্য যে, প্রথম খলিফা হযরত আবুবকরের (৬৩২-৬৩৪) খ্রি.) সময় ইরাকে আরবদের বিজয়াভিযানের সূচনা হয় । চতুর্থ খলিফা আলী গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হলে বিদ্রোহী মুয়াবিয়া নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন এবং দামেস্কে উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। ৭৪৭ সালে আবু আল আব্বাস ইরাক থেকে উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সাময়িক অভিযান শুরু করেন। ফলে উমাইয়া খিলাফতের পতন ঘটে এবং আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় । আব্বাসিয়রা ইসলামি বিশ্বের রাজধানী স্থানান্তর করেন বাগদাদে ৭৫০-১২৫৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান আব্বাসিয় শাসনকে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়। সাহিত্য, কলা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ যুগে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। ১২৫৮ সালে হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করে একে একটি ধ্বংস স্তূপে পরিণত করেন। যদিও হালাকু খান খুবই অল্প সময়ের জন্য বাগদাদে অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু এ অল্প সময় তার বাহিনী বাগদাদে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তা পুনর্গঠিত করতে পরবর্তী প্রায় ৫০০ বছর লেগেছিল। কিছু কিছু ক্ষতি আজো কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় নি। পরবর্তী ২০০ বছর ইরাক মোঙ্গল, তার্কোম্যান ও পারস্যের সাফাভী বংশের শাসনাধীনে ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ইরাকে ওসমানিয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫১৪-১৫৩৪ সালের মধ্যে পুরো ইরাক ওসমানিয় সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ওসমানিয় সাম্রাজ্যের অন্যান্য ভিলায়েতের মত ইরাককেও ৩টি ভিলায়েতে ভাগ করা হয়, যেমন-মসুল, বাগগাদ ও বসরা। ১৬০৩-১৬০৪ সালে বাগদাদের সেনানায়ক মুহাম্মদ আত- তাবাল প্রায় স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারি হয়ে ওঠেন। বাগদাদ ভিলায়েত ১৭০৮- ১৮৩১ সাল পর্যন্ত হাসান পাশা প্রতিষ্ঠিত প্রায় স্বাধীন একটি বংশ দ্বারা শাসিত হয় । মিদহাত পাশা ১৮৬৯-১৮৭২ সাল পর্যন্ত বাগদাদের শাসক ছিলেন। এ সময়েই ইরাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটারি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশেষে ইরাক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ইরাকের রাষ্ট্রীয় নাম রিপাবলিক অব ইরাক ।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসনাধীন ইরাক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরাকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসনের ঐতিহাসিক পটভূমি নিম্নে তুলে ধরা হল ।
ইরাক প্রশ্নে সর্বদা ব্রিটেনের স্বার্থ জড়িত ছিল। উল্লেখ্য যে, বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে ওসমানিয় সাম্রাজ্য ইউরোপীয় শক্তিসমূহের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। তুরস্কের ভূখণ্ডে ইউরোপীয় শক্তিসমূহের ক্ষমতার এ দ্বন্দ্ব বিংশ শতাব্দীতে প্রকট হয়ে উঠলেও এ প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল তারও এক শতাব্দী পূর্বে অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীতে। তুর্কি শাসনের দুর্বলতার সুযোগে তখন থেকেই ইউরোপীয় শক্তিসমূহ বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় ও তুরস্কের উপর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটেন পারস্য উপসাগরিয় শেখ শাসিত অঞ্চলগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদন করে। ফলে ব্রিটিশ বণিকরা পারস্য উপসাগরের উভয় তীরে অবস্থিত অঞ্চলসমূহের সাথে নির্বিঘ্নে বাণিজ্য করতে সক্ষম হয়। ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ইরাকের সাথে ব্রিটেনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই পারস্য উপসাগর দিয়ে চলাচলকারী ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজগুলিকে জলদস্যুদের আক্রমণ হতে রক্ষা করার জন্য ইরাকে ব্রিটিশ সামরিক উপস্থিতি জরুরী ছিল। ১৮৯৯ সালে তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কোমিয়া থেকে বাগদাদ এবং ১৯০২ সালে বাগদাদ থেকে বসরা পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের জন্য তুর্কি সরকার জার্মানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে ইরাকের প্রতি ব্রিটেনের আগ্রহ লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ফারটাইল ক্রিসেন্টে জার্মানির মত বৈরীভাবাপন্ন একটি রাষ্ট্রের আগমন নানা কারণে ব্রিটেনকে বিচলিত করে তুলে। কেননা এর ফলে ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যদিয়ে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের সাথে ব্রিটেনের স্থল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরানেও ব্রিটিশ তেল স্বার্থও বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯০৮ সালে ইরানের মসজিদ-ই-সুলায়মান নামক স্থানে তেল আবিষ্কৃত হওয়ার এক বছর পর এ্যাংলো পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি গঠিত হয়। ফলে ইরানে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষার্থে প্রতিবেশী ইরাকের উপরও ব্রিটেন তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ।
ইরাকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটারি শাসনের পটভূমিতে দেখা যায় যে, ব্রিটেনের বিশেষ প্রয়োজনেই ইরাকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য ছিল। কেননা ১৯১৪ সালে তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে ভারত থেকে ব্রিটিশ সৈন্য শাত-ইল-আরবের তীরবর্তী ইরাকি বন্দর আলফাও-এ অবতরণ করে ২২ নভেম্বর বসরা ভিলায়েত দখল করে নেয়। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে আগত প্রধান রাজনৈতিক কর্মকর্তা স্যার ফার্সিবক্স ঘোষণা দেন যে, আরবদের সাথে ব্রিটিশ সরকারের কোন বিভেদ নেই। যতক্ষণ আরবরা ব্রিটেনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন থাকবে এবং তুর্কি সেনাবাহিনীকে কোন প্রকার সহেযাগিতা করবে না ততক্ষণ আরবদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ব্রিটেন তাদের জীবন ও সম্পত্তির কোন ক্ষতি সাধন করবে না । তখনও ব্রিটেন বাগদাদ দখল করতে পারে নি। ১৯১৬ সালে কুটের যুদ্ধে জেনারেল টাউন্ডলেণ্ড আত্মসমর্পণ করেন। গ্যালিপলির যুদ্ধে মিত্র শক্তি পরাজয় বরণ করে। প্রায় ৭০০ বছর একের পর এক বৈদেশিক শক্তির শাসনাধীনে থাকার ফলে সহজাতভাবেই আরবরা সম্ভাব্য বিজেতাদের প্রতি ঝুঁকে পড়তে অভ্যস্থ ছিল । কিন্তু যুদ্ধের এ অনিশ্চিত মুহূর্তে জয়-পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ব্রিটেনকে সমর্থন করা তাদের দ্বিধা ছিল। তাই ইরাকে ব্রিটেন তার সামরিক অভিযানগুলিতে স্থানীয় আরবদের খুব একটা সহযোগিতা পায় নি। ১৯১৭ সালের মার্চ মাস নাগাদ ব্রিটিশ বাহিনী বাগদাদ ভিলায়েত এবং কারকুকসহ মসুল ভিলায়েতের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। জুলাই মাসে স্যার পার্সিবক্সের পদমর্যাদা প্রধান রাজনৈতিক কর্মকর্তা হতে কমিশনার পদে উন্নীত হয়। তবে বক্সের অধীনে প্রতিষ্ঠিত ইরাকের বেসামরিক প্রশাসন পরিচালিত হত সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। ব্রিটিশ বাহিনী যখন মসুল শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন ১৯১৮ সালের ৩১ অক্টোবর মুদ্রসের যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হয়। এ সময় ব্রিটিশ বাহিনী মসুল শহর হতে মাত্র ১৪ মাইল দূরে অবস্থান করছিল। ৭ নভেম্বর আরো উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে ব্রিটিশ বাহিনী মসুল দখল করে নেয়। যুদ্ধবিরতির পরে দখল করায় পরবর্তীতে মসুল নিয়ে ব্রিটেন ও তুরস্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং তা আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আদালত মসুলকে ইরাকের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। মসুল দখলের মধ্যদিয়ে ইরাকে ব্রিটিশ বিজয় অভিযানের সমাপ্তি ঘটলেও তুরস্ক ও ইরানের সীমান্তবর্তী কুর্দি অঞ্চল, বাগদাদের দক্ষিণ থেকে আল-নাসিরিয়া পর্যন্ত ইউফ্রেটিসের তীরবর্তী অঞ্চল এবং শিয়া অধ্যুষিত কারবালা ও নাজাফ শহর তখনও পুরোপুরি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে আসে নি। অবশ্য গোটা ম্যান্ডেট শাসনামল এমনকি তারপরও এ অঞ্চলগুলি ছিল অশান্ত । একটি বেসামরিক প্রশাসনের মাধ্যমে ব্রিটেন ইরাকে তার নিয়ন্ত্রণকে সুসংহত করার চেষ্টা চালায়। স্যার ফার্সী বক্স ও তার ডেপুটি আরনল্ড উইলসন কর্তৃক পরিচালিত এ প্রশাসনকে ইরাকে পূর্ব থেকে বিদ্যমান অনেক সমস্যার পাশাপাশি আরো কিছু নতুন সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছিল । গ্রামাঞ্চলে বসবাস করা ইরাকীদের দাবী ছিল উপজাতিদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর উপজাতিরা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার প্রশ্নে ছিল অনঢ়। ব্যবসায়ীরা তাদের স্বার্থ রক্ষায় আইন প্রণয়নের দাবি জানায়। পাশাপাশি তারা একটি কার্যকর বিচার ব্যবস্থার দাবিও জানিয়ে আসছিল। মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষগুলি সুনির্দিষ্টভাবে তাদের দাবি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছিল। তারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে আরো বেশি বরাদ্দের দাবিও জানায়। এছাড়া ভূ-স্বামীরা তাদের জমির উন্নয়ন, খাল খনন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারি মঞ্জুরীর দাবি জানিয়ে আসছিল। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় সৈনিকদের দ্বারা দখলকৃত ইরাকে সঙ্গত কারণেই ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ায় তারা ইরাকে ভারতীয় কায়দায় সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকে। স্থানীয়দের প্রশাসনিক যোগ্যতার উপর তাদের কোন আস্থা ছিল না। তাদের এ মনোভাবের ফলে স্থানীয় আরবরা কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পায় নি। ইরাকি প্রশাসন, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সর্বত্র ভারতীয় প্রশাসনের বৃটিশ কর্মকর্তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এমনকি ভারতীয় রূপি ইরাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে। এরপর থেকেই অক্ষশক্তির কাছ থেকে দখলকৃত অঞ্চলে সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ আপত্তি মিত্র শক্তির দেশগুলোর পক্ষে পুরোপুরি উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। কিছুটা এ কারণে আর কিছুটা জাতীয়তাবাদীদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বাগদাদ দখল করেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যার ফ্রেডারিক স্ট্যানলি মড অভ্যন্তরীণ শাসনের কিছু কিছু বিষয় ইরানিদের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন । এভাবে তিনি জাফর আল আসকারি, নূরি আল-সাইদ প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। কেননা এসব জাতীয়তাবাদীনেতা মক্কার শরীফ হুসাইনের নেতৃত্বে তুর্কি শাসন থেকে মুক্তির লক্ষে মিত্র শক্তিকে সমর্থন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট উড্রো-উইলসনের ১৪ দফা নীতি ঘোষণার পর ইরাকের ব্রিটিশ নীতিতে আরো পরিবর্তন আসে। শাসন ব্যবস্থায় ইরাকিদের অন্তর্ভুক্তির
ক্ষেত্রে পূর্বতন কঠোরতা কিছুটা হ্রাস পায়। ভারতীয় আইনের বদলে পুনরায় ওসমানিয় আইন চালু করা হয়। তবে শাসন ব্যবস্থায় ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পায়। ১৯১৭ সালের ইরাকি প্রশাসনে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সংখ্যা ছিল যেখানে ৫৯ জন, ১৯২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১,০২২ জন। উচ্চ পদগুলিতে আরবদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৪ ভাগেরও কম। পবিত্র শহর কারবালা ও নাজাফ এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ব্যাপক অরাজকতা বিরাজ করছিল। এতে একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা নিহিত হওয়ার পরও ব্রিটেন আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন নি। এবং লুবুর গোত্রসমূহ ভয়ানক সংঘাতে লিপ্ত ছিল। কুর্দি অধ্যুষিত পার্বত্যঞ্চল তখনো ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে আসে নি তুরস্কের দমন নীতিতে অতিষ্ট হয়ে হাজার হাজার আসিরিয় উদ্ধাস্তু ইরাকে আসতে থাকায় এক সংকটাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে ব্রিটেনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি ছিল ক্রমাগতভাবে জাতীয়তাবাদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়া। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে ফার্সী বক্স বিশেষ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে ইরান গমন করেন। ইরাকের ভারপ্রাপ্ত কমিশনারের দায়িত্ব পেলেন তরুণ প্রশাসক উইলসন। তিনি অনেকটা ভারতের মতই কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। ইরাকিদের পরিবর্তে প্রশাসনে ভারতীয়দের নিয়োগ ইরাকিদের মনে অসন্তোষের জন্ম হয় । এছাড়া রাজস্ব আদায়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কঠোরতা। শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ এবং আসিরিয় সম্প্রদায়ের মত সংখ্যালঘুদের প্রতি মাত্রারিক্ত সহানুভূতি ইত্যাদি কারণে ইরাকি জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে ।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের এ নীতির প্রতিবাদে ১৯১৮-১৯১৯ সালের মধ্যে ইরাকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গুপ্ত সমিতি গঠিত হয়। সাংবাদিক, ভূ-স্বামী, ধর্মীয় নেতা এবং উপজাতীয় নেতাসহ বিভিন্ন পেশায় লোকদের নিয়ে নাজাফে গঠিত হয় ‘জামিয়াত আল নাহদা আল ইসলামিয়া। এ সমিতির সদস্যদের হাতেই একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা নিহত হন। অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনগণকে সংঘটিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয় আল-জামিয়া আল ওয়াতানিয়া আল-ইসলামিয়া। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিয়া ও সুন্নী ব্যবসায়ী ওলেমাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় হারাস-আল ইসতিকফাল ।
ইরাকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এতে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দেয়। উল্লেখ্য যে, যুদ্ধ শেষে শরীফ হুসাইনের পুত্র-ফয়সাল আরবদের প্রতিনিধি হিসেবে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি স্বাধীন আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মিত্র শক্তির অনীহা তাকে হতাশ করে। অন্যদিকে শান্তি সম্মেলনে অত্যন্ত দৃঢ় গতির কারণে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ইরানের ভবিষ্যত শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন নির্দেশনা পায় নি। তাই কোনরকম নির্দেশনা ছাড়াই তারা ইরাকে নিজেদের মত করে একটি শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯১৯ সালের জুন মাসে সিরিয়ায় ফয়সাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সরকারের ইরাকি কর্মকর্তাগণ অতিসত্ত্বর ইরাকে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি স্মারকলিপি পেশ করে । চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ স্যানরেমো কনফারেন্সের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল ।
১৯২০ সালের ২৫ এপ্রিল ইতালিতে অনুষ্ঠিত স্যানরেমো কনফারেন্সে ইরাকের উপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর এ শাসনের খবর পৌঁছা মাত্রই একদল ইরাকি প্রতিনিধি উইলসনের সাথে দেখা করে স্বাধীনতার দাবি জানায়। এতে ফল না পেয়ে তারা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকে। জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ ম্যান্ডেটকে সামাজ্যবাদের আরেক রূপ হিসেবে অভিহিত করতে থাকে । কারবালার গ্যান্ড মুফতি ইমাম শিরাজি প্রতিশ্রুতি দেন যে, অমুসলিমদের দ্বারা মুসলিমদের শাসন ইসলাম বিরোধী। তিনি এ শাসনের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দেন। বাগদাদে সুন্নী ও শিয়া মুসলমানেরা মসজিদকে ব্রিটিশ বিরোধী প্রচারণা এবং জমায়েতের স্থান হিসেবে ব্যবহার করে। বাগদাদ থেকে এ বিদ্রোহ আরো দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সিরিয়ায় কর্মরত ইরাকি কর্মকর্তারা এ বিদ্রোহে উৎসাহ উদ্দীপনা প্রদান করে । এদিকে ১৯২০ সালে মসুলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দেখা দেয় এবং তা-ইউফ্রেটিস নদীর দক্ষিণ উপত্যকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণের গোত্রগুলি তাদের দীর্ঘদিনের রাজনেতিক স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে এমনিতেই ব্রিটিশ শাসনের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। এ সুযোগে তারা বিদ্রোহে যোগ দিল। ২ জুন মধ্য ইউফ্রেটিসে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ দেখা দেয়। একজন শেখ কৃষি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে বন্দী করে। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে তার গোত্রের লোকজন বিদ্রোহ করে। তাদের সাথে অন্যরাও যোগ দেয়। আগস্ট মাস নাগাদ মধ্য ইউফ্রেটিসের আল দিউওয়ানিয়া এবং আল-মুদ্রাফিক অঞ্চল দুটি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ইরাকের ইতিহাসে এ বিদ্রোহ The Great Iraqi revolution নামে পরিচিত। তবে টাইগ্রিস উপত্যকার উপর ব্রিটেসের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ থাকায় সেখানে বিদ্রোহ বিস্তার লাভ করতে পারে নি। কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিও শান্ত ছিল। কেননা আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে কুর্দিদের কোন আগ্রহ ছিল না। তারপরও ইরাকের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল বিদ্রোহ কবলিত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৩ মাস ইরাকে একটি অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করে। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর বোমারু বিমানের সহায়তায় কর্তৃপক্ষ এ বিদ্রোহ দমন করে। বিদ্ৰোহ দমনে ব্রিটেনকে প্রচুর জনশক্তি ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্রায় ৪০০ ব্রিটিশ সে সময় প্রাণ হারায় এবং ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ হয়। ব্রিটেনের কঠোর পদক্ষেপের ফলে বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হলেও এ বিদ্রোহ ইরাকের জাতীয়তাবাদের বিকাশ তথা একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ইরাকের অভ্যুদয়ের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কেননা এ বিদ্রোহে ইরাকি জনগণ শিয়া-সুন্নী ভেদাভেদ ও আন্তগোত্রীয় বিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। এ বিদ্রোহ ইরাকের জন্য স্বাধীনতা অথবা ইরাকিদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা এনে দিতে না পারলেও ইরাকে ভারতীয় নীতির অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল । বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ইরাকের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং একটি জাতীয় কাউন্সিল গঠন করতে বাধ্য হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, ভূ-স্বামী ও গোত্র প্রধানরা এ কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করে। এ বিদ্রোহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল এই যে, এর ফলে ইরাকে ব্রিটেন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে। বিদ্রোহটির কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ফয়সালের যুদ্ধকালীন সহযোদ্ধা ও উপদেষ্টা কর্নেল টি.ই.লরেন্স লন্ডন টাইমস পত্রিকায় লিখেন, শুধুমাত্র অপশাসনই বিদ্রোহের কারণ ছিল না। যুদ্ধের সময় আরবরা তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল স্বাধীনতা লাভের আশায়। শাসক পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্রিটিশ বা ফরাসি প্রজায় পরিণত হওয়ার জন্য তারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে নি। এছাড়া তুর্কি শাসনামলে বেসামরিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের শতকরা ৭০ ভাগই ছিল স্থানীয় আরব। আর ইরাকে নিযুক্ত সেনাবাহিনীর শতকরা ৯৫ ভাগ সৈনিক ছিল আরব । অথচ এ সময়ে ইরাকে ব্রিটেনের ৮০,০০০ সৈনিক সীমান্ত রক্ষার বদলে পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে। তবে এটা সত্য বা ব্রিটিশ শাসনাধীনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার বিনিময়ে যা স্বাধীনতা বিপন্ন করে অন্যান্য-গোত্রে উন্নতি কে চায়? তিনি প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে ব্রিটিশ কর্মকর্তা কর্মচারীর বদলে আরবদের নিয়োজিত করার দাবি জানান। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় জোনের একজন কর্মকর্তা লন্ডন টাইমসের মাধ্যমেই লরেন্সের বক্তব্যের জবাব দেন। তিনি বলেন, লরেন্সের বক্তব্য অনুযায়ী আরব রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। গোত্র প্রধানদের নিকট স্বায়ত্তশাসনের অর্থ হচ্ছে কর থেকে অব্যাহতি আর অবাধ লুটতরাজ ও হত্যার স্বাধীনতা। তাই গোত্রগুলি আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অভ্যস্ত করার পরই স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা উচিত। ইতোমধ্যে ফার্সী বক্স ইরান থেকে ফিরে আসেন এবং তার পদমর্যাদা হয় হাইকমিশনার। তিনি আবদ আল-রহমান আল-গিলানিকে ইরাকি সরকারের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করেন। ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানের অধিকারী হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গিলানির খুব একটা অভিজ্ঞতা ছিল না। এ সরকার ব্রিটিশ উপদেষ্টাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচালিত হত এবং হাইকমিশনার ফার্সী বক্সের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিল। তবে এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা ছিল। ১৯২১ সালে অনুষ্ঠিত কায়রো সম্মেলনে ইরাক সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলে ইরাকের ভবিষ্যত রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়। নিম্নে কায়রো সম্মেলনের বর্ণনা দেওয়া হল ।
১৯২১ সালে কায়রো সম্মেলনে ব্রিটেন ইরাক সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান স্থির করে । যা ১৯৫৮ সালের বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এ সম্মেলনে ইরাক সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। (এ) সিরিয়া থেকে ফ্রান্স কর্তৃক বিতাড়িত ফয়সালকে ইরাকের বাদশাহ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। ফয়সালের জাতীয়তাবাদী ইমেজ এবং বংশীয় মর্যাদা ইরাকিদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে মনে করেই ব্রিটেন এ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অন্যদিকে সিরিয়া হতে উৎখাত হওয়া ফয়সালকে ইরাকে বাদশাহী প্রদান করার মাধ্যমে ব্রিটেন আরবদেরকে প্রদত্ত তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি আংশিকভাবে হলেও বাস্তবায়নের প্রয়াস পায়। এভাবে আরবদের নিকট ব্রিটেনকে তার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালায়। এছাড়া ব্রিটেন মনে করছিল বাদশাহী লাভের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ফয়সাল বৃটেনের প্রতি অনুগত এবং নির্ভরশীল থাকবেন। ফলে ফয়সালের মাধ্যমেই ব্রিটেন ইরাকে তার ম্যান্ডেটরি শাসন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ফয়সাল ইরাকের উপর তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আবদুল্লাহর দাবি থাকায় ব্রিটিশ প্রস্তাব গ্রহণ করতে আপত্তি জানান। কারণ ১৯২০ সালের ১০ মার্চ সিরিয় কংগ্রেস ফয়সালকে সিরিয়ার সিংহাসন গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন এবং অল্পকাল পরেই ফ্রান্স কর্তৃক বিতাড়িত হযেছিলেন। একই সময় কংগ্রেস হুসাইনের দ্বিতীয় পুত্ৰ আবদুল্লাহকে ইরাকের বাদশাহ মনোনীত করেছিল। আরেকটি কারণে ইরাকের সিংহাসনারোহণে ফয়সাল কিছুটা ইতস্তত করেছিলেন। কেননা তখনো পর্যন্ত ইরাকিদের কাছ থেকে তিনি কোন প্রস্তাব পান নি। সর্বোপরি, ম্যান্ডেটরি শাসনাধীনে সিংহাসনারোহণের ক্ষেত্রেও তার আপত্তি ছিল। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ফয়সালের ইরাকের বাদশাহ হিসেবে নিযুক্তির পক্ষে আবদুল্লাহর সম্মতি আদায় করে। ইরাকে একটি গণভোটের মাধ্যমে বাদশাহ হিসেবে তার নিযুক্তিকে বৈধতা প্রদানের কথা জানায় । ব্রিটিশ উপনিবেশ মন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল জানান একটি চুক্তির মাধ্যমে ইরাকের সাথে বৃটেনের সম্পর্ক নির্ধারিত হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত ফয়সাল ব্রিটিশ প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে। বক্সের প্রচেষ্টায় ১৯২১ সালের ১১ জুলাই জাতীয় কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে ফয়সালকে ইরাকের বাদশাহ ঘোষণা দেয় । জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে ফয়সালের ইরাকের বাদশাহ হওয়ার পক্ষে ৯৬% ভোট পড়ে। নির্বাচনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রত্যক্ষভাবে ফয়সালের পক্ষে তাদের প্রভাব প্রয়োগ করে । প্রকৃতপক্ষে ইরাকে ফয়সালের এতটা জনপ্রিয়তা ছিল না । গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ইরাকের বাদশাহ পদের অন্যতম দাবিদার তালিব পাশাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কুর্দি ও উত্তর ইরাকের তুর্কি সমর্থক জনগণ ফয়সালকে সমর্থন করে নি। ইরাকের অভিজাত সম্প্রদায়ও কিছুটা ঈর্ষাবোধ করেছিল। শিয়ারা একজন ধর্মীয় নেতাকে বাদশাহ হিসেবে দেখতে চেয়েছিল । তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এসব বিরোধিতা সত্ত্বেও বাদশাহ হিসেবে ফয়সালের জনপ্রিয়তা ইরাকের অন্য যে কোন শক্তির চেয়ে বেশি ছিল। ২৭ আগস্ট ইরাকের প্রথম বাদশাহ হিসেবে ফয়সালের অভিষেক সম্পন্ন হয়। বাদশাহ হওয়ার পর তিনি ইরাকি জনগণের দাবী ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার নীতি গ্রহণ করেন। গোত্রগুলির সাথে সম্পর্ক নির্ধারণেও ফয়সাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ওসমানিয় শাসনামল থেকেই ইরাকের গোত্রভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কেন্দ্ৰীয় সরকারের নিকট একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছিল। এসব গোত্রের অধিকাংশই ছিল শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। শহরবাসীর সাথে এসব গোত্রের বিস্তর ব্যবধান ছিল । গোত্রগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সরকারি প্রচেষ্টা প্রায়ই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলত। ফলে ম্যান্ডেটারি শাসনামলের শুরু থেকেই গোত্রগুলির সাথে সরকারের মধ্যস্থা করতে সক্ষম একজন ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এক্ষেত্রে ফয়সাল ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত। গোত্রীয় মানসিকতা সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা ছিল। তার শৈশব কেটেছে আরবের মরভূমিতে। এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তার মরু অঞ্চলে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই বেদুঈনদের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয় তা তিনি জানতেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি গোত্রগুলির আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। এবং শহরবাসী ও গোত্রীয় সমাজের মধ্যকার যোগসূত্রে পরিণত হল। (বি) কায়রো সম্মেলনে স্থানীয় ইরাকিদের নিয়ে একটি সেনাবাহিন গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯২১ সালের মধ্যে সেনাবাহিনীতে অফিসার ও সৈনিক নিয়োগ পুরোদমে শুরু হয়। সাধারণত শিয়াদের মধ্যে থেকে সেনাবাহিনীর নিম্ন পদগুলিতে নিয়োগ দেয়া হত । তুর্কি সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের দিয়ে সেনাবাহিনীর উচ্চ পদগুলি পূরণ করা হয়। এসব কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিলেন সুন্নী মতাবলম্বী। কিছু কুর্দি কর্মকর্তাও সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে আসীন হন । (সি) চার্চিলের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঈঙ্গ-ইরাকি সম্পর্ক একটি চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সময় ইরাকি জনগণের মধ্যে ৩ ধরণের মত পরিলক্ষিত হয় ।
প্রথমত, কট্টর জাতীয়তাবাদীরা বাদশাহ এবং ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন এ উভয়েরই বিরোধী ছিল। তারা ইরাকের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং একজন ইরাকি কর্তৃক ইরাক শাসনের পক্ষে ছিল ।
দ্বিতীয়ত, ভূ-স্বামী ও জমিদার শ্রেণী, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং গোত্র প্রধানগণ ব্রিটিশ ম্যান্ডেটারি শাসনের পক্ষে ছিল।
তৃতীয়ত, মধ্যপন্থিদের মতে, বর্তমান পর্যায়ে স্বাধীনতার দাবি একটি অবাস্তব দাবি । এবং ম্যান্ডেটরি শাসন ও তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। তাছাড়া চুক্তির মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে ছিল।
এ তিনটি মত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে প্রথম মতটি ছিল চরম ও উগ্রপন্থি । দ্বিতীয় মতবাদটি ছিল সুবিধাবাদি আর ৩য় মতবাদটি ছিল বাস্তববাদী ।
এরপর ব্রিটিশ সরকার ইরাকের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করে এবং ইরাকে পরোক্ষভাবে বৃটিশ শাসন কায়েম করে। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ অভিভাবকত্বে ইরাককে স্ব-শাসনের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই লীগ অব নেশনস কর্তৃক ব্রিটেনকে ইরাকের ম্যান্ডেট প্রদান করা হয়। কিন্তু ম্যান্ডেটরি শাসন পরিচালনার উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয় নি। কায়রো সম্মেলনে ব্রিটেন একটি চুক্তির মাধ্যমে ইরাকের সাথে ম্যান্ডেটরি সম্পর্ক স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মাধ্যমে ইরাকিদের ম্যান্ডেট বিরোধী আন্দোলনও প্রমাণিত হবে বলে মনে করা হয়। বাদশাহ হিসেবে ফয়সালের অভিষেক হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ইরাকিদের সাথে আলোচনা শুরু করে। ফলে ১৯১২ সালের ১০ অক্টোবর একটি ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০ বছর। বলা হল উভয় পক্ষ সময়ে সময়ে চুক্তির ধারাগুলিতে পরিবর্তন আনতে পারবে। এ চুক্তির কোথায়ও ম্যান্ডেট কথাটির উল্লেখ ছিল না। ৩টি উপচুক্তি সহ স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতে বলা হল লীগ অব নেশনসের সদস্যপদ লাভ ব্রিটেনকে সহযোগিতা করবে। আরো বলা হল বৃটিশ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে ইরাকের বাদশাহ ব্রিটেনের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। যতদিন পর্যন্ত ইরাক ব্রিটেন প্রদত্ত ঋণ পরিশোধ করতে না পারবে ততদিন ইরাকের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণেও বাদশাহ ব্রিটেনের পরামর্শ মেনে চলবেন। সরকারের ১৮টি বিভাগের কিছু সুনির্দিষ্ট পদের বৃটিশ কর্মকর্তাগণ উপদেষ্টা ও পরিদর্শক হিসেবে নিযুক্ত হবেন। এ উপদেষ্টাদের মাধ্যমেই ব্রিটেন ইরাকে পরোক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। সামরিক বিষয়ক উপচুক্তিতে বলা হল ইরাকি সেনাবাহিকে সহযোগিতা করার জন্য ব্রিটিশ বাহিনী ইরাকে অবস্থান করবে । বিচার বিষয়ক উপচুক্তিতে বলা হল, ইরাকে বসবাসরত বিদেশিদের আইনগত অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব পাবে ব্রিটেন। ইরাকের কোন আদালতে বিদেশি নাগরিকের বিচার করতে হলে সে আদালতের এক বা একাধিক বিচারককে অবশ্যই ব্রিটিশ নাগরিক হতে হবে। অর্থনীতি বিষয়ক উপচুক্তিতে বলা হল, ইরাকে কর্মরত ব্রিটিশ কর্মর্তাদের অর্ধেক ব্যয়ভার ইরাক সরকার বহন করবে। ইরাকে বসবারত ব্রিটিশ বাহিনীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র আমদানির ক্ষেত্রে কোনরূপ শুল্ক আরোপ করা যাবে না। শুধু তাই নয় ওসমানিয় সরকার কর্তৃক গৃহীত ঋণের ইরাকি অংশের দায়ভার পরিশোধের উত্তরাধিকার সূত্রে ইরাকের উপর অর্পিত হবে। মোটকথা, এ চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইরাক ব্রিটেনের উপর পুরো নির্ভরশীল হয়ে পড়বে । ১৯২৩ সালে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আবদ-আল মুহসিন আল সাদুন চুক্তির সময়সীমা ২০ বছর থেকে ৪ বছরে নামিয়ে আনেন। চুক্তিকে কার্যকর করার জন্য এটিকে সংবিধানের অংশে পরিণত করা জরুরী ছিল । তাই চুক্তি সম্পাদনের সময় পারস্পরিক আলোচনার সময় থেকেই যুগপৎভাবে সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়াও শুরু হয়। সংবিধানে জাতীয় সংসদকে মন্ত্রীসভা গঠন ও বিলুপ্ত করার ক্ষমতা দেয়া হয়। অন্যদিকে বাদশাহর হাতে সকল প্রকার আইন অনুমোদন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সংসদের কার্যক্রম মূলতবি করার ক্ষমতা ছিল। এ ছাড়া সংসদের সম্মতি ছাড়াই তিনি চুক্তির বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য অর্ডিনান্স জারি করার ক্ষমতা পান। এভাবে সংবিধান বৃটিশ কর্তৃপক্ষকে পরোক্ষ শাসনের সুযোগ করে দেয়। ব্রিটেনের নিকট চুক্তিটি ছিল ইরাকের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার একটি কৌশল মাত্র। তাই চুক্তিটি সম্পর্কে বলা হয় “The treaty of 1912 was just another form of control, but properly sugar coated for the Iraqi state."
এ চুক্তির প্রতিফলনে শহরাঞ্চলে ভিন্ন চিত্র প্রতিফলিত হতে দেখা যায় । শহরাঞ্চলের জাতীয়তবাদীরা রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে ১৯১২ সালের ইঙ্গ-ইরাকি চুক্তি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ আন্দোলনে শিয়াদের ব্যাপক সমর্থন ছিল। এপ্রিল মাসে শিয়া মুজতাহিদ শেখ মাহদি আল- খালিসী কারবালায় ২০০ শিয়া নেতা ও গোত্র প্রধানদের এক সম্মেলন আহবান করে চুক্তির বিরোধীতা করেন। ইতোমধ্যে বাগদাদে ৩টি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। এর মধ্যে দুটি দলই ছিল শিয়া নেতৃত্বাধীন এবং চরমভাবে চুক্তি বিরোধী । চুক্তি বিরোধী বিক্ষোভের ফলে সরকার জুন মাসে নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য হয়। এ বিদ্রোহে ফয়সালের সমর্থনও সহযোগিতা রয়েছে বলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতীয়মান হয়। চুক্তিটি সম্পর্কে চরম হতাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে ফয়সাল বলেন, "This is not the kind of treaty which Mr. Charchill promised me in London.” ফলে বাদশার সাথে হাই কমিশনারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বিদ্রোহ চলাকালে ফয়সাল অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে হাইকমিশনার কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন। বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী অনেককে গ্রেফতার করেন বা নির্বাসনে পাঠান। এবং বিদ্রোহীদের পক্ষে সরব কিছু সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন। মূলত : শিয়ারাই চুক্তি বিরোধী বিদ্রোহে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। ম্যান্ডেটরি শাসনের শুরু থেকেই শিয়ারা ব্রিটিশ বিরোধী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে। শিয়াদের ব্রিটিশ বিরোধীতার শুরুর দিকে কিছু শিয়া নেতা মধ্যপন্থি সুন্নীদের সাথে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। শিয়া নেতা জাফর আবু আল তিম্মান একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এবং সুন্নীদের সাথে সহযোগিতার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন । কিন্তু তিনি চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন নি। ফলে মধ্যপন্থী সুন্নীদের সাথে চরমপন্থী শিয়াদের দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। শিয়া রাজনৈতিক দল দুটি ম্যান্ডেটারি শাসনের কট্টর সমালোচকে পরিণত হয়। তারা ম্যান্ডেটারি শাসনের বিরোধিতার পাশাপাশি একজন শিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের দাবি জানায়। সংখ্যার দিক থেকে শিয়ারা সুন্নীদের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও আধুনিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা গ্রহণের প্রতি তাদের কোন আগ্রহ ছিল না। ফলে শিয়াদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে যোগদান করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের অভাব ছিল । সঙ্গত কারণেই ইরাকের মন্ত্রীসভায়ও শিয়াদের প্রতিনিধিত্ব ছিল একেবারেই নগণ্য । কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক অংশীদারিত্বের কথা বিবেচনা করে শিয়াদের মধ্যে থেকে দু'একজন মন্ত্রীত্ব প্রদান করা হত। উপরন্ত ফয়সালকে তারা একজন বহিরাগত সুন্নী বাদশাহ হিসেবে বিবেচনা করত। ভৌগলিকভাবে শিয়াদের বসাবস ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে হওয়ায় সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সাথে তাদের যোগাযোগ থাকায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ইরাকের প্রতি আনুগত্যে কিছুটা ঘাটতি দেখা দেয়। রেজা শাহের দমন নিপীড়িনে বাধ্য হয়ে অনেক শিয়া ধৰ্মীয় নেতা ইরান থেকে ইরাকে এসে বসবাস করতে থাকে ।
ধর্মীয়ভাবে তারা এতটাই কট্টর ছিল যে, অনেক সময় তাদের প্রদত্ত ফতোয়ার কারণে ইরাকি প্রশাসনের সাধারণ কার্যক্রম পর্যন্ত ব্যাহত হত। তারা একই সাথে সুন্নী বিরোধী এবং ব্রিটিশ বিরোধী ছিল। তাই ঈঙ্গ-ইরাকি যৌথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা অসহযোগিতা করত। ১৯২২ সালে তাদের কার্যক্রমে বাদশাহ ফয়সাল এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি ৪০ জন ইরানি ধর্মীয় নেতাকে ইরাক হতে বিতাড়িত করে ইরানে পাঠিয়ে দেন। ১৯২৪ সালের সাংবিধানকি সভায় কিছু সুন্নী জাতীয়তাবাদী নেতাও চুক্তিটির বিরোধীতা করেছিল। চুক্তিটি ফয়সালের মনপুত না হলেও তিনি প্রকাশ্যে এর বিরোধীতা করেন নি। সিরিয়ায় তার স্বল্প কালিন শাসনামলে তিনি বৃহৎ শক্তির সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার পরিণাম সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি ১৯২২ সালের ১০ অক্টোবর মন্ত্রীসভাকে চুক্তিটি অনুমোদনের নির্দেশ দেন। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে নির্বাচিত সংবিধান সভা এ চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করে। ফলে ফয়সাল ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ইরাকিদের রোষাণলে পড়ে। ইরাককে স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ইরাকিরা ব্রিটেনকে দায়ী করে। ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় দেশ বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগে ফয়সালকে তারা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করে। তবে ফয়সাল তার ব্যক্তিগত প্রজ্ঞা দ্বারা ইরাকিদের তার নীতির যৌক্তিকতা সম্পর্কে বুঝাতে সক্ষম হন। তার মতে ব্রিটেন আপাতত যতটুকু ছাড় দিয়েছে তা হাত পেতে নেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। পরবর্তীতে অবস্থা বুঝে আরো বেশি অধিকার আদায়ের দাবি জানানোর সুযোগতো থাকছেই। এক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত আরব নীতি “Task and Task' বা পশ্চিমাদের নিকট যা ‘Step by step’ নীতি নামে পরিচিত তা অনুসরণ করেন। চুক্তিটিতে ম্যান্ডেটরি শাসনের অধিকাংশ ধারাই প্রতিফলিত হতে দেখে ইরাকিরা এর বিরোধিতা করে এবং নতুন আরেকটি চুক্তির দাবি জানায় । ইরাকিদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৬ সালের ১৩ জানুয়ারি এবং ১৯২৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর আরো দুটি ঈঙ্গ- ইরাকি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি দুটিতে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের কোন পরিবর্তন না হওয়ায় তা ইরাকি জাতীয়তাবাদীদের সন্তুষ্ট করতে পারে নি। ফলে এ চুক্তির বিরুদ্ধেও তীব্র আন্দোলন শুরু হয় এবং আরেকটি নতুন চুক্তির দাবি উত্থাপিত হয় ।
ইরাকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি বিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে লন্ডনে আন্তবিভাগীয় কমিটি গঠিত হয় এবং কতগুলো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যা নিম্নরূপ :
(এ) ম্যান্ডেট ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে ম্যান্ডেটরি শক্তির সাধারণ নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে ইরাকে একটি দেশিয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। (বি) জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ উদ্দেশ্যে জনমত যাচাই করা হবে। তবে ম্যান্ডেটরি শক্তির দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কোন প্রকারের সরকার গ্রহণযোগ্য হবে না ।
(সি) ভবিষ্যতে সংবিধানেও এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করা চলবে না যা ম্যান্ডেটরি দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে । এবং
(ডি) অন্ততপক্ষে সাময়িকভাবে যাযাবর ও উপজাতীয় এলাকাগুলি ব্রিটিশ কর্মচারীদের দ্বারাই প্রত্যক্ষভাবে শাসিত হবে।
ইরাকে ম্যান্ডেটারি শাসন ব্যবস্থায় নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ইরাকি কাউন্সিল অব স্টেট কর্তৃক ১৯২১ সালের ১১ জুলাই ফয়সালকে বাদশাহ হিসেবে নির্বাচিত করার সময়ই মতামত প্রকাশ করা হয় যে, ইরাকে একটি সাংবিধানিক প্রতিনিধিত্বমূলক এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। বাদশাহ ফয়সালও অচিরেই একটি সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দেন। ১৯২১ সালের শরৎকালে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য ২ সদস্যরে একটি কমিটি গঠন করা হয়। স্যার লাইজেল ডেভিডসনের পরামর্শক্রমে কমিটির সদস্য স্যার হুবার্ট ইয়ং এবং স্যার এডউন ড্রয়ার অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সংবিধান অনুসরণ করে ইরাকি সংবিধানের একটি খসড়া প্রস্তুত করেন। ফয়সাল খসড়াটি পরীক্ষা নিসরীক্ষরতার জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিতে প্রেরণ করেন। এ কমিটির সদস্য ৩ জন ছিলেন মন্ত্রী নাজি আল-সুয়াইদি, অর্থমন্ত্রী মামুন হিসকাইল এবং ফয়সালের ব্যক্তিগত সচিব রুস্তম হায়দার। তারা সংবিধানে বাদশাহকে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান সংক্রান্ত ধারাগুলির বিরোধিতা করেন। এবং তুরস্কের সংবিধানের অনুকূলে তা ঢেলে সাজান। উভয় খসড়া পৃথক পৃথকভাবে লন্ডনস্থ উপনিবেশ দফতরে পাঠানো হয়। উপনিবেশ দফতরের নির্দেশক্রমে উভয় কমিটি আলোচনায় বসে একটি সমন্বিত সংবিধান প্রণয়ন করে ।
উল্লেখ্য যে, সংবিধান প্রণয়নের সময় ব্রিটিশ নীতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বক্সের প্রাচ্য সচিব গারট্রুডবেল একটি সুবিখ্যাত উক্তি করেন, “Politics running on wheels greased with extremely well melted grease.” ১৯২০ সালে লীগ অব নেশনস ইরাকের উপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ঘোষণার পরই পূর্ব আলোচিত বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ বিদ্রোহ হতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ম্যান্ডেট ব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য করবার জন্য ইঙ্গ-ইরাকি সম্পর্ক একটি চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। এ চুক্তিতে যাতে ব্রিটেনের বিশেষ ক্ষমতা ও স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকে তা নিশ্চিত করাই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯২২ সালের এ চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হয়। ব্রিটেনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও এ খসড়ায় ইরাকের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের কথা এবং সাংবিধানিক সরকারের মূল নীতি সম্পর্কেও বলা হয়, যা নিম্নে প্রদত্ত হল ।
"His Majesty, the king of Iraq, agrees to frame an Organic Law for presentation to the constituent Assembly of Iraq and to give effect to the said law, which shall contain nothing contrary to the provisions of the present Treaty and shall take into account the rights, wishes and interests of all the population inhabiting Iraq."
যা হোক, এ সংবিধানে বাদশাহর ক্ষমতা হ্রাস করা হয় এবং মন্ত্রীসভাকে সংসদের নিকট জবাবদিহি করার ধারা সংযুক্ত হয়। তবে সংসদ অধিবেশনরত না থাকা অবস্থায় বাদশাহকে অর্ডিনান্স জারি করার ক্ষমতা দেয়া হয়। কিছু ছোট-খাট সংশোধনী আনয়নের পর এপ্রিল মাসে খসড়াটি ফেরত পাঠানো হয়। বাগদাদে কমিটি সংবিধানটিতে আরো কিছু সংশোধন করে এবং তা উপনিবেশ দফতরের অনুমোদন লাভ করে। ১৯২৩ সালের শরৎকালে সংবিধানটি চূড়ান্ত হয় । সংবিধানটি ইরাকের সাংবিধানিক সভায় অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হয়। ইতোপূর্বে একটি রাজকীয় আদেশে ১৯২২ সালের ২৪ অক্টোবর সংবিধান সভার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু শিয়া ধর্মীয় নেতাদের বিরোধীতার কারণে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বেশ কিছুটা বিলম্ব হয়। ১৯২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন সম্পন্ন হয়। সাংবিধানিক সভা ১৯২৪ সালের ১০ এপ্রিল সংবিধানের খসড়াটি একটি বিশেষ কমিটিতে প্রেরণ করেন। অবশেষে সংবিধান সভা কর্তৃক সংবিধানটি অনুমোদিত হয় এবং ১৯২৫ সালের ২১ মার্চ বাদশাহ ফয়সাল এতে স্বাক্ষর করার পর তা কার্যকারিতা লাভ করে। সংবিধানটিতেও লীগ অব নেশনসের ম্যান্ডেট সম্পর্কিত ২২ নং ধারা এবং ১৯২২ সালের এ্যাংলো-ইরাকি চুক্তি এবং পরবর্তীতে ১৯৩০ সালের এ্যাংলো ইরাকি চুক্তিটি সংযুক্ত করা হয় ৷

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]